গিরিগুহার গুপ্তধন – ২

দুই

ট্রাক প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলেছে। কখনও উঁচুতে কখনও ঢালু পথে। মাঝে মাঝে বড় বড় গাছের ডালপালা ট্রাকের মাথা ছুঁয়ে যাচ্ছে। সর সর করে আওয়াজ হচ্ছে।

দীপংকর ধীরে ধীরে মাথাটা তুলে বসল। নাঃ, মাথাটা ঠিকই আছে। শুধু সর্বাঙ্গে ব্যথা। উঠে বসতেই অবাক হয়ে গেল। এ কোথায় এসেছে ও! কী বিশাল বনভূমি। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। ওদের ট্রাকটা সেই পাহাড়ের ওপর দিয়ে পাকদণ্ডি পথ বেয়ে চলেছে। কিন্তু পাহাড়ের ওপরও এত জোরে ছুটছে কেন ট্রাক?

এইভাবে আরও কিছুক্ষণ যাবার পর একসময় ট্রাকটা এক জায়গায় এসে থামল।

লুঙ্গিপরা দু’জন লোক এসে উঁকি মেরে দেখল ওকে। তারপর বলল, আরে তুমি বসে আছ? আমরা তো ভাবলাম মরেই গেছ তুমি।

দীপংকর লোকদুটোকে ভাল করে দেখে বুঝল বর্ন ক্রিমিন্যাল বলতে যা বোঝায়, এরা ঠিক তাই। কিন্তু এরা কারা? ওকে ট্রাকে করে এখানে নিয়ে এল কেন? কী ওদের অভিপ্রায়?

দীপংকর বলল, আমি কোথায়?

তুমি এখন কলকাতা থেকে অনেক দূরে। তা কাল হঠাৎ কী হয়েছিল? পকেট মেরেছিলে কারও? না হলে, সন্ধেরাতে অমন করে ছুটছিলে কেন? সময়মতো ব্রেক না কষলে যে গাড়ির চাকায় চেপটে যেতে বাবা। অযথা আমরা খুনের দায়ে দায়ী হতাম। আমি বাইশ বছর স্টিয়ারিং ধরছি, এখনও পর্যন্ত চাপা দিইনি কাউকে। শুধু তুমিই আমার বদনাম করে দিচ্ছিলে। বেশ ছেলে যা হোক।

দীপংকর ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল লোকটির মুখের দিকে।

আর একজন বলল, চেয়ে দেখছ কী? এবার নেমে পড়ো। এখানে ঝরনার জলে মুখহাত ধুয়ে যা হোক কিছু খেয়ে নাও। আমরা তো ভেবেছিলাম লরির ধাক্কায় শেষই হয়ে গেছ। ওই জন্যে তুলে নিয়ে চলে এলাম। ভেবেছিলাম ডেড বডিটা পাহাড়ের জঙ্গলে যেখানে হোক ছুড়ে ফেলে দেব। তা যখন বেঁচেই গেছ তখন এসো। এসে কিছু মুখে দাও।

ওরা দীপংকরকে ট্রাক থেকে নেমে আসতে সাহায্য করল।

একজন বলল, তোমার নাম কী?

দীপংকর বলল, নাম কী? কী জানি। নাম কী আবার?

সে কী! নাম কী জান না? রাম, শ্যাম, যদু, মধু – এই হচ্ছে নাম। যেমন আমার নাম কালনেমি, ওর নাম ময়নিহান। তেমনি তোমার নাম? আমার কোনও নাম নেই।

ময়নিহান হাঃ হাঃ করে হেসে বলল, বল না ব্যাটা তোর নাম রাজকাপুর। কালনেমি বলল, সত্যিই তোর কোনও নাম নেই? নাকি নকশা করছিস? সত্যি বলছি আমার কোনও নাম নেই।

তোর বাবার নাম? বাবার নাম খগেন, না অন্য কিছু? মনে পড়ছে? কে আমার বাবা?

আরে যে তোকে জন্ম দিয়েছে। তোর মা আছে? না কি মাও নেই। বল এবার আপনা থেকে কুমড়োর মতো খেত-এ গজিয়েছিস?

দীপংকর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আমার কিছু মনে নেই। আমি কিছু মনে করতে পারছি না। তোমরা আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না।

কালনেমি বলল, হুঁ। বুঝেছি। কাল রাতের কথা তোর কিছু মনে পড়ে? না আমার কিছু মনে পড়ছে না। কিছু মনে নেই আমার। আমি কোথায় ছিলাম, আমার কে কে ছিল, কিছুই মনে নেই।

অ। তা এবার একটু মনে কর দিকিনি এই ট্রাকে তুই এলি কী করে? মনে কর। তাও মনে নেই।

সে কী রে! আমরা কে বল তো?

জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না।

কালনেমি আর ময়নিহান একটু সরে গিয়ে বলাবলি করতে লাগল, মনে হচ্ছে ছেলেটার স্মৃতি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। ওর তো কারও কথাই মনে নেই।

ময়নিহান বলল, বাঁচা গেছে। আমাদের ট্রাকেই যে ও ধাক্কা খেয়েছে এটা তা

হলে ও জানবে না। ও শুধু আমাদের দু’জনকে ওর উদ্ধারকারী বলেই ভাববে। ভুল হল। যেখানকার জিনিস সেখানে ফেলে রেখে এলেই হত। কোনও ঝামেলাই থাকত না তা হলে।

ঝামেলা থাকত না মানে? রাস্তায় এ অবস্থায় ছেলেটাকে ফেলে রাখলে দারুণ হইচই হত। কাছেপিঠে কোনও পুলিশের গাড়ি থাকলে তাড়া লাগাত আমাদের। এখন তা হলে কী করবি ছেলেটাকে নিয়ে?

কী আবার করব? কাছাকাছি কোথাও লোকালয় দেখে ছেড়ে দেব। না হলে কে হুজ্জোতি পোহাবে? ওর বাবা-মা কি এতক্ষণে থানা-পুলিশ করেনি ভেবেছিস? চারদিকে খবর চলে গেছে হয়তো।

দীপংকর তখন পাশেই একটি ঝরনার জলে গিয়ে মুখহাত ধুয়ে নিল।

এইখানে এক জায়গায় পাহাড়ের কোলে ঘন জঙ্গলের ধারে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান ছিল! ছিটে বেড়ার ঘর। দোকানে নেড়ো বিস্কুট, আর চা ছাড়া কিছুই নেই। মুড়ি হয়তো আছে। দোকানের লোকটি বেসন ফ্যানাচ্ছে, গরম কিছু ভাজি তৈরি করবার জন্য।

কালনেমি আর ময়নিহান কাঁধে গামছা নিয়ে জঙ্গলে চলে গেল। দোকানিকে বলে গেল দীপংকরের দিকে নজর রাখতে এবং একটু কিছু দিতে।

দীপংকর চা-দোকানের বেঞ্চিতে বসে এদিক ওদিক চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। কী সুন্দর সকাল। বুনো গাছ-গাছালির সবুজ পাতার কী চমৎকার গন্ধ। আর কত যে পাখি ডাকছে গাছে। ওটা কী পাখি, ঠিক টিয়ার মতো দেখতে, লম্বা লেজ আর ঘন নীল গায়ের রং। মাথার কাছটা বাদামি।

দোকানদার বলল, কী খোকাবাবু। মুলুক কাঁহা? কাঁহা সে ভাগাকে লে আয়া এ লোক?

দীপংকর বলল, জানি না। আমার কিচ্ছু মনে নেই। আমি কিছু মনে করতে পারছি না।

এ কেয়া বাত! কুছ ইয়াদ নেহি?

না। আমার বাবা-মা কাউকে মনে পড়ছে না। কোথায় ছিলাম তাও মনে নেই। হুঁ। তো এ দোনো বদমাশ কো কাঁহা মিলা?

তাও মনে নেই।

কুছ ইয়াদ নেহি আয়েগা তো ক্যা কিয়েগা? ক্যায়সে ঘর যাওগে তুম?

দীপংকর বলল, আমার খুব খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দেবে? হাঁ হাঁ জরুর দেগা। বইঠো। চা পিয়োগে?

হ্যাঁ।

লোকটি তাড়াতাড়ি টিনের বাক্স থেকে মুড়ি বার করে, একটু চানাচুর মিশিয়ে ওকে খেতে দিল। ততক্ষণে পিঁয়াজি ভাজা শুরু হয়ে গেছে। পিঁয়াজি ভাজা হলে

তাও দিল শালপাতার ঠোঙায় করে।

দীপংকর খেতে খেতে বলল, আচ্ছা আমি এখন কোথায়?

তুমি এখন ছোটনাগপুরের জঙ্গলে।

ছোটনাগপুর! সেটা কোথায়?

সেটা এইখানে। তুম পড়িলিখি লেড়কা। ছোটনাগপুর মালুম নেহি? সিংভূম জিলা। ঘাটশিলা হিয়াসে দু’ মিল।

ঘাটশিলা দু’ মাইল!

হাঁ।

এমন সময় কালনেমি আর ময়নিহান ফিরে এল। এসে বলল, কীরে ছেলে, ঘরবাড়ির কথা কিছু মনে পড়ছে?

না।

তোকে আমাদের ট্রাকে কে উঠিয়েছিল?

বলছি তো আমার কিচ্ছু মনে নেই।

ঠিক আছে। ওসব কথা মনে না-থাকাই ভাল। তা এখন কী করবি ঠিক করেছিস? আমরা তোকে এইখানেই ছেড়ে দেব। দিনের আলোয় তোকে নিয়ে যাবার দায়িত্ব নেব না আমরা।

আমি তোমাদের সঙ্গে যাব।

আমাদের সঙ্গে তো অনেকদূর এসেছ বাবা। এবার এখানেই থেমে থাকো, আর বেশি এগিয়ো না। আমরা ভাল লোক নই। বুঝলে?

দীপংকর চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বলল, কে বলে তোমরা ভাল লোক নও? তোমরা খারাপ লোক হলে তো আমাকে মেরেই ফেলতে!

ময়নিহান বলল, অ্যা-অ্যা-অ্যাই দেখো। এসব কী উলটোপালটা বলে রে পাখি। ওরে আমরা হলুম জেল-ভাঙা কয়েদি। আমাদের কাজ হল লুটমার করা, মানুষের বুকে ছুরি মারা, আর চোরাই মাল পাচার করা। এখন আমরা অনেক দূর র্যাব। চক্রধরপুর থেকে মাল নিয়ে চাঁইবাসা। তারপর সেখান থেকে চলে যাব রাঁচিতে।

বলো কী! আবার কবে ফিরবে?

আমাদের ফেরার কোনও দিনক্ষণ নেই। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে যদি ধরা না-পড়ি তা হলে তিনদিন পর। আর ধরা পড়লে দশ বছর জেলের ঘানি টেনে তারপর।

দোকানদার কালনেমি ও ময়নিহানকে গরম গরম পিঁয়াজি দিয়ে চায়ের ভাঁড় এগিয়ে দিল।

ময়নিহান বলল, ঠাকুর সিং?

দোকানদার বলল, বোলিয়ে।

ছেলেটাকে রাখবে তোমার কাছে?

জরুর। লেকিন কুছ ঝামেলা হো যায়েগা তো?

কুছ নেহি হোগা বাবা। কিছু হলে ব্লবে কোথা থেকে কীভাবে এসেছে তুমি কিছুই জান না। তুমি শুধু ওর আশ্রয়দাদা।

কালনেমি ও ময়নিহান চা খেয়ে গাড়িতে উঠে বসল। তারপর গাড়ি স্টার্ট করার আগে দশটা টাকা বার করে দীপংকরের হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখো তোমার কাছে। কিছু কিনে খাবে। সব যখন ভুলে মেরে দিয়েছ তখন তোমার দুর্গতি দূর করে কে? ছিলে আদরের দুলাল। এখন রাস্তায় ঘুরে ভিক্ষে করো। বলে চলে গেল ওরা।

দীপংকরের ইচ্ছে ছিল না টাকা নেবার। তবু ও নিল, না-নিলে চলবে কেন? ওর পকেটে তো মাত্র দুটো টাকা পড়ে আছে। এতে কী হবে? কাল রাত থেকে খাওয়া নেই। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে একেবারে। এখন দু’মাইল হেঁটে ঘাটশিলায় পৌঁছোতে পারলে নিশ্চয়ই কোনও খাবার হোটেল পাওয়া যাবে। ওকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ঠাকুর সিং বলল, আভি তুম ক্যা করোগে কুছ সোচা? কী

আর করব?

যাও দিন ভর ঘুমো। লেকিন স্যামকো হিয়া চলি আনা, সমঝা?

দীপংকর বলল, হ্যাঁ। তা আমি একবার ঘাটশিলায় যেতে চাই। কোনদিক দিয়ে যাব?

ইয়ে রাস্তা চলা গিয়া।

দীপংকর বলল, ঠিক আছে ঠাকুর সিং। আমি যাচ্ছি। সন্ধেবেলা যদি কোথাও থাকার জায়গা না পাই তো, আপনার এখানেই চলে আসব।

এমন সময় হঠাৎ একটা মারুতি গাড়ি উলটো দিক থেকে এসে ব্রেক কষল দোকানের সামনে। ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক মুখ বাড়িয়ে বললেন, কুছ খবর আয়া ঠাকুর সাব?

নেহি আয়া।

গাড়িটা স্টার্ট দিতে যাবে এমন সময় ঠাকুর সিং বলল, এ লেড়কা কো ঘাটশিলা পর ছোড় দেনা লালব্জি, থোড়া সা মেহেরবানি।

আরে মেহেরবানিকা কোই বাত নেহি। আও বাচ্চে।

দীপংকর বেশ প্রফুল্ল চিত্তে মারুতির ভেতরে ঢুকে বসল। ঠাকুর সিং হাত নেড়ে বিদায় জানাল দীপংকরকে।

মিনিট দশেকেরও কম সময়ের মধ্যে মারুতি গাড়িখানা ঘাটশিলায় এসে পৌঁছল। একেবারে স্টেশনের সামনে নামিয়ে দিয়ে আবার হুশ করে চলে গেল মোটরখানা।

দীপংকর প্রথমেই একটা বাঙালির খাবারের দোকানে গিয়ে ঢুকল। এখানে নিশ্চয়ই খবরের কাগজ থাকবে। আর সেই খবরের কাগজের প্রথম পাতাতে নিশ্চয়ই থাকবে গত সন্ধ্যার ওর ওই কু-কীর্তির কথা।

কিন্তু যা ভাবল তা হল না। পেট ভরে কচুরি-মিষ্টি খেয়ে যখন খবরের কাগজের পাতায় চোখ বোলাল, তখন দেখল এর সবক’টি খবরই ওর পড়া। অর্থাৎ এ কাগজ কালকের। আজকের কাগজ আসতে সেই বেলা দশটা। হাওড়া থেকে ইস্পাত এক্সেপ্রেস এসে না-পৌঁছুনো পর্যন্ত কাগজ পাওয়া যাবে না।

যাক এখনও কিছু সময়ের জন্য নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। কেন না ওর ওই হত্যাকাণ্ডের কথা এখানকার লোকদের জেনে ফেলার এখনও অনেক দেরি আছে।

খুব চালাকি করে হাবাগোবা সেজে অভিনয় করে পার পেয়েছে ও কালনেমি আর ময়নিহানের হাত থেকে। এমনকী ঠাকুর সিংকেও জানতে দেয়নি ওর আসল পরিচয়। কী দরকার। অচেনা পরিবেশে ছদ্মবেশই ভাল। না হলে কে কখন গিয়ে টুক করে পুলিশের কানে খবরটা তুলে দেয় তার ঠিক কী? এখন সমস্যা যেটা দাঁড়াল সেটা হল ও তো এখানে মানিলেস। সামান্য এই ক’টা টাকায় ও কী করবে। এ যা টাকা এতে ওর একটা দিন চলবে খুব জোর, কিন্তু তারপর? তারপর কোথা যাবে? কী খাবে? কী করবে? ভেবে ভেবে কোনও কূলকিনারাই পেল না ও। পুলিশের ভয়ে একবস্ত্রে পালিয়ে এসেছে।

যাই হোক। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে একটা নদী দেখতে পেল ও। কী চমৎকার সব পাথর, যেন বাসুকি নাগের মতো ফণা উঁচিয়ে আছে নদীর গর্ভে। এমন ও কখনও দেখেনি। কাচের মতো স্বচ্ছ নদীর জলধারা। বালিতে অভ্ররেণু চিকচিক করছে। একজনকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, এই নদীর নাম সুবর্ণরেখা। ছোটনাগপুরের পাহাড়মালা থেকে উৎপন্ন হয়েছে এই নদী। এই নদীর বালিতে সোনার রেণু আছে।

হঠাৎ ও দেখল দু’জন লোক ছোট কুলোয় করে বালি ছেঁকে হেঁকে কী যেন তুলছে।

ও কাছে গিয়ে বলল, বালিতে তোমরা কী খুঁজছ গো?

আমরা সোনা খুঁজছি।

সোনা খুঁজছ!

হ্যা গো। আমরা হলুম সোনাখোঁচা। এই থেকেই হেঁকেছুকে আমরা সোনার রেণু বার করব। তারপর সেগুলো জমিয়ে বিক্রি করব বাজারে।

দীপংকর বলল, সব নদীতেই কি সোনা পাওয়া যায়? আমাদের দেশেও তো নদী আছে। কই সেখানে তো কেউ সোনা খোঁজে না।

একজন হেসে বলল, সব নদীতে যে সোনা মেলে না বাবা। এ যে সোনার নদী। তাই এখানে মেলে।

দীপংকরের বুকের ভেতরটা যেন কীরকম করে উঠল। বলল, সোনার নদী! এই তা হলে সেই কল্পনার সোনার নদী। অর্থাৎ যে নদীতে সোনা পাওয়া যায়? হ্যাঁ গোঁ হ্যাঁ। সোনার নদী সুবর্ণরেখা।

দীপংকর অবাক হয়ে গেল। ওর জেঠু তা হলে মিথ্যে কিছু লেখেননি। বাড়িয়েও কিছু না। সোনার নদী তা হলে সত্যিই আছে।

লোকটি বলল, কী নাম তোমার খোকাবাবু?

আমার নাম? আমার নাম সোনাচাঁদ।

সুনাচাঁদ ? বাঃ বেশ নাম তো?

তোমার নাম কী?

আমার নাম হাঁসুলি।

কোথায় ঘর তোমার?

আমার ঘর নদীর ওপারে! ওই যে দেখছ পাহাড়ের কোলে জঙ্গলের ভেতরে ছোট্ট গ্রামখানা ওই গ্রামেই আমার বাড়ি।

আমাকে নিয়ে যাবে তোমার বাড়িতে?

কেন গো বাবু? আমার বাড়ি গিয়ে কী করবে

থাকি। তোমাকে বসতে দেব কোথায়?

গরিব লোক আমি। মাটির ঘরে

যেখানে হোক দিয়ো। তবু আমি তোমার সঙ্গে যাব।

তোমার মা-বাবা বকবেন না?

তাঁরা কেউ নেই এখানে। আমি একা।

সে কী! বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ নাকি তুমি?

দীপংকরের চোখদুটো ছলছলিয়ে উঠল একবার। বলল, হ্যাঁ। পালিয়েই এসেছি।

কেন পরীক্ষায় পাস করতে পারনি?

তা নয়, আসলে আমার সৎ মা তো। মারধোর করেন খুব।

তা বেশ করেছ। সৎ মায়ের মার খাওয়ার চেয়ে ঘর থেকে পালিয়ে আসা বরং ভাল। জীবনে দাঁড়াতে পারবে। বাড়ি কোথায় তোমার? বর্ধমানে।

বর্ধমানের কোন জায়গায়?

বসিরহাটে।

বসিরহাটে? বর্ধমানে আবার বসিরহাট কোথায় পেলে গো? বসিরহাট তো চব্বিশ পরগনায়।

আছে আছে। বর্ধমানেও আছে। যেমন ধর্মতলা কি শুধু কলকাতায়? ধর্মতলা সব জায়গাতেই আছে।

লোকটি বলল, তুমি তা হলে সত্যিই আমার বাড়িতে যাবে খোকাবাবু? হ্যাঁ যাব।

চলো তবে।

কী বিচ্ছিরি কালো ভূতের মতো চেহারা লোকটার। অথচ কী চমৎকার কথাবার্তা। একটা যাত্রীবাহী নৌকোয় দীপংকরকে উঠিয়ে নিজে ছাঁকনি জাল আর মাটির হাঁড়ি নিয়ে অদ্ভুত কায়দায় সাঁতার কেটে ওপারে গিয়ে উঠল। এ নদীতে জল খুব কম। কোথাও এক হাঁটু, কোথাও এক কোমর, কোথাও বা এক বুক জল। …তার বেশি নেই। তবুও পারাপারের জন্য নৌকা বাওয়া।

নৌকা ওপারে ভিড়তেই মাঝির হাতে দশটা পয়সা দিয়ে দিল দীপংকর।.

লোকটি সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে উঠল, না না। পয়সা দিয়ো না। এ নৌকা আমার, আর ওই মাঝি আমার ছেলে।

দীপংকর অবাক। এই বাপ আর ওই ছেল! ছেলের হাতে দামি রিস্টওয়াচ। নৌকার খোলের মধ্যে ট্রানজিস্টার বাজছে। টেরিকটের পায়াগুটোনো প্যান্ট পরে আছে। আর পরে আছে নাইলনের গেঞ্জি। বেশ নধর গড়নের সুঠাম দেহ। কত তফাত।

ওপারে নেমে বড় বড় ঘাসের বন, নল খাগড়া, কাশ ইত্যাদি ঠেলে উঁচু ডাঙায় উঠল ওরা। পাহাড়ি গাছপালা, বুড়ো মহুয়া, বেঁটে পলাশ সবই আছে ওখানে। ছোট ছোট টিলা দু’–একটা পেরিয়ে একটি ছোট্ট গ্রামে গিয়ে ওরা পৌঁছুল। গ্রামটি আদিবাসীপ্রধান। নিকানো মুছানো একটি উঠোনে দাঁড়িয়ে এক বুড়ি অপলকে তাকিয়ে রইল দীপংকরের দিকে। মাঠের রাখালরা লাঠির ওপর ভর দিয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল। চাইবে নাই বা কেন? ওই কালো কুচ্ছিত সোনাখোঁচাটার সঙ্গে এমন টুকটুকেপানা ছেলেকে দেখলে বিস্ময় না-হবেই বা কার? শুধু মানুষ কেন, গোরুগুলো পর্যন্ত এই পাথর কাঁকরের দেশে খুঁজে পেতে যে দু’-এক কল ঘাস মুখে পুরেছিল, তারাও এই অচেনা কিশোরকে দেখে ঘাস চিবোতে ভুলে গেল যেন। মুখের ঘাস মুখেই রইল তাদের।

দীপংকর যে সোনাখোঁচাটার সঙ্গে গিয়েছিল, আগেই বলেছি তার নাম হাঁসুলি। রাঙা মাটির নিকোনো মুছানো উঠোনের এক প্রান্তে খড়ের ছাউনি দেওয়া হাঁসুলির ঘর।

হাঁসুলির বউ দাওয়ায় বসে রান্না করছিল। অবাক হয়ে বলল, ই ছেইলেটো কে বটেক?

হাঁসুলি বলল, একটা ছেইলে বটেক। বাপ-মায়ের ওপর রাগ করে পালিয়ে এসেছে। দুটি ভাত খাবে। দু’-একদিন থাকবে। তারপর চলে যাবে। হাঁসুলির বউ বলল, কী নাম গো তোমার?

আমার নাম সোনাচাঁদ।

তা সুনাচাদের মতোই দেখতে বটে। বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ? মা-বাবা কাঁদবে না?

দীপংকর বলল, না! আমার তো সৎ মা। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে।

ও বুঝেছি। তা দেখো আমাদের এখানে দু’দিন থেকে। থাকতে পারো কি না। দীপংকর বলল, হ্যাঁ পারব।

হাঁসুলির বউ তখনই ওকে মুখহাত ধোবার জল দিল। তারপর মুড়ি আর পিঁয়াজকুঁচো একটা বাটিতে করে খেতে দিল।

দীপংকর সেই খেয়ে, এক গেলাস জল খেতেই তৃপ্তিতে ভরে উঠল ও। কী সুন্দর জলের স্বাদ এখানকার ! এমন জল তো হাওড়ায় নেই।

দীপংকর দেখল হাঁসুলি যে সোনামাখা বালি কুড়িয়ে এনেছিল সেগুলি খুব যত্ন করে একটি বাঁশের চোঙায় ভরে দেওয়ালের পেরেকে ঝুলিয়ে রাখল। হাঁসুলির বউ বলল, তা সুনাচাঁদ। তোমরা কী জাত গো বাবা? আমরা বামুন।

ও মা গো। তা আমাদের রাঁধা ভাত তুমি খাবে?

কেন খাব না?

আমরা যে জাতিতে ঝোরা। ওই ও বাড়ির ওরা হচ্ছে গণ্ড। আমরা হলুম সবচেয়ে ছোট জাত।

দীপংকর বলল, কে বলল? মানুষের একটাই জাত। সে জাত হল মানুষ। হাঁসুলির বউ গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করল দীপংকরকে। দীপংকর লাফিয়ে

উঠল, এ কী করছেন! আমি আপনার ছেলের মতো।

তা হোক বাবা। তুমি বামুনের ছেলে। দেবতা। আমাদের কত ভাগ্য যে, আজ তুমি আমাদের বাড়িতে এসেছ। তা বাবা একটা কথা বলি। ডিম খাও তুমি? আমি সব কিছুই খাই।

হাঁসুলিও তখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে দু’ পা ছড়িয়ে মুড়ি খেতে বসেছে। দীপংকর বলল, আচ্ছা ওই সোনা তোমরা বালি থেকে হেঁকে বার করবে কী করে?

সে অনেক হেফাজত গো। ছোট ছেলে তুমি। ওসব বুঝবে না। তবু লেখাপড়া জানা ভাল ভদ্রলোকের ঘরের ছেলে তো, তাই বলছি তোমাকে। বিশেষ করে তোমার যখন জানবার এত ইচ্ছে, তখন শোনো। প্রথমে আমরা সোনার রেণু মাখা বালি নদী থেকে অথবা পাথরের গা থেকে চেঁচে নিয়ে কুলোর মতো একটা পাত্রে রেখে বড় বড় পাথর ঢ্যালা কাঁকর বেছে ফেলে দিই। তারপর সেই কুলোটা নেড়ে চেড়ে ছোট কাঁকর ও অন্য পদার্থগুলো ফেলে দিই! এরপরে যে বালিটা পড়ে থাকে তাকে বেশ ভাল করে ধুয়ে নিই। এইভাবে বার বার ধুতে ধুতে কাদা-কাঁকর সব যখন ধুয়ে যায়, তখন কালো কালো বালি সামান্য কিছু পড়ে থাকে। তারই মাঝে মাঝে সোনার রেণুগুলো আমরা আলাদা করে নিই। ,

হাঁসুলির বউ বলল, তবে কী জানো বাবা, এতে আমাদের মজুরি পোষায় না। এই মানভূম সিংভূম অঞ্চলের সোনাখোঁচাদের তাই দুঃখের শেষ নেই। কাজেই তিনশো বছর আগেও আমাদের যে অবস্থা ছিল। আজও তাই আছে।

হাঁসুলি বলল, শুধু উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে কত সোনা নষ্ট হয় এখানে। অথচ এই নদী সোনার নদী। এত সোনা এখানে আর কোথাও নেই। আর আছে আসামে। তবে ওখানকার ব্যবস্থাও ভাল। সেখানে যে নদীতে সোনা আছে, তার ধারে ধারে গড়ে উঠেছে সোনাখোঁচাদের বাস।

দীপংকর বলল, আচ্ছা, কোথায় সোনা আছে ওরা খোঁজ পায় কী করে?

এমন কিছু শক্ত নয়। সোনাখোঁচারা ঘুরে বেড়ায়। নদী যেখানে হঠাৎ বেঁকে গেছে, বা স্রোত খুব দ্রুত এবং পাড় উঁচু ও ভাঙা ভাঙা, তার অপর পাড়ে প্রচুর সোনা পাওয়া যায়। অবশ্য প্রথমে বাঁশে করে নদী থেকে কতকটা বালি তুলে তাইতে সোনা আছে কি না দেখতে হয়। সেই বালিতে দশ বারোটা সোনার রেণু চিক চিক করলেই বুঝে নিতে হবে এতে সোনা আছে। এরপর নদীর ওপর একটা বাঁধ দেওয়া হয়। এবং মনোনীত জায়গাটির ওপর দিয়ে বয়ে যেতে দেওয়া হয় স্রোতকে। এইভাবে স্রোতে কাদা প্রভৃতি ময়লা পদার্থগুলি ধুয়ে গেলে দেখা যাবে, সোনার রেণু মাখা বালি তলায় চিক চিক করছে। তা হলে দেখা যাচ্ছে যে আমাদের এখানকার নিয়মের চেয়ে ওখানকার ওই নিয়মে অল্প মেহনতে ওইরকম পরিষ্কার সোনামাখা বালি পেয়ে যাচ্ছে ওখানকার লোকেরা।

দীপংকর বলল, ওই নিয়ম এখানে খাটে না?

না। এখানে সে সুবিধে নেই।

তারপর?

তারপর ওরা করে কী সেই বালি চেঁচে একটা বাঁশের চালুনির ওপর জমা করে। এবং লাউয়ের খোলায় করে তার ওপর ধীরে ধীরে জল ঢালতে শুরু করে, আর নাড়তে থাকে চালুনিটাকে। তার ফলে সোনামাখা বালি ধুয়ে নীচের একটি পাত্রে পড়ে। অবশ্য অল্প কাঁকর-পাথর যা থাকে সেগুলোকে ফেলে দেওয়া হয়। এইভাবে এক এক খেপে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ ঝুড়ি বালি ধোয়া হয়। এইবার এই ছাঁকা বালিতে পারা মিশিয়ে দেওয়া হয়। পারা দিলেই সোনার রেণুগুলো জড়িয়ে যায় পারার গায়ে। তখন এতে অল্প অল্প ঢাললেই সেই বালি ধুয়ে যায় এবং পারামাখা সোনা আলাদা হয়ে যায়।

দীপংকর বলল, বাঃ বেশ মজা তো। কিন্তু পারা থেকে সোনাগুলোকে বার করে কী করে?

আর কোনও অসুবিধে নেই। সেই পারামাখা স্বর্ণখণ্ড এক-একটা শামুকের ভেতরে রেখে সেগুলো আগুনে পোড়ালেই শামুক পুড়ে চুন হয়ে যায়, আর পারা উঠে গিয়ে সোনাটা বিশুদ্ধ হয়ে পড়ে থাকে।

দীপংকর বলল, ভাগ্যে তোমাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হল। না হলে এসবের কিছুই তো জানতাম না আমি।

হাঁসুলি বলল, আজকাল লোকজন বড় খারাপ হয়ে গেছে বাবা। তাই এ কাজে আর আনন্দ নেই। এই সোনা সোনা করে কত যে মারপিট, দাঙ্গা, খুন-খারাপি হয়ে চলেছে তা কী বলব।

দীপংকরের চোখদুটো যেন কীসের আশায় চকচকিয়ে উঠল! ওর তিমিরাবৃত মনে সামান্য একটু আলোকপাত হল যেন। ওর জেঠুও তো খুন হয়েছেন এই সোনা সোনা করেই। এই সোনার জন্যই তো গুপ্তঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁকে। দীপংকর তাই অবাক হয়ে বলল, এই সামান্য একটু সোনার জন্য খুন !

সামান্য সোনা নয় খোকাবাবু। এই নদী, ওই দূরের পাহাড় এসব হল স্বর্ণ-প্রসবিনী। ওই যে দেখছ পাহাড়গুলো, ওই পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় সোনা। ওইসব সোনাই তো বৃষ্টির জলে ধুয়ে বয়ে আসে নদীর স্রোতে।

ওই পাহাড়ে যদি অত সোনা তো তোমরা এত কষ্ট করে নদীর বালি ঘেঁটে সোনা বার করো কেন?

এই দেখো। আমরা যে হলাম সোনাখোঁচার জাত। গণ্ড, ঝোরা। আর ওই পাহাড়ে সোনা নিতে গেলে পাহাড়িরা তা নিতে দেবে কেন?

ওই পাহাড়ে অনেক সোনা!

অনেক! সোনার গুহা পর্যন্ত আছে।

বলো কী। সোনার গুহা! তা যদি সত্যি হয় তা হলে গভর্নমেন্টের লোকেরা এসে ওইসব সোনা নিয়ে যায়নি কেন?

আরে সবাই কি সন্ধান জানে? ওই সন্ধান জানতে গিয়েই তো সেবার এক বাঙালিবাবু গভীর রাতে খুন হয়ে গেল। সোনার সন্ধান কেউ পেলে তার আর রক্ষে নেই। ওখানকার লোকেরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেরে ফেলবে।

দীপংকর বললে, উঃ কী ভয়ানক।

হাঁসুলি বলল, সোনা যদি লোহার মতো সস্তা হত, তা হলে খুনখারাপি কিছুই হত না। ওই বাঙালিবাবু ছিলেন স্বর্ণ-সন্ধানী। পাহাড়ে-জঙ্গলে শুধু ঘুরতেন, আর সোনা খুঁজে বেড়াতেন।

দীপংকর বলল, আচ্ছা ওই পাহাড়ে আমি যেতে পারি না?

কেন পারবে না? তবে ওই পাহাড়গুলো এখান থেকে কাছে মনে হলেও ওগুলো কিন্তু অনেক দূরে। তা ছাড়া ওই পাহাড়ে গেলেই যে তুমি সোনা দেখতে পাবে তা তো নয়! কোথায় সোনা লুকিয়ে আছে খুঁজে বার করতে হবে। দুই পাহাড়ের মাঝের খাঁজে পাথরের মধ্যে সোনা থাকে। কালক্রমে যে পাথরে সোনা থাকে সেই পাথর পচে বর্ষার জলে নদীতে গিয়ে পড়ে। কোয়ার্টজ নামে এক ধরনের পাথরের মধ্যেই শুধু সোনা দেখতে পাওয়া যায়। এই পাথরের খাঁজে খাঁজে যেখানে সোনা থাকে তাকে স্বর্ণশিরা বলে। যে কোয়ার্টজ পাথরের খাঁজে সোনা থাকে, সেখানে শুধু কোদাল দিয়ে খুঁড়েই কত লোক বড়লোক হয়ে গেছে। ওই পাহাড়ে কখনও গেলে দেখবে কূপের মতো বড় বড় গর্ত। তা প্রায় পঞ্চাশ ষাট হাতের মতো গর্ত অনেক আছে। বহুকাল থেকেই মানুষ ওইখান থেকে সোনা সংগ্রহ করছে। এক এক জায়গায় সেই গর্ত এত বেশি যে, সেখানে বড় বড় গুহার সৃষ্টি হয়ে গেছে।

দীপংকর বলল, আমি যাব।

হাঁসুলি বলল, খবরদার খোকাবাবু! ওই কাজটি কোরো না।

কেন করব না?

ঘাঁটি ওখানে।

ওখানকার লোকজন ভাল নয়। তা ছাড়া বড় বড় ডাকাতের কাজেই সোনার সন্ধানে ওখানে গেলে কেউ ফেরে না।

দীপংকর বলল, আচ্ছা সেই যে বাঙালিবাবু খুন হয়েছেন বললে, ওই বাঙালিবাবুর নাম কী জান?

না বাবু। নাম জানি না। ওই বাঙালিবাবুর একটা এদেশি চাকর ছিল। সেও আধা খুন হয়ে গেল। তবে প্রাণে বেঁচেছে সে লোকটা।

লোকটা কোথায় থাকে।

ও থাকে বাসাড়েরা গ্রামে। ওর নাম ইকলু।

এমন সময় খাবারের ডাক পড়ল। হাঁসুলির বউ দাওয়ায় চাটাইয়ের আসন পেতে কলাইয়ের থালায় লাল মোটা চালের ভাত, ডাল, পোস্ত আর ডিমের ঝোল খেতে দিল দু’জনকে।

দীপংকরের দারুণ খিদে পেয়েছিল। তাই সে পরম তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে নিল সেই ভাত, তরকারি। এরপর বিশ্রাম। একটি ছোট্ট টিলার গায়ে গাছের ছায়ায় শুয়ে শুয়ে দীপংকর ঠিক করে নিল আর এখানে নয়। বেলা পড়ে আসছে। ওকে যেভাবেই হোক ঠাকুর সিং-এর আস্তানায় গিয়ে পৌঁছতেই হবে। কেন না ওই পাহাড় জঙ্গল ওইখান থেকেই তো শুরু। ওখানে থাকলে ওর অভিযান খুবই সহজ হয়ে উঠবে। ওই জঙ্গল ভেদ করে পাহাড় টপকে ও যেভাবেই হোক পৌঁছে যাবে বাসাডেরায়। ইকলুদের গ্রামে। আর সেখানে গিয়ে ইকলুকে খুঁজে বার করতে পারলেই ও অনেক কথা জানতে পেরে যাবে।

একটা খুন তো নিজের অজান্তেই হয়ে গেছে। পুলিশের খাতায় ওর নাম নিশ্চয়ই জ্বলজ্বল করছে এতক্ষণে। আর কয়েকটা খুন ওকে করতে হবে। ওর প্রথম টার্গেট কুন্দনলাল। যে ওর বাবাকে ভয় দেখিয়েছিল, যার জন্য টাটানগরের ওই বাড়িতে ওরা যেতে পারছে না। যে ওর বাবাকে সাকচি বাজারে মোটর বাইক চাপা দিতে গিয়েছিল। যদিও এ কাজ যে কুন্দনলালেরই তার কোনও প্রমাণ নেই, তবুও ওর মন বলছে এ কাজ ও ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। কেন না জেঠু তো লিখেইছেন, ‘শয়তানের মৃত্যু নেই। ওর হাতে হয়তো আরও অনেকের মৃত্যু আছে।’ দীপংকরের স্থির বিশ্বাস ওর জেঠুর হত্যাকারীও কুন্দনলাল ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু কীভাবে ধরা যায় লোকটাকে? এবং কী কৌশলে ওকে বধ করা যায়? ও তো নিরস্ত্র। আর যা কিছুই করুক না কেন, সবকিছুই করতে হবে ওকে খুব তাড়াতাড়ি। কারণ হত্যাকারীকে না-পেলে ওয়ারেন্ট বেরোবেই এবং যেখানেই গা ঢাক৷ দিয়ে থাকুক না ও, পুলিশ ওকে ধরবেই। তবে ভগবান সহায় তাই ও এইখানে অর্থাৎ এই সোনার নদীর দেশেই এসে পৌঁছেছিল। এই কথাটা মনে হতেই কেমন যেন শিহরিত হয়ে উঠল দীপংকর। তবে কি সত্যি সত্যিই ও ঈশ্বরের ইচ্ছায় এখানে এসেছে? না হলে ওর হাতে একটা মানুষ খুনই বা হল কেন? কেনই বা পালাতে গিয়ে ওই দুর্ঘটনা ঘটল? আর ঘটল যখন, তখন ওরা ওকে ট্রাকে না-তুলে রাস্তাতেই বা ফেলে দিয়ে এল না কেন? এবং এল যখন এই সোনার নদীর দেশে কেন? আসানসোল, দেওঘর অথবা বালেশ্বর, খুরদার দিকেও তো যেতে পারত? কিন্তু তা যখন হয়নি এবং ওর নিয়তিই যখন ওকে এই সোনার নদীর দেশে নিয়ে এসেছে, তখন তাঁর অভিপ্রায় কিছু একটা আছেই। অতএব হার ও মানবে না। তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’র মতন ও-ই হয়তো ওর জেঠুর হত্যাকারীদের ব্রহ্মাস্ত্র।

দীপংকর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর এইসব ভাবনাচিন্তা করে হাঁসুলির কাছ থেকে বিদায় নেবে বলে আবার ওদের ঘরে এল।

হাঁসুলির ছেলে, মানে সুবর্ণরেখার সেই মাঝি তখন খেতে বসেছে। খেতে খেতেই সে বলছে, আমি বলি কী, চুপি চুপি ওকে পুলিশের হাতে তুলে দাও। না হলে পরে ঝামেলা হলে আমাদেরই কোমরে দড়ি পড়বে।

হাঁসুলি দাওয়ায় শুয়ে বলছে, তাই কী হয়? তার চেয়ে পরশু তো আমি কলকেতা যাব। তখনই না-হয় ওর বাড়িতে একটা খবর দেব?

আরে এটা বুঝছ না কেন? ওর বাড়ির লোকে কি থানা-পুলিশ করেনি? তার ওপর এখানে চারদিকে ঢি ঢি পড়ে গেছে, একটি ভদ্দর লোকের ছেলে আমাদের বাড়ি এসে উঠেছে বলে। এখন পুলিশের কানে গেলে কী অবস্থা হবে? তার চেয়ে এখনও সময় আছে। যদি বাঁচতে চাও তো পুলিশে খবর দাও। না হলে ছেলে চুরির দায়ে ফাঁসবে একথা কিন্তু বলে দিলাম।

পুলিশের নাম শুনেই ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল দীপংকরের। সর্বনাশ! এরা যদি পুলিশ ডাকে এবং ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়, তা হলে তো সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। কেন না এখানকার পুলিশ ওকে আটক করেই খবর দেবে বেঙ্গল পুলিশকে। আর তারপরই জেল, হাজত, ফাঁসি।

দীপংকর এক মুহূর্তও আর রইল না সেখানে। সামান্য একটু পিছু হটে এসে  নদীর পথ ধরল। ওর ইচ্ছে হল পালাতে। কিন্তু তা সে করল না। কেন না ছুটতে গেলেই ও পালাচ্ছে বলে জেনে যাবে সকলে। এবং তখন ধরেবেঁধে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেবে ওরা। ওর জেঠুর হত্যাকারীদের খুঁজে বের করবার আর কোনও সম্ভাবনাই থাকবে না তখন।