৪
অটোয়ালের মুখে সর্বদা এক বুলি, “হামার কুছু নাই, সব রামজির কৃপা।” গোলগাল, আহ্লাদী চেহারা, মুখে সবসময় প্রসন্ন একটু হাসি, কখনও মেজাজ হারায় না। গঞ্জে তার চারটে গদি, দু’খানা বাড়ি, লাখো-লাখো টাকার কারবার। তার জলসত্র আছে, ধর্মশালা আছে, মস্ত গোশালা আছে। তার ‘আছে’র সংখ্যা এতই বেশি যে, ‘নেই’য়ের হদিশ পাওয়াই মুশকিল।
দিনদুই পরে এক সকালে অটোয়ালের গাড়ি এসে রাজবাড়ির গাড়িবারান্দার তলায় দাঁড়াল। রাজা প্রতাপ সামনের বারান্দায় ইজ়িচেয়ারে বসেছিলেন। অটোয়ালকে দেখে একটু সিধে হয়ে বসলেন। “অটোয়াল নাকি?”
“রাম রাম, মহারাজ। শরীর মেজাজ সব তন্দরুস্ত তো?”
“ওই আছে এক রকম। তা তুমি কী মনে করে?”
“কুনো মতলব নাই। এদিকে একটু কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম মহারাজকে একটু পরনাম করে যাই।”
“তা তুমি ভাল আছো তো?”
“রামজি কি কৃপায় চলছে মহারাজ।”
“তুমি তো আমার কাছে অনেক টাকা পাও। আমার অসুখের সময় বাড়ি বাঁধা রেখে পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলাম।”
“হাঁ মহারাজ, সো বাত ঠিক। তবে মুশকিল কী জানেন, পচাশ হাজার তো আর পচাশ হাজারে নাই, সে এখুন সুদে-আসলে দেড় লাখে পঁহুছে গেছে। আমাদের হাতে তো কুছু নাই, ইসব কোম্পানির নিয়ম।”
“দেড় লাখ! শেষে কি আমাকে ভিটেছাড়া হতে হবে
শশব্যস্তে হতজোড় করে অটোয়াল বলে, “নেহি মহারাজ, নেহি। পুরানা বাড়ির বদলে আপনি নূতন বাড়িতে যাবেন। এই ভূতের বাড়ি ছোড়িয়ে দেওয়াই তো ভাল। ছোট, কোজি বাড়ি হবে, আরামসে থাকবেন, মহারাজ।”
রাজা প্রতাপ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ করে রইলেন। “তা হলে আজ চলি মহারাজ, রাম রাম।”
রাজা প্রতাপ বললেন, “চুক্তির শেষ দিন কবে যেন?”
“আর পাক্কা দশ দিন আছে, মহারাজ
অটোয়াল চলে যাওয়ার পর রাজা প্রতাপ অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। সাতকড়ি বলল, “রাজামশাই, আপনি ভাববেন না। একটা না-একটা উপায় হয়ে যাবে।”
রাজাপ্রতাপ মাথা নেড়ে হতাশ গলায় বললেন, “না রে, আমাকে সান্ত্বনা দিস না, আর কোনও উপায় নেই, আমি জানি। মাত্র পঞ্চাশ হাজারের জন্য সাতপুরুষের ভিটে বিকিয়ে যাচ্ছে, আমারই দোষে।”
দুপুরবেলা সাতকড়ি ভাত খেয়ে যখন ঘরে যাচ্ছে, তখন তার পায়ের শব্দ পেয়ে বৃন্দাঠাকরুন হেঁকে বললেন, “কে রে? সাতকড়ি নাকি?”
“হ্যাঁ, দিদিমা।’
“একটু শুনে যা বাবা, দরকার আছে।”
ঘরে ঢুকে সাতকড়ি দেখল বৃন্দাঠাকরুন বিছানায় বসে গম্ভীর মুখে জুলজুল করে চেয়ে আছেন। তাকে দেখে বলে উঠলেন, “আমার একটা কাজ করে দিবি বাবা?”
“কী কাজ বলুন না?”
“করিস কিন্তু।”
“আচ্ছা, আগে তো শুনি কাজটা কী।
“একটা নোড়া দিয়ে সুহাসিনীর মুখটা একটু তুবড়ে দিবি? তোকে আমি পাঁচটা টাকা দেব।”
সাতকড়ি হেসে বলে, “কেন, সুহাসিনী করেছে কী?”
এ “আজ সকালে ঘর মুছতে এসে আমার নাকের ডগায় বুড়ো আঙুল নেড়ে কী বলে গেছে জানিস? বলেছে আমাদের নাকি এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। আর তার ব্যবস্থা করতে নাকি আজ সকালে লোক এসেছিল। শোনো কথা!সুহাসিনীর এত বুকের পাটা হয় কী করে বলবি? আমি হলুম গে রাজমাতা, আর এ আমাদের চোদ্দোপুরুষের ভিটে। আর আমাদেরই নাকি তাড়াবে! ওর এত আস্পদ্দা হয়েছে যে বলার নয়।”
“আচ্ছা দিদিমা, আমি সুহাসিনীকে বকে দেব’খন।” “ওরে না-না। বকলে হবে না। ওর থোঁতামুখ ভোঁতা করতে হবে। তুই হাতের কাছে নোড়াটা রাখিস, তা হলেই হবে।”
“আচ্ছা, আপনি এখন মাথা ঠান্ডা করে একটু ঘুমোন।”
“রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে, এখন কি আর ঘুম হবে রে! তা হলে নিশ্চিন্ত করলি তো বাবা? ভাল করে তুবড়ে দিস কিন্তু। গড় হেকিমপুরের রাজবাড়ি বলে কথা। আমাদের কত কামান, বন্দুক, কত সেপাই। কার সাধ্যি বল তো যে আমাদের তাড়ায়?”
“ঠিকই তো। সুহাসিনী খুব অন্যায় করেছে। আপনি ঘুমোন, কাল ব্যবস্থা হবে।”
“হ্যাঁ, এবার বুকটা ঠান্ডা হয়েছে। তা হলে একটু ঘুমোই।” সাতকড়িরও মনটা বড্ড খারাপ, রাতে তাই ঘুম আসছিল
না। শুয়ে-শুয়ে ভাবছিল, ‘আহা, যদি গুপ্তধনটন পাওয়া যেত তা হলে এই
বিপদে বড্ড কাজে লেগে যেত। থাকলেও তা খুঁজে বের করবে কে?’ হঠাৎ পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, “এ বাড়িতে কোনও গুপ্তধন নেই।”
সাতকড়ি কথা কইল না। পুতুলটা যদি মনের কথা শুনতে পেয়ে থাকে, তা হলে মনে-মনে কথা বলাই ভাল। সে মনে-মনেই প্রশ্ন করল, ‘কোনও উপায় আছে?’
পুতুল অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “গুপ্তধন আছে‘কোথায়?’
“মানুষের কাছে। তারাই গুপ্তধন। তুমি মানুষের কাছে যাও। তারা টাকা দেবে। রাজামশাইকে তারা ভালবাসে।”
‘লোকের টাকা মহারাজ নেবেন না।
“মহারাজ দয়া নেন না। কিন্তু এটা দয়া নয়, ভালবাসা। মহারাজ ভালবাসা নেবেন।”
‘তুমি কি কোনও ঠাকুর-দেবতা?’
পুতুল অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠল, “আমি যে কে, তা আমি নিজেই জানি না। তবে ঠাকুর-দেবতা নই। আমি একটা পুতুল। তবে অন্য রকম।”
সকালবেলা সুহাসিনী ঘর মুছতে এসেই ঝংকার দিল, “রোজ তুমি ঘরের মাঝমধ্যিখানে জলচৌকি পেতে বসে থাকো কেন? ওটা কি তোমার সিংহাসন? একটু আক্কেল যদি থাকে?”
“সক্কালবেলাটায় চোপা করিস না তো। এখন জপ করছি দেখছিস না!”
“তোমাকে জপ করতে বারণ করেছে কে? বিছানায় বসে জপ করলেই তো হয়।”
“হ্যাঁ রে, তোর মুখটা একটু দেখি। কাছে আয় তো?”
“ও মা, কোথায় যাব! হঠাৎ আমার থ্যাবড়া মুখটা দেখার শখ হল কেন?’
“আয় না কাছে।”
“এই তো এলুম। ভাল করে দেখে নাও। বলি আমাকে সিনেমায় নামাবে নাকি?”
“তোর মুখটা তুবড়ে যায়নি?”
“ও মা, আমার মুখ তোবড়াবে কেন? আমি কি তোমার মতো বুড়ি? তোমার যদি তোবড়ানো মুখ দেখতে এতই ইচ্ছে করে তা হলে আয়নায় নিজের মুখটা দেখলেই তো হয়!”
বৃন্দাঠাকরুন মুখখানা তোম্বা করে বললেন, “দূর-দূর, সাতকড়িটা কোনও কাজের নয়।”
হাবিজাবি বলছ? মাথাটা তো একদম গেছে দেখছি।”
“আমার মাথা যাবে কেন লা? গেছে তোর মাথা। কালে-কালে তোর আস্পদ্দা দেখে অবাক হই। কাল যা সব বলে গেলি সেগুলোই তো মাথা খারাপের লক্ষণ!”
“কী বলেছি বলো তো?”
“তুই বলিসনি যে, আমাদের এবাড়ি থেকে তাড়াতে লোক এসেছে?”
“ও মা! সেটা কি মাথা খারাপের লক্ষণ? সকালেই তো কাল গর্দানভাই অটোয়াল এসেছিল। এত্তেলা দিয়ে গেছে। দশদিনের মধ্যে দেড় লাখ টাকা শোধ দিতে না পারলে বাড়ির দখল নিয়ে নেবে। বুঝলে! এবার তল্পিতল্পা বাঁধাছাঁদা শুরু করে দাও। সব গোটাতে হবে।”
“কার এত সাহস যে, আমাদের বাড়িছাড়া করে? নিয়ে আয় তাকে আমার সামনে। দেখি কত বড় আস্পদ্দা?”
“কেন, মারবে নাকি? অত গুমোর কোরো না, তোমাদের রাজত্বি আর নেই। এখন ওই অটোয়ালদেরই রাজত্বি। বুঝলে?”
“আসুক একবার আমার সামনে, ঝাঁটাপেটা করে তার ভূত নামাব।”
“ও বাবা!বিষ নেই, তবু কুলোপানা চক্কর! এখন সিংহাসন ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বোসো তো, আমার সময় নেই, আরও দু’বাড়ি যেতে হবে।”
“তুই কাজের মেয়ে, কাজের মেয়ের মতো থাকবি, মালিকের মুখে-মুখে কথা কইবি কেন রে?”
“খেটে খাই বুঝলে, তোমাদের মতো পরের ধনে পোদ্দারি করি না। সারা জীবন তো গতর নাড়োনি, কত ধানে কত চাল তা বুঝবে কী করে! যখন হুড়ো দিয়ে তাড়াবে, তখন বুড়ো বয়সে শিক্ষা হবে। কাজের মেয়ে! যখন ঠেকায় পড়ো, তখন তো এই ঝিয়েরই পারলে পায়ে পড়তে হয়।”
বৃন্দাঠাকরুন রণে ভঙ্গ দিয়ে গনগন করতে-করতে বিছানায় গিয়ে বসলেন।
রাত জেগে বড়-বড় সাদা কাগজে লাল কালি দিয়ে অনেকগুলো পোস্টার লিখল সাতকড়ি। পোস্টারে লেখা, “মাত্র দেড় লক্ষ টাকা ঋণের জন্য গড় হেকিমপুরের ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ি আর দশদিন পর মহাজনের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে। আপনারা কি তা চান? যদি না চান, তা হলে রাজবাড়ি রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসুন। আপনারা সবাই হাত বাড়ালে রাজবাড়ি রক্ষা পাবে।”
ভোর হওয়ার আগেই গড় হেকিমপুরের প্রায় সর্বত্র পোস্টারগুলো সেঁটে দিয়ে এল সাতকড়ি। কাল হাটবার বলে হাটখোলায় কয়েকটা বেশি পোস্টার সাঁটল।
পরদিন সারা গড় হেকিমপুরে হইহই কাণ্ড। প্রথমে গুঞ্জন, তারপর মানুষের সুর চড়তে লাগল। এ কী অরাজকতা! দেনার দায়ে আমাদের রাজবাড়ি বিক্রি হয়ে যাবে? ইয়ার্কি নাকি? এ তো হতে দেওয়া যায় না! হাটখোলায় প্রায় মিটিং বসে গেল।
একটু বেলার দিকে খবর পেল হারু খাসনবিশ, তৎক্ষণাৎ দলবল নিয়ে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলতে ছুটে এল সে। তার দলবল হাটখোলার কয়েকটা পোস্টার ছিঁড়তেই লোকজন রে-রে করে তেড়ে এল। হারু বুক চিতিয়ে হুঙ্কার দিল, “খবরদার, আমাদের সঙ্গে লাগতে আসিস না, লাশ নামিয়ে দেব।” একজন ডাবওয়ালা তার দা হাতে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “এই দা দেখেছ! ধারালো দা, এক কোপে তোমার গলা নেমে যাবে।” হারু ফের একটা হুঙ্কার দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টির মতো চড়চাপড় পড়তে লাগল তাদের উপর।
হারাধন প্রথমে একটু ঘুসিটুসি চালানোর চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু হাটুরে কিল বলে কথা। কয়েকজন আবার লাঠি বাগিয়ে এসে দু’-চার ঘা বসিয়ে দিতেই হারু আর তার দলবল প্রাণভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে লাগল। বিস্তর লোক পিছু নিয়ে ছুটতে ছুটতে লাঠি, ঘুসি, চড়চাপড় চালিয়ে একেবারে রথতলার মাঠ পার করিয়ে দিয়ে এল তাদের।
আরও একটু বেলার দিকে গজপতির বাড়িতে গাঁয়ের মাতব্বর এবং বিশিষ্টজনেরা জমায়েত হয়েছেন। আলোচ্য বিষয় রাজবাড়ির সংকট। গাঁয়ের প্রায় কেউই বাদ নেই। এমনকী, চুরানব্বই বছরের উমাপদবাবু এবং নিরানব্বই বছরের দ্বিজপদ সাঁতরাও হাজির।
শিবু গায়েন বলল, “পোস্টারগুলো সাঁটল কে বলুন তো?”
গজপতি বলে, “আমার মনে হয় এ কাজটা করেছে সাতকড়ি। সে অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতোই কাজটা করেছে। শুধু পোস্টারেই এতটা রিঅ্যাকশন হবে, তা কেউ কি ভাবতে পেরেছিল? তাকে ডেকে পাঠিয়েছি। সে আসছে।”
যদু ঘোষ শুকনো মুখে বলল, “রাজবাড়ি যে বাঁধা আছে, তাই তো আমি জানতুম না। গত বিজয়া দশমীতেই তো রাজামশাই আর রানিমাকে প্রণাম করে এলুম, অনেক সুখ-দুঃখের কথাও হল, তখন তো একবারও মুখ ফুটে বললেন না!”
দ্বিজপদ বললেন, “নিজের অসুবিধের কথা রাজামশাই কখনওই কাউকে বলেন না। ওঁর আত্মসম্মানবোধ বড় টনটনে।”
সবাই কথাটা সমর্থন করল ।
গজপতি বলল, “এবার আমি রাজামশাইকে রাজি করিয়েই ছাড়ব। দেড় লাখ এমন বেশি কিছুই নয়। আমরা সবাই মিলে দু’দিনের মধ্যে টাকাটা তুলে ফেলতে পারব।”
সবাই হাত তুলে বলে উঠল, “রাজি, আমরা রাজি।”
এমনকী, হাড়কিপটে শিবু গায়েনও হাজার টাকা কবুল করে ফেলল।