কৈলাস চৌধুরীর পাথর – ১

‘কার্ডটা কিরকম হয়েছে দ্যাখ তো।’

ফেলুদা ওর মানিব্যাগের ভিতর থেকে সড়াৎ করে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করে আমায় দেখতে দিল। দেখি তাতে ছাপার অক্ষরে লেখা রয়েছে Prodosh C. Mitter, Private Investigator। বুঝতে পারলাম ফেলুদা এবার তার গোয়েন্দাগিরির ব্যাপারটা বেশ ফলাও করে জাহির করছে। আর তা করবে নাই বা কেন। বাদশাহী আংটির শয়তানকে ফেলুদা যে-ভাবে সায়েস্তা করেছিল, সে কথা ও ইচ্ছে করলে সকলকে বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াতে পারত। তার বদলে ও শুধু একটি ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়েছে—এই তো!

ফেলুদার নাম আপনা থেকেই বেশ রটে গিয়েছিল। আমি জানি ও এর মধ্যে দু’তিনটে রহস্যের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরির অফার পেয়েছে, কিন্তু কোনটাই ওর মনের মত হয় নি বলে না করে দিয়েছে।

কার্ডটা ব্যাগের মধ্যে পুরে রেখে পা দুটো টেবিলের উপর তুলে লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে ফেলুদা বলল, ‘বড়দিনের ছুটিতে কিছুটা মাথা খাটানোর প্রয়োজন হবে বলে মনে হচ্ছে।’

আমি বললাম, ‘নতুন কোন রহস্য বুঝি?’

ফেলুদার কথাটা শুনে ভীষণ এক্‌সাইটেড লাগছিল—কিন্তু বাইরে সেটা একদম দেখালাম না।

ফেলুদা তার প্যান্টের পাশের পকেট থেকে একটা ছোট্ট কৌটো বার করে তার থেকে খানিকটা মাদ্রাজী সুপুরি নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে বলল, ‘তোর খুব উত্তেজিত লাগছে বলে মনে হচ্ছে?

সে কী, ফেলুদা বুঝল কী করে?

ফেলুদা নিজেই আমার প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিল। ‘কী করে বুঝলাম ভাবছিস? মানুষ তার মনের ভাব যতই গোপন করার চেষ্টা করুক না কেন, তার বাইরে ছোটখাটো হাবভাব থেকেই সেটা ধরা পড়ে যায়। কথাটা যখন তোকে বললাম, ঠিক সেই সময়টা তোর একটা হাই আসছিল। কিন্তু কথাটা শুনে মুখটা খানিকটা খুলেই বন্ধ হয়ে গেল। তুই যদি আমার কথায় উত্তেজিত না হতিস, তাহলে কিন্তু যথারীতি হাইটা তুলতিস—মাঝপথে থেমে যেতিস না।’

ফেলুদার এই ব্যাপারগুলো সত্যিই আমাকে অবাক করে দিত। ও বলত, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা না থাকলে ডিটেক্‌টিভ হবার কোন মানে হয় না। এ ব্যাপারে যা খাঁটি কথা বলার সবই শার্লক হোম্‌স্‌ বলে গেছেন। আমাদের কাজ শুধু তাঁকে ফলো করা।’

আমি বললাম, ‘কী কাজে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে বললে না?’

ফেলুদা বলল, ‘কৈলাস চৌধুরীর নাম শুনেছিস? শ্যামপুকুরের কৈলাস চৌধুরী?’

আমি বললাম, ‘না, শুনি নি। কত বিখ্যাত লোক আছে কলকাতা শহরে—তার ক’জনের নামই বা আমি শুনেছি। আর আমার তো সবেমাত্র পনের বছর বয়স।’

ফেলুদা একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘এরা রাজসাহীতে বড় জমিদার ছিল। কলকাতায় বাড়ি ছিল; পাকিস্তান হবার পর এখানে চলে আসে। কৈলাসবাবুর পেশা হচ্ছে ওকালতি। তাছাড়া শিকারী হিসাবে নামডাক আছে। দু’খানা শিকারের বই লিখেছেন। এই কিছুদিন আগে জলদাপাড়া রিজার্ভ ফরেস্টে একটা হাতি পাগল হয়ে গিয়ে উৎপাত আরম্ভ করেছিল—উনি গিয়ে সেটাকে মেরে এলেন। কাগজে নামটাম বেরিয়েছিল।’

‘কিন্তু তোমার মাথা খাটাতে হচ্ছে কেন? ভদ্রলোকের জীবনে কোন রহস্য আছে নাকি?’

ফেলুদা জবাব না দিয়ে, তার কোটের বুক পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে আমাকে দিল।

‘পড়ে দ্যাখ।’

আমি চিঠির ভাঁজ খুলে পড়ে দেখলাম। তাতে এই লেখা ছিল—

‘শ্রীপ্রদোষচন্দ্র মিত্র সমীপেষু।

সবিনয় নিবেদন,

অমৃতবাজার পত্রিকায় আপনার বিজ্ঞাপন দেখিয়া আপনাকে এই পত্র দেওয়া স্থির করিলাম। আপনি উপরোক্ত ঠিকানায় আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলে বাধিত হইব। কারণ সাক্ষাতে বলিব। আমি এক্সপ্রেস ডেলিভারি যোগে এই পত্র পাঠাইতেছি, সুতরাং আগামীকল্য ইহা আপনার হস্তগত হইবে। আমি পরশু অর্থাৎ শনিবার, সকাল ১০টায় আপনার আগমন প্রত্যাশা করিব। ইতি। —ভবদীয় শ্রীকৈলাসচন্দ্র চৌধুরী।’

চিঠিটা পড়ামাত্র আমি বললাম, ‘শনিবার সকাল দশটা মানে তো আজই, আর এক ঘণ্টার মধ্যেই।’

ফেলুদা বলল, ‘তোর দেখছি বেশ ইম্‌প্রুভমেন্ট হয়েছে। তারিখ-টারিখগুলো বেশ খেয়াল রাখছিস।’

আমার মনে এর মধ্যেই একটা সন্দেহ জেগে উঠেছে। বললাম, ‘তোমাকেই যখন ডেকেছে, তখন কি আর সঙ্গে অন্য কেউ…’

ফেলুদা চিঠিটা আমার হাত থেকে নিয়ে সযত্নে ভাঁজ করে পকেটে রেখে বলল, ‘তোর বয়সটা কম বলেই হয়ত তোকে সঙ্গে নেওয়া চলতে পারে। কারণ তোকে হয়ত মানুষ বলেই ধরবেন না ভদ্রলোক। কাজেই তোর সামনে কথাবার্তা বলতে আপত্তি করবেন না। যদি করেন, তাহলে তুই না হয় পাশের ঘরে-টরে কোথাও অপেক্ষা করিস, সেই ফাঁকে আমরা কথা সেরে নেবো।’

আমার বুকের মধ্যে টিপ্ টিপ্‌ শুরু হয়ে গিয়েছে। ছুটিটা কি করব কি করব ভাবছিলাম। এখন মনে হচ্ছে হয়ত দারুণ ইন্টারেস্টিং ভাবেই কেটে যাবে।

দশটা বাজতে পাঁচ মিনিটে আমরা ট্রামে করে কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট আর শ্যামপুকুর স্ত্রীটের মোড়ে পৌঁছলাম। পথে একবার ট্রাম থেকে নেমে ফেলুদা দাশগুপ্ত এন্ড কোম্পানী থেকে কৈলাস চৌধুরীর লেখা একটা শিকারের বই কিনেছিল, সেটার নাম ‘শিকারের নেশা’ বাকি পথটা বইটা উল্টেপাল্টে দেখল। ট্রাম থেকে নামার সময় সেটা কাঁধে ঝোলানো থলির মধ্যে রেখে বলল, এমন সাহসী লোকের কেন ডিটেক্‌টিভের দরকার পড়েছে কে জানে।’

একান্ন নম্বর শ্যামপুকুর স্ত্রীট, একটা মস্ত পুরোন আমলের ফটকওয়ালা বাড়ি—যাকে বলে অট্টালিকা। সামনের দিকে বাগান, ফোয়ারা, পাথরের মূর্তি ইত্যাদি পেরিয়ে বাড়ির দরজায় কলিং বেল টেপার আধ মিনিটের মধ্যেই ভিতর থেকে পায়ের আওয়াজ পেলাম। দরজা খুলতে দেখি একজন ভদ্রলোক, যাকে দেখে কেন জানি মনে হল, তিনি কখনই কৈলাসবাবু ন’ন, কারণ বাঘ মারা মানুষের এমন গোবেচারা চেহারা হতেই পারে না। মাঝারি সাইজের মোটা-সোটা ফর্সা ভদ্রলোক—বয়স ত্রিশের বেশি বলে মনে হয় না। চোখের চাহনিতে কেমন জানি একটা সরল, ছেলেমানুষী ভাব। লক্ষ করলাম ভদ্রলোকের হাতে একটা ম্যাগ্‌নিফাইং গ্লাস রয়েছে।

‘কাকে চান আপনারা?’ গলার আওয়াজ দেখলাম মানানসই রকমের মিহি ও নরম।

ফেলুদা একটা কার্ড বার করে ভদ্রলোককে দিয়ে বলল, ‘কৈলাসবাবুর সঙ্গে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। উনি চিঠি দিয়েছিলেন।’

ভদ্রলোক কার্ডটায় চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘আসুন ভিতরে।’

দরজা দিয়ে ঢুকে একটা সিঁড়ি পেরিয়ে ভদ্রলোক একটা আপিস ঘরে নিয়ে গিয়ে আমাদের অপেক্ষা করতে বললেন।

‘আপনারা একটু বসুন—আমি মামাবাবুকে খবর দিচ্ছি।’

বহুদিনের পুরোন একটা কালো টেবিলের সামনে দুটো পুরোন হাতলওয়ালা চেয়ারে আমরা বসলাম। ঘরের তিনদিকে আলমারি বোঝাই পুরোন বই। সামনে টেবিলের উপর নজর যেতে একটা মজার জিনিস দেখলাম। তিনখানা মোটা স্ট্যাম্প অ্যালবাম একটার উপর আরেকটা স্তূপ করে রাখা রয়েছে, আর আরেকটা অ্যালবাম খোলা অবস্থায় পড়ে আছে, যাতে সারি সারি স্ট্যাম্প যত্ন করে আটকানো রয়েছে। কয়েকটা সেলোফেনের মধ্যে কিছু আলগা স্ট্যাম্পও রয়েছে, আর তাছাড়া রয়েছে স্ট্যাম্প-কালেক্‌টারদের অত্যন্ত দরকারী ও আমার খুব চেনা কয়েকটা জিনিস, যেমন হিঞ্জ, চিমটে, স্ট্যাম্পের ক্যাটালগ ইত্যাদি। এখন বুঝতে পারলাম ভদ্রলোকের হাতের ম্যাগ্‌নিফাইং গ্লাসটাও এই কাজেই ব্যবহার হয়, আর তিনিই এই সব স্ট্যাম্পের কালেক্‌টর।

ফেলুদাও ওই সবের দিকেই দেখছিল, কিন্তু ও নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু কথা হবার আগেই ভদ্রলোক ফিরে এসে বললেন, ‘আপনারা বৈঠকখানায় এসে বসুন, মামা এক্ষুনি আসছেন।’

মাথার উপর বিরাট ঝাড়লণ্ঠনওয়ালা বৈঠকখানায় গিয়ে আমরা দু’জনে সাদা খোলস দিয়ে ঢাকা একটা প্রকাণ্ড সোফার উপর বসলাম। ঘরের চারিদিকে পুরনো বড়লোকী ছাপ। একবার বাবার সঙ্গে বেলেঘাটার মল্লিকদের বাড়িতে ঠিক এইরকম সব আসবাব, পেণ্টিং, মূর্তি আর ফুলদানির ছড়াছড়ি দেখেছিলাম। এছাড়া রয়েছে মেঝের উপর একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ছাল, আর দেয়ালে চারটে হরিণ, দুটা চিতাবাঘ আর একটা মহিষের মাথা।

প্রায় দশ মিনিট বসে থাকার পর একজন মাঝবয়সী কিন্তু বেশ জোয়ান গোছের ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। তাঁর রং ফরসা, নাকের তলায় সরু গোঁফ আর গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবী পায়জামা আর ড্রেসিং গাউন।

আমরা দু’জনেই উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলাম। ভদ্রলোক আমাকে দেখে যেন ভুরুটা একটু কপালে তুললেন। ফেলুদা বলল, ‘এটি আমার খুড়তুতো ভাই।’

ভদ্রলোক আমাদের পাশের সোফাতে বসে বললেন, ‘আপনারা কি দু’জনে একসঙ্গে ডিটেক্‌টিভগিরি করেন?’

ফেলুদা হেসে বলল, ‘আজ্ঞে না। তবে ঘটনাচক্রে আমার সব কটা কেসের সঙ্গেই তপেশ জড়িত ছিল। ও কোন অসুবিধা করে নি কখনো।’

‘বেশ। …অবনীশ, তুমি যেতে পারে। এদের জন্যে একটু জলযোগের ব্যবস্থা দেখো।’

স্ট্যাম্প-জমানো ভদ্রলোকটি দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন; তিনি তাঁর মামার আদেশ শুনে চলে গেলেন। কৈলাস চৌধুরী ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না—আমার চিঠিটা কি আপনি সঙ্গে এনেছেন?’

ফেলুদা একটু হেসে বলল, ‘আমিই যে প্রদোষ মিত্তির সেটার প্রমাণ চাইছেন তো? এই যে আপনার চিঠি।’

ফেলুদা পকেট থেকে কৈলাসবাবুর চিঠিটা বার করে ভদ্রলোকের হাতে দিল। উনি সেটায় একবার চোখ বুলিয়ে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে ফেলুদাকে ফেরত দিয়ে দিলেন।

‘এ সব প্রিকশন নিতেই হয়, বুঝতেই পারছেন। যাই হোক্‌—শিকারী বলে আমার একটা নামডাক আছে জানেন বোধ হয়।’

ফেলুদা বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

ঘরের দেয়ালে জানোয়ারের মাথাগুলির দিকে আঙুল দেখিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘এগুলো সব আমারই শিকার। সতেরো বছর বয়সে বন্দুক চালাতে শিখি। তার আগে অবিশ্যি এয়ার গান দিয়ে পাখি-টাখি মেরেছি। সম্মুখ সমরে জানোয়ার কোনদিন আমার সঙ্গে পেরে উঠবে বলে মনে হয় না। কিন্তু…যে শত্রু অদৃশ্য ও অজ্ঞাত—সে আমাকে বড় ভাবিয়ে তোলে।’

ভদ্রলোক একটু থামলেন। আমার বুকের ভিতরটায় আবার ঢিপ্‌ঢিপ্‌ শুরু হয়েছে। জানি এক্ষুনি ভদ্রলোক রহস্যের কথাটা বলবেন, কিন্তু এত কায়দা করে আস্তে আস্তে আসল কথাটায় যাচ্ছেন যে তাতে যেন সাস্‌পেন্স আরো বেডে যায়।

কৈলাসবাবু আবার শুরু করলেন।

‘আপনার বয়স যে এত কম তা জানা ছিল না। কত হবে বলুন তো?’

ফেলুদা বলল, ‘টুয়েন্টি এইট।’

‘কাজেই, যে কাজের ভার আপনাকে দিতে যাচ্ছি সেটা আপনার পক্ষে কতদূর সম্ভব তা জানি না। পুলিশকে আমি এ ব্যাপারে জড়াতে চাই না, কারণ এর আগে আরেকটা ব্যাপারে তাদের সাহায্য নিয়ে ঠকেছি। ওরা অনেক সময় কাজের চেয়ে অকাজটা করে বেশি, আর এটাও ঠিক যে আমি তরুণদের অশ্রদ্ধা করি না মোটেই। কাঁচা বয়সের সঙ্গে পাকা বুদ্ধির সমাবেশটা খুব জোরালো হয় বলেই আমার বিশ্বাস।’

এবারে কৈলাসবাবুর থামার সুযোগ নিয়ে ফেলুদা গলা খাঁক্‌রিয়ে বলল, ‘ঘটনাটা কি সেটা যদি বলেন..।’

কৈলাসবাবু এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বার করে ফেলুদাকে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন তো এটা পরে কি বোঝেন।’

ফেলুদা কাগজটা খুলে ধরতে আমি পাশ থেকে ঝুঁকে পড়ে সেটায় চোখ বুলিয়ে নিলাম। তাতে ইংরেজিতে যা লেখা রয়েছে তার মানে হয় এই—‘পাপের বোঝা বাড়িও না। যে জিনিসে তোমার অধিকার নেই, সে-জিনিস তুমি আগামী সোমবার বিকেল চারটার মধ্যে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দক্ষিণ গেটের বিশ হাত ভিতর দিকে, রাস্তার বাঁ ধারে লিলি ফুলের প্রথম সারির প্রথম গাছটার নিচে রেখে আসবে। আদেশ অমান্য করার, বা পুলিশ-গোয়েন্দার সাহায্য নেওয়ার ফল ভালো হবে না—তোমার অনেক শিকারের মতোই তুমিও শিকারে পরিণত হবে একথা জেনে রেখো।’

‘কী মনে হয়?’ গম্ভীর গলায় কৈলাসবাবু প্রশ্ন করলেন।

ফেলুদা কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা দেখে বলল, ‘হাতের লেখা ভাঁড়ানো হয়েছে, কারণ একই অক্ষর দু’তিন জায়গায় দু’তিন রকম ভাবে লেখা হয়েছে। আর, নতুন প্যাডের প্রথম কাগজে লেখা।

‘সেটা কী করে বুঝলেন?’

‘প্যাডের কাগজে লেখা হলে তার পরের কাগজে সে লেখার কিছুটা ছাপ থেকে যায়। এ কাগজ একেবারে মসৃণ।’

‘ভেরি গুড। আর কিছু?’

‘আর কিছু এ থেকে বলা অসম্ভব। এ চিঠি ডাকে এসেছিল?’

‘হ্যাঁ। পোস্টমার্ক পার্ক স্ট্রীট। তিনদিন আগে এ চিঠি পেয়েছি। আজ শনিবার ২০শে।’

ফেলুদা চিঠিটা ফেরত দিয়ে বলল, ‘এবার আপনাকে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই, কারণ আপনার শিকারের কাহিনী ছাড়া আপনার সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই আমার।’

‘বেশ তো। করুন না। মিষ্টি মুখে পুরে খেতে খেতে করুন।’

চাকর রূপোর প্লেটে রসগোল্লা আর অমৃতি রেখে গেছে। ফেলুদাকে খাবার কথা বলতে হয় না। সে টপ্‌ করে একটা আস্ত রসগোল্লা মুখে পুরে দিয়ে বলল, ‘চিঠিতে যে জিনিসটার কথা লেখা হয়েছে সেটা কি জানতে পারি?’

কৈলাসবাবু বললেন, ‘ব্যাপারটা কি জানেন—যাতে আমার অধিকার নেই, এমন কোন জিনিস আমার কাছে আছে বলে আমার জানা নেই। এ বাড়িতে যা কিছু আছে। তা সবই হয় আমার নিজের কেনা, না হয় পৈতৃক সম্পত্তি। আর তার মধ্যে এমন কোন জিনিস নেই যেটা আদায় করার জন্য কেউ আমাকে এমন চিঠি দিতে পারে। তবে একটিমাত্র জিনিস আছে যেটা বলতে পারেন মূল্যবান ও লোভনীয়।’

‘সেটা কী?’

‘একটা পাথর।’

‘পাথর?’

‘প্রেশাস স্টোন।’

‘আপনার কেনা?’

‘না, কেনা নয়।’

‘পৈতৃক সম্পত্তি?’

‘তাও না। পাথরটা পাই আমি মধ্যপ্রদেশে চাঁদার কাছে একটা জঙ্গলে। একটা বাঘকে ধাওয়া করে আমরা তিন-চার জন একটা জঙ্গলে ঢুকেছিলাম। শেষ পর্যন্ত সেটাকে মারা হয়। কাছেই একটা বহু পুরোন ভাঙা পরিত্যক্ত মন্দিরে একটা দেবমূর্তির কপালে পাথরটা লাগানো ছিল। ওটার অস্তিত্ব বোধহয় আমাদের আগে কেউই জানত না’।

‘ওটা কি আপনার চোখেই প্রথম পড়ে?’

‘মন্দিরটা সকলেই দেখেছিল, তবে পাথরটা প্রথম আমিই দেখি।’

‘সঙ্গে আর কে ছিল সেবার?’

‘রাইট বলে এক মার্কিন ছোক্‌রা, কিশোরীলাল বলে এক পাঞ্জাবী, আর আমার ভাই কেদার।’

‘আপনার ভাইও শিকার করেন?’

‘করত। এখন করে কিনা জানি না। বছর চারেক হল ও বিদেশে।’

‘বিদেশ মানে?’

‘সুইজারল্যান্ড! ঘড়ির ব্যবসার ধান্দায়।’

‘যখন পাথরটা পেলেন তখন ওটা নিয়ে আপনাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি হয় নি?’

‘না। তার কারণ ওটার যে কত দাম সেটা কলকাতায় এসে জহুরীকে দেখাবার পর জানতে পারি।’

‘তারপর সে খবর আর কে জেনেছে?’

‘খুব বেশি লোককে বলি নি। এমনিতে আত্মীয়-স্বজন বিশেষ কেউ নেই। দু’একজন উকিল বন্ধুকে বলেছি, কেদার জানত, আর বোধহয় আমার ভাগনে অবনীশ জানে।’

‘পাথরটা বাড়িতেই আছে?’

‘হ্যাঁ। আমার ঘরেই থাকে।’

‘এত দামী জিনিস ব্যাঙ্কে রাখেন না যে?’

‘একবার রেখেছিলাম। যেদিন রেখেছিলাম তার পরের দিনই একটা মোটর অ্যাক্সিডেন্ট হয়—প্রায় মরতে মরতে বেঁচে যাই। তারপর থেকে ধারণা হয় ওটা কাছে রাখলে ব্যাড লাক্‌ আসবে, তাই ব্যাঙ্ক থেকে আনিয়ে নিই।’

‘হুঁ…।’

ফেলুদার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। ওর ভ্রূকুটি দেখে বুঝলাম ও ভাবতে আরম্ভ করে দিয়েছে। জল খেয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বলল, ‘আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?’

‘আমি, আমার ভাগ্‌নে অবনীশ, আর তিনটে পুরোন চাকর। আর আমার বাবাও আছেন, তবে তিনি একেবারে অথর্ব, জরাগ্রস্ত। একটি চাকর তার পিছনেই লেগে থাকে সারাক্ষণ।’

‘অবনীশবাবু কী করেন?’

‘বিশেষ কিছুই না। ওর নেশা ডাকটিকিট সংগ্রহ করা। বলছে একটা টিকিটের দোকান করবে।’

ফেলুদা একটু ভেবে মনে মনে কী জানি হিসাব করে বলল, ‘আপনি কি চাইছেন আমি এই পত্ৰলেখকের অনুসন্ধান করি?’

কৈলাসবাবু যেন একটু জোর করেই হেসে বললেন, ‘বুঝতেই তো পারছেন এই বয়সে এ ধরনের অশান্তি কি ভালো লাগে? আর শুধু যে চিঠি লিখছে তা নয়—কাল রাত্রে একটা টেলিফোনও করেছিল। ইংরিজিতে ওই একই কথা বলল। গলা শুনে চিনতে পারলাম না। কী বলল জানেন? বলল, নির্দিষ্ট জায়গায় এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জিনিসটা রেখে না এলে একেবারে আমার বাড়িতে এসে আমাকে ঘায়েল করে দিয়ে যাবে। অথচ এ পাথর হাতছাড়া করতে আমি মোটেই রাজী নই। তা ছাড়া লোকটার যখন কোন ন্যায্য দাবী নেই, অথচ হুমকি দিচ্ছে—তখন বুঝতে হবে সে বদমাইস, সুতরাং তার শাস্তি হওয়া দরকার। সেটা কি করে সম্ভব সেটাই আপনি একটু ভেবে দেখুন।’

‘উপায় তো একটাই। বাইশ তারিখে সন্ধ্যাবেলা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আশেপাশে ঘাপ্‌টি মেরে বসে থাকা। তাকে তো আসতেই হবে।’

‘সে নিজে নাও আসতে পারে।’

‘তাতে ক্ষতি নেই। যে-ই এসে লিলি গাছের পাশে ঘুরঘুর করুক না কেন, সে যদি আসল লোক নাও হয়, তাকে ধরতে পারলে আসল লোকের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব হবে না।’

‘কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না। লোকটা ডেন্‌জারাস্ হতে পারে। সে যখন দেখবে লিলি গাছের তলায় পাথরটা নেই, তখন যে কী করতে পারে তা বলা যায় না। তার চেয়ে বাইশ তারিখের আগে—অর্থাৎ আজ আর কালের মধ্যে—এই লোকটি কে তা যদি জানা সম্ভব হত তাহলে খুবই ভালো হত। এই চিঠি, আর ওই একটা টেলিফোন কল—এই দুটো থেকে কিছু বার করা যায় না?’

ফেলুদা সোফা ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করে দিয়েছে। ও বলল, ‘দেখুন কৈলাসবাবু, চিঠিতে সে লিখেছে যে, গোয়েন্দার সাহায্য নিলে ফল ভালো হবে না—সুতরাং আমি কিছু করি বা না করি, আপনি যে আমাকে ডেকেছেন, এতেই আপনার বিপদের একটা আশঙ্কা আছে। সুতরাং আপনি বরঞ্চ ভেবে দেখুন যে আমাদের সাহায্য চান কিনা।’

কৈলাসবাবু ঠাণ্ডার মধ্যেও রুমাল দিয়ে তাঁর কপাল মুছে বললেন, ‘আপনি, এবং আপনার সঙ্গে আপনার ভাইটি—এ দু’জনকে দেখলে কেউ মনে করবে না যে আপনাদের সঙ্গে গোয়েন্দার কোন সম্পর্ক আছে। এটা একটা অ্যাডভানটেজ। আপনার নাম লোকে জেনে থাকলেও, আপনার চেহারা জানে কি? মনে তো হয় না। সুতরাং সেদিকে আমার বিশেষ ভয় নেই। আপনি রাজী হলে কাজটা নিন। উপযুক্ত পারিশ্রমিক আমি দেবো।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ। তবে যাবার আগে একবার পাথরটা দেখে যেতে চাই।’

‘নিশ্চয়ই।’

কৈলাসবাবুর পাথর ওঁর শোবার ঘরে আলমারির ভিতর থাকে। আমরা ভদ্রলোকের পিছন পিছন একটা শানবাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় পৌঁছলাম। সিঁড়িটা গিয়ে পড়েছে একটা লম্বা, অন্ধকার বারান্দায়। তার দু’দিকে সারি সারি প্রায় দশ-বারোটা ঘর, তার অনেকগুলো আবার তালা বন্ধ। চারিদিকে একটা থমথমে ভাব, আর লোকজন নেই বলেই বোধ হয় সামান্য একটু আওয়াজ হলেই তার প্রতিধ্বনি হয়।

বারান্দার শেষ মাথায় ডানদিকের ঘর হল কৈলাসবাবুর শোবার ঘর। আমরা যখন বারান্দার মাঝামাঝি এসেছি, তখন দেখি পাশের একটা ঘরের দরজা অর্ধেক খোলা, আর তার ভিতর দিয়ে একজন ভীষণ বুড়ো লোক গলা বাড়িয়ে ঘোলাটে চোখে আমাদের দিকে দেখছে। আমার তো দেখেই কিরকম ভয় ভয় করতে লাগল। কৈলাসবাবু বললেন, ‘উনিই আমার বাবা। মাথার ঠিক নেই। সব সময়েই এখান দিয়ে ওখান দিয়ে উঁকি মারেন।’

কাছাকাছি যখন এসেছি, তখন বুড়োর চাহনি দেখে সত্যিই আমার রক্ত জল হয়ে গেল। আর সেই ভয়াবহ চাহনি দিয়ে উনি তাকিয়ে রয়েছেন কৈলাসবাবুর দিকে।

বাবার ঘর পেরিয়ে কিছুদূর গেলে পর কৈলাসবাবু বললেন, ‘বাবার সকলের উপরেই আক্রোশ। ওঁর ধারণা সকলেই ওঁকে নেগ্‌লেক্ট করে। আসলে কিন্তু ওঁর দেখাশোনার ত্রুটি হয় না।’

কৈলাসবাবুর ঘরে দেখলাম প্রকাণ্ড উঁচু খাট, আর তার মাথার দিকে ঘরের কোণায় আলমারি। সেটা খুলে তার দেরাজ থেকে একটা নীল ভেলভেটের বাক্স বার করে বললেন, ‘সাতরামদাসের দোকান থেকে এই বাক্সটা কিনে নিয়েছিলুম এই পাথরটা রাখার জন্য।’

বাক্সটা খুলে নীল আর সবুজ রং মেশানো লিচুর সাইজের একটা ঝলমলে পাথর বার করে কৈলাসবাবু ফেলুদার হাতে দিয়ে বললেন—

‘একে বলে ব্লু বেরিল। ব্রেজিল দেশে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে যে খুব বেশি আছে তা নয়। অন্তত এত বড় সাইজের বেশি নেই সে-বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।’

ফেলুদা পাথরটা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক নাড়িয়ে দেখে ফেরত দিয়ে দিল। এবার কৈলাসবাবু তাঁর পকেট থেকে একটা মানিব্যাগ বার করলেন। তারপর তার থেকে পাঁচটা দশটাকার নোট বার করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এইটে আগাম। কাজটা ভালোয় ভালোয় উতরে গেলে বাকিটা দেবো, কেমন?’

‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে ফেলুদা নোটগুলো পকেটে পুরে নিল। চোখের সামনে ওকে রোজগার করতে এই প্রথম দেখলাম।

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে ফেলুদা বলল, ‘আপনার ওই চিঠিখানা আমাকে দিতে হবে, আর অবনীশবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলব।’

নিচে যখন পৌঁছলাম, ঠিক সেই সময় বৈঠকখানা থেকে টেলিফোন বাজতে আরম্ভ করেছে। কৈলাসবাবু তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরলেন।

‘হ্যালো।’

তারপর আর কোন কথা নেই। আমরা বৈঠকখানায় ঢুকতেই কৈলাসবাবু ফ্যাকাশে মুখ করে ধপ্‌ করে টেলিফোনটা রেখে দিয়ে বললেন, ‘আবার সেই লোক, সেই হুমকি।’

‘কি বলল?’

‘এবার আর কোন সন্দেহ রাখে নি।’

‘তার মানে?’

‘বলল—কোন জিনিসটা চাইছি বুঝতে পারছ বোধহয়। চাঁদার জঙ্গলের মন্দিরে যেটা ছিল সেইটে।’

‘আর কী বলল?’

‘আর কিছু না।’

‘গলা চিনলেন?’

‘না। তবে এইটুকু বলতে পারি যে গলাটা শুনতে ভালো লাগে না। আপনি বরং আরেকবার ভেবে দেখুন।’

ফেলুদা একটু হেসে বলল, ‘আমার ভাবা হয়ে গিয়েছে।’

কৈলাসবাবুর কাছ থেকে অবনীশবাবুর ঘরে গিয়ে দেখি তিনি ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে টেবিলের উপর রাখা কি একটা জিনিস খুব মন দিয়ে পরীক্ষা করছেন। আমরা ঢুকতেই টেবিলের উপর হাতটা চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

‘আসুন, আসুন!’

ফেলুদা বলল, ‘আপনার ডাকটিকিটের খুব শখ দেখছি।’

অবনীশবাবুর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, ওই আমার একমাত্র নেশা। বলতে গেলে আমার ধ্যান জ্ঞান চিন্তা।’

‘আপনি কি কোনো দেশ নিয়ে স্পেশালাইজ করেন, না সারা পৃথিবীর টিকিট জমান?’

‘আগে সারা পৃথিবীরই জমাতুম, কিন্তু কিছুদিন হল ইন্ডিয়াতে স্পেশালাইজ করছি। আমাদের এই বাড়ির দপ্তরে যে কি আশ্চর্য সব পুরোন টিকিট রয়েছে তা বলতে পারি না। অবিশ্যি বেশির ভাগই ইন্ডিয়ার। গত দু’ মাস ধরে হাজার হাজার পুরোন চিঠির গাদা ঘেঁটে টিকিট সংগ্রহ করেছি।’

‘ভালো কিছু পেয়েছেন?’

‘ভালো? ভালো? ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ‘আপনাকে বললে বুঝবেন? আপনার এ ব্যাপারে ইন্টারেস্ট আছে?’

ফেলুদা একটু হেসে বলল, একটা বয়সে তো সকলেই ওদিকটায় ঝোঁকে—তাই নয় কি? কেপ-অফ্‌-গুড-হোপের এক পেনি, মরিশাসের দু’ পেনি আর বৃটিশ গায়নার ১৮৫৬ সনের সেই বিখ্যাত স্ট্যাম্পগুলো পাবার স্বপ্ন আমিও দেখেছি। বছর দশেক আগে লাখ খানেক টাকা দাম ছিল ওগুলোর। এখন আরো বেড়েছে।’

অবনীশবাবু উত্তেজনায় প্রায় লাফিয়ে উঠলেন।

‘তাহলে মশাই আপনি বুঝবেন। আপনাকে দেখাই। এই দেখুন!’

ভদ্রলোক তার চাপা হাতের তলা থেকে একটা ছোট্ট রঙীন কাগজ ফেলুদাকে দিলেন। দেখি খাম থেকে খোলা রঙ প্রায় মিলিয়ে যাওয়া একটা টিকিট।

‘কী দেখলেন?’ অবনীশবাবু প্রশ্ন করলেন।

ফেলুদা বলল, ‘শ’খানেক বছরের পুরোন ভারতবর্ষের টিকিট। ভিক্টোরিয়ার ছবি। এ টিকিট আগে দেখেছি।’ ‘দেখেছেন তো? এবার এই গ্লাসের মধ্যে দিয়ে দেখুন।’

ফেলুদা ম্যাগনিফাইং গ্লাস চোখে লাগাল।

‘এবার কী দেখছেন?’ ভদ্রলোকের গলায় চাপা উত্তেজনা।

‘এতে তো ছাপার ভুল রয়েছে।’

‘এগজ্যাক্টলি!’

‘POSTAGE কথাটার G-এর জায়গায় C ছাপা হয়েছে।’

অবনীশবাবু টিকিট ফেরত নিয়ে বললেন, ‘তার ফলে এটার দাম কত হচ্ছে জানেন?’

‘কত?’

‘বিশ হাজার টাকা।’

‘বলেন কী?’

‘আমি বিলেত থেকে চিঠি লিখে খোঁজ নিয়েছি। এই ভুলটার উল্লেখ স্ট্যাম্প ক্যাটালগে নেই। আমিই প্রথম এটার অস্তিত্ব আবিষ্কার করলাম।’

ফেলুদা বলল, ‘কন্‌গ্র্যাচুলেশন্‌শ। কিন্তু আপনার সঙ্গে টিকিট ছাড়াও অন্য ব্যাপারে একটু আলোচনা ছিল।’

‘বলুন।’

‘আপনার মামা—কৈলাসবাবু—তাঁর যে একটা দামী পাথর আছে সেটা আপনি জানেন?’

অবনীশবাবুকে যেন কয়েক সেকেন্ড ভাবতে হল। তারপর বললেন, ‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ। শুনেছিলাম বটে। দামী কিনা জানি না—তবে ‘লাকি’ পাথর সেটা একবার বলেছিলেন বটে। কিছু মনে করবেন না। আমার মাথায় এখন ডাকটিকিট ছাড়া কিছু নেই।’

‘আপনি এ বাড়িতে কদ্দিন আছেন?’

‘বাবা মারা যাবার পর থেকেই। প্রায় পাঁচ বছর।’

‘মামার সঙ্গে আপনার গোলমাল নেই তো?’

‘কোন মামা? এক মামা তো বিদেশে।’

‘আমি কৈলাসবাবুর কথা বলছি।’

‘ও। ইনি অত্যন্ত ভালো লোক, তবে…’

‘তবে কী?’

অবনীশ ভুরু কুঁচকোলেন।

‘ক’দিন থেকে—কোনো একটা কারণে—ওঁকে যেন একটু অন্যরকম দেখছি।’

‘কবে থেকে?’

‘এই দু-তিন দিন হল। কাল ওঁকে আমার এই স্ট্যাম্পটার কথা বললাম—উনি যেন শুনেও শুনলেন না। অথচ এমনিতে রীতিমত ইন্টারেস্ট নেন। আর তাছাড়া, ওঁর কতগুলো অভ্যেস কিরকম যেন বদলে যাচ্ছে।’

‘উদাহরণ দিতে পারেন?’

‘এই যেমন, এমনিতে রোজ সকালে উঠে বাগানে পায়চারি করেন, গত দু’দিন করেন নি। ঘুম থেকে উঠেইছেন দেরীতে। বোধহয় রাত জাগছেন বেশি।’

‘সেটার কোন ইঙ্গিত পেয়েছেন?’

‘হ্যাঁ। আমি তো একতলায় শুই। আমার ঠিক উপরের ঘরটাই মামার। পায়চারি করার শব্দ পেয়েছি মাঝ রাত্রে। গলার স্বরও পেয়েছি। বেশ জোরে। মনে হল ঝগড়া করছেন।’

‘কার সঙ্গে?’

‘বোধহয় দাদু। দাদু ছাড়া আর কে হবেন। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করারও শব্দ পেয়েছি। একদিন তো সন্দেহ করে সিঁড়ির নিচটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম মামা ছাত থেকে দোতলায় নামলেন, হাতে বন্দুক।’

‘তখন ক’টা?’

‘রাত দুটো হবে।’

‘ছাতে কী আছে?’

‘কিছুই নেই। কেবল একটা ঘর আছে—চিলেকোঠা যাকে বলে। পুরোন চিঠিপত্র কিছু ছিল ওটায়, সেসব আমি মাস খানেক হল বের করে এনেছি।’

ফেলুদা উঠে পড়ল। বুঝলাম তার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।

অবনীশবাবু বললেন, ‘এসব কেন জিজ্ঞেস করলেন বলুন তো।’

ফেলুদা একটু হেসে বলল, ‘আপনার মামা কোনো কারণে একটু উদ্বিগ্ন আছেন। তবে সে নিয়ে আপনি ভাববেন না। আপনি স্ট্যাম্প নিয়েই থাকুন। এদিকের ঝামেলা মিটলে একদিন এসে আপনার কালেকশান দেখব’খন।’

কৈলাসবাবুর সঙ্গে একবার শেষ দেখা করে ফেলুদা বলল, ‘আপনাকে ষোল আনা ভরসা দিতে পারছি না, তবু এটুকু বলছি যে আপনার ভাবনাটা আমায় ভাবতে দিন। রাত্রে ঘুমোতে চেষ্টা করুন, দরকার হলে ওষুধ খেয়ে। আর ছাতে যাবেন না দয়া করে। এ পাড়ার বাড়িগুলো যেরকম ঘেঁষাঘেঁষি, আপনার শত্রু পাশের কোনো বাড়িতে এসে আস্তানা গেড়ে থাকলে বিপদ হতে পারে।’

কৈলাসবাবু বললেন, ‘ছাতে গিয়েছিলাম বটে, তবে সঙ্গে বন্দুক ছিল। একটা আওয়াজ পেয়েই গিয়েছিলাম, যদিও গিয়ে কিছুই দেখতে পাই নি।’

‘বন্দুকটা সব সময়ই কাছে রাখেন তো?’

‘তা রাখি। তবে মানুষের মনের উদ্বেগ অনেক সময় তার হাতের আঙ্গুলে সঞ্চারিত হয় সেটা জানেন তো? বেশিদিন এইভাবে চললে আমার টিপের কি হবে জানি না।’

* * *