গড় হেকিমপুরের রাজবাড়ি – ৫

সাতকড়ি লাজুক মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আজ্ঞে, আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলা আমার আস্পদ্দার সমান। আমি তো সামান্য মানুষ। কথাটথাও বিশেষ আসে না আমার। আমার নিবেদন হল, আপনাদের আর কষ্ট করে টাকা তুলতে হবে না। হাটের মানুষজন, ব্যাপারীরাই প্রায় আড়াই লাখ টাকা তুলে দিয়েছে।”

শুনে সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল। গজপতি বলল, “তার মানে কী? শুধু হাটখোলার লোকেরা দিলেই হবে? আমরা এখনও বেঁচে আছি না!হাটখোলার কাছে ছোট হয়ে যাব নাকি হে!কী বলেন আপনারা?”

উমাপদবাবু উঠে বললেন, “কক্ষনও না। আমরা যদি ওর ডবল তুলে না দিই তা হলে আমার নাম পালটে রাখব, এই বলে দিলাম।”

কানাইমাস্টার বলল, “অবশ্যই। দরকার হলে আমি আমার বউয়ের গয়না দিয়ে দেব। আমার এক পূর্বপুরুষ তো রাজাদের পাঠশালে পড়াতেন। সম্পর্ক আজকের নয় বাপু।”

যদু ঘোষ বলে উঠল, “আমি দশ হাজার দেব বলে ঠিক করেছিলাম, ওটা ডবল করে বিশ হাজার করলাম। আমার ঊর্ধ্বতন চতুর্থ পুরুষ রাজবাড়ির পালপার্বণে দই আর মন্ডামেঠাই সাপ্লাই দিতেন।”

ভোলাবাবু অনেকক্ষণ ধরে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করছিলেন। এবার বললেন, “আচ্ছা, এটা কি গড় হেকিমপুরের রাজবাড়ির কথা বলা হচ্ছে?”

গজপতি রাগের গলায় বলে, “ভোলাদা, সব সময়ে মেঘের রাজ্যে বাস করলে কি হবে? মাঝে-মাঝে একটু ধরাধামেও তো নামতে হবে, নাকি?”

এক পূর্বপুরুষ, কত নম্বর তা বলতে পারব না, তবে তিনি রাজসভার পণ্ডিত ছিলেন। রাজবাড়ির প্রতি আমারও কর্তব্য আছে।”

গজপতি বলে, “ওহে সাতকড়ি, বাড়তি টাকাটা দিয়ে রাজবাড়ির সংস্কার হবে। ওরকম ভূতুড়ে চেহারা পালটে যাতে রাজবাড়ির মতোই দেখায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।”

“যে আজ্ঞে। আপনারা বড্ড ভাল লোক, এত ভাল লোক আমি

আর দেখিনি!” সাতকড়ির চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে লাগল। গজপতি বলল, “তুমিও বড়ই ভাল। রাজামশাই আর রানিমাকে তুমি আগলে না রাখলে কী যে হত?”

তিনদিনের মধ্যেই আরও প্রায় পাঁচ লাখ টাকা উঠে এল। একুনে দাঁড়াল প্রায় সাড়ে সাত লাখ। একেবারে ভাসাভাসি কাণ্ড।

একদিন সকালবেলায় রাজা প্রতাপ যখন বাইরের বারান্দায় তাঁর ইজিচেয়ারে বসে আছেন তখন সাতকড়ি গিয়ে বলল, “রাজামশাই, আপনাকে আর বাড়ি ছাড়তে হবে না। টাকার জোগাড় হয়ে গেছে।”

রাজা প্রতাপ ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত গলায় বললেন, “তার মানে? টাকা কি গাছ থেকে পড়ল?’

ভোলাবাবু ভারী লজ্জিত হয়ে বলেন, “না, এই বুঝতে আমার একটু সময় লাগে।”

“এবার বুঝেছেন তো?”

“মনে হয় নির্যস বুঝতে পেরেছি। আমার মনে ছিল না, আমার

“না রাজামশাই, গড় হেকিমপুরের সবাই রাজবাড়ি বেদখল হয়ে যাচ্ছে শুনে রুখে দাঁড়িয়েছে। তারাই নিজের গরজে টাকার বন্দোবস্ত করে ফেলেছে।”

রাজামশাই বিরক্ত হয়ে বললেন, “সে কী! ওরা কেন টাকা দেবে? আর আমি নেবই বা কেন?”

“আজ্ঞে সে আপনার অভিরুচি। তবে তারা রাজা এবং তাদের রাজবাড়িকে বড্ড ভালবাসে। মুটে-মজুররা অবধি যে যা পেরেছে, দিয়েছে। রাজবাড়ি তারা কোনও মহাজনের হাতে যেতে দেবে না। এটা কিন্তু দয়া নয়, ভালবাসা।”

রাজা প্রতাপ ভ্রু কুঁচকেই বললেন, “আমার মনে হচ্ছে এর মধ্যে তুই কলকাঠি নেড়েছিস?”

“যে আজ্ঞে, কলকাঠি নাড়া নয়, তবে আমি সবাইকে ঘটনার কথা জানিয়েছি। তার বেশি কিছু করতে হয়নি। পুরো গাঁ খেপে উঠেছে।”

রাজা প্রতাপ খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। সাতকড়ি প্রমাদ গুনছিল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ গম্ভীর মুখে বসে থেকে হঠাৎ রাজা প্রতাপ ভারী প্রসন্ন মুখে একটু হাসলেন।

” “বলছিস? ওরা আমাকে ভালবাসে! রাজাদের তো আজকাল কেউই পছন্দ করে না। তবে ওরা ভালবাসে কেন?”

“তা জানি না রাজামশাই। তবে প্রায় সকলেরই রাজবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক আছে। এ বাড়িকে তারা নিজেরই বাড়ি বলে মনে করে।”

রাজাপ্রতাপ প্রসন্ন মুখে বললেন, “তাই বুঝি?” “হ্যাঁ, রাজামশাই।”

“যদি তাই হয়, তবে এ টাকা রাজবাড়ির উদ্ধারের কাজই লাগুক।” “প্রণাম রাজামশাই। আমি আসি।”

পাঁচদিনের মাথায় একদিন গড় হেকিমপুর থেকে পঞ্চাশজনেরও বেশি লোক দল বেঁধে গঞ্জে গর্দানভাই অটোয়ালের গদিতে হানা দিল। হঠাৎ দুপুরে এতগুলো লোককে একসঙ্গে দেখে অটোয়াল অবাক। ঘাবড়ানো গলায় বলল, “কী বেপার গজপতিবাবু! কী হল?”

গজপতি বলল, “আপনার কাছে রাজবাড়ি দেড় লাখ টাকায় বাঁধা আছে তো? আপনি কন্ট্রাক্টটা বের করুন। আমরা টাকা এনেছি।”

বিস্মিত অটোয়াল বলে, “আপনারা টাকা দিবেন কেনো? টাকা তো দিবেন মহারাজ।”

“মহারাজই টাকা পাঠিয়েছেন। আমরা পঞ্চাশজন আছি। পিছনে কিন্তু আরও লোক আসছে।”

অটোয়াল বিবর্ণ মুখে বলল, “হাঁ-হাঁ, কিঁউ নেহি!কিন্তু ওই ভূতের বাড়ি ডিমলিশ করে আমি একটা মডার্ন রিসোর্ট বানিয়ে দিতাম। কত অ্যাট্রাকটিভ বেপার হত?”

“আমাদের ভূতের বাড়িই ভাল লাগে অটোয়ালজি। আপনি টাকাটা গুনে নিন আর কাগজটা বের করুন।”

অটোয়াল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হাঁ-হাঁ, কিঁউ নেহি।”

পিছন ফিরে সিন্দুক খুলে স্ট্যাম্পপেপারটা বের করে আনল অটোয়াল। গজপতি টাকার বান্ডিলটা বাড়িয়ে দিল। অভ্যস্ত হাতে টাকা গুনতে লাগল অটোয়াল। গোনা শেষ হলে বলল, “সব ঠিক আছে। কাগজটা লিয়ে যান। রাম রাম গজপতিবাবু।”

“হ্যাঁ, রাম রাম।”

বিকেলে প্রায় মিছিল করে গড় হেকিমপুরের কয়েকশো লোক রাজবাড়িতে হাজির হয়ে গেল। ভিতরে ঢুকল অবশ্য কয়েকজন। বাকিরা ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।

বিস্মিত রাজা প্রতাপ বললেন, “এ কী!কী ব্যাপার গজপতি?” গজপতি চুক্তিপত্রটা রাজামশাইয়ের পায়ের কাছে রেখে প্রণাম

করে বলে, “মহারাজ, এর পর কোনও দরকার পড়লে মহাজনের কাছে না গিয়ে আমাদের বলবেন। আমরা আপনার সন্তানের মতো।”

রাজা প্রতাপ প্রসন্ন মুখে বললেন, “এবার থেকে তাই হবে বাবা।” পরদিন থেকেই মিস্তিরিরা লেগে গেল রাজবাড়ি সারাই করতে।

সকালবেলা বৃন্দাঠাকরুন নিত্যকার মতো জলচৌকিতে বসে মালা টপকাচ্ছেন। কিন্তু জপে মন নেই। কখন সুহাসিনী আসে তার জন্য চোখ-কান খোলা রেখেছেন। আজ যেন সুহাসিনী আসতে বড্ড দেরি করছে! মনে-মনে বেশ অস্থির হয়ে পড়েছেন বৃন্দাঠাকরুন। আজ সুহাসিনীকে মুখের মতো জবাব দিতে হবে। গড় হেকিমপুরের

রাজবাড়ি নিয়ে মশকরা? আজ আসুক মুখপুড়ি। বুঝিয়ে দিতে হবে রাজবাড়ির দাপট।

ন্যাতা-বালতি নিয়ে সুহাসিনী ঢুকতেই জপ বন্ধ রেখে গলা তুলে বৃন্দাঠাকরুন বলে উঠলেন, “কী রে মুখপুড়ি, খুব যে আঙুল নাচিয়ে বলেছিলি আমাদের নাকি ভিটেছাড়া করতে লোক আসছে! এখন দ্যাখ, বাড়ি মেরামত করতে মিস্তিরি লেগেছে, কেমন আগের মতোই আবার ঝকমক করবে। পারল কেউ কিছু করতে?”

সুহাসিনী ঠোঁট উলটে বলল, “সব জানি গো দিদিমা, গড় হেকিমপুরের লোকেরা টাকা তুলে দিয়েছে রাজবাড়ি রক্ষে করতে। আরও শুনবে? আমিও একজোড়া সোনার মাকড়ি বেচে পাঁচশো টাকা দিয়েছি। শত হলেও রাজবাড়ি তো আর ঠিক পরের বাড়ি নয়।”

বৃন্দাঠাকরুন কেমন যেন ভোম্বল হয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর অবাক গলায় বললেন, “তুই মাকড়ি বেচে টাকা দিয়েছিস?”

“তা কী করব বলো। আমাদের হাতে কি সবসময় নগদ টাকা থাকে? সে মাকড়ি গেছে যাক, কপালে থাকলে আবার হবে। রাজবাড়ি তো বেঁচেছে।”

আজ সুহাসিনী হুড়ো দেওয়ার আগেই জলচৌকি ছেড়ে বিছানায় উঠে বসলেন বৃন্দাঠাকরুন। তারপর হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, “পোড়া চোখে জল আসছে কেন রে?”

“ও মা!কাঁদছ কেন? তোমার চোখে এখনও যে জলের স্টক আছে জানতাম না তো?”

“একটু কাছে আসবি মুখপুড়ি, তোর মুখখানা আজ একটু ভাল করে দেখি। আর একটু আদর করি। আয় তো কাছে।”

সুহাসিনী হেসে ফেলে বলল, “আর আদিখ্যেতার দরকার নেই, আমি বরং তোমাকে একটা পেন্নাম করি। ভাল করে আশীর্বাদ করো দিকি।”

“আয়, কাছে আয়।”