গানের কথা : ভারত ও কাবুল
শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, কে জানিত কাবুলিও গান গায়।
কিন্তু সত্যই কাবুলি গান গাইতে আর শুনতে ভালোবাসে।
কাবুলে কিন্তু লোকসঙ্গীতেরই রেওয়াজ বেশি। কাবুলে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা কম, এবং সে সঙ্গীতে তার নিজস্ব কোনও ঐতিহ্য নেই বলে সে সম্পূর্ণ নির্ভর করে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওপর। কাবুল শহরে যে দু চারজন কালোয়াত আছেন তাঁরা প্রায় সকলেই উত্তর-ভারতে বাস করে সদ্গুরুর কাছ থেকে কলাচর্চা শিখে গিয়েছেন। তবে উচ্চারণের বেলা খাঁটি হিন্দি গানে তাঁরা একটুখানি বিব্রত হয়ে পড়েন যদিও উর্দু গজল গাইতে তাঁদের তেমন কোনও অসুবিধা হয় না।
যাদের রেডিও আছে, তাঁরা প্রায়ই ভারতীয় কেন্দ্র থেকে আমাদের ওস্তাদি, গজল-গীত শুনে থাকেন।
কাবুলিরা খাস আরবি, ইরানি বা তুর্কিস্তানি সঙ্গীত শুনে সুখ পান না।
তাই যখন খবর এল, পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর কাবুলে গান গাইতে গিয়েছেন তখন আনন্দিত হলুম। এঁর পূর্বে কজন সত্যকার ওস্তাদ কাবুলে গিয়েছেন সেকথা আমার জানা নেই, তবে দু চারজন গিয়ে থাকলেও ওঙ্কারনাথ যে সেখানে রাজসম্মান পাবেন সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না।
কার্যত তাই হয়েছে।
একদা কাবুলের রাজা যেরকম শ্রমণ হিউয়েন সাঙকে সাদর অভ্যর্থনা করেছিলেন ঠিক তেমনি কাবুলের আজকের রাজা পণ্ডিত ওঙ্কারনাথকে সহৃদয় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। রাজা জহির শাহ পণ্ডিতজিকে বলেন, রেকর্ডে পণ্ডিতজির সঙ্গীত শোনার সৌভাগ্য তার পূর্বেই হয়েছিল; কিন্তু মুখোমুখি তাঁর আপন কণ্ঠের গান শোনার সুযোগ তার জীবনে এই প্রথম।
কাবুলিরা তাগড়া জাত; তারা সঙ্গীতে শুরুগম্ভীর কণ্ঠ পছন্দ করে। ঠিক ওই বস্তুটিই পণ্ডিতজির আছে– তিনি গাইতে আরম্ভ করলে সভাস্থল গমগম করতে থাকে। তিনি যে শুধু এদেশে সুখ্যাত তাই নয়, ইয়োরোপও তাঁর গলা শুনে মুগ্ধ হয়েছে। আমার এক জর্মন বন্ধু পণ্ডিতজির ‘নীলাম্বরী’তে গাওয়া ‘মিতুয়া’ রেকর্ডখানা বাজিয়ে বারবার আনন্দোল্লাস প্রকাশ করেন।
তাই ওঙ্কারনাথ যে কাবুলে অকুণ্ঠ উচ্চকণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করতে পেরেছেন তাতে আশ্চর্য হবার কী!
কিন্তু এই কি শেষ?
হাউই জ্বলে ছাই হয়ে যাওয়ার পূর্বে তার শিখা দিয়ে যে লোক তার মাটির প্রদীপটি জালিয়ে নেয় সে-ই বুদ্ধিমান। ওঙ্কারনাথ কাবুলে যে আতসবাজি দেখিয়ে দিলেন তার জের এখানেই শেষ হওয়া উচিত নয়। ওরই খেই ধরে অনেক কিছু করবার আছে।
বিদেশি কত ছাত্র ভারতীয় সরকারের বৃত্তি নিয়ে এদেশে এসে ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি শিখে যায়। এসব বিদ্যা আমাদের নিজস্ব নয়, ইয়োরোপের কাছ থেকে শেখা। এগুলোতে আমাদের আপন কোনও গর্ব নেই। কিন্তু কাবুলি ‘শাগরেদ’ যদি ভারতে এসে আমাদের নিজস্ব সঙ্গীত শিখে যায় তবে তাতে ভারতের গর্ব ষোল আনা; এই করেই পুনরায় ভারত-আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক যোগসূত্র স্থাপিত এবং দৃঢ়ীভূত হবে। ভারত সরকারের উচিত তার সুব্যবস্থা করা– আফগানিস্তান আমাদের তুলনায় গরিব দেশ। (আরেকটা কথা ভুললে চলবে না। কাবুলে পাশ্চাত্য ‘জাজ’ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে; আমরা যদি এই বেলা জোর হাতে হাল না ধরি তবে একদিন দেখতে পাব, কাবুল আর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতে চায় না।)
দ্বিতীয়ত, এদেশ থেকে ছাত্র কিংবা অধ্যাপক পাঠাতে হবে কাবুল গিয়ে অনুসন্ধান করতে, আমাদের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এবং নৃত্য একদা কাবুলে কতখানি প্রচারিত এবং প্রসারিত ছিল এবং অদ্যকার পরিস্থিতিই-বা কী! তাঁকে প্রস্তাব করতে হবে, কী করলে আমাদের সঙ্গীত সে দেশে আপন অর্ধলুপ্ত গৌরব পুনরায় উদ্ধার করতে সক্ষম হবে।
এসব কর্ম যত শীঘ্র করা যায় ততই মঙ্গল।
আমি চেষ্টা করছি, কাবুলি খবরের কাগজ থেকে পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের বিজয় অভিযান উদ্ধার করতে।– শক্ত কাজ। দিল্লিতে তো আর কাবুলি সংবাদপত্র বিক্রয় হয় না! পেলেই কিন্তু পেশ করব।