গিরিগুহার গুপ্তধন – ৩

তিন

গ্রাম থেকে বের হয়ে উঁচুনিচু জমি পার হয়ে টিলা পাহাড়ের পরিবেশ ছেড়ে নদীর ঘাটে এসে পড়ল দীপংকর।

সুবর্ণরেখার মাঝি এখন অন্য লোক।

যাত্রী বোঝাই নৌকোটা ছাড়বার অপেক্ষায় ছিল। দীপংকর যেতেই ওকে তুলে নিয়ে তির তির করে ওপারের দিকে এগিয়ে চলল নৌকোটা। দু’ মিনিটও সময় লাগল না। নদীর গর্ভে একটি বড় পাথরের গায়ে এসে ঠেকল।

দীপংকর নৌকো থেকে নেমেই ঠিক করে নিল আর কোনও দিকে নয়, একেবারে সোজা গিয়ে উঠবে ঠাকুর সিং-এর ডেরায়। কেন না ওই গভীর অরণ্যে ও পর্বতে অভিযান চালাতে গেলে ঠাকুর সিং-এর আশ্রয়টাই ঠিক। ঠাকুর সিং-এর মন জুগিয়ে দু’-চারটে দিন থেকে বাসাডেরায় গিয়ে ইকলুর সঙ্গে দেখা করবে ও। তারপর ইকলুর মুখ থেকে সেদিনের ঘটনার কথা কিছু শুনে খোঁজখবর করবে ওর জেঠুর হত্যাকারীর। এবং যে মুহূর্তে ও সব জেনে ফেলবে সেই মুহূর্তে যেভাবেই হোক জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে গিয়েও আঘাত হানবে হত্যাকারীকে। অর্থাৎ বদলা ও নেবেই। এবং বদলা নেবার পর নিজেই গিয়ে ধরা দেবে পুলিশকে। তখন আর লুকিয়ে থাকবার কোনও দরকারই হবে না।

সুবর্ণরেখার পাড় থেকে উঠে এসে একটু উঁচুনিচু পথে চলার পর ঘাটশিলা শহরে ঢুকল।

দীপংকরের মনে হল এখান থেকেই ওকে আবার অভিনয় শুরু করতে হবে। অর্থাৎ কিনা ওকে দেখাতে হবে ও একজন স্মৃতিহারা কিশোর। দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পাবার পর থেকে ওর পূর্ব-স্মৃতি লোপ পেয়েছে। ওর কোনও নাম নেই, ঠিকানা নেই, এই ওর পরিচয়।

দীপংকর একবার ভাবল একটা দোকানে বসে ও আজকের কাগজটা দেখে। আজকের কাগজে নিশ্চয়ই ছবিসহ গতকালের খুনের ঘটনাটা ফলাও করে ছাপা হবে। আর তাই থেকেই জানতে পারবে ওকে গ্রেপ্তার করবার জন্য পুলিশ কীভাবে চারদিকে তোলপাড় করছে। কিন্তু মনে হলেও সাহস হল না! যদি ওই গুরুত্বপূর্ণ খবরটা দেখবার সময় কেউ ওকে চিনে ফেলে? তা হলে? তা হলে কী হবে?

না। তার চেয়ে ওসব কৌতূহল মনের মধ্যে চেপে রেখেই ঠাকুর সিং-এর ডেরায় চলে যাওয়া ভাল।

দীপংকর আর অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে ধীরে ধীরে পাহাড় ও জঙ্গলের পথ ধরল। দিনের আলো নিভে আসছে একটু একটু করে। পাখিরা কলরব করে ঘরে ফিরছে। হঠাৎই কেমন যেন বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল ওর। একটা চাপা কান্না যেন বুক থেকে হাহাকার করে বেরিয়ে আসতে চাইল। মা’র কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল বাবার কথা। মা-বাবাকে ছেড়ে ও যে কখনও একা থাকেনি। কোথাও যায়নি। ওর অভাবে ওর মা-বাবার অবস্থাই বা কেমন? দীপংকরকে না পেলে তাঁরা কি বাঁচবেন? ওর কত ইচ্ছে হল এখুনি বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু কী করে যাবে ও? যেতে পারলে মা-বাবাকে সব কথা খুলে বললে তাঁরা হয়তো সবই বুঝবেন। কিন্তু পুলিশ তো বুঝবে না। তারা ঠিক এসে ওকে ওর মায়ের বুক থেকে কেড়ে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরবে। তারপর…।

আরে! তুম আ গিয়া?

দীপংকর চেয়ে দেখল পশ্চিমদেশীয় একজন দেহাতি লোক, হাঁটুর ওপরে কাপড়পরা, ওর দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে ও চেনে না। বলল, কে তুমি? তুম ওহি লেড়কা যো নাম বতানে নেহি সতা? ক্যা নাম হ্যায় তুমহারা? জানি না।

সমঝ গিয়া। হাম তো তুমকো দিন ভর চুঁড়নে লাগা। ঠাকুর সিং নে ভেজা হামকো।

দীপংকর বলল, তুমি ঠাকুর সিং-এর লোক? ভালই হয়েছে জায়গাটা আমি ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। আমি ঠাকুর সিং-এর কাছেই যাচ্ছিলাম। চলো তোমার সঙ্গেই যাই।

দীপংকর লোকটির সঙ্গে কিছুটা পথ যেতেই চিনতে পারল সকালবেলার সেই জায়গাটিকে।

সন্ধ্যার অন্ধকার বিভীষিকার মতো ঢেকে গেছে চারদিকে। অরণ্যের জন্য অন্ধকার আরও ঘন। আরও জটিল।

ঠাকুর সিং-এর দোকানে টিম টিম করে আলো জ্বলছে।

ওকে দেখেই ঠাকুর সিং পরমাদরে ডাকল, আও মুন্নে। কাঁহা গয়ে থে? খানা পিনা কুছু হুয়া?

দীপংকর বলল, হ্যাঁ।

লেকিন ঠারনে কা জায়গা নেহি মিলা। এহি তো—

আমি আপনার এখানেই থাকব।

আভি তক্ কুছ ইয়াদ আয়া?

না। আমি কোনও কিচ্ছু মনে করতে পারছি না।

ঠাকুর সিং বলল, ঠিক হ্যায়! তুম হিয়া ঠার যাও। বলেই ডাকল, চম্পা! এ চম্পা! কিউ?

ও লেড়কা আ গয়া। উসকো লে কর ঘর চলা যা তু।

দীপংকর দেখল ছোট একটি লণ্ঠন হাতে নিয়ে দোকানের ভেতর থেকে এক কিশোরী বেরিয়ে এল। চম্পা তো চম্পা। যেন সত্যিকারের চাঁপাফুল একটি। নামের সঙ্গে রূপের এমন সামঞ্জস্য সচরাচর দেখা যায় না। কথায় বলে দুধে আলতায় গোলা রং। ঠিক তাই। চাঁপার পাপড়ির মতো। ওর কালো কালো ভাসা ভাসা চোখদুটো কই মাছের মতো ছটফট করছে যেন।

দীপংকরকে ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে ঠাকুর সিং বলল, আমার লেড়কি। যাও, উসিকি সাথ মেরা ঘর চলা যাও। হিয়া রহনা ঠিক নেহি।

চম্পা ওর দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, আও মেরা সাথ। কী চমৎকার ডাক। যেন কত পরিচিত। কত দিনের ভাব ভালবাসা। কত আপনজন।

দীপংকর চম্পার সঙ্গ নিল।

অন্ধকার বনপথে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ওরা। যেতে যেতে চম্পা বলল, ক্যা নাম তুমহারা।

জানি না।

আরে নাম ইয়াদ নেহি?

না।

চম্পা এবার থেমে দাঁড়াল একবার। তারপর ভাল করে দীপংকরকে দেখে বলল, বেচারা। পরে বলল, ঠিক আছে। হাম তুমহারা নয়া নাম দে দেগা।

বেশ তো দাও। কী নাম দেবে?

আমি তোমার নাম দেব বন্ধু।

এ কী! তুমি বাংলা বলছ?

আমি বাংলা বলতে পারি। থোড়া থোড়া।

থোড়া থোড়া কেন, বেশ ভালই তো বলছ তুমি।

আমি তোমার কাছে আরও ভাল বাংলা শিখে নেব।

সেই অন্ধকারে ওরা যে কোনদিকে যাচ্ছিল তার কিছুই বুঝতে পারছিল না দীপংকর। তবে আলো হাতে সম্পূর্ণ অজানা অচেনা এক দেশে চম্পার সঙ্গে পথ চলতে খুব ভাল লাগছিল ওর। কতই বা বয়স চম্পার? খুব জোর তেরো কি চোদ্দো। দীপংকরের সমবয়সি। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যে।

এক জায়গায় এসে থামল চম্পা। তারপর বলল,

মেরা হাত পাকড়িয়ে। দীপংকর বলল, আবার হিন্দি বলে ফেললে তো?

চম্পা হেসে বলল, স্যরি মিস্টার, স্যরি। আমার হাত ধরো।

দীপংকর বলল, বাঃ। তুমি ইংরেজিও জান দেখছি। এই বনবাসে থেকে এত স্মার্ট কী করে হলে তুমি?

তুমি কি মনে করো আমি একটা জংলি মেয়ে। জঙ্গলে থাকলেও পড়া-লিখা করি আমি। এই বছর আমি ক্লাস সেভেনে উঠেছি। তুমি?

দীপংকর চুপ করে রইল।

চম্পা করুণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কী, মনে করতে পারছ না? দীপংকর ঘাড় নাড়ল।

ঠিক আছে। দু’-চারদিন কে বাদ সব ইয়াদ আ যায় গা। এখন আমার হাতটা ধরে নেমে এসো একটু।

দীপংকর চম্পার হাত ধরে একটু গড়ানে জায়গা থেকে নেমে চলে এল। তারপর ওরা দু’জনে আর একটু পথ এক সঙ্গে চলে একটি ছোট কুটিরে এসে হাজির হল।

চম্পা বলল, হামারা মকান। তুমি হয়তো বড় লোকের ছেলে। পাক্কা মকানে থাক। গদি বিস্তারায় শোও। লেকিন হাম গরিব আদমি-

দীপংকর সঙ্গে সঙ্গে চম্পার মুখে হাত রাখল। বলল, আর একবার ওই কথা

বললে আমি কিন্তু রাগ করব খুব। চলে যাব এখান থেকে। গরিব আবার কী? চম্পা তেমনি মধুর করে হেসে বলল, তোমার কষ্ট হোবে না তো এখানে? দীপংকর বলল, হোবে নয়, হবে।

চম্পা ফিক করে হেসে বলল, কষ্ট হলই বা করব কী? আমাদের আর কিছু নেই।

তোমার মা নেই চম্পা?

না। বাবা ছাড়া আমার কেউ নেই।

তোমার বাবা খুব ভাল। উনি যদি আমাকে আশ্রয় না-দিতেন তো আমি কোথায় যেতাম বলো তো? তার চেয়েও বড় কথা সকালে এখান থেকে চলে গিয়ে আর যদি ফিরে না আসতাম, তা হলে তোমাকে পেতাম না। চম্পা, আমার বোন নেই। অথচ আমার বোনের খুব শখ। আমার একটি বোন থাকবে। সে আমাকে দাদা বলে ডাকবে। তুমি আমার সেই অপূর্ণ সাধ পূরণ করো চম্পা!

তবে যে তুমি বললে তুমি কিছু ইয়াদ করতে পারছ না? এই তো, এই তো ইয়াদ হচ্ছে তোমার।

আর একটু হলেই ধরা পড়ে গিয়েছিল আর কী। দীপংকর হঠাৎ দু’হাতে কপালটাকে টিপে ধরে বলল, না না না। কিছু মনে পড়ছে না আমার। সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। চম্পা! আমাকে ধরো। একটু জল দাও আমাকে। উঃ। কী দারুণ ঘুরছে মাথাটা।

চম্পা ওকে ধরে দাওয়ার ওপর বসিয়ে দিয়ে বলল, তুমকো কুছ ইয়াদ করনে নেহি হোগা। চুপচাপ বসো তুমি। ইয়াদ করতে গেলেই মাথার কষ্ট হবে। তবে আমার মনে হচ্ছে একটু একটু করে সবই মনে পড়বে তোমার। এই বলে এক গেলাস জল এনে দিল ওকে।

দীপংকর এক নিশ্বাসে জলটা খেয়ে নিল। আঃ। কী অপূর্ব স্বাদ এখানকার জলের।

চম্পা বলল, তুমি শোবে? যদি শুতে চাও তো বলো। দাওয়ায় চাটাই বিছিয়ে দিই। তারপর রাতের খানা বানাই।

দীপংকর বলল, না। এখনই শোব না। তুমি খাবার তৈরি করো। আমি তোমার সঙ্গে বসে বসে গল্প করি।

দীপংকর দাওয়ায় বসে ফুরফুরে হাওয়ায় দেহটাকে চাঙ্গা করে তুলল। কিন্তু ওর এখানে সবচেয়ে অসুবিধে যেটা হল সেটা হচ্ছে এই, পরে থাকা জামা আর প্যান্ট ছাড়া একটা কিছু তো নেই। টাকা-পয়সা বলতে ওর নিজের দু’ টাকা, এবং সকালে পাওয়া সেই দশটি টাকা আছে। এতে কী হবে? চম্পা যদি ছেলে হত তা হলে ওর কাছ থেকে একটা প্যান্টসার্ট চেয়ে নিয়ে পরতে পারত। কিন্তু ও তো মেয়ে।

দীপংকর বসে বসে চম্পার কাজ দেখতে লাগল। কত কম বয়স। অথচ কী কাজের। আসলে মা নেই তো। তাই সব কাজই ওকে করতে হয়।

একটু পরেই একটি আট-ন’ বছরের ছেলেকে একটা ঘটিতে করে দুধ নিয়ে আসতে দেখা গেল। ছেলেটি বাইরের গেটের কাছ থেকে ডাকল, চম্পাদিদি। আ যাও বাবুয়া।

দুধের ঘটিটা নিয়ে ছেলেটি ঢুকতেই ইয়া কেঁদো বাঘের মতো একটা কুকুরও এসে ঢুকল। কুকুরটা দীপংকরকে দেখেই চিৎকার করে উঠল, ভৌ-উ-উ-উ-উ। চম্পা বলল, চেল্লাও মাৎ। দেখা নেহি মেহমান আয়া। যাও, উধার যাও। খানা খালো!

বলতেই কুকুরটা সরে গেল একপাশে। তারপর একটি মাটির গামলায় রাখা এঁটো ভাত-ডাল ইত্যাদি খেতে লাগল।

ছেলেটি দুধের ঘটিটা দাওয়ায় রেখে চলে গেল আবার।

দীপংকর বলল, ছেলেটি কে গো?

বাবুয়া। উধারবালা গাঁও কা এক গোয়ালাকি লেড়কা। খুব ভাল ছেলে। এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চম্পা কিছু কাঠকুটো জোগাড় করে দাওয়ায় পাতা উনুনে কাঠের জ্বাল দিয়ে চায়ের জল বসাল। তুমি চা খাও?

দীপংকর বলল, হ্যাঁ খাই।

আমি চা না-খেয়ে একদম কাজ করতে পারি না।

চা তৈরি হলে, উনুনে ডাল বসিয়ে রুটির ময়দা মাখতে লাগল চম্পা। আর সেই কুকুরটা হঠাৎ ওপরে উঠে এসে দীপংকরের গায়ে গা ঠেকিয়ে শুয়ে লেজ নাড়তে লাগল।

দীপংকর চা খেতে খেতে বলল, তোমার মা কতদিন মারা গেছেন চম্পা? মালুম নেহি।

সে কী! তুমি তখন খুব ছোট বুঝি? মায়ের কথা মনে পড়ে না তোমার? মনে পড়ে লাভ কী বলো? ও জিন্দা তো নেহি হোগা।

তোমার বাবুজি কখন আসবেন?

বাবুজি? বাবুজি আসবেন কেন? দোকান ফেলে কী আসতে পারেন বাবুজি। তা হলে তুমি একা থাকবে?

চম্পা হেসে বলল, একা থাকব কেন? তুমি তো আছ।

সে না হয় আজ। কিন্তু এর আগে কী করে থাকতে? পরে কী করবে?

চম্পা মুখ তুলে দেখিয়ে দিল কুকুরটাকে। বলল, ও থাকত আমার কাছে। এখন তুমিও থাকবে। আমরা তিনজন হয়ে গেলাম। এখন থেকে তুমি, আমি আর ভেলুয়া।

ভেলুয়া!

হ্যা। কুকুরটার নাম। এক বাঙালিবাবুর কুকুর ছিল ও। কুকুরটা আমাকে খুব ভালবাসত। তা সেই বাঙালিবাবু মরে গেলে ও আমার কাছেই রয়ে গেল।

এই ঘন অন্ধকারে যেন একটা আলোর শিখা দেখতে পেল দীপংকর। এই ভেলুয়াকে দিয়েই কাজ হবে। চম্পাকে দিয়েও হবে। একটু একটু করে কুরে কুরে সব কিছু জেনে নেবে ও।

দীপংকর বলল, বাঙালিবাবু কী করে মরল? অসুখ করেছিল বুঝি? উঁহু। কুছ বুরা আদমি অচানক মার ডালা উনকো। সে কী! খুন !

চম্পা ঠোটে তর্জনী রেখে বলল, চুপ। অ্যায়শা বাত মাৎ বোল না।

দীপংকর চুপ করল।

রান্না শেষ করে দীপংকরকে খেতে দিল চম্পা। তারপর ভেলুয়াকে সঙ্গে নিয়ে ওর বাবার কাছে খাবার পৌঁছে দিতে চলে গেল। যাবার সময় দীপংকরকে বলে গেল ঘুম পেলে দাওয়াতেই শুয়ে পড়তে। দীপংকর ঘাড় নেড়ে ‘হ্যা’ বলল।

খুব ভোরে যখন ঘুম ভাঙল দীপংকরের, তখন পাখিদের কলরবে চারদিক মুখ হয়ে উঠেছে। মাটির ঘরের মাটির দাওয়ায় শুয়ে পাহাড় আর জঙ্গলের পরিবেশে ভোরের গন্ধ শুঁকে ওর মনে হল সারাজীবন ও এই অরণ্যেই কাটাবে। দরকার নেই শহরের ইট, চুন, সুড়কির বিলাসবাহুল্যে। এই মন ভরানো, প্রাণ মাতানো প্রকৃতির কোলে উদ্দাম শিশুর মতো ছুটোছুটি করবে। আজ ও বুঝতে পারল কেন ওর জেঠু অত টাকার মালিক হয়েও অমন সোনার সম্পদ মাটিতে পুঁতে রেখে চির বনবাস যাপন করতেন। টাটানগরের সাকচিতে মস্ত দোতলা হাঁকালেও জেঠুর প্রাণ ছিল এই পাহাড়, নদী, ঝরনা ও গভীর বন। না হলে ভোগবিলাসী মানুষ হলেও কিছুতেই উনি তাঁবু খাটিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতেন না।

দীপংকর ঘুম ভেঙে আড়মোড়া ভাঙতেই ওর মাথার নীচে বালিশ এবং গায়ে চাদর অনুভব করল। আসলে ও ঘুমিয়ে পড়বার পর, যখন বাবুজিকে খাবার দিয়ে ফিরে আসে চম্পা, তখনই এই ব্যবস্থা ও করে। কিন্তু কোথায় চম্পা! চম্পা কই? ঘরের দরজায় তো শিকল দেওয়া। তার মানে ঘরেই ছিল। বাইরে কোথাও যাবার আগে শিকল দিয়ে গেছে।

দীপংকর দাওয়া থেকে নেমে বাইরে এল। রাতের আঁধার সবে কেটেছে। এখানে চারদিকে শুধু টিলার পর টিলা আর কত মহুয়া গাছ। দীপংকর ধীরে ধীরে একটি টিলার কাছে এগিয়ে এল! কী নির্জন চারদিক। পাঁচ ছ’ ঘর মানুষের বসতি এখানে। তারপর শুধুই জঙ্গল। শুধুই পাহাড়। আহা! কী অপূর্ব পরিবেশ। দীপংকরের জীবনে এই প্রথম পাহাড় দেখা। এর আগে ছবিতেই যা পাহাড় দেখেছে। সেই পাহাড় এখন জীবন্ত।

দীপংকর ধীরে ধীরে একটি টিলার ওপর উঠল। টিলা মানে ন্যাড়াটিলা নয়। গাছ-গাছালিতে ভরতি। টিলার ওপরে উঠেই দেখল দূরে একটি ছোট ঝরনার পাশ দিয়ে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে চম্পা ঘরের দিকে আসছে। ওকে দেখে যেন বুকে বল এল দীপংকরের। সে দূর থেকেই ডাকল, চম্পা! এই চম্পাকলি! আমি যাব?

চম্পা থমকে দাঁড়িয়ে উত্তর দিল, কিউ?

তোমার কাঠের বোঝাটা আমি মাথায় নিয়ে আসব?

চম্পা দূর থেকেই বলল, নেহি। তুম নেহি সকোগে। তুমি পারবে না। আমাদের ঘাড় শক্ত। তুমি এখনও কচি নরম আছ। বাচ্চা ছেলে।

দীপংকর তখন দ্রুত পায়ে ছুটে টিলার ওপর থেকে নামতে লাগল নীচে। তাই দেখে চিৎকার করতে লাগল চম্পা, রুখ যাও। রুখ যাও। এ কী করছ। থামো! দীপংকর থেমে পড়ল।

চম্পা বলল, এইবার আস্তে আস্তে নেমে এসো। পাহাড় থেকে, টিলা থেকে বা কোনও গড়ানো জায়গা থেকে কখনও অমন ছুটে নামতে যাবে না। তা হলেই পড়বে।

দীপংকর চম্পার কথা মতো তাই করল। তারপর টিলা থেকে নেমে যখন ওর কাছে গেল তখন কী আনন্দ দু’জনের।

চম্পা বলল, আমাকে ঘরে না দেখে তুমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলে না?

খুব ভয় করছিল আমার!

কেন, ভয় করছিল কেন? তুমি না ব্যাটাছেলে?

বাঃ রে। আমি তোমাদের অতিথি। এখানে তুমি ছাড়া আমার আপনজন কেউ নেই। আমি কোথা থেকে এসেছি, আমি কে, কিছুই আমার মনে নেই। কাজেই ভয় করবে না? তোমাকে হারালে এই বনে-জঙ্গলে আমি কোথায় যাব? কার কাছে থাকব?

চম্পা ওর উজ্জ্বল ঝকঝকে দাঁতের সারিতে ঝিলিক দিয়ে হাসল এবার। তারপর বলল, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। এই ডাকাতের আস্তানায়—। বলেই থেমে গেল চম্পা।

দীপংকর অভিনয় করে বলল, ডাকাতের আস্তানা? ডাকাত কী গো চম্পা? ডাকাত কাকে বলে?

সে তুমি বুঝবে না। বোঝবার চেষ্টা করো না। যাক। মুখহাত ধুয়েছ? না।

চলো ঝরনার কাছে। মুখ ধোবে। এখানেই আমি সব কিছু করি। বেলায় এখানে আমরা দু’জনে এসে চান করব।

দীপংকর একটা আশ শ্যাওড়ার ডাল ভেঙে দাঁতন করতে করতে চলল। চম্পা ওর মাথার কাঠের বোঝাটা মাটিতে নামিয়ে দীপংকরের হাত ধরে উঁচুনিচু পাথরে পা রেখে ঝরনার কাছে এগিয়ে গেল। পাহাড়িয়া ঝরনা ঝিরিঝিরি বইছে। কী স্নিগ্ধ শীতল জল।

দীপংকর সেই ঝরনার জলে বেশটি করে মুখ ধুয়ে কুলকুচি করে নিল। চম্পা বলল, চলো। ঘরে চলো। তোমাকে কিছু খেতে দিই গে। বাবুজির দোকান থেকে মুড়ি আর পিঁয়াজি আনতে হবে। চা খাবে তো? দীপংকর বলল, হ্যাঁ। আমার মা রোজ সকালে আমাকে চা করে খাওয়াতেন। এখন তুমি খাওয়াও।

তোমার মায়ের কথা মনে পড়ছে এবার?

উঁহু। শুধু চা খেতাম, রুটি খেতাম, ভাত খেতাম এই সব মনে পড়ছে। এ ছাড়া আর কিচ্ছু না।

চম্পা বলল, জানো, তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে তুমি এক ভিনদেশি রাজপুত্তুর। আমাকে পাতালপুরী থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে বলে এসেছ।

আমারও কী মনে হচ্ছে জানো, তুমি এক বন্দিনী রাজকন্যা। আমি যুদ্ধ করে তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। তবে পাতালপুরী থেকে নয়। দুর্গম গিরিকাস্তার থেকে।

চম্পা হোঃ হোঃ করে হেসে গড়িয়ে পড়ল। সেই হাসিতে দীপংকরও যোগ দিল।

এমন সময় দূর থেকে ঠাকুর সিংকে আসতে দেখা গেল সেখানে।

চম্পা তাড়াতাড়ি কাঠের বোঝাটা মাথায় তুলে নিয়ে বলল, বাবুজি আরহা হ্যায়।

ঠাকুর সিং কাছে এসে বলল, আরে চম্পা! তু হিয়া ক্যা করতে হো?

জঙ্গলমে গিয়া থা বাবুজি ! লকড়ি লেনে কে লিয়ে।

ঠাকুর সিং এবার দীপংকরকে সস্নেহে বলল, হিয়া কুছ তকলিফ নেহি হোতি

তো বেটা? হামারা চম্পা বিটিয়াক৷ সাথ রহো। আপনা বহিন সমঝো। উঁ? হামকো গ্যালুডি যা না হ্যায়। সামকো আপস আউঙ্গা।

দীপংকর বলল, আপনি নিশ্চিন্তে যান বাবুজি।

ক্যা কহা তুমনে? বাবুজি?

হ্যাঁ। আপনি চম্পারও বাবুজি। আমারও। তা আপনি যেখানে যাচ্ছেন সেখান থেকে আমার জন্যে একটা প্যান্ট আর গেঞ্জি নিয়ে আসবেন? কেন না এই যা পরে আছি এর বেশি আমার কিছু নেই।

ঠাকুর সিং বলল, জরুর লে শোয়েঙ্গে।

চম্পা বলল, বাবুজি আমার জন্যে কাচের চুড়ি আর রঙিন ফিতে আনবে কেমন?

ঠাকুর সিং ‘আচ্ছা, সব কুছ লেকে আয়েঙ্গে হাম’ বলে চলে গেল।

দীপংকর আর চম্পা অনেকক্ষণ ধরে ঠাকুর সিং-এর চলে যাওয়া দেখল। তারপর দু’জনে গুন গুন ভোমরার মতো গান গাইতে গাইতে ফিরে এল ওদের  পর্ণকুটিরে। কুটির অবশ্য ফাঁকা ছিল না। দাওয়ার ওপর থাবা গেড়ে বাঘের মতো বসেছিল ভেলুয়া। ওরা যেতেই দাওয়া থেকে নেমে এসে ওদের পায়ের কছে শুয়ে কুঁই কুঁই করে গড়াগড়ি খেতে লাগল।