গড় হেকিমপুরের রাজবাড়ি – ১

যদু ঘোষ যে গজপতি রায়ের কাছ থেকে পঁচাত্তর টাকা পায়, এটা গড় হেকিমপুর গাঁয়ের সবাই জানে। শুধু জানে বললে কম বলা হয়, এই নিয়ে হাটেবাজারে নানা রকম আলোচনাও হয়ে থাকে। হওয়ারই কথা কিনা! কারণ, তল্লাটের সবাই জানে গজপতির টাকার লেখাজোখা নেই। কিন্তু বাইরে থেকে বোঝে কার সাধ্যি! বাবাকেলে একখানা সাদামাটা বাড়িতে থাকে, নিতান্তই সাদামাটা জীবন।

বাজারে তার একটা ছোটমতো মুদির দোকান আছে বটে, কিন্তু তা থেকে তেমন কিছু রোজগার হওয়ার কথাও নয়। তবু গড় হেকিমপুরসহ আরও পাঁচটা গাঁয়ের লোক জেনে গিয়েছে গজপতি রায়ের অনেক টাকা।

যদু ঘোষ অতি ধৈর্যশীল লোক, অন্য কেউ হলে এতদিনে ওই পঁচাত্তর টাকার আশা ছেড়েই দিত। কিন্তু যদু ঘোষ ছাড়েনি। প্রায় রোজই সকালবেলায় নিয়মিত, অর্থাৎ ঝড়বাদলা না হলে, বা বাঘা শীত না পড়লে, বা আমাশায় কাবু হয়ে না পড়লে, অথবা পুরনো অর্শের ব্যথাটা চাগাড় না দিলে যদু ঘোষ গজপতির বাড়িতে হানা দেবেই কী দেবে। না, প্রথমেই তাগাদা দেওয়াটা ভাল দেখায় না, তাই যদু ঘোষ প্রথমে কুশলপ্রশ্নাদি করে, তারপর গাঁয়ের নানা ঘটনার কথা উঠে পড়ে, কিপটে শিবু গায়েন যে নাতির অন্নপ্রাশনে ঘিয়ের বদলে নারকোল তেল দিয়ে পোলাও রান্না করিয়ে সবাইকে খাইয়েছিল, কিংবা পটল গুণ যে গোরুর দুধের চেয়ে মোষের দুধ অধিক পুষ্টিকর বলায় নিতাই মণ্ডলের সঙ্গে তুমুল কাজিয়া লেগে গিয়েছিল এবং তার ফলে নিতাই যে পটলের কান কামড়ে দিয়েছিল এবং তার ফলে পটল যে একটা কুণ্ডুল হাতে নিয়ে নিতাইকে খুঁজছে আর নিতাই যে হায়দরগঞ্জে তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে, কিংবা মদন মালাকার যে বেজায় হিসেবি লোক বলে জুতো কিনতে গিয়ে সব মাপের জুতোর এক দাম দেখে লোভে পড়ে নিজের সাত নম্বর মাপের পা হওয়া সত্ত্বেও দশ নম্বর মাপের জুতো কিনে এনে জুতোয় পুরনো ন্যাকড়া ভরে গবাসগবাস করে নেংচে হাঁটছে আর নাকাল হচ্ছে, অথবা গড়বাড়ির ভূতের সংখ্যা ইদানীং বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে যাওয়ায় বুড়ো রাজা প্রতাপনারায়ণ আজকাল দুধ বা জল খেতে গেলেও দু’চারটে ভূত দুধ আর জলের সঙ্গে মিলেমিশে তাঁর পেটে গিয়ে সেঁধোচ্ছে আর তাতে প্রতাপবাবুর পেটে বায়ু হয়ে বিশাল-বিশাল উদ্‌গার উঠছে, সে বিষয়ে বুড়ো কবরেজ রামপ্রসন্ন রাজগুরুর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই এবং তাঁর সন্দেহ, তাঁর অব্যর্থ ওষুধে রাজা প্রতাপনারায়ণের উপকার না হলেও সেইসব ওষুধ খেয়ে ভূতগুলো দিব্যি চনমনে হয়ে ওঠায় আর রাজাবাবুর পেট থেকে বেরবার নামটিও করছে না আর তাতে যে মহারানির অনিদ্রা এবং ভিরমির রোগ দেখা দিয়েছে এবং সেইসব ব্যাদড়া ভূতকে জব্দ করতে এসে শ্রীদাম ওঝার বিদ্যেও যে ফেল মেরেছে এবং সে যে ভূতেদের কাছে নাকে খত দিয়ে চোখের জল ফেলতে-ফেলতে বিদায় নিয়েছে, সেইসব কথাই দু’জনের মধ্যে সবিস্তারে আলোচনা হয়। আর সেইসব আলোচনা ভারী রসস্থ হয়ে ওঠে যখন প্রতিদিনই গজপতির গিন্নি বীণাপাণি দেবী তাদের কথার মাঝখানেই ভারী যত্ন করে জলখাবার বেড়ে দেন। কখনও ওমলেট আর পরোটা, কোনওদিন লুচি আর পেস্তা বাদাম দেওয়া মোহনভোগ, কোনওদিন কড়াইশুঁটির কচুরি আর ছোলার ডাল, কোনওদিন বা কাজুবাদাম ছোলার চটপটি আর ধনেপাতা দিয়ে তায়েবগঞ্জের বিখ্যাত মুড়ির মাখা, কখনও বা ঢাকাই পরোটার সঙ্গে আলুর দম, আর তার সঙ্গে অতি চমৎকার দার্জিলিংয়ের চা। যদু ঘোষকে রোজই স্বীকার করতেই হয় যে, বীণাপাণিবউঠানের রান্নার হাতটি চমৎকার। মনেমনে এটাও যদু ঘোষকে মানতে হয় যে, গজপতির বাড়িতে এলে তার সকালটা কাটে বড্ড ভাল।

তবে হ্যাঁ, তাগাদার কথাটাও সে ভোলে না। কিন্তু সহবত বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, নাকি? কথাবার্তার মাঝখানে হুট করে অভদ্রের মতো ওসব কথা তো আর তোলা যায় না। তাই গল্পগুজব করে, পরিপাটি জলখাবারটি খেয়ে ঘণ্টাদেড়-দুই পর সে যখন ওঠে, তখন সাড়ে আটটা বা পৌনে ন’টা বেজে যায়। “চলি হে গজু, ” বলতেবলতে সে উঠে পড়ে, কিন্তু তখনও তাগাদা নয়। সে সটান হেঁটে গিয়ে সদর দরজার চৌকাঠের দিকে পা বাড়িয়ে হঠাৎ নাটকীয়ভাবে একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে ভারী বিনয়ের সঙ্গেই বলে, “ভাই গজু, একটা কথা ছিল।”

গজপতি ভারী আহ্লাদের সঙ্গেই বলে, “আহা, কথা তো থাকতেই পারে। অত কিন্তু-কিন্তু করছ কেন, বলে ফেললেই তো হয়।”

যদু যেন মরমে মরে গিয়ে আরও বিনয়ী হয়ে বলে, “না, এই বলছিলাম কী, তোমার কাছে আমার যে সামান্য পঁচাত্তরটা টাকা পাওনা আছে সেটা অনেকদিন হয়ে গেল কিনা। তাই বলছিলুম যদি টাকাটা এবার ঝপ করে ফেলে দাও তা হলে…?

গজপতিও অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে বলে, “আরে তাই তো!টাকাটা তো অনেকদিন হয়ে গেল হে?”

যদু কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “হ্যাঁ ভাই, তা দু’বছর হতে চলল।”

গজপতির বিস্ময় যেন বাগ মানতে চায় না। চোখ কপালে তুলে

সে বলে, “বলো কী? এর মধ্যেই দু’বছর হয়ে গেল? ইস, সময় কত তাড়াতাড়ি চলে যায় বলো তো?”

যদু ম্লান মুখে বলে, “তা সময়ের আর দোষ কী বলো! তার তো আর থেমে থাকলে চলে না! রেলগাড়ি যেমন ইষ্টিশনে-ইষ্টিশনে থামে তেমন জো তো আর সময়ের নেই। কী বলো?”

“তাও তো বটে হে! নাহ, এবার তোমার টাকাটা একটা শুভদিন দেখে দিয়ে ফেলতেই হচ্ছে। এতদিন কারও টাকা আটকে রাখা ভারী অন্যায়! তবে চিন্তার কথা কী জান, এই দু’বছরে তোমার এবং আমার এবং আর সকলেরই দু’বছর করে বয়স বেড়েছে। আমি সাঁইত্রিশ থেকে উনচল্লিশ, তুমি বোধ হয় একচল্লিশ থেকে তেতাল্লিশ, উমাপদবাবু বিরানব্বুই থেকে চুরানব্বুই, দ্বিজপদ সাঁতরা সাতানব্বুই থেকে নিরানব্বুই, আমার ছোট ছেলে ন্যাড়া সাত থেকে নয়… না হে, আমরা তো দু’বছরে অনেকটা বুড়ো হয়ে গেলুম!”

যদু ঘোষ একটু থতমত খেয়ে বলে, “তা অবিশ্যি বটে। তা হলে তুমি বরং পঞ্জিকায় শুভদিনটা দেখে রেখো।”

“হ্যাঁ হে, আজই ঠাকুরমশাই ব্রহ্মপদ ভশ্চাযকে খবর পাঠাচ্ছি। ছিঃ ছিঃ, এতদিন টাকাটা আটকে রাখাটা তো ঠিক হয়নি?”

অবশ্য এসব কথা শুনে-শুনে যদুর কণ্ঠস্থ হয়ে গিয়েছে। গত দু’বছর ধরে রোজই শুভদিন দেখা হচ্ছে। আজও সেই শুভদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।

একদিন যদু ঘোষ একটু চাপ সৃষ্টি করার জন্য বলে ফেলেছিল, “দেখো ভাই গজু, কিছু মনে কোরো না। টাকা ধার নিলে কিন্তু সুদ দেওয়ারও একটা নিয়ম আছে।”

অত্যন্ত আহ্লাদিত হয়ে গজপতি বলল, “বটেই তো! ধার নিলে তো সুদ দেওয়ারই নিয়ম। কাবলিওয়ালারা নিচ্ছে, মহাজনরা নিচ্ছে, ব্যাঙ্ক নিচ্ছে, তোমারও সুদ ন্যায্য পাওনা। তা কত করে সুন্দ চাও বলো তো!”

যদু মরমে মরে গিয়ে বলে, “তুমি বন্ধু মানুষ, তোমার কাছে সুদ চাইতে আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। কিন্তু প্রথাই বা ভাঙি কী করে বলো? তা দিনপ্রতি দু’টাকা করে সুদ ধার্য করলে কি অন্যায় হবে হে গজু?”

গজপতি একগাল হেসে বলে, “অন্যায়! এর মধ্যে তো আমি অন্যায়ের ছায়াও দেখতে পাচ্ছি না। দিনপ্রতি দু’টাকা তো! আমি ভাবছি তোমার লোকসান হয়ে যাবে নাকি! এত কম সুদে কি তোমার পোষাবে?”

যদু লজ্জায় অধোবদন হয়ে বলে, “না-না, এর বেশি সুদ তোমাকে দিতে হবে না। দু’টাকাই যথেষ্ট।”

গজপতি একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ছেড়ে বলে, “যাক, তা হলে ওই দু’টাকাই বহাল রইল কিন্তু।”

“হ্যাঁ, ভাই।”

এবার গজপতি একটু ভাবিত হয়ে বলে, “দেখো যদু, একটা কথা মনে পড়ে গেল, তুমি যদি কিছু মনে না করো তো বলি।”

“আহা, মনে করার কী আছে! তোমাকে সেই ইজেরপরা বয়স থেকে চিনি। তুমি তো আর কম বদমায়েশি করোনি আমার সঙ্গে। আমার কত সাধের লাল বলটায় ব্লেড চালিয়ে বারোটা বাজিয়েছিলে, আমার রংপেনসিল চুরি করে ফটিকের ব্যাগে ঢুকিয়ে দু’জনের ঝগড়া লাগিয়েছিলে, জগুপণ্ডিতের টিকি কেটে আমার ইশকুলের ব্যাগে রেখে দিয়ে আমাকে কী মারটাই খাইয়েছিলে?”

“আহা, ওসব কথা আবার কেন?”

“না, এই বলছিলুম, এত সবের পরেও কি আমি তোমার উপর রাগ করে থেকেছি কখনও?”

“তা বটে। তা হলে বলেই ফেলি। মনে হচ্ছে তুমি মনে কিছু করবে না। তা বলছিলুম কী, এই যে তুমি আমার বাড়িতে প্রায়ই পায়ের ধুলো দাও, এতে আমি কি কখনও অখুশি হয়েছি? বরং তুমি এলে আমাদের আহ্লাদই হয় এবং আমার গিন্নিও তোমাকে সাধ্যমতো আদরযত্ন করে থাকেন, ঠিক কিনা?”

“খুব ঠিক, বরং একটু বেশিই ঠিক। তোমরা দু’জনে আমাকে একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই আদরযত্ন করে থাকো, আর সে-কথা আমি পাঁচজনকে বলিও। তা কথাটা উঠছে কেন বলো তো! আপ্যায়নটাও তো বেশ ভারী রকমেরই হয়।”

“হ্যাঁ, তাই বলছিলাম যে, ওই আপ্যায়নটাপ্যায়নেরও তো একটা দাম হয়, নাকি?”

“তাও তো বটে হে! এদিকটা তো ভেবে দেখা হয়নি।”

“তাই বলছিলাম, ওই দু’টাকা সুদটা আপ্যায়নের সঙ্গে কাটাকুটি করে নিলে হয় না?”

“তাই তো হে, এ-রাস্তায় তো কখনও ভাবা হয়নি! হ্যাঁ, তা তো হতেই পারে, হয়ও, এবং হওয়াই উচিত। সুদটা তো দাঁড়াচ্ছে না মোটেই! দাঁড়ানোর জোরই পাচ্ছে না যে! না হে গজু, সুদটা শুয়েই পড়েছে দেখছি। না ভাই, তোমাকে আর সুদ নিয়ে ভাবতে হবে না। কিন্তু হুট করে আমার মাথায় একটা প্রশ্নও আসছে যে!”

“কী বলো তো?”

“ভাবছিলুম রোজ সকালে তোমার বাড়িতে যে আপ্যায়নটা আমার হয়ে থাকে, তা তো দু’টাকার মাপে অনেক বেশি। তা ধরো ত্রিশ-চল্লিশ টাকাও হতে পারে। তা হলে দিনপ্রতি ত্রিশ-চল্লিশ টাকা ধরলে যে আমার ধারটাও দাঁড়ায় না। সেটা শোধ হয়ে গিয়ে বরং তোমারই অনেক টাকা পাওনা হয় আমার কাছে?”

হঠাৎ গজপতি একটা বাঘা হুংকার ছেড়ে বলে, “কে বলেছে ও কথা? তার জিব টেনে ছিঁড়ে নিয়ে কুকুরকে খাওয়াব না!”

যদু সেই হুংকারের ধাক্কায় আধ হাত পিছিয়ে গিয়ে ভয়ে-ভয়ে বলে, “কিন্তু কথাটা কি তোমার ন্যায্য বলে মনে হচ্ছে না?”

গজপতি এবার আর-একটু নরম হুংকার ছেড়ে বলল, “খবরদার! আর কখনও ওকথা উচ্চারণ কোরো না। ধার শোধ হওয়া কি সোজা? এ কি ছেলের হাতের মোয়া নাকি যে, যখন-তখন হুট বলতেই ধার শোধ হয়ে যাবে! ওই ধার যেমন আছে তেমনই আছে, এক পয়সাও শোধ হয়নি। কথাটা মনে থাকে যেন!”

যদু ঘোষ ঘাবড়ে গিয়ে বলে, “তা মনে থাকবে ভাই, তুমি যখন বলছ, তখন আর কথা কী! তবে কি কাল সকাল থেকে যেমন তাগাদায় আসছিলাম তেমনই আসব? সেটা কি ভাল দেখাবে?”

গজপতি ফের গর্জন করে ওঠে, “আসবে না মানে! তোমার ঘাড়ে ক’টা মাথা? তাগাদা না দিলে কি কখনও আদায়উশুল হয়? গর্দানভাই অটোয়ালকে দেখো, বিলভাই আগরওয়ালাকে দেখো, তায়েবগঞ্জের পশুপতি সাহাদাসকে দেখো, সারাদিন আদায় উশুলের চেষ্টায় এখানে-সেখানে হানা দিয়ে বেড়াচ্ছে। আলিস্যি বলতে শরীরে কিছু নেই। আর তাই ওদের অত পয়সা! ওদের দেখে তোমার শেখা উচিত যদু?”

যদু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “এ জন্মে আর মহাপুরুষ হওয়া হবে না আমার।”

“আহা মহাপুরুষই বা হতে হবে কেন তোমাকে!মহাপুরুষ হওয়ার অনেক হ্যাপা। শুধু বলছি, তাগাদাটা বজায় রেখো। তাতে ধারটা আর ভোঁতা হওয়ার জো পায় না, বেশ ধারালোই থাকে।”

যদু ঘোষ চলে যাওয়ার পর বীণাপাণিদেবী এসে ঝংকার দিয়ে বলেন, “আচ্ছা বাপু, তুমি এত পিচেশ কেন বলো তো! কত টাকা এদিকওদিক হয়ে যাচ্ছে আর ওই যদু ঘোষের টাকা ক’টা ফেলে দিতে পারছ না! যেমন পিচেশ তুমি, তেমনই পিচেশ ওই যদু ঘোষ। পঁচাত্তরটা টাকার জন্য দু’বছর ধরে রোজ টানা মারছে। কাল আসুক, ও টাকা আমিই দিয়ে দেব যদু ঘোষকে।” “

গজপতি আর্তনাদ করে ওঠে, “সর্বনাশ গিন্নি, সর্বনাশ! ও কাজও কোরো না। তা হলে যে সব গন্ডগোল হয়ে যাবে! ও টাকা শোধ হয়ে গেলে যদু কি আর ভুলেও এ বাড়িমুখো হবে বলে ভেবেছ? আমার সব প্ল্যান যে ভেস্তে যাবে?”

“ও কী কথা? কী মতলব এঁটেছ বলো তো! ওই সামান্য ক’টা টাকা কি তোমার গাপ করার মতলব নাকি? এত পাপ কি ভগবান সইবেন? আর লাখও নয়, কোটিও নয়, মাত্র পঁচাত্তরটা টাকা! ও তো তোমার একদিনের বাজারের খরচ! ওই সামান্য ক’টা টাকার জন্য কেউ কাউকে দু’বছর ধরে ঘোরায়?”

“আহা, ও তুমি ঠিক বুঝবে না। আসলে কী জান, যদু আমার অনেকদিনের পুরনো বন্ধু তো, ও এলে গল্পটল্প করে আমার সময়টা ভারী ভাল কাটে। আর তুমি সকালের জলখাবারটাও ভারী ভাল বানাও। নইলে তো সেই শুকনো রুটি আর আলুচচ্চড়ি গিলতে হয়। ধারটা শোধ হয়ে গেলে কি আর যদু আসবে ভেবেছ! সকালটাই আমার আলুনি হয়ে যাবে। আড্ডাও হবে না, আর খ্যাঁটনটাও মারা যাবে।”

“কী নোলা বাপু তোমার!” বলে বীণাপাণিদেবী রাগ করে চলে

তাগাদাও। তা সেদিন যদু রোজকার মতোই রওনা হওয়ার মুখে দরজার কাছ বরাবর গিয়ে সদরের দিক পা বাড়িয়ে আবার নাটকীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে সবে বলেছে, “ভাই গজু, ওই যে সামান্য একটা…”

গজপতি হঠাৎ যেন উথলে উঠে ভারী আহ্লাদের গলায় বলল, “আরে সেই পঁচাত্তর টাকা ধারটা তো!আর চিন্তা নেই হে গজু, দিনক্ষণ সব মিলে গেছে। সামনের অমাবস্যাটা পার হলেই প্রতিপদের দিন ব্রহ্মপদ ভশ্চায একটু যজ্ঞ করে ঋণশোধের বিলম্বজনিত ত্রুটি স্খালন করে দিলেই আমি টাকাটা তোমার হাতে তুলে দেব। সেদিন গাঁয়ের মাতব্বরদেরও একটু মিষ্টিমুখ করাতে ডেকেছি কিনা।”

যদু ভারী আশান্বিত হয়ে বলল, “তাই!যাক, তুমি যে দায়মুক্ত হয়ে যাচ্ছ, এতেই আমি খুশি।”

“হ্যাঁ-হ্যাঁ, সেই আনন্দেই আমি সেদিন বাজনদারদেরও ডেকেছি কিনা, ওই যে মকবুল ব্যান্ডপার্টি হে, আজকাল খুব নামডাক, বুঝেছ?”

যদু চোখ কপালে তুলে বলে, “ভাল কথা। কিন্তু ভাই, এত আড়ম্বর কি ভাল দেখাবে? ধারটা একটু বেশি হলেও না হয় কথা ছিল, ওই সামান্য পঁচাত্তর টাকার জন্য এত আয়োজন! এ যে ঢাকের দায়ে মনসা বিকোনোর অবস্থা?”

গজপতি গর্জন করে বলে উঠল, “কত সামান্য জিনিস থেকে কত বড়-বড় ঘটনা ঘটে যায় তা জান? বট গাছের বীজ কতটুকু বলো তো! এইটুকু একটুখানি বীজ থেকে কত বড় গাছটা বেরয় তা কি খেয়াল করেছ? অ্যাটম বোমার কথাও তো তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে। কানাঘুষো শুনেছি অ্যাটম এতই ছোট যে চোখেই দেখা যায় না। কিন্তু যখন ফাটে তখন কি আর ছোটখাট জিনিস বলে মনে হয় হে! কিংবা বামন অবতারের কথাই ধরো, ছোটখাট বেঁটেবক্কেশ্বর মানুষ, কিন্তু যখন তিন নম্বর পা-টা বাড়ালেন তখন স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জুড়েও সেই পা-খানা রাখার জায়গা জুটল না! ছোটখাট বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাটা বিবেচনার কাজ নয়, বুঝলে?”

যদু কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “ঘাট হয়েছে ভাই, কোন আহাম্মক আর ছোট জিনিসকে ছোট বলে!”

গজপতি ভারী উদার গলায় বলে, “তা হলে ওই কথাই রইল, শুক্লা প্রতিপদে সকাল-সকালই চলে এসো। একজন ঋণখেলাপী ঋণমুক্ত হবে আর তুমি তোমার হক্কের টাকাও পেয়ে যাবে! তোমার তো আনন্দ হওয়া উচিত, মুখখানা অমন আঁশটে করে রেখেছ কেন বলো তো! এতদিনের হারানিধি ফেরত আসছে, এ যেন অনেকদিন বাদে শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে বাপের বাড়িতে ফিরছে, এ যেন কুয়োয় পড়ে যাওয়া পুরনো বালতি উদ্ধার হচ্ছে, এ যেন হঠাৎ খবর এসেছে যে তোমার বেয়াইয়ের পুরনো বাতব্যাধি সেরে গেছে!এ কি আনন্দের খবর নয়?”

“বেয়াইয়ের বাতব্যাধি সেরে গেলে আমার আনন্দ হওয়ার কী বলো তো?”

“ওই তো তোমার দোষ। আনন্দটা আগে তো করে নাও, উপলক্ষটা নিয়ে বরং পরে ভেবো।”

যদু বিষণ্ন বদনে বলে, “আমার যদিও তেমন আনন্দ হচ্ছে না, তবু তুমি যখন বলছ, তখন দেখি একটু আনন্দ করার চেষ্টা করে।” “এই তো বাহাদুরের মতো কথা।”

গেলেন।

যথারীতি যদু ঘোষের আসা-যাওয়া বহাল রইল, সেই সঙ্গে বিনীত

দেখতে-দেখতে শুক্লা প্রতিপদ এসে গেল। সকাল থেকেই গজপতির বাড়িতে সাজো-সাজো রব। তায়েবগঞ্জ থেকে বিখ্যাত কেটারার নন্দ গোঁসাই এসে তার দলবল নিয়ে কাজে নেমে পড়েছে। এলাহি ভোজের ব্যবস্থা হচ্ছে। বাসমতী চালের ভাত, সোনা মুগের ডালে মাছের মুড়ো, পাঁঠার মাংস, রুই মাছের কালিয়া, আলুবখরার চাটনি, পাঁপড়ভাজা, বিষ্টুপুরের বিখ্যাত গামছা বাঁধা দই আর পাঁচ রকমের মিষ্টি। গাঁয়ের মাতব্বররা তো বটেই, সেই সঙ্গে আরও বিস্তর লোকের নেমন্তন্ন হয়েছে। ব্রহ্মপদ ভট্টাচার্য যজ্ঞে বসে গিয়েছেন। বেশ লম্বা যজ্ঞ, দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার কথা। বিরাট প্যান্ডেলে সারি-সারি চেয়ার পাতা, গাঁয়ের লোকেরা বসে গল্পটল্প করছে।

ভুলোমনের মানুষ ভোলাবাবু সামনে একজন অচেনা লোককে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, এ বাড়িতে কি কারও শ্রাদ্ধ হচ্ছে মশাই?”

লোকটা মিচকে হেসে বলে, “ঠিকই ধরেছেন মশাই, এবাড়িতে টাকার শ্রাদ্ধ হচ্ছে।”

ভোলাবাবু দুঃখের একটা চুকচুক শব্দ করে বললেন, “তা তিনিই কি জগবন্ধুর বাবা?”

লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “টাকা কার বাবা নয় বলুন তো, ভোলাবাবু?”

ভোলাবাবু ভারী অবাক হয়ে বলেন, “ভোলাবাবু! আমার নাম কি ভোলা নাকি? কিন্তু তা কী করে হয়? একটু আগে যে একজন আমাকে ‘মহাদেববাবু’ বলে ডাকল!”

“আহা তাতে কী? মহাদেব আর ভোলায় আর কতটুকু তফাত?” ভোলাবাবু ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “কিন্তু আমি আসলে কে, তা না জেনে কি কারও বাড়িতে ঢোকা ভাল দেখাবে? আমি মহাদেব না ভোলা, এখন তার মীমাংসা করে কে?”

“কার বাড়িতে ঢুকতে চাইছেন বলুন তো ভোলাবাবু!” “ওই তো বললুম দীনবন্ধু না কী যেন।”

“তা হলে ঠিক বাড়িতেই এসেছেন। এটাই জগবন্ধু ওরফে দীনবন্ধু ওরফে গজপতির বাড়ি। আর আমি যতদূর জানি, তিনি আপনার ভায়রাভাই। আর উলটো দিক থেকে গজপতিও আপনার ভায়রাভাই। এ পর্যন্ত যদি ভুল না বলে থাকি তা হলে আপনার নামটা দাঁড়াচ্ছে ভোলানাথ মুস্তফি। তায়েবগঞ্জের জগন্নাথ কলেজের দর্শনের অধ্যাপক।”

ভারী আশ্চর্য এবং খুশি হয়ে ভোলাবাবু বললেন, “তাই তো, আমি তো ভোলানাথ মুস্তফিই বটে! আর আজ তো গজপতির বাড়িতেই আমার নেমন্তন্ন! আপনি বাঁচালেন মশাই! আপনি তো বেশ জানেন-শোনেন দেখছি। আজ যে গজপতির মেয়ের বিয়ে তা একদম খেয়াল ছিল না।”

“আচ্ছা ভোলাবাবু, আপনি কি কখনও শুনেছেন কারও মেয়ের বিয়ে আর বাবার শ্রাদ্ধ একই দিনে হচ্ছে?”

“না-না, তা কী করে হয়! সেরকম তো শুনিনি কখনও?”

“তা হলে নেমন্তন্ন বাড়িতে ঢোকার আগেই ফয়সালা করে নিন, আজ গজপতির বাবার শ্রাদ্ধ না মেয়ের বিয়ে! না হলে ভিতরে গিয়ে যে বিপদে পড়বেন?”

ভোলাবাবু ভারী আতান্তরে পড়ে বিপন্ন মুখে বললেন, আপনি তো বেশ জানেন-শোনেন দেখছি, আপনিই যদি একটা মীমাংসা করে দেন?”

“তা হলে শুনে রাখুন, আপনি দু’বছর আগেই গজপতির বাবার শ্রাদ্ধে নেমন্তন্ন খেয়ে গেছেন, আর গজপতির ভায়রাভাই হিসেবে আপনার এও জানা উচিত যে, গজপতির মোটে মেয়েই নেই। তার পাঁচ-পাঁচটা ছেলে। একটাও কন্যাসন্তান হয়নি বলে গজপতির ভারী দুঃখ।”

“না-না, আপনার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে মশাই, অনেক কিছু শেখার আছে। তা হলে আজকের নেমন্তন্নটা কী বাবদে বলুন তো! আজ গজপতির বিবাহবার্ষিকী বা জন্মদিন নয় তো?”

“আজ হল গে ভাদ্র মাসের ঊনত্রিশ তারিখ। আমি যতদূর জানি গজপতি জন্মেছিল মাঘ মাসের বারো তারিখে, আর বিয়ে একুশে আষাঢ়, আর প্রতি বছরই ওই দুটো দিনে আপনি এ বাড়িতে পাত পেড়ে বসে ভোজ খেয়ে যান।”

“আপনি তো মশাই খবরের জাহাজ! যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি। নাহ, দুনিয়ায় কত কিছু জানার আছে মশাই, কিন্তু আমি তো দেখছি কিছুই জানি না!”

“যে আজ্ঞে, বিদ্বানরাও বলেন, জানার নাকি শেষ নেই। তবে সেসব হল উঁচুস্তরের জানা। এই ধরুন ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস বা স্পিনোজার দর্শন কিংবা কোয়ান্টাম থিয়োরি। আমাদের জানা হল গিয়ে এলেবেলে জানা, কে কার ভায়রাভাই, কার কবে শ্রাদ্ধ, কার ক’টা ছেলেপুলে এইসব আর কী! ওসব না জেনেও তো আপনার দিব্যি চলে যাচ্ছে ভোলাবাবু!ঠিক কিনা বলুন?”

“আপনি কখনও বেঠিক কিছু বলেন বলে তো মনেই হচ্ছে না!” “আজ্ঞে আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে এই হারাধন

খাসনবিশের ওই গুণটা আছে, না জেনে কোনও কথা কয় না।”

“হারাধন খাসনবিশ! নামটা একটু চেনা-চেনা ঠেকছে কেন বলুন তো?”

“আহা চেনা-চেনা তো ঠেকবেই। হাটে-বাজারে যেখানে যাবেন, সেখানেই আমার বদনাম শুনতে পাবেন। এমনকী যখন সন্ধেবেলার দিকে ফুরফুরে বাতাস ছাড়ে তখন যদি বাতাসে কান পেতে একটু ঠাহর করেন তা হলেই শুনতে পাবেন, বাতাসে ফিসফাস হচ্ছে, হারু খাসনবিশ হল এই, হারু খাসনবিশ হল সেই। তা বলে ওসব আবার ফস করে বিশ্বাস করে বসবেন না যেন। লোকের স্বভাবই হল অন্যের খুঁত বের করা। আমি মশাই, কারও সাতে-পাঁচে থাকি না, কারও বাড়া ভাতে ছাই দিই না, বছর-বছর গয়া, কাশী, বৃন্দাবন ঘুরে পাপতাপ ধুয়ে আসি, দানধ্যান করি, তবু মশাই লোকে এমন নিমকহারাম যে, বদনাম করতে ছাড়ে না। আচ্ছা আপনিই বলুন তো ভোলাবাবু, আমাকে দেখে কি আপনার খারাপ লোক মনে হচ্ছে?”

“হারু ভোলাবাবু আঁক করে একটা বাতাসের গোল্লা গিলে ফেললেন। তারপর হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, বিশ! অ্যাঁ! হারু খাসনবিশ নাকি আপনি! ওরে বাবা! আমার বুকটার মধ্যে যে বড্ড ধুকপুক হচ্ছে! হার্ট না ফেল হয়ে যায়! আচ্ছা আমার পা দুটো অমন ঠান্ডা হয়ে আসছে কেন? মাথাটাও ভোঁ-ভোঁ করতে লেগেছে যে! আমি বোধ হয় মূর্ছা যাব?”

“আরে মশাই, ঘাবড়াচ্ছেন কেন? আমি কি আর আগের হারু আছি! আমারও তো বয়স হচ্ছে, না কি! গত বোশেখে বিয়াল্লিশে পা দিলুম যে!বিয়াল্লিশ কি সোজা কথা? বিয়াল্লিশে একটা লোকের আর কী অবশিষ্ট থাকে বলুন তো। আগে তিন মণ লোহা এক ঝাঁকিতে মাথার উপর তুলে ফেলতুম, আজকাল একঘটি জল তুলতেই হাঁসফাঁস লাগে। এক চোপাটে দু’-আড়াই কিলো মাংস উড়িয়ে দিয়েও মনে হত পেটটা যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে, আর আজকাল শুক্তো দিয়ে এইটুকু ভাতও যেন তল হতে চায় না। যে দু’খানা মুগুর ঘুরিয়ে আমি এক সময়ে কসরত করতাম, তার এক-একটারই ওজন ছিল এক মণ করে, আর এই তো সেদিন বাজার থেকে দুটো নারকোল আনতেই যেন দম বেরিয়ে গেল। আরও শুনবেন? বয়সকালে দু’প্যাকেট তাস একসঙ্গে ধরে দু’হাতে ফস করে ছিঁড়ে ফেলতাম। আর এখন ডিমসুতো ছিঁড়তেও আগুপিছু করতে হয়। আর বয়স হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে দাপটটাও কি আর আছে? এখন কি আর সেই আগের মতো কেউ মান্যিগন্যি করে বলে ভেবেছেন? কী, আমার কথাগুলো কি বিশ্বাস হচ্ছে না নাকি?”

এ নিয়ে মোট চারটে বড়-বড় বাতাসের গোল্লা গিলে ফেলেছেন ভোলাবাবু, তাঁর পেট এখন ঠাসেঠাস হয়ে আছে বায়ুতে। নেমন্তন্নের মাছ-মাংস কোথায় সেঁধোবে কে জানে! তিনি কাঁপা গলায় বললেন, “আজ্ঞে বিশ্বাস করার খুব চেষ্টা করছি কিন্তু। আসলে হাত-পায়ের কাঁপুনিটা না থামলে মাথাটা কাজ করতে চাইছে না কিনা!তবে আপনি দেখবেন বিশ্বাসটা কিন্তু হয়ে পড়বে।”

“না মশাই, বুঝতে পারছি, আপনার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, আর তাই অত ঘাবড়ে যাচ্ছেন। ঠিক আছে, আপনি না হয় আমার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে দেখুন আমি হেরে যাই কি না! তা হলে তো বিশ্বাস হবে? কী বলেন! অবিশ্যি আমি জানি একজন বুড়োমানুষের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে আপনি মোটেই রাজি হবেন না, তবে লড়লে দেখতে পেতেন, গড়হেকিমপুর এক সময়ে যার নামে কেঁপে উঠত সেই হারু খাসনবিশ আর বেঁচে নেই, কিংবা বেঁচেও জীবস্মৃত হয়ে আছে। নইলে কি চোখের সামনে এত বড় অরাজকতাটা হতে পারত? গত বিশ বছর ধরে গোটা পরগনায় এমন কোনও ভোজবাড়ি নেই যেখানে হারু খাসনবিশের নেমন্তন্ন হয়নি! বুঝতেই তো পারছেন, হারু খাসনবিশের সেই দিন আর নেই। নইলে গজপতির মতো বিচক্ষণ মানুষ এত বড় ভোজে আমাকে ডাকল না মশাই!”

ভোলাবাবুর দু’খানা চোখ অবিশ্বাসে গোল হয়ে ঠেলে কোটর থেকে বেরিয়ে আসে আর কী, হাঁ করে চেয়ে থেকে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলেন, “ডাকেনি? কী সর্বনাশ! কী সর্বনাশ! বাপের শ্রাদ্ধ হতে না-হতেই যে এবার তার নিজের শ্রাদ্ধও ঘনিয়ে এল! হায়-হায়, তার বয়স তো এখনও চল্লিশও পোরেনি!”

“আহা, আপনি ভুল করছেন ভোলাবাবু, আজ মোটেই গজপতির বাপের শ্রাদ্ধ নয়!”

ভারী অবাক হয়ে ভোলাবাবু বলেন, “নয়? তা হলে মেয়ের বিয়ে তো নিশ্চয়!”

“আজ্ঞে না, তা-ও নয়!”

ভারী হতাশ হয়ে ভোলাবাবু বলেন, “তা হলে তো ব্যাপারটা বাপের বিয়েই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে হারুবাবু! কিন্তু তা-ই বা কী করে হয়! নাহ, এ তো বড় বিপদেই পড়া গেল দেখছি?”

“আপনি ঘাবড়াবেন না, আমি তো বলেইছি আপনাকে যে, আমি আর সেই আগের হারু নেই। আমি শুধু পুরনো বন্ধুর মতোই গজপতির কাছে জানতে চাই, কাজটা কি ঠিক হল হে গজপতি? না হয় আমি বুড়োই হয়েছি, না হয় আমার আর আগের দাপট নেই, তা বলে কি পুরনো সম্পর্ক, সামাজিকতা, সৌজন্য, অদ্রতাভদ্রতা সব তুলে দিতে হয়? এত বড় দুঃখটা সে আমাকে দিতে পারল? এত অপমান কি ভগবান সইবেন? আপনিই বলুন দিকি ভোলাবাবু!”

ভোলাবাবু হঠাৎ গর্জন করে বলে উঠলেন, “না-না, কখনওই নয়! এত বড় অবিচার চলতেই পারে না। চলুন হারুবাবু, আজই এর একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলা যাক। এক্ষুনি ফয়সালা হওয়া দরকার! দু’জনে মুখোমুখি হয়ে এর একটা মীমাংসার প্রয়োজন। শুধু একটু খেয়াল রাখবেন, রক্তপাতটাত যেন না হয়। আর নিতান্তই যদি হয় তা হলে আমাকে একটু ইশারা করবেন, আমি বরং একটু ফাঁকে গিয়ে দাঁড়াব। রক্তটা আমার ঠিক সয় না কিনা, দাঁতকপাটি লেগে যায়।”

হারু খাসনবিশ জিব কেটে বলে, “ছিঃ ছিঃ ভোলাবাবু, কী যে বলেন! রক্ত দেখলে আমারও যে মাথায় চক্কর দেয়! আমারও যে রক্তে ভারী অরুচি! সেদিন আমার ছোট ছেলে গোবিন্দ পেনসিল কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলে রক্ত পড়ায় আমি তো প্রায় শয্যা নিয়েছিলাম আর কী?”

পট্টবস্ত্র পরে হাসি-হাসি মুখে গজপতি যখন যজ্ঞে বসতে যাচ্ছে তখনই ঝড়ের মতো হাজির হয়ে ভোলাবাবু উত্তেজিত গলায় বলে উঠলেন, “এখন যজ্ঞটজ্ঞ রাখো, দক্ষযজ্ঞ লাগতে যে আর দেরি নেই! সব যে তছনছ হয়ে যাবে হে!”

গজপতি ভোলাবাবুকে ভালই চেনে, কাজেই সে উত্তেজিত না হয়ে শান্তভাবেই সব শুনল। তারপর চোখ কপালে তুলে বলল, “বলেন কী হারুদাদা! আপনাকে নেমন্তন্ন করা হয়নি! আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা? এই তো সেদিন প্রাতঃকালেই আপনার বাড়িতে গিয়ে হানা দিয়েছিলুম নেমন্তন্ন করতে। তা আপনার ছোটখুকি বলল, আপনি নাকি সকালেই সমাজসেবা করতে বেরিয়ে গেছেন। তাই হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখি, আপনি কালাচাঁদ সাউকারের বাড়িতে সমাজসেবায় ভারী ব্যস্ত রয়েছেন। কালাচাঁদকে তারই উঠোনের আম গাছটার সঙ্গে বেঁধে একটা খেঁটে লাঠি দিয়ে শিক্ষে দিচ্ছেন, আর কালাচাঁদ চিলচেঁচানি চেঁচাচ্ছে, আর আপনার দলবল কালাচাঁদের ঘর থেকে তৈজসপত্র আর বাক্সপ্যাঁটরা টেনে-টেনে ছুড়ে উঠোনে ফেলছে।”

ভারী লাজুক মুখ করে হারু খাসনবিশ বলে, “আহা, ওসব কথা আবার কেন হে! থাক -থাক, আর বলতে হবে না।”

“না-না, সে কী হয়! তা আপনাকে ভারী ব্যস্ত দেখে আমি ওই অবস্থাতেই হাতজোড় করে বললাম, ‘হারুদাদা, সামনের ঊনত্রিশে ভাদ্র দুপুরবেলা যে আমার বাড়িতে একবার পায়ের ধুলো না দিলেই নয়! একটু ডালভাতের ব্যবস্থা করেছি যে, ’ তা আপনি আমার দিকে রক্তচক্ষুতে চেয়ে বললেন, ‘দেখছিস না ব্যস্ত আছি, এসময়ে কেউ নেমন্তন্ন করে?’ তা আমি বললুম, ‘হারুদাদা, আপনি তো সকাল থেকে রাত অবধি নানা রকম সমাজের কাজে দম ফেলার ফুরসতই পান না, আপনাকে ফাঁকমতো পাওয়া কি সোজা কথা! তখন আপনি গমগমে গলায় বললেন, ‘আচ্ছা-আচ্ছা, ঠিক আছে।””

হারু খাসনবিশ যেন আরও একটু লজ্জা পেয়ে বলে, “আসলে কী জানিস তো গজু, আমার বোধ হয় বয়স হচ্ছে রে, তাই কত কী যে ভুলে যাই। এখন একটু-একটু মনে পড়ছে বটে, তুই নেমন্তন্নের কথা কী যেন বলছিলি সেদিন?”

হঠাৎ ভিড়ের ভিতরে পিছন থেকে একজন গোলগাল চেহারার লোক হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে অভিমানের গলায় বলে, “আহা, হারুর ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু আমার নেমন্তন্নটা কেন ফাঁক গেল সেটা জানতে পারি কি? আমি হলুম গে কাদাপাড়ার নটবর মুন্সী, কাশীরাম চক্রবর্তীর শ্রাদ্ধে একশো সাতাশিটা রসগোল্লা খেয়ে বিশ্বরেকর্ড করেছিলাম। এখনও গাঁ-গঞ্জ থেকে লোকে ভিড় করে আমার খাওয়া দেখতে আসে। সেই আমা হেন লোককে একবারটি ভদ্রতার খাতিরেও কি বলা যেত না!’

গজপতি শশব্যস্তে বলল, “বলেন কী নটবরখুড়ো, আপনাকে নেমন্তন্ন না করে নরকের রাস্তা পরিষ্কার করব নাকি? গেল হপ্তায় বুধবার আপনার বাড়িতে গলবস্ত্র হয়ে নেমন্তন্ন করতে গেছিলুম। তা খুড়িমা দরজা খুললেন না, জানালা দিয়েই বলে দিলেন, ‘নেমন্তন্ন করতে এসেছ বুঝি! কিন্তু উনি তো ঘোর আন্ত্রিকে পড়ে আছেন।’ শুনেই তো আমার আক্কেল গুড়ুম। আন্ত্রিক কীরকম খারাপ অসুখ কে না জানে!তাই আর চাপাচাপি করিনি। আন্ত্রিকের রোগীকে ভোজ খাওয়ানো যে মহাপাতক!”

“আন্ত্রিক হোক আমার শত্তুরের। আমার কেন আন্ত্রিক হতে যাবে, হ্যাঁ? তবে হ্যাঁ, গত হপ্তায় বুধবার আমি অঘোর তান্ত্রিকের আখড়ায় ছিলুম বটে। বিলদাসজী বেশ জম্পেশ ভাণ্ডারা দিয়েছিলেন কিনা। তুমি দেখছি আজকাল কান শুনতে ধান শুনছ হে! তা হলে কি নেমন্তন্নটা বহাল আছে বলেই ধরে নেব?”

“বিলক্ষণ! নেমন্তন্ন বহাল নেই মানে? আলবত বহাল আছে। অঘোর তান্ত্রিকের সঙ্গে ঘোর আন্ত্রিকের একটু গন্ডগোলে কি আর ভোজ আটকায়?”

কুমোরপাড়ার কাঁদুনে কানাইমাস্টার উঠে দাঁড়িয়ে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধরা গলায় বললেন, “বাপু গজপতি, তোমাকে তো আজ থেকে চিনি না, প্রায় জন্ম থেকেই চিনি। আমার বাড়ির সামনে দিয়েই তোমার প্রায় নিত্য যাতায়াত। তবু তোমার এ কীরকম ব্যবহার বলো তো! না হয় তোমাকে ছেলেবেলায় ইংরিজি আর অঙ্ক পড়াতে গিয়ে দু’-চার ঘা বেত মেরেছি কিংবা কান মলে দিয়েছি, হয়তো কান ধরে নিলডাউনও করিয়ে রেখেছি, তা বলে এভাবে প্রতিশোধ নিতে হয়? শত হলেও তো আমি তোমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক! আমাকে নেমন্তন্ন না করে তুমি কি গোটা শিক্ষকসমাজকেই অপমান করলে না? বাড়িতে ভোজ দিচ্ছ আর কানাই মাস্টারমশাইয়ের কথা একবারও মনে পড়ল না তোমার?”

গজপতির চোখেও জল আসার উপক্রম। সে গদগদ হয়ে বলল, “স্যার, আর ক’বেন না, আমি কিন্তু কান্না সামলাতে পারব না। আপনি কী করে ভাবলেন যে, আপনাকে নেমন্তন্ন না করে আমি ভোজ দিতে পারি? আপনার কানমলা, গাঁট্টা, চড়চাপড়, বেত তো আমার

অলঙ্কার। আমি প্রথমেই আপনাকেই নেমন্তন্ন করতে গেছিলাম একেবারে ভোর-ভোর সময়ে। আপনার মেজো ছেলে হাজু বলল, ‘বাবাকে খুঁজছ? তা বাবাকে পাবে কোথায়? বাবা তো সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে গেছে।”

কানাইমাস্টার অবাক হয়ে বলেন, “হাজু বলেছে ও কথা! দেখো দিকি কাণ্ড! কোন দুঃখে হিমালয়ের ওই বাঘা ঠান্ডায় মরতে যাব বলো তো! তবে গত সপ্তাহে আমি আমার মেজো মেয়ে পুঁচকির বাড়ি সেই সিমলায় গেছিলুম বটে। ফুটফুটে একটা নাতি হয়েছে তো, তাই।”

আমতা-আমতা করে গজপতি বলে, “তা হলে আমারই বোধ হয় শোনার ভুল। সাধু নয় বোধ হয়, দাদু হয়ে সিমলায় গেছেন, এমনটাই কী বলেছিল হাজু?”

“আহা, মানুষমাত্রেরই ভুল হয়। তাতে কী! আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ভোজ না খেয়ে নড়ছি না হে!”

হাত কচলাতে-কচলাতে গজপতি বলে, “আজ্ঞে, আমার সৌভাগ্য।”

গজপতি ঝামেলা সামলে ফের যজ্ঞে বসতে যাচ্ছিল, কিন্তু ফের একট বাধা পড়ে গেল। হঠাৎ লম্বা সুডুঙ্গে চেহারার বৃন্দাবন কীর্তনিয়া একটা বেতের লাঠি আপসাতে-আপসাতে প্যান্ডেলে ঢুকেই খ্যানখ্যানে গলায় চেঁচাতে লাগল, “কোথায় গজপতি! উঠে আয় বেয়াদব! আমি হলুম গে গাঁয়ের মাথা, বলতে গেলে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, সেই আমাকে বাদ দিয়ে মোচ্ছব করার সাহস তোর হয় কী করে? গ্রামপ্রধানের কি কোনও সম্মান নেই নাকি?”

গজপতি থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে একেবারে সাষ্টাঙ্গে পেন্নাম ঠুকে অবাক হয়ে বলল, “বৃন্দাবনজ্যাঠা, সশরীরে আপনাকেই কি দেখছি? ভুল দেখছি না তো! ওহ, যা চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন! বুধবার দুপুরের দিকে নেমন্তন্ন করতে গেছি, আপনার জামাই রসময় বলল, ‘কাকে নেমন্তন্ন করবে হে! তিনি তো গতকালই মারা গেছেন! শুনে তো আমার সেখানেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার অবস্থা! গাঁয়ের বটবৃক্ষ বলতে তো আপনিই আছেন জ্যাঠা, আমাদের এত বড় আশ্রয় আর কে! আপনি মারা গেলে আমাদের বেঁচে থাকাটাও যে আলুনি হয়ে যায়।”

বৃন্দাবনের খ্যানখেনে গলায় হুঙ্কারটা ঠিক আসে না, তবে সে চিলের মতো চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে বলল, “কেন রে হতচ্ছাড়া, পঁচাশিটা কি মরার বয়স বলে তোর মনে হয়? এখনও উমাপদবাবু, দ্বিজপদ সাঁতরা রয়েছে, আমাকেই মারার মতলব কেন তোর? গাঁয়ের পাকা মাথাগুলোকে মেরে তারপর বেলেল্লাপানা আর ম্লেচ্ছাচারের খুব সুবিধে হয় বুঝি?”

এক বিঘত জিব কেটে গজপতি বলে, “কী যে বলেন জ্যাঠা, আপনারা তো আমাদের মাথায় ছাতার মতোই বিরাজ করছেন, সব ঝড়ঝাপটা তো আপনাদেরই সামলাতে হচ্ছে। গাঁয়ের মাথায় আছেন বলেই আমরা রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোই। রসময় যে কেন কথাটা বলেছিল তা বুঝতে পারছি না।”

“আহা! বিনয়বচনে একেবার গলে পড়ছিস যে! আসলে তোর পেটে জিলিপির প্যাঁচ। রসময় মোটেই মরার কথা বলেনি। সে তোকে বলেছিল, আমি আমার নিরানব্বই বছরের পিসিকে দেখতে আড়া গ্রামে গেছিলাম।”

“ইস! ছিঃ ছিঃ! বড্ড ভুল হয়ে গেছে তো বৃন্দাবনজ্যাঠা। তবে শুনেছি মৃত্যুসংবাদ রটলে নাকি আয়ু বাড়ে।”

যাই হোক, এসব গন্ডগোল সামলে গজপতি যখন যজ্ঞে বসতে গিয়েছে, তখন ঠাকুরমশাই ব্রহ্মপদ ভশ্চায একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, “দিলে তো যজ্ঞটাকে পণ্ড করে! মোক্ষম লগ্নটা ছিল হে, দেরি করায় ফস করে মঘাটা ঢুকে পড়ল?”

“সর্বনাশ! তা হলে কী হবে?”

ব্রহ্মপদ বিরস মুখে বলেন, “দেখি, কবে আবার এমন লগ্ন পাওয়া যায়!”