গিরিগুহার গুপ্তধন – ৫

পাঁচ

খুব তাড়াতাড়ি দু’জনে দু’মুঠো খেয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। একটা নতুন গামছায় ছাতু চিঁড়ে আর ভেলি গুড় বেঁধে নিল চম্পা। তারপর পরিপাটি চুল আঁচড়ে বিনুনি করে সাপের মতো বেণীটা ঝুলিয়ে দিল পিছন দিকে। ভাঙা আয়নায় মুখ দেখল। দীপংকরের চুলগুলোও যত্ন করে আঁচড়ে দিয়ে দরজায় শিকল তুলে বেরিয়ে পড়ল দু’জনে।

কিছুদূর আসার পরই ওদের পিছনে আরও একজনের অস্তিত্ব অনুভব করল ওরা। সে হল ভেলুয়া।

চম্পা বলল, যা। ঘর যা ভেলুয়া। উধার যা কে সব কুছ দেখভাল কর। দীপংকর বলল, কেন, আসুক না ও। দূর পথ যাত্রায় ও যদি আমাদের সঙ্গী হয় তো মন্দ কী? বলেই ডাক দিল সে, আয়রে ভেলুয়া। কিন্তু।

কোনও কিন্তু নয় চম্পা। তুমি আমাকে কোথায় কোনখানে লুকিয়ে রাখবে তা তো জানি না। তবু আমার নিরাপত্তার জন্যে ভেলুয়ার কাছে থাকাটা খুবই দরকার। তা ছাড়া তুমি তো একা ফিরবে। এই জঙ্গলে যদি তোমার কোনও বিপদ হয়? ভেলুয়া থাকলে কেউ তোমার দিকে এগোতে সাহস করবে না।

তা হলে আসুক।

ভেলুয়া তখন ছুটে এসে ওদের পায়ের কাছে লুটোপুটি খেতে লাগল। তারপর ওদের পথপ্রদর্শক হয়ে চলতে লাগল ও।

দীপংকর বলল, কী আশ্চর্য! ও কী করে জানল আমরা কোথায় যাব?

ও সব জানে। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে যাবার এই একটিই মাত্র পথ।

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

গেলেই দেখতে পাবে।

ওরা ঝরনার পাশ দিয়ে কিছু পথ এসে একটি ছোট্ট টিলার ওপর উঠল। তারপর সেটা অতিক্রম করে প্রবেশ করল এক গভীর বনে। শাল আর সেগুনের ঘন অরণ্যানির মাঝে সুঁড়ি পথ ধরে ওরা এগোতে লাগল। এখানে চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। যাঝে একটা শীর্ণা নদী পড়ল। চম্পার কোমল হাতখানি ধরে সে নদীও পার হল দীপংকর। এবার পাহাড়ে ওঠা। একটি বড় পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে উঠতে লাগল ওরা। এ পথে জঙ্গলে কাঠ আনতে লরি যাতায়াত করে। সেই নির্জন প্রান্তরে অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে দীপংকর অভিভূত হয়ে গেল। ওর মনে হল, এই তো, বেশ তো। আর কেন ঘরে ফেরা? কেনই বা অনুসন্ধান? এই অরণ্যে চম্পা ও ভেলুয়াকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে যাক ও। আর শহর সভ্যতায় কাজ নেই। চির বনবাসেই এ জীবনটা কাটিয়ে দিক ওরা।

ওরা যে পাহাড়ে উঠেছিল সেই পাহাড় অতিক্রম করার পর নামার মুখে দেখল আরও মনোহারী শোভা৷ এই কালো কোয়ার্টজাইট পাথরের পটভূমিতে রঙিন ফুলের শোভায় এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই খররৌদ্র মধ্যাহ্নে মায়াময় হয়ে উঠেছে। ওরা যত এগোয় অরণ্যের সৌন্দর্য ততই প্রকট হয়। কাছে দূরের শৈলমালা, দু’–একটি বন্যগ্রাম, শ্বেতশুভ্র ইউক্যালিপ্টাসের কণ্ঠ জড়ানো ঘন পত্রের চিহড় লতা সবই আকর্ষণীয়।

দীপংকর অভিভূত হয়ে বলল, কী সুন্দর।

চম্পা রসিকতা করে বলল, কোনটা? এই বনভূমি? না আমি? দুটোই। আমার কী মনে হচ্ছে জান?

কী মনে হচ্ছে?

আর কোথাও না গিয়ে এইখানেই আমরা থেকে যাই। তারপর?

তারপর আবার কী? এই অরণ্যে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষদের মতো আমরা গাছের বাকল পরে ঘুরে বেড়াব।

ওমা! সে কী? খাব কী আমরা?

বনের ফলমূল।

এটা রামায়ণের যুগ নয় গো মশাই। এ বনে শাল, সেগুন, পলাশ, শিমুল ই আছে। প্রাণধারণ করে বেঁচে থাকার মতো কোনও ফলের গাছ নেই।

আমার কিন্তু ইচ্ছে করছে এইখানে এই পাহাড়ের কোলে ওই যে ঝিরিঝিরি ঝরনাটা ঝরে পড়ছে, ওর ঠিক পাশটিতে একটি ঘর করি।

বেশ তো করো না। এই বনডুংরির শৈলমালায় তরুণ যোগী হয়ে তুমি মহাদেবের মতো তপস্যা করো আর আমি তোমার সেবাযত্ন করি। আবার পথ চলা।

যেতে যেতে চম্পা বলল, ওই দেখো দীপ। ওগুলো কী বলো তো? কী জানি। এ তো দেখছি গাছের ওপর ঘর।

হ্যাঁ। বুনো হাতি, ভালুক, শুয়োরের পাল এসে খেতের ফসল নষ্ট করে।

তাই গাছের ওপর ঘর করে মানুষ পাহারা দেয়। জন্তুজানোয়ারেরা দলবদ্ধ হয়ে এসে পড়লেই ক্যানেস্তারা বাজিয়ে ওরা মুখে বিকট শব্দ করে তাড়া দেয়।

কাছেপিঠে গ্রাম আছে বুঝি?

হ্যাঁ। এসে গেছি আমরা। ওই যে দেখছ দূরের গ্রামখানা। আমি ওখানেই তোমাকে রেখে যাব।

তুমি চলে যাবে চম্পা?

যেতে তো হবেই। না হলে তোমারই বিপদ হবে। ওরা যখনই জেনে যাবে আমি তোমার সঙ্গে পালিয়ে গেছি তখনই চারদিক তোলপাড় করতে থাকবে। তার চেয়ে আমি ফিরে গেলে ওদের গতিবিধির দিকে নজর রাখতে পারব। মাঝেমধ্যে তোমাকে এসে দেখে যাব। তার যদি কোনওরকমে তোমার বাড়ির ঠিকানা পাই তা হলে সঙ্গে সঙ্গে আমি চলে যাব তোমার মা-বাবার কাছে। কী করে যাবে?

কেন? ট্রেনে করে। ওখানে গিয়ে চারদিক ছুঁড়ে তোমার ঠিকানা খুঁজে বার করব।

খুব ভাল হয় তা হলে।

যাই হোক, ওরা পাহাড় থেকে নেমে এক জায়গায় মালভূমির মতো অংশে এসে একটি গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করল। পাহাড়িয়া ছোট্ট গাঁও। কী সুন্দর!

চম্পা বলল, এই গাঁওয়ের শেষ সীমানায় মা রংকিনীর মন্দির আছে। আসল মন্দির অবশ্য যদুগোড়ার পথে। ঘাটশিলা থানার পাশে মায়ের আসল মূর্তিটা আছে। তবে এখানেও মা খুব জাগ্রত। শনি-মঙ্গলবারে বলি হয়। হাট বসে। আজ হাটবার।

ওরা যখন মন্দিরের কাছে গেল তখন কেউ নেই সেখানে। সকালে বারোটার মধ্যে পুজো হয়ে গেছে। এখন সবাই অদূরে হাট নিয়ে ব্যস্ত।

চম্পা মন্দিরের ঘণ্টায় ঢং করে একটা শব্দ করল। তারপর এক ভয়ংকরী দেবীমূর্তির সামনে স্থির হয়ে বসল। চাঁপাফুলের পাপড়ির মতো গায়ের রং যার, এমন একটি চোদ্দো-পনেরো বছরের সুন্দর মুখ স্কার্টপরা মেয়েকে এই পরিবেশে এক নবীনা যোগিনী বলে মনে হল।

দু’চোখ বুজে অনেকক্ষণ ধরে চম্পা কী যেন প্রার্থনা করল দেবীর কাছে, তারপর দীপংকরকে বসতে বলে কোথায় যেন চলে গেল। একটু পরেই আবার যখন ফিরে এল তখন ওর দু’হাত ভরতি অজস্র বনফুল। সেই ফুল দেবীর চরণে অঞ্জলি দিয়ে বলল, দেবীকে প্রণাম করো।

চম্পা দীপংকর দু’জনেই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল দেবীকে।

তারপর উঠে দাঁড়াল দু’জনে।

চম্পা বলল, এসো, তোমাকে ভিলসর্দারের কাছে নিয়ে যাই। এই সর্দার আমাকে নিজের লেড়কির মতো পেয়ার করেন। লালজির সঙ্গে ওর একদম দোস্তি নেই। তাই লালজির লোকেরা এই গাঁওতে ঢোকে না।

সর্দার যদি আমাকে রাখতে না চান? চাইবেন। শুধু একটা কথা। কী?

মাটির নীচে একটা সুড়ঙ্গ ঘরে তোমাকে থাকতে হবে। দিনের বেলা সেখানে লুকিয়ে থাকবে! রাত্রে বাইরে আসবে। সর্দারের কথার কখনও অবাধ্য হবে না। তারপর দেখছি দু’-চারদিন পরে তোমাকে নিয়ে কী করা যায়। তোমার দেখভাল তো আমাকেই করতে হবে।

কিন্তু আমাকে সেখানে একা রেখে তুমি যদি চলে যাও, আমি তো পাগল হয়ে যাব চম্পা।

তবু যেতে আমাকে হবেই।

না। তোমাকে আমি ছাড়ব না।

বোকামি কোরো না ছাড়ো।

এখন বেলা কত জানো? ওই দেখো বিকেল গড়িয়ে পড়ছে। আকাশের রং লাল। এই দূর বনপথে একা তুমি কী করে যাবে? ভেলুয়া সঙ্গে গেলেও অত বড় একটা পাহাড় তোমাকে ডিঙোতে হবে। জঙ্গলে যারা কাঠ কাটতে আসে তাদের ভয়, অন্ধকারে বাঘের ভয়, তা ছাড়া কত ভালুকও এখন রাতের আঁধারে ঝরনায় নদীতে জল খেতে আসবে। এইসব জেনেশুনে আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি? কাজেই তুমি যাচ্ছ না। আজও না। কালও না।

কিন্তু…।

কোনও কিন্তু নয়। তুমি এখন থেকে আমার কাছেই থাকবে। আমার কাজ শেষ হলেই এখান থেকে চলে যাব আমরা।

কোথায়?

আমাদের বাড়ি। যেখানে আমার মা আছেন, বাবা আছেন।

চম্পা সবিস্ময়ে বলল, কী বলছ তুমি দীপ? তুমি বড় রহস্যময় হয়ে উঠছ। এখানে তোমার কীসের কাজ? তা ছাড়া তুমি তো সবই ভুলে গেছ। কী করে নিয়ে যাবে আমাকে তোমার মা-বাবার কাছে?

দীপংকর চম্পার দুটি হাত মুঠোর মধ্যে ধরে সস্নেহে বলল, ওগো বনবালা আমি কিছুই ভুলিনি। আমার সব কিছুই মনে আছে। শুধু নিজেকে বাঁচাবার জন্য তোমাদের কাছে অভিনয় করেছিলাম এতক্ষণ। তোমার সরল অন্তঃকরণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি যখন বুঝলাম তুমি সত্যই আমার হিতৈষী তখন আর তোমার কাছে সত্য গোপন করে লাভ কী? আমার জেঠুর হত্যাকারীকে আমি খুঁজে বার করব, এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে এখানে এসেছি। না-হলে ঘাটশিলা থেকেই বিদায় নিতাম! তুমি আমাকে সাহায্য করবে চম্পা। কেন না আমার জেঠুর সঙ্গে তোমার পরিচয় ছিল। তুমি চরা গ্রাম চিনিয়ে আমাকে নিয়ে যাবে। সেখানে আমার জেঠুর বিশ্বস্ত ভৃত্য ইকলু আছে। আর ওই ভেলুয়া! ও তো আমার জেঠুরই পোষা কুকুর। আমি জেঠুর লেখা ডায়েরি পড়েছি। তাই তো জেনেছি আমার জেঠু প্রচুর সোনাদানা এই অরণ্যে পাহাড়ে কোথায় যেন লুকিয়ে রেখেছেন। সেগুলো খুঁজে বার করতে হবে। কাজেই এখন তুমি যাবে কি? তুমি আমার পাশে না থাকলে আমি যে কিছুই করতে পারব না।

দীপংকরের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল চম্পা। অবাক বিস্ময়ে বলল, দীপ তুমি এত বুদ্ধিমান? সত্যিই যদি তুমি আত্মবিস্মৃত হওয়ার এই অভিনয় না করতে, তা হলে খুবই বিপদে পড়ে যেতে। কালনেমি বা ময়নিহানই হয়তো শেষ করে ফেলত তোমাকে। না হলে তুলে দিত লালজির হাতে। লালজি ভারী নৃশংস লোক। ওর মনে কোনও মায়াদয়া নেই।

এখন বলো সব কথা আগে থেকে তোমাকে খুলে না বলে তোমাকে এবং ভেলুয়াকে নিয়ে এই দূর অঞ্চলে চলে এসে ভাল কাজ করেছি কি ন!? খুব ভাল কাজ করেছ দীপ। তোমার জেঠুকে আমিও জেঠু বলতাম। মানিকজেঠু। তিনি আমাকে মেয়ের মতো ভালবাসতেন। এই ভেলুয়া ছিল তাঁর প্রাণ। সেদিন যদি ভেলুয়া ওঁর কাছে থাকত তা হলে কখনওই দুর্বৃত্তরা ওঁকে হত্যা করতে পারত না। আমি মাঝেমধ্যে ওনার কাছে যেতাম। সেদিনও গিয়েছিলাম। আমার ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে উনি ভেলুয়াকে আমার সঙ্গে দিয়েছিলেন। ভেলুয়া সে রাতে আমার কাছেই ছিল। আর সেই সুযোগে ওরা শেষ করে দিল ওনাকে।

ওরা কারা?

কারা আবার! লালজির লোকেরা। এই অঞ্চলের অনেক গাঁওবালে তো লালজির লোক। আসলে তোমার জেঠু অনেক সোনা ওদের খপ্পর থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তো, তাই এত রাগ। এখানে রংকিনীর সেবাইত যে ভিলসর্দার আছে, সেও তোমার জেঠুরই লোক। তোমার জেঠুর জন্যেই এখানে গুপ্তকক্ষ তৈরি করা হয়েছিল। মানে উনি নিজেই করিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে থাকতেন সেখানে। তোমার জেঠুর সমাধিও দেখিয়ে আনব! আমি মাঝে মাঝে সেখানে ফুল দিয়ে আসি। তুমিও দেবে।

দীপংকর বিস্মিত হয়ে বলল, জেঠুর সমাধি? আমার জেঠুকে দাহ করা হয়নি? না। ওনার যেসব লোকেরা সোনা সংগ্রহের কাজ করত তাদের বেশিরভাগই ছিল খ্রিস্টান। তারা সবাই সিংভূমের আদিবাসী ‘হো’ হো?

হ্যাঁ। ‘হো’ মানে মানুষ। ওদের ধারণা ওরাই পৃথিবীতে প্রথম মানুষ জাতি। আমার জেঠুর চাকর ইকলুও তো হো ছিল।

এখনও আছে। সেও খ্রিস্টান। চলো না তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। দীপংকর বলল, তা হলে তুমি ঘরে ফিরছ না। এখন থেকে আমার কাছেই থাকছ। অতএব ভিলসর্দারের ওখানে আমরা দু’জনেই থেকে যাই এসো। চম্পা বলল, না। ভিলসর্দারের ওখানে আর আমাদের থাকবার কোনও প্রয়োজন নেই। ওদের সঙ্গে আর দেখা না-হওয়াটাই ভাল। কেন না তোমাকে রেখে দিয়ে চলে যেতাম সে কথা আলাদা। আমিও যদি থাকি তা হলে ধরা পড়ে যাবার ভয় আছে। কেন না আমার বাবুজি গালুডি থেকে ফিরে যখন আমাদের দু’জনকে দেখবেন না, তখন চারদিক তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকবেন। যদি এখানে এসে হাজির হন তা হলেই ধরা পড়ে যাব। উনি কিছুতেই তোমার সঙ্গে আমাকে চলে যেতে দেবেন না। আমাকে উনি দারুণ ভালবাসেন।

তা হলে বেলা থাকতে থাকতে চলো কোথাও কোনও গুহায় গিয়ে আশ্রয় নিই।

চলো।

চম্পা ডাকল, আয় ভেলুয়া। আ যা মেরা সাথ।

ভেলুয়া এতক্ষণ কাছে-পিঠেই ঘুর ঘুর করছিল। এবার চম্পার ডাকে লেজ নেড়ে নেড়ে ছুটে এল। তারপর এগিয়ে চলল ওরা দূরের পাহাড়ের দিকে।

দীপংকর বলল, চম্পা, তোমাকে আমার একটা কথা বলা হয়নি। তুমি তো এত কিছু জেনেছ, কিন্তু জান কি কেন আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি?

কেন?

আমি একজনকে খুন করেছি।

জানি।

অবশ্য খুন করব বলে নয়। দুটি মেয়ের ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে একজনকে অস্থানে মেরে বসি। আর সেই আঘাতেই সে মারা যায়। আমি তখন ভয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ি। ময়নিহান ও কালনেমি আমাকে তখনই লরি করে এখানে নিয়ে আসে। তারপর তো সবই জান। এখন প্রশ্ন হল এইভাবে কদ্দিন আমি লুকিয়ে বেড়াব? লোকালয়ে একদিন তো আমাকে যেতেই হবে। তখন? তখন তো হাতে হাতকড়া পড়বে আমার। তারপর জেল, হাজত, ফাঁসি কিংবা দ্বীপান্তর। তবে তোমার ভয় নেই চম্পা। তোমাকে আমি ঠিক আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসব।

চম্পা বলল, যদি তাই হয় তা হলে কী দরকার ফেরবার? এই অরণ্যেই দিন কাটিয়ে দেব আমরা। তোমার জেঠুর অনেক সোনা লুকনো আছে। তার কিছু আছে আমার জন্যে। সেগুলো আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। তাতেই আমাদের দিন চলে যাবে।

তোমার জন্য! আমার জেঠু তোমাকে দিয়ে গেছেন?

হ্যা। আমি বড় হলে আমার বিয়ের খরচের জন্য। আমার বাবুজিও তা জানেন না। আমি শুধু আমার অংশটার কথা জানি। বাকি কোথায় লুকনো আছে তা জানি না।

সেগুলোর জন্যই সম্ভবত জেঠু খুন হয়েছেন। কুন্দনলালজি আমাকে আটকে রেখে আমার বাবাকে মোচড় দিয়ে জানতে চাইবেন, সেগুলোর সন্ধান আমাদের জানা আছে কি না। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার বাপি এসবের কিছু জানেন না।

তবে দীপংকর, আমার মনে হয় ঝড়ি থেকে পালিয়ে এসে তুমি বোধহয় ভুলই করেছ।

ভুল করেছি।

হ্যাঁ। কেন না তুমি তো নির্দোষ। তুমি তো খুনি নও। তা ছাড়া এখনও নাবালক তুমি। দুটি মেয়ের ইজ্জত বাঁচাতে কাউকে আক্রমণ করতে গিয়ে যদি কোনও অঘটন ঘটে যায় তার জন্যে তো তুমি দায়ী নও। সেটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। ওই মেয়েদুটিও তো তোমার হয়ে সাক্ষী দিত। তারা যখন বলত তাদের জন্যই এ কাজ তুমি করেছ, তখনই তো সত্যাসত্য প্রমাণ হয়ে যেত।

তুমি ঠিক বলেছ চম্পা। এই কথাটা তো আমার একবারও মনে হয়নি। চলো আগে গুপ্তধনের ব্যবস্থা করি। লালজি শয়তানের বারোটা বাজাই। তারপর নিজেই গিয়ে ধরা দেব। দেখি কী হয়।

ওরা যখন চলা শুরু করল বেলা তখন গড়িয়ে আসছে। কাছে দূরের পাহাড়ে পাহাড়ে তখন অস্তরাগের সিঁদুর খেলা।

ওরা পায়ে পায়ে হাটের দিকে এগোল। ছদ্মবেশ ত্যাগ করে দীপংকরকে যেমন সুখী লাগছে, সুন্দরী চম্পাও তেমনি কলকে ফুলের মালা গলায় এই অরণ্যভূমে অপরূপা।

দীপংকর বলল, বড্ড খিদে লাগছে। চলো কোথাও কিছু খাওয়া যাক।

কী খাবে? পয়সা আছে তোমার কাছে? আমার তো কিচ্ছু নেই।

আছে। যা আছে তাতে দু’জনের হয়ে যাবে।

ওরা কথা বলতে বলতে হাটে এল। আদিবাসী হাট। বেতের জিনিস, কাঁচা তরিতরকারি, চুনো পুঁটি মাছ, শাড়িকাপড়, কাচের চুড়ি, খেলনা পুতুল সব কিছুই আছে। ওরই মধ্যে এক জায়গায় গরম জিলিপি ভাজছে একজন। আর একজন নিয়ে বসেছে মুড়ি আর তেলেভাজা।

ওরা দু’জনে একটি গাছতলায় বসে গরম জিপিলি খেল এক ঠোঙা করে। তারপর একটা নতুন গামছা কিনে তাইতে কিছু মুড়ি আর তেলেভাজা বেঁধে নিয়ে যাত্রা শুরু করল। একটা প্লাস্টিক বোতল চেয়ে নিল একজনের কাছ থেকে। তাই তে খানিক জল ভরে নিল। না হলে রাতবিরেতে জলতেষ্টা পেলে যাবে কোথায়? পথের সম্বল এটুকু থাক। সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই ওদের যে কোনও একটা আশ্রয়ে মাথা গুঁজতে হবে। না হলে এই বাঘ ভালুকের দেশে প্রাণট! খোয়াতে হবে বেঘোরেই।