খুদে যাযাবর ইসতাসি – শৈলেন ঘোষ
আমি ইসতাসি।
ইসতাসি আমার নাম। এমন নাম তো তোমরা কোনোদিন শোনোনি! সুতরাং ভাবতে পারো, ছেলেটার এ কী অদ্ভুত নাম রে বাবা! অবিশ্যি আমার নামটা তোমার কানে অদ্ভুত ঠেকলেও, আমাকে দেখলে যে তোমার খুব খারাপ লাগবে, তা বলতে পারি না। কেননা, আমার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা এই যে লাল-নীল ডোরাকাটা প্যান্টটা দেখছ, গায়ে রঙিন ফুল-হাতা, ফুল-কাটা জামাটা দেখছ, তার ওপর এই যে দেখছ, জরির-কাজ-করা জ্যাকেটটা, বলো, এ দেখে আমাকে তোমার ভালো লাগছে না? তবুও তো টুপিটা মাথায় দিইনি। অবিশ্যি আমি দেখতেই-বা কম কী! বলতে পারো, আমার তো এখন বয়স তেমন হয়নি। সবে দশ পেরিয়ে এগারোয় পড়েছি। সুতরাং অমন রংচঙে সাজ-পোশাক পরলে এই বয়সে বাঁদরকেও দেখতে ভালো লাগে!
ছিঃ! ছিঃ! তা বলে আমায় বাঁদর বোলো না! আমি ইসতাসি। আমি এক যাযাবরের ছেলে।
আমি জানি না, যাযাবর বললে তোমরা আমায় ঠিক চিনতে পারবে কি না! শুধু জেনো আমাদের কোনো ঠিক নেই, ঠিকানা নেই। তোমাদের মতো আমাদের না আছে মস্ত-মস্ত বাড়ি, না আছে দামি-দামি আসবাব। পথেই আমাদের ঘর। এই পথে-পথেই আমরা দলবেঁধে ঘুরে বেড়াই। যাই এক দেশ থেকে আর-এক দেশে। ক-দিনের জন্যে মাঠে-ঘাটে তাঁবু ফেলি। তারপর সময় হলেই আবার আর-এক দেশে পাড়ি দিই। বেশ লাগে। আমরা শুধু দেখে বেড়াই। নতুন-নতুন দেশে কত নতুন মানুষ, কত নতুন মুখ। কত নতুন কথা।
প্রথমেই বলে রাখি, আমার মা-বাবা কেউ নেই। কী করে যে আমি আমার মাকে, বাবাকে হারিয়েছি, সে কথা বলতে গেলে এখনও আমার বুক কেঁপে ওঠে। তাদের কথা ভাবতে-ভাবতে আমি মাঝে-মাঝে নিজেকেও কেমন হারিয়ে ফেলি! এখনও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে তাদের। মায়ের মুখখানি এখনও আমার চোখের ওপর স্পষ্ট ভেসে ওঠে। আঃ! কী সুন্দর দেখতে ছিল আমার মাকে! কী মিষ্টি গান গাইত আমার মা। আমার বেশ মনে পড়ে, মা পরত রঙিন ঘাঘরা। মায়ের পায়ে ছিল রুপোর মল। গলায় মোহর-আঁটা মালা। আর কানে ছিল এত্তো বড়ো দুটো চাঁদির রিং। সেজেগুজে মা যখন সন্ধ্যারাতে চাঁদের আলোয় গান গাইত, কী ভালোই না লাগত। আর আমার বাবা? একটা ঢিলেঢালা প্যান্ট পরে, রঙিন ডোরাকাটা জামা গায়ে দিয়ে, মাথায় টুপি এঁটে মায়ের গানের সঙ্গে ব্যানডুররিয়া বাজাত। জ্যোৎস্নারাতে দলের সবাই যখন কাজের শেষে আমাদের তাঁবু-ঘেরা সবুজমাঠে জমায়েত হয়ে আনন্দ করত, সেই আনন্দে মাকেও গান গাইতে হত। আমি হলপ করে বলতে পারি, সে-গান শুনলে আমার মতো তোমরাও অবাক হয়ে যেতে।
ব্যানডুররিয়া বাজনাটা তোমরা কেউ দেখেছ কি না জানি না। এটা একটা তারের বাজনা। অনেকটা ম্যান্ডোলিনের মতো দেখতে। তবে, ম্যান্ডোলিনের পেটটা নাশপাতির মতো গোল। এটার পেট চ্যাপা। গলায় ঝুলিয়ে আঙুল ছুঁয়ে এর তারে সুর তুললে আমি হলপ করে বলতে পারি, তোমার পা-দুটি আপনা-আপনি নেচে উঠবে।
আমার বাবা যেমন ব্যানডুররিয়া বাজাতে পারত, তেমনি জানত মজার জাগলিং-এর খেলা। একসঙ্গে কুড়িটা বড়ো-বড়ো কাঠের বল আকাশে ছুঁড়ে এমন চরকি খাওয়াত যে, দেখলে তুমি হাঁ হয়ে যেতে! বাবার হাতের কায়দায় শূন্যে ঘুরতে-ঘুরতে ওই কাঠের বলগুলোকে কখনো মনে হত একটা মস্ত মালা। কখনো মনে হত একটা এত্তো বড়ো লাটু বাঁই-বাঁই করে ঘুরছে। আবার কখনো মনে হত যেন আকাশ-মুখো একটা রকেট হুস-হুঁস করে উড়ে যাচ্ছে। শুধু কাঠের বল কেন! লোহার চাকতি, না-হয় তারের রিং, এমনকী কাঠের ছোট্ট-ছোট্ট রংচঙে টুল নিয়েও বেমালুম শূন্যে ছুঁড়ে নানান খেলা দেখাতে পারত আমার বাবা।
একটু-আধটু ম্যাজিকও জানত বাবা। তবে আনাতিদাদার মতো অমন নয়। আনাতিদাদা ম্যাজিক দেখাতে দেখাতে ‘ফুস’ বলেই চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারত। উঃ! সে কী তাজ্জব ব্যাপার! তুমি এখানে খোঁজো, আর যেখানেই খোঁজো, খুঁজে আর পেতে হচ্ছে না। আমি তো প্রথম দিন খেলাটা দেখে একেবারে থ। এই খেলাটা দেখালে অনেক পয়সাও পেত আনাতিদাদা।
সে তো বটেই! পয়সা তো পেতেই হবে। নইলে চলবে কেমন করে! আমরা তো যাযাবর। আমাদের এমনি করেই দিন চলে। এমনি নাচ দেখিয়ে, গান শুনিয়ে, খেলা দেখিয়ে, আর নয়তো ঘরে-হাটে সাত সতেরো জিনিস বিক্রি করে।
তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ, আনাতিদাদা কে? আনাতিদাদা আমাদের দলের সর্দার। আমাকে খুব, খুউব ভালোবাসত। ভারি শক্ত-সমর্থ মানুষ ছিল আনাতিদাদা। এত্তোখানি চওড়া বুক। বুকভরতি সাহস। হাতের আঙুলগুলো এমনি পুরুষ্টু! একখানি ঘুসি মারলে আর দেখতে হবে না! প্রাণ নিয়ে টানাটানি। অবিশ্যি কম বেশি আমাদের সকলেই সাহসী। হতেই হয়। কেননা, যাদের পথে-পথেই শুধু হাঁটতে হয়, জানে না, আজকের হাঁটা-পথ কালকে কোথায় গিয়ে থামবে, তাদের জীবনে পদে-পদে বিপদ যে! এই সাহস আর শক্তি দিয়েই তো সে-বিপদ রুখতে হয়!
এই ছোট্ট বয়েসেই, বাবার হাতে ওই ব্যানডুররিয়াটা বাজাতে দেখলেই, আমারও হাত নিশপিশ করত। মনে হত, আমিও যদি বাবার মতো ব্যানডুররিয়া বাজাতে পারতুম। ছেলেমানুষি বুদ্ধি তো! তবু, বাবাকে ফাঁকি দিয়ে, মাঝে-মাঝেই ওই ব্যানডুররিয়ার তারগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে টুং-টুং টান দিতে ছাড়িনি। বাজনা হত না। কিন্তু হাতের টানে বেসুরো যে-শব্দগুলো বাজনা হয়ে কানে বাজত, তাতেই ভারি মজা লাগত আমার। আর মজা লাগত বলে, সুযোগ পেলেই তার ধরে টান দিতুম। একদিন এমনি করে টান দিতে গিয়ে বেমক্কা একটা তার টং করে ছিঁড়ে ছিটকে গেল। বুঝতেই পারছ, তখন আমার কী অবস্থা! বাবার বকুনির ভয়ে আমি একেবারে জুজু! আমার যদি ছেঁড়া তার জোড়া দেওয়ার সাধ্যি থাকত, তাহলে তো কোনো কথাই ছিল না। বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কাজটি সেরে চুপচাপ বসে থাকতুম। বাজাতে-বাজাতে বাবাকেও দেখেছি কখনো-সখনো তার ছিঁড়ে ফেলতে। আবার দেখেছি, কত সহজেই তার জোড়া দিয়ে বাজনায় নতুন করে সুর জুড়েছে বাবা। সে যেন বাবার কাছে কিছুই নয়।
তোমাদের আগেই বলেছি, আনাতিদাদার কথা। সুতরাং এখন বাবার বকুনির হাত থেকে আমায় বাঁচতে হলে, আনাতিদাদার হাতে নিজেকে ধরা দিতে হয়। তাই আমি ছুটলুম আনাতিদাদার তাঁবুতে। আমরা যে মাঠে এখন তাঁবু ফেলেছি, ঠিক তার সামনেই আনাতিদাদার তাঁবু। একছুটে তাঁবুতে ঢুকতেই দেখি, আনাতিদাদা তামুক খাচ্ছে। ঠিক এই সময়ে, হঠাৎ তার তাঁবুতে আমাকে ঢুকতে দেখে আনাতিদাদার চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে প্রায় চিৎকার করেই আমার নাম ধরে ডাক দিল, ইসতাসি! ডাক দিয়েই একবুক হাসি ছড়িয়ে আমাকে অভ্যর্থনা করল। আমাকে দেখে কী যে খুশি, সে তোমাকে কী বলব! আমার কিন্তু হাসি পেল না। আমার মুখখানা শুকনো দেখে, তার অবাক হওয়ারই তো কথা! হাসতে হাসতে থমকে গিয়ে কেমন সন্দেহের চোখে চাইল আমার দিকে। আমি ছুটে গেলুম আনাতিদাদার কাছে। আনাতিদাদা আমাকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। তার বুকের মধ্যে মুখটা লুকিয়ে হাঁপাতে লাগলুম।
অবাক হয়েই আনাতিদাদা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, ইসতাসি?’
আমি ফুঁপিয়ে উঠলুম। ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে বললুম, ‘বাজনা!’
আনাতিদাদা আমার এমন উত্তর শুনে আরও অবাক হল। জিজ্ঞেস করল, ‘বাজনা? কীসের বাজনা? কার বাজনা?’
‘বাবার। ব্যানডুররিয়া।’
কী হয়েছে?’ আনাতিদাদার গলায় আরও অবাকের সুর।
বাজাতে গিয়ে তার ছিঁড়ে ফেলেছি!’
আর কোনো কথা নয়। সঙ্গে-সঙ্গে একেবারে হো-হো করে হেসে উঠেছে আনাতিদাদা। আমি আনাতিদাদাকে হাসতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। আনাতিদাদার বুকের ভেতর থেকে মুখটা সরিয়ে এনে তার চোখের সামনে তুলে ধরলুম। আনাতিদাদা আমার মুখখানা দেখে আরও জোরে হেসে উঠেছে। হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে ছ্যাঃ ছ্যাঃ! এর জন্যে ইসতাসি ভয় পায়।
আমি নিজের ভয়টাকে তবুও নিজের মধ্যে লুকোতে পারলুম না? আমার চোখদুটো ভয়ে কাঠ হয়েই,আনাতিদাদার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। আনাতিদাদা আমার মাথায় একটা ছোট্ট ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি, ব্যানডুররিয়াটা বাজাতে ইচ্ছে যায় বুঝি?’
আমি বললুম, ‘হ্যাঁ বাবার মতন।’
‘আমি শিখিয়ে দেব।’
এতক্ষণ আমার যে-মুখখানা ভয়ে কালো হয়ে ছিল, হঠাৎ সে-মুখে আলো ঝলসে উঠল। আনাতিদাদার এ-কথাটা আমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছি না। তাই তার হাত দুটো ধরে প্রায় লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলুম, ‘সত্যি?’
আনাতিদাদা বলল, ‘নিশ্চয়ই!
‘আমি পারব?’
‘আলবাত!’
আনন্দে আমি আরও লাফিয়ে উঠলুম, মাটি থেকে আকাশে।
কিন্তু তারপর হঠাৎ-ই আবার ব্যানডুররিয়ার তার ঘেঁড়ার কথাটা মনে পড়তেই আনন্দটা কেমন যেন চুপসে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘বাবার ব্যানডুররিয়াটার কী হবে?’
আনাতিদাদা বলল, ‘ওটার জন্যে ভাবনা নেই। ওটা বাবাই ঠিক করে নেবে। আমি বলে দেব। কিন্তু এক শর্তে! আমি যে তোমাকে ব্যানডুররিয়া বাজাতে শেখাব, এ-কথাটা এখন কাউকে বলতে পারবে না।
‘কেন?’
‘একদিন হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দেব।’
কথাটা শুনে আমার খুব ভালো লাগল। হ্যাঁ, সত্যিই তো! হঠাৎ একদিন আমি যদি ব্যানডুররিয়া শুনিয়ে বাবাকে অবাক করে দিতে পারি, বলো, সেদিন কী দারুণ মজা হবে!
আনাতিদাদাও যে ব্যানডুররিয়া বাজাতে পারে, এ-কথাটা তোমাদের বলতে একদম ভুলে গেছি। অবিশ্যি ম্যাজিক-খেলা দেখাতে আনাতিদাদার যতটা উৎসাহ দেখতে পাবে, ব্যানডুররিয়ার বেলায় তা নয়। একেবারেই বাজায় না যে তা নয়। তবে কালেভদ্রে। তাই বলে যেন মনে কোরো না, তেমন বাজাতে পারে না! বাববা! দারুণ ওস্তাদ! কী ম্যাজিক, কী ব্যানডুররিয়ায়।
আমার বেশ মনে আছে, একদিন সন্ধেবেলায়, মাঠের জমায়েতে বাবার সঙ্গে ব্যানডুররিয়ার এমন লড়াই শুরু করে দিল যে, তাই শুনে তো সবাই একেবারে থ! এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়! কেউ ছাড়বার পাত্তর নয়! যখন বাজনা শেষ হল, আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম! কে হারল, আর কে যে জিতল কেউ ই বলতে পারল না। সেই রাতটা আমার আরও স্পষ্ট মনে আছে এই জন্যে যে, দুজনের কাউকেই আমি হারতে দিতে রাজি ছিলুম না। কেউ একজন হারলেই আমি সাংঘাতিক দুঃখ পেতুম। কারণ, দুজনেই যে আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।
যাক বাবা! ব্যানডুররিয়ার তার-ঘেঁড়ার ব্যাপারটা নিয়ে বাবা আমায় কিছু বলেনি। বাবা যখন শুনল, উলটে বলল কী, ‘ছিড়ক, ছিড়ক। বাজাতে গেলে তো ছিঁড়বেই। এমনি ছিঁড়তে-ছিঁড়তে একদিন ইসতাসি ওস্তাদ হয়ে উঠবে। হবে একজন পাকা ব্যানডুররিয়া-বাজিয়ে!’ এ-কথা শুনে, সেদিন যে আমার কী আনন্দ হয়েছিল, সে কী বলব তোমাদের!
.
হ্যাঁ, এখন আমি সত্যিই ব্যানডুররিয়া-বাজিয়ে হয়ে উঠেছি। তবে, এখনও ঠিক পাকা হইনি। আনাতিদাদা গোপনে-গোপনে তালিম দিয়ে, মোটামুটি অনেকটা বাজাতে শিখিয়ে দিয়েছে। প্রথম-প্রথম এত গোলমেলে লাগত! তেমনি অসুবিধা। হবেই তো। আমি যে ছোট্ট। বাজনাটাকে বাগে আনতেই কদিন কেটে গেল। তারপর ধীরে ধীরে যখন সড়গড় হয়ে গেল, তখন সা-রে-গা-মা ছাড়িয়ে গানের বাজনাও বাজাতে শিখে গেলুম। আর সত্যিই, এমন লুকিয়ে-ছাপিয়ে শিখলুম যে, কেউ ঘুণাক্ষরে জানতেও পারল না। এমনকী, বাবা, মা কেউ না। আমি বলতে পারি, আনাতিদাদা সত্যিই এক আশ্চর্য মানুষ! নইলে, আমার মতো এক আনাড়িকে এত সহজে এমন সুন্দর ব্যানডুররিয়া বাজাতে শিখিয়ে দিতে পারে! নিজের কথা ভেবে, আমার নিজেরই কেমন অবাক লাগে!
কিন্তু তার চেয়েও আশ্চর্য কথা, আমার এই ব্যানডুররিয়া শেখা নিয়ে আনাতিদাদার মনের ভেতর যে মতলবটা লুকিয়ে ছিল, সেইটা। সে-মতলবটা কিন্তু কাকপক্ষীও টের পেল না। এমনকী, আমিও না। তোমাদের তো আগেই বলেছি, যাযাবর বলে এক জায়গায় বেশি দিন থাকি না। এক দেশ থেকে আর-এক দেশ এরই মধ্যে কতবার হয়ে গেল। আর এই দেশে-দেশে ঘুরে-ঘুরে আমারও গোপনে-গোপনে বাজনা শেখা চলল। আনাতিদাদা আদা-জল খেয়ে এমন করে আমায় নিয়ে পড়েছে যেন ওস্তাদ না-করে কিছুতেই ছাড়বে না।
এমনি করে আমার বাজনা শেখা চলছে। আনাতিদাদা এরই মধ্যে ম্যাজিক-খেলা দেখিয়ে পয়সা রোজগার করে আনছে। মায়ের গান, বাবার মজার-মজার হাতের খেলা–সবই চলছে ঠিক-ঠিক। যে-দেশেই যাই সে দেশের সবার চোখেই আমরা যেন আশ্চর্য মানুষ। যারা এক জায়গায় থাকতে জানে না, কোনো দেশে পাকাঁপোক্ত ঘর বেঁধে বাস করে না, আজকের পথ কালকে কোথায় থামবে–সে নিয়ে ভাবনা করে না, তাদের তো আশ্চর্য লাগবেই!
তবু একটা কথা এই ফাঁকে না বলে পারছি না। কী জানি কেন, কেউ আমাদের বিশ্বাসও করে না। হয়তো আমাদের দেশ নেই বলে, দেশে-দেশে ঘর-বেঁধে পাকাপাকি বাস করি না বলে, সবাই কেমন যেন সন্দেহের চোখে দেখে আমাদের। কেউ বলে, আমরা লুঠেরা! কেউ বলে, তস্কর! আমাদের পেটে-পেটে শয়তানি বুদ্ধি! আমরা মানুষ ঠকাই! এক দেশের গোপন খবর অন্য দেশকে জানিয়ে দিই! আমরা গুপ্তচর! এই ভেবেই বুঝি তারা আমাদের হেনস্তাও করতে ছাড়ে না। আমরা যখন খেলা দেখাই, তারা তখন আমাদের ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারে! পেছনে ফেউ ডাকে! ঠাট্টা করে! সুযোগ পেলে জিনিস-পত্তর কেড়ে নিতেও ছাড়ে না! তবু বলি, এই নিয়েই আমরা বেঁচে আছি। এই নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। অন্যের দেশে গিয়ে, অন্যের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করা তো আমাদের সাজে না! সেটা তো ঠিক রাস্তা নয়। কেউ যদি বলে, হটো এ-দেশ থেকে, এখানে তোমরা একমুহূর্তও থাকতে পারবে না, তখন কি আর গা-জোয়ারি চলে! তখন লোটা-কম্বল গুটিয়ে নিয়ে চলো আবার আর-এক রাজ্যে।
সে তবু ভালো। তোমার পোযাচ্ছে না, তুমি বললে, দেশ ছাড়ো! আমরাও মানে-মানে সরে পড়লুম। কিন্তু কোনো দেশ যদি মুখে টু শব্দটি না করে পেছন থেকে ছুরি মারে, তখন তাকে কী বলবে? আর এমনিই এক ঘটনা ঘটে গেল কোনো-এক দেশে, সে-দেশের রাজ-সরকারের গোপন আদেশে। সেই কথাই এখন আমি বলব।
আমি এখন ব্যানডুররিয়া বেশ ভালো বাজাতে পারি। আমি এখন আরও একটু বড়ো হয়েছি বলে প্রথম প্রথম যে-অসুবিধা ছিল, এখন আর তা একদম নেই। মা গান গাইলে, আমি লুকিয়ে-লুকিয়ে সেই গানের সুর ভাঁজতে-ভাঁজতে ব্যানডুররিয়ায় তুলে নিতে পারি। আমার ভাবতে মজা লাগে, আমার এই বিদ্যের বহরটা একমাত্র আনাতিদাদা ছাড়া আর কেউ জানে না। আর তাই একদিন সবাইকে হঠাৎ অবাক করে দেবার জন্যে যে-মতলবটা মনে-মনে এঁটে রেখেছিল আনাতিদাদা, সেটা আমিও একেবারে শেষমেশ জেনেছিলুম। মতলবটা আনাতিদাদার মুখে প্রথম শুনেই আমার যে কী মজা লাগল, সে তোমাদের কী বলব! ভাবতে ভাবতে আনন্দে গা আমার শিউরে উঠছিল। ঘটনাটা যখন সত্যি-সত্যি ঘটবে তখন যে কী হবে, আমি ভাবতেই পারছি না।
এই মজার মতলবটা আনাতিদাদা মনে-মনে আঁটলেও, সে-দেশের রাজ-সরকার গোপনে-গোপনে যে মতলবটা এঁটে রেখেছে, সে-খবরটা আনাতিদাদা একদম জানতেই পারেনি। তাই দলের সর্দার হিসেবে, সহজ মনেই ঘোষণা করল, আমাদের তাঁবু-গাড়া সামনের মাঠটায় সেদিন রাত্রে এক জলসা বসবে। কিন্তু জলসায় যে কী হবে, কে গাইবে, কে নাচবে, কে বাজাবে সে-কথা কিছু বলল না।
আজকের রাতটা বেশ নরম। হালকা-নীল চাঁদের আলো গড়িয়ে পড়েছে আমাদের সবুজ মাঠটার ওপর। আলোয়-আলোয় থিকথিক করছে চত্বরটা। চত্বরের মধ্যিখানে একটা মস্ত বড়ো ধুনুচি রাখা হয়েছে। সেই ধুনুচির আগুনের বুক থেকে গুগগুল ছড়ানো গাঢ় ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। সেই ধুনিচিটাকে ঘিরে আমাদের দলের সবাই গোল হয়ে বসেছে। আমি ছাড়া। আমি তখন ব্যানডুররিয়াটা গলায় ঝুলিয়ে লুকিয়ে আছি আনাতিদাদার তাঁবুতে। মা ওই দলের মধ্যে বসে-বসে দু-একবার আমার খোঁজে মাথা উঁচিয়ে এদিক ওদিক চাইল বটে,কিন্তু আমায় দেখতে না পেয়ে খুব যে একটা ব্যস্ত হল, তা অবশ্য মনে হল না। মা ভাবল, নিশ্চয়ই এখানে-ওখানে কোথাও আছি আমি। আমায় কী করতে হবে সেটা আনাতিদাদা চুপি-চুপি আগেভাগেই পাখিপড়ার মতো শিখিয়ে রেখেছে। সুতরাং সেই কথাটা যতই ভাবছি, ততই আমার বুকের ভেতরটা খুশিতে লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠছে। কিন্তু আমরা তখনও কেউ-ই জানতে পারিনি, এ-আনন্দ কিছুক্ষণের। একটা ভয়ংকর ঘটনা ওত পেতে আছে। একটু পরেই বুঝি-বা সে থাবা মারবে।
থাক সে-কথা। এখন যা হচ্ছে, তাই বলি।
আনাতিদাদা সর্দার, সে-কথা তো তোমাদের আগেই বলেছি। নিশ্চয়ই মনে আছে। সুতরাং আনাতিদাদা ওই জলসার আসরে উঠে দাঁড়াল। তারপর হেঁকে-হেঁকে ঘোষণা করল, ‘এ-দেশ ছেড়ে যাবার সময় হয়েছে। আমাদের। কাল ভোরের আলোয় আমাদের আবার যাত্রা শুরু হবে। এখানে আজ আমাদের শেষরাত। শেষরাতে আজ তোমাদের সকলকে চমকে দেবার মতো একটি উপহার আমি দেব। তার আগে রুশমি-বোন আমাদের গান শোনাবে।’
তোমাদের বলে রাখি, রুশমি আমার মায়ের নাম। আনাতিদাদা আমার মাকে রুশমি-বোন বলেই ডাকে। সুতরাং সর্দার আনাতিদাদার হুকুমে আমার মা গান শুরু করল। সে-গানের প্রথম দুটি লাইন আমার এত ভালো লাগে:
সুন্দর পৃথিবী আহা! তুমি সুন্দর,
তোমার বুকের নীড়ে আমাদের ঘর!
এই গানটা মায়ের গলায় যখন সুরে-সুরে ভরে যায়, আমি হলপ করে বলতে পারি, শুনলে তুমি একেবার হতবাক হয়ে যাবে। তার ওপর এই সুরে সুর মিলিয়ে বাবার হাতের ব্যানডুররিয়া যদি বেজে ওঠে, তাহলে সে যে কী আশ্চর্য ব্যাপার হয়, সে যে না শুনেছে, তাকে আমি বোঝাতে পারব না। কিন্তু আজ বাবার বাজনা বেজে উঠল না। আনাতিদাদার তাঁবুর ভেতরে এতক্ষণ আমি গলায় ব্যানডুররিয়া ঝুলিয়ে চুপটি করে বসে ছিলুম এই মুহূর্তটির জন্যে। আনাতিদাদার কথামতো, মায়ের গলায় গান শুরু হবার সঙ্গে-সঙ্গে আমার হাতের ব্যানডুররিয়া সেই গানের সুরে সুর মিলিয়ে বেজে উঠল। আমি বাজনা বাজাতে-বাজাতে ধীর পায়ে তাঁবুর ভেতর থেকে জলসার চত্বরে এগিয়ে এলুম। বিদ্যুৎ চমকে উঠলে আকাশে যেমন হঠাৎ আলোর ঝিলিক দিয়ে ওঠে, তেমনি যেন নিমেষে সবার চোখ ঝলসে গেল আমার দিকে তাকিয়ে। তারা বিশ্বাসই করতে পারছে না, তাদের আদরের ইসতাসি তার মায়ের গাওয়া গানের সঙ্গে ব্যানডুররিয়া বাজাচ্ছে নিজের হাতে! আমার মা গাইতে-গাইতে থমকে যায়। বাবা চমকে তাকায়। আনাতিদাদার মুখে মুচকি-মুচকি হাসি। থমকে গিয়ে মা যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলল ক্ষণেকের জন্যে। হারিয়ে গেল গানও তার কণ্ঠ থেকে। আমি থামলুম না। বাজিয়েই চললুম। একটুখানি থেমে নিমেষের মধ্যেই মা যেন গান ফিরে পেল আবার। মা গেয়ে উঠল দ্বিগুণ উৎসাহে। আমি মায়ের আরও কাছে এগিয়ে গেলুম। একেবারে মুখোমুখি। তোমায় বলব কী, অমনি সঙ্গে-সঙ্গে চত্বর জুড়ে আমাদের দলের যত মানুষ জমায়েত হয়েছিল, সবাই একসঙ্গে মায়ের গলায় গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠল : ‘সুন্দর পৃথিবী আহা! তুমি সুন্দর!’ অমন যে আনাতিদাদা, যাকে কোনোদিন আমি গান গাইতে শুনিনি, সেই আনাতিদাদার গলাতেও সুর! নিমেষের মধ্যে সেই জ্যোৎস্নারাতের সবুজ চত্বরটা যেন অপরূপ এক সুরের রূপকথার মতো ঝলমলিয়ে উঠল। তুমি শুনলে বোধহয় আরও অবাক হবে, কারো-কারো পা-দুটিও যেন অস্থির হয়ে উঠল। নেচে উঠল তারা। গলায়-গলায় গান, পায়ে-পায়ে ছন্দ। সে যে কী আশ্চর্য দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না।
হয়তো এ আনন্দ চলেছিল কিছুক্ষণ। তুমি যতক্ষণ ভাবছ, হয়তো তার চেয়েও কম সময়। আনন্দের জোয়ার যখন ঢেউ তুলে ফুলে-ফুলে উঠছিল, ঠিক তখনই সেই ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটে গেল। অদৃশ্য কোন আড়াল থেকে আমাদের এই আনন্দবিভোর মানুষগুলোর ওপর কারা যেন আচম্বিতে গুলি ছুড়ল, গুড়ুম গুড়ুম! অতগুলো আনন্দ-উচ্ছল মানুষ পলকে হতচকিত। কিছু বুঝতে না-বুঝতেই আবার বুক-কাঁপানো আওয়াজ, দুম-দুম! এবার বন্দুকের গুলি নয়, বোমার বিস্ফোরণ! দেখতে-দেখতে সমস্ত চত্বরটা বারুদের গন্ধে আর নিকষ-কালো অন্ধকার ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল। বিপদে সন্ত্রস্ত মানুষগুলো আর্তনাদ করে উঠল, বাঁচাও, বাঁচাও!’ গানে-গানে ভরপুর সেই সবুজ চত্বর কান্না আর চিৎকারে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল! কার গায়ে আঘাত লাগল, কেউ দেখল না। কে বাঁচল, কে মরল কেউ জানল না। নিজে বাঁচার জন্যে যে যেদিকে পারল, সেই দমবন্ধ ধোঁয়ার ভেতর ঘুরপাক খেতে-খেতে ছুটতে লাগল।
ঠিক এই সময়ে আমি দেখতে পেলুম, একদল পুলিশ হম্বিতম্বি করতে-করতে এদিকেই ধেয়ে আসছে। আমি কী করব, ভেবেই পাচ্ছি না। আমি তখনও বুঝতে পারিনি, আমার মা আমারই সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে-পড়ে মাটির ওপর ছটফট করছে। মায়ের বুকে গুলি লেগেছে। দেখতে পেলুম না বাবাকেও। তার যে কী হল, তাও জানি না। আমি দেখতে পেলুম পুলিশের হাতে বন্দুকের নলগুলো এদিক-ওদিক ছটফট করতে-করতে আমারই দিকে এগিয়ে আসছে। আমার বুকের মধ্যে সাহসের আগুনটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। আমি ভাবলুম, ওরা যদি গুলি ছোঁড়ার আগে আমার আর একটু কাছে আসে, তবে ওই যে ধুনিচির আগুনটা এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে, ওই আগুন ছুঁড়ে ওদের অন্ধ করে দেব। পুলিশের দল আমার আরও কাছাকাছি এসে পড়েছে। আর দেরি নয়। আমিও তড়িৎগতিতে ধুনুচিটার দিকে এগিয়ে যাব বলে পা বাড়ালুম। ঠিক এমন সময়ে কে যেন তারস্বরে চিৎকার করে ডেকে উঠল, ইসতাসি, ইসতাসি!’
আমি থতমত খেয়ে থমকে গেলুম। কিন্তু দেখতে পেলুম, পুলিশের দল আরও কাছে এগিয়ে এসেছে। আমি গলা শুনে বুঝতে পেরেছি, কে আমায় ডাকছে। এ ডাক আনাতিদাদার। তাকে খুঁজে পাবার জন্যে সেই অন্ধকার ধোঁয়ার মধ্যে আমার চোখ দুটো ছটফট করে উঠল। তাকে দেখতে না-পেয়ে আমিও চিৎকার করে ডেকে উঠলুম, ‘আনাতিদাদা!’
অমনি সঙ্গে-সঙ্গে আবার বন্দুক গর্জে উঠল, গুডুম-গুড়ুম!
দেখলুম, আর দেরি করা ঠিক নয়। ওরা আমার বুকে আঘাত হানার আগে আমাকেই প্রতিশোধ নিতে হবে। তাই চোখের পলকে ছুট দিয়ে ওই মস্ত ধুনুচিটা এক হাতে তুলে নিলুম। ছুঁড়ে দিলুম ওদের গায়ে। ওদের গুলি আর ছোঁড়া হল না। আগুনের ফুলকি ছিটকে-ছড়িয়ে ওদের চোখে-মুখে জ্বালা ধরিয়ে দিল। দেখতে পেলুম, সেই আগুন ওদের মাথার টুপিতে জ্বলছে, পোশাক পুড়ছে। সারা দেহে আগুনের ঝলকানি। আমি ভাবলুম, এই সুযোগ! এবার আমায় পালাতে হবে! আমার হাতে তখনও সেই ব্যানডুররিয়াটা। এখন তার কোনো শব্দ নেই। একটু আগে এই ব্যানডুররিয়ার সুর থেকে যে আনন্দ উছলে উঠছিল, এখন সেই আনন্দ মরণ-কান্নার আর্তনাদে আছড়ে পড়ছে চারিদিকে। আমি ছুট দিলুম পালাবার জন্যে। ঠিক এই সময়ে ঝট করে কে যেন আমার জামার কলারটা খামচে ধরে টান দিল। আমি ঝটপট ঘুরে দেখার আগেই চিৎকার করে ডাক দিলুম, ‘আনাতিদাদা, আমাকে বাঁচাও।’
আমার চিৎকার শুনে, আমার জামাসুদ্ধ গলাটা পাকিয়ে একটা লোক কাঁপা গলায় ধমকে উঠল, ‘চোপরাও!’
আমি পিছন ফিরে দেখি,পুলিশের একজন হোমরা-চোমরা আমাকে মারবার জন্যে তার রিভলভারটা আমার দিকে তাক করে ধরে আছে। আমি এক্ষুনি নির্ঘাত মরব, এই কথাটা ভাবতে কতটুকুই বা সময় পেয়েছি, ঠিক সেই সময়ে আবার একটা রিভলভারের শব্দ, সাঁ-ই-ই! আমি আতঙ্কে শিউরে উঠে পিছু ফেরার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলুম, আমায় যে-পুলিশটা ধরেছিল, তার পিঠেই কে গুলি ছুঁড়েছে! লোকটা আমায় ছেড়ে মাটির ওপর আর্তনাদ করে নেতিয়ে পড়ল। পড়ামাত্র আনাতিদাদা পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ইসতাসি–’।
ডাক শুনে মুখ ঘোরতেই দেখি, আনাতিদাদা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভীষণ উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে। তারই হাতে রিভলভার। ওই রিভলভারের গুলিতেই পুলিশের লোকটা ঘায়েল হয়েছে। আনাতিদাদার ডাক শুনে আমিও চিৎকার করে সাড়া দিলুম, ‘আনাতিদাদা!’
আনাতিদাদা আমায় আর কোনো কথা বলতে দিল না। মুহূর্তে রিভলভারটা নিজের পকেটে পুরে ফেলে আমাকে জাপটে ধরল। তারপর চকিতে আমাকে নিয়ে একটা তাঁবুর আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে পড়ল। এমন চটজলদি সমস্ত ঘটনাটা ঘটে গেল যে, আমি নিজেই হতচকিত হয়ে গেলুম। সেই হোমরা-চোমরা পুলিশটার পিঠে গুলি লাগার সঙ্গে-সঙ্গে আমি শুনতে পেলুম, পুলিশের এক বিরাট বাহিনী তর্জন-গর্জন করতে-করতে সেই চত্বরটা তোলপাড় করছে। আমি তখনও শুনছি গুলির আওয়াজ। অবিশ্যি ততক্ষণে চত্বরটাও প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। যে বাঁচল, সে পালাল। যে পারল না, হয় সে গুলির আঘাতে কাতরাচ্ছে, না-হয় মরেছে। আমি আনাতিদাদাকে জড়িয়ে ধরে চুপিসারে জিজ্ঞেস করলুম, ‘মা? বাবা?’
আনাতিদাদা আমার মুখটা চেপে ধরল, ‘না কথা নয়। আড়াল থেকে নিঃশব্দে উঁকি মারলে আনাতিদাদা। আমিও উঁকি দিলুম। পুলিশের দল আনাতিদাদাকে ধরার জন্যে আহত বাঘের মতো গর্জে-গর্জে খুঁজে বেড়াচ্ছে এধার-ওধার। আনাতিদাদা জানে, এমন অবস্থায় এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়। তাই আমার হাত ধরে তক্কেতক্কে এই তাঁবুর আড়াল থেকে, ঠিক পাশেই একটা ঝোপ ছিল, সেখানে লুকিয়ে পড়ল। এই ঝোপের আড়াল থেকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তাঁবুর ভেতরে পুলিশ ঢুকে-ঢুকে খোঁজাখুঁজি করছে। শুনতে পাচ্ছি, তাঁবু ছেঁড়ার শব্দ। ওরা এক তাঁবু থেকে আর এক তাঁবুতে দুড়দাঁড়িয়ে ঢুকে পড়ে। সব তছনছ করে বেরিয়ে আসে। চিৎকার করে। আর সামনে যা পায় পায়ের বুট দিয়ে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে লাথি মারে!
ঠিক এই মুহূর্তে আমাকে নিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে পড়ল আনাতিদাদা। তারপর সেখান থেকে নিঃসাড়ে একটা মস্ত বাড়ির পাঁচিলের আড়ালে গা-ঢাকা দিল। আমি প্রায় নিশ্বাস চেপে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম সেখানে। কী ভীষণ উৎকণ্ঠা। তারপর একফাঁকে সেই পাঁচিলের আড়াল থেকে ঢুকে পড়লুম একটা ঘুপচিমতো গলির ভেতরে। সেখান থেকে মার ছুট!
ছুটতে ছুটতে আমার বুকের ভেতরটা চমকে উঠল। চিৎকার করে আনাতিদাদাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘আমার মা কোথায় গেল? আমার বাবা?’।
আনাতিদাদা ছুটতে ছুটতেই বললে, ‘এখন কোনো কথা নয়! তোকে বাঁচতে হবে!
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কেন এ-কথা বলছ?’
‘পুলিশ তাদের গুলি মেরেছে।’
আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। আমি ছুটতে ছুটতে থমকে গেলুম। আমার বুকের ভেতরটা যেন থেমে গেছে। আমি কাঁদতে পারলুম না। কাঁপতে লাগলুম। আনাতিদাদা ব্যস্ত হয়ে আবার আমার হাত ধরে টান দিল। না, আমি যাব না। তখন আমার শরীর উত্তেজনায় গুমরে উঠছে। মন বলছে, যারা আমার মা আর বাবাকে গুলি মেরেছে, তাদের আমি দেখে নেব।
আনাতিদাদা আবার বলল, ইসতাসি, তোকে বাঁচতে হবে! এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ওরা দেখে ফেলবে!’
‘কটা মাত্র গুলি আছে।’
‘একজনকেও তো মারতে পারব।’
‘একজনকে মারলে কী লাভ! প্রতিশোধ নিতে হলে আমাদের তৈরি হতে হবে।’ বলে আনাতিদাদা আমার হাতটা তার হাতের মুঠি দিয়ে শক্ত করে ধরল। আশ্বাসে ভরপুর সেই হাতে হাত দিতেই আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলুম না। ডুকরে কেঁদে ফেললুম। আনাতিদাদা আমার মুখখানা তার চোখের কাছে সরিয়ে এনে বলল, ‘ভয় নেই, আমি আছি। চ, আমার সঙ্গে।
আমি কথা বলতে পারলুম না। এক হাতে আমার ব্যানডুররিয়া আর এক হাতে আনাতিদাদার শক্ত মুঠি শক্ত করে ধরে আমি ছুটলুম।
.
অনেকক্ষণ ছুটতে-ছুটতে আর যখন পারছিলুম না, আনাতিদাদা তখন নিজেই বলল, ‘এবার একটু থামতে পারা যায়।’
আমরা দুজনেই হাঁপাচ্ছি। হাঁপাতে-হাঁপাতেই পিছু ফিরে এদিক-ওদিক দেখছি। না, কেউ টের পায়নি মনে হয়। আমরা বোধ হয় পুলিশের চোখ এড়িয়ে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে গেছি।
আমার এখন কথা বলার মতো মনের অবস্থা নয়। আমি যেন প্রায় বোবা। মা আর বাবার মুখ দুটি যতই মনে পড়ছে, আমি যেন নিজেকে ততই কেমন অসহায় মনে করছি। আনাতিদাদার সেই কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, পুলিশ তাদের গুলি মেরেছে। এ-কথা শুনলে কোন ছেলের না মনের ভেতর আগুন জ্বলে ওঠে! এই পৃথিবীতে যার মা নেই, বাবা নেই তার আর কী আছে। আমি তাই ভারি একা, এখন, এই মুহূর্তে।
আমাকে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনাতিদাদাই কথা বলল। আমি বুঝতে পারছি, আনাতিদাদা এতক্ষণ ছুটে এসে তার দূরন্ত নিশ্বাসটাকে এখনও বাগে আনতে পারেনি। কষ্ট হচ্ছে। তবু সেই কষ্ট অগ্রাহ্য করে আমাকে ডাকল, ইসতাসি।’
হঠাৎ সেই ডাক শুনে চমকে উঠলুম।
‘এটা স্টেশন।’
আমি হাত দিয়ে আমার চোখ মুছে নিলুম।
‘আমাদের এইখানে খানিকক্ষণ গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে,’ আনাতিদাদা বলল, ‘এক্ষুনি ট্রেন আসবে।
এতক্ষণ আমি ভালো করে দেখিনি এই জায়গাটা। ভালো করে দেখার কথাটা আমার মনেই আসেনি। আমার মনে শুধু একটা কথাই বার বার ধাক্কা দিয়ে বলে যাচ্ছে, প্রতিশোধ নিতে হবে, প্রতিশোধ!
সুতরাং আনাতিদাদা যখনই বলল, এখানে লুকিয়ে থাকতে হবে, তখনই আমি ঘুরে-ফিরে দেখবার চেষ্টা করলুম কেমন জায়গা এটা। হ্যাঁ, এটা রেলের স্টেশনই বটে। অনেক রাত হয়েছে বলে লোকজন কম। অবিশ্যি প্ল্যাটফর্মে আলো ঝলমল করছে। আমরা দুজনে লুকিয়ে-ছাপিয়ে একটা বেঞ্চের ওপর জড়াজড়ি করে বসে রইলুম। এই যে ছুটে আসা, এই যে আলো-ঝলমল স্টেশন, বা পুলিশের ভয়, অথবা বন্দুকের আওয়াজ, সঙ্গে অতগুলো মানুষের আর্তনাদ, এসবের কোনোটাই এখন আমার কাছে কিছু নয়। এখন শুধু বার বার আমার মা আর বাবার কথাই মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, মায়ের গান, বাবার ব্যানডুররিয়া বাজাতে বাজাতে খুশিতে দুলে ওঠা, তার জাগলিং-এর খেলা দেখাবার কসরত, কিংবা তাদের গল্প বলা, তাদের মুখের শব্দগুলি আর প্রাণ-খোলা হাসি। মা হাসলে আমি তার মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতুম। কেননা, হাসতে-হাসতে মায়ের মুখখানি এমন অদ্ভুত আর সুন্দর হয়ে ঝলসে উঠত যে, তুমি তা না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না। আমার তখন সত্যিই মনে হত, ভাগ্যিস, আমার মা আমার না হয়ে অন্য কারো হয়ে যায়নি!
হঠাৎ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঝোলানো ঘন্টাটা বেজে উঠল। এদিক-ওদিক দূরে-দূরে অনেকগুলো লাল আলো লাইনের ওপর মাথা উঁচিয়ে পিটপিট করে জ্বলে জানান দিচ্ছে, এদিকের লাইন বন্ধ। যেদিকের লাইনে গাড়ি আসছে, দেখি, সেদিকে সবুজ আলো জ্বলে উঠেছে। উঠে দাঁড়াল আনাতিদাদা। আমার হাতের দিকে তাকিয়ে অনেকটা চাপা গলায় বলল, ‘দে।’ বলে আমার হাত থেকে ব্যানডুররিয়াটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে এবার বলল, ‘চ।’
আমিও উঠে দাঁড়ালুম। আনাতিদাদার হাত ধরে এগিয়ে গেলুম প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি। দেখতে পেলুম, দূরে আলোর একটা বিন্দু ছুটতে-ছুটতে ধেয়ে আসছে। দেখছি যতই সেই বিন্দু এগিয়ে আসছে, ততই বাড়তে-বাড়তে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে সামনে, লাইনের ওপর। সেইসঙ্গে ট্রেনের ক্ষীণ শব্দটাও ধীরে-ধীরে যেন সেই আলোর সঙ্গে তীব্র হচ্ছে। ঝিক-ঝিক-ঝিক-ঝিক।
স্টেশনে ট্রেন এসে থামল। আনাতিদাদার হাত ধরে গাড়িতে উঠতে গিয়েই আমার বুকটা ধড়ফড় করে চমকে উঠল। দেখে ভেসে গেল কান্নায়। অনুতাপে ভমন বলে উঠল, আমি মা আর বাবাকে চিরদিনের মতো এখানে ফেলে রেখে পালিয়ে যাচ্ছি। আমার পা-যেন চলতে চায় না। আনাতিদাদা আমার হাতে টান দিল। আমার চমক ভাঙল। আমি ট্রেনে উঠে পড়লুম। গাড়ি ছেড়ে দিল।
আমরা দুজনে চুপচাপ বসে পড়লুম এক-কোণে। আনাতিদাদা ব্যানডুররিয়াটা আবার আমার হাতে এগিয়ে দিল। আমি সেটা গলায় ঝুলিয়ে নিলুম। আমাদের সঙ্গে আর তো কিছু নেই। এই ব্যানডুররিয়াটা, আর বোধ হয় আনাতিদাদার পকেটে সেই রিভলভারটা। বোধ হয় কেন, নিশ্চয়ই। কেননা, আমি দেখেছি, রিভলভারটা আনাতিদাদা পকেটেই পুরেছে। এক যদি তালেগোলে পকেট থেকে পড়ে গিয়ে থাকে, তা হলে অন্য কথা। তবে এটা ঠিক, হুড়োহুড়িতে আনাতিদাদার জামা-প্যান্ট-জ্যাকেট সবই কেমন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। আনাতিদাদার মুখখানাও এতক্ষণে ট্রেনের আলোয় ভালো করে দেখতে পেলুম। বুঝতেই পারলুম, দুঃসহ ভাবনায় অথবা গভীর দুঃখে সেই মুখখানা চুপসে এতটুকু হয়ে গেছে। আমাকে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকতে দেখেই বোধ হয়, আনাতিদাদা আমার দিকে ফিরে তাকাল। হঠাৎ আমার চোখে চোখ পড়তেই দেখি, যেন তার চোখে ফোঁটা-ফোঁটা জল চিকচিক করে উঠেছে। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলুম না। চকিতে নিজের মুখখানা জানলার ফাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে ডুকরে-ডুকরে কেঁদে উঠলুম। আমার পিঠে হাত রাখল আনাতিদাদা। হাত দিয়ে পিঠটা আস্তে চাপ দিতেই, আমার কান্নার শব্দটাকে আমি কোনোরকমে সামলে নিলুম। আমি বুঝতে পেরেছি, এভাবে কেঁদে-ওঠাটা আমার ঠিক হয়নি। পাশের লোক কান্না শুনতে পেলে সন্দেহ তো করতেই পারে!
আমি লুকোবার চেষ্টা করলেও আমার ঠিক পাশের লোকটি আমার কান্না শুনতে পেয়েছিল! সে আচমকা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে বসল, কী খোকা, মন কেমন করছে?’ তখন আমি আচমকা থমকে উঠে তার দিকে ফিরে তাকিয়েছি।
আনাতিদাদা তো দারুণ চালাক। পাছে আমি কী বলতে কী বলে ফেলি, তাই আমায় উত্তর দেবার সময় না দিয়েই নিজে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, মা-বাবাকে ছেড়ে যাচ্ছে তো!’
‘কোথায় যাচ্ছে?’
‘আমার কাছে। আমি কাকা।’
‘ও।’
লোকটা চুপ করে গেলেই ভালো ছিল। তা না, লোকটা আমাকেই আবার বলল, ‘কাকার সঙ্গে যাচ্ছ, কাঁদতে আছে!’
আমার আর তখন কান্না! কখন থেমে গেছে! বোধ হয় লোকটার ভয়ে! কারণ, ভাবছি, যদি লোকটা অন্য কিছু জিজ্ঞেস করে! জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছি, তখন কী উত্তর দেব?
অবশ্য সেসব কথা সে জিজ্ঞেস করল না। কিন্তু যে-কথা জিজ্ঞেস করল, তাতে অতি বড় সাহসী মানুষেরও বুকের রক্ত জল হয়ে যায়! আমি না-হয় ছোটো ছেলে। কিন্তু আনাতিদাদার মতো শক্তসমর্থ লোকও যখন তার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল, তখন তুমি কী বলবে বলো?
লোকটা প্রথমে চুপ করেই ছিল। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল, ‘দেখলুম, তোমরা এই স্টেশন থেকেই উঠলে?’
আনাতিদাদা মুখে কথা না-বলে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।
‘আমিও এখান থেকেই উঠলুম। লোকটাও বলল।
আমার বুকের ভেতরটা দুরদুর করে কেঁপে উঠেছে। আবার জিজ্ঞেস করল, ‘ওদিকের কোনো খবর জানো নাকি?’
‘কোন দিকের?’
‘সে কী! জানো না? এমন একটা সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেল!’
‘আমরা তো কিছুই জানি না!’ যেন আকাশ থেকে পড়ল আনাতিদাদা।
লোকটা হাত নেড়ে বলল, ‘তাজ্জব ব্যাপার। তোমরা কি শহরে বাস করো না? জানো না, একদল যাযাবরকে আজ পুলিশ ভীষণ ঠেঙিয়েছে! গুলি করে কটাকে খতম করেও দিয়েছে।’
‘তাই নাকি।’
লোকটা আবার বলল, ‘দেবেই তো। যা বাড়াবাড়ি করছিল! একেবারে ডাকাত মশাই, ডাকাত। ক-দিন ধরে শহরের মানুষকে তিষ্ট্রতে দিচ্ছিল না। মেরেছে, বেশ করেছে! গভর্মেন্ট তো হুকুমই দিয়েছে, যাযাবর দেখো আর খতম করো। অনেকগুলো ধরা পড়েছে। কটা পালিয়ে গেছে। শুনছি নাকি এই ট্রেনেও কটা লুকিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের খুঁজে বার করার জন্যে পুলিশও এই গাড়িতে ওত পেতে আছে। ওঃ, এই এক জাত মশাই, যাযাবর! ব্যাটাদের না আছে ধম্ম, না আছে কম্ম! শয়তান! শয়তান!’
আমি বলতে পারি, অন্য সময় হলে বাছাধনের ঘাড়ে ধড় থাকত না। এতক্ষণে তিনি ধরাশায়ী হতেন। কিন্তু লোকটার মুখে এইসব আজেবাজে বদনাম শুনেও আনাতিদাদা বেমালুম হজম করে গেল। বোধ হয়, এই গাড়িতে পুলিশ যাযাবরদের ধরবার জন্যে ওত পেতে আছে, এই কথাটা শুনেই তার মাথা ঘুরে গেল! আনাতিদাদা এমনই ঘাবড়ে গেল যে, প্রায় চমকে দাঁড়িয়ে উঠে চক্ষের নিমেষে চলন্ত ট্রেনের চেন ধরে টান মারল! মেরেই, আমায় টানতে-টানতে পালাবার জন্যে দরজার দিকে ধেয়ে গেল। মানুষ বিপদে পড়লে বোধ হয় এমনি করে তার বুদ্ধিটাও লোপ পেয়ে যায়! তা নইলে আনাতিদাদার মতো বুদ্ধিমান মানুষ হুট করে এমন একটা কাঁচা কাজ করে বসবে! এ-কথা ভাবাই যায় না! সঙ্গে-সঙ্গে একগাড়ি লোক হা-হা করে উঠেছে। আমাদের অমন করে পালাতে দেখে প্রথমটা তারা থতমত খেয়ে গেলেও, পরেই তারা ‘ডাকাত, ডাকাত’ বলে চিৎকার করে আমাদের ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চেনের টানে ট্রেন তো এখন একেবারে স্টপ! আমরা ধস্তাধস্তি করতে করতে ট্রেন থেকে লাফ দেবার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না! ট্রেনের কামরায় শুরু হয়ে গেল ভীষণ হই-হুঁল্লোড়! আমি বোধ হয় আমার গলায় ঝোলানো এই ব্যানডুররিয়াটা আর রক্ষা করতে পারলুম না! এক্ষুনি চুরমার হয়ে গেল বলে!
হঠাৎ শুনি, সত্যিই চুরমার হয়ে যাওয়ার শব্দ! চুরমারের শব্দটা ব্যানডুররিয়ার নয়! পকেটে যে রিভলভারটা ছিল, সেইটা বার করে গুলি ছুঁড়েছে আনাতিদাদা! একটা লোকের গা ছুঁয়ে সেই গুলি ছিটকে লেগেছে ট্রেনের আলোর গায়ে। আলো নিবল। ঝনঝন করে আলোর কাঁচ ভেঙে পড়ল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে ছেয়ে গেল সারাটা কামরা। সেই অন্ধকারে এক-কামরা মানুষ আতঙ্কে চিৎকার করে মরাকান্না শুরু করে দিল! দেখতে-দেখতে পুলিশও হাজির। তাদের হাতের টর্চ ঝলসে উঠেছে! দৌড়ে এসে তারা কামরাটার মধ্যে ঢুকে পড়তেই আনাতিদাদা আমাকে নিয়ে মেরেছে লাফ! লাফ মেরেই চোঁ-চাঁ দৌড়, একেবারে সামনের দিকে। কামরা-ভরতি অত লোকের মধ্যে একজনও যে আমাদের দেখতে পাবে না, এ তো হতে পারে না। সুতরাং যার নজর গেল, সে-ও অমনি সঙ্গে-সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই পালাচ্ছে, ওই পালাচ্ছে!’
আকাশে তখনও জ্যোৎস্না। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, রেল-লাইনের ধারটা। যেখানে আমরা লাফিয়ে পড়েছি, সেখানে এবড়ো-খেবড়ো পাথর ছড়ানো। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়-মারা খুব শক্ত। তবু সেই পাথরের ওপর দিয়েই ছুটতে-ছুটতে আমরা রেল-লাইনের ঠিক ধারেই একটু নিচুমতো জলা জায়গায় ঝটপট নেমে পড়লুম। নামতে না নামতে পুলিশের বন্দুক থেকে ক-রাউণ্ড গুলি গুড়ুম-গুম করে বুক কাঁপিয়ে আমাদের ঠিক মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। ভাগ্য বলতে হবে! ওই নিচু জায়গাটায় নামতে যদি আর এক মুহূর্ত দেরি হত, তবে আমাদের মরণের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারত না।
আনাতিদাদা কথা না বলে হাঁটু ভেঙে, গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলল। আমাকে ইশারায় অনুসরণ করতে বলল। আমিও এগিয়ে চলি আনাতিদাদার পাশে-পাশে।
শুনতে পাচ্ছি, পুলিশ এগিয়ে আসছে। তার সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে-করতে ছুটে আসছে ট্রেনের যাত্রীরা। আমি জানি, আর রেহাই নেই। এবার নিশ্চিত ধরা পড়ব। ঠিক তক্ষুনি জলাটার ধার ঘেঁষে বেশ একটা ঘন ঝোপঝাড়ের জঙ্গল যেন নজরে পড়ল আমাদের। মাঝে-মাঝে দেখা যাচ্ছে, কটা বড়ো বড়ো গাছ। আনাতিদাদা আর কিছু না পেয়ে আমাকে হ্যাঁচকা মেরে ওই ঝোপের মধ্যেই ধাঁ করে ঢুকে পড়ল। পুলিশের দল তো প্রায় এসেই পড়েছে। যতই জ্যোৎস্না ঝিলিক মারুক, চাঁদ তো আর সূর্যের মতো চারিদিকে স্পষ্ট আলোয় ভরিয়ে দিতে পারে না। রাত সে রাতই! সুতরাং বলতে পারি, ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ার ফলে আমরা অন্তত কিছুক্ষণের জন্যেও পুলিশের হাত থেকে বাঁচলুম! কেননা, এই ঝোপের মধ্যে, এই জ্যোৎস্না রাতে সবকিছু ঠিক ঠিক ঠাওর করা খুবই মুশকিল।
কিন্তু মুশকিল সে তো তোমার-আমার কাছে। পুলিশের কাছে মুশকিল-টুশকিল বলে কোনো কথা নেই। তার ওপর তাদের হাতে বড়ো বড়ো টর্চ। ঝোপের মধ্যে তাদের টর্চের আলো ঝলসে উঠতেই, আমি জানি, নির্ঘাত ধরা পড়ে গেছি! এই বুঝি টর্চের আলো আমাদের গায়ের ওপর ঠিকরে পড়ল!
প্রথমে আমি ভেবেছিলুম, ঝোপটা তেমন কিছু নয়। বুঝি একটুখানি। ওই সাংঘাতিক উত্তেজনায় আর উৎকণ্ঠায় সব কেমন গোলমাল হয়ে গেছল আমার। তার ওপর জ্যোৎস্নারাতের কুহেলি আলো! সুতরাং ঝোপের চেহারাটা বুঝে ওঠা, আমি কেন, কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। শুনলে বোধ হয় অবাক হয়ে যাবে, এটা আদপে ঝোপই নয়। যেটাকে এতক্ষণ ঝোপ বলে ভ্রম হচ্ছিল, আসলে সেটা একটা মস্ত ঘন জঙ্গলের শুরু!
এ-কথাটা আনাতিদাদাই বা জানবে কী করে! কিন্তু পুলিশের টর্চ জ্বলে উঠতেই ব্যাপারটা বোঝা গেল। অন্য সময় হলে এই রাত-দুপুরে কে আর শখ করে এই জঙ্গলে ঢুকতে সাহস করে! পুলিশও হয়তো সাহস করল না। কেননা, তাদের পায়ের শব্দ শুনে মনে হচ্ছে, জঙ্গলের বাইরে থেকেই তারা ঝোপঝাড় সরিয়ে মুড়িয়ে আমাদের খোঁজাখুঁজি করছে। আমি একেবারে স্পিকটি নট! আনাতিদাদার গা ঘেঁষে সিঁটিয়ে রইলুম! কিন্তু বিপদ যখন আসে, সে তো একা আসে না। হল কী, বোধ হয় একটা বড়োসড়ো গিরগিটি টপাস করে আমার পিঠের ওপর লাফিয়ে পড়ল। আমি তো আঁতকে উঠেছি। তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে সেটাকে যেই সরিয়ে দিতে গেছি অমনি বেমক্কা হাতটা গিয়ে পড়ল আমার গলায় ঝোলানো ব্যানডুররিয়াটার তারে! আচমকা ঝন করে সেটা বেজে উঠতেই পুলিশের দল ও তার সঙ্গে জনতা চিৎকার করে উঠেছে, ‘ওইখানে, ওইখানে!
আমরা এবার ধরা পড়লুম বলে! ছিঃ! ছিঃ! আমার অসাবধানে এ কী বিপদ ঘটে গেল! আনাতিদাদা সেই বিপদের কথা বুঝতে পেরেই, ঝট করে আমার জামাটা খামচে ধরে মারল এক ঝটকা-টান! তারপর সেই ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছুট!
ছুট বললেই তো আর জঙ্গলের মধ্যে ছোটা যায় না! চারিদিকে ছোটো-বড়ো নানান গাছ। কাঁটা-ঝোপ, ডালপালা! গায়ে লাগছে, পায়ে ফুটছে। হয়তো রক্ত পড়ছে। কিন্তু সে-সব এখন কিছু নয়। কারণ, আমাদের ধরবার জন্যে টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে পুলিশদলও তেড়ে আসছে। তারা আমাদের সোজাসুজি দেখতে না পেলেও, আমাদের ছোটার সঙ্গে-সঙ্গে গাছে-গাছে, ঝোপে-ঝাড়ে গায়ের ধাক্কা যতই লাগছে, ততই শব্দ হচ্ছে আর ঝোপঝাড়গুলো নড়ে উঠছে। আমরা কোন দিকে পালাচ্ছি, হদিস করে ফেলতে তাদের এতটুকু কষ্ট হচ্ছে না। সুতরাং তারা চোখ-কান বুজে সেইদিকেই বন্দুক ছুড়ল গুড়ুম-ম-ম! আমার লাগেনি। আনাতিদাদার লাগল কি না বলতে পারছি না। কিন্তু আনাতিদাদা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার হাতটা চেপে ধরল। তারপর সেই ঘুপচি জঙ্গলের মধ্যে ঝুপ করে বসে পড়ল। আমিও বসে পড়েছি। একদম নিশ্বাস চেপে, নিঃসাড়ে শুনতে লাগলুম গাছপালা টপকে ওরা এদিকেই আসছে! ওরা বোধ হয় ভেবেই নিয়েছে গুলি খেয়ে আমরা ঘায়েল হয়েছি।
ওরা যখন আমাদের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে, আমাদের প্রায় ধরে-ধরে, তখনও আনাতিদাদাকে চুপটি করে বসে থাকতে দেখে, আমি ধরেই নিয়েছিলুম, আনাতিদাদার গায়ে গুলি লেগেছে। কিন্তু তা তো নয়! কেননা, এবার হামাগুড়ি দিয়ে আনাতিদাদা আমাকে নিয়ে আরও একটু নিরাপদ জায়গায় যাবার জন্যে খুব সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে চলল। বুকে ভর দিয়ে চলতে হচ্ছে বলে, আমার গলায় ঝোলানো ব্যানডুররিয়াটা হাতে নিয়েছি। কী যে অসুবিধা হচ্ছে, তোমাদের বোঝাতে পারব না! বুকের ছাল-চামড়া ছিঁড়ছে! ওরা যেদিকটা লক্ষ করে এগোচ্ছে, আনাতিদাদা একটু পাশ কাটিয়ে ঠিক তার উলটো দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের চোখে প্রায় ধুলো দিয়ে আনাতিদাদা এমন একটা জায়গায় এসে লুকিয়ে পড়ল যে, আমার মনে হল, হয়তো বা এ-যাত্রা ওদের হাত থেকে আমরা রক্ষা পেলুম। আমার মনে হলে কী হবে! ওরা তো ছাড়বার পাত্র নয়! আমাদের খুঁজে না-পেয়ে, সেই পুলিশের দল একেবারে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড শুরু করে দিল। সেই জায়গাটাকে ঘিরে ফেলে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল। ওরা যেদিকে টর্চের আলো ফেলছে, ঠিক তার উলটো দিকে অন্ধকারটা মনে হচ্ছে, আরও গাঢ়। সুতরাং এই গাঢ় অন্ধকারে আমাদের আরও বেশ খানিকটা দূরে সরে আসতে সুবিধাই হল। ওরা ওদিকে চেঁচামেচি করে তল্লাশি চালাচ্ছে, এদিকে আমরাও নিঃশব্দে জঙ্গলের আরও গভীরে ঢুকে পড়ছি। তারপর যখন মনে হল, ওদের নাগালের বাইরেই চলে এসেছি, আনাতিদাদা তখন দাঁড়িয়ে উঠে আমাকে প্রায় ছোঁ মেরে টেনে নিল তার কাছে। তারপর ওই অসংখ্য গাছগাছালি আর ভয়ংকর অন্ধকার পেরিয়ে, খানিকটা হেঁটে, অনেকটা ছুটে আর মাঝেমধ্যে ডিঙিয়ে লাফিয়ে পিটটান দিল। আমি হলপ করে বলতে পারি, অন্য সময় হলে রাত-দুপুরে বনে-জঙ্গলে ঢোকা তো দূরের কথা, আনাতিদাদা আমাকে এর আশপাশে ঘুরঘুর করতেই দিত না। আজ সেই আনাতিদাদাই আমাকে নিয়ে জঙ্গলের জালে জড়িয়ে পড়ে এক ভয়াবহ বিপদের সঙ্গে লড়াই করছে। এই বিপদসংকুল জঙ্গলে এই মুহূর্তে হঠাৎ কোনো হিংস্র জীব আমাদের যে আক্রমণ করতে পারে, সে কথা হয়তো এখন আনাতিদাদা ভাবতেই পারছে না। কিন্তু কপাল বলো আর যাই-ই বলো, আমরা এখনও বেঁচে আছি। পুলিশের গুলি অথবা জঙ্গলের জন্তু, কেউ-ই এখনও পর্যন্ত আমাদের মেরে ফেলতে পারেনি। যদিও পুলিশের হাত থেকে আপাতত আমরা বেঁচেছি, কিন্তু গভীর জঙ্গলের জন্তুর হাত থেকে আমরা নিস্তার পাব কি না, তা এখনই বলতে পারি না। আমরা চুরি করিনি, ডাকাতি করিনি, করিনি খুন-জখমের মতো কোনো অন্যায় কাজ, তবু সেই দেশের মানুষের চোখে, সরকারের চোখে আমরা শত্রু। আমাদের শেষ করতে ওদের বারুদের গুলি তাই গর্জে উঠেছে। আমরা যতই গান গাই, যতই বাজনা বেজে উঠুক আমাদের হাতে, সে সুরে তোমার মনে দোলা লাগলেও, ওরা টলবে না। সুতরাং খুনি-দসু অথবা লুঠেরার মতো জঙ্গলের এই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আমাদের ছুটে পালাতেই হবে!
.
আচ্ছা, আমরা কি সত্যিই বেঁচে গেছি? বলতে পারি না। তবে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমাদের এখন। কারণ, যত ভয় পেয়েছি, তার চেয়ে দৌড়-ঝাঁপ করেছি অনেক বেশি। হাত দিয়ে ডালপালায় ঠেলা মারতে মারতে, অথবা পা দিয়ে কাঁটা মাড়াতে মাড়াতে আমাদের হাত-পা দুই-ই গেছে! শুনতে পাচ্ছি আনাতিদাদার নিশ্বাসের তীব্র শব্দ। হাঁপাচ্ছে! আমিও! আমাদের মুখে কোনো কথা নেই। দুজনেই অবাক। একটু আগে জঙ্গল জুড়ে ঝিঁঝির একটানা যে-শব্দ কানের ভেতর তোলপাড় করছিল, এখন তা-ও যেন কত অস্পষ্ট! এই প্রায় শব্দহীন অন্ধকার জঙ্গলের এইখানে এসে আমার পা-দুটো যেন আর চলতে চাইছিল না। আমি বুঝতে পারছি, আনাতিদাদারও কষ্ট হচ্ছে। তবু আনাতিদাদা হাঁটছে। আমি আর পারলুম না। একটা গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ধরলুম। সেই গুঁড়ির গায়ে নিজের মাথাটা ঠেকিয়ে হাঁসফাঁস করতে লাগলুম। আমি বুঝতে পারলুম, আনাতিদাদাও দাঁড়িয়ে পড়েছে। মুখ তুলে দেখি, আমার মতো আনাতিদাদাও আর একটা গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ধরে ছটফট করছে।
কষ্টটা একটু যখন থিতিয়ে এল, আমি আগুপিছু কিছু না ভেবেই বসে পড়লুম সেই গাছের নীচে। উঃ! দাঁড়াতে পারছিলুম না। গাছের নীচের এই অসমান জায়গাটা ঘিরে কত যে ঘুপচি-ঝোপে ভরতি হয়ে আছে, তা কি আর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি! হয়তো এটা সাপখোপের আড্ডাখানা। সে-কথা আর তখন কে ভাবছে! এখন একটু স্থির হয়ে বসতে পারলেই বাঁচি। শরীরের কোন জায়গাটায় যে কেটেছে, কোথায় লেগেছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, সারা শরীরটাই যেন জ্বলে যাচ্ছে আমার। অসহ্য যন্ত্রণা।
আমার কাছে এগিয়ে এসেছিল আনাতিদাদা। জঙ্গলের গাঢ় অন্ধকারে কেউ কারোরই মুখ দেখতে পাচ্ছি না। আনাতিদাদাও আমার পাশে বসে পড়তে মনে হল, আমারই মতো তারও কষ্ট হচ্ছে। এই নিস্তব্ধ অন্ধকারে আমাদের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটা মনে হচ্ছে যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো মাঝে-মাঝে গর্জে উঠছে। আমি চমকে যাচ্ছি। এরই ফাঁকে অনেক কষ্টে আমিই প্রথম কথা বললুম। কাঁপা গলায় ডাক দিলুম, ‘আনাতিদাদা।’
‘অ্যাঁ?’ আনাতিদাদার গম্ভীর গলার স্বরটা এখন কেমন যেন ভাঙা-ভাঙা ক্লান্ত সুরে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।
‘রিভলভারটা?’
আনাতিদাদার হাত দুটো ভীষণ ছটফটিয়ে পকেটটা পরখ করে স্থির হয়ে গেল। হ্যাঁ, আছে।
আমি বললুম, ‘ওদের অনেক লোক। যদি জঙ্গলটা ঘিরে ফেলে?’।
আনাতিদাদা বলল, ‘আমরা জঙ্গলের অনেক গভীরে চলে এসেছি। হয়তো খুঁজে পাবে না।’
‘এর পর?’
‘আজ রাতটা এখানেই কাটাতে হবে!’
‘তারপর?’
‘সকালে এখান থেকে বেরিয়ে পড়ব।’
‘কোথায় যাবে?’
‘জঙ্গলের বাইরে।’
‘ওরা দেখে ফেললে?’
‘রিভলভারটা যখন এখনও হারায়নি, তখন আশা করতে পারি ওটা কাজে লেগে যাবে।’ আনাতিদাদার গলায় স্বরটা এখন ভারি দৃঢ়। বলল, ‘মরার আগে কটাকে খতম করতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হবে না। ভয় পাস না!’
আনাতিদাদার সেই গলার স্বর শুনে, আমার গলার স্বর, স্তব্ধ হয়ে গেল।
আবার নিস্তব্ধতা। নিস্তব্ধ এই জঙ্গলে এখন আমরা প্রাণ হাতে নিয়ে সকালের জন্যে অপেক্ষা করছি। আমরা জানি না, এখন কত রাত্রি। জানি, আনাতিদাদার হাতে একটা ঘড়ি আছে। কিন্তু এই অন্ধকারে শত চেষ্টা করলেও সেই ঘড়ির মধ্যে সময়ের আঁকগুলো খুঁজে পাওয়া খুবই শক্ত। হঠাৎ এমনই সময়ে আনাতিদাদাই আবার কথা বলল, ‘ব্যানডুররিয়াটা?’
সেটা আমি হাত থেকে নামিয়ে পাশে রেখে দিয়েছিলুম। আনাতিদাদা জিজ্ঞেস করতেই আমি তাড়াতাড়ি সেটা হাত বাড়িয়ে দেখে নিয়ে বললুম, ‘এই তো!’
‘যাক, বেঁচে গেছে।’
‘ভেবেছিলুম ভেঙে যাবে।’
আনাতিদাদা আমার কথা শুনে নিশ্বাসে বুকটা ভরে নিয়ে বলল, ‘কোনোদিনই ভাঙবে না।’
‘কেন?’
তুই যে ওটাকে বড্ড ভালোবাসিস।’
আনাতিদাদার এই কথা শুনে আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলুম। মনে পড়ে গেল আমার বাবার কথা। গলায় ঝুলিয়ে সেই ব্যানডুররিয়া বাজানোর দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল। বড্ড ভালোবাসত বাবা বানডুররিয়াটা। আর ভালোবাসত বলেই বুঝি অত মিষ্টি সুর তার হাতের আঙুল ছুঁয়ে ওই তারে বেজে উঠত।
কী ভাবছিস, ইসতাসি?’ আনাতিদাদা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
আনাতিদাদার গলা শুনে আনমনা আমি থতমত খেয়ে গেছি। তাড়াতাড়ি উত্তর দিলুম, ‘কিচ্ছু না।
‘চুপ করে আছিস কেন?’
‘ভাবছি, সব দোষ আমার!’
‘কীসের দোষ?’
‘তখন আমার হাতটা আচমকা লেগে গেল বলেই তো ব্যানডুররিয়ার তারটা বেজে উঠল, আর সঙ্গে-সঙ্গে সেই ঝোপের মধ্যে পুলিশও আমাদের হদিস পেয়ে গেল। তা নইলে পুলিশ হয়তো আমাদের খুঁজেই পেত না!’
আমার কথা শেষ হতে না হতেই আনাতিদাদা সামনে চেয়ে আচম্বিতে আমার মুখটা চেপে ধরল। আমি থতমত খেয়ে গেছি। ভয়-পাওয়া চোখদুটো আমার অন্ধকারে স্থির হয়ে গেল। যদিও আনাতিদাদা হাত দিয়ে আমার মুখটা চেপে ধরে আছে, বুঝতে পারলুম, তার চোখ দুটো অন্যদিকে চেয়ে আছে। চেয়ে আছে সামনে। আমিও তাকালুম সেইদিকে। আনাতিদাদা গলার স্বরটাকে একেবারে না শোনার মতো চেপে বলল, ‘দেখতে পাচ্ছিস?’
দেখতে পাওয়ার মতো তেমন কিছু তখনও দেখতে না পেয়ে আমিও আরও চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী?’
‘দুটো চোখ!’
আমার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। স্বাভাবিক কারণেই সেই চোখদুটো দেখার জন্যে আমার চোখদুটোও ছটফটিয়ে ঝলসে উঠল। কিন্তু অন্ধকার ঘুটঘুঁটে বনে কোথায় যে সেই চোখ, আমি আঁতিপাতি করেও তা দেখতে পেলুম না। তাই আবার জিজ্ঞেস করলুম, ‘কই?’
জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে দেখি, আনাতিদাদার চোখদুটো এতক্ষণ যে-দিকে স্থির হয়েছিল, সেদিকের ঝোপটা মড়মড় করে কেঁপে উঠেছে। মনে হল, দুরন্ত গতিতে কে যেন অন্য কোথাও লুকিয়ে পড়ল। আমি আঁতকে আনাতিদাদাকে জড়িয়ে ধরলুম। আনাতিদাদা চোখের পলকে রিভলভারটা পকেট থেকে বার করে ফেলল। আমরা দুজনেই ধড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়লুম। বুঝতেই পারছ, আমরা দুজনেই তখন বোবা হয়ে গেছি। উত্তেজনায় দুজনেই হাঁপাচ্ছি। আমাদের নিশ্বাসের শব্দগুলোকে সামলাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। পারছি না। আমি ভেবেই নিয়েছিলুম, এ বোধ হয় পুলিশ! কারণ সেই মুহূর্তে পুলিশ ছাড়া আমার মাথায় আর কী ঠাঁই পাবে! সুতরাং আমি তখনই মনে মনে তৈরি হয়ে গেছি, এক্ষুনি মরব আমরা। এই বোধ হয় পুলিশের গুলি এসে লাগল আমাদের বুকে।
কিন্তু আশ্চর্য, সেই অবস্থায় সেইখানে অনেকক্ষণ জবুথবুর মতো দাঁড়িয়ে থেকেও পুলিশের গুলির আওয়াজ অথবা অন্য কোনো শব্দ আমরা শুনতে পেলুম না। এমনকী আর কিছু নজরেও পড়ল না। তখনই আবার ভয়-জড়ানো গলায় আনাতিদাদাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘পুলিশ?’
আনাতিদাদা হাতের রিভলভারটা তেমনি হাতে উঁচিয়ে বলল, ‘বোধ হয় না।’
আমি বললুম, ‘তবে?’
‘বুঝতে পারছি না।’
পুলিশ নয়, এই কথাটা শুনে আমার আরও গোলমাল হয়ে গেল সব কিছু। পুলিশ না হলে আর কী হতে পারে? এমন ঘন জঙ্গলে, এই গভীর রাতে আর কে আমাদের লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখবে? আমি ভেবে কূল পাচ্ছি না। এমন সময় আনাতিদাদা হঠাৎ আমার হাতটা আবার ধরল। একটু দূরে সরিয়ে আনল। অবশ্য আনাতিদাদা তার চোখের দৃষ্টিটা সেই ঝোপের দিকেই স্থির রেখে দিল। তারপর তড়িৎগতিতে আর একটা মস্ত গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। সেখান থেকে উঁকি-ঝুঁকি মারতে লাগলুম।
অনেকক্ষণ পরে যখন মনে হল, তেমন কিছু নয়, তখন আমার নিশ্বাসের শব্দটাও প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু তবু আনাতিদাদাকে নিশ্চিন্ত হতে দেখলুম না। তার হাবেভাবে মনে হল না, এই গাছটার আড়াল থেকে আনাতিদাদা এখনই বেরিয়ে পড়বে। সুতরাং মনে মনে ভেবে নিলুম, তাহলে বোধ হয় বিপদ এখনও কাটেনি। কাজেই আনাতিদাদার গা ঘেঁষে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলুম।
এমন সময় হঠাৎই আমার মনে হল, আমার পিঠের ওপর যেন একটা গরম বাতাস ধাক্কা মারছে! আমি বুঝতে পারলুম, এ কারো নিশ্বাসের ধাক্কা! নিশ্চয়ই আমার পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে! ঝট করে পিছন ফিরে তাকাতেই আমি ভয়ে নিথর পাথর! আমার পেছনে তখন কোনো পুলিশ না, কোনো মানুষ না। একটা অচেনা জন্তু! জন্তুটা তার মাথাটাকে আমার পিঠে টিপ করে দাঁড়িয়ে আছে! মনে হল, এই বুঝি ঢু মেরে আমার পিলে ফাটিয়ে দেয়! বুঝতেই পারছ, আমি নেহাতই ছোটো। সুতরাং আমার পক্ষে সেই ভয়ংকর চেহারার জন্তুটাকে দেখে, সেই সময় চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা কি সম্ভব? আমি চিৎকার করে উঠলুম, ‘আনাতিদাদা–
আচমকা আমার এমন চিৎকার শুনে আনাতিদাদাও বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেই জন্তুটার দিকে নজর পড়তেই আঁতকে চিৎকার করে উঠল, ‘ইসতাসি, বাইসন!’ বলেই আমার হাতটা ধরে মারল লাফ! তারপর দৌড়!
আমি বুঝতে পারলুম,! এ-দৌড় আমাদের বাঁচার জন্যে ব্যর্থ চেষ্টা! কেননা, এখানে সহজে দৌড় দেওয়া যায় না, সে-কথা তোমাদের আগেই বলেছি। আর দৌড়তে পারলেও, জঙ্গলের জন্তুর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া আমাদের কম্ম নয়। সুতরাং আনাতিদাদা আমার হাত ধরে এর ফাঁকে ওর ফাঁকে ঘুরপাক খাচ্ছে বটে, কিন্তু জন্তুটাও তাড়া লাগিয়ে আমাদের প্রায় কাবু করে ফেলেছে! আমরা দুজনেই এমন ভয় পেয়ে গেছলুম যে সেই সময়ে রিভলভারটা ছুড়লে যে বাঁচি সেকথা কারোরই মনে পড়ল না! একবার যদি মনে পড়ত, তবে প্রাণ বাঁচাতে এত ছোটাছুটির দরকারই হত না! তাছাড়া জন্তুটার জঙ্গলের ঘোঁতঘাঁত সবই জানা! আমরা তার সঙ্গে পারব কেন! চরকি খেতে-খেতে আমাদের যতই দম ছুটে যায়, বাইসনটার ততই যেন তেজ বাড়ে! শেষমেশ আমারই পিঠের ওপর সেই বিকট চেহারার বাইসনটাটেনে মারল এক গোঁত্তা! আমি আর কিছু জানি না। শুধু এইটুকু মনে আছে, বাইসনের মাথার সেই প্রচণ্ড গোত্তা যখন আমার পিঠে এসে পড়ল মনে হল, যেন খুব উঁচু একটা পাহাড়ের ওপর থেকে একটা পাথরের চাঁই আমার ঘাড়ে পড়েছে। আমি গুঁড়িয়ে গেছি! আমার টুকরো-টুকরো হাড়গোড়গুলো সাত হাত দূরে-দূরে ছিটকে ছড়িয়ে গেছে। তারপরেই আমার চোখে সব অন্ধকার!
.
ধীরে-ধীরে আমার চোখের অন্ধকার যখন কেটে গেল, তখন রাতের অন্ধকারও চলে গেছে। আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে। কিন্তু কেমন যেন একটা আচ্ছন্নভাব। আমি কিছুই ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলুম না। সবই কেমন সেন অস্পষ্ট! সুতরাং আমি বুঝতে পারলুম না, এখন আমি কোথায় শুয়ে আছি!