ক্যারাটে মৃত্যুবাহী
কুস্তি এবং মুষ্টিযুদ্ধ বা বক্সিংকে যদিও খেলা বলেই ধরা হয়, আর কুস্তি ও মুষ্টিযুদ্ধের প্রতিযোগিতার আয়োজনও হয়ে থাকে, তবে এই দুটি খেলা হাতাহাতি লড়াইয়ের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু ক্যারাটে খেলা নয়–এটা সত্যিই লড়াই, নিরস্ত্র যুদ্ধ। জাপানে কেউ ক্যারাটে নামক রণবিদ্যা আয়ত্ত করতে পারলে, অর্থাৎ জাপানের কোনো ক্যারাটে বিদ্যালয় থেকে কোনো ছাত্রকে ক্যারাটে-বিশারদ বলে স্বীকৃতি দিলে জাপানি পুলিশের কাছে উক্ত ছাত্রের নাম রেজিস্ট্রি করতে হয় এবং এই কথা বলে মুচলেকা দিতে হয় যে, উক্ত ক্যারাটে-যোদ্ধা প্রাণ বিপন্ন না হলে কখনো মারামারি করবে না।
তবু মুচলেকা দিলেও সবসময় কি কথা রাখা যায়? আর মুচলেকা তো জাপানি পুলিশের কাছে, যদি কোনো ক্যারাটে-যোদ্ধা জাপানের বাইরে তার বিদ্যাকে হাতেনাতে প্রয়োগ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করবে কে?
দক্ষ ক্যারাটে-বিশারদ গুলি ভরতি রাইফেলের মতোই ভয়াবহ। রাইফেলের সেফটি ক্যাচ তুলে ট্রিগার টিপলেই অস্ত্রটি সগর্জনে মৃত্যু পরিবেশন করে। ক্যারাটের নীতিশিক্ষা ওই সেফটি ক্যাচ–ক্যারাটে-যোদ্ধা যদি কখনো নিজের উপর সংযম হারিয়ে তার নীতি ভুলে যায়, তবে রাইফেলের গুলির মতোই নিদারুণ আঘাত এসে পড়ে বিপক্ষের উপর। সেই আঘাতের ফলে আহত ব্যক্তির সাংঘাতিক দৈহিক ক্ষতি হতে পারে। এমনকী মৃত্যু হওয়াও অসম্ভব নয়। অস্ত্রধারী মানুষের চাইতেও ক্যারাটে-বিশারদ অধিকতর বিপজ্জনক ব্যক্তি, কারণ অস্ত্র দেখে লোকে সাবধান হতে পারে কিন্তু ক্যারাটেকে চোখে দেখা যায় না–ক্যারাটে-যোদ্ধা এই প্রাণঘাতী অদৃশ্য অস্ত্রকে বহন করে সর্বাঙ্গে, মুহূর্তের মধ্যে প্রয়োগকারীর মুষ্ট্যাঘাত, পদাঘাত বা আঙুলের খোঁচায় : নির্দয় মৃত্যুর পরোয়ানা নেমে আসতে পারে কলহে নিযুক্ত বিপক্ষের উপর। ক্যারাটে নামক রণবিদ্যা যে আয়ত্ত করেছে, সে কখনো নিজের ওপর সংযম হারিয়ে ফেললে ঘটনার পরিণতি যে কতটা ভয়ানক হতে পারে নিম্নে পরিবেশিত কাহিনিটি তার প্রমাণ :
আমেরিকার এক ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক জাপানের ইয়োকোহামা নামক স্থানে দু-বছরের জন্য কার্যে নিযুক্ত হন। একটি আমেরিকান ব্যবসায়ী সংস্থা জাপান সরকারের সঙ্গে ব্যাবসায়িক চুক্তি করেছিল, ওই সংস্থার পক্ষ থেকে নিয়োগ করা হয়েছিল উল্লিখিত ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোককে। ওই আমেরিকান ভদ্রলোক অবশ্য আমাদের কাহিনির নায়ক নন, নায়কের স্থান অধিকার করেছে তার ছেলে জো লার্কিন। ছোটোবেলা থেকেই জো বেশ শক্তিশালী। কিছুদিন সে মুষ্টিযুদ্ধ অভ্যাস করেছিল। এমনকী মুষ্টিযুদ্ধকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার কথাও তার মনে হয়েছিল। পেশাদার মুষ্টিযোদ্ধার উপযুক্ত শরীর ছিল তার দৃঢ় পেশি, দ্রুত গতি আর দুরন্ত সাহস। দরকার ছিল শুধু উপযুক্ত শিক্ষা আর নিয়মিত অভ্যাস।
জাপানে এসে জো মুষ্টিযুদ্ধের পরিবর্তে ক্যারাটের প্রতি আকৃষ্ট হল। কঠিন পরিশ্রমের ব্যাপার। হাতের মুঠি পাকিয়ে ঘুসি মারতে এবং তালুর পাশ দিয়ে কাটারির মার অভ্যাস করতে করতে দারুণ ব্যথায় হাত অসাড় হয়ে আসে, ঘণ্টার পর ঘন্টা কঠিন পরিশ্রমে আড়ষ্ট হয়ে যায় বাহুর পেশি, নগ্নপদে কঠিন বস্তুর ওপর লাথি মারতে মারতে ভেঙে যায় পায়ের আঙুল, আর
আর এই কষ্ট সহ্য করে টিকে থাকতে পারলেই অভ্যাসকারীর সাধনায় সিদ্ধিলাভ!
দুই বৎসর কঠিন পরিশ্রমের পর জো লার্কিন ক্যারাটে রণবিদ্যা আয়ত্ত করতে সমর্থ হল। আর তখনই ক্যারাটের বিধিনিষেধ সম্পর্কে তাকে সাবধান করে দেওয়া হল–প্রাণ বিপন্ন না হলে লড়াই করা চলবে না। অপমানিত হলেও অপমান সহ্য করতে হবে। ক্যারাটে বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাকে ক্যারাটে-যোদ্ধা বলে স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গেসঙ্গে জাপানি পুলিশের খাতায় তাকে নাম লেখাতে হয়েছে রাস্তায় বা কোনো দোকানের মধ্যে মারামারি করলে ক্যারাটে-যোদ্ধা আইনত অপরাধী, তাকে শাস্তি দেওয়া হবে সরকার থেকে।
–অপমানিত হলেও সহ্য করতে হবে?
–হ্যাঁ, সেটাই নিয়ম। ক্যারাটে-যোদ্ধার মারামারি করার উপায় নেই। শুধুমাত্র জীবন বিপন্ন হলেই সে লড়াই করতে পারে।
জো লার্কিন তার আত্মজীবনীতে বলেছে, এত সব বিধিনিষেধ আছে জানলে সে ক্যারাটে শিখত কি না সন্দেহ।
তবে জোকে বেশিদিন জাপানে থাকতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই নিজের দেশ আমেরিকায় ফিরে এসেছিল সে। তার বয়স তখন উনিশ। সেই তরুণ বয়সেই জাপানি পুলিশের খাতায় ক্যারাটে-যোদ্ধা বলে তার নাম উঠে গেছে।
দেশে এসে আমেরিকার সেনাবাহিনীতে নাম লেখাল জো। আর্মি ট্রেনিং বা সামরিক শিক্ষা বেশ কঠিন, কিন্তু ক্যারাটে শিক্ষার ভয়ংকর পাঠশালায় পাঠ নেওয়ার পর সামরিক শিক্ষা জোর কাছে বাগান থেকে ফুল ভোলার মতোই সহজ মনে হয়েছিল। অতি অল্পদিনের মধ্যেই সে সার্জেন্ট হল। তারপর তাকে পাঠানো হল সমুদ্র পার হয়ে অন্য দেশে।
এতদিন তার সাংঘাতিক বিদ্যাকে হাতেনাতে প্রয়োগ করার সুযোগ পায়নি জো, এইবার ক্যাসাব্লাংকা নামক ফরাসিদের আস্তানায় সে নিজের ক্ষমতা যাচাই করার সুযোগ পেল। অবশ্য এর আগে ঝগড়া বা মারামারির সম্ভাবনা কখনো হয়নি এমন নয়। প্ররোচনা এসেছে ভীষণভাবে। কিন্তু ইয়াকোহামার প্রফেসর সাতো বার বার সাবধান করে ভয় দেখিয়েছিলেন–খুনের দায়ে পড়ার অনেক ঝামেলা। সেই ঝামেলার ভয়েই অনেক সময় অপমান সহ্য করে সরে এসেছে। জো, অপমানকারীকে আঘাত করার চেষ্টা করেনি কখনো। একবার মারামারি বাধলে মেপে মেপে ওজন বুঝে আঘাত করা সম্ভব নয়। ক্যারাটে মৃত্যুবাহী দেহের দুর্বল স্থানে ক্যারাটের আঘাত মৃত্যুকে ডেকে আনতে পারে মুহূর্তের মধ্যে। এসব কথা খুব ভালোভাবেই জানত জো, তাই ঝগড়ার সূত্রপাত হলে সে সতর্ক হয়ে যেত। সে মিষ্টি কথায় ঝগড়া এড়িয়ে যেতে শিখেছিল; তবু যখন মাথায় রাগ চড়ে যাওয়ার উপক্রম হত, তখন দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখত প্রবল ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে।
তবু মানুষ তো যন্ত্র নয়, সংযমের বাঁধন একদিন ছিঁড়ল। যাকে কেন্দ্র করে ব্যাপারটা ঘটল, সেই লোকটা জাহাজি শ্রমিক, আলজিরিয়ার মানুষ। মানুষটা প্রায় সাড়ে ছয় ফুট উঁচু, বিশাল বুক, চওড়া কাঁধ, মুখের ডান দিকে চোখের তলা থেকে চিবুক পর্যন্ত ছুরিকাঘাতের শুষ্ক ক্ষতচিহ্ন–এক নজর দেখলেই বোঝা যায় সে দাঙ্গাহাঙ্গামায় অভ্যস্ত। আলজিরিয়ানটি পানাগারে মদ্যপান করতে এসেছিল। জো দেখল, সে বেশ মাতাল হয়ে পড়েছে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে লোকটা গেলাসের পর গেলাস মদ গিলছিল, তখনও পর্যন্ত কোনো গোলমাল করেনি, কিন্তু তার হাত অল্প কাঁপছিল নেশার ঝেকে।
দুর্ভাগ্যক্রমে জো দাঁড়িয়ে ছিল লোকটার খুব কাছেই। হঠাৎ আলজিরিয়ান শ্রমিকটি হাত বাড়িয়ে জো-র হাতের গেলাস ধাক্কা মেরে ফেলে দিল।
তুই একটা শুয়োর, গর্জন করে মাতাল আলজিরিয়ান, তুই একটা দুর্গন্ধ শুয়োর। তোর গাঁ থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরোচ্ছে।
ঠিক, ঠিক, একটু হেসে ঝগড়া এড়িয়ে যেতে চাইল জো, তুমি বরং আর এক গেলাস মদ নাও।
মুখে হাসলেও জো-র মাথায় তখন আগুন জ্বলছে। ক্যারাটে না-শিখলে সে নিশ্চয়ই লোকটার চোয়ালে ঘুসি বসিয়ে দিত। কিন্তু ক্যারাটের শিক্ষা তাকে প্রতিরোধ করল না, এখনও তার প্রাণ বিপন্ন হয়নি, এখনও আঘাত হানবার সময় আসেনি। কিন্তু বহুদেশের বহু লোক সেখানে জমায়েত হয়েছে, তাদের সামনে নিজেকে কাপুরুষ ভীরু প্রতিপন্ন করতে জো লার্কিনের খুবই খারাপ লাগছিল–তবু আশ্চর্য সংযমের পরিচয় দিল সে, দুই হাত তাড়াতাড়ি ঢুকিয়ে দিল প্যান্টের পকেটে।
হঠাৎ মাতালটা জো লার্কিনের মুখের ওপর থুথু ছিটিয়ে দিল, তারপর বুনো জানোয়ারের মতো গর্জে উঠে একটা মদের বোতল টেবিলে ঠুকে ভেঙে ফেলল। পলকের মধ্যে বোতলের তলার দিকে আত্মপ্রকাশ করল ধারালো ছুরির মতো অনেকগুলো ভাঙা কাঁচের টুকরো।
সেই ভাঙা বোতলের গলার দিকটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধারালো কাঁচগুলো সজোরে জো-র মুখের ওপর বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল মাতাল, কিন্তু জো চটপট সরে যাওয়ায় মাতালের চেষ্টা সফল হল না।
লোকজন তখন চিৎকার করে মাতালের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে, মেয়েরা আর্তনাদ করছে ভীতস্বরে।
দ্বিতীয় বার আঘাত হানল মাতাল। আবার সরে গেল জো। বোতলের ধারালো কাঁচগুলো জো-র মুখের কয়েক ইঞ্চি দূরে শূন্যে ছোবল মারল।
এবার আর জো-র হাত দুটো পকেটের ভিতর নেই, বেরিয়ে এসেছে। এখনও জো আশা করছে কেউ মাতালটাকে ধরে ফেলবে, পকেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা ভয়ংকর হাত দুটো বোধ হয় ব্যবহার করার দরকার হবে না। কিন্তু ভীষণদর্শন মাতাল নিগ্রোটার সামনে কেউ এগোল না, সকলেই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে একটা রক্তাক্ত দৃশ্যের প্রতীক্ষা করতে লাগল।
জো লার্কিনের সহকর্মী কয়েকটি সৈন্য অবশ্য সেখানে ছিল, তারা ভয় পায়নি, ব্যাপারটা উপভোগ করছিল। জো-র মুখে তারা শুনেছে সে ক্যারাটে-যোদ্ধা, হঠাৎ খুনের দায়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে বলে সে মারামারির মধ্যে যেতে চায় না। অথচ তাদের সামনে জো কার্যকলাপে কোনো প্রমাণ রাখেনি! তাই আজ তারা নিশ্চেষ্ট–শুধু মুখের কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়, তারা দেখতে চায় হাতের কাজ।
পানাগারের ভিতর বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল মাতাল আর জো। কয়েকবার ভাঙা বোতল উঁচিয়ে আঘাত হানতে চেষ্টা করল মাতাল। প্রত্যেকবারই সরে গিয়ে লোকটার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল জো, ছুরির মতো ধারালো কাঁচগুলো একবারও জোর মুখ স্পর্শ করতে পারল না।
বার বার ব্যর্থ হয়ে লোকটা খেপে গেল। হঠাৎ সে বোতলটা ছুঁড়ে মারল জো-র মুখ লক্ষ করে। এবারও জো সরে গেল, কিন্তু আত্মরক্ষা করতে পারল না বোতলটা তার মাথার ওপর পড়ে ছিটকে গেল অন্যদিকে।
আঘাতের ফলে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল জো… কয়েক মুহূর্তের স্তম্ভিত অনুভূতি… মাথা বেয়ে নামছে তপ্ত তরল একটা ধারা… রক্ত!
জো সামলে ওঠার আগেই মাতাল তাকে আক্রমণ করেছে। এবার তার হাতে ঝকঝক করছে। ধারালো ছুরি।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে জো-র মগজের মধ্যে কী যেন ঘটল..সেফটি ক্যাচ! ক্যারাটে শিক্ষার সেফটি ক্যাচ এখন সরে গেছে, এখন সে আক্রান্ত, তার জীবন এখন বিপন্ন, লড়াই করার অধিকার এখন তার আছে।
উদগ্র ক্রোধ এইবার মুক্তি পেল, জোর কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল ভয়ংকর চিৎকার!
জোর বাঁ-হাত কাটারির মতো পড়ল শত্রুর ছুরি ধরা পুরোবাহুর (forearm) উপর। অনভ্যাসের ফলে আঘাতের শক্তি কমে গেছে, তাই ছুরিটা মাতালের হাত থেকে খসে পড়ল, কিন্তু হাতটা অবশ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সেই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সামলে নিয়ে জো শত্রুর পরবর্তী আক্রমণের প্রতীক্ষা করতে লাগল।
মাতাল জো-র পেট লক্ষ করে ছুরি চালাল। জো একপাশে সরে গেল, তারপর ডান হাত বাড়িয়ে মাতালের ছুরি ধরা হাতের কবজি চেপে ধরল। পরক্ষণেই তার বাঁ-হাত কাটারির মতো মাতালের বাহুর পেশিতে আঘাত করে ছুরি ধরা হাতটাকে অসাড় করে দিল। ..
এইবার ক্যারাটের খেলা–মাতাল ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই তার শত্রু চট করে একপাশে ঘুরে গিয়ে নিজের বাঁ-কাঁধের উপর রাখল, সঙ্গেসঙ্গে পাঁজরের ওপর নিদারুণ কনুইয়ের গুঁতো সেই আঘাত সামলে ওঠার আগেই মাতালের ছুরি সমেত হাতটা সবেগে শূন্যে উঠে প্রবল আকর্ষণে শত্রুর কাঁধের উপর পড়ল, তৎক্ষণাৎ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল কনুইয়ের হাড়!
ক্যারাটের মার–পৃথিবীর কোনো ডাক্তারই সেই হাড়কে আর জোড়া লাগাতে পারবে না!
ছুরিটা অনেক আগেই পড়ে গেছে মেঝের উপর। বিস্ময়-বিস্ফারিত ভীত দৃষ্টিতে মাতাল দেখল, তার ডান হাতটা ভাঙা অবস্থায় নড়বড় করে ঝুলছে!
তবু সে হার মানল না। বুনো জানোয়ারের মতো গর্জন করে সে শত্রুর পেট লক্ষ করে লাথি ছুড়ল। লাথি লাগল না, কিন্তু তার পায়ের গোড়ালি ধরা পড়ল শত্রুর মুঠোর মধ্যে পরক্ষণেই এক হ্যাঁচকা টান এবং মাতাল হল মেঝের উপর লম্বমান!
এইবার জো-র ভারী জুতো সমেত লাথি এসে পড়ল মাতালের তলপেটে, সঙ্গেসঙ্গে লড়াই শেষ। লোকটা হাঁফাতে হাঁফাতে আর্তনাদ করতে লাগল। হঠাৎ এক ঝলক বমি বেরিয়ে এসে তার আর্তকণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিল।
শায়িত শত্রুর দিকে মুহূর্তের জন্য দৃষ্টিপাত করল জো। তার বুকের ভিতর জেগে উঠেছে। রক্তলোভী দানবের হিংস্র উল্লাস–পলকে নীচু হয়ে মাতালের হাতটা চেপে ধরে সে মোচড় দিল, একেবারে চুরমার হয়ে ভেঙে গেল হাতটা। আবার একটা আর্ত চিৎকার। আবার এক ঝলক বমি। তারপরই অজ্ঞান হয়ে গেল লোকটা।
পানশালার মধ্যে অন্তত বারো রকমের বিভিন্ন জাতির লোক ছিল। সবাই নির্বাক, স্তব্ধ, শেষকালে ধরাশায়ী শত্রুর ওপর জো-র অমানুষিক অত্যাচার তাদের বিস্ময় ও আতঙ্কে স্তব্ধ করে দিয়েছে। জো-র সঙ্গীদের মুখেও কথা নেই, তাদের দৃষ্টি আতঙ্কে বিস্ফারিত–তারা যেন চোখের সামনে এক অপার্থিব বিভীষিকা দেখছে।
কেউ একটি কথা বলল না। জো এতক্ষণে নিজেকে বুঝতে পারছে। ক্যারাটে তার ভিতর এক রক্তলোভী হিংস্র দানবের জন্ম দিয়েছে, যে-দানব অপরকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়। ভাঙা হাতটাকে মুচড়ে দিয়ে লোকটাকে যন্ত্রণা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তলপেটে লাথি না-মেরেও সে লোকটাকে কাবু করতে পারত। অবরুদ্ধ হিংসা মুক্তি পেয়েই তার প্রবৃত্তি চরিতার্থ করেছে যথেচ্ছভাবে। হঠাৎ তীব্র বিবমিষা জো-কে অস্থির করে তুলল, কোনোরকমে প্রস্রাব আগারে ঢুকে সে বমি করে ফেলল।
বেরিয়ে এসে জো দেখল, পানাগারের ভিতরে অবস্থা যেন কিছুটা স্বাভাবিক। ভিড়ের মধ্যে কেউ অ্যামবুলেন্স ডেকে পাঠিয়েছে। ফরাসি সাইরেনের উৎকট ধ্বনি কানে এল। পুলিশ আসছ। জো বিশেষ ভয় পেল না। প্রথমে ভাঙা বোতল, পরে ছুরি নিয়ে লোকটা যে তাকে আক্রমণ করেছিল, সেই দৃশ্য বহু লোক দেখেছে। সে যে মারামারি করতে চায়নি বরং এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে সেটাও প্রমাণ করা কঠিন হবে না–বহু মানুষের চোখের সামনে এসব ঘটনা ঘটেছে। না, পুলিশকে নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে না, মূৰ্ছিত লোকটির কথাই চিন্তা করছে সে। হঠাৎ পকেট থেকে অনেকগুলো ডলার বার করে সে অচেতন মানুষটার পকেটে গুঁজে দিল। আলজিরিয়ান নিগ্রোর ভাঙা হাড় আর জোড়া লাগানো যাবে না, কিন্তু ওই টাকায় অন্তত ভালোভাবে চিকিৎসা করার সুযোগ সে পাবে।
কয়েকটা দিন কাটল। সেনানিবাসের সকলেই অকুস্থলে উপস্থিত সৈনিকদের মুখ থেকে ব্যাপারটা শুনেছে। হঠাৎ একদিন জো আবিষ্কার করল সে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। কেউ তার সঙ্গে কথা কইতে চায় না। জো নানাভাবে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা জমাতে চেষ্টা করল। বৃথা চেষ্টা। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া তারা তার সঙ্গে কথা বলে না। জমাট তাসের আড্ডায় সে উপস্থিত হলে তাসের আড্ডা ভেঙে যায়। নানা ছুতোয় সকলে স্থান ত্যাগ করে। সিনেমা যাওয়ার আমন্ত্রণ এখন। কেউ তাকে করে না। বন্ধুদের মধ্যে যারা তাকে ক্যারাটের কৌশল শেখাতে অনুরোধ ছেড়ে তোষামোদ পর্যন্ত করত, তারাও এখন তাকে এড়িয়ে চলতে চায়।
ফল হল সাংঘাতিক। জো আবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছিল। হয়তো সে তার মারাত্মক বিদ্যাকে দ্বিতীয় বার প্রয়োগ করত না। কিন্তু সবাই তাকে এড়িয়ে চলছে দেখে সে মনে মনে ভীষণ হিংস্র হয়ে উঠল। তার প্রাণঘাতী আক্রোশকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সে সুযোগের অপেক্ষায় রইল।
সুযোগ এল কিছুদিনের মধ্যেই। ছয়টি সৈন্যের সঙ্গে একদিন জো বেরিয়েছিল টহল দিতে। জো স্বয়ং ছিল দলের নেতা। নিতান্ত অভাবিতভাবেই হঠাৎ একটি জার্মান সৈন্য তাদের সামনে এসে পড়ল। সৈন্যটি তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণ করল, সে নাকি পথ হারিয়েছে। আমেরিকান সৈন্যরা অস্বস্তি বোধ করতে লাগল–নির্দিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করার জন্য তারা টহল দিতে বেরিয়েছে, এখন বন্দিকে নিয়ে আস্তানায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।
জার্মান সৈন্যটি যখন বুঝল তাকে গুলি করা হবে না, সে আশ্বস্ত হল। দেখা গেল সে ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। জো তাকে কিছু খাদ্য আর সিগারেট দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দেহটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল–হ্যাঁ, লম্বায়-চওড়ায় জার্মানটি প্রায় তারই মতো, আঁটোসাঁটো শরীরটা দেখলে মনে হয় সে ব্যায়ামে অভ্যস্ত। জো বন্দির সঙ্গে কথা বলছিল। তার সঙ্গীরা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল। বন্দিকে নিয়ে যে-সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, জো যে তার সমাধান করতে চাইছে সেটা তারাও বুঝতে পারছিল। এই ভয়ংকর ক্যারাটে-যোদ্ধাটি যে কেমন করে এই সমস্যার সমাধান করবে সেটাও তারা আন্দাজ করতে পারছিল–তাই বন্দির সঙ্গে কথা বলতে তারা বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করেনি।
জো বন্দিকে প্রশ্ন করল, তুমি কখনো বক্সিং লড়েছ? জার্মান বন্দির বলিষ্ঠ দেহ আর ভাঙা নাকের গড়ন দেখেই জো-র ওই প্রশ্ন। অনুমান নির্ভুল। বন্দি জানাল ১৪ বছর বয়স থেকেই সে বক্সিং লড়ছে। তা ছাড়া ফুটবল খেলার অভ্যাসও তার আছে।
বাঃ! চমৎকার! জো বলল, শোনো, তোমার সঙ্গে একটা চুক্তি করছি। আমরা হাতাহাতি লড়াই করব। যদি আমাকে হারাতে পারো তাহলে তোমায় মুক্তি দেওয়া হবে। ঠিক আছে?
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, জার্মান বন্দি বলল। তার কণ্ঠস্বরে আতঙ্কের আভাস। সে বোধ হয় বুঝেছিল তার বিপদ আসন্ন।
তুমি ঠিকই বুঝেছ, জো বলল, নাও, তৈরি হও। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।
জো জামা খুলে ফেলল। বন্দিও তার উদাহরণ অনুসরণ করল। জো দেখল, বন্দির বুক বেশ চওড়া, হাত-পায়ের কঠিন মাংসপেশি বন্দির দৈহিক শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। জো খুশি হল। শক্তিশালী মানুষ না হলে লড়াই করে সুখ নেই।
জো-র সঙ্গীরা নীরব। তারা জানত জো ক্যারাটে-যোদ্ধা, তার ভয়াবহ খ্যাতি তাদের কানেও এসেছে। এখন তারা স্তব্ধ হয়ে জো-র কার্যকলাপ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।
লড়াইয়ের শুরুতে জার্মান সৈন্যটি বিশেষ উৎসাহ দেখাল না। জো প্রতিরোধের ভঙ্গিতে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ায়নি, মুখ আর শরীর প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে উন্মুক্ত বন্দি তবুও নিশ্চেষ্ট, তার আঘাত হানা উদ্যম নেই কিছুমাত্র।
জো এবার বন্দিকে উত্তেজিত করতে সচেষ্ট হল, সে সজোরে চড় মারল বন্দির গালে, আমি জানি নাজিরা ভীরু, কাপুরুষ। তোমাদের লড়াই করার সাহস নেই। সঙ্গেসঙ্গে গালাগালি।
এবার কাজ হল। বন্দির চোখে-মুখে ফুটল ক্রোধের আভাস। সে এগিয়ে এসে সজোরে ঘুসি ছুঁড়তে লাগল। একটা ঘুসিও অবশ্য জো-কে স্পর্শ করতে পারল না। সুকৌশলে আঘাতগুলো এড়িয়ে গেল জো।
জো এবার কাজ শুরু করল, ডান হাতের বুড়ো আঙুল করতল চেপে রইল, আঙুলগুলো ছুরির মতো আড়ষ্ট, শক্ত–পরক্ষণেই সেই কঠিন আড়ষ্ট আঙুলগুলো দারুণ জোরে ছোবল মারল প্রতিদ্বন্দ্বীর পেটের মাঝখানে। দারুণ যাতনায় জার্মান বন্দির শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল, তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
আবার শ্বাস টেনে নিজেকে প্রস্তুত করার আগেই জো-র বাঁ-হাতের বজ্রমুষ্টি হাতুড়ির মতো আছড়ে পড়ল বন্দির ওষ্ঠের ওপর। কয়েকটা দাঁত ভেঙে গেল সঙ্গেসঙ্গে। ক্যারাটে-ঘুসি সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে ওই আঘাতেই দাঁতের পরিবর্তে মুখের হাড় ভাঙত, তারপর আর এক ঘুসিতে ভাঙা হাড়গুলো পৌঁছে যেত মগজের মধ্যে। ইচ্ছে করেই ভুল করেছিল জো, ক্যারাটের মরণমার মারতে চায়নি সে। লড়াইটাকে দীর্ঘস্থায়ী করে বন্দিকে যন্ত্রণা দিয়ে ধীরে ধীরে হত্যা করতে চাইছিল সে।
নাজি বন্দিটি ভীষণভাবে আহত হলেও তখন পর্যন্ত মারামারি করার ক্ষমতা হারায়নি। সে বুঝেছিল শত্রুকে পরাস্ত করতে না-পারলে তার মৃত্যু নিশ্চিত, অতএব হিংস্র আক্রোশে সে এবার জো-র ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জো শান্তভাবে অপেক্ষা করছিল তার ডান হাত তলার দিকে ঝুঁকে পড়েছে আর আঙুলগুলো খুলে ছড়িয়ে রয়েছে উপযুক্ত জায়গায় ছোবল মারার জন্য।
ক্যারাটে শিক্ষায় ওই ভঙ্গিকে বলে নাকিতে–অতি ভয়ংকর ওই খোলা আঙুলের নিষ্ঠুর আঘাত।
জো আঘাত হানল। বন্দির নাকের দু-পাশ দিয়ে সটান দুই চোখে খোঁচা মারল আঙুলগুলো। তৎক্ষণাৎ বন্দির দুই চক্ষু হল রক্তাক্ত, অন্ধ।
ওইভাবে আঘাত হানার কৌশল শিখলেও হাতেনাতে কখনো সেই শিক্ষাকে প্রয়োগ করার সুযোগ পায়নি জো। আঙুলগুলোকে লোহার মতো শক্ত করে নির্ধারিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে সে ক্যারাটে শিক্ষার বিদ্যালয়ে, কিন্তু আঘাত হানতে পারেনি কারণ, অংশীদার সহকর্মীর বিপদ ঘটতে পারে। এতদিন পরে ওই ভয়ংকর কৌশলকে বাস্তবে বাস্তবায়িত করবার সুযোগ পেল জো।
বন্দির অবস্থা তখন শোচনীয়। জো-র বন্ধুরাও তার নিষ্ঠুরতা দেখে চমকে গেছে। ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে আতঙ্ক-বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে তারা তাকিয়ে আছে জোর দিকে। যাতনাকাতর অন্ধ বন্দি তখন অসহায়ভাবে আর্তনাদ করছে অস্ফুট কণ্ঠে–হিংস্র পশুর মতো জো তার ওপর লাফিয়ে পড়ল। প্রথমে বন্দির বাঁ-হাত, তারপর ডান হাত ভাঙল জো। সঙ্গেসঙ্গে ক্রুদ্ধ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল জো-র সহকর্মী সৈনিক ছয়জন। জো বুঝল, বন্দির উপর আর অত্যাচার করলে সৈন্যরাই খেপে যেতে পারে। ছয়টি রাইফেলধারী মানুষকে উত্তেজিত করা ক্যারাটে–যযাদ্ধার পক্ষেও বিপজ্জনক, অতএব জো হাতের কাজ শেষ করতে সচেষ্ট হল। মৃত্যুবাহী ক্যারাটের এক দারুণ আঘাতে বন্দির নাকের হাড় ভেঙে মগজে প্রবেশ করল, হতভাগ্যের মৃত্যু হল তৎক্ষণাৎ।
ক্যারাটের নিয়ম লঙ্ঘন করেছিল জো। আত্মরক্ষার জন্যই ওই অদ্ভুত প্রাচ্যদেশীয় রণকৌশল শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু জো তার বিদ্যাকে প্রয়োগ করেছিল অন্তরে নিহিত হিংস্র উল্লাস চরিতার্থ করার জন্য। এবং সেইজন্য সে অনুতপ্ত হয়নি কিছুমাত্র।
যথাসময়ে সদরে রিপোর্ট গেল বন্দি নাকি পলায়নের চেষ্টা করেছিল, তাই তাকে হত্যা করা হয়েছে। জো-র সঙ্গীরা চুপ করে রইল। জার্মানদের চাইতেও সার্জেন্ট জো লার্কিন সম্পর্কে তাদের ভীতি ছিল অনেক বেশি।
কিছুদিন পরে আবার ক্যারাটেকে কাজে লাগানোর সুযোগ পেল জো লার্কিন। একটি জার্মান ক্যাপ্টেনকে মার্কিন সেনানিবাসে বন্দি করে আনা হয়েছিল। লোকটা ঝটিকা-বাহিনীর ক্যাপ্টেন, হিটলারের অন্ধ ভক্ত, গোঁড়া নাজি–শত্রুপক্ষের প্রত্যেকটি মানুষ তার কাছে অতিশয় ঘৃণ্য।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ অনুসারে মার্কিন বাহিনীর ক্যাপ্টেন জোন্স ওই নাজি বন্দিকে কয়েকটা প্রশ্ন করে। জোন্স আদর্শ ভদ্রলোক, প্রশ্ন করার আগে বন্দির হাতে সে এক গেলাস মদ তুলে দিয়েছিল। হতভাগা নাজি এমন ভালো ব্যবহারের মূল্য দিল না–গেলাসের মদ জোন্সের মুখে ছিটিয়ে দিয়ে সে সজোরে পদাঘাত করল তার পেটে!
আর কিছু করার আগেই প্রহরীরা তাকে ধরে ফেলল। ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে জোনস আর্তনাদ করছে রুদ্ধস্বরে, তার পেটের নাড়ি ছিঁড়ে গেছে বুটসমেত লাথির আঘাতে।
হাসপাতালে যাওয়ার আগে জো লার্কিনকে ডেকে পাঠাল ক্যাপ্টেন জোন্স। যদিও জোন্স কখনো জো লার্কিনের সঙ্গে ক্যারাটে সম্পর্কে কোনো প্রসঙ্গ তোলেনি, তবু জো সম্পর্কে কিছু গুজব তার কানে এসেছিল নিশ্চয়ই।
জো আসতেই ক্যাপ্টেন জোন্স বলল, বন্দিকে এইবারতুমি প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করবে। তারপর জো-কে কাছে আসতে ইশারা করে জোন্স মৃদুস্বরে বলল, ওই শয়তানটাকে নিয়ে তুমি যা খুশি করতে পারো। পরিণামের কথা ভেবে ভয় পেয়ো না। আমি তোমাদের ক্যাপ্টেন, আমি তোমাকে সবসময়ই সমর্থন করব।
বাঃ! চমৎকার! জো তো এইরকমই চাইছিল। তার অন্তরের অন্তস্থলে এক ঘুমন্ত দানব জেগে উঠল হিংস্র উল্লাসে।
গেস্টাপো নামে কুখ্যাত জার্মান গুপ্ত পুলিশ কাউকে গোপনে খুন করতে হলে মধ্যরাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে তাকে নিয়ে আসে–ঠিক সেইভাবেই মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে মার্কিন প্রহরীরা নাজি ক্যাপ্টেনকে একটা ফাঁকা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বন্দি জার্মানকে তার প্যান্ট পরার সময়ও দেওয়া হয়নি, তার পরনে ছিল শুধু ছোটো হাফ প্যান্ট। ওই অবস্থায়ই তাকে নগ্নপদে হাঁটিয়ে আনা হয়েছে।
ঘরের মধ্যে অপেক্ষা করছিল জো লার্কিন। তার পোশাকে স্ট্রাইপ চিহ্নগুলোর দিকে তাকাল বন্দি, তারপর শুদ্ধ ইংরেজিতে প্রশ্ন করল, এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ কী?
হের ক্যাপিটান, জো তার শার্ট আর প্যান্ট খুলতে খুলতে বলল, তোমার ভারি বদঅভ্যাস, লোকজনকে তুমি লাথি মারো। এটা খুবই অন্যায় আর অভদ্র ব্যবহার। তোমাকে আমি আজ ভদ্রতা শিখিয়ে দেব।
হের ক্যাপিটান সঙ্গেসঙ্গে জো-র কথার আসল মানেটা বুঝতে পারল, ব্যাপারটা তার ভারি মজার মনে হল।
হো হো শব্দে হেসে সে বলল, তুমি?
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, লোকটা হাতাহাতি মারামারিতে বেশ দক্ষ, নিজের দৈহিক শক্তি সম্পর্কে তার ধারণাও যে খুবই উঁচু সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। জো প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করল–প্রায় ছয় ফুট দু-ইঞ্চির মতো লম্বা, চওড়া বলিষ্ঠ কঁধ, কোমরের দিকটা চাপা, হাতে-পায়ে কঠিন মাংসপেশির স্ফীত বিস্তারের কোথাও এতটুক মেদের চিহ্ন নেই–হ্যাঁ, লোকটা গর্ব করার মতো দেহের অধিকারী বটে। বন্দির গায়ের রং রোদে পোড়া, নিশ্চয়ই ফাঁকা মাঠে ব্যায়াম করার অভ্যাস আছে। জো ভাবল হয়তো কিছু কিছু জুডোর কায়দা লোকটা রপ্ত করেছে।
ততক্ষণে পোশাকের আবরণ থেকে মুক্ত হয়েছে জো। তার পরনে জার্মান বন্দির মতোই একটা ছোটো হাফ প্যান্ট এমনকী পায়ের ভারী বুট দুটো খুলে ফেলা হয়েছে। জুতো পায়ে লাথি মারার সুযোগ নিতে চায় না জো, তার একমাত্র ভরসা মৃত্যুবাহী ক্যারাটে।
ঠিক আছে, মুর্খ আমেরিকান শুয়োর, নাজি গর্জন করে উঠল, আমি ভদ্রতা শেখার জন্য প্রস্তুত।
লোকটার চোখে-মুখে একটা হিংস্র দীপ্তি জ্বলে উঠল, কিন্তু সে এগিয়ে এল না, প্রতিদ্বন্দ্বীর আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। জো একটু অবাক হল, লোকটার মতলব সে বুঝতে পারল না।
আচম্বিতে বিস্ময়ের চমক! ক্যারাটে! এই লোকটাও ক্যারাটে-যোদ্ধা! যেভাবে ডান পায়ের আঙুলগুলো গুটিয়ে নিয়ে সে লাথি চালাল তাতে প্রমাণ হয়ে গেল ক্যারাটের মরণ খেলায় সেও এক খেলোয়াড়।
চিবুকের উপর প্রচণ্ড পদাঘাতে ছিটকে পড়ল জো লার্কিন!
আর একটু হলেই ঘাড় ভাঙত, কোনোরকমে আত্মরক্ষা করে জো উঠে দাঁড়াল। ভালোভাবে টাল সামলে দাঁড়ানোর আগেই সে দেখতে পেল জার্মান বন্দি তাকে আক্রমণ করতে আসছে। চকিতে পিছন ফিরে পায়ের গোড়ালি দিয়ে আঘাত হানল জো। ঠিক জায়গায় সেই আঘাত লাগলে লড়াইয়ের মোড় তখনই ঘুরে যেত, তবে জো-র লাথিটা একেবারে ব্যর্থ হল না–নাজির দম বেরিয়ে গেল, সে থমকে দাঁড়াল মুহূর্তের জন্য।
লোকটা সত্যিই কঠিন ধাতুতে গড়া, আর তেমনি চটপটে। জো ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই নাজি তাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলল যে, জো দস্তুরমতো যন্ত্রণা ভোগ করল। অবশ্য জো মুহূর্তের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং তলপেট লক্ষ করে প্রাণঘাতী লাথিটা এড়িয়ে গিয়েছিল। ব্যর্থ হয়ে বন্দি আবার জোর চিবুক লক্ষ করে লাথি হাঁকাল আর একটুর জন্য ফসকে গেল। জো ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে, লোকটা ক্যারাটে জানে এবং যথেষ্ট ক্ষিপ্র, তবে সে পাকা খেলোয়াড় নয়।
সেই মুহূর্তে নাজি যেভাবে অবস্থান করছিল, তাতে জো-র পক্ষে তার চিবুকে কনুই দিয়ে আঘাত করার সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। বলাই বাহুল্য, জো সেই সুযোগ নিতে একটুও দেরি করেনি। নাজি বন্দি চোখে সর্ষে ফুল দেখতে দেখতে বসে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে জো ক্যারাটের বিশেষ পদ্ধতিতে পদাঘাত করল শত্রুর মুখে। জার্মান সৈন্যের নাক ভেঙে গেল তৎক্ষণাৎ।
আহত নাজি সেনা দারুণ আক্রোশে লাফিয়ে উঠল, তারপর ধেয়ে এল জো-কে আক্রমণ করতে। সে কিছু করার আগেই তার কণ্ঠনালীতে হাতের তালু দিয়ে কাটারির মতো আঘাত হানল জো। যন্ত্রণায় জার্মানটির মুখ নীল হয়ে গেল।
লড়াইয়ের পরবর্তী বিবরণ এমন নিষ্ঠুর যে, সেই বর্ণনা পাঠকের মনকে পীড়িত করবে। সংক্ষেপে বলছি, সৈন্যটিকে অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে অবশেষে তাকে হত্যা করেছিল জো। সকালের আলোতে জার্মান সৈন্যটির মৃতদেহের অবস্থা দেখে জো নিজেও শিউরে উঠেছিল।
লড়াইয়ের উন্মাদনা তখন কেটে গেছে, হত্যার নির্দয় লালসা তৃপ্ত হওয়ায় জো লার্কিনের বুকের মধ্যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে হন্তারক দানব অনুতপ্ত জো ক্যাপ্টেন জোন্সের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলল। কী অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে লোকটাকে সে হত্যা করেছে, তার বিশদ বিবরণ দিয়েছিল জো। সেই বিবরণ (পাঠকদের কাছে আমি যা বর্ণনা করিনি) শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ক্যাপ্টেন জোন্স।
পরবর্তীকালে সেনাবিভাগের কাজে ইস্তফা দিয়ে নাগরিকদের জীবন গ্রহণ করল জো লার্কিন। এমন একটা অফিসে সে কাজ নিয়েছিল যেখানে কারো সঙ্গে মারামারি হওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।
জো লার্কিনের সংক্ষিপ্ত কাহিনি এখানেই শেষ। কৌতূহলী পাঠকের মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে, ক্যারাটের অভিশাপ থেকে জো কি আজ মুক্ত? জো নিজেও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ নয়। তবে পরিশিষ্ট হিসাবে তার নিজস্ব বক্তব্য তার জবানিতেই পরিবেশন করছি :
পাঠক! একটা কথা বলে আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। আমার প্রকৃত নাম জো লার্কিন নয়। আপনি যদি শক্তিশালী হন আর গায়ের জোর দেখাতে গুন্ডামি করতে ভালোবাসেন, আর সেইজন্যই যদি কোনো রাত্রে কোনো রেস্তরাঁ বা পানাগারের মধ্যে খুব শান্তশিষ্ট একটি লোককে আপনার যাবতীয় অসভ্যতা সহ্য করে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে অত্যন্ত গোবেচারার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন, তবে
তবে বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। কারণ আমার দৈহিক ক্ষমতা এখনও অটুট, আর একবার মারামারি বাধলে আমি শেষ না-দেখে থাকতে পারি না।
[১৩৮৭]