দশ
জ্ঞান যখন ফিরল তখন রাত গভীর। চম্পা ও দীপংকর ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখল, চারদিকে শুধু মশালের আলো। ওরা দু’জনে মাটিকাদায় মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। যেমনি চম্পা, তেমনি ও।
ওদের মাথার শিয়রে ওরা কারা! দলে দলে আদিবাসীরা সারবন্দি দাঁড়িয়ে আছে। আর অসংখ্য পুলিশ। ওই তো ইকলুভাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দীপংকর হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল, মা! মাগো। দীপংকরের মা জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে।
বাপিও এসে ওর সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
ওদিক থেকে ঠাকুর সিংও ছুটে এসে বুকে টেনে নিল চম্পাকে, চম্পা? চম্পা মা আমার।
সবই যেন অকল্পনীয় ব্যাপার বলে মনে হল। এও কি সম্ভব! এই গভীর রাতে গিরিগুহার সামনে বাপি, মা, ঠাকুর সিং। না না। এ সত্যি নয়। ওরা হয়তো মরেই গেছে। তাই প্রেত হয়ে এইসব অবাস্তব দৃশ্য দেখছে ওরা, অথবা এ সবই স্বপ্ন। কিন্তু না। এই জগতে মৃত্যু যেমন অমোঘ, স্বপ্ন যেমন সত্যি, তেমনি অবাস্তব ও বাস্তব।
মা দীপংকরকে বুকে নিয়ে বললেন, কোথায় লেগেছে বাবা? কী কষ্ট হচ্ছে তোর? তোকে কে এখানে নিয়ে এল?
ওদিকে চম্পা বলল, বাবুজি। মুঝে মাপ কর দো বাবুজি।
ঠাকুর সিং চম্পাকে বুকে নিয়ে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলেন।
আর ভেলু? সে এসে দীপংকর ও চম্পার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেতে লাগল।
ইকলু বলল, এই ভেলুয়ার জন্যেই আজ তোমরা রক্ষা পেলে ভাই। ও গিয়ে খবর না দিলে আমরা জানতেই পারতাম না তোমরা কে কোথায় আছ। দীপংকর বলল, আমি ভেবে পাচ্ছি না তোমরা কীভাবে আমাদের উদ্ধার করলে?
পুলিশ অফিসার মি. লালচাঁদ শর্মা হাসতে হাসতে এসে বললেন, শুনবে শুনবে। সব কিছুই শুনবে। আগে সব স্নান করে পরিষ্কার হও। কিছু খাও-টাও তারপর সব শুনবে। একদিন একরাত পড়েছিল তো গুহাবন্দি হয়ে। যে ভাবে তোমাদের উদ্ধার করেছি তা আর শুনে কাজ নেই, বরাত জোর যে দু’জনেই বেঁচে গেছ এ যাত্রায়।
অতএব তাই হল।
চম্পা ও দীপংকরকে স্ট্রেচারে শুইয়ে সবাই মিলে সেই অন্ধকারেই ধরে নিয়ে চলল ইকলুদের গ্রামে। পথে ধারাগিরির ঝরনার জলে বেশ ভাল করে স্নান করতেই ধুলোকাদা ধুয়ে গিয়ে দু’জনের তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ আবার ফুটে উঠল। আগের মতো।
এরপর ইকলুর বাসায় গিয়ে ইকলুর একটা ধুতি পরে ফেলল দীপংকর এবং চম্পাকেও পরানো হল ইকলুর বউয়ের একটা শাড়ি। এক গেলাস করে গরম দুধও খাওয়ানো হল দু’জনকে।
দলে দলে লোক এসে জুটল তখন সেখানে। পুলিশও এল।
তারপর কথা প্রসঙ্গে সব কিছু যখন শুনল ওরা তখন বুঝতে পারল ঠাকুর সিং, ইকলু এবং ভেলুয়া না-থাকলে কোনও কিছুই হত না। ওই গুহার ভেতর দমবন্ধ হয়ে পচে মরতে হত ওদের।
ঘটনাটা এই রকম—
সেদিন ইকলুদের গ্রাম থেকে ফিরে এসেই ঠাকুর সিং কুন্দনলালের মুখোমুখি হয়। ঠাকুর সিং-এর স্থির বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল যে কুন্দনলালই গোপনে কিছু জানার জন্য চম্পাকে এবং হত্যার অথবা ব্ল্যাকমেলের জন্য দীপংকরকে গুম করেছে।
এই নিয়ে তুমুল কলহ দু’জনের।
ঠাকুর সিং কুন্দনলালকে শাঁসিয়ে এল, যদি সে তার লেড়কিকে ফেরত না দেয় তা হলে সমুচিত শিক্ষা দেবে তাকে। এই কথা বলেও কিন্তু ঠাকুর সিং চুপ থাকেনি। সোজা ট্রেনে চেপে হাওড়া স্টেশনে এসে ওখানকার পুলিশকে দীপংকরের বৃত্তান্ত জানায়। দীপংকরের অন্তর্ধানরহস্য নিয়ে চারদিকে তখন হইচই হচ্ছিল খুব। কাজেই ওর ঠিকানা খুঁজে বার করতে দেরি হল না। দীপংকরের মা-বাবা দু’জনেই নিকটবর্তী থানায় ঠাকুর সিং-এর বক্তব্য পেশ করিয়ে সোজা চলে আসেন ঘাটশিলায়। তারপর সব কথা খুলে বলেন এখানকার ভারপ্রাপ্ত অফিসার লালচাঁদ শর্মাকে।
এদিকে ইকলুও ছুটে আসে থানায়। কেন না ওই ভয়ংকর দুর্যোগের রাতেই বাড়িতে দু’দুটো খুন এবং সেই সঙ্গে চম্পা ও দীপংকরের উধাও হয়ে যাওয়াটা ওকে সাংঘাতিক রকমের ভাবিয়ে তুলল। সেদিন অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়েছিল ওরা। হঠাৎ ভেলুয়ার চিৎকারে ঘুম ভাঙে। ঘুম ভেঙে উঠেই বাইরের দৃশ্য দেখে ছুটে ওপরে যায়। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। তার ওপর ভেলুয়া বার বার কাপড়ের খুট ধরে ওকে টানাটানি করতে থাকে বলে ভেলুয়ার পিছু নেয় ও। ওর পিছু পিছু সেই গুহামুখের কাছে এসে যে ভয়াবহ ধস দেখে তাতে ওর সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে। এদিকে গুহার সামনেই ভেলুয়ার আক্রমণে বীভৎস চেহারা নিয়ে একজন পাক্কা শয়তানকেও মৃতঅবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। তখন ও বুঝতে পারে চম্পা ও দীপংকর ধস চাপা পড়েছে। তাই আর কাল বিলম্ব না করে ছুটে আসে থানায়। এখানেই দীপংকরের বাবা-মা এবং ঠাকুর সিং-এর সাথে দেখা হয়।
এরপর চলে আদিবাসীদের এবং সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় ধস মুক্তির অভিযান।
ভগবান সহায়। তাই দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার প্রচেষ্টায় ধসমুক্ত করে ওদের উদ্ধার করা হয়।
লালচাঁদের বক্তব্য, কুন্দনলালকে তার দলবল সহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কিন্তু দীপংকর ও চম্পা যে সে রাতে ওই গুহায় কী কারণে গিয়েছিল সেকথা পুলিশকে কিছুতেই বলল না। শুধু বলল লালজির ভয়ে ঠাকুর সিং-এর বাসা থেকে পালিয়ে আসে ওরা এবং ইকলুর বাসায় ওই লোকরা ওদের গুম করতে এসেছিল দেখে ওদের দু’জনকে শেষ করে ওরাও নিরাপদ হবার জন্য ওই গুহায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু এই রকম ভয়াবহ ধসের মুখে যে ওরা পড়বে তা ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি।
ইকলু বলল, ধস তো হবেই। সোনার লোভে পাহাড় কেটে চারদিক তো ফেঁাপড়া করে দিয়েছে। তার ওপরে এই প্রবল বর্ষণ। কাজেই ওপরের ভারী পাথরের চাপ নীচের শূন্যস্থান সহ্য করতে পারবে কেন? অতএব অনিবার্যভাবে যা ঘটবার তা ঘটে গেছে।
ওরা যখন কথা বলছে তখন ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। আদিবাসীদের জ্বলন্ত মশালও তখন নিভু নিভু।
মা বললেন, কিন্তু তুই এখানে কী করে এলি দীপু? তোর জন্য আমরা যে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম।
দীপংকর তখন সব কথা খুলে বলল সকলকে।
শুনে মা-বাপি দু’জনেই মাথায় হাত দিয়ে বললেন, হায় কপাল! এই জন্যে তুই পালিয়ে এসেছিলি? কেন আমরা কি কেউ নই? একবার এসে আমাদের ওকথা বলতে পারিসনি? মা-বাবাকে না-জানিয়ে পালানোর ফলটা টের পেলি তো? তোকে কোথাও লুকিয়ে রাখবার প্রয়োজন হলে সে ব্যবস্থা তো আমরাই করতাম। তোর জেঠুর কৃপায় আমাদের কী কোনও অভাব আছে রে?
সত্যি মা খুব ভুল হয়ে গেছে। আসলে আমি তখন এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে কী বলব। তার ওপর ওই দুর্ঘটনা।
তা হলে শোন বোকা ছেলে, তুই যাকে ঘুসি মেরে পালিয়েছিলি সে আসলে মরেইনি। দিব্যি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। ওর বাবা-মা অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে সারিয়ে তুলেছেন ওকে। আর ওই মেয়েদুটো, যাদের জন্যে তুই ওই কাজ করেছিলি তারা তোর ব্যাপারে সব কথা বলেছে পুলিশকে। কাজেই ভুল বুঝে বৃথাই কষ্ট পেলি তুই।
বৃথা নয় মা। ভাগ্যিস এসেছিলাম তাই তো তোমাদের চিরশত্রু কুন্দনলালকে দলবল সমেত ধরাতে পারলাম। আমার বদলে আমার জেঠুর হত্যাকারীই এখন ফাঁসির মঞ্চে উঠবে আশা করি। আর এখানে ওইভাবে না এলে চম্পাকেও তো পেতাম না। মা, মাগো! আমি চম্পাকে কথা দিয়েছি মা, ও এখন থেকে আমাদের কাছেই থাকবে। ,
মা সঙ্গে সঙ্গে চম্পাকে বুকে টেনে নিয়ে ওর ডালিমের মতো লাল টুক টুক গালে চুমু খেয়ে বললেন, সে কথা তুই কী বলবি। আমিই তো বলব। এখন ওর বাবা যদি দয়া করে মেয়েটাকে আমায় দেন তবেই—।
ঠাকুর সিং আনন্দের আবেগে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল এবার। তারপর মায়ের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে বলল, আমি এখুনি ওকে তোমার পায়ে অর্ঘ্য দিলাম মা। এ সংসারে ওর কেউ নেই। আমার তো উমর জায়দা হয়ে গেছে। কবে আছি, কবে নেই। তাই ওকে তোমরা তোমাদের সাথে নিয়ে যাও। আমার জীবনের শেষ ক’টা দিন আমি একটু শান্তিতে থাকি। বলে পুলিশ অফিসার লালচাঁদের দিকে নিজের হাতদুটি এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনি আমাকে গ্রেপ্তার করুন হুজুর! জীবনে আমি অনেক খারাপ কাজ করেছি। আমায় জেলে রাখুন, ফাঁসি দিন, যা ইচ্ছা করুন।
লালচাঁদ হেসে বললেন, পুলিশের কাছে গ্রেফতার হতে চাইলেই গ্রেফতার হওয়া যায় না ঠাকুর সিং। তুমি ভাল লোক ছিলে না এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সবই তো শোনা কথা। তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণ কই? তা ছাড়া আমাদের খাতায় তোমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগও নেই, পরোয়ানাও নেই। অতএব কোন আইনে আমি তোমাকে অ্যারেস্ট করব? তাই তুমি যেমন ছিলে তেমনই থাকবে।
মা বললেন, হ্যাঁ। তেমনই থাকবে। তবে এখানে নয় তোমার মেয়ের কাছে। আমাদের বাড়িতে।
ঠাকুর সিং হতবাক।
লালচাঁদ বললেন, চলুন, আপনাদের সবাইকে আমার জিপে করে ঘাটশিলায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
অতএব ইকলুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জিপে উঠল ওরা। বাপি, মা, দীপংকর, চম্পা, ঠাকুর সিং সবাই উঠল।
ওরা যখন জিপে উঠেছে তেমন সময় সেই রবারের গোসাপটাকে ইকলুভাই টানতে টানতে নিয়ে এসে চম্পার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এই নাও চম্পাদিদি। আমি আমার ভালবাসার দান হিসেবে এটা তোমাকে উপহার দিলাম।
চম্পা ও দীপংকর এটার কথা ভুলেই গিয়েছিল এতক্ষণ। ইকলু যে কখন কোন ফাকে দেখতে পেয়ে এটাকে সরিয়ে ফেলেছিল তা কে জানে? তাই আবেগের উচ্ছ্বাসে গোসাপটাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল ওরা।
লালচাঁদ বললেন, কী ওটা?
ঠাকুর সিং ইকলুর দিকে এক নজর তাকিয়েই হেসে বলল, বাচ্চো কা খিলোনা।
ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করল।
এবার প্রত্যাবর্তন।
কিন্তু এই বিদায় মুহূর্তে ভেলুয়া! ভেলুয়া কই? ওকে তো রেখে যাওয়া হবে না। কোথায় গেল সে? খোঁজ খোঁজ শুরু হল চারদিকে। কোথায় গেল ভেলুয়া? ভেলুয়াকে পাওয়া গেল না। কোথায় যে গেল সে, কে জানে? কিন্তু কেউ না-জানলেও আমি জানি। আমি জানি সে তখন কোথায় ছিল। ধারাগিরি ঝরনার কাছে ওর মনিবের সমাধির উপর শুয়ে সে তখন নীরবে নিভৃতে কাঁদছিল। ওর দু’চোখের জল যখন টপ টপ করে ঝরে পড়ছিল সমাধির ওপর, তখন বাতাসের দীর্ঘশ্বাসে এই পাহাড় ও বনতল ভরে উঠছিল বুঝি!