গড় হেকিমপুরের রাজবাড়ি – ৬

পুতুল বহুদিন চুপ করে আছে। কোনও প্রশ্নেরই জবাব নেই। তবু পুতুলটাকে লুকিয়ে রাখে সাতকড়ি। রোজ নিজের বালিশে শোয়ায়। আর কী যত্ন করবে তা ভেবে পায় না। হয়তো আর কথা কইবার দরকার নেই, হয়তো কথা ফুরিয়ে গিয়েছে, কিংবা হয়তো এবার সত্যিকারের পুতুলই হয়ে গিয়েছে। কে জানে!

তাই সাতকড়ির মনটা বড্ড খারাপ ।

রানিমা একদিন তাকে ডেকে বললেন, “হ্যাঁ রে, তোর মুখটা অমন শুকনো কেন রে? মনটা কি ভাল নেই? কী হয়েছে?”

“কিছু না রানিমা, এমনি এখানে আর ভাল লাগছে না। আমি তো বাউন্ডুলে মানুষ। মনে হয় এবার আপনাদের কাছ থেকে ছুটি নেওয়ার সময় হয়েছে।”

“বলিস কী? তুই কি আর আমাদের কাজের লোক? তোকে তো আমার ছেলে বলেই মনে হয়। রাজামশাইও বলছিলেন, আজকাল নিজের ছেলেও এত করে না, তুই আমাদের জন্য যতটা করেছিস। আমরা দু’জনে মিলেই ঠিক করেছি, এই বাড়িঘর আর সামান্য যে জমিজমা আছে, সব তোকে দিয়ে যাব। আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবি বাবা? আমাদের সুদিন থাকলে তোর একটা হিল্লে করেই যেতাম। এখন কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা আছে সব জড়ো করলে খুব কম হবে না। তুই জোয়ান মানুষ, খেটেখুটে ঠিক উপায় করতে পারবি। আমাদের আদায়উশুল করার লোক নেই বলে জমিজমা থেকে কিছুই আসে না। তুই উঠেপড়ে লাগলে ঠিক আদায় হবে।”

সাতকড়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “একটু ভেবে দেখি রানিমা। মনটা ভাল নেই।”

“আমি তো মায়ের মতোই, আমাকে বলা যায় না?” “কী বলব, তা বুঝতে পারছি না। শুনলে আপনি হয়তো হাসবেন।”

“তোর যাতে মন খারাপ হয়েছে, তা শুনে হাসব কেন রে?” “আপনাদের গোলঘরের তিন নম্বর আলমারিতে একটা সবুজ পোশাক পরা পুতুল আছে জানেন?”

রানিমা হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “জানব না কেন? খুব জানি। ওই পুতুল চুরি করতে কতবার চোর এসেছে।”

‘‘আপনি কি জানেন, পুতুলটা কথা কইতে পারে?”

“জানি বাবা, খুব জানি। ও আসলে পুতুল না আর কিছু, তা জানি না। শুধু লক্ষ করেছি, বেশি ঘাঁটাঘাঁটি পছন্দ করে না। ওকে ওর জায়গাতেই রেখে দিলে খুশি হয়।”

“যদি চুরি হয়ে যায়?”

“সে ভয় নেই। কাঁচা চোর হলে ও নিজেই ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়, আর পাকা চোর হলে পালিয়ে আসে আমার বা রাজামশাইয়ের কাছে। কিন্তু কাছে রেখে দেখেছি, বড্ড চুপ হয়ে যায়।”

“ওকে আমি আমার কাছেই রেখেছি। আর কথা কইছে না।”

রানিমা হেসে বললেন, “সেদিন চোর এসেছিল বলে কি তোর কাছে পালিয়ে এসেছিল?”

“হ্যাঁ মা।”

“এখন থেকে আমাকে মা বলেই ডাকিস, রানিমা নয়। বুঝেছি, তোকে ও ভাল লোক বলে চিনেছে। ওকে ওর জায়গায় রেখে দে। আমাদের অনেক বিপদ-আপদের সময় ও কিন্তু জানান দিয়েছে। রাজামশাইয়ের যখন অসুখ করেছিল, তখন ওই দর্পনারায়ণই বলেছিল অটোয়ালের কাছে ধার করতে। আমি বললুম, শোধ দেব কেমন করে। তখন বলেছিল, শোধ হয়ে যাবে। এমনকী, তুই আসার আগে যখন কাজের লোকের অভাবে আমি খুব কষ্টে পড়েছিলাম বাতব্যাধিতে কাতর হয়ে কাতরে কাতরে রান্নাবান্না করছি, তখন একদিন দুপুরবেলা বলে উঠল, লোক আসবে। ভাল লোক।”

“সত্যি, মা?”

“হ্যাঁ বাবা, তুই এলি বলেই তো বাঁচলুম।”

“ওর নাম কি দর্পনারায়ণ রেখেছেন?”

“আমি না, তোদের রাজামশাই রেখেছেন। ওর গলার স্বর নাকি হুবহু রাজামশাইয়ের ঠাকুরদা দর্পনারায়ণের মতো। দাদু ওঁকে বড্ড ভালবাসতেন, তাই ওঁর বিশ্বাস, ওর দাদুই পুতুলে ভর করে আছেন। কী জানি বাবা কী। দুনিয়ায় কত রহস্যই যে আছে।”

সাতকড়ি একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, “আমার ভুল হয়েছিল মা, আমি তোমাদের ছেড়ে যাব না।”

রানিমার মুখে সূর্যোদয়ের মতো একটা হাসি ফুটে উঠল।