গড় হেকিমপুরের রাজবাড়ি – ৩

“বুঝলে গজপতি, কাল রাতে রাজবাড়িতে চোর ঢুকেছিল বলে শোনা যাচ্ছে।”

“বটে! চোরের কি আক্কেল নেই!রাজবাড়িতে আর আছেটা কী চুরি করার মতো?”

“সেইটেই ভাবছি। শোনা যাচ্ছে যে, জানালার শিক খসিয়ে গোলঘরে ঢুকে একটা পুতুল নিয়ে গেছে।”

“বলো কী যদু, চোরে পুতুল চুরি করতে এত মেহনত করে জানতাম না তো?”

“তা বটে। আর সেইটেই রহস্য।”

গজপতি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে কী একটু ভাবল, তারপর বলল, “দাঁড়াও, আমার একটা কথা মনে পড়ছে।” “কী কথা বলো তো?”

“গোলঘরে একটা আলমারিতে সবুজ পোশাক পরা একটা পুতুল আছে। ওটা আর-পাঁচটা পুতুলের মতো নয়, একেবারে অন্য রকম। আমার মনে আছে, যেদিন রাজবাড়ির গোলঘরের আলমারিতে প্রথম দিন পুতুলটাকে দেখি সেদিন আমি খানিকটা সম্মোহিত হয়ে পুতুলটার দিকে চেয়ে ছিলাম। ঘণ্টাখানেক আমার কোনও হুঁশই ছিল না, চেয়ে আছি তো চেয়েই আছি। আমার একটু ভয়ও হয়েছিল, তাই আর কখনও গোলঘরে ঢুকিনি। ওই পুতুলটাকে আমার মনে হয়েছিল কোনও জাদুকর, হিপনোটিজ়ম জানে। চোখদুটো তো একদম জ্যান্ত, মানুষের মতো।”

যদু ঘোষ একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বলে, “ওই পুতুলটাই। তোমার মতো আমারও একটা ব্যাপার হয়েছিল। তখন আমার দশ-বারো বছর বয়স। রাজবাড়িতে ঘুরঘুর করতুম। তখনও রাজবাড়ির তেমন পড়তি অবস্থা নয়, গেলে রানিমা নাড়ু-মোয়া দিতেন। একদিন পুতুলটা দেখে খুব লোভ হল। ভাবলাম এ বাড়িতে তো পুতুল খেলার লোক নেই, শুধুমুধু পড়ে আছে। আলমারিতে একটা সস্তা মাস্টার লক লাগানো ছিল। চাবিটা কোথায় আছে তা আমি জানতাম। বৈঠকখানার একটা টেবিলের ড্রয়ারে। চুপচাপ সেটা নিয়ে এসে তালা খুলে পুতুলটা নিতে যাব, হঠাৎ কে যেন একটা ধমক দিয়ে বলল, ‘অ্যাই! খবরদার! হাত দিবি না!’ কে বলল, কোথা থেকে বলল, কিছুই বুঝতে পারলাম না, ভয়ে ঘাম দিচ্ছিল। দৌড়ে পালিয়ে আসি।”

“বুঝলাম। পুতুলটার উপর অনেকেরই বোধ হয় নজর ছিল। কিন্তু তা হলে এতদিন চুরি যায়নি কেন বলো তো?”

আজ বীণাপাণিদেবী ডালপুরি আর ঘুগনি নিয়ে এলেন, গজপতি আর যদু ঘোষ ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ভোলানাথ মুস্তফি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বাইরের বারান্দায় দ্রুত পায়চারি করছিলেন, আর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ গলায় আপনমনে বলছিলেন, “এ কী মগের মুল্লুক হয়ে উঠল!অ্যাঁ!শেষ অবধি পুকুরচুরি!চুরির আর কী বাকি রইল? এর পর তো… এর পর তো লোকের বাড়ি চুরি যাবে। রাতে বিছানায় শুয়েছি, সকালে উঠে দেখব গাছতলায় পড়ে আছি। বাড়ি হাওয়া। কিছুই বিচিত্র নয়।”

এই সময়ে তাঁর বউ বেরিয়ে এসে বললেন, “ওগো, তুমি অত ছটফট করছ কেন?”

ভোলাবাবু কটমট করে গিন্নির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছটফট করব না! কত বড় কাণ্ডটা হয়ে গেল কাল রাত্তিরে! আস্ত একটা পুকুর চুরি হয়ে গেল!এ কি দুশ্চিন্তার কথা নয়?”

“আহা, তা নিয়ে তোমার অত ভাবনার কী! যার পুকুর চুরি হয়ে গেছে সে ভাবুক গিয়ে।”

“বলো কী গিন্নি, এর পর তো আমাদের পুকুরও চুরি হয়ে যাবে!” গিন্নি বললেন, “না গো, সেই ভয় নেই।” যাবে না কেন?”

“কেন, আমাদের পুকুর চুরি

“তার কারণ আমাদের পুকুরই নেই যে! কস্মিনকালেও ছিল না।” ভ্রু কুঁচকে ভোলাবাবু বললেন, “ঠিক জান তো যে, আমাদের পুকুরই নেই।”

“ও মা, জানব না কেন!বিশ্বাস না হলে তুমি বাড়ির চারপাশ ঘুরে দেখে এসো, পুকুর আছে কিনা।”

ভোলাবাবু খানিকটা দমে গেলেও উত্তেজনা রয়ে গেল। এত বড় একটা কাণ্ড ঘটে গেল, এ তো হজম করাই মুশকিল। তিনি পোশাক পরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন। এখন একটু হাঁটাচলা না করলে উত্তেজনাটা কমবে না। কিছুদূর হাঁটতেই কাদাপাড়ার নটবর মুন্সীর সঙ্গে দেখা।

“এই যে মাতব্বরবাবু, কাল রাতে কত বড় কাণ্ড ঘটে গেল জানেন তো?”

“মাতব্বর নই, আমি নটবর।”

“আহা, এখন নাম নিয়ে জলঘোলা করার সময় নয়। কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল জানেন কি?”

“কী হয়েছে বলুন তো?”

“কাল রাতে আস্ত একটা পুকুর চুরি হয়ে গেছে।” “সর্বনাশ, কার পুকুর চুরি গেছে বলুন তো!” “সেটা এখনও ঠিক জানি না।”

নটবর মুন্সীর চোখ কপাল উঠল, “সর্বনাশ! আমার পুকুরটাই চুরি যায়নি তো! আমি যে সবে রুই-কাতলার চারা ছেড়েছি মশাই! বহু টাকার জিনিস!” বলেই নটবর হঠাৎ দৌড়তে শুরু করল, আর নিমেষে হাওয়া হয়ে গেল।

হাটখোলার কাছাকাছি কানাইমাস্টারের সঙ্গে দেখা। উত্তেজিত গলায় শিবুবাবু বলে উঠলেন, “শুনেছেন তো খবরটা ধানাইপানাইবাবু?”

বিরক্ত কানাইমাস্টার বলে, “ধানাইপানাইয়ের মানে জানেন? যাকে-তাকে যা খুশি বলে ডাকলেই হল?”

“আহা, নামে কী এসে যায়! বলি খবরটা শুনেছেন কি না?”

কানাইমাস্টার মুখটা আঁশটে করে বলে, “তা শুনব না কেন? খুব

শুনেছি। পটল গুন লটারিতে দু’লাখ টাকা পেয়েছে তো? ও খবর সবাই জেনে গেছে।”

“আরে না মশাই, না। কাল রাতে আস্ত একটা পুকুরই চুরি হয়ে গেছে।”

“বলেন কী মশাই, পুকুরচুরি কি সোজা কথা! পুকুরচুরি করতে অনেক প্রতিভা লাগে। ও তো আর হ্যাতান্যাতা চোরের কাজ নয়! ওই গর্দানভাই অটোয়াল, বিঠলভাই আগরওয়ালা, পশুপতি সাহা দাস এদের মতো প্রতিভা না থাকলে পুকুরচুরি করা সম্ভব নয়, বুঝলেন!”

একটু থতমত খেয়ে ভোলাবাবু বলেন, “তা এরা সব কারা বলুন তো?”

“এরা সব নামকরা পুকুরচোর।”

“তা হলে এরাই কি পুকুরটা চুরি করেছে?”

“করে থাকলে আমি অন্তত অবাক হব না।”

“তা হলে পুলিশ এদের ধরছে না কেন বলুন তো?”

“সর্বনাশ! পুলিশের কথা ভাবতেও যাবেন না। তা হলে গাঁয়ের বাস ওঠাতে হবে। পুলিশ এদের হাতের পুতুল। বুঝলেন কিছু? আপনার বোধ হয় বুঝতে একটু সময় লাগবে। বাড়ি গিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আরও একটু কষে ভাবুন গে৷”

কানাইমাস্টার আর কথা না বাড়িয়ে “চলি ভোলাবাবু, ” বলে হনহন করে হাঁটা ধরলেন।

ভোলাবাবু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবলেন, ‘তা হলে এই হল ব্যাপার! কিছু প্রতিভাবান লোক নিয়মিত পুকুর চুরি করছে এবং পুলিশ তাদের ধরছে না! নাহ, ধানাইপানাইবাবু অনেক খবর রাখেন।’

“ভোলাবাবু যে! তা এখানে দাঁড়িয়ে আকাশমুখো চেয়ে কী ভাবছেন বলুন তো!”

ভোলাবাবু একটু চমকে উঠে সামনে যাকে দেখলেন, তার মুখটা খুবই চেনা, ভীষণ রকমের চেনা। তবে লোকটা যে কে, তা বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি বললেন, “এই পুকুরচুরি নিয়েই ভাবছিলাম আর কী।”

“ও, তাই বলুন। তা ভেবে কিছু বের করতে পারলেন কি?”

“কিছু ট্যালেন্টেড লোক নাকি নিয়মিত পুকুরচুরি করছে। গত রাত্তিরেও একটা আস্ত পুকুর চুরি করে নিয়ে গেছে।”

“সে আর বেশি কথা কী? পুকুরচুরির কথা আমরাও শুনতে পাই বটে। কিন্তু আপনাকে পুকুরচুরির খবরটা দিল কে?”

“তা ঠিক মনে নেই। তবে সকালে যখন আমি বাগানে হাঁটছিলাম, তখনই রাস্তা থেকে একটা বেঁটেমতো লোক বলে গেল, ‘শুনেছেন মশাই, কাল রাতে একটা পুকুরচুরি হয়ে গেছে।”

“আচ্ছা ভোলাবাবু, আপনি তো আপনভোলা মানুষ, হঠাৎ পুকুরচুরি নিয়ে ভাবনায় পড়লেন কেন?” “এটা কি উদ্বেগের বিষয় নয়?”

“পুকুর সত্যিই চুরি হলে অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়। তবে আপনার জানা উচিত যে পুকুরচুরি একটা আলঙ্কারিক কথা, সত্যিকার পুকুরচুরি সম্ভব নয়।”

“নয়!কিন্তু লোকটা যে বলে গেল!”

“আপনি শুনতে ভুল করেছেন। ওটা পুকুর নয়, কাল রাতে রাজবাড়ি থেকে একটা পুতুল চুরি হয়েছে। পুতুলকে আপনি পুকুর শুনেছেন।”

ভোলাবাবু মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বললেন, “পুতুল! ছোঃ! পুতুল কি একটা চুরি করার জিনিস হল?”

“পুতুল বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন না। কোনও-কোনও পুতুল আছে, লাখ টাকা দাম।”

“নাকি! তা ইয়ে, আপনি তো বেশ জ্ঞানী লোক! আপনি কে যেন?”

“চিনলেন না তো! এখন আমি যদি বলি, আমার নাম চার্লি চ্যাপলিন, তা হলে কি বিশ্বাস হবে?”

ভোলাবাবু চোখ মিটমিট করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “যাহ, আপনি ঠাট্টা করছেন?”

লোকটা হেসে বলল, “বুঝতে পেরেছেন তা হলে!আমি যদু ঘোষ, আপনার ভায়রাভাই গজপতির বন্ধু।”

“দেখো কাণ্ড! আরে আপনি যদু ঘোষ, তা আগে বলবেন তো! গজপতির সেই পঁচাত্তর টাকা না কত যেন ধার আছে আপনার কাছে?” “হ্যাঁ, যেটা আদায় হচ্ছে না।”

“আর সেইজন্যই তো গজপতি ভোজ দিয়েছিল। ওহ, তোফা খাইয়েছিল কিন্তু।”

“হ্যাঁ, ভোজটা জব্বর হয়েছিল। এরকম ধার দিয়েও সুখ। আচ্ছা নমস্কার, আজ আসি তা হলে!”

“নমস্কার, নমস্কার! আপনি একজন বিজ্ঞ লোক, আমার কত বড় ভুলটা ভাঙিয়ে দিলেন।”

রথতলার কাছে ভারী চেনাজানা একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। “এই যে, তা তুমি কত কড়ি যেন?”

“আজ্ঞে ওই সাতই আছে, বাড়েওনি, কমেওনি।”

“হ্যাঁ-হ্যাঁ, তুমি তো রাজভবনে থাকো, তাই না?”

জিব কেটে সাতকড়ি বলে, “কী যে বলেন ভোলাবাবু, রাজভবনে! আমি থাকি গরিব রাজবাড়িতে।”

থাকার কপাল কি করে এসেছি“তা বটে, তা বটে। তা শুনলাম রাজবাড়ি থেকে নাকি একটা লাখ টাকা দামের পুতুল চুরি হয়ে গেছে।”

“পুতুলের দাম কি লাখ টাকা হয় ভোলাবাবু? তবে কাল রাতে একটা পুতুল চুরি হয়ে গেছে, এটা সত্যি। আপনাকে খবরটা কে দিল?”

“ওই তো কী ঘোষাল না কে যেন। আমি আবার নামটাম মনে রাখতে পারি না।”

“যে আজ্ঞে, সেটা আমরা জানি।”

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভোলাবাবু বললেন, “যাক, ফাঁড়াটা পুতুলের উপর দিয়ে কেটে গেছে। পুকুর তো আর চুরি হয়নি। হলে ভারী দুশ্চিন্তার ব্যাপার হত।”

ভোলাবাবু নিশ্চিন্ত মনে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। সাতকড়ি হাঁ করে ভোলাবাবুর গমনপথের দিকে চেয়ে রইল।

কাঠগোলার কাছে একজন মাঝবয়সি লোককে কান ধরে ওঠবোস করাচ্ছিল হারাধন খাসনবিশ। তার সঙ্গে গোটাচারেক স্যাঙাত। সাতকড়িকে দেখে মাঝবয়সি লোকটাকে ওঠবোস চালিয়ে যেতে বলে হারু খাসনবিশ এগিয়ে এল।

“এই যে সাতকড়ি, রাজবাড়ির কী ব্যাপার বলো তো! শুনলাম কাল রাতে নাকি বাড়িতে চোর ঢুকেছিল। এ তো ভাল কথা নয়। শিউচরণ সিং করেটা কী? আর তুমিও বোধ হয় নাক ডেকে ঘুমোও! এরকম অরাজকতা তো চলতে দেওয়া যায় না। গর্দানভাই তো বলেইছে অত বড় বাড়ি দেখভালের মতো লোকবলও রাজামশাইয়ের নেই। তাই একটা ছোটখাট বাড়ির বন্দোবস্ত করেই রেখেছে। তা ছাড়া ও বাড়ি তো এখন আইনত গর্দানভাইয়েরই সম্পত্তি। দয়া করে থাকতে দিচ্ছে বই তো নয়! রাজামশাইকে বেশ করে বুঝিয়ে বোলো। আমিও ওবেলা একবার যাব’খন।”

“যে আজ্ঞে, তবে কিনা আমি কাজের লোক বই তো নয়। আমার বলাটা আস্পর্ধা হয়ে যাবে।”

“আহা, আমি বলেছি সেটাই বোলো। রাজবাড়িতে বোধ হয় গোটাচল্লিশেক ঘর, দোতলাটা তো খোলাই হয় না। ইঁদুর-মাকড়সার আড়ত হয়ে আছে। বাড়ির মেনটেনেন্স বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, নাকি! মোটে তিনজন লোকের কি অত বড় বাড়ির দরকার হয়?”

“যে আজ্ঞে, তবে এই বয়সে ওঁদের ভিটেছাড়া করাটা কি ঠিক হবে হারুবাবু?”

হারু হঠাৎ হুঙ্কার । উঠল, “কী বললি? ভিটেছাড়া মানে কী? যখন বাড়ি বাঁধা রেখেছিল তখন ভিটের কথা মনে হয়নি? আর তুই কাঁদুনি গাইছিস কেন? ওটা কি তোর বাপের সম্পত্তি? ফের মুখে-মুখে কথা কইলে মুন্ডু ঘুরিয়ে দেব। বুঝেছিস বেয়াদব?”

কিন্তু হারুর তড়পানিতে সাতকড়ি তেমন ভয় পেল বলে মনে হল না। একটু মিষ্টি হেসে বলে, “তা হারুবাবু, গর্দানভাইয়ের সঙ্গে আপনার বন্দোবস্তটা কীরকম বলুন তো!”

গিয়ে একটু বিশ্রাম করুন গে।”

হারু এত অবাক হয়ে গেল যে, মিনিটখানেক হাঁ করে চেয়ে রইল। তারপর, “তবে রে….” বলে বিশাল হাতে প্রচণ্ড এক চড় বসাতে গেল।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, চড়টা সাতকড়ির গালে মোটেই লাগল না, হাওয়া কেটে বেরিয়ে গেল, আর হাতটা বেমক্কা ঘুরে যাওয়ায় টাল সামলাতে না-পেরে হারু খাসনবিশ উপুড় হয়ে গদাম করে মাটিতে পড়ে ককিয়ে উঠল।

সাতকড়িই গিয়ে হারাধনকে তুলতে তুলতে বলল, “খুব লেগেছে নাকি হারুবাবু? তা এই বয়সে কি ওসব হুড়যুদ্ধু করা ভাল?”

হারাধন দাঁড়িয়ে রোষকষায়িত চোখে চেয়ে বলে, “তোর এত সাহস!”

“আজ্ঞে, সাহসের কী দেখলেন! আমি রোগা-দুবলা মানুষ, ওই চড়টা লাগলে আমার সত্যিই মুন্ডু ঘুরে যেত, তাই মাথাটা সরিয়ে নিয়েছিলাম।”

হারু হুঙ্কার দিয়ে বলে, “আমি যখন কাউকে থাপ্পড় মারি, তখন সবাই চুপচাপ থাপ্পড় খায়, কেউ মাথা সরিয়ে নেওয়ার সাহস দেখায় না। বুঝলি? কিন্তু এবার তোকে কে বাঁচাবে?”

বলেই হারাধন খাসনবিশ দুটো হাত সাঁড়াশির মতো সাতকড়ির গলার দিকে বাড়িয়ে এগোতেই সাতকড়ি কোলকুঁজো হয়ে সুট করে বগলের তলা দিয়ে বেরিয়ে এল। হারু টাল সামলাতে সামলাতে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে হাঁক দিয়ে বলল, “ভাল চাস তো চালাকি না করে সামনে আয়। নইলে তোর খবর আছে।”

সাতকড়ি নির্বিকার মুখে বলল, “আপনি তো হাঁপাচ্ছেন মশাই! ঘাড়ে-গর্দানে যা চেহারা করেছেন, তাতে হাঁপ তো ধরবেই। যান, বাড়ি

হারাধন তার স্যাঙাতদের হুকুম করল, “ওরে, এই ইঁদুরটাকে পাছড়ে ধর তো। এটাকে আজ ভাল করে শিক্ষা দিয়ে দিই। যাতে জীবনে আর বেয়াদবি করার সাহস না পায়।”

স্যাঙাতরা চটপট এগিয়ে এল। সাতকড়ি একলম্ফে তফাত হয়েই পাঁইপাঁই করে ছুটতে লাগল। চার স্যাঙাতও তাকে ধরার জন্য পিছুপিছু দৌড়তে লাগল। সাতকড়ি ছুটতে ছুটতেই হঠাৎ উবু হয়ে বসে পড়ল। যে ছোকরা তার পিছনেই ছিল, সে সাতকড়ির পিঠে হোঁচট খেয়ে একটা ডিগবাজি দিয়ে সামনের দিকে দড়াম করে আছড়ে পড়ল। সাতকড়ি বসা অবস্থাতেই পিছন ফিরে পরের ছোকরা নাগালে আসতেই পা বাড়িয়ে তাকে একটা লেঙ্গি মারল। এই ছোকরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শূন্যে উঠে রাস্তার পাশে নয়ানজুলিতে গিয়ে পড়ল। পরের ছোকরা তার দিকে হাত বাড়াতেই সে হাতটা ধরেই ছোকরার ছুটন্ত শরীরটাকে নিজের চারদিকে বারকয়েক পাক খাইয়ে ছেড়ে দিল। ছোকরা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল রাস্তার উপরেই। চতুর্থ জন এসে জাপটে ধরল সাতকড়িকে। সে তার কনুই দিয়ে ছোকরার পেটে একটা মোক্ষম গুঁতো দিতেই ছেলেটা সাতকড়িকে ছেড়ে পেট চেপে বসে পড়ল।

চোট আর বিস্ময় সামলে ছেলে চারটে উঠে দাঁড়ানোর আগেই ধীরেসুস্থে হাঁটা দিল সাতকড়ি। সে জানে ছেলেগুলো আর তার পিছু নেবে না। নিলেও চিন্তা নেই, তার কাছে আরও কিছু মুষ্টিযোগ আছে।

তাকে দেখে গজপতি ভারী খুশি হয়ে বলল, “আরে, এসো এসো সাতকড়ি, অনেকদিন বাদে তোমাকে দেখলাম। তা খবরাখবর সব ভাল তো?”

“আজ্ঞে, খবরের চেয়ে অখবরই বেশি।”

“কেন বলো তো! শুনলুম কাল রাত্তিরে নাকি রাজবাড়ি থেকে সেই পুতুলটা চুরি হয়ে গেছে?”

“একটা পুতুল চুরি হয়েছে বটে। তবে আপনি কোন পুতুলটার কথা বলছেন?”

গজপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সে একটা ছিল, সবুজ পোশাক পরা ভারী সুন্দর ডলপুতুল। চোখদুটোয় হিপনোটিজ়ম ছিল হে। আমি তো ভয় পেয়ে আর কখনও গোলঘরে যাইনি। শুনছি সেটাই নাকি চুরি গেছে। শুনে ভারী দুঃখ পেয়েছি। ও জিনিস আর ভূ-ভারতে ও পাওয়া যাবে না।”

“আজ্ঞে, সেটাই চুরি গেছে বটে।”

“বাড়িতে আগলবাগল না থাকলে এসব তো হবেই। কী আর করা!”

“যে আজ্ঞে।”

“রাজবাড়ি আমার নিজের বাড়ির মতোই। আমার বাবার ঠাকুরদা এস্টেটের দেওয়ান ছিলেন। রাজবাড়িরই পয়সায় আমাদের প্রতিপালন হয়েছে। ও বাড়ির কাছে আমাদের অনেক ঋণ। বুঝলে?”

“যে আজ্ঞে। তবে এখন আর কাউকে প্রতিপালন করার ক্ষমতা নেই। তাঁরা নিজেদেরই প্রতিপালন করে উঠতে পারছেন না। কী আর বলি দুঃখের কথা। এ বাড়ির মায়ায় বড় আটকে গেছি। সেদিন রানিমা দুঃখ করে বলছিলেন, ‘এর চেয়ে ভিক্ষে করলেও কিছু পয়সা হত। কিন্তু কী করি বলো। এ জায়গায় একসময় রাজত্ব করেছি বলে চক্ষুলজ্জায় সেটা আর পেরে উঠছি না।””

“বলো কী! রাজবাড়ির এরকম দুর্দশা হয়েছে নাকি?”

“যে আজ্ঞে। ভাতের ফ্যান ফেলা হয় না, তরকারির খোসাসুদ্ধু রাঁধতে হয়। সর্ষের তেল যে কতকাল বাড়িতে ঢোকেনি! দুধ-ঘিয়ের তো প্রশ্নই ওঠে না।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গজপতি বলে, “আমরা অনেকেই টাকাকড়ি দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাজামশাইয়ের আত্মসম্মান বোধ বড্ড বেশি। রাজি হননি। বললেন, ‘রাজত্ব গেছে যাক, কিন্তু এখন কি সম্মানটাও খোয়াব?’ আমরা আর রা করতে পারিনি।” “যে আজ্ঞে। রাজামশাইয়ের ওটা খুব আছে বটে।”

“শোনো সাতকড়ি, আমার চারটে দুধেল গাই, অঢেল দুধ হয়। তুমি বরং কাল থেকে রাজামশাই আর রানিমার জন্য রোজ এক সের করে দুধ নিয়ে যেয়ো।”

“যে আজ্ঞে। ওতেই ভাসাভাসি কাণ্ড হয়ে যাবে।”

“তুমি ওঁদের বড্ড ভালবাসো, তাই না!”

“আজ্ঞে, ভালবাসা জিনিসটা তো বুঝি না। তবে খিদে-তেষ্টায় কাতর হয়ে যখন মরতে বসেছিলাম, তখন রানিমা তুলে নিয়ে গিয়ে আমাকে রক্ষা করেন। টাকাপয়সা দিতে পারছেন না, তবে বড্ড স্নেহ করেন। আমি বাউন্ডুলে মানুষ, এঁদের কাছে খুব বাঁধা পড়ে গেছি। এঁদের ছেড়ে যেতেও পারছি না।”

“তুমি যে ভাল লোক, তা আমি জানি।”

মাঝরাত্তিরে ওই একই কথা আর একজনও বলল সাতকড়িকে। পুতুলটা। পুতুলকে আর কাছছাড়া করেনি সাতকড়ি। এখন পুতুলকে সে নিজের ঘরে লুকিয়ে রাখে। পুতুলটা চুরি গেছে বলে যে খবর রটেছে, তা আর সে ভাঙেনি। রাতে নিজের বালিশেই শুইয়ে রাখে, নিজে হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমোয়। পুতুল বড্ড মেজাজি, কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় না, কিন্তু যখন-তখন নিজের খেয়ালে কথা বলে ওঠে। যেমন এখন বলল, “তুমি একজন ভাল লোক।” তারপরই স্পিকটি নট। একদম চুপ। সাতকড়িও বেশি ঘাঁটায় না পুতুলকে।