গিরিগুহার গুপ্তধন – ৬

ছয়

হাট থেকে বেরিয়ে ওরা দুই পাহাড়ের মাঝের বনপথ ধরে গভীর জঙ্গলের দিকে এগোতে লাগল। ভেলুয়াও ওদের সঙ্গে সমানে চলেছে। পথ চলায় ওর যেন ক্লান্তি নেই। ভেলুয়া আগে আগেই চলছিল। যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল ও।

কী হল! কী হল রে ভেলুয়া?

ওরা দেখল পথের মাঝখানে কিছু ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ। নিশ্চয়ই কাউকে বাঘে খেয়েছে। এই দেখে ওরা আর এগোতে সাহস করল না। কিন্তু মা-এগোলেও থাকবে কোথায়?

হঠাৎ দীপংকরের নজরে পড়ল কিছু দূরে একটা কুণ্ডুল পড়ে আছে।

ও কাছে গিয়ে সেটা কুড়িয়ে নিল। আর তখনই দেখতে পেল সেই ভয়াবহ দৃশ্যটা। একটা লোক অদূরে জঙ্গলের ভেতর বড়সড় একটা পাথরে শুয়ে আছে। লোকটার বুক পেট ফালা ফালা। প্রাণটুকু অবশিষ্ট আছে। সেটুকুও আর থাকবে না হয়তো।

চম্পা বলল, নিশ্চয়ই ভালুকের হাতে পড়েছিল লোকটা। চলো ওর মুখে একটু জল দিয়ে আসি। এই বলে ওরা দু’জনে লোকটার কাছে গেল। কিন্তু জল দেবার আগেই একবার শেষবারের মতো কেঁপে উঠে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল সে।

চম্পা বলল, আর এক মুহূর্ত নয়। যেভাবেই হোক কোনও পাহাড়ি গাঁওয়ে গিয়ে পৌঁছতে হবে আমাদের। চলো, চলো, পা চালাও।

এমন সময় কয়েকজন হাট ফেরতা বুনো লোক এসে পড়ল সেখানে। যাক বাবা বাঁচা গেল। ওরা কুসুমডি গ্রামে যাচ্ছিল। চম্পা ওদের চিনত। তাই দলে ভিড়ে গেল।

কুসুমডি বেশি দূরে নয়। মিনিট দশেকের পথ। ওরা ওদের পিছু পিছু দশ মিনিট হেঁটে সেই গ্রামে এসে পৌঁছুল। শুধু পাহাড় আর পাহাড় এখানে।

এখানে পাহাড়ের কালো বুনোদের ঘরবাড়ি কয়েকটি থাকলেও, ওরা ওদের বলেকয়ে একটি সুউচ্চ গাছের মাথায় জঙ্গল পাহারা দেবার জন্য যে ঘর, সেই ঘরই একটি এক রাতের জন্য চেয়ে নিল। আর বলে দিল কেউ এসে ওদের খোঁজ করলে ওরা যে এখানে আছে সে কথা যেন না বলে।

আর ওরা দু’জনে দড়ির মই বেয়ে একটি ঘনপত্র বিশিষ্ট গাছের মাথায় যে ঘর, সেই ঘরে গিয়ে জুটল। কী ছোট ঘর। কাঠের তৈরি। ডালপালা দিয়ে। তাইতে খড় বিছানো। এক পাশে একটি ক্যানেস্তারা। আসলে ফসলের সময় ফসল পাহারা দেবার জন্যে যখন এই ঘরে থাকা হয় তখন এটা কাজে লাগে।

চম্পা বলল, শোনো ঘুম পেলে দু’জনেরই এখানে ঘুমিয়ে পড়াটা ঠিক হবে না। যখন তুমি ঘুমোবে তখন আমি জাগব, যখন আমি ঘুমোব তখন তুমি জাগবে। কেমন?

দীপংকর বলল, সে তো বটেই।

দীপংকরের বুক তখন ভয়ে ঢিপ ঢিপ করছে। কেন না বাতাসের আন্দোলনে ডালগুলো যখন দুলে উঠছে, তখন বার বারই মনে হচ্ছে এই বুঝি ঘরটা ভেঙে পড়বে মাটিতে। না হলে চারপাশের বন্য প্রকৃতির শোভা এখানে অপরূপ। এমন পরিবেশে তো জীবনে থাকেনি কখনও, এই বনবাসর তাই ওর কাছে স্বর্গীয়। চম্পা বনবালা। এরকম অঢেল সৌন্দর্য ওর দেখা আছে। কিন্তু ও তো এই.প্রথম দেখছে। একটু পরেই আকাশের সুগোল চাঁদ পরিষ্কার দেখা গেল। জোছনায় ফুল ফুটছে যেন চারদিকে। পূর্ণিমা এগিয়ে আসছে হয়তো। তাই এত আলো।

দীপংকর চম্পার অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানির দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ! তারপর এক সময় বলল, আমার জেঠুর ব্যাপারে তুমি কি কিছু আমাকে বলবে?

চম্পা বলল, নিশ্চয়ই বলব। তোমার জেঠু ছিলেন এই পাহাড় বনের দেবতা। এখানকার বন্যেরা সকলেই তাঁর কাছে উপকৃত। উনি প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলের সুখ দুঃখের খোঁজ নিতেন। মানুষের আপদেবিপদে অসুখেবিসুখে পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। সাইকেলে চেপে হোমিওপ্যাথি ওষুধ নিয়ে গ্রাম গ্রামান্তরে গিয়েও বিনামূল্যে চিকিৎসা করতেন রোগীদের। ওনার ওষুধের এমনই গুণ ছিল যে এক ফোঁটা ওষুধ খেলেই রোগ সেরে যেত। একবার হল কী আমার খুব অসুখ হল। রাত্রিবেলা। কোথাও ডাক্তার পাওয়া যায় না। বাবুজি ছুটলেন তোমার জেঠুর কাছে। সে সময় উনি কাছাকাছিই ছিলেন তাই রক্ষে। খবর পাওয়া মাত্রই ছুটে এলেন আমাদের ঘরে। তারপর এমন ওষুধ দিলেন যে খাওয়া মাত্রই ভাল হয়ে গেলাম। সেদিন থেকে যতদিন পর্যন্ত না আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হলাম ততদিন উনি রোজ এসে আমাকে ওষুধ দিয়ে যেতেন।

তারপর?

তারপর আর কী? ভাল হবার পর আমিও যখনতখন যেতাম তোমার জেঠুর কাছে। তোমার জেঠু খুব ভোজনরসিক লোক ছিলেন। অনেক টাকার মালিক তো। প্রতিদিন একটা দুটো করে মুরগির মাংস উনি রান্না করে খেতেন। ওনার ইকলু চাকরটা আদিবাসী হলে কী হয় রান্নার ব্যাপারে খুব পটু ও। ভাল সাইকেল চালাতে পারত। ঘাটশিলা থেকে জেঠুর জন্যে ভাল ভাল সন্দেশ-রসগোল্লা নিয়ে আসত। তবে জেঠু কিন্তু সবই একা খেতেন না। পঁচিশ-ত্রিশ টাকার মিষ্টি কিনে এনে নিজে সামান্য কিছু খেয়ে, বাকি সব ইকলুকে দিয়ে বিলিয়ে দিতেন। আমি আসলে ওই সব ভাল ভাল জিনিস খাবার লোভেই এখানে আসতাম। মাঝে মাঝে তোমার জেঠুকে বলতাম, আচ্ছা জেঠুমণি! তুমি চাকরি করো না, চুরিডাকাতি করো না। তবু তুমি এত টাকা পাও কোথা থেকে? জেঠু হেসে বলতেন, ভগবান দেয়। ওরে বেটি! আমি যা কখনও চিন্তাও করিনি ওই ওপরতলা ভগবান না চাইতেই আমাকে তাই দিয়েছেন। আমার অনেক— অনেক টাকা। আমার যা টাকা আছে তাতে আমি এই শহরটাকেই কিনে ফেলতে পারি। তাই শুনে আমি বলতাম, তা হলে তুমি এই বনেজঙ্গলে তাঁবুতে রাত কাটাও কেন? গাছের ওপর ঘর করে থাক কেন? ভিলসর্দারের ওখানে মাটির নীচে ঘরের ভেতর লুকাও কেন?

তা জেঠু বলতেন, জানিস বেটি, টাকা-পয়সা বিষয়সম্পত্তি এসব হচ্ছে মানুষের ভালভাবে বেঁচে থাকবার একটা অবলম্বন। বহু কষ্ট করে এসব অর্জন করতে হয়। কিন্তু আমি যখন কষ্ট না করেই এইসব পেয়ে গেছি তখন কেন ছুটব আলেয়ার পিছনে? এই যে অরণ্য এর রূপ, রস, গন্ধ যে মানুষ ভোগ না করল, তার জীবনই বৃথা। গভীর নিশীথে এই ঝরনা বা নদীতীরে হরিণের জল খেতে আসা যে দেখল না তার কীসের জনম? এই গাছের ওপর ঘরে শুয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত বনভূমির সৌন্দর্য যে উপভোগ করতে না এল তার কি জন্য পৃথিবীতে আসা? অবশ্য ইচ্ছে থাকলেও অনেকের জীবনে তা ঘটে ওঠে না। কেন না তাদের ঘর আছে, সংসার আছে, তাদের রুজি রোজগারের জন্যে ছুটতে হয়। আমার তো তা নেই। এই অরণ্য তার যে সম্পদ আমার হাতে তুলে দিয়েছে তাতে আমি রাজার ঐশ্বর্য পেয়ে গেছি।

দীপংকর অবাক বিস্ময়ে চম্পার মুখের দিকে চেয়ে সব কথা শুনে যেতে লাগল। যদিও এই ছোট ডালপাতার ঘরে কোনও আলো না থাকায়, ওর মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না, তবুও ওর ভ্রমরকালো চোখদুটো যেন কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে কই মাছের মতো ছটফট করছিল। দীপংকর বলল, বলে যাও। বলে যাও চম্পা। তারপর ?

তারপর আমি জেঠুর গলা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললাম এই অরণ্য তোমার হাতে কী সম্পদ তুলে দিয়েছে জেঠু! জেঠু বললেন, অমূল্য সম্পদ। এক সময় আমি জাহাজে চাকরি করতাম। সাহেবদের কাছ থেকে অনেক গিনি মোহর উপহার পেতাম। এরকম অনেক আমার ভাইয়ের কাছে গচ্ছিত আছে। আমার ভাই, বউমা এবং তোর বয়সি ওদের একটি ফুটফুটে ছেলেও আছে। ওই গিনি আমি তাদের ভোগ করবার জন্যে দিয়েছি। তাদের বলেই রেখেছি আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন কেউ ওতে হাত দেবে না। আমি মরে গেলে যদি কখনও খুব বিপদে পড়, তখনই শুধু খরচা করবে ওগুলো। কারণ অযথা বড়লোক হবার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু সংগ্রহ করতে নেই, বা পুঁজি নষ্ট করতে নেই। এতে মানুষ নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনে। যাই হোক, ওদের কাছে গিনিগুলৈা গচ্ছিত রাখলেও নিজের জন্য উপার্জিত অর্থ কিছু রেখেছিলাম। তাই দিয়ে টাটানগরে একটা বাড়ি করেছি। ব্যাঙ্কেও রেখেছি প্রচুর টাকা। এ টাকা অবশ্য জাহাজে কাজ করে উপার্জন করিনি। এটা সোনা কেনাবেচার দালালি করে উপার্জন করেছি। এই সোনার নদীর দেশের রেণু থেকে সোনাখোঁচারা স্বর্ণসন্ধান করলে তা আমার মধ্যস্থতায় বিক্রি হত। এইভাবেই যখন অল্প পরিশ্রমে আমি প্রচুর টাকার মালিক হলাম, তখন এই অরণ্যমায়ায় পড়ে গেছি। ভাবলাম আর কী হবে অর্থ? অনেক—অনেক তো হয়েছে। এত যে তা সারাজীবনে দু’হাতে খরচ করেও শেষ করতে পারব না। অতএব পেটের চিন্তা যখন নেই তখন পরম নিশ্চিন্তে জীবনের বাকি দিনগুলো প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ উপভোগ করে যাই। মানুষের সেবা করি। এইভাবেই আমার অরণ্যজীবন শুরু হল।

দীপংকর বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জানো চম্পা, তুমি যেন রূপকথার কোনও গল্প আমাকে শোনাতে বসেছ। সবচেয়ে আশ্চর্য, এতক্ষণ ধরে বাংলায় কথা বলছ তুমি, অথচ তোমার জিভের কোনও জড়তা নেই। কী পরিষ্কার বাংলা, আমার মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই তোমার মা-বাবা বাঙালি ছিলেন।

হয়তো। তবে বাংলায় কথা বলতে আমার খুব ভাল লাগে। আর অনর্গল যখন বলতে থাকি তখন বলার মধ্যে বেশ সরলতা এসে যায়। কিন্তু পরে আবার যে কে সেই। ঠিক দু’-এক কথার মাঝে হিন্দি বলে ফেলি। রোজ যদি তোমার সঙ্গে কথা বলি তা হলে দেখবে আর আমার কথায় হিন্দির টান আসবে না।

দীপংকর বলল, রাত এখন কত তা কে জানে? সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি আবার শুরু করো আমার জেঠুর কথা।

হ্যাঁ। তোমার জেঠু বলেছিলেন, এইভাবে অরণ্যবাস করতে করতে একদিন তিনি ভেলুয়াকে সঙ্গে নিয়ে ধারাগিরি পার হয়ে আরও গভীর জঙ্গল ও পাহাড়ের মধ্যে চলে যান। এমন সময় হঠাৎ দেখলেন কয়েকজন লোক ছোট ছোট ঘোড়ার পিঠে মালপত্তর চাপিয়ে কোথায় যেন চলেছে। তাদের একজনের হাতে বন্দুকও ছিল। জেঠু সহসা আক্রমণ না করে, সাহসে ভর করে ওদের অনুসরণ করেন। ওরা একটি গুহার মধ্যে সেই সব মাল খালাস করে চলে যায়। ওরা চলে যাবার পর, জেঠু ওদের লুকিয়ে রাখা মালপত্তরগুলো পরীক্ষা করতে গিয়েই অবাক হয়ে যান। দেখেন কিনা তাল তাল সোনা। আর সেই সোনার সঙ্গে কিছু অলংকার দেখেই জেঠুর মনের কোণে কীসের একটা সন্দেহ যেন ঝিলিক মেরে ওঠে। জেঠু বার বার সেগুলো দেখতে থাকেন। এ যে তাঁর অতি পরিচিত। এই অলংকার মিলারসাহেবের মেম হেনরিয়েটার। আর ওই মুদ্রাও তো মিলারসাহেবেরই চুরি করা। অর্থাৎ এত সব চুরি করেও আশ মেটেনি। তাই আরও অধিক কিছু পাবার লোভে খুন করে মিলারসাহেবকে। কিন্তু খুন যে করে সে তো কুন্দনলাল। তবে কী…।

জেঠুর ডায়েরির সেই অংশটার কথা মনে পড়ল দীপংকরের। চম্পা আর কিছু বলার আগেই দীপংকর বলল, জেঠুর ডায়েরি আমি পড়েছি! কুন্দনলাল মিলারসাহেবকে খুন করে প্রচুর সোনা নিয়ে পালাতে যাবার সময় আমার জেঠু ওকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। সেই সময় দু’জনের ধস্তাধস্তিতে কুন্দনলাল ভিক্টোরিয়া জাহাজ থেকে গঙ্গার জলে পড়ে যায়। গঙ্গায় তখন ষাঁড়াষাঁড়ির বান! সেই বানের তোড়ে কোথায় ভেসে যায় কুন্দনলাল তা কে জানে? তারপর হঠাৎ একদিন তার সাথে অনেক— অনেকদিন পরে দেখা হয় খড়্গপুরের গোলবাজারে। সে যাই হোক, কুন্দনলালের লুট করা ওই সোনার ব্যাপারে আর কিছু জানা যায় না। সেগুলো কি জাহাজেই পড়ে থাকে? না জেঠু নিজেই সেগুলো নিজের কাছে রেখে দেন? না হলে এত অর্থ ওই জাহাজের চাকরি ছাড়ার পরই কী করে উপার্জন করেন জেঠু?

চম্পা বলল, সে ব্যাপারটা আমাদের অবশ্য না-জানলেও চলবে। তা ওই সম্পত্তি মানে ওই গুহার ভেতর থেকে সোনার তাল, অলংকার, গিনিগুলো জেঠু উদ্ধার করে আনেন। তারপর সেগুলো এমন এক জায়গায় উনি লুকিয়ে রাখেন যে তা কেউ জানে না। একমাত্র আমি ছাড়া।

সে কী!

হ্যাঁ। তুমি কি বিশ্বাস করবে দীপংকর! উনি আমাকে এত ভালবেসে ফেলেছিলেন যে, বলে গেছেন, হঠাৎ যদি কখনও আমি মারা যাই তা হলে ওগুলো তোর হবে। তোর বিয়ের জন্য যৌতুক হিসেবে আমি ওগুলো রেখে গেলাম। দেখিস, যেন ভুলেও এ কথা কাউকে বলিস না। তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তুই-ই বঞ্চিত হবি তোর প্রাপ্তি থেকে।

তুমি জানো সেগুলো কোথায় আছে?

জানি। তোমাকেও দেখাব। কাল সকালে আমরা সেখানে গিয়ে উদ্ধার করব সেগুলো। সব হয়তো পারব না। করব কিছু কিছু। তারপর তোমাকে নিয়ে চলে যাব তোমাদের বাড়িতে।

কিন্তু জেঠুর খুনের ব্যাপারটা?

হ্যাঁ। ওই সোনার তাল, মুদ্রা এবং অলংকার সেই গুহা থেকে সরিয়ে আনার পর হঠাৎ কিছু লোক ওই জেঠুকে সন্দেহ করে পিছনে লাগে। তাদের মধ্যমণি ছিলেন লালজি। অর্থাৎ ওই কুন্দনলাল। তবে এখানকার বুনোরা বা মা রংকিনীর সেবায়েত ওই ভিলরা জেঠুর সহায় ছিলেন বলে লালজি খুব একটা সুবিধে করতে পারছিলেন না। আমার মনে হয় সেইজন্যে লালব্জিই জেঠুকে খুন করেছেন। যে রাতে জেঠুকে খুন করা হয়, ভেলুয়া সে রাতে আমার কাছে ছিল। সেদিন ছিল শনিবার। আমি কুসুমডির হাটে ঘুরে বেড়িয়ে তোমার জেঠুর দেওয়া কাচের চুড়িতে দু’হাত ভরিয়ে যখন বাড়ি ফিরতে গেলাম, তখন বেলা গড়িয়েছে। তাই জেঠু ভেলুয়াকে আমার সঙ্গে দিলেন। ব্যস। সেই সুযোগে সেই রাতেই খুন হয়ে গেলেন জেঠু।

হঠাৎ ভয়ংকর একটা নিনাদে সেই অরণ্যভূমি থর থর করে কেঁপে উঠল। দীপংকর ভয়ে চিৎকার করে দু’হাতে আঁকড়ে ধরল চম্পাকে। ওর মধ্যে ও যেন আর নেই তখন।

চম্পাও ভয় পেয়ে গিয়েছিল প্রথমে। তারপর বলল, ও কিছু না। বাঘের ডাক। পরক্ষণেই চারদিক থেকে ক্যানেস্তারা পেটানোর শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। শুরু হল কুকুরের ক্রুদ্ধ চিৎকার। বনের পাখিরা ভয় পেয়ে আকাশময় উড়ে এলোমেলো ভাবে পাক খেতে লাগল। কী বিপর্যয়। ওরা ওপর থেকে উঁকি মেরে দেখল, একটা বিশাল দেহ বাঘ ওদেরই গাছের নীচে বসে ঘন ঘন ল্যাজ নাড়ছে। দীপংকর ভয়ে কানে আঙুল দিয়ে চোখ বুজল। বাঘটা চলে গেল একটু পরেই। কেন না ক্যানেস্তারা বেজে উঠলে মানুষ জেগে উঠেছে বুঝলে বাঘ আর থাকে না। একটু পরে দীপংকর ঘুমিয়ে পড়ল।

বনমোরগের ডাকে যখন ঘুম ভাঙল দীপংকরের, তখন দেখল অল্প অল্প করে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে এই মৌনীস্তব্ধ গিরিঅরণ্যে।

এক সময় চম্পাও উঠে বসল। তারপর দু’হাত টান করে হাই তুলে বলল, স্যরি। জেগে থাকতে থাকতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চলো চলো, আর দেরি নয়। দিনের আলোতেই যত ভয়। ইকলুদের গ্রামে না-পৌঁছনো পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। কেন না আমার মন বলছে বাবুজির লোকজন সকাল হলেই এইদিকে আমাদের খোঁজে আসবে। বলেই দড়ির মইটা ওপর থেকে ঝুলিয়ে দিল চম্পা। তারপর সেই মই বেয়ে দু’জনেই নামল গাছ থেকে। কুড়িয়ে পাওয়া সেই কুণ্ডুলটা দীপংকর কিন্তু সঙ্গে রাখতে ভুলল না।

ভেলুয়া কাছেপিঠেই ছিল। ওদের নামতে দেখেই লেজনেড়ে ছুটে এল সেখানে। তারপর আবার চরৈবেতি। অর্থাৎ চলা শুরু হল।

পাহাড়ের পথে একটা উত্তরাই পেরোতেই ওরা একটা ঝরনার ধারে এসে পৌঁছুল। সেখানে ঝরনার জলে মুখহাত ধুয়ে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিল ওরা।

দীপংকর বলল, আমার খুব খিদে পাচ্ছে। কী করি বলো তো?

কী আর করবে? আমারও খিদে পাচ্ছে খুব। কিন্তু এখানে এই অরণ্যে কোথাও কিছু নেই। কাল থেকে পথ হাঁটা কী কম হল? ভেলুয়াটাও খায়নি কিছু। এই সময় একটু কিছু পেটে না-দিলে যে আর পথ চলতে পাচ্ছি না।

এমন সময় জঙ্গলের ভেতর থেকে দু’জন সশস্ত্র যুবক কালো প্যান্টি আর ডোরাকাটা গেঞ্জি গায়ে ওদের সামনে হাসতে হাসতে এসে দাঁড়াল। দু’জনেরই চেহারা দানবাকৃতি। চোখেমুখে নৃশংসতার ছাপ। ওদের হাতে উদ্ধৃত ছোরা। ওদের একজন বলল, আরে চম্পা! তু হিয়াতক ক্যায়সে আ গিয়া? ও লেড়কা কৌন হ্যায়?

চম্পা রেগে বলল, তু পুছনেয়ালা কৌন?

আর একজন বলল, তুই লালজির সাথে টক্কর মারতে যাচ্ছিস চম্পা! তুই কি ভেবেছিস এই লেড়কাকে নিয়ে ভাগবি, আর মানিকবাবুর লুটেরা মাল হাপিস করবি, তা আমরা বসে বসে দেখব? কাল রাত থেকে তোদের দু’জনকে খুঁজছি আমরা। কোথায় যাচ্ছিস তোরা? গুপ্তধন নিতে?

চম্পা বলল, পথ ছোড়ো। বদমাশ কাহাকা। হট

আমরা হটে যাবার জন্যে আসিনি চম্পা। তোদের যাও।

দু’জনকে লালজির কাছে

পৌঁছে দেবার জন্য আমরা এসেছি। বলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল চম্পার ওপর। চম্পা চিৎকার করে উঠল, বাঁচাও বাঁচাও।

ভেলুয়া তখন বাঘের মতো লাফ দিয়ে লোকটার ঘাড়ে পড়েছে। তারপর আঁচড়েকামড়ে একশা করতেই, চম্পাকে নামিয়ে দিয়ে পালাতে গেল। ভেলুয়া খ্যাপার মতো তাড়া করল তাকে।

আর একজন হতভম্ব হয়ে যেই-না ছোরা উঁচিয়ে আক্রমণ করতে আসবে দীপংকরকে, সেও অমনি কুড়ল উচিয়ে আক্রমণ করল তাকে।

মুহূর্তের ব্যাপার। দেখা গেল সেই ভয়াবহ আক্রমণকারীর ছোরাধরা কাটা হাতটা পড়ে আছে পাথরের ওপর। আর সে থরথর করে কাঁপছে, এ ক্যা কর দিয়া তুমনের মেরা হাত দে দো।

দীপংকর বলল, এই হাত দিয়েই তোরা আমার জেঠুকে খুন করেছিলি। তোকে দিয়েই আমার বদলা নেবার পালা শুরু। শেষ হবে কুন্দনলালকে দিয়ে। যদি আর একটা হাত খোয়াতে না-চাস তো ভাগ এখান থেকে।

লোকটা পালাল।

আগের লোকটাকে তাড়িয়ে ভেলুয়া তখন ছুটতে ছুটতে আসছে। ভেলুয়া এলে চম্পা, দীপংকরও ছুট লাগাল। আর কেউ থাকে এখানে?