গাইড
দিল্লিতে একটি সরকারি টুরিস্ট ব্যুরো বসেছে। তার প্রধান কর্ম টুরিস্টদের সদুপদেশ দেওয়া, এটা-সেটা করে দেওয়া এবং বিচক্ষণ গাইডের তদারকিতে শহরের যাবতীয় দ্রষ্টব্য বস্তু দেখানো।
এই সম্পর্কে এক ভদ্রলোক খবরের কাগজে চিঠি লিখতে গিয়ে জানিয়েছেন, দিল্লিতে বিচক্ষণ গাইডের বিলক্ষণ অভাব। আমি পত্ৰলেখকের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।
‘পাণ্ডা’ এবং ‘গাইড’ হরেদরে একই মাল। তীর্থস্থানের গাইডকে পাণ্ডা বলা হয় তাই গয়াতে আপনি পাণ্ডা ধরেন, কিংবা বলুন, পাণ্ডা আপনাকে ধরে– আর ঐতিহাসিক ভূমি এবং তীর্থক্ষেত্রের যদি সমন্বয় ঘটে তবে সেখানে পাণ্ডা এবং গাইডের সময় হয়। যেমন জেরুজালেম। তিন মহা ধর্ম– ক্রিস্টান, ইহুদি এবং মুসলমান এখানে এসে সম্মিলিত হয়েছে। তার ওপর জেরুজালেমের অভেজাল ঐতিহাসিক মূল্যও আছে। ফলে পৃথিবীর হেন দেশ হেন জাত নেই যেখান থেকে তীর্থযাত্রী (পাণ্ডার বলির পাঁঠা) এবং টুরিস্ট (গাইডের কুরবানির বকরি) জেরুজালেমে না আসে।
দিল্লি অনেকটা জেরুজালেমের মতো। এর ঐতিহাসিক মূল্য তো আছেই, তীর্থের দিক দিয়ে এ জায়গা কম নয়। চিশতি সম্প্রদায়ের যে পাঁচ গুরু এদেশে মোক্ষলাভ করেছেন তাঁদের তিনজনের কবর দিল্লিতে। কুতুবমিনারের কাছে কুৎব উদ্দিন বখতিয়ার কাকির (ইনি ইলতুৎমিশ-অলতমশের গুরু) কবর, হুমায়ুনের কবরের কাছে নিজাম উদিন আওলিয়ার কবর (ইনি বাদশা আলা উদিন খিলজি এবং মুহম্মদ তুগলকের শুরু) আর দিল্লির বাইরে শেষ শুরু নাসির উদিন ‘চিরাগ দিল্লি’র কবর। আর কালকাজি, যোগমায়া তো আছেনই।
এসব জায়গায় পাণ্ডারা যা গাঁজাগুল ছাড়ে সে একেবারেই অবর্ণনীয়। এদিকে বলবে এটা হচ্ছে আকবরের দুধ-ভাইয়ের কবর, ওদিকে বলবে, তিন হাজার বছরের পুরনো এই কবরের উপরকার এমারত!
বেঙ্গল কেমিকেলের আমার এক সুহৃদ গিয়েছিলেন বৃন্দাবন। পাণ্ড দেখালে এক দোলনা– ভক্তিভরে বললে, এ দোলনায় দোল খেতেন রাধাকৃষ্ণ পাশাপাশি বসে। বন্ধুটি নাস্তিক নন, সন্দেহপিশাচ। বললেন, “যে কড়ির সঙ্গে দোলনা ঝোলানো রয়েছে, তাতে তো লেখা রয়েছে, টাটা কোম্পানির নাম; আমি তো জানতুম না, টাটা এত প্রাচীন প্রতিষ্ঠান!’
পরদিন বৃন্দাবন থেকে সজল নয়নে বিদায় নেবার বেলা বন্ধু সে জায়গায় গিয়ে দেখেন, কড়িতে প্রাণপণ পলস্তারার পর পলস্তারা রঙ লাগানো হচ্ছে।
***
দিল্লিতে ভালো গাইডের সত্যই অভাব। সখা এবং শিষ্য শ্রীমান বিবেক ভট্টাচার্য কপালি লোক। তিনি কখনও কখনও ভালো গাইড পেয়ে যান– সে বিষয়ে তিনি দেশে মনোরম প্রবন্ধ লিখেছেন কিন্তু সচরাচর আপনার কপালে এখানে যা গাইড জুটবে তারা না জানে ইতিহাস এবং না পারে ছড়াতে গাঁজা-গুল।
ভালো গাইড মানে কথকঠাকুর, আর্টিস্ট। তাঁর কর্ম হচ্ছে, ইতিহাস আর কিম্বদন্তি মিলিয়ে মিশিয়ে আপনাকে গল্পের পর গল্প বলে যাওয়া, আর সেসব গল্প শুনে আপনি এত খুশি যে দিনের শেষে তাঁকে পাঁচ টাকা দিতে আপনার বুক কচকচ করে না।
একদা ভিয়েনা শহরে আমি এইরকম একটি গাইড পেয়েছিলুম। শহরের দ্রষ্টব্য বস্তু দেখাতে দেখাতে বলল, ‘এই দেখুন শ্যোনব্রুন প্রাসাদ। রাজাধিরাজ ফ্রানৎসয়োসেফ এখানে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখতেন পল্টনের কুচকাওয়াজ। দেশ-বিদেশের গেরেমভারি রাজকর্মচারী রাজদূতেরা হুজুরের চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে দেখতেন আমাদের শৌর্য-বীর্য আমাদের ঐশ্বর্য। তার পর হুজুর বেরুতেন সোনার পাত মোড়া গাড়িতে, বিবি সাহেবা বেরোতেন রুপোর গাড়িতে। আহা, কোথায় গেল সেসব দিন!’
খানিকক্ষণ পর বাড়ি ফেরার পথে গাইড বলল, ‘দেখুন দেখুন, এই ছোট্ট বাড়িখানা, ফ্রান্সয়োসেফ যেরকম রাজার রাজা ছিলেন, ঠিক তেমনি সঙ্গীতে রাজার রাজা বেটোফেন দৈন্যে-ক্লেশে কাতর হয়ে এই লজঝড় বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর শেষ কটি সিমফনি সেই ত্রিলোকবিখ্যাত স্বর্গীয় সঙ্গীতসুধা কে না পান করেছে বলুন– তিনি এইখানেই রচেছিলেন।’
আমি করজোড়ে সে বাড়িতে নমস্কার করলুম দেখে গাইডের হৃদয়ে বিষাদে হরিষ দেখা দিল। ট্যাক্সিওয়ালাকে বললেন, ‘একটুখানি চক্কর মেরে বেটোফেন যে বাড়িতে দেহত্যাগ করেছিলেন সেইটে দেখিয়ে দাও।’
সে বাড়ির সামনে আমরা দু জনাই নিস্তব্ধ। এই জীর্ণ-শীর্ণ দরিদ্র গৃহে রাজাধিরাজ বেটোফেন দেহত্যাগ করলেন!
***
আমরা বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ গাইড ট্যাক্সিওয়ালাকে বললেন, “একটু তাড়াতাড়ি চালাও বাছা, ওই পাশের বাড়িতে আমার শাশুড়ি থাকেন, খাণ্ডার রমণী, পাছে না দেখে ফেলে।’