খুদে যাযাবর ইসতাসি – ৩

একটা ভাল্লুক!

আমি স্থির! না-পারি বসতে, না-পারি চলতে! পা দুটো অসাড় হয়ে কাঁপতে লাগল। বুকে সাহস এনে কাঁপুনিটাকে যতই ঠেকাবার চেষ্টা করছি, কিছুতেই পারছি না। আমি স্পষ্ট দেখছি ভাল্লুকটাকে। দেখছি, জন্তুটার গায়ের রং বাদামি। নাকের সামনে সাদা ছোপ। গা-ভরতি লম্বা লোম। চোখ দুটো কুতকুত করছে। সে-চোখ দেখে বলা মুশকিল, এই মুহূর্তে সে পেটে-পেটে কী মতলব আঁটছে। কিন্তু তার পায়ের নোখগুলো দেখলে তোমার মনে হবেই, বাছাধন একবার যদি ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তবে আমাকে শেষ করে ফেলতে তার বেশি সময় লাগবে না।

এখন আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে ভাল্লুকটার দূরত্ব খুব বেশি হলে চার-পাঁচ হাত! সুতরাং তোমরা ধরে নিতে পারো, আমার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। আহা রে! আমাকে মেরে ফেলার আগে এই গভীর জঙ্গলের জন্তুটা যদি আমার দু-চারটে কথাও বুঝতে পারে। তবে তাকে বলি, ‘হে বন্ধু, এই দ্যাখো আমার গলায় ঝোলানো বাজনা। আমি তোমাকে মারতে আসিনি। আমার বন্ধু ওতিয়ার সঙ্গে আমরা আনন্দ করতে এসেছিলুম। কিন্তু আমাদের আনন্দে বাধা দিয়েছিল একদল বুনো শুয়োর। তারা আমাদের মারতে চেয়েছিল। আমার বন্ধু ওতিয়া ভয় করেনি তাদের। ওতিয়াও আক্রমণ করেছিল তির-ধনুক নিয়ে। তারপর ওতিয়া জঙ্গলের কোথায় যে হারিয়ে গেল, আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তাকে খুঁজতে-খুঁজতে আমিও হারিয়ে গেছি। আমায় যদি মারতে চাও তুমি, মারো! কিন্তু একটিবার যদি বলে দাও, কোথায় গেলে শেষবারের মতো আমি ওতিয়াকে দেখতে পাব, তবে তাকে শেষবারের মতো দেখে আমি নিজেই তোমার হাতে মরবার জন্যে এগিয়ে যাব।’

আমার চোখ ছলছলিয়ে উঠেছিল বোধহয়। খুবই স্বাভাবিক। এইরকম অবস্থায় আমার মতো তুমিও যদি পড়তে, তোমার চোখে জল আসত না?

হঠাৎ আমি হকচকিয়ে গেছি! আমার চোখ দুটো ছটফটিয়ে উঠেছে! দেখি কী, আচমকা ভাল্লুকটা সামনের পা-দুটো তুলে খাড়া দু-পায়ে দাঁড়িয়ে উঠল। দাঁড়াতেই, তার মুখের ঠোঁট দুটো দু-ফাঁক হয়ে দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল। তারপর অমনি দু-পায়ে হাঁটতে-হাঁটতে সে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি তো জানি, এবার আমার সময় হয়ে এসেছে। আমি জানি, এবার ভাল্লুকটা তার সামনের দু-পা দিয়ে আমায় জাপটে ধরবে। জাপটে ধরে আমার হাড়গোড়গুলো সব গুঁড়িয়ে ফেলবে। আমি শেষ-নিশ্বাস ফেলার আগে হয়তো মাটির ওপরে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দু-পায়ের ওই তীক্ষ্ণ নোখগুলো দিয়ে আমার বুকটা চিরে ফেলে ভাল্লুকটা নিশ্চিন্ত হবে। কী জানি আমার কী হল, আমার বুকের মধ্যে কে যেন জাদুমন্ত্রের মতো সাহস এনে দিল। আমি ছুট দিলুম। এদিকটায় কত বড়ো-বড়ো ঘাস জন্মেছে। আমার একেবারে বুক অবধি লম্বা। আমি দু-হাত দিয়ে সেই ঘাস সরাতে-সরাতে যতটা সম্ভব জোর কদমে ছুটতে লাগলুম। তুমি তো জানো না, ঘাসের মধ্যে দিয়ে ছোটা কী দুঃসাধ্য কাজ! পায়ের দফারফা। বুঝতে পারছি, কেটে আর কাঁটা ফুটে রক্তারক্তি হচ্ছে। হোক। আমায় বাঁচতে হবে। ওতিয়াকে আমায় খুঁজে বার করতেই হবে।

আমি হঠাৎ-ই একবার দাঁড়ালুম। যদিও আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে, হাঁপাচ্ছি, তবু ভেবো না যেন, আমার দম ফুরিয়ে গেছে। এখনও আমি আরও কিছুক্ষণ নিশ্চায়ই ছুটতে পারব। ওই ভাল্লুকটার খপ্পর থেকে বাঁচার জন্যে আরও খানিকক্ষণ যুঝতে পারব। তবু দাঁড়ালুম। কারণ, ভাল্লুকটার তেড়ে আসার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছিলুম না। শুনতে পাচ্ছিলুম না, ঝোপঝাড় ভেঙে পড়ার কোনো আওয়াজ। আমি চকিতে একবার পিছু ফিরলুম। হ্যাঁ, তাই তো। আমার পেছনে কোনো ভাল্লুকও নেই, কিচ্ছু নেই। আমি অবাক হয়ে গেলুম। তবে কি ভাল্লুকটা আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারল না। এ-কথাটা আমি কেন, তোমরাও নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবে না। সেটা নিশ্চয়ই এখানে কোনো ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে। সুতরাং এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা নয়! যেমন করে তোক এখান থেকে পালাতে হবে। এইকথা মনে হতেই আমি আবার ছুট দিলুম।

কিন্তু চমকে গেলুম। ছুটতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালুম। কেননা, যেদিক দিয়ে ছুটে যাব, ঠিক সেইদিকেই ভাল্লুকটা চুপটি করে বসে আছে। আমার চোখে ধুলো দিয়ে, কোন ফাঁকে, কোন পথ ধরে যে সে ওখানে গেছে, আমি বুঝতেই পারছি না। যেন ভেলকি! আমি এখন ভাল্লুকটার একেবারে নাগালের মধ্যে। এখান থেকে ছুটলেও আমার নিস্তার নেই।

কিন্তু আশ্চর্য! ভাল্লুকটার এখনই যা করা উচিত ছিল, সে তো তা করছে না! কই এক লাফে ছুটে এসে আমার গলাটা তো টিপে ধরছে না! স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমায় দেখছে খালি! ও কী ভেবেছে, আমার এই যে ব্যানডুররিয়াটা, এটা কোনো মারাত্মক অস্ত্র! ভেবেছে, এগিয়ে এলেই এটা দিয়ে ওর মুণ্ডপাত করব। এ-কথা যদি ভেবে থাকে জন্তুটা আমার বাঁচোয়া! এ-যাত্ৰা আমি রক্ষা পেলেও পেয়ে যেতে পারি। সুতরাং ভাল্লুকটাকে আরও বেশি করে ভয় পাইয়ে দেবার জন্যে আমার মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আমি ব্যানডুররিয়াটা চটপট বাগিয়ে ধরে ভাল্লুকটার দিকে ঠিক বন্দুকের মতো তাক করে উঁচিয়ে ধরলুম।

ভাল্লুকটা কিন্তু ভয় পেয়ে পালাল না। এমনকী, নড়েচড়ে ভয় পাবার ভাব-ভঙ্গিও করল না। আমি অবিশ্যি ঠিক অমনি করে ব্যানডুররিয়াটা উঁচিয়ে ধরে এক-পা এক-পা করে পিছু হটতে লাগলুম। ভাল্লুকটা ট্যাঁও করে না, টুও করে না। আমার দিকে যেমন করে চেয়েছিল, তেমনিই চেয়ে রইল। আমি এতক্ষণ প্রায় নিঃসাড়ে পিছু হটছিলুম। যখন দেখলুম, ভাল্লুকটার সত্যিই কোনো সাড়া-শব্দ নেই, দে টেনে দৌড়! ব্যাস ছুটতে গিয়েই চিতপটাং। ঝোপের মধ্যে বেটপকা পায়ে কিছু জড়িয়ে গেল! লাগল কি লাগল না সে-কথা ভাববার সময় কই! সামনে সাক্ষাৎ যমদূত! হাতের ব্যানডুররিয়াটা কোননারকমে সামলে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালুম। এক বুক নিশ্বাস নিয়ে আবার ছুটতে গেলুম। পারলুম না। দেখলুম, যেদিক দিয়ে পালাবার ফাঁক খুঁজছি, ভাল্লুকটা এখন সেইদিকেই ঘাপটি মেরে বসে আছে! আশ্চর্য!

ঠিক এইসময়ে আমার মনের অবস্থা যে কী, তা খুলে না-বললেও তোমাদের নিশ্চয়ই বুঝে নিতে কষ্ট হবে না। আমি ভেতরে-ভেতরে এমন ভড়কে গেলুম যে, এখন কী করব সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। মনে হল, ভাল্লুকের খপ্পর থেকে রক্ষা পাওয়ার আর বোধ হয় পথ নেই। আমি ভাল্লুকের ফাঁদে পড়েছি। ফাঁদের মধ্যে আটকা পড়ে এমনি করে ছটফটিয়ে মরতে হবে। আর সে-মরণ যে কী কষ্টের, তা এখন কেউ না-বললেও, বুঝে নিতে কষ্ট নেই। কিন্তু সেভাবে তিলে তিলে আমি মরতে চাই না। তাহলে কী করা? ভাল্লুকটার সঙ্গে লড়াই করব? আমার বয়েসটা যদি ঠিক-ঠিক মনে করতে পারো, মনে করতে পারো–আমি তোমাদেরই মতো ছোট্ট, তবে নিশ্চিত জেনো, ভাল্লুকের সঙ্গে খালি হাতে লড়াই করা আমার সাধ্যে কুলাবে না। ভাবো তো একবার ভাল্লুকের সেই দশাসই চেহারাটার কথা! উফ! কী ভয়ংকর মূর্তি! সত্যি, যেন একটা কালো যম! এই গভীর জঙ্গলে, এমনি এক কেলেকিষ্টি যমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটি ছোট্ট ছেলে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে, এ-ছবিটা কল্পনা করলে, তোমার গায়ে কাঁটা দেবে না?

আপাতত আমি বন্দি। অর্থাৎ এই ঝোপের আড়াল থেকে ছুটে পালাবার আমি আর কোনো উপায় দেখছি না। কেননা, ভাল্লুকটা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে স্থির নজর রেখেছে আমার ওপর। একেই বোধ হয় বলে নজরবন্দি।

না, এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে মানুষ! একটা কিছু করতেই হয়! এই কথা মনে হতেই, একটা দুরন্ত দুঃসাহস আমার বুকের ভেতরে নাড়া দিয়ে উঠল। আমি শেষমেশ ভাল্লুকটার দিকেই এগিয়ে গেলুম। বলে রাখা ভালো, আমার হাতের ব্যানডুররিয়াটাকে আর বন্দুক বানাতে সাহস হল না। ওটা যেমন বাজনা আছে, তেমনিই থাক। কিন্তু যতই এগিয়ে যাচ্ছি, ততই মনে হচ্ছে, আমার শেষসময় বুঝি ঘনিয়ে এল! এই বুঝি ভাল্লুকটা লাফিয়ে পড়ল ঘাড়ে! শত্রুকে ঘায়েল করার এমন সহজ সুযোগ তার জীবনে বুঝি বা আর কোনদিন আসেনি, আসবেও না।

কিন্তু ঠিক এইসময়ে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল। আমাকে এগিয়ে যেতে দেখে ভাল্লুকটা কোথায় তেড়ে আসবে, তা নয়, পিছিয়ে যাচ্ছে। এ আবার কী ধরনের কৌশল! আমি দাঁড়িয়ে পড়লুম। ভাল্লুকটাও দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি পিছু হটলুম। ভাল্লুকটাও সামনে হেঁটে এল। আমি থামলুম। ভাল্লুকটাও থামল। আমি বাঁ দিকে গেলুম। ভাল্লুকটাও বাঁয়ে ফিরল। আমি ডাইনে হাঁটলুম। ভাল্লুকটাও ডাইনে হেলল। তাজ্জব ব্যাপারতো!

এখন আমার কী করা উচিত? মাথায় আসছে না কিছুই। নিস্তব্ধ চারিদিক। সেই নিস্তদ্ধতারও একটা রহস্যময় শব্দ আমার কানে বাজছে। এখন জঙ্গলের সেই শব্দের সঙ্গে আমার বুকের ভেতরের ভয়ের শব্দটাও যেন একাকার হয়ে গেছে! অদ্ভুত একটা অবস্থা। সেই অবস্থায় নিশ্চুপ আর নিশ্চল হয়ে আমি ওই ভাল্লুকটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। আর আমার সঙ্গে তাল রেখে ভাল্লুকটাও দাঁড়িয়ে রইল অনড় হয়ে।

হঠাৎ একটা কাণ্ড হয়ে গেল! হল কী, বেটপকা আমার হাত লেগে ব্যানডুররিয়ার একটা তার ঝন করে বেজে উঠল। চমকে গেল বোধ হয় ভাল্লুকটা। সে একটু চনমন করে নড়ে-চড়ে উঠল। তার উৎসুক চোখ দুটো এখন আমার মুখের ওপর থেকে সরে ওই ব্যানডুররিয়াটার ওপর গিয়ে পড়ল। সে রেগে গিয়ে আমার হাতের এই বাজনাটা দেখছে, না, শব্দ শুনে অবাক হয়ে চেয়ে আছে, তা আমি কেমন করে বলি! কিন্তু ব্যানডুররিয়ার এই ঝন শব্দটা আমার এই মুহূর্তের ভয়ের ভাবনাগুলিকে কেমন যেন হালকা করে দিল নিমেষের মধ্যে। আমার তক্ষুনি মনে হল, এখন এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে না-থেকে, মরবার আগে, শেষবারের মতো ব্যানডুররিয়াটা বাজাতে তো পারি! তুমি হলে এ-অবস্থায় কী করতে জানি না। কিন্তু আমি বাজালুম। আমার সাধের এই বাজনাটা নিয়ে, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার মায়ের গাওয়া সেই গানটির সুর বাজালুম। নিস্তব্ধ প্রকৃতির বুকের ওপর আমার বাজনার সুর কেমন এক অদ্ভুত শোনাচ্ছে! এ যেন আমি বাজাচ্ছি না। আমার হাত ধরে বুঝি বা অন্য কেউ বাজিয়ে দিচ্ছে। আমি চোখ বুজে দেখতে পাচ্ছি আমার মাকে। দেখতে পাচ্ছি, আমার বাবাকে। মনে হচ্ছে, তাদের হাসি-হাসি মুখ দুটি আমার কপালের কাছে, একেবারে কাছে এগিয়ে এসেছে। তাদের ঠোঁটগুলি এইমাত্তর যেন আমার কপাল ছুঁয়ে গেল। আমি চমকে উঠলুম। চমকে চেয়ে ফেলতেই আমার স্বপ্ন ভেঙে গেল। না, তারা কেউ নেই। আমার মা, আমার বাবা কেউ-ই না

কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলুম আর-এক দৃশ্য দেখে। দেখলুম, সেই ভাল্লুকটা আমার বাজনার তালে-তালে সামনের দু-পা ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে উঠেছে! নাচছে! এ কি বিশ্বাস করবার কথা? না সম্ভব? এ গভীর জঙ্গলের এক হিংস্র জীব তার শত্রুকে হাতে পেয়েও মারছে না, তারই বাজনার তালে নাচছে, এ-কথা বললে কোন মানুষ আমাকে পাগল না বলে! কিন্তু আমি যা স্পষ্ট দেখছি, তাকে মিথ্যে বলি কেমন করে! আমি দেখছি, ভাল্লুকটা আমার বাজনার সুরে যেন বিভোর হয়ে গেছে। এখন তাকে দেখলে মনে হয়, নাচ ছাড়া ও বুঝি জগতের আর কিছুই জানে না। আর ঠিক এই মুহূর্তে আমি ছাড়া এই বন্য-জন্তুটার বুঝি আর-কোনো বন্ধুই নেই! আমারও এতক্ষণ ভাল্লুক নামে যে-জন্তুটাকে মনে হয়েছিল নৃশংস এক জীব, এখন তার নাচ দেখতে-দেখতে মনে হচ্ছে, এই নিঃসঙ্গ, নির্জন বনে এমন চমৎকার বন্ধু বুঝি আর হয় না। কোথায় গেল আমার মরণের ভয়! কোথায় গেল আমার বিপদের ভাবনা! আমি এখন নিজেই নাচতে শুরু করে দিয়েছি। সে এক অদ্ভুত কাণ্ড! এখন এই বনের ভাল্লুকের সঙ্গে ইসতাসি নামে এই ছোট্ট ছেলেটার নাচ দেখলে, তোমার মনে হতে বাধ্য, ইসতাসি নিজেই বুঝি এক বন্য প্রাণী!

কে জানত, ওই নৃশংস জীবটার সঙ্গে আমার এ আনন্দের উচ্ছ্বাস একটুক্ষণের জন্যে। কে জানত, এমন এক গভীর জঙ্গলে অমন অসতর্ক হয়ে হই-হুঁল্লোড় করতে নেই। যে-কোনো মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে! সত্যি বলতে কী, এমন আশঙ্কা আমার মনে একেবারেই আসেনি। আমি কেমন যেন সব ভুলে গেছি। ভাল্লুকটার নাচ দেখে, নিজেও নাচতে-নাচতে তার একদম কাছে চলে এসেছি। তারপরেই সব শেষ! অকস্মাৎ একটা প্রচণ্ড আঘাত পড়ল আমার ঘাড়ের ওপর। চকিতে আমার দু-চোখ ভরে অন্ধকার নেমে এল। আমি পড়লুম, না, মরলুম, কিছুই জানি না।

তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, আমি মরিনি। মরলে কী আর আমার এ-গল্প তোমরা শুনতে পেতে! আমি আঘাত পেয়ে পড়ে গিয়েছিলুম। পড়ে-পড়ে অচৈতন্য হয়ে ধুকছিলুম। আমার যখন চেতনা ফিরে এল, আমার চোখে তখন আলোর রোশনাইটা ভারি অসহ্য লাগছিল। ভালো করে চাইতে পারছিলুম না। সব যেন কুয়াশার মতো ঝাপসা। ভাবতে পারছি না কিছুই। যেন একটা জবুথবু জীবন্ত জঞ্জাল পড়ে আছি জঙ্গলে।

একটু-একটু করে যখন আমার চোখের আলো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, আমি ধীরে-ধীরে মনে করতে পারছিলুম আমার নিজের কথা, তখন যেন পর্দায় ভেসে ওঠা ছবির মতো আমার চোখে ফুটে উঠেছিল প্রথম সেই ভাল্লুকটার ছবি। আমি পরিষ্কার মনে করতে পারছি, তার সেই নাচের সেই উদ্ভট চেহারাটা! সে নাচছিল আমার ব্যানডুররিয়ার সুরে তাল মিলিয়ে। আমি মনে করতে পারছি, এমনই সময়ে আমার ঘাড়ের ওপর কে যেন প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল। আমি কিছু খেয়াল করার আগেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলুম। কিন্তু আমার শেষ মুহূর্তের শেষ দৃষ্টিটি ঠিক মনে করিয়ে দিচ্ছে, এ-আঘাত আমায় সেই ভাল্লুক করেনি। যে করেছে, তাকে আমার দেখতে পাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। কারণ সে আমায় আক্রমণ করেছিল পিছন থেকে। আর আক্রমণ এমনই অতর্কিতে যে, আমার তখন করার কিছুই ছিল না।

হঠাৎ বুকটা চমকে উঠল। কে যেন আমার বুকের মধ্যে ধাক্কা মেরে ওতিয়ার মুখটা মনে পড়িয়ে দিল। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলুম। আমার ব্যানডুররিয়াটা হাতের কাছে দেখছি না। কষ্ট হচ্ছে, তবু উঠে দাঁড়ালুম। খুঁজতে লাগলুম বাজনাটা। দেখতে পেলুম, একটু দূরে ছিটকে পড়ে আছে সেটা। আমি হন্তদন্ত হয়ে সেটা তুলে নিতে গিয়ে দেখি, ভাল্লুকটা আহত অবস্থায় শুয়ে আছে সেটার পাশে। তার সারা গায়ে ক্ষত। রক্ত। সে যেন আমার অপেক্ষায় সেটা আগলে বেঁচে আছে। বুঝতে বাকি রইল না, সে কোনো হিংস্র জন্তুর সঙ্গে লড়াই করেছে। হয়তো আমাকে বাঁচাবার জন্যে। অথবা ব্যানডুররিয়াটা রক্ষা করতে। আমি তার কাছে ছুটে গেলুম। আমার দিকে ভারি করুণ দৃষ্টিতে চাইল সে। উঠে বসল। আমার চোখ থেকে তার চোখ সরিয়ে নিয়ে ওই সামনের ঝোপটার দিকে তাকাল। আঁতকে উঠলুম। দেখলুম, সেই ঝোপে একটা চিতা বাঘ ক্ষতবিক্ষত হয়ে মরে পড়ে আছে। দেখে মনে হল, কিছুক্ষণ আগে বনের দুই জন্তুর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়ে গেছে এইখানে। গাছের ডালপালা ঝোপঝাড় ভেঙে ছড়িয়ে একেবারে ছয়লাপ! বুঝতে পারলুম, এই চিতাটাই তখন আমায় আঘাত করেছিল। আর তার হাত থেকে আমাকে বাঁচাবার জন্যেই ভাল্লুকটাও লাফিয়ে পড়েছিল তার ঘাড়ে। দেখে বুঝতে কষ্ট নেই, এ-লড়াইয়ে জিতেছে ভাল্লুকটা। চিতা মরেছে, আমি বেঁচেছি। সুতরাং এখন নিশ্চিত হয়ে গেছি ভাল্লুকটা আমার বন্ধু। আনন্দের উত্তেজনায় আমি ভাল্লুকটার গলা জড়িয়ে ধরলুম। তার ক্ষত জায়গাগুলিতে হাত বুলিয়ে দিলুম। সে উঠে দাঁড়াল। তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে খুশির আনন্দে আমার বুকের ভেতরটা দুলে উঠল। সে হাঁটল। সেই মৃত চিতাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল, বাঘটা সত্যি মরেছে কি না। ছিটকে-পড়া ব্যানডুররিয়াটা তুলে নিয়ে আমিও পৌঁছে গেলুম চিতাটার সামনে। বিশ্বাস করতে পারছি না, এখন আমি বনের এক দুর্ধর্ষ জীবন্ত প্রাণী ভাল্লুকের পাশে দাঁড়িয়ে আর-এক ভয়ংকর হিংস্র প্রাণী চিতাবাঘের মৃতদেহটার দিকে চেয়ে-চেয়ে দেখছি। চিতাটার একটা চোখ ফুটো হয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। বুকের চামড়াটা ভাল্লুকের নোখের তীক্ষ্ণ আঁচড়ে দু-ফাঁক হয়ে ঝুলে পড়েছে। মনে হচ্ছে, কেউ যেন কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার বুকটা ফালা করে দিয়েছে। গায়ে কাঁটা দিল আমার। চিতাটাকে দেখতে দেখতে তাচ্ছিল্যে চোখ ফেরাল ভাল্লুকটা। ঘুরে দাঁড়াল। আমায় দেখল। কী বুঝল জানি না। কিন্তু আমার মনে হল, ও যেন বলতে চাইছে, ‘ভয় নেই ইসতাসি, আমি যতক্ষণ আছি তোমার গায়ে কেউ একটি আঁচড়ও কাটতে পারবে না।’

আমার তখন বলতে ইচ্ছে করল, ‘হে আমার প্রিয় ভালুকবন্ধু, তোমার এই দয়ার কথা আমি কোনোদিনই ভুলব না। তুমি ছিলে বলেই আমি বেঁচেছি। তোমাকে দেখে আজ আমি ভাবতে পারছি, বনের হিংস্র প্রাণী শুধু মানুষের প্রাণ নেয় না, তাকে ভালোবাসে। দুঃখ এই, আমি তোমার এই ভালোবাসার প্রতিদান তো কিছুই দিতে পারব না। এ প্রতিদান আমি আমার মানুষবন্ধু ওতিয়াকেও যে দিতে পারিনি। হঠাই সে হারিয়ে গেল এই জঙ্গলে। তাকে আর খুঁজে পেলুম না। খুঁজতে-খুঁজতে আমি তোমার দেখা পেয়েছি। তুমি কি পারো না আমাকে একটু সাহায্য করতে?

আমার মনের এত কথা ভাল্লুক বুঝল কি না জানি না। আবার দু-পায়ে ভর দিয়ে আমার মুখের সামনে সে উঠে দাঁড়াল। চিতাকে খুন করার রক্তে তার পায়ের থাবাদুটো এখনও রাঙা হয়ে আছে। ধারালো নোখগুলো কী ভয়ংকর তীক্ষ্ণ। দু-পায়ের সেই থাবা দিয়ে আচমকা সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। এবার বুঝি আমার পালা! বুঝি আমার প্রাণ নেয়! আমি আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠার আগেই, সে আমাকে নরম স্পর্শে বুকের মধ্যে টেনে নিল। সে বুকে ভালোবাসা, শুধু ভালোবাসা! আতঙ্ক নয়, আনন্দে চিৎকার করে উঠলুম আমি। তারপর তার বুকের ভেতরে হাবুডুবু খেতে-খেতে আমিও তাকে জড়িয়ে ধরার জন্যে আমার ছোট্ট দুটি হাত মেলে দিলুম। পারলুম না তাকে জড়িয়ে ধরতে। কারণ, বিরাট ই জন্তুটাকে ধরার জন্যে আমার এই হাতদুটি নিতান্তই ছোট্ট। হেসে উঠলুম আমি। হাসতে-হাসতে ওর বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমার ব্যানডুররিয়ার তারে ঝংকার তুলে ভাল্লুকটাকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছি। ভাল্লুকও ঘুরছে আমার সঙ্গে। হয়তো আমার ব্যানডুররিয়ার শব্দের তালে সেও দুলছে! ভারি একটা অদ্ভুত শব্দ বেরুচ্ছে এখন আমার ব্যানডুররিয়ার তারে, ‘জোরো–জোরো।’ বাজনার শব্দটাকে আমার মুখে লুফে লুফে আমিও গলা মিলিয়ে চেঁচাতে লাগলুম, ‘জোরো–জোরো।’ তখনই আমার মনে হল, আচ্ছা, ভাল্লুকটাকে যদি ‘জোরো’ বলে ডাকি। মনে হতেই, ছুটতে-ছুটতে আমি ভাল্লুকটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লুম। গলা ছেড়ে ডাক দিলুম, ‘জোরো

দেখতে পেলুম, আমার ডাক শুনে ভাল্লুকটার ছোট্ট দুটো চোখ খুশিতে চকচক করেছ। আমি আর একবার ডাকতেই সে মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করে আমার কাছে প্রায় লাফিয়ে ছুটে এল। আমি ওর গলাটা জড়িয়ে ধরলুম। তারপর আমার মাথাটা ওর মাথায় ঠেকিয়ে ডাকতে লাগলুম, ‘জোরো, জোরো, জোরো।’

ভাল্লুকটা হাঁপাচ্ছে। তার বুকের শব্দটা আমি শুনতে পাচ্ছি। তার নিশ্বাসে খুশির উত্তেজনা। সে-নিশ্বাস এত গরম!

.

মনে হচ্ছে, কতদিন পরে তোমাদের সঙ্গে আমার আবার দেখা হল। এখন আমি অন্য এক ইসতাসি। ওই বনজঙ্গল পেরিয়ে আমি এখন শহরের মানুষ। ওই বন পেরিয়ে কেমন করে যে আমি শহরে এসেছি, সে আর এক গল্প। হ্যাঁ, আমার বন্ধু জোরোই আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। এখন সে-ই আমার এই নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সঙ্গী। জোরোকে নিয়ে আমার আবার শুরু হয়ে গেছে পথে-পথে আর এক নতুন জীবন। ও নাচে, আমি বাজনা বাজাই। তোমরা শুনলে অবাক হবে, আমার এখন অনেক পয়সা। আর তা সব জোরোর জন্যে।

এখন যে শুধু জোরো আমার ব্যানডুররিয়ার তালে-তালে নাচে তাই নয়। খেলা দেখায়। অনেকরকম খেলার ভেলকি দেখাতে পারে সে। সামনের দু-পা উঁচিয়ে দাঁড়ানোটা তো সে টুসকি মারলেই করতে পারে। কিন্তু পেছনের পা শূন্যে তুলে, আর্চ হয়ে, মাথাটা নিচু করে সে যখন হাঁটে, দেখলে তোমার তাক লেগে যাবে। ওই অবস্থায় হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ এমন ভলট দেয় যে, দেখলেই হাততালি।

হ্যাঁ, এখন অনেক হাততালি আমার কপালে জুটছে। এখন যেন আমার আবার সেই যাযাবরের জীবন শুরু হয়ে গেছে। আমি এখন এক ভাল্লুক-নাচিয়ে যাযাবর। সত্যি বলছি, এই ব্যানডুররিয়া বাজিয়ে পথে-পথে আমি যে এইভাবে জোরোর নাচ দেখিয়ে বেড়াব এটা আমি কল্পনাই করতে পারিনি কোনোদিন। একদিন হঠাৎই ব্যাপারটা ঘটে গেল। সেদিন রাস্তার ধারে বসে নিজের খেয়ালেই আমি ব্যানডুররিয়াটা বাজাচ্ছিলুম। সেই বাজনার তালে-তালে এমন সব আজব কাণ্ড করছিল জোরো যে, তাই দেখে আমি নিজেই তো থ। হঠাৎ দেখি, তার সেই আজব কাণ্ডকারখানা দেখতে-দেখতে একটি একটি করে অগুনতি লোক আমার সামনে এই পথের ওপর জমে গেল। জোরোকে দেখে তারা হেসে কুটোকুটি। আনন্দে লুটোপুটি। আমার বাজনার তালে তারাও নাচতে লাগল। চেঁচাতে লাগল, বাহাবা! বাহাবা!’ আর আমিও মনে-মনে জোরোকে বলতে লাগলুম, ‘বহুত আচ্ছা! বহুত আচ্ছা!’।

হ্যাঁ, আমি এখন আর ভাবতেই পারি না, এই বন্য জন্তুটা একটা নৃশংস জানোয়ার। এখন আমার মনে হয়, বনের এই ভাল্লুকটা যেন আমার অনেক কাছের এক আপনজন। এই পৃথিবীতে ও জন্ম নিয়েছে বুঝি আমারই জন্যে। হয়তো তাই। এই প্রাণীটা যদি না থাকত, ওই দুর্গম বনের বিপদ থেকে কে আমাকে রক্ষা করত! কিংবা আজ আমাকে কে এত পয়সা দিত।

 এখন আমার কত পোশাক হয়েছে। রঙের ছড়াছড়ি। লাল নীল হলদে সবুজ। কত রঙের পোশাক। যখন যেটা মন চায় পরি। আর পরতে-পরতে ভাবি, আমার সেই জঙ্গলের বন্ধু ওতিয়ার গাছপাতা-সাজানো সেই পোশাকের মতো আমার এই পোশাক কি অত সুন্দর!

হঠাৎ-হঠাৎই মনে পড়ে যায় আমার ওতিয়ার কথা। হঠাৎ-হঠাৎ তার সেই মুখের হাসিটি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার সেই গান, কিংবা কলকল করে কথা বলার মিষ্টি শব্দগুলি আমার কানে বেজে উঠলে আমার অশ্রুর ফোঁটাগুলিকে আমি ধরে রাখতে পারি না। তখন আমায় দেখে এই বনের ভাল্লুকটা যে কী ভাবে, জানি না। সে কী বুঝে যে এই সময়ে আমার হাতের ওপর তার মাথাটি এগিয়ে দেয়, তা-ও আমি জানি না। শুধু আমার চোখের জল সামলে নিয়ে আমি তাকে জড়িয়ে ধরি। আর অস্পষ্ট গলার স্বরে বলি, ‘পারিস না তুই ওতিয়াকে খুঁজে দিতে? পারিস না আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে?’

আমার ইচ্ছে আছে একটা গাড়ি কিনব। ঘোড়ায়-টানা গাড়ি। একটা-একটা করে এখন এতসব জিনিসপত্তর জমে গেছে যে, আর গাড়ি না-হলেই নয়। আমার পিঠে বাঁধা এই ব্যাগটা আর কাজে আসছে না। তাছাড়া পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে মুসাফিরের মতো ঘোরাঘুরি করতেও বেশ ঝামেলা। আমার এই তাঁবুটাই দ্যাখো কী ভারী! অবিশ্যি তাঁবুটা জোরোই পিঠে নিয়ে বয়ে চলে। দরকার মতো খাঁটিয়ে নিতে আমার তেমন কষ্ট হয় না।

আমি যে ঘোড়ায়-টানা গাড়ির কথা বলছি, সেই গাড়িগুলো দেখতে কিন্তু দারুণ। টায়ার-আঁটা চারটে চাকার ওপর ফ্রেমে এঁটে কে যেন একটা বাক্স বসিয়ে রেখেছে। এতে যত খুশি জিনিসপত্তর তো রাখতে পারোই, তার ওপরে বেশ গুছিয়ে বিছানা পেতে ঘুম দিতেও দিব্যি আরাম। গাড়ির দরজাটা পেছনদিকে। ওই তোমাদের পুলিশ-ভ্যানে যেমন থাকে আর কী! সামনে বসে তুমি গাড়ি চালাও গড়গড়িয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে। ছোটো এক দেশ থেকে আর-এক দেশে! তবে জোরোকে নিয়ে মুশকিল আছে। গাড়ির ভেতরে তো আর সে ঢুকতে পারবে না। যা কুঁদো। অবিশ্যি গাড়ির চালের ওপর ইচ্ছে করলেই জোরো উঠে পড়তে পারবে। চালে বসেই সে দেশে-দেশে ঘুরতে পারবে।

কদিন হল আমি এক কারনিভলে জোরোর খেলা দেখাতে এসেছি। এখানেই তাঁবু গেড়েছি। এ যেন নানান খেলার মজার মেলা। যত পারো আনন্দ করে নাও। একটা মস্ত মাঠে কারনিভল সাজিয়ে কত খেলাই না দেখানো হয়। এখানে ম্যাজিক দ্যাখো, ভেলকি দ্যাখো, গান শোনো, নাচ দ্যাখো–যা খুশি তাই। ইচ্ছে করলে ওই জায়েন্ট হুইলে চড়ে যত খুশি চরকি খেতে পারো। মেরি-গো-রাউণ্ডে ঘুরপাক খাও। মিনি-রেলে চেপে যেখানে খুশি চলে যাও। আমিও এসেছি এখানে। আমি জানতুম, এখানে জোরোর খেলা দেখিয়ে আর আমার ব্যানডুররিয়া শুনিয়ে বেশ কিছু পয়সা হবে। গাড়িটা তো কিনতে হবে!

 কিন্তু আমি যা ভাবতে পারিনি এ যে তাই হল। জোরো যে এত তাড়াতাড়ি সবার এমন প্রিয় হয়ে উঠবে, এ যে আমার কল্পনার বাইরে। কারনিভলের সব ভিড় যেন উপচে পড়ছে জোরোর খেলা দেখবার জন্যে। কারনিভল জুড়ে অত যে সব মজার কাণ্ড, সেদিকে কেউ ছোটে না। ছুটে আসে আমার দিকে। খেলা দেখাব কী, ভিড় সামলাতেই হিমশিম। আর তারপরেই হল উলটো বিপত্তি! অন্য যারা খেলা দেখাতে এসেছে, তারা আমার ওপর ভীষণ চটিতং! আমার ওপর ভীষণ হিংসে! বটেই তো! ব্যাবসা করতে এসে মার খেলে, কার আর মন-মেজাজ ঠিক থাকে বলো! সুতরাং আমি যাতে পাততাড়ি গুটিয়ে মানে-মানে কেটে পড়ি তার জন্যে কুচক্রীরা ফন্দি আঁটতে বসল। কে জানে, হয়তো আমায় মেরেই বসে

কথাটা কানে এল আমার আজ। আমার এত যে উৎসাহ, এত যে খুশি, সব যেন চুপসে গেল নিমেষে! দুঃখে মনটা মুষড়ে পড়ল। আমি যেন কেমন হতাশ হয়ে পড়লুম। কী করব এবার?

যখনই আমার মনটা এমনি দুঃখ আর হতাশায় ভেঙে পড়ে, তখনই যেন আমার কানে-কানে কে বলে যায়, ‘ভেঙে পড়ছ কেন ইসতাসি? ওই তো তোমার বন্ধুটি সঙ্গে রয়েছে! তোমার ব্যানডুররিয়া। ওর তারে তোমার হাতের আঙুলগুলি আলতো ছোঁয়ায় টান দাও, তোমার সব দুঃখ শেষ হবে।’

আমি তখন সত্যিই ব্যানডুররিয়াটা হাতে তুলে নিই। বাজাই। আজও তাই খেলার শেষে তাঁবুতে ফিরে, হাতে তুলে নিলুম আমার ব্যানডুররিয়া। তার একটি-একটি তারে ঝংকার টেনে ভাবতে লাগলুম, সত্যি ভারি প্রিয় আমার এই বন্ধুটি। কত গভীর সংকট থেকে সে আমাকে রক্ষা করেছে। কত মৃত্যুর হাত থেকে সে আমাকে বাঁচিয়েছে। আর এই বাজনাটার জন্যেই তো আজ আমি জোরোকে পেয়েছি। জঙ্গলের অন্ধকার থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এক আশ্চর্য ভাল্লুক! আর ওতিয়া?

এখন রাত। ব্যানডুররিয়ার তারে-তারে সুর বেজে ওঠে আমার হাতের স্পর্শে। আমার গলা গেয়ে ওঠে ওতিয়ারই সেই গান :

দুঃখ কীসের বন্ধু
আমি তো আছি,
তোমারই যে পাশে-পাশে
এত কাছাকাছি।

গাইতে গাইতে আমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি এই মুহূর্তে। আমার গানের শব্দগুলি ভারি ধীরে ধীরে এই রাতের অন্ধকারে গুনগুনিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। মনে পড়ে যায়, আমার সেই ফেলে-আসা দিনগুলির কথা। আমার মা, আমার বাবা, আমাদের সেই দল। মনে পড়ছিল, সেই ভয়ংকর রাতের কথা। সেই রাতে প্রথমে মায়ের গানের সঙ্গে ব্যানডুরিয়া বাজাচ্ছিলুম আমি। তারপর সেই বন্দুকের গুলি। বোমা, পিস্তল, পুলিশ। তারপর আনাতিদাদার সঙ্গে

‘ইসতাসি!

 ‘কে!’ আমি চমকে উঠলুম। আমার গান স্তব্ধ হয়ে গেল।

ইসতাসি!

আমি তাঁবুর বাইরে ছুটে এলুম!

ইসতাসি!

অত্যন্ত চেনা গলা আমার! অথচ অন্ধকার রাতে আমি তখনও ভালো করে চিনতে পারিনি। তাই ব্যস্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলুম, ‘কে?’

 ‘আমি।’

হঠাৎ আমার চোখের ওপর একঝলক আলো কে যেন ছুঁড়ে দিল। আমি দেখতে পেয়েছি। আমি চিনতে পেরেছি। আমি চিৎকার করে উঠেছি, ‘আনাতিদাদা–I’ ছুটে গেলুম তার কাছে। জড়িয়ে ধরলুম। কেঁদে ফেললুম। তারপর দুজনে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলুম না

আনাতিদাদাই প্রথমে কথা বলল, ‘এতদিন কোথায় ছিলি ইসতাসি?’

উপছে-পড়া চোখের জল সামলাতে-সামলাতে আমিও জিজ্ঞেস করলুম, ‘তুমিই-বা কোথায় ছিলে আনাতিদাদা?

আমার মুখের দিকে চাইল আনাতিদাদা। তারপর বলল, ‘জেলে।’

 আমি শিউরে উঠলুম।

 ‘পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলুম। ওরা আমার পায়ে গুলি মেরে আমায় কাবু করে ফেলে। তারপর ধরে নিয়ে যায়।

আমি বুঝতে পারলুম,আনাতিদাদার সেই গুরুগম্ভীর গলার স্বর কেমন যেন ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। সেই ক্ষীণস্বরে আনাতিদাদা আবার বলল, কদিন আগে ছাড়া পেয়েছি। পয়সা নেই। তাই কারনিভলে ম্যাজিক দেখাতে এসেছি। এখন আর তেমন পারছি না। শরীরটা গেছে। পায়ে গুলি লেগে যে ঘা হয়েছিল, সেটা বিষিয়ে গেছে। তাই আমার ম্যাজিক দেখার লোকই জুটছে না। তার ওপর শুনলুম, একটি ছোট্ট ছেলে ভাল্লুক-নাচ দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। এই কারনিভলে লোকে দল বেঁধে তার খেলাই দেখতে ছুটছে। অন্যের খেলা কেউ দেখছে না। আমার কৌতূহল হল, কে ছেলেটি! কী এমন খেলা! দেখতে গেলুম। দেখে চমকে উঠলুম। এ যে ব্যানডুররিয়া হাতে আমার ইসতাসি! আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠেছিলুম। কিন্তু না, তখন আর কিছু করিনি। শুধু চুপিচুপি ইসতাসির আস্তানাটা খুঁজে বার করেছি। ইসতাসিকে অবাক করে দেব বলে, এই অন্ধকারে, লুকিয়ে-লুকিয়ে এখন এসেছি। এসে দেখছি, আমার চেয়েও এক বড়ো জাদুকরকে।’ বলে আনাতিদাদা আমার মাথায় হাত রাখল। আমায় কাছে টেনে নিয়ে আদর করে চুমু খেল। তারপর হাঁপাতে লাগল। আমার মনে হল, আনাতিদাদার হাত-পাগুলো থরথর করে কাঁপছে। আমি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তোমার কষ্ট হচ্ছে, আনাতিদাদা?

‘কই? না।’

আমি বুঝতে পারলুম, আনাতিদাদা দাঁড়াতে পারছে না। তার পিঠে-বাঁধা ম্যাজিকের ঝুলিটা তাড়াতাড়ি নামিয়ে নিয়ে বললুম, ‘এসো, এসো, ভেতরে এসো।’

হ্যাঁ, তাই চ। একটু বসে যাই।’

 ভেতরে এল আনাতিদাদা। তাঁবুর ভেতর জ্বলন্ত আলোয় আনাতিদাদার মুখখানা ভালো করে দেখে আমি শিউরে উঠলুম।

‘তোমার এ কী চেহারা হয়েছে আনাতিদাদা?’

‘আর বাঁচব না বেশিদিন।’

‘ও-কথা বোলো না আনাতিদাদা।’

 ‘গুলির বিষে শরীরটা ঝরঝরে হয়ে গেছে যে।’

হাঁটুর ওপরে ব্যান্ডেজ-বাঁধা জায়গাটা আনাতিদাদা দেখাল।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘এখন কোথায় আছ?’।

‘পথে।’ বলেই হেসে উঠল আনাতিদাদা। হাসি দেখে বুঝতে কষ্ট হল না, আনাতিদাদার কিছুই নেই।

আমি বললুম, ‘আর পথে-পথে তোমায় ঘুরতে হবে না আনাতিদাদা। আজ থেকে মনে করো, আমার তাঁবুই তোমার নিজের তাঁবু।’

‘ইসতাসি! বুকের ভেতর থেকে একটা চাপা আনন্দে আমার নাম ধরে ডাক দিল আনাতিদাদা। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমার চোখের দিকে চাইল। ভারি নিশ্চিন্ত সেই চাউনি।

আমি আবার বললুম, ‘তোমাকে আমি যেমন করেই হোক ভালো করে তুলব, আনাতিদাদা।’

কী করে পারবি?’

 ‘যেমন করে তুমি পেরেছে আমাকে ব্যানডুররিয়া শেখাতে।’

 ‘হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে শুনছিলুম তোর বাজনা। এখন কী চমৎকার বাজাস!’ বলতে-বলতে একঝিলিক মুচকি হাসি আনাতিদাদার ঠোঁটে ঢেউ খেলে গেল। আমি দেখলুম, সে-হাসিতে জৌলুস নেই। যেন কষ্ট মেশানো।

আমি বললুম, ‘আনাতিদাদা, বিছানায় শুয়ে পড়ো। তোমার কষ্ট হচ্ছে।’

 আনাতিদাদা বলল, ‘না, তেমন না। তবে শুতে আপত্তি নেই।’

আমার খাবারের কৌটোতে দুধ আর রুটি ছিল। এনে বললুম, ‘খেয়ে নাও।

 ‘তোর?’

 ‘আমি খেয়েছি।’

 ‘না কি লুকোচ্ছিস?’

 ‘তোমাকে কখনো মিথ্যে বলিনি আনাতিদাদা।’

 ‘তাহলে খেতে পারি, দে!’

আনাতিদাদা দুধ আর রুটি খেতে-খেতে জিজ্ঞেস করল, ‘গান শিখলি কোথায়?’

 ‘নিজে-নিজে।

অবাক হল আনাতিদাদা, ‘বলিস কী! নিজে-নিজে এত সুন্দর শিখেছিস?’

‘সব তো তোমারই জন্যে।’ আমি উত্তর দিলুম।

 ‘ভাল্লুকটা? কিনেছিস?’

 ‘না!’

 ‘তবে?’

 ‘জঙ্গল থেকে পেয়েছি।

‘হঠাৎ-হঠাৎ এমন সব আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে যায়, ভাবাই যায় না।’

আমি বললুম, ‘তোমার সঙ্গেও দেখো, হঠাৎ কেমন দেখা হয়ে গেল। এও তো এক আশ্চর্য ঘটনা।’

 আনাতিদাদা উত্তর দিল, ‘আশ্চর্য তো বটেই। কেননা, আমার ঠিক মৃত্যুর আগে, আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি।’

আনাতিদাদার কথা শুনে আমার বুকটা ছ্যাঁত করে চমকে উঠল। আমি বললুম, ‘ও-কথা কেন বলছ। আনাতিদাদা? তুমি মরবে কেন? কে তোমাকে মরতে দেবে?’

আনাতিদাদা আমার মুখের দিকে চাইল। আমার একটা মস্ত বড়ো ছায়া তাঁবুর গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার সেই ছায়ার মতো, আনাতিদাদাও নিশ্চপ, নিস্তব্ধ!

হঠাৎ আমিই সেই নিস্তব্ধতা ভাঙলুম। বললুম, ‘ঘুমিয়ে পড়ো।’

আনাতিদাদা জিজ্ঞেস করল, ‘তোর বাজনাটা কই?’

 ‘শুনবে?’

 ‘শুনব। বাজনার সঙ্গে তোর গান।’

আমি গাইলুম। অবাক হয়ে আমার গান শুনতে-শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল আনাতিদাদা। তার ঘুমে নিজঝুম মুখখানি দেখতে-দেখতে কত কথাই না মনে পড়ে যায়। মানুষটার সেই লোহার মতো শক্ত-পুরুষ্টু চেহারাটা যেন ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। এই এতখানি চওড়া বুক, সেই শক্ত দুটি হাত, সেই জীবন্ত দুটি চোখ, সবই যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। এখন একটা হাড়-জিরজিরে মানুষের কঙ্কাল যেন আনাতিদাদা। বড়ো কষ্ট হল। মনে-মনে ভাবলুম, এমন-একটা নির্দোষ মানুষকে গুলি মারতে হাত কাঁপল না!

সকালে ঘুম ভাঙল যখন, আনাতিদাদাকে বললুম, ‘আজ থেকে তোমাকে আর কষ্ট করে ম্যাজিক দেখাতে হবে না। তুমি তাঁবুতে শুয়ে থাকো। খেলা দেখাব আমরা, আমি আর জোরো। পয়সা আনব। তোমাকে আবার আগের মতো ভালো করে তুলব। শুরু করব নতুন জীবন। একটা গাড়ি কিনব। গাড়ি করে দেশে দেশে ঘুরব। তখন আবার তুমি ম্যাজিক দেখাবে। জোরো নাচের ভেলকি দেখাবে আমি গান গাইব, ব্যানডুররিয়া বাজাব।’

আমার কথাশুনে শুধুই হাসল আনাতিদাদা। কথা বলল না। উঠতেও পারল না। বোধ হয় বন্দুকের গুলি খাওয়া বিষাক্ত ঘা আরও বিষিয়ে উঠেছে আজ। বোধ হয় ব্যথাটা বেড়েছে।

.

আরও সাতদিন কারনিভল এখানে থাকবে। আরও সাতদিন আমি আর জোরো কারনিভলে খেলা দেখাতে পারব। আরও সাত দিনে আরও পয়সা হবে। আজও যেমন হল

আজ অবিশ্যি একটা ভারি মজার ব্যাপার হয়ে গেল। খেলার শেষে সব লোকজন চলে গেলে, আমিও যাব বলে গোছগাছ করছি, হঠাৎ দেখি একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। সে আমার ব্যানডুররিয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। প্রথমটা তেমন গা করিনি। কিন্তু অনেকক্ষণ পরেও যখন দেখলুম, তার সেই দৃষ্টি একইভাবে অবাক হয়ে আছে, তখন কেমন সন্দেহ হল। আমি তাকে ডাকলুম। জিজ্ঞেস করলুম, ‘অমন অবাক হয়ে কী দেখছ?’

সে প্রস্তুত ছিল না। একটু থমকে গেল। তারপর বলল, বাজনা।’

আমি বললুম, ‘ওঃ! বাজাতে ইচ্ছে করছে?’

সে আমার মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল।

আমি বললুম, ‘বেশ তো, বাজাও।’

ছেলেটি ব্যানডুররিয়ার তারে হাত দিল। বেজে উঠল টুং-টাং-টুং। তার মুখখানা হাসিতে ভরে গেল।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘তোমার নাম কী?

সে বলল, ‘জুতসু।’

 আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘কোথা থাকো তুমি?’

সে বলল, ‘এখানে, এই কাছেই। দিদি নাচ দেখাতে এসেছে কারনিভলে।

 ‘তুমিও নাচতে পারো বুঝি?

 ‘ধ্যাত!’ ছেলেটি লজ্জা পেল। বলল, ‘নাচি না, দিদি নাচে। আমি তালি বাজাই।

আমি হেসে ফেললুম। একটু জোরেই হেসেছি। আর ঠিক তক্ষুনি কোথা ছিল ছেলেটির দিদি, দৌড়ে এসে গম্ভীর গলায় ডাকল তার ভাইকে, ‘জুতসু।’

ভাই চমকে চাইল।

দিদি ধমকে উঠল, ‘এখানে কী করছিস?

বাজনা বাজাচ্ছি।’

 ‘শিগগির আসবি!’

 ‘একটু পরে যাচ্ছি।’

গলাটা আরও একটু চড়িয়ে দিদি বলল, ‘এক্ষুনি আসবি।’

 ছেলেটা যাচ্ছে না দেখে আমি বললুম, ‘এখন যাও, পরে এসো।’

চলে গেল জুতসু নামে ছেলেটি। আমি জানি না তারপরে কী হল। কিন্তু অবাক হয়ে ভাবতে বসলুম, ছেলেটির দিদি অমন তিরিক্ষি মেজাজে কথা বলল কেন! ও তো কোনো দোষ করেনি!

দেখি, ছেলেটি পরের দিনও এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘আবার এলে? দিদি বকবে না?’

সে বলল, ‘দিদিকে লুকিয়ে পালিয়ে এসেছি।

আমি বললুম, ‘লুকিয়ে? ঠিক করোনি।’

সে বলল, ‘তোমাকে আমার ভালো লাগে।’

‘কেন?’

 ‘তুমি খুব ভালো। কী সুন্দর বাজনা বাজাও তুমি। আমি রোজ শুনি। এটা কী বাজনা?’

‘ব্যানডুররিয়া।’

‘আমায় শিখিয়ে দেবে?’

 ‘দিদির নাচের সঙ্গে বাজাবে বুঝি?’

 ‘ধ্যাত! ওই আবার নাচ! কেউ দেখেই না। সক্কলে তোমারই বাজনা শোনে আর ভাল্লুকের খেলা দেখে। তোমার ওপর দিদির কী রাগ।’

ছেলেটির এই কথা শুনে আমি একটু থতমত খেয়ে গেলুম। জিজ্ঞেস করলুম, ‘কেন?’

সে বলল, ‘দেখনি, খবরের কাগজে তোমার নাম বেরিয়েছে?’

আমি বললুম, ‘আমি জানি না তো।’

 ‘দেখে দিদির গা জ্বলে গেছে। আর অন্য যারা খেলা দেখাতে এসেছে, তাদের কী হিংসে তোমার ওপর। কেউ পয়সাই পাচ্ছে না।’

আমি বললুম, ‘এতে আমার কী দোষ। আমিও তো পয়সা উপায় করতে এসেছি। আমাকে পয়সা উপায় করতেই হবে। আমার আনাতিদাদার খুব অসুখ। তাকে যে আমায় ভালো করতে হবে।’

ঠিক এই সময়ে ছেলেটির দিদি আচমকা এসেছিল। আমি বুঝতেই পারিনি সে এসেই আমার সঙ্গে চোটপাট শুরু করে দেবে। সে হঠাৎই এসেছিল ঝড়ের মতন। ঝড়ের মতন ঝাঁকিয়ে উঠে সে বলেছিল, ‘আমি পছন্দ করি না, তুমি আমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলো। তোমার মতলবটা কী, তা আমার জানা আছে।’

আমি বললুম, কী জানো? আমি জানতে পারলে খুশি হব।’

ছেলেটির দিদি আরও রেগে উঠল। প্রায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘আমিও জানতে পারলে খুশি হব, ওর কানে তুমি কী-মন্ত্র দিচ্ছ!’

আমি বললুম, ‘জুতসু আমাকে ভালোবাসে।’

 সে বলল, ‘আমি তোমাকে অপছন্দ করি।’

আমি থমকে গেলুম। আর কথা বলা যায়! এমন কথা যার মুখ দিয়ে বেরোয়, তার সঙ্গে কথা না-বলাই ভালো। দেখতে পেলুম, ছেলেটির মুখখানি ভারি করুণ হয়ে আছে আমার দিকে চেয়ে। আমার কেমন মায়া লাগল। আমি তাকে বলতে পারলুম না, তুমি আর এসো না আমার কাছে। দিদিই তার হাত ধরে টান দিল। হেঁচকা মেরে বলল, ‘ফের যদি আসবি, পুঁতে ফেলব!’

ছেলেটি শেষবারের মতো আমার দিকে চাইল। তারপর দিদির সঙ্গে চলে গেল।

মনটা ভারি খারাপ লাগছে আজ। তাঁবুতে ফিরে দেখি, আনাতিদাদা আরও কাহিল হয়ে পড়েছে। অন্য দিন খুশিতে উছলে আমি তাঁবুতে ফিরি। আজ ওইরকম একটা কাণ্ড ঘটে যেতে স্বাভাবিকভাবেই আমার সে খুশি মুখ থেকে মুছে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও নিজের দুঃখটা মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারলুম না। ধরা পড়ে গেলুম আনাতিদাদার কাছে। অবাক হয়েই আনাতিদাদা জিজ্ঞেস করল, ইসতাসির মুখখানা আজ অমন শুকিয়ে কেন? কী হয়েছে?’

আমি বললুম, ‘এমনি।’

 ‘একটা কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। নইলে হাসি নেই কেন ইসতাসির মুখে?’।

আমি বললুম, ‘ভাবছি, কারনিভলে আর খেলা দেখাব না। চলে যাব। আমার জন্যে অন্য সকলের ক্ষতি হচ্ছে।’

‘কী ক্ষতি?’

 ‘সক্কলে আমার খেলাই দেখে। ওদের খেলা দেখতে লোক হয় না।

আনাতিদাদা রুগণ হাতটা এগিয়ে আমার মুখটা তার চোখের কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘ছিঃ! ছিঃ! ইসতাসি হেরে গেল!’

আমি বললুম, ‘ওরা আমায় পছন্দ করে না।’

 ‘না, তোকে হিংসে করে।’

আমি চুপ করে গেলুম। আমায় চুপ থাকতে দেখে আনাতিদাদা বলল, ‘আমার জন্যেই তোকে এমন হেনস্তা হতে হচ্ছে।’

‘কে বলল তোমার জন্যে?’ আমি প্রায় রেগে চিৎকার করে উঠেছিলুম। নিজেকে সামলে নিলুম। বললুম, ‘আনাতিদাদা, কেউ আমাকে হেনস্তা করল, কি অপছন্দ করল তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। তোমার জন্যে আমি সবকিছু করতে পারি। তোমাকে ভালো হতে হবে আনাতিদাদা। আবার সেইরকম সাহসী আর শক্ত-সমর্থ হয়ে তুমি আমার হাত ধরে আমায় নিয়ে যাবে দেশে-দেশে। আমি ব্যানডুররিয়া বাজিয়ে গান শোনাব। চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে সকলকে বলব, ‘আমার এই আনাতিদাদার কাছে আমি শিখেছি ব্যানডুররিয়া বাজাতে।’

আমি দেখতে পেলুম, আনাতিদাদার চোখের পাতাদুটি ভারি ছটফট করে ওঠা-নামা করছে। সেই আধো আলো, আধো-ছায়াতে আমি দেখতে পেলুম না সেই চোখের পাতায় কোনো কান্নার ফোঁটা দুলে উঠছে কি না! সত্যি বলতে কী, সেই কান্না আমি দেখতে চাই না। আমি চাই, আনাতিদাদা হেসে উঠুক। তার একবুক হাসি হা-হা-হা করে উপচে আমাকে বলুক, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ভালো হব আবার। আমার শক্ত হাতখানা তোর হাতের ওপর রাখব। তারপর দু-জনায় ছুটে যাব পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। সঙ্গে যাবে জোরো, এই ভাল্লুক আর এই ছোট্ট তাঁবুটা। আমরা সারা দুনিয়ায় আনন্দ বিলিয়ে বেড়াব। শুধু আনন্দ। যে আনন্দ মানুষকে দুঃখ ভোলায়!’

কিন্তু কিছুই বলল না আনাতিদাদা। চেয়েই রইল। ভারি শূন্য সেই চাউনি।

আজও আমি কারনিভলে এসেছি। আজও জোরোর খেলা দেখাতে হবে আমায়। কেননা, আজ এই শহরের মেয়র আসবেন কারনিভলে। তিনি কারনিভল দেখবেন। দেখবেন, হাসি-হল্লা খুশি-মজার মেলা। আজ তাই কারনিভলের এই মস্ত চত্বরটা ঝাড়পোঁছ করে ধুলো-জঞ্জাল সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নতুন করে সাজানো হয়েছে কারনিভল। কত রংচঙে বেলুন উড়ছে। কত রঙিন পতাকা। রং-ঝলমল কাগজের ফুল। আর কত আলোর বাহার। আসলে কালকের ওই ঘটনার পর থেকে মনটা আমার এমন মুষড়ে আছে যে, কিছুই যেন ভালো লাগছে না। তবু ব্যানডুররিয়া বাজাতে হবে। তবু জোরো খেলা দেখাবে।

মেয়র যখন এসেছিলেন, তখন সন্ধে পার হয়েছে। তিনি এসেছিলেন একা নয়, সঙ্গে আরও কত লোক। সন্ধ্যার কারনিভল জমজমাট। বুঝতেই পারছ, মেয়রকে খুশি করবার জন্যে, সবাই তাদের সব-সেরা খেলাগুলি দেখাচ্ছে আজ। সব-সেরা মজা।

একটি-একটি মজা দেখার জন্যে তিনি এক-এক জায়গায় দাঁড়ান। একটু মাথা হেলান, একটু খুক করে কাশেন, তারপর হাঁটেন। এমনি করে হাঁটতে-হাঁটতে তিনি আমার খেলার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার ব্যানডুররিয়া বেজে উঠল। আমার ভাল্লুক মেয়রকে দেখেই মারল ভলট। মেরেই সটান দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর মেয়রকে সালুট করল। সঙ্গে-সঙ্গে চারিদিক থেকে হাততালি। তারপর জোরো মাথায় একটি রঙিন ছাতা ধরে, শূন্যে তারের ওপর হাঁটতে-হাঁটতে, একবার এ-পাশ থেকে ও-পাশ, আবার ও-পাশ থেকে এ পাশ এল। তারের ওপর জোরোর এ এক আশ্চর্য ব্যালেন্সিং-এর খেলা। আমার ব্যানডুররিয়া সেই ব্যালেন্সিং এর তালে-তালে বেজে ওঠে। হাততালি, শুধু হাততালি। মেয়রসাহেব কিন্তু হাতে তালিও মারেন না, মুখে হাসিও আনেন না। গম্ভীর হয়ে দেখেন। যেন পাথর-কাটা মূর্তি।

দেখতে-দেখতে মেয়রসাহেব তাঁর পাশের লোককে ইশারায় কাছে ডেকে ফিসফিসিয়ে কী যেন বললেন। পাশের লোকটি আমার কাছে এল। একে মেয়রসাহেবের মুখখানা অমন গম্ভীর, তার ওপর তাঁর একজন পার্শ্বচর যখন আমার কাছে এসে দাঁড়াল, তখন আমার ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। এবার বোধ হয় সাহেব নিজেই আমাকে এখান থেকে চলে যাবার ফরমান জারি করবেন। কিন্তু না। তাঁর পার্শ্বচর গলার স্বরটা একটু উঁচিয়ে, সবাইকে শুনিয়ে-শুনিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ওহে ভাল্লুক-নাচিয়ে, তোমার নাম কী?

আমি ধরা-ধরা গলায় বললুম, ‘ইসতাসি।’

 আবার সেই ব্যক্তিটি চিৎকার করে বললে, ‘ইসতাসি, তোমার ভাল্লুকের খেলা দেখে আর তোমার অদ্ভুত বাজনা শুনে মাননীয় মেয়র অত্যন্ত খুশি হয়েছেন।’

আমি মেয়রকে উদ্দেশ্য করে মাথা নোয়ালুম।

 পার্শ্বচর আবার বলল, ‘মাননীয় মেয়র মনে করেন, এখানে যতরকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, তার মধ্যে তোমার খেলাই সব-সেরা।’

আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে আবার মাথা নিচু করলুম। আবার হাততালি।

‘তাই মাননীয় মেয়র তোমার এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তোমাকে একটি উপহার দিতে চান।’

 উত্তেজনায় আমার সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। দেখতে পেলুম মেয়রসাহেব

আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। তেমনি গম্ভীর তিনি। তেমনি চুপচাপ।

আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। এখন তিনি আমাকে দেখে একটু মুচকি হাসলেন। তারপর আমার কাঁধে হাত রাখলেন। কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ‘শাবাশ।’ বলে তিনি পকেটে হাত পুরলেন। একটি সোনার মেডেল বার করে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন।

এতক্ষণ থমথম করছিল চারিদিক। সবার মুখে কী-হয় কী-হয় ভাব। কিন্তু যে-মুহূর্তে আমার গলায় মেডেল ঝিকমিকিয়ে উঠল, সকলের মুখে সে কী খুশির হল্লা। আমি হাঁটু গেড়ে বসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানালুম। তিনি আমায় দু-হাত দিয়ে তুলে নিলেন। তারপর আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘এমনি করে সবাইকে আনন্দ দাও।’ বলে তিনি যেমন করে এসেছিলেন, তেমনি করে চলে গেলেন। আমি হতবাক।

আমার খেলার চারিপাশে যত লোক জমায়েত হয়েছিল, তারা সবাই চিৎকার করে আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। আমি হাত তুলে সে-অভিনন্দন গ্রহণ করছি। হঠাৎ দেখি, জুতসু। কোথায় ছিল? ওই অত লোকের ভিড় ঠেলে, একেবারে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সে কী আনন্দ তার! যেন তারই কেউ আপনজন এই সোনার মেডেল জয় করেছে। আমি তাকে দেখে, এত আনন্দেও শিউরে উঠলুম। এই বুঝি তার দিদি এসে পড়ে। এই বুঝি লাগিয়ে দেয় চেঁচামেচি। রক্ষে, তার দিদি এল না।

 আমি এবার জোরোকে নিয়ে প্রায় লাফাতে-লাফাতে তাঁবুর দিকে ছুটলুম। এখন আনাতিদাদা একা আছে তাঁবুতে। দেখে এসেছি তার শরীরটা আজ আরও খারাপ। কী খুশিই-না হবে আনাতিদাদা। আমার এ-জয় তো তারই জয়। তাঁবুতে ফিরেই ওই সোনার মেডেল তারই গলায় আমি পরিয়ে দেব। তারপর আনাতিদাদার বুকের ওপর মাথা রেখে বলব, ‘আজ আমি জিতেছি আনাতিদাদা, আমি জিতেছি।’

কিন্তু বলতে পারলুম না। কেননা, তাঁবুতে ফিরে দেখি, আনাতিদাদা নেই! প্রথমটা ভেবেছিলুম, বুঝিবা আনাতিদাদা এদিক-ওদিক কোথাও আছে। কিন্তু আশ্চর্য, কোথাও নেই! সবদিক আতিপাতি করে খুঁজেও যখন পেলুম না তখন ডাক দিলুম, ‘আনাতিদাদা, আনাতিদাদা।’ সাড়া পেলুম না। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠলুম। তবে কি আনাতিদাদা চলে গেল। হঠাৎই আনাতিদাদার ম্যাজিকের ব্যাগটা আমার নজরে পড়ে গেল। কিন্তু ওটা কী! রিভলভারটা বাইরে কেন! হাতে তুলে নিলুম। এ কী! রিভলভারটার সঙ্গে একটা চিঠি! চিঠিতে লেখা :

প্রিয় ইসতাসি,
আমি চলে যাচ্ছি। আমার মৃত্যুর দিন যখন এগিয়ে আসছে, তখন তোমাকে কষ্ট দিতে আমি খুবই ব্যথা পাচ্ছি। আমার মৃত্যুর আগে এই যে তোমার সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা হল, এই যে তোমাকে শেষবারের মতো দেখতে পেলুম এই তো আমার জয়। আমার ব্যাগ-ভরতি ম্যাজিক আর রিভলভারটা দিয়ে গেলুম।
রিভলভারে একটাই গুলি আছে। পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করার আগে ওটা মাটির তলায় পুঁতে লুকিয়ে রেখেছিলুম। তোমার কাছেই থাক। বলা যায় না, কোনোদিন কাজে লেগে যেতে পারে। সুখী হও। ইতি
–আনাতিদাদা

চিঠিটা পড়া শেষ করে থমকে গেলুম। মনে হল, এই মুহূর্তে পৃথিবীটা যেন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমার চোখ ফেটে কান্নাও এল না, মুখ ফুটে কথাও বেরুল না। আমি নির্বাক। বসে পড়লুম। মুখখানাকে লুকিয়ে ফেললুম দুই হাঁটুর ফাঁকে। তারপর ফুঁপিয়ে উঠলাম।

আমি জানি না এমনি করে কতক্ষণ বসেছিলুম। দেখিনি জোরো কখন নিঃসাড়ে আমার পাশে এসে বসেছে। হয়তো আমার মতো সে-ও দুঃখ পেয়েছে। তাই আমার মতো সেও এখন নিশ্চুপ, নির্বাক।

এমনই সময়ে হঠাৎ একটা শোরগোল শুনে আমার চমক ভাঙল। দেখলুম, সেই মেয়েটি একেবারে মারমুখী হয়ে আমার তাঁবুর ভেতর ঢুকে পড়েছে। দেখি, তার পেছনে আরও অনেকজন। দেখে চিনতে কষ্ট হল না, এরা সবাই কারনিভলে এসেছে খেলা দেখাতে। আমি অবাক চোখে তাদের মুখের দিকে চাইলুম। আমায় কোনো কথা বলতে দিল না তারা। আচমকা চিৎকার করে তাণ্ডব শুরু করে দিল তাঁবুর ভেতরে। আমাকে জাপটে ধরল আচম্বিতে। এমন অবস্থার জন্যে আমি একেবারেই তৈরি ছিলুম না।

 আমার পাশেই জোরো। আমি জানি জোরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে আর রক্ষে নেই। তাই আমি চিৎকার করে উঠলুম, ‘আমায় ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও।’

কে শুনছে! আমি ধস্তাধস্তি করে কোনোরকমে এদের হাত ছাড়িয়ে জোরোকে জড়িয়ে ধরলুম। জড়িয়ে ধরে আবার চেঁচালুম, ‘তোমরা থামো। এক্ষুনি আমার তাঁবু থেকে বেরিয়ে যাও! জোরো খেপলে তোমাদের একজনও প্রাণে বাঁচবে না!’

কিন্তু তারা শুনল না। হিংসায় উন্মাদ হয়ে তারা আমায় শেষ করে ফেলতে চায়। তারা আমার সবকিছু লুঠ করছে। তাঁবু তছনছ করে দিচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, রাগে ফুলছে জোরো।

তারা আমার জিনিসপত্তর ভাঙচুর করছে।

জোরোও ফুঁসছে।

তারা আমার তাঁবুটা টান মেরে ছিঁড়ে ফেলছে।

 জোরো আমার হাত ছাড়াবার জন্যে আমায় ধাক্কা দিল।

দেখতে পেলুম সেই মেয়েটা চোখের পলকে আমার ব্যানডুররিয়া নিয়ে পালাচ্ছে।

জোরো দেখতে পেয়েছে। আমাকে সে ঝটকা মারল। আমি পড়ে গেলুম। পারলুম না তাকে ধরে রাখতে। আমি ধমকে উঠলুম, ‘জোরো।’

ততক্ষণে জোরো বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। আমি ছুটে এসে লাফিয়ে পড়লুম জোরোর ঘাড়ের ওপর। জোরোর সঙ্গে আমার ধস্তাধস্তি লেগে গেল! তাই দেখে যে-যেদিকে পারল মারল ছুট! কিন্তু জোরোর অন্য দিকে লক্ষ নেই। লক্ষ্য ওই মেয়েটা!

আমি আর জোরোর সঙ্গে কতক্ষণ ধস্তাধস্তি করতে পারি! জোরো শেষে আমারই ওপর খেপে উঠল। আমাকেই বুঝি আক্রমণ করে! আমি ছিটকে গেলুম। সেই তকে জোরো ছুটল ওই মেয়েটাকে ধরবার জন্যে।

আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলুম। আমি জানি, জোরো এক্ষুনি এক ভয়ংকর কাণ্ড করে বসবে। আমি জোরোর পেছনে ছুটলুম। আমার হাতে আনাতিদাদার রিভলভার। এই ক্ষিপ্ত বন্য-জন্তুটাকে শায়েস্তা করতে এখন এই রিভলভার ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমি যদি এখনই ওকে রুখতে না পারি, তবে মেয়েটার নির্ঘাত মরণ।

আমি ছুটতে-ছুটতে দেখতে পেলুম, জোরো প্রায় ধরে ফেলেছে মেয়েটাকে। ভয়ে পিছু ফিরে চিৎকার করে উঠল মেয়েটা, ‘বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও।’

আর দেরি করা যায় না। আমাকে এখনই রিভলভার ছুঁড়তে হয়। এই ক্ষিপ্ত একটা বন্য-জন্তুর হাত থেকে একটি অসহায় মেয়েকে যদি রক্ষা করতে না পারি, তবে এ-রিভলভারের মূল্য কী! আমি রিভলভার তাক করলুম। আমি আমার প্রিয় বন্ধুকে ধমক দিয়ে শেষবারের মতো চিৎকার করে ডাক দিলুম, ‘জোরো–’

বোধ হয় জোরো একটু থতমত খেয়ে গেছল। হয়তো চকিতে সে একবার আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছিল। ঠিক এই ফাঁকে, মেয়েটি আশ্চর্য কৌশলে জোরোকে এড়িয়ে আমারই দিকে ছুটে এল। আর্তনাদ করছে সে। আমাকে আচমকা জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাঁচাও!’ আমাকে এমনভাবে সে জাপটে ধরল যে, আমি টাল সামলাতে পারলুম না। আমার আঙুলের চাপ লেগে রিভলভারের গুলি ছুটল এলোমেলো। নিশানা ফসকে গুলি জোরোর গায়ে না-লেগে হাওয়ায় উড়ে গেল।

গুলির শব্দে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল জোরো। সে বুঝতে পেরেছে, আমি তাকে মারতে চাই। তাই সে লাফিয়ে পিছু ফিরে আমাকেই আক্রমণ করল। আমি ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে মেয়েটিকে বললুম, ‘পালাও! মেয়েটি পালাল।

জোরো আমাকে আক্রমণ করল তার সামনের পায়ের থাবা দিয়ে। আমি সে-আঘাত সহ্য করতে পারলুম না। এত তীব্র সে-আঘাত যে, আমি মুখ থুবড়ে ক-হাত দূরে ছিটকে পড়লুম। বুঝতে পারছি, মাথায় লাগল। অসহ্য যন্ত্রণা। আমার বুকের ভেতরটা এত হাঁপিয়ে উঠল যে, আমি নিশ্বাসটাকে কিছুতেই সামলাতে পারলুম না। অসহায়ের মতো সেই রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগলুম।

অনেকক্ষণ পর যখন আমার ঘোর কাটল, তখনও আমার ওঠার ক্ষমতা নেই। শুয়ে-শুয়েই অতি কষ্টে এ পাশ ওপাশ করছি। এ-দিক ওদিক দেখছি। হঠাৎ বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। দেখি, জোরো! একটু দূরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই সে যেন একটু চনমন করে উঠল। তখনকার সেই হিংস্র চোখ দুটো তার এখন মনে হচ্ছে কত শান্ত! বুঝি বা বন্ধুকে অমন আঘাত করে এখন অপরাধীর মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে!

একটু পরেই আমি উঠে বসতে পারলুম। আর-একটু পরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে পারলুম। হাঁটতে-হাঁটতে তাঁবুতে ফিরে এলুম। আমার এই ছোট্ট তাঁবুটা এখন কেবলই একটা ধবংসস্তূপ। সেই ধবংসস্তূপের মধ্যেই আবার শুয়ে পড়লুম।

এখন কী করব আমি! কাল এখান থেকে আমায় চলে যেতেই হবে। হয়তো কাল একটু সুস্থ হয়ে উঠব। কিন্তু কোথায় যাব আমি এই শূন্য হাতে? শূন্যই তো! আমার যে আপন বলতে আর কেউ রইল না। অমন যে জোরো, যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন আমার, সেই স্বপ্নও আজ ভেঙে গেল। আমার প্রিয় আর সবসেরা বন্ধু ব্যানডুররিয়া, সেটাও কেড়ে নিয়ে গেল ওরা! কেন এত হিংসা ওই একটা ছোট্ট বাজনার ওপর! আমার বাজনা তো শুধু সুরে-সুরে ছড়িয়ে দিয়েছে আনন্দ। ক্ষতি তো কারো করেনি। তবে কেন এত রাগ!

আমি ঘুমিয়ে পড়লুম।

ভেবেছিলুম, খুব সকাল-সকাল উঠব। পারিনি। ঘুমিয়েই ছিলুম। হঠাৎ একটা গরম নিশ্বাসের উত্তাপ আমার পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। ঘুম ভেঙে গেল। চমকে চেয়ে দেখি, জোরো। মনে হয় সারারাত জেগেই বসেছিল আমার পাশে। আমি উঠে পড়লুম। বাইরে রোদ। এবার যেতে হবে। যেতে হবে আমায় এক দেশ থেকে আর-এক দেশে। এ-জগৎ থেকে আর-এক অজানা জগতে। পড়ে রইল আমার ছেঁড়া টুকরো তাঁবু। পড়ে রইল তাঁবুর ভেতর ভাঙাচোরা আমার শখের জিনিসগুলি। ওগুলির দিকে চেয়ে দেখতে আমার মন চাইছিল না। চোখ ফেরালুম জোরোর দিকে। দেখতে কষ্ট লাগছিল। কেননা, ওর কাছ থেকে এবার আমায় বিদায় নিতে হবে। এগিয়ে গেলুম তার কাছে। তার মুখের দিকে চেয়ে থাকলুম কিছুক্ষণ। তার পিঠে হাত রাখলুম। কাঁপছে সে। তার গলাটা দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললুম, ‘আমায় তুই মেরেছিস বলে মনে করিস না যেন, আমি তোর ওপর রাগ করেছি জোররা! তোর আবার দোষ কোথায়? আমিই তো রিভলভারের গুলি ছুঁড়ে তোকে মারতে চেয়েছিলুম। আমিই তো অপরাধী। এই জঘন্য কাজের জন্যে আমি যে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছি না জোরো! আমার বারবার মন বলছে, আমি বিশ্বাসঘাতক! আমার বিপদের দিনে তোর মতো বন্ধু পেয়েছিলুম বলে, আজও আমি বেঁচে আছি। সেই বন্ধুকে গুলি মারতে যার হাত ওঠে, সে বিশ্বাসঘাতক বিশ্বাসঘাতককে আর বিশ্বাস নয়। তুই বনে ফিরে যা জোরো। খোলা আকাশের নীচে সেই তোর ঘর। সেইখানেই তোর সুখ। তোর আনন্দ। সেখানে আর যাই থাক, বিশ্বাসঘাতক নেই।’ বলতে-বলতে কেমন যেন ভার হয়ে আসছিল আমার গলার স্বর। না আমার ভেঙে পড়লে চলবে না। আমি বুক ফুলিয়ে উঠে দাঁড়ালুম। জোরোর দিকে আর ফিরে তাকালুম না। আমার শূন্য হাতের মুঠি দুটো শক্ত করে চেপে ধরে পা ফেললুম।

ইসতাসি’।

আমি থতমত খেয়ে গেছি। হঠাৎ এ-সময়ে কে ডাকল? সামনে চমকে চেয়ে দেখি, এ যে সেই মেয়েটি! দেখি, তার হাতে আমার ব্যানডুররিয়া। তার চোখদুটিতে যেন অনেক দুঃখের কালোছায়া জড়িয়ে আছে।

মেয়েটি ব্যানডুররিয়াটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরা-গলায় বলল, ইসতাসি, তোমার ব্যানডুররিয়া!’।

আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালুম। দেখলুম, তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তার ছোট্ট ভাই জুতসু। মুখখানা তার থমথম করছে।

মেয়েটি বলল, ‘কিছু মনে কোরো না ইসতাসি। আমি তোমাকে বুঝতে পারিনি।’

ক্ষণেক চেয়ে, হাত বাড়ালুম। ব্যানডুররিয়াটা হাতে নিলুম। বললুম, ‘অনেক কষ্ট দিলুম। চলি। পথে নামলুম।

ইসতাসি!’ সে আবার ডাকল।

 আমি থামলুম

সে বলল, ‘তুমি যদি না যাও ইসতাসি?’

আমি বললুম, ‘আমি যাযাবর।

মেয়েটি আমার হাতদুটি জড়িয়ে ধরল। তার মুখখানি কান্নায় ভরে গেছে।

আমি বললুম, ‘বোন, আমায় যেতে দাও! হয়তো আবার দেখা হবে।’

ওর হাতদুটি আলতো সরে গেল আমার হাত থেকে। আমি এগিয়ে গেলুম জুতসুর কাছে। দু-ফোঁটা চোখের জল ওর গালের ওপর দিয়ে ভেসে গেছে। আমি ওর চিবুকটি ধরে ওর চোখের ফোঁটাদুটি মুছে দিলুম। সে-কান্নার জল আমার হাতে ছড়িয়ে রইল। কথা বলতে পারল না জুতসু। হাতটা বাড়িয়ে দিল। তার হাতে একটা খেলনা-গাড়ি। আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী?’

‘তোমার।’ বলে সে আমায় জড়িয়ে ধরল। তারপর আবার ফুঁপিয়ে উঠল।

বোধ হয় এই খেলনা-গাড়ি কারনিভল থেকে কিনেছে সে, নিজে খেলবে বলে। আমি হাতে নিলুম। আমার সব গেছে। মনে-মনে ভাবলুম, একদিন স্বপ্ন দেখেছিলুম, একটা গাড়ি কিনব আমি। ঘোড়ায় টানা গাড়ি। সেই গাড়ি চেপে এক দেশ থেকে আর-এক দেশে যাব। দেশে-দেশে ব্যানডুররিয়া বাজিয়ে গান গাইব, জোরোর খেলা দেখাব। কিন্তু সে-স্বপ্ন আমার মিথ্যে। সত্যি যেন এই খেলনা-গাড়ি। এ-গাড়ি কত সুন্দর! এ যে একটি ছোট্ট ছেলে, জুতসুর, ভালোবাসায় ভরা! তাই এই খেলনা-গাড়িটা আমার ছেঁড়াখোঁড়া জামার পকেটে পুরে ফেললুম। তারপর ব্যানডুররিয়ার তারে সুর তুললুম। গেয়ে উঠলুম আমার হারিয়ে-যাওয়া বন্ধু ওতিয়ারই গাওয়া সেই গানটি :

আমি তো কখনো দিইনিকো ব্যথা
একটিও কোনো প্রাণীকে,
অনেক দুঃখ পেয়েও তো আমি
বন্ধু আমার জানি কে!
তারপর হাঁটা দিলুম।

অনেকক্ষণ পর, যখন ক্লান্ত পা-দুটো অবশ হয়ে আসছিল, মনে হচ্ছিল, পথের পাশে ওই গাছের নীচে বসি একটু, তখন আমি পিছু ফিরেছিলুম একটিবার। অনেক দূরে পিছনের হাঁটা-পথে চোখ পড়তেই আমি চমকে উঠেছিলুম। এ কী! জোরো সে আসছে ক্লান্ত পায়ে একা-একা। আমি দাঁড়ালুম। সে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। তারপর হঠাই সে দু-পা ওপরে তুলে আমায় জড়িয়ে ধরল। যেন সে বলতে চাইল, ‘তোমাকে একা-একা আমি কোথাও যেতে দেব না। তুমি যেখানে যাবে, সেখানেই আমি যাব। আমাকে মারতে চাও মারো। তবু জেনো, আমি তোমার বন্ধু।’

আনন্দে চোখে জল এসে গেল আমার। ওর মুখখানা দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে আমার মুখের সামনে তুলে ধরলুম। চেয়ে রইলুম কিছুক্ষণ। তারপর অস্ফুট গলায় বলে উঠলুম, বন্ধু।’ তারপর দুজনে ওই সবুজ গাছের আড়ালে হারিয়ে গেলুম।