৩
পরদিন সকালে ফেলুদা কৈলাসবাবুকে ফোন করে বলল তিনি যেন নিশ্চিন্তে বাড়িতে বসে থাকেন; যা করবার ফেলুদাই করবে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কখন যাবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে?’
ফেলুদা বলল, ‘কাল যে সময় গিয়েছিলাম, সেই সময়। ভালো কথা, তোর স্কুলের ড্রইং-এর খাতা, পেনসিল-টেনসিল আছে তো?’
আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম।
‘কেন, তা দিয়ে কি হবে?’
‘আছে কিনা বল না!’
‘তা তো থাকতে হবেই।’
‘সঙ্গে নিয়ে নিবি। লিলি গাছের উল্টো দিকে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে তুই ছবি আঁকবি—গাছপালা, মেমোরিয়াল বিল্ডিং—যা হয় একটা কিছু। আমি হব তোর মাস্টার।’
ফেলুদার আঁকার হাত রীতিমত ভালো। বিশেষ করে, মাত্র একবার যে-মানুষকে দেখেছে, পেনসিল দিয়ে খস্খস্ করে মোটামুটি তার একটা পোর্ট্রেট আঁকার আশ্চর্য ক্ষমতা ফেলুদার আছে। কাজেই ড্রইংমাস্টারের কাজটা তার পক্ষে বেমানান হবে না।
শীতকালের দিন ছোট হয়, তাই আমরা চারটের কিছু আগেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পৌঁছে গেলাম। সোমবার ভীড়টা আরো কম। তিনটে পেরামবুলেটার সাহেবের বাচ্চাদের নিয়ে নেপালী আয়ারা ঘোরাফেরা করছে; একটা পরিবারকে দেখে মারোয়াড়ি বলে মনে হল; আর তাছাড়া দু’-একজন বুড়ো ভদ্রলোক। এদিকটায় আর বিশেষ কেউ নেই। কম্পাউন্ডের মধ্যেই, কিন্তু গেট থেকে বেশ কিছুটা দূরে চৌরঙ্গীর দিকটায় একটা বড় গাছের তলায় দু’জন প্যান্টপরা লোককে দেখলাম, যাদের দিকে দেখিয়ে ফেলুদা আস্তে করে আমায় কনুই দিয়ে একটা খোঁচা দিল। বুঝলাম ওরাই হচ্ছে পুলিশের লোক। ওদের কাছে নিশ্চয়ই লুকোন রিভলবার আছে। ফেলুদার সঙ্গে পুলিশের কিছু লোকের বেশ খাতির আছে এটা জানতাম।
লিলি ফুলের সারির উল্টো দিকে কিছুটা দূরে খাতা-পেনসিল বার করে ছবি আঁকতে আরম্ভ করলাম। এ অবস্থায় কি আঁকায় মন বসে? চোখ আর মন দুটোই অন্য দিকে চলে যায়, আর ফেলুদা মাঝে মাঝে এসে ধমক দেয়, আর পেনসিল দিয়ে খস্খস্ করে হিজিবিজি এঁকে দেয়—যেন কতই না কারেক্ট করছে! আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেলেই ফেলুদা বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে এদিক ওদিক দেখে।
সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। কাছেই গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজল। লোকজন কমে আসছে, কারণ একটু পরেই বেশ ঠাণ্ডা পড়বে। মারোয়াড়িরা একটা বিরাট গাড়িতে উঠে চলে গেল। আয়াগুলোও পেরামবুলেটার ঠেলতে ঠেলতে রওনা দিল। লোয়ার সারকুলার রোড দিয়ে আপিস ফেরতা গাড়ির ভীড় আরম্ভ হয়েছে, ঘন ঘন হর্নের শব্দ কানে আসছে। ফেলুদা আমার পাশে এসে ঘাসের উপর বসতে গিয়েও বসল না। দেখলাম তার চোখ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গেটের দিকে। আমি সেইদিকে চেয়ে গেটের বেশ কিছুটা বাইরে রাস্তার ধারে একজন ব্রাউন চাদর জড়ানো লোক ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলাম না। ফেলুদা চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে কিছুক্ষণ ওই দিকে দেখে বাইনোকুলারটা আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘দ্যাখ্।’
‘ওই চাদর গায়ে দেওয়া লোকটাকে?’
‘হুঁ।’
বাইনোকুলার চোখে লাগাতেই লোকটা যেন দশ হাতের মধ্যে চলে এল, আর আমিও চমকে উঠে বললাম, ‘একি—এ যে কৈলাসবাবু নিজে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন!’
‘হ্যাঁ। চল—নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজতে এসেছেন।’
কিন্তু আমরা রওনা হবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম ভদ্রলোক হাঁটতে আরম্ভ করলেন। গেটের বাইরে এসে কৈলাসবাবুকে আর দেখা গেল না।
ফেলুদা বলল, ‘চল শ্যামপুকুর। ভদ্রলোক বোধ হয় আমাদের দেখতে পান নি, আর না দেখে নিশ্চয়ই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।’
ট্যাক্সি পেলে ট্যাক্সিই নিতাম, কিন্তু আপিস টাইমে সেটা সম্ভব নয়, তাই ট্রাম ধরার মতলবে চৌরঙ্গীর দিকে রওনা দিলাম। রাস্তা দিয়ে পর পর লাইন করে গাড়ি চলেছে। হঠাৎ ক্যালকাটা ক্লাবের সামনে এসে একটা কাণ্ড হয়ে গেল যেটা ভাবলে এখনো আমার ঘাম ছুটে যায়। কথা নেই বার্তা নেই, ফেলুদা হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা টান মেরে প্রায় আমাকে ছুঁড়ে রাস্তার একেবারে কিনারে ফেলে দিল। আর সেই সঙ্গে নিজেও একটা লাফ দিল। পরমুহূর্তে, দারুণ স্পীডে আর দারুণ শব্দ করে একটা গাড়ি আমাদের প্রায় গা ঘেঁষে চলে গেল।
‘হোয়াট দ্য ডেভিল!’ ফেলুদা বলে উঠল। ‘গাড়ির নাম্বারটা…’
কিন্তু সেটার আর কোন উপায় নেই। সন্ধ্যার অন্ধকারে অন্য গাড়ির ভীড়ের মধ্যে সে গাড়ি মিলিয়ে গেছে। আমার হাতের খাতা-পেনসিল কোথায় ছিটকে পড়েছে তার ঠিক নেই, তাই সেটা খুঁজে আর সময় নষ্ট করলাম না। এটা বেশ বুঝতে পারছিলাম যে ফেলুদা ঠিক সময় বুঝতে না পারলে আমরা দু’জনেই নির্ঘাত গাড়ির চাকার তলায় চলে যেতাম।
ট্রামে ফেলুদা সারা রাস্তা ভীষণ গম্ভীর মুখ করে রইল। কৈলাসবাবুর বাড়িতে পৌঁছে সোজা বৈঠকখানায় গিয়ে সোফায় বসা কৈলাসবাবুকে ফেলুদা প্রথম কথা বলল, ‘আপনি দেখতে পেলেন না আমাদের?’
ভদ্রলোক কেমন যেন থতমত খেয়ে গেলেন। বললেন, ‘কোথায় দেখতে পেলাম না? কী বলছেন আপনি?’
‘কেন, আপনি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল যান নি?’
‘আমি? সে কি কথা! আমি তো এতক্ষণ শোবার ঘরে বিছানায় শুয়ে ভাবনায় ছটফট করছিলুম—এই সবে মাত্র নীচে এসেছি।’
‘তাহলে কি আপনার কোন যমজ ভাই আছে নাকি?’
কৈলাসবাবু কিরকম যেন একটু অবাক হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘সেকি, আপনাকে সেদিন বলি নি?
‘কী বলেন নি?’
‘কেদারের কথা? কেদার যে আমার যমজ ভাই।’
ফেলুদা সোফার উপর বসে পড়ল। কৈলাসবাবুরও মুখটা যেন কেমন শুকিয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘আপনি কেদারকে দেখেছেন? সে ওখানে ছিল?’
‘উনি ছাড়া আর কেউ হতেই পারেন না।’
‘সর্বনাশ!’
‘কেন বলুন তো? কেদারবাবুর কি ওই পাথরটার উপর কোন অধিকার ছিল?’
কৈলাসবাবু হঠাৎ কেমন যেন নেতিয়ে পড়লেন। সোফার হাতলে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তা ছিল…তা ছিল। কেদারই প্রথম পাথরটা দেখে। আমি মন্দিরটা দেখি, কিন্তু দেবমূর্তির কপালে পাথর কেদারই প্রথম দেখে।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী। একরকম আবদার করেই পাথরটা আমি নিই। অবিশ্যি মনে জানতুম ওটা আমার কাছে থাকলে থাকবে, কেদার নিলে ওটা বেচে দেবে, দিয়ে টাকাটা নষ্ট করবে। আর ওটার যে কত দাম সেটা আমি জেনেও কেদারকে জানাই নি। সত্যি বলতে কি, কেদার যখন বিদেশে চলে গেল, তখন আমার মনে একটা নিশ্চিন্ত ভাব এল। কিন্তু ওখানে হয়ত ও বিশেষ সুবিধা করতে পারে নি, তাই ফিরে এসেছে। হয়ত পাথরটাকে নিয়ে বিক্রী করে সেই টাকায় নতুন কিছু ব্যবসা ফাঁদবে।’
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ফেলুদা বলল, ‘এখন উনি কি করতে পারেন সেটা বলতে পারেন?’
কৈলাসবাবু বললেন, ‘জানি না। তবে আমার মুখোমুখি তো একবার তাকে আসতেই হবে। বাড়ি থেকে যখন বেরোই না, আর লিলি গাছের নিচে পাথর যখন রাখি নি, তখন সে আসবেই।’
‘আপনি কি চান আমি এখানে থেকে একটা কোন ব্যবস্থা করি?’
‘না। তার কোন প্রয়োজন হবে না। সে আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কিছু করবে বলে মনে হয় না। আর কথা যদি বলতে আসে, তাহলে ভাবছি পাথরটা দিয়েই দেব। আপনার কর্তব্য এখানেই শেষ। আপনি যে লাইফ রিস্ক করে আজ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়েছিলেন, তার জন্যে সত্যিই আমি কৃতজ্ঞ। আপনি বিলটা পাঠিয়ে দেবেন, একটা চেক আমি দিয়ে দেবো।’
ফেলুদা বলল, ‘লাইফ রিস্কই বটে। একটা গাড়ি তো পিছন থেকে এসে প্রায় আমাদের শেষ করে দিয়েছিল!’
আমার কনুইটা খানিকটা ছড়ে গিয়েছিল, আমি সেটা এতক্ষণ হাত দিয়ে ঢাকবার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু চেয়ার ছেড়ে ওঠবার সময় ফেলুদা সেটা দেখে ফেলল।
‘ওকি রে, তোর হাতে যে রক্ত!’ তারপর কৈলাসবাবুর দিকে ফিরে বলল, ‘কিছু যদি মনে করেন—আপনার এখানে একটু ডেটল বা আয়োডিন হবে কি? এই সব ঘাগুলো আবার বড্ড চট্ করে সেপ্টিক হয়ে যায়।’
কৈলাসবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘ইস্—যা হয়েছে কলকাতার রাস্তাঘাট! দেখি, অবনীশকে জিজ্ঞেস করি!’
অবনীশবাবুর ঘরের সামনে গিয়ে ডেটলের কথা জিজ্ঞেস করতেই উনি কেমন যেন একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি যে এই দিন সাতেক আগেই আনলে। সে কি এর মধ্যেই ফুরিয়ে গেল?’
কৈলাসবাবু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘ওহো, তাই তো! এই দ্যাখ, খেয়ালই নেই। আমার কি আর মাথার ঠিক আছে?’
ডেটল লাগিয়ে কৈলাসবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে দেখি ফেলুদা কর্ণওয়ালিস স্ত্রীটে ট্রামের দিকে না গিয়ে যাচ্ছে উল্টো দিকে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ও বলল, ‘গণপতিদা’র কাছে একবার টেস্টম্যাচের টিকিটের কথাটা বলে যাই। এত কাছেই যখন এসেছি…’
কৈলাসবাবুর দুটো বাড়ি পরেই গণপতি চ্যাটার্জির বাড়ি। আমি ওর নাম শুনেছি ফেলুদার কাছে, কিন্তু দেখি নি কখনো। রাস্তার উপরেই সামনের ঘর, টোকা মারতেই গেঞ্জীর উপর পুলোভার পরা একজন নাদুসনুদুস ভদ্রলোক দরজা খুলল।
‘আরে, ফেলু মাস্টার যে—কী খবর?’
‘একটা খবর তো বুঝতেই পারছেন।’
‘তা তো বুঝছি, তবে সশরীরে তাগাদা না দিতে এলেও চলত। তোমার রিকোয়েস্ট কি ভুলি? যখন বলিচি দেবো তখন দেবোই।’
‘আসার কারণ অবিশ্যি আরেকটা আছে। তোমার বাড়ির ছাত থেকে শুনিচি উত্তর কলকাতার একটা খুব ভালো ভিউ পাওয়া যায়। একটা ফিল্ম কোম্পানীর জন্য সেইটে একবার দেখতে চাইছিলাম।’
‘স্বচ্ছন্দে! সটান সিঁড়ি দিয়ে চলে যাও। আমি এদিকে চায়ের আয়োজন করছি।’
চারতলার ছাতে উঠে পূব দিকে চাইতেই দেখি—কৈলাসবাবুদের বাড়ি। একতলার বাগান থেকে ছাত অবধি দেখা যাচ্ছে। দোতলার একটা ঘরে আলো জ্বলছে—আর তার ভিতরে একজন লোক খুট্খুট করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। খালি চোখেই বুঝতে পারলাম সেটা কৈলাসবাবুর বাবা। ছাতের ওপর ওই যে চিলেকোঠা—তার জানলার দিকে দেয়ালটা দেখা যাচ্ছে। দরজাটা বোধহয় উল্টো দিকে।
দোতলার একটা বাতি জ্বলে উঠল। বুঝলাম সেটা সিঁড়ির বাতি। ফেলুদা বাইনোকুলার চোখে লাগাল। একজন লোক সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। কে? কৈলাসবাবু। এতদূর থেকেও তার লাল সিল্কের ড্রেসিং গাউনটা দেখেই বোঝা যায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কৈলাসবাবুকে দেখা গেল না। তারপর হঠাৎ দেখি উনি ছাতে উঠে এসেছেন। আমরা দু’জনেই চট্ করে একসঙ্গে নিচু হয়ে শুধু চোখদুটো পাঁচিলের ওপর দিয়ে বার করে রাখলাম।
কৈলাসবাবু এদিক ওদিক দেখে চিলেকোঠার উল্টোদিকে চলে গেলেন। তারপর ঘরের বাতি জ্বলে উঠল। কৈলাসবুকে জানালায় দেখা গেল। উনি আমাদের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার বুকের ভিতরে ভীষণ জোরে টিপ্ টিপ্ আরম্ভ হয়ে গেছে। কৈলাসবাবু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মাটিতে বসে পড়লেন।
কিছুক্ষণ পর কৈলাসবাবু আবার ঘরের বাতি নিভিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে চলে গেলেন।
ফেলুদা শুধু বলল, ‘গোলমাল, গোলমাল।’