গতি ও স্থিতি

গতি ও স্থিতি

জীবনযাত্রা পরিবর্তনশীল। জীবন তা নয়। সেই জন্ম সেই মৃত্যু, সেই জরা সেই ব্যাধি, সেই যন্ত্রণা সেই বেদনা, সেই শোক সেই দুর্ভোগ। আবার সেই কামনা সেই বাসনা, সেই প্রেম সেই প্রীতি, সেই বিরহ সেই মিলন, সেই মমতা সেই মায়া।

সাহিত্য যদি পরিবর্তনশীলের সঙ্গে গাঁটছড়া বঁাধে তাহলে সাহিত্যে আর সাংবাদিকতায় প্রভেদ থাকে না। সাহিত্যের গাঁটছড়া জীবনযাত্রার সঙ্গে নয়, জীবনের সঙ্গে। তা বলে সাহিত্যে পরিবর্তনের প্রতিফলন থাকবে না তা নয়। তার সমালোচনা থাকবে না তা নয়। পরিবর্তনের সঙ্গে তার বিরোধও নেই। সেনিজেও তো যুগে যুগে বদলে যায়। বদলাতে বদলাতে সাহিত্যই থাকে।

মানুষের জীবনযাত্রা কোনোদিনই অপরিবর্তনীয় ছিল না। যুগে যুগে পরিবর্তিত হতে হতে দু-তিনশো বছর আগে সব দেশেই মোটের উপর একই রূপ ধারণ করেছিল। অধিকাংশ লোক কৃষিজীবী, কারুশিল্পজীবী। গ্রামেই তাদের বসতি। অল্পলোকের বাস শহরে। তারা বাণিজ্য করে, রাজ্য চালায়। সংস্কৃতিও তাদেরই সঙ্গে জড়িত। যদি না হয় লোকসংগীত বা রূপকথা বা ছড়া।

তারপর এই দু-তিনশো বছরে জীবনযাত্রার রূপ সব দেশেই কম-বেশি বদলে গেছে, বদলে গিয়ে একই রূপ হয়েছে বা হতে চলেছে। সর্বত্র গ্রাম হটে যাচ্ছে, কৃষি হটে যাচ্ছে, কারুশিল্প হটে যাচ্ছে, শহর বেড়ে যাচ্ছে, তার বহর বেড়ে যাচ্ছে, তার আকর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে, বাণিজ্য ফেঁপে উঠছে, যন্ত্রশিল্প বলে একটা নতুন জিনিস ভুঁই ফুঁড়ে উঠছে, মানুষ এখন আকাশে উড়ছে। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে উড়ে যেতেও পারবে। যদি নিজের তৈরি পারমাণবিক অস্ত্রে নিজেকেই ধ্বংস না করে।

এই যে রূপান্তর, এর কোথাও পুরাতন স্বাভাবিক ছন্দ নেই, মন্থর গতি নেই। সর্বত্র তোলপাড়, বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয়। কোথাও বেশি, কোথাও কম। ইংল্যাণ্ডে যা হতে দেড়শো বছর লেগেছে, রুশ দেশে পঞ্চাশ বছর, ভারত হয়তো তাকে ত্রিশ বছরে নিষ্পন্ন করবে। করতে গিয়ে বিপর্যস্ত হবে। খুব কম সময়ের মধ্যে খুব বেশি অদলবদলের যে গতিবেগ তা মানুষের জীবনযাত্রাকে লন্ডভন্ড করে। ধনতন্ত্রের জায়গায় সমাজতন্ত্র বললেও গতিবেগের ইতরবিশেষ হয় না। অস্থিরতা লেগেই থাকে।

আলোড়নের ফলে ক্ষুণ্ণ হয় পূর্বপুরুষেও ধর্ম, সমাজব্যবস্থা, পরিবারের গড়ন, রীতিনীতির প্রবর্তন হয়। এসব পরিবর্তনের তলে তলে কাজ করছে কয়েকটি আইডিয়া ও আইডিয়াল। মানুষ ইচ্ছা করলে বিশ্বনিয়ন্তা হতে পারে, প্রকৃতির নিয়ন্তাও হতে পারে। ব্যক্তি হিসাবে সেযতই দুর্বল হোক-না কেন সমষ্টি হিসাবে সেপ্রবলপ্রতাপ। সকলের সব দুঃখ দূর হওয়া সম্ভব। জগৎটা মায়া নয়। মর্ত থেকে স্বর্গে যাবার স্বপ্ন না দেখে স্বর্গকেই মর্তে নামিয়ে আনা যায়। সব মানুষই সমান। সব মানুষই স্বাধীন। মৈত্রীই কাম্য, তবে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত থাকাই সুবুদ্ধি। মানবিক ব্যাপারে অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃতের স্থান নেই। যুক্তি আর বিবেক হবে চিন্তা ও কর্মের নিয়ামক। ভগবান থাকতেও পারেন না-থাকতেও পারেন, কিন্তু মানুষ তো আছে। সেযদি ইচ্ছা করে ও সাধনা করে তবে অতিমানব হতে পারে। পারফেকশন লাভ করতে পারে। মৃত্যুকে জয় করতে না পারলেও ব্যাধিকে ও জরাকে জয় করতে পারে।

গত দুই মহাযুদ্ধে মানবিকবাদীদের মানবের উপর বিশ্বাস মানবভাগ্যের উপর বিশ্বাস গুরুতর ধাক্কা খেয়েছে। প্রকৃতির হাতে নয়, ভগবানের হাতে নয়, মানুষেরই হাতে। সেইজন্যে ধাক্কা সামলে নেওয়াটাই আপাতত প্রাথমিক কাজ। তার জন্যে বেশ কিছুকাল শান্তি। গত শতাব্দীটা মোটের উপর শান্তিতে কেটেছিল বলেই মানুষ ইহলোকেই স্বর্গসুখের কল্পনা করতে পেরেছিল। কিন্তু একটার পর একটা মহাযুদ্ধ ঘটবার পর মানুষ আর সহজে বিশ্বাস করতে পারছে না যে মহাযুদ্ধের দিন গেছে, সম্মুখে মহাশান্তি।

গত শতাব্দীর ফ্রি উইলের সেপ্রতিপত্তি আর নেই। একজন কি দুজন মানুষের বুদ্ধির দোষে বা ভুলে বা আকস্মিকভাবে যেকোনো দিন একটা মহামারি বেঁধে যেতে পারে। কেই-বা বেঁচে থাকবে যে সেই একজন বা দুজনকে দায় করবে বা সেই আকস্মিকতাকে আয়ত্তে আনবে। এটা যদি সাধারণ মানুষের হাতে না হয় তবে ফ্রি উইলের তাৎপর্য কী? তা হলে ডিটারমিনিজমের উপরে ছেড়ে দিতে হয়। মানুষ নিমিত্তমাত্র। ঐতিহাসিক শক্তির দ্বন্দ্বে সেসতরঞ্চের বোড়ে। তার ধারণা সে-ই চালক। ধারণাটা ফাঁপা।

সাধারণ মানুষ ইচ্ছা করলে আত্মাহুতি দিতে পারে। সেইভাবে ফ্রি উইলকে জিতিয়ে দিতে পারে। ডিটারমিনিজমকে অস্বীকার করতে পারে। ‘না’ বলার ক্ষমতা এখনও সাধারণ মানুষের হাতে। যেকোনো মানুষের হাতে। কোনো মানুষই সম্পূর্ণ অসহায় নয়। দুর্বলতম মানুষেরও আত্মিক বল আছে। কিন্তু তা হলে মধ্যযুগের সন্তদের মতো আগুনে পুড়ে আত্মিক বলের সাক্ষ্য দিতে হয়। সেদিক থেকে তিনশো বছর পেছিয়ে যেতে হয়। পেছিয়ে যাওয়া ও এগিয়ে যাওয়া দুই-ই কেমন করে হতে পারে? আর পেছিয়ে গেলে গ্রামে ফিরে যেতে হয়, সরলতর জীবনে ফিরে যেতে হয়। জটিলতর সভ্যতার থেকে পিছু হটা কি মুখের কথা! যখন দেখা যাচ্ছে শহরের দিকেই ঐশ্বর্যের দিকেই গড্ডালিকাপ্রবাহ।

যার চোখ আছে সে-ই দেখছে যে বিশ্বরঙ্গমঞ্চে এক বিরাট নাটকের অভিনয় চলেছে। তার কয়েক অঙ্ক শেষ হয়েছে, কয়েক অঙ্ক এখনও বাকি। এটা ইন্টারভ্যাল। পরাক্রান্ত ঐতিহাসিক ও নৈতিক শক্তিসমূহ লীলা করছে।

সঙ্গে সঙ্গে এও দেখতে পাচ্ছে যে একে একে নিবিছে দেউটি। মানুষের প্রাণ এখন কীটপতঙ্গের মতো মূল্যহীন। সেনারীই হোক আর শিশুই হোক তার প্রাণ থাকা-না-থাকা সমান। যুদ্ধে যেটুকু দয়ামায়া ছিল এখন সেটুকু উঠে গেছে। সেটা এখন ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য। যেমন হৃদয়বত্তার স্থান নেই তেমনি বিবেকেরও স্থান নেই। ন্যায়-অন্যায় বিবেচনাও দুর্বলচিত্ততা। বিজ্ঞান মানুষকে যতই শক্তিমান করছে ততই দেখা যাচ্ছে সেহৃদয়হীন বিবেকহীন প্রাণ সম্বন্ধে শ্রদ্ধাহীন মারণযন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। মানুষের পক্ষে এটা গৌরবের কথা নয়।

পক্ষান্তরে মারণাস্ত্রের মার খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ও লড়তে থাকাও কম গৌরবের কথা নয়। অতি সাধারণ মানুষও অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিচ্ছে, হার মানছে না, আত্মসমর্পণ করছে না। এটাও তো গণনার মধ্যে আনতে হবে। মানবাত্মা যতদিন অপরাজিত থাকবে ততদিন মানবের উপর বিশ্বাসও থাকবে। একটা দেশ হয়তো সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়েও প্রমাণ করে যাবে যে সেঅপরাজিত ও অনবরত। পরিণামে অন্তঃপরিবর্তন ঘটবে। আর সব পরিবর্তন বাহ্য। অন্তঃপরিবর্তনই সবচেয়ে মূল্যবান। আমাদের যুগ তার জন্যেই প্রতীক্ষমাণ।

সাহিত্যিক এখন কী করবে? একে তো জীবন থেকে মহত্ত্ব চলে যাচ্ছে, হৃদয় থেকে করুণা, প্রাণ থেকে প্রাণের প্রতি শ্রদ্ধা, চরিত্র থেকে ন্যায়-অন্যায় বোধ। এই অমানবিকতার উপর কোনো বড়ো সাহিত্য দাঁড়াতে পারে না। সাহিত্যিকের কাছে এর মতো প্রতিবন্ধক আর কী আছে? অবশ্য সব প্রতিবন্ধকের পাশ কাটিয়ে যাবার কৌশল খুঁজলেই মেলে। তা হলেও মানতে হবে সেসাহিত্য কখনো মহৎ হতে পারে না, যদি জীবন থেকে মহত্ত্ব চলে যায়; জীবনের কোনো একটি কোণে যদি-না একটুখানি মহত্ত্বের সলতে জ্বলতে থাকে; যার আলো সাহিত্যের উপরেও পড়বে।

দেউটি যদি একবার নিবে যায় তো বহু শতাব্দীর জন্যে নিবে যাবে। এমনি করেই এক-একটা সভ্যতা দেউলে হয়ে গেছে। মূল্যগুলোই হচ্ছে দীপ। মূল্য চলে গেলে দীপ নিবে যায়। আমরা যেন একটা অন্ধকার হতে থাকা প্রেক্ষাগৃহে বসে নাটকের অভিনয় দেখছি আর সেনাটক ক্রমশ ক্লাইম্যাক্সের দিকে চলেছে। ট্র্যাজিক ক্লাইম্যাক্স। অবশ্য মন্দের ভিতর থেকে ভালো আসবে; অন্তঃপরিবর্তন এই যা সান্ত্বনা। আরেক সান্ত্বনা এই যে নাটকটা চিত্তাকর্ষক।

সাহিত্যিককে আত্মরক্ষা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে তার আপনার আত্মাকে। সেনিজে অমানবিক হবে না। অপ্রমত্ত থাকবে। বিবেকহীন হবে না। হৃদয়বান হবে। শাশ্বত মূল্যরাজি অবিকৃত থাকবে। চিরন্তন সত্য শিব সৌন্দর্যকে, প্রেম মৈত্রী করুণাকে সযত্নে পাহারা দেবে। এর জন্যে যদি দুঃখ পেতে হয় দুঃখ পাবে। যদি প্রাণে মরতে হয় তাও শ্রেয়।

তারপর এই অন্ধকারের মধ্যে আলো খুঁজতে হবে। আলো যে কোনোখানেই নেই তা নয়। প্রত্যেক মেঘের রুপালি পাড় থাকে। অন্ধকারের ছিদ্রে ছিদ্রে আলোক প্রবেশ করে। সাহিত্যিকের দৃষ্টি অন্ধকারেও অন্ধ হয়ে যায় না। তার চোখ সব অবস্থায় খোলা থাকে। আলোর রেখা সে-ই সর্বপ্রথম দেখতে পায়।

রিয়্যালিটির অভ্যন্তরে যেতে হলে আরও এক জোড়া চোখ চাই। নাটক দেখতেও তো অপেরা গ্লাস লাগে। অনেকসময় চোখ বুজে দেখাই আসল দেখা। দৃশ্যমান জগতের পিছনে যে সত্য আছে তাকে উদ্ধার করতে হলে চাই ধ্যানদৃষ্টি।

স্থিতি একটা জায়গায় আছেই, যেখানে এ জগৎ স্থিত। কেউ একে ধ্বংস করতে পারবে না। তেমনি মানুষকেও, তার সত্যকেও। সত্যিকার জীবনকেও। গতি যেখানেই নিয়ে যাক স্থিতি সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। আকাশের ধ্রুবতারার মতো। শাশ্বত মূল্যরাজি নির্বাপিত হবে না, হতে পারে না। যখন মনে হবে যে নিবে গেছে তখনও জ্বলতে থাকবে।