সাত
ওরা দু’জনে এবং ভেলুয়া একটি সংকীর্ণ বনপথ ধরে ছোটা শুরু করল। একটু ছুটে আসার পরই পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল দীপংকর, উ হু হু। বাবারে, মরে গেলুম।
কী হল! কী হল দীপ।
দীপংকরের পায়ের বুড়ো আঙুলের মাথাটা কেটে গিয়ে তখন গল গল করে রক্ত ঝরছে।
চম্পা বলল, লেগেছে খুব?
হ্যা। ভীষণ জ্বালা করছে।
ওতে কিছু হবে না। পাথুরে জায়গা। আমার অমন কত লাগে। দাঁড়াও এক্ষুনি রক্ত বন্ধ করে দিচ্ছি। বলে ছুটে গিয়ে তিন রকম গাছের পাতা হাতের তালুতে কচলে লাগিয়ে দিল দীপংকরের পায়ে। এরপর ওর পায়ের দু’-এক জায়গায় অতি চমৎকারভাবে ম্যাসেজ করে ওর হাতধরে টেনে তুলল ওকে।
দীপংকর বলল, খুল লেগেছে। আর একদম ছুটতে পারব না।
আর ছুটতে হবেও না। আমার হাত ধরো। ধরে একটু একটু করে পা ফেলে এগিয়ে এসো।
দীপংকর তাই করল। চম্পার হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে ভর করে একটু একটু চলা শুরু করল। এইভাবে কিছু পথ আসতেই এক জায়গায় থেমে দাঁড়িয়ে চম্পা বলল, আরে এসে গেছি। ওই দেখা যায় বাসাড়েরা গ্রাম। ওখানেই আমাদের ইকলু থাকে। তবে কী জানো দীপ, এখানেও আমরা বিপদমুক্ত নই। তার কারণ লালজির লোকেরা জেনে গেছে আমরা পালিয়ে এসেছি এখানে। হয়তো আমার বাবুজিও জেনে যাবে। কাজেই ওই পাহাড়ে তোমার জেঠুর সম্পত্তি যেখানে আছে, সেখানে যাওয়াটা হয়তো আমাদের উচিত হবে না। সে কী! তা হলে এত কষ্ট করে এখানে আসাটাই তো বৃথা।
যেতে পারি। কিন্তু প্রচণ্ড লড়াই বেধে যাবে। হয়তো সেই যুদ্ধে তোমাকে আমাকে দু’জনকেই মরতে হতে পারে। রাজি?
রাজি। আমি মরতে চাই। তবে ওই ধনরত্নের সন্ধান লুঠেরাদের হাতে তুলে দিয়ে নয়। ওদের সমুচিত শিক্ষা দিয়ে। তোমাকে জেঠু নিজে হাতে যা দিয়ে গেছেন তা উদ্ধার না করে আমি যাব না। আমার হয়তো ফাঁসি হবে, কিন্তু তোমার তো দীর্ঘ জীবন আছে।
চম্পা দীপংকরের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, বার বার তুমি ওকথা বলো না দীপ। তা হলে আমার মন খুবই খারাপ হয়ে যাবে। মা রংকিনীর ওপর ভরসা রাখো। মা নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হবেন। হয়তো শেষ পর্যন্ত তোমার কিছুই হবে না।
এই বলে কথা বলতে বলতে ওরা বাসাড়েরা গ্রামে পৌঁছুল। ওই তো ইকলুর কাঠের ঘরের দোতলায় ইকলু বসে বসে কী যেন খাচ্ছে। জেঠুর পয়সায় ইকলুও তো এখন বড়লোক।
চম্পা দূর থেকেই ডাকল, ই-ক-লু…উ…।
ভেলুয়া ইকলুকে দেখেই ভৌ ভৌ ডাক ছেড়ে মনের আনন্দে ছুটল ইকলুর বাড়ির দিকে।
ইকলুও তখন বারান্দা থেকে ওদের দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে নেড়ে ডাকছে। কী আনন্দ! কী আনন্দ!
ওরা ইকলুদের বাড়িতে যেতেই কোনও আত্মীয়কুটুম্ব সব এলে যে রকম হয়, সেই রকম হইচই পড়ে গেল। ইকলু দোতলা থেকে নেমে এসে চম্পাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে ঝর ঝর করে কাঁদতে লাগল।
আর ভেলুয়া করল কী, ইকলুকে আঁকড়ে ধরে অনবরত কেঁউ কেঁউ করতে লাগল। ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে লাগল! ইকলু পরমাদরে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল তখন।
চম্পা বলল, আমাদের খুব বিপদ। এই বিপদে তোমাকে একটু সাহায্য করতে হবে ইকলুভাই।
বলুন দিদিভাই কী করতে হবে?
তার আগে পরিচয় করিয়ে দিই এই ছেলেটির সঙ্গে। এই যে ছেলেটি দেখছ, এ হচ্ছে তোমার মনিব সেই মানিকজেঠুর ভাইপো।
হ্যাঁ হ্যাঁ। দীপংকর। ডাক নাম দীপু। বাবুর কাছে অনেকবার শুনেছি ওর কথা। ছোটবেলায় ওকে তো দেখেওছি। বাবু টাটানগরে বাড়ি করবার পর তো ও এসেছিল। তখন অবশ্য ও ছোট ছিল খুব। তা ও এখানে কী করে এল?
সেই কথাই তো বলব তোমায়। এখন আমরা কয়েকটা দিন থাকব তোমাদের এখানে। আমাদের দু’জনকে এখানে একটু আশ্রয় দিতে হবে। আর খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে আমাদের। এখুনি তুমি আমাদের দু’জনকে কিছু খেতে দাও। কাল থেকে প্রায় না-খেয়েই আছি আমরা। খেতে খেতে সব বলব।
ইকলু অবাক চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল দীপংকরের দিকে। তারপর বলল, বসো। বসো তোমরা। আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি তোমাদের জলখাবারের। বলেই ভেতর বাড়িতে ঢুকে গিয়ে সম্ভবত ওর বউকে কোনও কিছু করবার নির্দেশ দিয়ে এল।
একটু পরেই ওপরের ঘরে ইকলুর বউ ও মেয়েরা দু’থালাভর্তি
সিদ্ধ আর আলু-মরিচ দিয়ে গেল।
মুড়ি, রাঙালু
ইকলুর বউ বলল, চা খাও তো তোমরা? চা আনছি আমি।
দীপংকর ও চম্পা হাসি মুখে বলল, হ্যাঁ খাই। বলে খুব তৃপ্তি করে সেই সব খেতে লাগল। খেতে খেতেই সব কথা খুলে বলল ইকলুকে।
সব কিছু শোনার পর রাগে লাল হয়ে উঠল ইকলুর মুখ। ওর দু’চোখে যেন আগুন ছুটতে লাগল। বেশ বজ্রকঠিন গলায় বলল, তোমাদের কোনও ভয় নেই ভাই। যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি ততক্ষণ এই গ্রামে ঢুকে ওরা তোমাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। বাবুজিকে খুন করার অপরাধে এখানকার বুনোরা এখন এমন খেপে আছে যে লালজির লোকদের দেখলেই মেরে ফেলবে ওরা।
কিন্তু তবুও ওরা তো আমাদের খোঁজে না এসে পারবে না।
শুধু তোমাদের খোঁজে কেন, ওদের মুখের গ্রাস বাবুজি যেভাবে ছিনিয়ে নিয়েছেন, তাতে সেই সবের খোঁজেও ওদের আসতে হবে! চোরাগোপ্তাভাবে রাতের অন্ধকারে আসেও ওরা এখানে। তবে এ গ্রামে নয়। ওই ওধারে যে পাহাড়গুলো রয়েছে দেখছ ওইখানে।
চম্পা বলল, জানি আমি। ওই গহন গিরিকন্দরে গুহায় গুহায় কেন ওরা কীসের আসায় ছুটে বেড়ায় জানি। আজ এখনই ওইখানে আমাদের যেতে হবে। তাই—।
না দিদিভাই। ওখানে পাহাড়ের ফাটলের গায়ে যে স্বর্ণশিরা আছে, তাই থেকে সোনার সন্ধানে এখনও ওই পাহাড়মালার অধিবাসীরা রুজি-রোজগারের ধান্দা দেখছে। ওদের সঙ্গেও লালজির লোকদের যোগাযোগ। কাজেই ওখানে তোমাদের যাওয়া ঠিক হবে না।
তা হলে জেঠু নিজে হাতে আমাকে যা দিয়ে গেছেন, তা তো চিরকাল ওইখানে লুকানো থাকবে।
তা কেন? খুব সাবধানে এবং কৌশলে ওগুলো আনতে হবে। কিন্তু সে কাজ এখনই না। আরও দু’-চার দিন যাক। তার আগে ওদের গতিবিধি আমি লক্ষ করি।
চম্পা বলল, আচ্ছা ইকলুভাই, ওখানকার পাহাড়িরা তো আমাকে চেনে। আমি যদি ঘুরে বেড়ানোর ছলে ওখানে যাই?
না যেয়ো না। তার কারণ তখন তুমি এমনই যেতে। তোমার জেঠুকে সবাই মানত, ভয়ও করত। এখন তিনি নেই এবং তুমি ছেলেমানুষ, কাজেই ওইসব মালপত্তর নিয়ে আসতে গেলেই বিপদে পড়বে তুমি। ওরা ঠিক তোমার পিছু নেবে এবং ছিনতাই করবে। তা ছাড়া তোমায় তো বলেইছি ওই লালজির অনেক লোক ওখানে আছে। বিশেষ করে লালজির গোপনীয় অনেক কিছুই লুকানো আছে ওই সব গুহায়। কাজেই ওখানে গেলে তোমাদের দু’জনকে আলুভাতের মতো মুখে পুরে নেবে ওরা। এক, যেতে পারো রাত্রিবেলা। কিন্তু তখন হিংস্র জানোয়ারগুলোর উপদ্রবে পথ চলতে পারবে না। কাজেই ওখানে যাওয়ার ব্যাপারে একটা মতলব বার করতে হবে।
ওরা যখন এইসব আলোচনা করছে তেমন সময় একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল ওরা, ইকলু! এ ইকলু ভেইয়া? জেরা শুনো তো?
ইকলু সেই ডাক শুনে বারান্দার রেলিং ধরে ঝুঁকে বলল, আরে ঠাকুর সিং? কী ব্যাপার!
থোড়া সা গড়বড়। আমার চম্পা বিটিয়া তুমহারা পাশ আয়া কি নেহি? চম্পা! কই না তো!
আয়া নেহি?
না। তবে বাবুজির কুকুর ভেলুকে আজ সকাল থেকে এখানে দেখছি! একথা না-বলা ছাড়া অবশ্য আর কোনও উপায় ছিল না। তার কারণ ভেলুয়া অদূরেই উঠোনে শুয়ে শুকনো মুড়ি চিবোচ্ছিল। ইকলু বলল, চম্পাদিদি এখানেই বা আসবে কেন? আপনি কি বকাঝকা করেছেন কিছু?
ওসব কোনও ব্যাপারই নয়। তো ঠিক আছে, ও যদি এখানে আসে তা হলে যেভাবেই হোক ওকে এখানে আটকে রাখবে। ওর সঙ্গে একটা ছেলেও থাকবে হয়তো। আমি বিকেলের দিকে আর একবার এখানে খোঁজ নিতে আসব। ভেলুয়া যখন এখানে এসেছে তখন ওরা খুব কাছাকাছিই আছে।
ইকলু বলল, ঠাকুর সিং? আপনি আর কোনও সময়েই এখানে আসবেন না। কারণ আমাদের এখানকার লোকেরা আপনার ওপরেও খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। চম্পা আমার কাছে কোনওরকমে এসে পড়লে আপনি জানবেন ও খুব নিরাপদেই থাকবে। কিন্তু আপনার লালব্জির নজর নেই তো ওর ওপর?
আছে ইকলু ভাই। ওর সঙ্গে একটা লেড়কাও আছে। ওই লেড়কা মানিকবাবুর ভাই কা লেড়কা! মাথার একটু গোলমাল আছে। বাড়ির কথা মনে করতে পারছে না। কাউকে চিনতে পারছে না। তা ওই লেড়কাটাকে বাড়িতে রেখেই আমি ভুল করেছি। চম্পা বিটিয়াকে সাথে নিয়ে ও ভেগেছে। ওর জন্যে আমার লেড়কি বিপদে পড়ে যাবে।
ইকলু সব শুনে বলল, বাবুর ভাইয়ের লেড়কাকে তুমি ঘরে রেখেছ। লালজির সঙ্গে ওদের দুশমনি, আর তুমি বলছ ও তোমার বিটিকে নিয়ে ভেগেছে। ঠাকুর সিং! তোমার উমর কত হল? তুমি কি এই কথাটা একবারও মনে করতে পারছ না যে, ওই লালজিই ওদের দু’জনকে ধরে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেখেছে কোথাও?
ঠাকুর সিং প্রায় চিৎকার করে উঠল, ইকলু! তুমি— তুমি ঠিকই বলেছ ইকলু। এই কথাটা তো আমার একবারও মনে হয়নি। লালজির লোকেরাও ওদের সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এই ভেলুয়াটা ওরা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এইখানে এসে জুটল কী করে?
ইকলু বলল, আমি এদিকটা দেখছি। তুমি লালজির দিকে নজর রাখো ঠাকুর সিং। যাও দেরি কোরো না।
ঠাকুর সিং দেরি করল না। অদূরে গাছের ডালে বেঁধে রাখা একটা দেশি ঘোড়ার পিঠে চেপে পাহাড়ি পথের বাঁকে উধাও হয়ে গেল।
ঠাকুর সিং চলে যাবার অনেক পরে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দু’জনে। পেট ভরে জল খাবার খেয়ে, চা খেয়ে ওরা এখন তৃপ্ত।
ইকলু বলল, আর তোমাদের ভয় নেই। আমি এখুনি লোক লাগিয়ে দিচ্ছি। তারা চারদিকে নজর রাখবে। এই এলাকার ভেতরে কেউ ঢুকলেই তির কাঁড় দিয়ে শেষ করে দেবে তাকে। বলেই ইকলু হন হন করে কোথায় যেন চলে গেল। চম্পা ও দীপংকর দেখল একজন আদিবাসী লোক উঠোনের প্রান্তে বসে
মুরগি কাটছে। তার মানে দুপুরে মাংস-ভাত ভালই জমবে।
চম্পা বলল, চলো দীপ, তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই। কোথায়?
যেখানে আমাদের জেঠুর সমাধি সেইখানে।
একথা শুনেই দীপংকরের মন উতলা হয়ে উঠল। বলল, চলো চলো। আগে সেখানে যাই।
চম্পা ডাকল, আয় ভেলুয়া। আ যা মেরা সাথ।
দীপংকর বলল, আবার হিন্দি!
স্যরি!
ওরা দু’জনে ইকলুদের গ্রাম ছেড়ে কোথায় যেন এগিয়ে চলল। সঙ্গে চলল ভেলুয়া।
বেশ কিছু পথ আসার পর ঝর ঝর করে একটা জল পড়ার শব্দ শোনা গেল। দীপংকর কানখাড়া করে সেই শব্দ শোনার পর বলল, ও কীসের শব্দ! মনে হচ্ছে যেন, কাছেই কোনও জলপ্রপাত আছে।
হ্যাঁ। ওই সেই বিখ্যাত ঝরনা ধারাগিরি। ওই—ওই দেখো। আর ওইখানে ওই যে যিশু ক্রশ দেখছ, ওটাই হচ্ছে জেঠুর সমাধি।
ভেলুয়া এতক্ষণ মন্থর গতিতে ওদের সঙ্গে আসছিল। এবার তিরবেগে ছুটে সেই সমাধির ওপর গড়াগড়ি খেতে লাগল।
দীপংকর ও চম্পাও ছুটল।
চম্পা বলল, এই এখানে তোমার জেঠু তাঁবু খাঁটিয়ে থাকতেন।
কিন্তু এ তো দেখছি গভীর জঙ্গল চারদিকে। এখানে বাঘ আসত না? বাব্বাঃ। তা আবার আসত না? তবে উনি খুব সাহসী লোক ছিলেন। তার ওপর জাল দিয়ে চারদিক ঘেরা থাকত। তাই বাঘ-ভালুকে কোনও ক্ষতিই করতে পারত না জেঠুর।
কথা বলতে বলতেই ওরা এখান-সেখান থেকে কিছু বনফুল তুলে ফেলল। তারপর সেগুলো এপিটাফের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে প্রণাম জানাল জেঠুর স্মৃতির উদ্দেশে।
আর ভেলুয়া? সে সমানে গড়াগড়ি খেতে লাগল সেখানে। মুখ দিয়ে ‘আঁউ আঁউ’ শব্দ করে কী করুণভাবে কাঁদতে লাগল।
চম্পা বলল, আজ দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আমরা আবার আসব এই পথে। তারপর?
তারপর আজই যাব ওই দূরের পাহাড়ে। সেখানে ছোট্ট একটি গুহার ভেতরে এক গোপন স্থানে আমার সম্পত্তি লুকানো আছে। যা তোমারও।
কিন্তু আমার যে খুব ভয় করছে।
কীসের ভয়?
যদি বাঘ-ভালুকের হাতে পড়ি?
সে ভয় যে নেই তা নয়। তবু সাবধানে সাহসে ভর করে যেতে হবে। ইকলুকে জানাব না। ওর ওখান থেকে গোটা দুই ছোরা নিয়ে লুকিয়ে পালাব। একটা দড়ি জোগাড় করতে হবে।
ওসব কী হবে?
পাহাড়ে উঠতে গেলে এগুলো চাই।
আমি বলছিলাম কী, আজকের দিনটা বিশ্রাম নিয়ে কাল সকালে যদি খুব ভোর ভোর যেতে?
তা গেলেও হয়। তবে সকালের দিকে লোকজন এসে পড়ার সম্ভাবনাটা খুব। কারণ মাঝেমাঝে অনেকে ওইখানে পাথর কাটতে আসে। ওরা থাকলে কিন্তু আমাদের জিনিসপত্তর ওদের চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে আসা একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তার চেয়ে আমি চাই কী, ওগুলো সংগ্রহ করে রাতটা ওই গুহায় কাটিয়ে কাল খুব ভোর ভোর উঠে রওনা দেব। তারপর যেখানেই হোক পালাব এখান থেকে।
তা না হয় হল। কিন্তু ওই রত্নসামগ্রী নিয়ে দিনমানেও কি পালাতে পারব আমরা? যদি কেউ কেড়ে নেয়?
সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। এখন চলো ঘরে ফেরা যাক।
এমন সময় ইকলুর গলা শোনা গেল, চম্পা দিদিভাই! ও চম্পা দিদিভাই ! বলি এখানে কী করছ?
চম্পা হাসি মুখ করে বলল, দীপংকরকে দেখাচ্ছিলাম, ওর জেঠুর সমাধি। আমাকে বলে আসা উচিত ছিল তো? আমি কত ভাবছি তোমাদের কথা।
তোমরা এখন এমন একজনের নজরে রয়েছ, যার চোখ থেকে তোমাদের আড়াল করা অসম্ভব। অথচ রক্ষা তোমাদের করতেই হবে।
চম্পা বলল, ইকলুভাই, আমি কালই দীপুকে নিয়ে পালাতে চাই কলকাতায়। তুমি কি একটু ব্যবস্থা করে দেবে? কালই চলে যাবে?
হ্যাঁ।
তোমার জিনিসগুলো নেবার তা হলে কী হবে?
ভাবছি লোভ করব না। যেখানকার জিনিস সেখানেই থাক। আমরা আপাতত পালিয়ে বাঁচি।
ইকলু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, না না। তা ঠিক নয়। জীবনে বেঁচে থাকতে গেলে কিছু কিছু জিনিসের খুবই প্রয়োজন আছে। তোমার জিনিস তুমি নিয়ে যেয়ো। ওর মূল্য অনেক। আমি তো বাবুজির সামান্য ভৃত্য ছিলাম একজন। উনি আমাকেও বঞ্চিত করেননি। আমাকে উনি যা দিয়ে গেছেন তাতে এই গ্রামটাকে এখন আমি কিনতে পারি। এখনও অনেক— অনেক ধন রত্ন আমার ঘরের ভেতর মেঝের নীচে পৌঁতা আছে। যা পেয়েছি তার দশভাগের এক ভাগেই আমি বড়লোক। বাকি ন’ভাগ এ জীবনে হয়তো খরচই করতে পারব না।
চম্পা বলল, আমি কিন্তু তোমার ওপর ভরসা রাখছি।
ইকলু বলল, বেশ। আজই আমি একটা খড়বোঝাই গোরুর গাড়ি ঠিক করে রাখব। তোমরা ওগুলো উদ্ধার করে নিয়ে এলেই ওই খড় চাপা দিয়ে আমি তোমাদের ঘাটশিলায় পৌঁছে দেব, কেমন?
এই চমৎকার প্রস্তাবে ওরা দু’জনেই আনন্দে নেচে উঠল। দীপংকর ঠিক করল ভেলুয়াকেও ওদের সঙ্গে নিয়ে যাবে। এখন পেটভরে খেয়েদেয়ে ইকলুর ঘরে তেড়ে একটা ঘুম দিলেই সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে দু’জনের। ওরা পায়ে পায়ে ঘরের দিকে এগোল।