এক
চারদিকে পাহাড়। পাহাড়ের পর পাহাড় যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। ওই পাহাড়ের কোল বেয়ে বয়ে চলেছে সোনার নদী। বিস্তৃত শালবন, গভীর অরণ্যানি শ্যামল উপত্যকা, আর সব কিছুর শেষে যে বড় পাহাড়, সেই পাহাড়ের এক সুবিশাল গুহার ভেতরে…।
এই পর্যন্ত পড়ে থেমে যেতে হল দীপংকরকে। কেন না বাকিটা কীভাবে যেন অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। কিন্তু থেমে গেলেও এক অদম্য কৌতূহল ওর কিশোরমনকে তোলপাড় করতে লাগল। কী ছিল সেই গুহার ভেতরে? গুপ্তধন? নাকি অন্য কিছু? কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর যিনি দেবেন তিনি আজ আর ইহলোকে নেই। দীপংকর তবুও বার বার সেই পুড়ে যাওয়া ডায়েরির পাতার ওপর চোখ বোলাতে লাগল।
ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা।
মা এসে বললেন, কীরে, এখনও জেগে আছিস তুই? এবার শুয়ে পড়। দীপংকর মা’র দিকে ওর ডাগর ডাগর চোখদুটি তুলে বলল, মা বাপি কখন আসবে?
ওর আসতে দেরি হবে বাবা। হয়তো রাত বারোটাও হতে পারে। কিন্তু উনি এসে যদি দেখেন, তুই এখনও জেগে বসে ওইসব পড়ছিস তা হলে কিন্তু খুব রেগে যাবেন।
আচ্ছা মা, জেঠুর কাগজপত্তরে হাত দিলে তোমরা এত রেগে যাও কেন?
তোমার বাপি পছন্দ করেন না বলে। চিরকাল বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন, আর ডায়েরির পর ডায়েরি লিখে গেছেন। তাঁর মতন লোকের যে এমন পরিণতি হবে তা কি কেউ জানত?
মা। দীপংকর বলল, এই ডায়েরিটা লেখার সময়েই জেঠু খুন হয়েছিলেন তাই না
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন? কেন ওরা আমার জেঠুকে খুন করল? উনি তো অত্যন্ত পরোপকারী লোক ছিলেন। কী চমৎকার কথাবার্তা বলতেন। আর কী দারুণ রসিক। প্রত্যেকটি কথায় রসিকতা মাখানো ছিল তাঁর। এমন মানুষকে কেউ খুন করে?
যারা খুনি তাদের ছুরিকাঘাতে কেউই বাদ যায় না বাবা।
আমার মনে হয় এই ডায়েরিটা লেখার সময় নিশ্চয়ই জেঠুর টেবিলে কোনও মোমবাতি ছিল। খুনের সময় সেটি উলটে যায়, আর তাতেই বাকি অংশটা পুড়ে যায়।
অনেক রাত হয়েছে দীপু। এসো শোবে এসো। যতক্ষণ না তোমার বাপি আসেন, আমি ততক্ষণ তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব। ওটা রেখে দাও তুমি। ওখানে অনেক দরকারি কাগজপত্তর আছে।
অতএব ডায়েরিটা মুড়ে যথাস্থানে রেখে দিল দীপংকর। তারপর বিছানায় এসে শুতে মা ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
দীপংকর বলল, মা, তুমি দেখে রেখো, আমি বড় হয়ে যে ভাবেই হোক আমার জেঠুর হত্যাকারীকে ধরবই। যারা আমার জেঠুকে হত্যা করেছে ভগবান ক্ষমা করলেও, আমি তাদের ক্ষমা করব না।
মা বললেন, ভগবানও কাউকে ক্ষমা করেন না বাবা। তাঁর হিসাবের খাতায় সব কিছু জমা হয়ে থাকে। সময় মতো তিনি যার যা পাওনা তাকে তা কড়ায়গণ্ডায় পাইয়ে দেন। তোমার জেঠু দেবতার মতো লোক ছিলেন। কাজেই তাঁকে যারা হত্যা করেছে তারা কিছুতেই রেহাই পাবে না।
দীপংকর একবার চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। বারবার ডায়েরির পাতার ওই কয়েক ছত্র লেখাটার কথা মনে পড়তে লাগল তার। কী আছে ওই গুহায়? গুপ্তধন? যদি থাকে তবে লোকজন নিয়ে তিনি তা উদ্ধার করবার চেষ্টা না করে ডায়েরির পাতায় লিখতে গেলেন কেন? কেন তিনি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন?
দীপংকর একটুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকে একসময় বলল, আচ্ছা মা, সোনার নদী কোথায়? সোনার নদী কি সত্যিই আছে? কী জানি বাবা।
জেঠু ডায়েরিতে লিখেছেন কিনা!
লিখেছেন নাকি? হয়তো সেরকম কোনও নদীর সন্ধান তিনি কোথাও পেয়েছিলেন। তাই হয়তো দুর্বৃত্তেরা হত্যা করেছে তাঁকে। আচ্ছা মা, জেঠুর অনেক টাকা ছিল তাই না?
হ্যাঁ। জেঠুর সব টাকার মালিক এখন তুই। ব্রিটিশ আমলের লোক উনি। জাহাজে চাকরি করতেন। কত দেশ-বিদেশ যে ঘুরেছেন তার ঠিক কী? সাহেবরা খুশি হয়ে তোর জেঠুকে গিনি উপহার দিতেন আর সেগুলো তিনি নিয়ে এসে জমা করতেন ঘরের সিন্দুকে। সেদিন চাবি খুলে দেখি প্রায় একশোটারও বেশি গিনি আছে তার ভেতরে। ব্যাঙ্ক ভরতি জেঠুর টাকা। তবে খুব বুদ্ধিমান লোক ছিলেন তো উনি, তাই সবকিছুর উইল করে গেছেন তোর নামে। মাসে মাসে মোটা টাকা ব্যাঙ্ক থেকে সুদ পেতেন, আর সেই টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। অরণ্য ছিল তাঁর প্রাণ। তিনিই ছিলেন যেন বনের রাজা।
দীপংকর এবার একটু উঠে বসে বলল, মা, জেঠু ঠিক কোন জায়গায় খুন হয়েছিলেন তুমি জানো? আমার মনে হয় সোনার নদী সেখানেই কাছেপিঠে কোথাও আছে।
জায়গাটার কথা আমি ঠিক বলতে পারব না! তবে সিংভূমের অরণ্যে এইটুকু জানি।
এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল। নিশ্চয়ই বাপি এসেছেন। দীপংকর চোখ বুজল। মা উঠে গেলেন দরজা খুলতে।
দরজা খুলতেই বাপির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, দীপুটা ঘুমিয়েছে?
শুয়েছে অনেকক্ষণ।
আজও কাজের কাজ কিছু হল না। তা ছাড়া মনে হচ্ছে আমার পিছনেও লোক লেগেছে।
মা শিউরে উঠলেন, সে কী!
দীপংকরের বুকটাও ভয়ে ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। বাপির পিছনেও লোক লেগেছে! কিন্তু কেন? বাপি তো কোনও ঝামেলায় থাকেন না। তবে কি ওরা বাপিকেও খুন করবে? কী এমন অপরাধ করেছেন জেঠু, যে তার ফল বাপিকেও ভোগ করতে হবে?
মা বললেন, তুমি কী করে বুঝলে যে তোমার পিছনেও লোক লেগেছে? সাকচি বাজারের কাছে একজন লোক এমনভাবে মোটর বাইক নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল যে আর একটু হলেই চাপা দিত আমাকে! তুমি রক্ষা পেলে কীভাবে?
হঠাৎ একটি মিলিটারি ট্রাক এসে পড়ায় কেটে পড়ল লোকটা। তারপর স্টেশনে ট্রেনে উঠতে যাচ্ছি, তেমন সময় একজন বিচ্ছিরি চেহারার লোক, গালের একটা পাশ আগুনে পোড়া। আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, বাবু ম্যাচিস। আমি তাকে দেশলাইটা দিতেই একটা বিড়ি ধরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে খিক খিক করে হাসল লোকটা। তারপর কী বলল জানো? কী বলল ?
বলল, আপনি তো মানিকবাবুর ভাই, তাই না? আমি বললাম, তুমি কে? তার উত্তরে লোকটি বলল, সময় হলেই আমাকে চিনতে পারবেন বাবু। আচ্ছা চলি। বলে আমাকে এক চোখ বুজে এক চোখ দেখিয়ে চলে গেল। দীপংকরের শরীরের ওপর দিয়ে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে
গেল। মা বললেন, তুমি আর ওখানে যেয়ো না। তোমার দুটি পায়ে পড়ি। ওনার যা হবার তা হয়েছে। এখন পুলিশের কাজ পুলিশ করুক।
আমিও তাই ভাবছি। শুধু ভেবে পাচ্ছি না ওরা কী চায়? দাদাকে ওরা খুনই বা করল কেন, আর আমার ওপরই বা ওদের রাগের কারণ কী?
ঘড়িতে তখন ঢং ঢং করে বারোটা বাজল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দীপংকর পড়তে বসেও পড়ায় মন বসাতে পারল না। বারবার বাপির কথাটা ওর কানে ঘুরেফিরে বাজতে লাগল। একটা টেপ যেন অনবরত বেজে চলেছে মনে হচ্ছে আমার পিছনেও লোক লেগেছে।’ তবে কি বাপিকেও ওরা মেরে ফেলবে? না না এ হতে পারে না। দীপংকর দু’ হাতে ওর চুলের মুঠি ধরে মাথাটাকে একবার ঝাঁকিয়ে নিল। না। মানসিক উত্তেজনা তাতেও কমল না।
ও উঠে গিয়ে দেখল রান্নাঘরে মা উনুনে হাওয়া করছেন। মা’র চোখে জল। বাপি খবরের কাগজ পড়ছেন। দৃষ্টি কাগজের পাতায়। কিন্তু কী যেন ভাবছেন উনি।
দীপংকর আস্তে করে ডাকল, বাপি? উঁ?
তুমি আর টাটানগরে যেয়ো না। কী হবে গিয়ে? জেঠু খুন হয়েছেন। যদি তোমারও কিছু একটা হয়ে যায়? টাটানগরের ওই বাড়ি তুমি বিক্রি করে দাও।
ও বাড়ির মালিক এখন তুমি। আমি কি বেচতে পারি? তা হলে আমিই বেচে দেব।
আগে তুমি বড় হও। তারপর তোমার সম্পত্তি নিয়ে তুমি যা খুশি করো। এখন তুমি নাবালক। এখন কোনও কিছুই করা চলবে না।
তা হলে যেভাবে যে অবস্থায় পড়ে আছে বাড়িটা তেমনি থাক।
আপাতত তাই থাকবে।
দীপংকর অত্যন্ত আদরের সঙ্গে ওর বাপিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আচ্ছা বাপি, জেঠু ওনার ডায়েরিতে যেসব জায়গার কথা লিখে গেছেন সেগুলো কি সত্যিই আছে?
আছে বইকী। না থাকলে কি এমনি লিখেছেন?
তা হলে সোনার নদীর কথা নিশ্চয়ই মিথ্যে নয়?
সোনার নদী! জেঠু লিখেছেন নাকি?
হ্যাঁ। আচ্ছা বাপি সিংভূমের কোথায় খুন হয়েছিলেন জেঠু? সিংভূম কোথায়?
ছোটনাগপুরের একটা জায়গার নাম। ধারাগিরি ঝরনার ধারে তোমার জেঠু রাতের অন্ধকারে খুন হয়েছিলেন গুপ্তঘাতকের হাতে। ওনার একজন ‘হো’ চাকর ছিল। তাকেও অর্ধমৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পাওয়া যায়নি শুধু ভেলুকে। অর্থাৎ তোমার জেঠুর শিকারি কুকুরকে। কুকুরটা টাটানগরে তোমার জেঠুর বাড়ি পাহারা দিত। আর জেঠুর সঙ্গে জঙ্গলে যেত। একবার দলমা পাহাড়ে কয়েকজন, দুষ্কৃতকারী তোমার জেঠুকে আক্রমণ করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভেলু তাদের এমন শিক্ষা দিয়েছিল যে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল বাছাধনরা।
সেই রাতে ভেলু তা হলে কোথায় ছিল?
সেটাই তো রহস্যময়। ওরা হয়তো জেঠুকে খুন করার আগে তাকেও মেরে ফেলেছিল।
তা হলে তো ভেলুর মৃতদেহ সেখানেই পড়ে থাকত বাপি?
বাপি হেসে বললেন, তোমার বুদ্ধিমত্তায় আমি খুব খুশি হয়েছি। বড় হয়ে তুমি ভাল গোয়েন্দা হতে পারবে। তবে এখন তোমার লেখাপড়ার সময়। জেঠুর খুনের ব্যাপারটা নিয়ে এখন তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। আর শোনো, জেঠুর কাগজপত্তর বেশি ঘেঁটো না। তুমি যখন বড় হবে, তখন হয়তো ওগুলো তোমার কাজে লাগবে। শুধু তোমার আর তোমার মায়ের মুখ চেয়ে আমি এখুনি কিছু করব না। আমাকে সাবধান হতেই হবে। তুমি নির্ভাবনায় থাকো। কেমন?
দীপংকর ‘হ্যাঁ’ বলে তখনকার মতো চলে গেল।
দুপুরে বাপি যখন অফিসে, আর মা যখন ঘুমোতে গেছেন, তেমন সময় দীপংকর আবার শুরু করল তার কাজ। চুপি চুপি জেঠুর ঘরে ঢুকে সব কিছু উলটেপালটে দেখতে লাগল।
ইদানীং জেঠু বেশির ভাগ সময় সাকচিতে থাকতেন। মাঝেমধ্যে যখন আসতেন, তখন অনেক কিছুই রেখে যেতেন। তার মধ্যে সারা বছরের লেখা ডায়েরিটাই খুব যত্নের সঙ্গে রাখতেন তিনি। অথচ আশ্চর্য! ডায়েরিতে তিনি কত কী লিখেছেন, কিন্তু ভুলেও কোনও শত্রুর কথা লেখেননি। তা হলে কি জেঠু হঠাৎই খুন হয়েছেন? ভুলবশত? তবু সেই যে কথায় আছে, ‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই’, দীপংকরও তাই করতে লাগল। একটার পর একটা ডায়েরির পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক জায়গায় একটু রহস্যের গন্ধ পেল ও। জেঠু লিখেছেন, ‘অনেকদিনের পর কুন্দনলালের সঙ্গে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল গোলবাজারে। লোকটা একটি পাক্কা শয়তান। ভিক্টোরিয়া জাহাজে মিলারসাহেবকে ওই লোকটাই খুন করে। ওই জাহাজে প্রচুর সোনা ছিল। সেগুলো নিয়ে ভাগবার তালে ছিল ও। কিন্তু আমি হাতেনাতে ধরে ফেলি ওকে।
গভীর রাতে আমার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করবার সময় জাহাজের ডেক থেকে জলে পড়ে যায় ও। সেই সময় গঙ্গায় ষাঁড়াষাঁড়ির বান আসে। তারপর ওর আর কোনও হদিস পাওয়া যায় না। ভেবেছিলাম লোকটা মরে গেছে। কিন্তু না! এতদিনে এই পরিণত বয়সে বুঝলাম শয়তানের মৃত্যু নেই। ওর হাতে হয়তো আরও অনেকের মৃত্যু আছে।’
এরপর কুন্দনলাল প্রসঙ্গে আর কিছুই লেখেননি জেঠু। ডায়েরির পাতায় সাল তারিখ সহ লেখা ‘খড়্গপুর’। তার মানে গোলবাজারটা খড়্গপুরেই।
আর একদিনের ডায়েরিতে জেঠু লিখেছেন— ‘জানি না কাজটা ভাল করলাম কি না। লুটের ধন। তার ওপর শুধুই সোনা। পুলিশকে জানালে হইচই হবে। আমাকেই হয়তো জড়িয়ে দেবে জালে। আর ওরাও যখন টের পাবে তখন পুলিশে খবর দেওয়ার জন্যে আমাকেই দেবে ডিস্যুম করে। তার চেয়ে ও জিনিস লুকনো থাক। সোনার নদীর দেশে এই গভীর অরণ্যে গহন গিরিকন্দরেই লুকানো থাক মাটির তলায়।’
এই পর্যন্ত পড়ে যা যেখানে ছিল সব ঠিকঠাক সেইখানে রেখে জেঠুর ঘর থেকে বেরিয়ে এল দীপংকর। এইবার বুঝতে পেরেছে জেঠুর মৃত্যুর রহস্যটা কী। ওই লুকানো সোনার সন্ধানেই কোনও দুষ্কৃতকারীর দল জেঠুকে বিরক্ত করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত না-পেয়ে তাঁকে হত্যা করে। কিন্তু তাই যদি হয়, তা হলে ওরা পিছন থেকে মারবে কেন জেঠুকে? ওরা তো জেঠুকে ধরে নিয়ে যাবে, ভয় দেখাবে, তারপর নানারকম অত্যাচারের শেষে নৃশংসভাবে হত্যা করবে ওরা।
যাই হোক। জেঠুর ডায়েরি পড়ে দীপংকর এই সত্যে উপনীত হল যে, নিজের অজান্তেই জেঠু কিছু ক্রিমিন্যালের চক্রে পড়ে যান এবং তার পিছনেও রয়েছে ওই লুকানো সোনা আর সেই ক্রিমিন্যালদের নায়ক হয়তো কুন্দনলাল। কিন্তু এই কুন্দনলালকে চেনা যাবে কী করে? জেঠু তো তার চেহারার কোনও বর্ণনা দেননি।
ভেবে ভেবে কোনও কূলকিনারা পেল না দীপংকর। ওর বাবার কাছে টাটানগর স্টেশনে যে বিকৃত চেহারার লোকটা দেশলাই চেয়েছিল, সে-লোকটাও তো কুন্দনলাল হতে পারে?
জেঠু মারা গেছেন প্রায় এক মাস হয়ে গেল। বিহার-পুলিশ এখনও তাঁর খুনের কোনও কিনারা করতে পারল না। জেঠুর ‘হো’ চাকরটাকে অর্ধমৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। কিন্তু এই লোকটার নাম কী? এই লোকটা নিশ্চয়ই পুলিশের হেফাজতে হাসপাতালে আছে। আচ্ছা কোন রকমে এই লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ করলে জেঠুর সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না? কারা কী কারণে জেঠুর পিছনে লেগেছিল সেকথা ওর চেয়ে ভাল আর কে বলতে পারবে? ওই লুঠের মাল জেঠুর নেবারই বা দরকার কী ছিল? বাপির মুখে শুনেছে জেঠুর নাকি অনেক—অনেক টাকা। কিন্তু এত টাকা জেঠু পেতেন কোথায়? ব্রিটিশরাজ তো কবেই শেষ হয়ে গেছে। এখন তো সাহেবরা আর জেঠুকে ডেকে আদর করে গিনি উপহার দেন না। তা ছাড়া যে জিনিস গহন গিরিকন্দরে মাটির নীচে লুকিয়ে রেখেছেন জেঠু, সে জিনিসের সন্ধান তিনি পেলেন কী করে? আর পেলেন যখন তখন সেইসব তিনি ঘরেই বা নিয়ে এলেন না কেন? তার মানে জেঠু ভালমানুষ হলেও খুব রহস্যময় লোক ছিলেন। অত সোনা উনি লুকিয়ে রাখলেন মাটির তলায়— আবার বনের রাজা হয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন, সব যেন কীরকম জট পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার ভেতর।
বিকেলবেলা নিজের অভ্যাসবশে দীপংকর একা একাই বেড়াতে চলল। এমনিতে ছেলে হিসাবে সে খুব মেধাবী। দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোর বাসনা প্রবল। খুব চাপা আর জেদি প্রকৃতির। তবে খুব ঠান্ডা মাথার।
রামকৃষ্ণপুর ঘাটে ক্রেনজেটির সামনে এসে দীপংকর বসল ট্রেলপারের ওপর। গঙ্গায় এখন জোয়ার ভরতি। বড় বড় গাদা বোটগুলো মাল বোঝাই হচ্ছে। মাথার ওপর ঘর ঘর শব্দে ক্রেনে করে মাল আসা-যাওয়া চলছে। দূরে খিদিরপুরের ডকে সারি সারি জাহাজ মাস্তুল খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে ও দেখতে পেল। এইরকমই কোনও একটি জাহাজে মিলারসাহেবের আন্ডারে কাজ করতেন জেঠু। আজ সেই মিলারসাহেবও নেই, জেঠুও নেই। দুর্ভাগ্য দু’জনেরই। দু’জনেই নিহত হলেন গুপ্তঘাতকের হাতে।
দীপংকর ট্রেলপারে বসে গঙ্গায় ঢেউ গুনতে লাগল। ওর মনের ভেতরে এখনও এক অস্থির উত্তেজনা। সেই সঙ্গে অনেক কিছু হারাবার ভয়। যদি কোনওদিন দুষ্কৃতকারীরা অফিস থেকে ফেরার পথে ওর বাপিকে কলকাতার রাজপথেই গাড়ি চাপা দেয়? ও যখন স্কুলে থাকবে এবং ওর বাপি যখন অফিসে সেইসময় ওরা এসে যদি ওর মাকেই কোনওদিন খুন করে রেখে যায় তা হলে? তা হলে কী হবে? উঃ ভগবান, কেন যে জেঠু বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন, কেন যে সোনা সোনা করে পাগলা হতেন, তা কে জানে?
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে না-আসা পর্যন্ত দীপংকর ট্রেলপারে বসে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে ফিরে আসবার সময়ই দেখল বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারার একটি বখাটে ছেলে শিস দিতে দিতে কেমন যেন নাচের ভঙ্গিমায় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা ওর চেয়েও দু’-এক বছরের বড়ই হবে। তবে তার পোশাকপরিচ্ছদ দেখলে মনে হবে বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে, কিন্তু বখাটে।
লঞ্চঘাটের দিক থেকে দুটি ফ্রকপরা কিশোরী মেয়ে সেই পথে আসছিল তখন।
তাদের দেখেই বখাটে ছেলেটার শিস দেবার ধুম বেড়ে গেল।
পথে লোকজন তখন ছিল না বললেই হয়। ফলে ছেলেটির সাহস বেড়ে গেল খুব।
মেয়েদুটিও তখন বিব্রত বোধ করতে লাগল নিজেদের। দু’-একবার আড়চোখে দেখল দীপংকরকে! তারপর আরও জোরে যাবার জন্য পা চালাল।
বখাটে ছেলেটিও এবার একটি হিন্দি গানের সুর ভেঁজে ওদের পিছু নিল।
মেয়েদুটি হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। তারপর ঘুরে তাকিয়ে বলল, এ কী, আপনি সেই থেকে আমাদের পিছু পিছু আসছেন কেন?
ছেলেটি দু’হাত কোমড়ে রেখে কঠিন গলায় বলল, পিছু পিছু কেন যাব? সরকারি রাস্তায় পথ চলছি। তোমাদের গায়ে লাগছে কেন?
দীপংকর আর থাকতে পারল না। ছেলেটির মুখোমুখি হয়ে বলল, চেহারাটি তো বেশ ভদ্রলোকের মতো। তা আমার বোনেদের বিরক্ত করতে এসেছ কেন বাবা? এখানে যে আমিও আছি তা দেখনি বুঝি?
ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে দীপংকরের জামার কলারটি ধরে কাছে টেনে আনল একবার। তারপর এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলে দিল রাস্তার ওপর।
মেয়েদুটি ছুটে গিয়ে হাত ধরে তুলে দাঁড় করাল দীপংকরকে।
বখাটে ছেলেটি তখন হাঃ হাঃ করে হাসতে লাগল। বলল, এক ফোঁটা ছেলে আমার সঙ্গে লাগতে এসেছিস ব্যাটা। ফোট এখান থেকে।
দীপংকর তখন চোট খাওয়া বাঘের মতো রুখে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ উত্তেজনায় হাতের ঘুসি পাকিয়ে যথাশক্তি দিয়ে ছেলেটার তলপেটে প্রচণ্ড আঘাত করল। একবার শুধু ‘ওক’ করে একটা শব্দ। তারপরই গল গল করে রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগল ছেলেটির মুখ দিয়ে।
মেয়েদুটি সভয়ে পিছিয়ে এসে বলল, এ কী? এ কী করলে ভাই? ও যে মরে যাবে। এ তো খুন!
কিন্তু আমি তো তোমাদেরই মর্যাদা রক্ষা করতে…।
ওই দেখো ওর জিভটা কীরকম বেরিয়ে আসছে। পালাও পালাও, তুমি এখান থেকে। এখুনি পালাও। আমরা কাউকে কিছু বলব না। তুমি শিগগির পালাও। নইলে তোমাকে পুলিশে ধরবে।
দীপংকর হতচকিত। কী যে করবে তা সে ভেবে পেল না। এমনটি হবে তা ভাবতেও পারেনি ও। কী করতে গিয়ে কী হয়ে গেল। দীপংকর খুন করল! তার মানে এবার পুলিশ ওকে খুঁজবে। ধরা পড়লে বিচার হবে। ফাঁসি হবে কি? যাবজ্জীবন কারাদণ্ড তো হবেই। শিশু অপরাধীদের জেলে ওকে রাখা হবে। উঃ। সে কী ভয়ংকর ব্যাপার। খাঁচার পাখির মতো বন্দি হয়ে থাকতে হবে সারা জীবন। ওর দিকে আঙুল দেখিয়ে লোকে বলবে ‘ওই যে দেখছ ছেলেটা, ও খুনি।’ তার মানে আজ থেকে দীপংকর ও কুন্দনলাল এক।
দীপংকর দেখল সেই বখাটে ছেলেটা দু’হাতে পেট চেপে লুটিয়ে পড়ল রাস্তার ওপর।
মেয়েদুটি এক ফাঁকে কখন সরে পড়েছে।
ওই তো দূরে একটা কীসের যেন হেড লাইট এগিয়ে আসছে না? নিশ্চয়ই পুলিশের গাড়ি। না হলে এমন সময় আলো জ্বেলে ওই গাড়িটা এদিকেই বা আসবে কেন? দীপংকর আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। যেদিকে এসেছিল সেইদিকেই ছুটল। ছুট—ছুট—ছুট।
ফরসোর রোড পার হয়ে আবার সেই ট্রেলপারে এসে হাঁসফাঁস করে হাঁপাতে লাগল। এ কী! পুলিশ কেন? খইনি টিপতে টিপতে দুটো পুলিশ যে এদিকেই আসছে। ওরা কি ওয়ারলেসে খবর পেয়ে গেছে! নিশ্চয়ই পেয়েছে এবং সেই খবর পেয়েই ওকে ধরবে বলে আসছে ওরা।
দীপংকর আবার ছুটল।
ছুটতে ছুটতে এক জায়গায় এসে পড়তেই…
ক্যাক ক্যাচ। খুব জোরে ব্রেক কষল গাড়িটা। আর একটু হলেই থেঁতলে যেত দীপংকর। তবু যেটুকু ধাক্কা ও পেয়েছে তাতেই একটু একটু করে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে গেল।
লরির ড্রাইভার বলল, খুব বেঁচে গেছে এ যাত্রা।
আর একজন কে বলল, ইন্টারন্যাল হ্যামারেজ হয়ে যেতে পারে। কী করব ওস্তাদ, এখানেই ফেলে রেখে যাব, না তুলে নেব গাড়িতে?
দীপংকর চোখ না-মেলেই বুঝল একজন লোক পাঁজাকোলা করে তুলে নিল ওকে। ওর মাথাটা আরও ঝিম ঝিম করতে লাগল। তারপর আর কিছুই ওর মনে নেই।
জ্ঞান যখন ফিরল তখন ভোরের আভাস অল্প অল্প করে ফুটে উঠছে। দূর আকাশে তারার দীপগুলি নিভু নিভু। দ্রুতগামী ট্রাকের ওপর শুয়ে অসহায় দীপংকর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। এ কোন দেশ? এ কোন রাজ্যে ও এসে পড়েছে? কী চমৎকার বাতাসের ঘ্রাণ এখানকার। নিশ্বাস নিতে বুক যেন ভরে উঠল।