গড় হেকিমপুরের রাজবাড়ি – ২

রাজমাতা বৃন্দাবনবাসিনী দেব্যার সঙ্গে সুহাসিনীর সম্পর্ক আদায়কাঁচকলায়। বেহানবেলায় বৃন্দাবনবাসিনী শুদ্ধ বস্ত্র পরে দেড়শো বছরের পুরনো জলচৌকিটায় বসে মালা টপকাচ্ছিলেন, রোজ যেমন টপকান। আজ সকালখানা ভারী ঠান্ডা আর শান্ত, বাইরে পাখির কূজন শোনা যাচ্ছে, মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে, গাছপালায় মর্মরধ্বনিও উঠছে, হাতের মালাটা বনবন করে ঘুরছে আর জপটাও তরতর করে এগোচ্ছে। ঠিক এমন সময়ে হড়াম করে দরজাটা খুলে জলভর্তি লোহার বালতিটা ঠকাস করে মেঝেয় রেখেই সুহাসিনী হুড়ো দিয়ে বলে উঠল, “এখন সরো তো, বিছানায় উঠে পা তুলে বোসো। আমার সময় নেই, ঘর মুছব।”

বৃন্দাবনবাসিনী এই প্রাতঃকালটায় অশান্তি পছন্দ করেন না। তিনি অতি শান্ত গলায় বললেন, “দ্যাখ সুহাসিনী, এখন আমি জপে বসেছি, এ সময়ে তুই কোন আক্কেলে ঘর মুছতে ঢুকিস? সহবত বলেও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি?”

সুহাসিনী ঝংকার দিয়ে বলে উঠল, “তোমার শরবত নিয়ে তুমি থাকো গে, আমার বাপু আরও পাঁচ বাড়িতে কাজ আছে।”

তবু বৃন্দাবনবাসিনী ধৈর্য হারালেন না। গলা উঁচুতে না তুলেই বললেন, “হ্যাঁ রে সুহাসিনী, কার সঙ্গে কথা কইছিস, তা কি খেয়াল আছে?”

“ও মা! এ ঘরে তুমি ছাড়া আর কে আছে যে কথা কইব?” “আমি যে রাজমাতা, তা কি বিস্মরণ হয়েছিস নাকি?”

“সে তুমি রাজমাতাই হও, আর ছাতামাথাই হও তাতে আমার কী? আমাকে গতর খাটিয়ে খেতে হয়, বুঝলে? রোজ সকালে ঘর জুড়ে বসে জপ করার কী? অত বড় জবড়জং খাট আছে, ঘরের কোণে অত বড় একটা পাটাতনের সাইজ়ের চেয়ার রয়েছে, তবু রোজ ঘরের মাঝখানটায় যে আড় হয়ে বসে জপের অছিলায় ঝগড়ার সুতো খোঁজো, তা কি আমি জানি না?”

“ওম্মা গো! আমি আবার কবে ঝগড়া করলুম!”

“আকাশ থেকে পড়লে যে! তোমার গলা থেকে যে রোজ ফাটা বাঁশের আওয়াজ বেরয়, তা সবাই শুনতে পায়। আর কত মিছে কথা কইবে! অত মিছে কথা কইলে জপতপে কি কাজ হয় বাপু?”

বৃন্দাবনবাসিনী এবার গলা তুলে বললেন, “তোর আস্পদ্দা যে আকাশে উঠেছে!বলি তুই কি দারোগার বউ, না জজের মা, যে অমন বুক চিতিয়ে কথা কইছিস! আগেকার দিন হলে তো তোকে উঠোনের আম গাছটার সঙ্গে বেঁধে বিছুটি দেওয়াতুম।”

বৃন্দাবনবাসিনীর মুখের সামনে দু’হাতের বুড়ো আঙুল নেড়ে সুহাসিনী বলে, “সে দিন আর নাই রে নাতি, থাবা-থাবা চিনি খাতি! ফোকলা বাঘের তর্জনগর্জন সার। এখন জলচৌকিটা ছেড়ে ওঠো দেখি, আমি কাজ সারি। তোমার সঙ্গে বকবক করতে গিয়ে রোজপড়ে আমার অন্য লোকের বাড়ি যেতে দেরি হয়ে যায়।”

বৃন্দাবনবাসিনী আর ট্যাঁ-ফোঁ না করে বিছানায় উঠে বসে গলা তুলে বললেন, “এ হল আমার ঘর, এ ঘরে আমি কোথায় বসব না-বসব সেটা কি তুই ঠিক করবি? বড্ড বাড় বেড়েছে তোর, বুঝলি?”

“আর ঘরের গুমোর কোরো না তো! বাড়িখানা যে গর্দানভাই অটোয়ালের কাছে বাঁধা আছে, তা সবাই জানে। মাঝে-মাঝেই তো এসে হুমকি দিয়ে যায়। যদি একদিন পাইক-বরকন্দাজ নিয়ে এসে সবাইকে রাস্তায় বের করে দিয়ে বাড়ির দখল নেয়, তখন ঘরের গুমোর কোথায় যাবে বলো তো বৃন্দাঠাকরুন!”

এবার বৃন্দাবনবাসিনী হুঙ্কার ছাড়লেন, “কার এত বুকের পাটা যে রাজবাড়ি দখল করবে? গড় হেকিমপুর রাজ্যে আট হাজার সেপাই, কামান, বন্দুক, কীসের কমতি আছে বল তো! এক ডাকে আমাদের

হাজার-হাজার প্রজা দা-কুড়ুল নিয়ে বেরিয়ে আসবে না? তোর গর্দানভাইয়ের গর্দান কি আস্ত থাকবে?”

“ওই আনন্দেই থাকো! আট হাজার সেপাই! ফুঃ! ওই তো একটা বুড়ো হাবড়া, হেঁপো কেশো রুগি শিউচরণ সিং হল গে তোমাদের সেপাই, দেউড়িতে ভাঙা টুলে বসে ঝিমোয়। আট হাজার সেপাইয়ের স্বপ্ন দেখছ নাকি? খাইয়েদাইয়ে, বেতন দিয়ে পুষতে পারবে আট হাজার সেপাইকে? শিউচরণের বেতনই বলে মাস-মাস বাকি পড়ছে! আর লোক হাসিয়ো না তো বাপু! সেই ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি রাজবাড়ির কামান সামনের বাগানে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে আর ছেলেরা তার উপর উঠে ঘোড়া-ঘোড়া খেলছে, আর বন্দুক-পিস্তল তো কবেই মরচে পড়ে ঝুরঝুরে হয়ে গেছিল, কালী লোহার সের দরে কিনে নিয়ে লাঙলের ফাল আর হাত-দা বানিয়েছে।”

বৃন্দাঠাকরুন তবু ফুঁসে উঠে বললেন, “ওরে, অত তড়পাসনি, মরা হাতি লাখ টাকা। নেই-নেই করেও যা আছে, তাতে সাতটা গৰ্দানভাই কেনা যায়, বুঝলি?”

“মুরোদ জানা আছে। নিজের চোখেই দেখেছি, এক পো কুচো চিংড়ি কিনতে তোমাদের বাজারসরকার সাতকড়ি সাতবার আগুপাছু করে। আর বাজারসরকারেরই বা কী ছিরি! একটাই লোক বাজারসরকার সেজে বাজার করছে, ফিরে এসে জামা ছেড়ে চাকর হয়ে বাসন মাজতে বসে যাচ্ছে, আবার সে-ই রাঁধুনি হয়ে রাঁধতে লেগে যাচ্ছে! একটা বোকাসোকা লোক পেয়েছিলে বলে রক্ষে। নইলে ফুটুনি বেরিয়ে যেত। সাত মাসের মাইনে বাকি, তাও মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে। আর নিজের ঢাক কত বাজাবে বাপু!ঢাক যে ফেঁসে গিয়ে ঢ্যাপঢ্যাপ আওয়াজ বেরচ্ছে।”

বৃন্দাঠাকরুনের আবেগ হঠাৎ উথলে উঠল, “এত বড় কথা! তবে দেখতে চাস? এই দ্যাখ!” বলে শিয়রের তোশকের তলায় হাত ঢুকিয়ে একটা বিঘতখানেক লম্বা পেতলের চাবি বের করে দেখিয়ে বললেন, “এবার বিশ্বাস হল তো যে, এ বাড়ির মহিমে এখনও শেষ হয়নি?”

সুহাসিনী মুখ বেঁকিয়ে বলে, “আ মোলো যা, ও চাবিও কি আজ দেখছি নাকি! সেই জন্মবয়স থেকে দেখে আসছি। তোমার শ্বশুর মরার সময়ে তোমাকে দিয়ে গেছিল। সে গল্পও হাজারবার শুনেছি। বলি চাবি দিয়ে আজ অবধি কোনও তোশাখানা খুলতে পেরেছ কি? সাতাশ বছর ধরে ধস্তাধস্তি তো কিছু কম করোনি।”

বৃন্দাঠাকরুন অত্যন্ত কুপিত হয়ে বলেন, “যা তো মুখপুড়ি, ঘর মোছা হয়ে গেছে, এবার বিদেয় হ। সকালবেলায় তোর মুখ দেখলে পাপ হয়।”

“এহ, পাপ হয়! আমার বাবার ঠাকুরদা এবাড়ির হুঁকোবরদার ছিল বলে মায়া করে কাজ করে দিয়ে যাই, নইলে এ বাজারে তিনশো টাকায় কেউ এ কাজ করে? তাও প্রতি মাসে বেতনের টাকা তিন কিস্তিতে আদায় হয়। আমি ছেড়ে দিলে আর কাজের লোক জুটবে ভেবেছ? এই পোড়া মুখখানা সকালে একদিন না দেখলে তো এবাড়িতে কান্নাকাটি যায়। তখন তো বাবা-বাছা বলে কত তোষামোদ! তখন কোথায় থাকে তোমার পাপ?”

“ওহ, ভারী কাজ দেখাচ্ছে! গড় হেকিমপুরের রাজবাড়ি বলে কথা। এ বাড়িতে কাজ করতে পারলে লোকে বর্তে যায়, তা জানিস? বরাবর এ বাড়ির কাজের লোকেরা বেতন পেয়েছে মোহরে। ইদানীং একটু টানাটানি যাচ্ছে বলে না হয় প্রথাটা ভাঙতে হয়েছে। তার জন্য কত কথাই শোনালি!হাতি যখন খন্দে পড়ে, চামচিকেও লাথি মারে।”

“হ্যাঁ, নিৰ্যস বলেছ, যখন চামচিকের সময় আসে তখন চামচিকে লাথি তো মারবেই। তখন মুখটি বুজে লাথি হজম করতে হয়, বুঝলে? বাক্যি দিয়ে বাঘ-ভাল্লুক মারলে তো চলবে না, মুরোদ চাই।”

আজ গড় হেকিমপুরের হাটবার। কাঁটাপুর খালের ধারে বেশ ফাঁদালো হাট। মেলা মানুষের আনাগোনা। একখানা চটের ব্যাগ হাতে সাতকড়ি বহুক্ষণ ধরে হাটের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত টানা মেরে যাচ্ছে। রানিমা মোটে তিরিশটি টাকা হাতউপুড় করে যে ফর্দখানা ধরিয়ে দিয়েছেন, তা দেখলে চোখ কপালে ওঠার কথা। তবে কিনা সাতকড়ির অভ্যেস আছে। অনেক মাথা খাটিয়ে এবং বিস্তর দরাদরির পর সে কেনাকাটা শুরু করে। বেলা গড়ালে দরও একটু নামে। আর ফর্দটাও মাথায় রাখলে চলে না। কারণ ফর্দে ঘি, গরম মশলা, পাঁঠার মাংস, চিতলের পেটিও আছে। প্রথম দিন ফর্দ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে পুরুতমশাইকে গিয়ে দেখিয়েছিল। তা রাজপুরোহিত ব্ৰহ্মপদ ভট্টাচাৰ্য একটু হেসে বললেন, “ওরে, রাজবাড়ির ফর্দ বলে কথা, ওসব না লিখলে কি মানমর্যাদা থাকে? ওসব লিখতে হয়। তা বলে তুই ঘাবড়াস না। যা পারিস, নিয়ে আয়।” সাতকড়িও বোঝে, ওসব অভ্যেসের বশে লেখা। ওসব জিনিস বহুকাল রাজবাড়ির দেউড়ি পেরিয়ে ভিতরে ঢোকেনি। সাতকড়ি হাটের উত্তর দিকে এক প্রান্তে এক ব্যাপারীকে দেখে তাক করে এগোচ্ছিল। ব্যাপারী বেগুন আর ঢ্যাঁড়শ বেচতে বসেছে। একটু যেন উসখুস ভাব, বোধ হয় বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। এই সময়ে কেনা দামে মাল ছেড়ে দেয় ব্যাপারীরা। কিন্তু দশ কদম এগোতে না-এগোতেই আচমকা সামনে পাহাড়ের মতো হারাধন খাসনবিশ পথ আটকে দাঁড়াল।

“এই যে সাতকড়ি, বলি হন্তদন্ত হয়ে চললে কোথায়?”

সাতকড়ি বিগলিত হয়ে হাত কচলে বলে, “এই আজ্ঞে, একটু বাজারহাট করছি।”

হারু খাসনবিশ চোখ দু’খানা সরু করে তাকে নিরীক্ষণ করে বলে, ‘একটা কথা কও তো সাতকড়ি। এই আমরা যারা গড় হেকিমপুরে থাকি তারা সবাই ভূমিপুত্তুর। এ গাঁয়ে চার-পাঁচ পুরুষের বাস। উটকো যারা এসে জোটে, তারাও কারও না কারও আত্মীয়-কুটুম। কিন্তু তুমি কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলে বলো তো! বলি তোমার মতলবখানা কী? শুধু জুড়েই বসোনি, রাজবাড়িতে কাজও জুটিয়ে নিয়েছ।”

সাতকড়ি ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলে, “আজ্ঞে, আপনি তো জানেন হারুবাবু, আমার চালচুলো নেই, পৈলেন গাঁয়ে বাস ছিল, তা সেখান থেকে হুড়ো দিয়ে তাড়াল বলে নানা জায়গায় ঠেক খেয়ে-খেয়ে এখানে আগমন। খিদে-তেষ্টায় প্রাণ যেতে বসেছিল। রানিমা দয়া করে থাকতে দিয়েছেন। মতলব কিছু নেই।”

“ও গল্প তো সবাই জানে। বলি ভিতরে আর কোনও গল্প নেই তো!কোনও সুলুকসন্ধানে যে রাজবাড়িতে ঢোকোনি, তার প্রমাণ কী? একটু খোলসা করে বলো তো ভায়া, কোনও গোপন খবরটবর আছে নাকি?”

সবেগে মাথা নেড়ে সাতকড়ি বলে, “আজ্ঞে না, হারুবাবু।”

“শোনো বাপু, আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা ছিলেন রাজবাড়ির সহিস। তাই রাজবাড়ির উপর আমাদের একটা হক আছে। বলতে গেলে, আমি রাজবাড়িরই লোক। এক রকম হিস্যাদারও বলতে পার। যদি কোনও সুলুকসন্ধান পেয়েই যাও তা হলে আমাকে খবর দিতে যেন ভুল না হয়। তোমার যে একটামাত্র গর্দান, সেটা যেন মনে থাকে।”

সাতকড়ি ভালমানুষের মতো ঘাড় কাত করে বলে, “যে আজ্ঞে।” যেতে গিয়েও ফিরে দাঁড়িয়ে হারু বলে, “শুনলুম তোমার নাকি সাত মাসের বেতন বাকি! সেটাও তো সন্দেহের কথা। এ-বাজারে কেউ বিনিমাগনা কারও বাড়িতে গতরে খাটে! না হে বাপু, তোমার মতলব আমার ভাল ঠেকছে না। তুমি বড় দাঁও মারার তালে আছ?”

সাতকড়ি বিনয়ের সঙ্গেই বলে, “না হারুবাবু, মতলব কিছু খারাপ নেই। মরতেই তো বসেছিলুম, এখন মাথার উপর ছাদ আর দু’বেলা দু’মুঠো ভাত তো জুটছে! তাই বেতনের জন্য চাপাচাপি করিনি। আর আমারটা খাবেই বা কে! তিনকুলে আমার কি কেউ আছে!”

হারাধন কটমট করে খানিক চেয়ে থেকে বলল, “তুমি গভীর

জলের মাছ হে! তবে আমিও চোখে-চোখে রাখছি তোমাকে। কথাটা মনে রেখো।”

“যে আজ্ঞে।”

হারুবাবুর পাল্লায় পড়ে মওকাটা একটু হলেই ফসকে যেত, ব্যাপারী তার ঝুড়ি ওঠানোর তোড়জোড় করছিল, সময়মতো গিয়ে পড়ায় অর্ধেকেরও কম দামে ঢ্যাঁড়শ আর বেগুন কিনে ফেলতে পারল সাতকড়ি। তাতেই ফতুর হওয়ার জোগাড়। কোনওক্রমে এক আঁটি কলমি শাক, দু’টি পাতিলেবু আর একমুঠো কাঁচা লংকাও হল।

“ওহে, তুমি কত কড়ি যেন?”

বাজার ফেরত সাড়ে তিন টাকা এখনও পকেটে রয়েছে, তাই দিয়ে কী কেনা যায়, সেটা গভীরভাবে ভাবছিল সাতকড়ি। ঠাকুরমশাই বলেছিলেন, ভাল করে মাথা খাটালে অল্প দিয়েও অনেক কিছু করা যায়। তাই সাড়ে তিন টাকা খুব অল্প টাকা বলে মনে হচ্ছিল না তার। কষে না ভাবলে মাথা থেকে ফিকির বের করা যায় না কিনা। সাড়ে তিন টাকায় কেনাকাটা করতে অঙ্কেরও মাথা চাই। আর অঙ্ক একবার মাথায় ঢুকলে ভূতের মতোই চেপে বসে। তাই সাড়ে তিন টাকার ফেরে পড়ে ভাবতে-ভাবতে তার বাহ্যজ্ঞান একরকম ছিল না বললেই হয়। তাই কথাটা শুনতে পায়নি।

“ওহে বাপু, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? বাজার করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া খুব খারাপ। আমার জ্যাঠামশাইয়ের তো ওই কারণেই একান্ন টাকা পকেটমার হয়ে গেছিল কিনা। ওহ, সে কী ঘুম রে বাবা! একবার তো এমন ঘুমোলেন যে, একেবারে পরের দিন দু’দিনের বাজার করে ফিরলেন।”

চটকা ভেঙে সাতকড়ি লজ্জিত হয়ে বলল, “ভোলাবাবু, নমস্কার। ঘুমিয়ে পড়িনি আজ্ঞে, তবে একটু ভাবনায় পড়েছি কিনা।”

“কেন বাপু, তোমার সামনে কি কোনও এগজামিন-টেগজামিন আছে?

“কী যে বলেন ভোলাবাবু, ইস্কুল-পাঠশাল চোখেই দেখলাম না, তো এগজামিন?’

‘ইয়ে, তা তুমি কত কড়ি যেন?”

“আজ্ঞে, সাত হলে কি আপনার চলবে?”

“সাত! তা সাতই বা মন্দ কি? আসলে আমিও একটু ভাবনায় পড়েছি কিনা। তাই এতক্ষণ একটা চেনামুখ খুঁজছিলাম, শেষে এই তোমাকে দেখে ভারী চেনা-চেনা লাগল। শুধু কি তাই! নামটাও মনে পড়ে গেল।”

“আজ্ঞে, এ তো আমার সৌভাগ্য, আমার মতো একজন হ্যাতান্যাতার নাম কে-ই বা মনে রাখে বলুন। তা আপনার ভাবনাটা কী নিয়ে?”

“বাড়ি থেকে পইপই করে বলে দিয়েছে, আজ ঝিঙে আনতেই হবে। তা আমি একজনের সঙ্গে দরাদরি করে কিনতে গিয়ে শুনলুম সেটা নাকি ঝিঙেই নয়, চিচিঙ্গে। কী মুশকিল বলো তো! আচ্ছা তুমি কি বলতে পার ঝিঙেটা দেখতে ঠিক কেমন? গোল না লম্বা! আমি যে জানি না তা নয়, কিন্তু এখন পেটে আসছে কিন্তু মাথায় আসছে না। তা একজন বলল ঝিঙের গায়ে নাকি লম্বা-লম্বা খাঁজ আছে, তো সেইমতো কিনতে গিয়ে শুনলুম সেটা নাকি ঢ্যাঁড়শ। কী বিপদেই যে পড়েছি ভায়া?”

“আজ্ঞে, বিপদের সঙ্গেই আমাদের বসবাস। কিন্তু ভোলাবাবু, আপনি তো ভুলো মনের মানুষ, একটু কষে ভাবুন তো, বাড়ি থেকে ঠিক ঝিঙের কথাই বলেছে কি? অন্য কিছু নয় তো?”

ভোলাবাবুর চোখ হঠাৎ গোল-গোল হয়ে গেল, “সর্বনাশ, তা হলে কি ঝিঙের কথা বলেনি! তা হলে কীসের কথা বলেছে বলো তো?”

“সেইটেই তো আপনাকে ভাবতে বলছি! আমি যতদূর শুনেছি আপনি তেমন জুৎসই বাজার করতে পারেন না বলে আপনাকে বাড়ি থেকে বাজারে পাঠানো হয় না। তাই আপনাকে বাজারে দেখে আমারও ধন্দ লাগছে।”

ভোলাবাবু হঠাৎ দু’হাতে মাথা চেপে ধরে উবু হয়ে বসে পড়ে বললেন, “তাই তো! তা হলে আমি বাজারে এলুম কেন বলো তো?”

“মাঝে-মাঝে বাজারে আসা খারাপ কিছু নয়। বাজারে এলে মানুষের শিক্ষে হয় বলে শুনেছি, বস্তুজ্ঞান বাড়ে, কাণ্ডজ্ঞান হয়। এমনি বেড়াতে-বেড়াতে মাঝে-মাঝেই চলে আসবেন।”

ভোলাবাবু ফের একটা ঝাঁকি মেরে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, “দাঁড়াও বাপু, দাঁড়াও, আমার যেন আবছা মনে পড়ছে, আমি কলেজের ক্লাস নেব বলে বেরিয়েছিলুম। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। যখন রিকশায় উঠেছি, তখন কে যেন পিছন থেকে বলল, ‘ওগো, আজ কিন্তু হাট থেকে ঝিঙে আনতে ভুলো না, ’ কে বলল বলো তো!”

“আজ্ঞে গিন্নিমা হতে পারেন, পাশের বাড়ির যদু ঘোষের বউ হতে পারেন, দৈববাণী হওয়াও বিচিত্র নয়।”

“তুমি আমার মাথাটাকে আর গুলিয়ে দিয়ো না তো! কিন্তু যদু ঘোষের বউ কি আমার পাশের বাড়িতে থাকে?”

“যদি বাড়ি বেচে ভিনগাঁয়ে চলে গিয়ে না থাকেন, তা হলে তো যদুবাবুর আপনার পাশের বাড়িতেই থাকার কথা। আর যদু ঘোষ যদি থেকে থাকেন, তা হলে তাঁর গিন্নিরও না-থাকার কথা নয়।”

ভোলাবাবুর চোখ ফের গোল গোল হয়ে গেল, “বলো কী! যদু ঘোষের বউয়ের এত সাহস যে, আমাকে ঝিঙে আনতে বলবে?”

“আজ্ঞে যা দিনকাল পড়েছে, তাতে লোকের আস্পদ্দা বড়ই বেড়েছে। মানীর মানমর্যাদা আর বজায় থাকছে না।”

“কিন্তু আমিই বা কোন আক্কেলে যদু ঘোষের বউয়ের জন্য ক্লাস কামাই করে হাটে ঝিঙে খুঁজে মরছি!”

“আহা, বিচলিত হবেন না। ‘ওগো, আজ কিন্তু হাট থেকে ঝিঙে আনতে ভুলো না’— এ বড় জব্বর কথা, তবে কিনা এ কথাটা দুনিয়ার যে-কোনও গিন্নিমাই তাঁর কর্তাকে বলতে পারেন। আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে, কথাটা যদুবাবুর বউ যদুবাবুকেই বলেননি তো! একটু আগে আফতাবের দোকান থেকে যদুবাবুকে যেন ঝিঙে কিনতে দেখেছি বলেও মনে হচ্ছে।”

ভোলাবাবু ভারী লজ্জিত হয়ে বলেন, “ইস, ছিঃ ছিঃ, বড্ড ভুল হয়ে গেছে তো! আর-একটু হলেই রাজ্যের ঝিঙে নিয়ে কি বিপদেই না পড়তে হত!ভাগ্যিস তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তোমার নামটা কত কড়ি যেন!”

“ওই সাতই থাক।”

“না হে, তুমি কিন্তু একজন বিচক্ষণ লোক, তোমাকে হাতে রাখা দরকার। কোথায় থাকা হয় যেন?”

“আজ্ঞে আমার ঠিকানা খুব সোজা। গড় হেকিমপুরের রাজবাড়ি বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে।”

“আরে, আগে বলবে তো! তুমি হলে গিয়ে রাজবাড়ির সাতকড়ি! সেই জন্যই মুখটা অমন চেনা-চেনা লাগছিল। তাই বলো! তুমি তো চেনা লোকই হে! আর রাজবাড়িই কি আমার অচেনা নাকি! রাজা বিক্রম নারায়ণের সভাপণ্ডিত ছিলেন গদাধর মুস্তফি। আমার দাদুর ঠাকুরদা। ছেলেবেলায় রাজবাড়ির মাঠে কত খেলেছি, কুল আর পেয়ারা চুরি করে খেয়েছি। তা হলে তুমি তো একরকম আমাদের নিজেদেরই লোক, কী বলো?”

“আজ্ঞে, আমার সৌভাগ্য।

গলাটা এক পরদা নামিয়ে ভোলাবাবু বলেন, “তা হলে আজকের ঘটনাটা তোমার আর আমার মধ্যেই থাক। পাঁচ কান করার দরকার নেই। বরং এই পঞ্চাশটা টাকা রাখো।”

“না ভোলাবাবু, ঘুষ দিতে হবে না। ঘটনা যে কিছু ঘটেছিল তা তো আমার মনেই নেই।”

“আহা ঘুষ নয় হে, ঘুষ নয়, এটা রাজবাড়ির নজরানা বলেই ধরে

নাও না কেন। রাজবাড়িরই অন্নে আমাদের প্রতিপালন হয়েছিল তো। এটুকু তো আমাদের করাই উচিত।”

ভারী লজ্জার সঙ্গে সাতকড়ি টাকাটা নিয়ে জামার পকেটে পুরে একগাল হেসে বলল, “রাজবাড়িতে সর্ষের তেলের ব্যবহার এক রকম উঠেই গেছে কিনা। রাজামশাই সেদ্ধ, পোড়া খেতে গিয়ে একটু খুঁতখুঁত করেন। তা আজ এক পলা সর্ষের তেল নিয়ে যাব ভাবছি।”

“বেশ-বেশ। রাজা-গজাদের তেল দেওয়া খুব ভাল। তা হলে

আমি বরঞ্চ কলেজের দিকে রওনা হয়ে পড়ি, কী বলো?” “সে আর বলতে!”

ভোলাবাবু রওনা দেওয়ার পর সাতকড়ি একটু তেল, একভাগা চুনো মাছ আর বুক ঠুকে একটা মোচাও কিনে ফেলল। আজ একেবারে ভাসাভাসি বাজার হয়েছে। রাজবাড়ির পক্ষে রীতিমতো ভোজ। সাতকড়ি বেশ প্রসন্নমনে মুখে একটু হাসি ঝুলিয়ে হাটটা আর একবার টহল দিচ্ছিল, হঠাৎ পিঠে একটা ছোটমতো থাবড়া খেয়ে মুখ ফেরাতেই একটা গোলগাল হাসিমুখ চোখে পড়ল।

“কত সরালে হে সাতকড়ি? রাজবাড়ির বাজার বলে কথা! মার্জিন ভালই থাকবে, কী বলো?”

প্রাতঃকালটায় কিপটে শিবু গায়েনের মুখ দেখলে নাকি হাঁড়ি ফাটে, দুধ কেটে যায়, ডাল সেদ্ধ হয় না। তবে সাতকড়ি ঠাহর করে দেখল, একটু বেলা হয়েছে, ঠিক প্রাতঃকাল বলা যায় না। সে বেশ বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “যে আজ্ঞে, তা মার্জিন তো থাকার কথাই শিবুবাবু, তবে জিনিসপত্তরের দামটাও এমন ফোঁসফোঁস করছে যে, কাছে এগোতে বুকের পাটা লাগে। মার্জিন মোটে থাকছেই না।”

“তা মালপত্র সরালে কেমন? এই ধরো, থালাটা, বাটিটা, রুপোর চামচ, রানিমার হাতবাক্সের লুকোনো মোহর কিংবা রাজামশাইয়ের হিরের আংটি, এসব সরাতে পারনি?”

ভারী লজ্জিত হয়ে সাতকড়ি বলে, “আজ্ঞে আমি বড়ই অপদার্থ। তেমন হাতমকশো হয়নি তো?”

“দূর-দূর, তুমি কোনও কন্মের নও। আমরা ছেলেবেলায় রাজবাড়িতে খেলতে গিয়ে কত কী কুড়িয়ে আনতাম। বিলিতি পুতুল, রুটি কাটার ছুরি, পাথরের পরি। নেই-নেই করেও রাজবাড়িতে এখনও যা আছে তাতে এই তোমার মতো মানুষকে সাতবার কেনা যায়।”

“না শিবুবাবু, সাতবার নয়, আরও বেশি হবে। আমার মতো মনিষ্যির কি কোনও দাম আছে?”

“তা অবিশ্যি ঠিক। নিজের দাম বাড়াতে না পারলে কাজের কাজ হয় না। আর দাম বাড়াতে গেলে কাম বাড়াতে হয়। যত কাজ করবে তত দাম বাড়বে। তাই বলি নিজের দামটা এবার বাড়িয়ে ফেলো।”

“আজ্ঞে তা তো বটেই। বড় নির্যস কথা বলেছেন। মাঝে-মাঝে এরকম মোক্ষম কথা শুনলে গা বেশ গরম হয় কিন্তু।”

“আমার কাছে মোক্ষম কথা ছাড়া অন্য কথা পাবে না।” “আজই বাড়ি গিয়ে কথাটা লিখে ফেলতে হবে। দাম বাড়াতে গেলে কাম বাড়াতে হয়। জব্বর কথা মশাই।”

শিবু গায়েন চোখটা একটু ছোট করে, গলাটা একটু নামিয়ে বলে, “শুনলুম, তোমার নাকি সাত মাসের মাইনে বাকি! সত্যি নাকি?” “যে আজ্ঞে।”

জিবে একটু আফসোসের চুকচুক শব্দ করে শিবু গায়েন বলে, “এহ, এটা তো ঠিক হচ্ছে না!সাত মাসের বেতন তো কম কথা নয়?” “আজ্ঞে সে তো বটেই।”

“তা হলে তোমার চলছে কী করে বলো তো বাপু!”

“আজ্ঞে সে কথা শুনলে চোখে জল আসবে শিবুবাবু। আমার কিছুই চলছে না মশাই, সব থেমে আছে। বাড়বৃদ্ধি নেই, আগুপাছু নেই, থেমে আছি তো থেমেই আছি। পালপাড়ার চাকাভাঙা রথটার মতো।”

“এ তো ভাবনার কথা হল হে।”

“যে আজ্ঞে। বড়ই ভাবনার কথা।”

“রাজবাড়ি তো এক রকম আমারও বাড়ি কিনা। আমার ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ মনোহর গায়েন ছিলেন রাজা গোবিন্দনারায়ণের কোষাধ্যক্ষ। হরেদরে অর্থমন্ত্রীই ছিলেন বলতে পার। তাই রাজবাড়িকে পরের বাড়ি বলে ভাবতেই পারি না, বুঝলে!”

“যে আজ্ঞে, আপনাকে দেখেও কেওকেটা বলেই মনে হয়।”

“তা অবিশ্যি ঠিক। কিন্তু তুমি তো ভাবিয়ে তুললে বাপু। সাত মাসের মাইনে বাকি, এ তো বড্ড অবিচার! তা কী আর করবে, রাজবাড়ির অবস্থাও সুবিধের নয়।”

“সে কথাও ঠিক। রাজবাড়ির অবস্থা মোটেই সুবিধের নয়“তা তোমার কি কিছু হাতখরচা দরকার?”

“আহা, হাতখরচা কথাটা কতদিন শুনিনি!ও নামের যে বস্তু আছে তাই তো ভুলে গেছিলুম। হাতদুটো কতকাল হাতখরচার জন্য হাহাকার করছে। কিন্তু দেয় কে বলুন! তেমন পয়সাওয়ালা, মহানুভব, দানশীল, দয়ালু, দিলদরিয়া, উদার, অকৃপণ, রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মতো মানুষ কি আর আছে?”

“তা থাকবে না কেন? এই তো ধরো, আমিই তোমাকে দশটা টাকা দিতে পারি।”

ভারী অবাক হয়ে সাতকড়ি বলে, “আপনি দেবেন? তাই তো ভাবি দুনিয়াটা যে পাপ আর পাপীতে ভরে গেল, তা হলে এখনও চন্দ্র-সূর্য উঠছে কার জন্য? এই এতক্ষণে ধাঁধাটা কাটল। এই আপনার মতো দু’-চারজন এখনও টিকে আছেন বলেই চন্দ্র-সূর্য ওঠে। তা হলে দিয়েই ফেলুন, একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাক!”

“আহা, আমার পকেটে কি টাকাপয়সা থাকে? আমার বড্ড খরচের হাত বলে বেরনোর সময় আমার গিন্নি পকেট থেকে টাকাপয়সা সব বের করে রেখে দেন। কখন ফস করে গরিব-দুঃখীকে এক খাবলা টাকা দিয়ে দিলাম তার তো ঠিক নেই কিনা! একবার তো এক ভিখিরিকে দু’টাকাই দিয়ে ফেলেছিলাম প্রায়, ভাগ্যিস গিন্নি সঙ্গে ছিলেন, একেবারে শেষ মুহূর্তে ‘করো কী, করো কী’ বলে হাতটা চেপে ধরেছিলেন, তাই রক্ষে?”

সাতকড়ি মাথা নেড়ে বলে, “ওহ, জোর বেঁচে গেছেন মশাই!”

“হ্যাঁ, ফাঁড়াটা একচুলের জন্য কেটে গেছে। তবে টাকাটা তুমি এক রকম পেয়েই গেছ বলে ধরে নিতে পার। শুধু একখানা সোজা কাজ করে দিতে হবে।”

“সেটা একটু-একটু অনুমান হচ্ছিল কিন্তু শিবুবাবু। তা কাজটা কী?”

“কাজ বললে বাড়াবাড়ি হয়। ব্যাপারটা কাজের মতো কাজই নয়। রাজবাড়ির খাসমহলের উত্তর দিকের গোল ঘরে যে মস্ত আলমারিটা আছে তার উপরের তাকে একটা ছেলে ডলপুতুল আছে। সবুজ পোশাক পরা। সেইটে একটু এনে দিতে হবে।”

সাতকড়ি অবাক হয়ে বলে, “আপনার কি এখন আর পুতুলখেলার বয়স আছে শিবুবাবু?”

“আরে রামোঃ! আমি পুতুল খেলব কেন? আসল কথাটা তবে ভেঙেই বলি। ছেলেবেলায় যখন রাজবাড়িতে গিয়ে ঘুরঘুর করতাম তখনই ওই পুতুলটা দেখে ভারী ভাল লেগেছিল। তা রানিমা তখনই বলেছিলেন, ‘নিবি পুতুলটা? নে না! তখন চক্ষুলজ্জায় নিতে পারিনি। কিন্তু সেই থেকে পুতুলটা আমায় খুব টানে। এখন ভাবি রাজবাড়িতে পুতুলটা শুধুমুদু পড়ে আছে, তার চেয়ে ওটা আমার নাতিকে দিলে সে একটু খেলত। বুঝলে তো ব্যাপারটা?”

“আজ্ঞে, বুঝতে কোনও অসুবিধে হল না। তবে কিনা শিবুবাবু, ব্যাপারটা কিন্তু চুরির খাতে পড়ে যাচ্ছে।”

শিবু গায়েন হেঃ হেঃ করে হেসে বলে, “শোনো কথা! এ নাকি চুরি! ওরে বাপু, রানিমা তো সেই কোন কালেই পুতুলটা আমায় দিয়ে রেখেছেন। মনে করো, ওটা আমাকে উৎসর্গ করাই আছে। আমারই

জিনিস আমাকে এনে দিলে সেটা কোন আইনে চুরিতে দাঁড়ায় বলো তো!”

“তা বটে। তবে রানিমাকে গিয়ে সেটা মনে করিয়ে দিলেই তো হয়?”

শিবু গায়েনের মুখটা শুকিয়ে গেল, গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “আহা, রানিমাকে আবার বিরক্ত করার কী দরকার? ওঁর বয়স হয়েছে, পুরনো কথা হয়তো স্মরণে নেই। তা ছাড়া আমি একবার অসাবধানে রাজামশাইয়ের একটা কাট গ্লাসের গেলাস ভেঙে ফেলেছিলুম বলে রাজামশাই খুব রেগে যান। সেই থেকে আমার রাজবাড়িতে ঢোকা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। বুঝলে না! নইলে আমিই গিয়ে রানিমা’র কাছ থেকে পুতুলটা নিয়ে আসতুম।”

“দেখুন শিবুবাবু, ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, পরের দ্রব্য না বলিয়া লইলে তাহাকে চুরি করা বলা হয়। তা এইসব ভাল-ভাল কথাই তো আমাদের মা-বাপ। কথাগুলো এখনও তামাদি হয়ে যায়নি বলেই শুনেছি যেন।”

“আহা, ভাল কথা তো চিরকালই ভাল কথা। ওসব কথার কোনও মার নেই। শুনলেই গা-টা ঝাঁকি মেরে ওঠে, ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো। এই যে, সদা সত্য কথা বলিবে, লোভে পাপ পাপে মৃত্যু, অহঙ্কারের পতন নিশ্চয়ই, এমন কত ভাল-ভাল কথাই তো পুঁথিপত্তরে লেখা আছে। তবে কিনা ভাল কথাগুলোকে একটু পাশ না কাটালে কি সংসারধর্ম করা যায়! পাপী-তাপীতে দুনিয়াটা ভরে গেছে তো, তাই এদের সঙ্গে পাল্লা টানতে গেলে ভাল কথা মাথায় রাখলে কি চলে! শঠে শাঠ্যং বলেও তো একটা কথা আছে। ধরো, ধার নেওয়া কি ভাল? তবু এক মহাপুরুষ বলে গেছেন ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’। তা বাপু, তোমার পাপের ভয় হয়ে থাকে তা হলে আমি বরং টাকাটা পাঁচ গুণ করে দিচ্ছি, একেবারে কড়কড়ে পঞ্চাশ টাকা।”

“শিবুবাবু, আজকাল পঞ্চাশ টাকায় আধ লিটার সর্ষের তেলও হয় না। পঞ্চাশ টাকা এক সময়ে কেরানিবাবুদের মাসমাইনে ছিল। ফেলে-ছড়িয়ে-খেয়ে দিব্যি চলে যেত। পঞ্চাশ টাকার সেই সুদিন কি আর আছে! পঞ্চাশ টাকা এখন পাঁচ সিকেরও অধম।”

“দেখো সাতকড়ি, তোমাকে আমি একজন সোজা সরল লোক বলেই জানতাম। এখন দেখছি, তুমি বেশ ধুরন্ধর লোক।”

“কী যে বলেন শিবুবাবু, ধুরন্ধর হলে কি এমন বেগার খেটে মরতুম! আমি আসলে সরল সোজাই, আর সরল বলেই অন্যেরা কতটা বাঁকা তা বুঝতে পারি, বুঝলেন কিনা?”

“খুব বুঝেছি হে, হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। তা তুমিই বরং একটা দর বলো। কিন্তু আগেই বলে রাখছি, আমার হার্ট কিন্তু ভাল নয়। তেমন দর হাঁকলে হার্ট ফেল হয়ে মারা যেতে পারি। একটু বুঝেশুনে একটা দর বলে ফেলো।”

“তার আগে একটা কথা বলবেন? আপনার মতো বিষয়ী আর হিসেবি লোক একটা পুতুলের জন্য পঞ্চাশ টাকা কবুল করতে রাজি, এ তো ভারী গোলমেলে ব্যাপার! তা পুতুলটা কী দিয়ে তৈরি বলুন তো! সোনা-রুপো নয়তো! কিংবা হিরে-বসানো চোখ?”

“আরে না-না, পুরনো আমলের গ্যাটাপার্চার পুতুল। আমরা বলতুম, আলুর পুতুল। ফঙ্গবেনে জিনিস রে ভাই। নিতান্তই ছেলেবেলার একটা ভালবাসার বস্তু, তাই ভুলতে পারিনি বলেই টাকাটা কবুল করেছিলাম। বুঝলে তো! বাজারে ও পুতুলের দাম দশ-বিশ টাকার বেশি হবে না।”

“বলেন কী শিবুবাবু, দশ-ি শ-বিশ টাকার পুতুলের জন্য আপনি এত লবেজান হয়ে পড়লেন!”

“ওই যে বললুম, ছেলেবেলা থেকেই পুতুলটার প্রতি আমার ভারী টান৷”

“দেখুন শিবুবাবু, পুতুলের দাম যাই হোক, ওটা চুরি করলে আমার পাপ হবে। পাপের মূল্য ধরে দুশো টাকার নীচে আমার পোষাবে না।”

“ওহে তুমি বরং আমাকে একটু ধরো, আমি বোধ হয় মূর্ছা যাব। মাথাটা কেমন করছে!”

“আজ্ঞে, দুশো টাকাতেই যদি মূর্ছা যান তা হলে পাঁচশো হাঁকলে কী করতেন?”

“তা হলে এতক্ষণে আমার হয়ে যেত।”

“ঠিক আছে মশাই, তা হলে আমার দ্বারা এ কাজ হল না। আমি চললুম। গিয়ে রান্না না-বসালে রাজামশাইয়ের খেতে দেরি হয়ে যাবে।”

বলে দু’পা এগোতেই শিবু গায়েন বলল, “আহা, অত তাড়া কীসের? বলছিলুম কী, একটু দরাদরি করারও তো একটা নিয়ম আছে, নাকি?”

সাতকড়ি মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে, দরাদরি করে লাভ হবে না। পাপটার কথাও ভাবতে হবে তো! আমি জীবনে কখনও না বলিয়া পরদ্রব্য লই নাই। এই প্রথম একটা বড় পাপ করছি তো!প্রায়শ্চিত্তেরও তো খরচা আছে মশাই!”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শিবু গায়েন বলে, “কী আর করি বলো। আজ বড় লোকসানের দিন গেল। ঠিক আছে ওই দুশো টাকাই দেব’খন। কাজটা উতরে দাও ভাই।”

শিবু গায়েন বিদেয় হল।

দুপুরবেলায় বাড়ির সবাই একটু ভাতঘুমে মগ্ন। তা ঘুমেরও দোষ নেই, বহুদিন পরে আজ রাজবাড়িতে একটু ভালমন্দ রান্না হয়েছে। সর্ষের তেল বেশ গরগরে করে চুনো মাছ, দু’-তিন রকম তরকারি, ঘন ডাল। আর চাই কী? সবাই চেটেপুটে খেয়েছে। ফাঁক বুঝে সাতকড়ি গোল ঘরখানায় গিয়ে আলমারিটার সামনে দাঁড়াল। এ বাড়ির আনাচকানাচ, গুপ্ত ঘর, জিনিসপত্তর সব সাতকড়ির নখদর্পণে। তবে

পুতুলের আলমারি নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি, কোনওদিন ঘামাতে হবে বলে ভাবেওনি। তবে শিবু গায়েন আজ তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। শিবুবাবুর মতো অর্থপিচাশ একটা ডলপুতুলের জন্য দুশো টাকা কবুল করছে, এ যেন বানরে সঙ্গীত গায়, শিলা জলে ভাসি যায়!

সবুজ পোশাক-পরা ডলপুতুলটা চিনে নিতে তার লহমাও দেরি হল না। ভারী সুন্দর পুতুল, দেখলেই কোলে নিতে ইচ্ছে যায়। অদ্ভুত হল পুতুলটার জ্বলজ্বলে দুটো চোখ। যেন জ্যান্ত। পুতুলের যে এমন জ্বলজ্বলে চোখ হতে পারে, তা ভাবাই যায় না। আলমারিটায় একটা টিপ-তালা লাগানো আছে বটে, তবে সেটা একেবারেই পলকা জিনিস। রানিমা বলেছিলেন বটে যে, এ-ঘরে সব পুরনো জিনিস রাখা আছে। বেশির ভাগই একশো-দেড়শো বছরের পুরনো। এ পুতুলটাও বোধ হয় তাই।

সাতকড়ি তার ট্যাঁক থেকে একটা সাতফলা ছুরি বের করল। তাতে হরেক যন্ত্রপাতি, স্ক্রু ড্রাইভার থেকে ছোট করাত অবধি। তা থেকে একটা সরু ছুঁচলো ফলা বের করে তালায় ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই তালা খুলে গেল। পুতুলটার দিকে হাত বাড়াতেই কে যেন বলে উঠল, “শিবু গায়েন কিন্তু খুব পাজি লোক।”

সাতকড়ি চমকে উঠে চারদিকে চেয়ে দেখল। কেউ কোথাও নেই। তবে কথাটা কইল কে? স্পষ্ট শুনেছে। ঘরের বাইরে বেরিয়ে চারদিক ঘুরে দেখল। কেউ কোথাও নেই। থাকার কথাও নয়। রাজা প্রতাপ একটু আয়েশি মানুষ, বেশি হাঁটাচলা বা নড়াচড়া পছন্দ করেন না। রানিমা’র হাঁটুতে ব্যথা। হাঁটাচলায় ভারী কষ্ট। বাকি থাকেন বৃন্দাঠাকরুন। তা তিনিও ঘর আগলে বসে থাকতে ভালবাসেন। আর গলাটা পুরুষমানুষের। বাইরের লোকও ঢোকেনি, কারণ সদর দরজা সে নিজের হাতে বন্ধ করেছে। তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে! সাতকড়ি ভেবে কোনও থই পেল না। ফিরে এসে পুতুলটা আলমারি থেকে বের করে দেখল, মোটেই হালকা-পলকা জিনিস নয়। বেশ ওজন। অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পুতুলটা দেখল সে। চোখদুটোয় যেন সম্মোহন আছে। পুতুলটা আবার জায়গামতো রেখে আলমারিতে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে এল।

তারপর নিজের একটেরে ঘরে শুয়ে শুয়ে ঠ্যাং নাচাতে-নাচাতে ভাবতে লাগল। শিবুবাবু পুতুলটার জন্য দুশো টাকা দিতে চায় কেন, আর নির্জন ঘরে কথাটা কইল কে!ভেবে অবশ্য কূলও পেল না।

রাতের বেলা নিজের একটেরে ঘরখানায় ঘুমিয়ে ছিল সাতকড়ি। মাঝরাতে হঠাৎ টের পেল, কে যেন তার পাশে শুয়ে আছে। ছোট্ট একটা মানুষ। ঘুমজড়ানো গলায় সে বলল, “কে রে?”

পাশ থেকে কে যেন ফিসফিস করে বলল, “চুপ!শব্দ কোরো না। বাড়িতে চোর ঢুকেছে।”

ধড়মড় করে উঠে বসল সাতকড়ি। কথা কয় কে? ঘর অন্ধকার, তার টর্চবাতিও নেই।

চোর এসেছে! সাতকড়ি লাফিয়ে উঠে শিয়রের কাছে রাখা লাঠিগাছা নিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়েই হাঁকাড় ছাড়ল, “কে রে? কে ঢুকেছিস বাড়িতে?” তারপর চটপট গোটা বাড়িটায় টহল মেরে দেখল কোথাও চোরের নামগন্ধ নেই। শেষে গোলঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল, পুবদিকের জানালাটা খোলা আর দুটো শিক হাওয়া। তা হলে চোর তো সত্যিই এসেছিল! জানালাটা দিয়ে বাইরের জ্যোৎস্নার আলো আসছিল। দেখতে পেল, সেই পুতুলের আলমারির তালাটা ভাঙা, আর পুতুলটাও নেই। সাতকড়ি ভারী চিন্তায় পড়ে গেল। একটা পুতুলের জন্য চোর আসছে, কিপটে শিবু গায়েন দুশো টাকা দিতে রাজি। ব্যাপারটা কী? জানালাটা বন্ধ করে সে আবার নিজের ঘরে শুতে গিয়েই চমকে উঠল। চোখসওয়া অন্ধকারে স্পষ্ট দেখল, তার বালিশে মাথা রেখে পুতুলটা দিব্যি শুয়ে আছে। এবং চোখও বোজা। সেটা অবশ্য আশ্চয্যি নয়, অনেক পুতুল শোয়ালে চোখ বুজে যায়। কিন্তু তাকে ফিসফিস করে চোরের কথাটা কে বলল? তার কেমন সন্দেহ হচ্ছে, ব্যাপারটা ভূতুড়ে। তা রাজবাড়িতে যে ভূত আছে, তা সে জানে। রাজামশাই তো প্রায়ই ভূত দেখে চেঁচামেচি করেন।

হঠাৎ সাতকড়ি শুনতে পেল কে যেন বলে উঠল, “আমি ভূত নই।”

সাতকড়ি হাঁ। তবে কি পুতুলটাই কথা কইছে? অ্যাঁ! ভয়ে আর বিস্ময়ে তার গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। পুতুলটার দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সে। তারপর এক ঝটকায় পুতুলটা তুলে দাঁড় করাল। পুতুলটা চোখ চেয়েছে। ঘরটা একটা নরম আলোয় ভরে গেল।

সাতকড়ি পুতুলটার দিকে চেয়ে বলল, “তুমি কথা কইতে পার?” পুতুল চুপ।

আরও বারকয়েক একই প্রশ্ন করে সাতকড়ি। পুতুল চুপ।

সাতকড়ি পুতুলকে যত্ন করে নিজের বালিশে শুইয়ে দিয়ে নিজে হাতের উপর মাথা রেখে চোখ বুজে একটু ভাবল। পুতুল নিজেই বলেছে, সে ভূত নয়। তবে এ কে? সাতকড়ি কিছুই ভেবে পেল না। তবে চোরের ভয়ে যে পুতুলটা তার কাছে এসে লুকিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। হঠাৎ পুতুলটার জন্য মায়ায় তার বুক ভরে গেল। পুতুলের গায়ে একটু আদরের হাত বুলিয়ে সে বলল, “ঘুমোও।”