কে তুমি – ৬

ছয়

টুটুল নেই।

গোটা পৃথিবীটাই ফাঁকা হয়ে গেছে পলির কাছে। শূন্য হয়ে গেছে সারা জীবনটা। শ্মশানের ওপর নতুন করে খেলাঘর গড়েছিল পলি। সেখানে একটি মাত্র গৃহপ্রদীপ জ্বলছিল টুটুল। সেই টুটুল নেই!

টুটুল নেই, এ—কথা ভাবতেও পারে না পলি। এত বড় মর্মান্তিক সত্যকে না পারে ভাবতে, না পারে সে ভুলতে। জীবনটা তার শ্মশান করে চলে গিয়েছিল নরেন—তার প্রথম স্বামী। তবু সেই শ্মশানের বুকেই ধরল কুঁড়ি, ফুটল ফুল। সেই ফুলটি বুকে নিয়েই দিন কাটাচ্ছিল পলি। মুছে গিয়েছিল তার সব দুঃখ, সব বেদনা। তার সমস্ত শূন্যতা ভরে উঠেছিল টুটুলকে পেয়ে। তার চোখের আলো, তার বুকের নিশ্বাস টুটুল। সাত রাজার ধন একটি মাণিক।

সেই টুটুল নেই, অথচ পলি আছে। কেমন করে দিন কাটবে তার?

তবু দিন কাটছে বইকি! টুটুলের জামা, টুটুলের ছোট ছোট মোজা, ভাঙা পুতুল—এই সব বুকে করেই দিন কাটছে পলির।

কখনও হাসে, কখনও কাঁদে। কখনও বা মোজা—জামা—পুতুলকে চুমু খায় আর বিড়বিড় করে বকে।

একদিন মাঝরাতে ‘টুটুল এলি’ বলে চিৎকার করে দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়েছিল পলি। ফিরিয়ে এনেছিল বিজয় বিশ্বাস। নইলে কোথায় চলে যেত কে জানে!

আড়ালে চোখ মোছেন মিসেস নস্কর। বিজয় সান্ত্বনা দিয়ে বলে, তুমি অত ভেবো না পলি। টুটুলকে আমি খুঁজে বার করবই—ফিরিয়ে আনব তোমার কাছে।

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে পলি। কথাটা যেন বিশ্বাস হয় না।

বিজয় বললে, টুটুলের ছবি দিয়ে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিই, কি বলো? দেখি সন্ধান পাওয়া যায় কিনা! তারপর আদালত আছে।

শিউরে ওঠে পলি। বলে, না, না, না, নরেনকে তুমি জানো না, জোর করে নিতে গেলে টুটুলকে সে হয়তো মেরেই ফেলবে। টুটুলের সন্ধান চাই না, তুমি নরেনের সন্ধান এনে দাও।

.

উমেশ মজুমদার বললেন, হ্যাঁ, আমার স্ত্রী ফিরে এসেছেন। হপ্তাখানেক আগে। ডেকে পাঠাচ্ছি।

টুটুলের মাথায় হাত রেখে নরেন বললে, এই ছেলেটির কথাই বলেছিলাম।

ডান হাতের দুই আঙুল দিয়ে চশমাটা কপালের ওপর তুলে ধরলেন উমেশবাবু। এটি তাঁর অভ্যাস। বললেন, ও! এই ছেলেটি! তা এটি—

আমারই ছেলে। নরেন বললে।

চশমাটা আবার নাকের ওপর নামিয়ে রাখলেন উমেশবাবু। তারপর প্রশ্ন করলেন, নিজের ছেলেকে পরের হাতে দিতে চাইছেন কেন?

এ প্রশ্নের জবাব ভেবেই এসেছে নরেন। বললে, ভালোভাবে মানুষ হবে বলে। সামর্থ্য থাক আর নাই থাক, দুনিয়ার সকল বাপই তা আশা করে।

মনে হল জবাবটা মনঃপূত হয়েছে উমেশবাবুর। বললেন, তা বটে। ছেলেটির মা আছেন?

এক মুহূর্ত থেমে নরেন বললে, না।

দার্শনিকের মতো মুখ করে উমেশবাবু বললেন, বিচিত্র ব্যাপার সংসারে! আপনার ঘরে ছেলে আছে, মা নেই, আর আমার ঘরে দেখুন, মা হবার লোক মজুত, কিন্তু ছেলে নেই। অথচ ছেলের জন্যেই একবার নয়, দু—দুবার সংসারী হওয়া। শাস্ত্রেই তো বলেছে, পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। কিন্তু এমন কপাল যে কিছুতেই কিছু হল না! তাই আমার দ্বিতীয়া স্ত্রীর মুখ চেয়ে স্থির করলাম একটি পোষ্য—

হঠাৎ কথা বন্ধ হয়ে গেল উমেশবাবুর। মাথায় আধ—ঘোমটা টেনে ঘরে এসে দাঁড়ালেন একটি মহিলা। শান্ত সুশ্রী চেহারা। উমেশবাবুর দ্বিতীয়া স্ত্রী অনুভা। বয়সে উমেশবাবুর চেয়ে অনেকখানি ছোট।

উমেশবাবু বললেন, আমাদের বিজ্ঞাপন দেখে এই ভদ্রলোকটি এসেছেন অনু। ইনিই ছেলেটির বাবা। মা নেই, ছেলেটিকে দেখেশুনে নাও। তুমি মত দিলে এঁর সঙ্গে ব্যবস্থা করব।

একদৃষ্টিতে টুটুলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন অনুভা। একরাশ কোঁকড়ানো কালো চুলের নিচে ডাগর দুটি চোখ আর ফুলের মতো কচি মুখখানা দুর্নিবার আকর্ষণে তাঁকে টানছিল। দু—হাত বাড়িয়ে মিষ্টি গলায় তিনি ডাকলেন, এসো।

টুটুলের কিন্তু যাবার লক্ষণ দেখা গেল না। নরেনের হাঁটু ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে শুধু বললে, বাড়ি যাব।

নরেন বললে, যাও না—ডাকছেন!

অনুভা আবার ডাকলেন, এসো না খোকা! কত ছবি দেখাব তোমায়, পাখি দেখাব! লক্ষ্মী ছেলে, এসো!

এ প্রলোভনেও কোনো ফল হল না। টুটুল তেমনি দাঁড়িয়ে রইল। নরেনের হাঁটু ঘেঁষে। নরেন তার কানে কানে বললে, যাও না টুটুল! তোমায় কত ভালোবাসেন, কত খেলনা দেবেন! কত লজেন্স, কত চকোলেট—

টুটুল প্রশ্ন করলে, আর দম—দেওয়া মোটরগাড়ি?

নরেন বললে, নিশ্চয়, নিশ্চয়! তোমাকে কিনে দেবেন বইকি! যাও না ওঁর সঙ্গে।

উজ্জ্বল হয়ে উঠল টুটুলের চোখ দুটো। অনুভার দিকে এবারে এগোতে লাগল এক—পা এক—পা করে। সে পৌঁছবার আগেই অনুভা তাকে টপ করে কোলে তুলে নিলেন।

উমেশবাবু বললেন, তোমার মত আছে তো অনু? নরেনবাবুর সঙ্গে তাহলে পাকা কথা বলব?

বলো।—বলে টুটুলকে বুকে জড়িয়ে অনুভা ভেতরে চলে গেলেন।

সেই দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলেন উমেশবাবু। তারপর নরেনের দিকে ফিরে দার্শনিকের মুখভাব নিয়ে বললেন, মুনি—ঋষিরা এই জন্যেই সংসারটাকে বলেছেন, মায়া প্রপঞ্চ। একরত্তি একটা ছেলে কোথা থেকে এসে এক নিমিষে বেঁধে ফেলল। এও তো মায়ার খেলা।

কিন্তু নরেন দার্শনিক নয়, বস্তুতান্ত্রিক। তবু একজন বড় খদ্দেরের মন রাখার জন্যে তাকেও দার্শনিক সাজতে হল, বললে, বটেই তো! সংসার মানেই মায়া!

সাড়া দিলেন না উমেশবাবু। বোধ করি ডুবে রইলেন দর্শন তত্ত্বের চিন্তায়। কিন্তু নরেনের মনে তখন অর্থনীতির চিন্তা। হাতের রিস্টওয়াচটার দিকে তাকিয়ে সে হঠাৎ বলে উঠল, ওহো, অনেক বেলা হয়ে গেছে দেখছি! মাপ করবেন উমেশবাবু, কাজের কথাটা তাহলে হয়ে যাক। ছেলে যদি আপনাদের পছন্দ হয়ে থাকে, তাহলে বিজনেসটা এবারে মিটিয়ে ফেলাই ভালো।

হঠাৎ যেন ধ্যান থেকে জেগে উঠলেন উমেশবাবু। বললেন, ছেলে অবশ্যই পছন্দ হয়েছে অনুর। কিন্তু শুধু ছেলে পছন্দ হলেই নেওয়া চলে না নরেনবাবু।

কেন?

ছেলে যে আপনার, তার প্রমাণ কি? প্রমাণ না পেলে টাকাটাও দেওয়া যায় না!

দার্শনিকের খোলসের মধ্যে এতখানি কড়া পাটোয়ারী বুদ্ধি চাপা আছে, তা কে জানে! নরেন কিন্তু জানে। তাই তৈরি হয়েই এসেছে সে। বললে, কি প্রমাণ চান বলুন?

উমেশবাবু বললেন, যে কোনো সঙ্গত প্রমাণ হলেই চলবে। কিছু মনে করবেন না নরেনবাবু, প্রমাণের কথাটা তোলা এই কারণে যে, পরের হাতে ছেলে দেওয়াও যেমন গুরুদায়িত্ব আছে, পরের ছেলে নেওয়াতেও তেমনি গুরুদায়িত্ব। ধরুন এই ছেলে যদি আপনার না হয়ে অপরের হয়, তাহলে কি ফ্যাসাদেই আমায় পড়তে হবে ভাবুন দিকি!

নরেন সায় দিয়ে বললে, বটেই তো!

কাগজে তো দেখেছেন, ছেলেচুরির কারবার আজকাল কিরকম চলেছে!

ঠান্ডা গলায় নরেন বললে, দেখেছি বইকি! তারপর পকেট থেকে একখানা খাম বের করে উমেশবাবুর হাতে দিলে।

খাম থেকে বেরোল একখানা ফোটো।

উমেশবাবু বলে উঠলেন, এ তো ওই ছেলেটির ছবি! কিন্তু আপনিই যে এর বাপ, তার প্রমাণ কোথায়?

নরেন বললে, আছে। ফোটোর উলটো দিকটা দেখুন—

টুটুলের ফোটোর উলটো দিকটা দেখতে দেখতে উমেশবাবুর মুখের চেহারাই গেল বদলে। উলটো দিকে ইংরাজিতে লেখা রয়েছে:

‘প্রিয় নরেন, তোমার ছেলের জন্মদিনে আমার আন্তরিক আশীর্বাদ রইল।’ নিচে সই করা, জি. টমাস। সেন্টপলস চার্চ।

উমেশবাবু প্রশ্ন করলেন, টমাস সাহেবের সঙ্গে আপনার আলাপ কি সূত্রে?

নরেন বললে, ফাদার টমাস টুটুলের মায়ের সঙ্গে আমার বিবাহ দিয়েছিলেন।

উমেশবাবু যেন সাপ দেখলেন। বললেন, আপনি খ্রিস্টান?

মনে মনে নরেন বললে, এই সেরেছে! মুখের খাতিরে হয়েছিলাম। বিয়ের পর প্রায়শ্চিত্ত করে আবার হিন্দু হই।

তাই বলুন। উমেশবাবুর নিশ্বাস আবার সহজ হয়ে এল।

আর কোন প্রমাণ দরকার? প্রশ্ন করলে নরেন।

উমেশবাবু বললেন, না।

বেশ, তবে ফটোখানা আপনিই রেখে দিন। আর আমার প্রাপ্যটা—

উমেশবাবু বললেন, নিশ্চয় পাবেন। তার আগে একটি দানপত্র লিখে দিন, স্বেচ্ছায় এবং সজ্ঞানে—

পকেট থেকে একখানা ভাঁজ করা কাগজ বের করে নরেন বললে, আমি তৈরি হয়েই এসেছি।

কাগজখানায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে উমেশবাবু বললেন, ঠিক আছে। বসুন। আপনার চেকটা লিখে দিই।

টেবিলের ড্রয়ার খুলে চেকবই বার করলেন উমেশবাবু। আর নরেন ভাবতে লাগল, দশ হাজার টাকায় রেসের বুকী মিত্তিরের দেনার গর্তটা অনেকখানি বুজিয়ে দেওয়া যাবে। ইদানীং লাক মোটেই ফেভার করছে না নরেনকে।

কিন্তু সাধে বাদ সাধল টুটুল। তীর বেগে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল নরেনের কোলে। তারপর দুই হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল, বাড়ি যাব—মামির কাছে যাব। বাড়ি চলো বাপি!

কোঁকড়ানো কালো চুল কপালের ওপর ঝেঁপে আছে। ডাগর দুই চোখ ছাপিয়ে গোলাপি মুখখানা একাকার হয়ে গেছে চোখের জলে। টুটুল শুধু ফুঁপিয়ে ওঠে আর পাতলা ঠোঁট কাঁপিয়ে বলে, মামি যাব—বাড়ি চলো বাপি!

বাপি! কে শেখালে এই ডাক টুটুলকে? প্রকৃতি, না রক্তের টান? আবিষ্টের মতো বসে রইল নরেন। আর মুখের ওপর জলে ভেজা কচি মুখের ছোঁয়া পেয়ে থেকে থেকে শিউরে উঠতে লাগল।

থেমে গেল উমেশবাবুর হাতের কলম। ভেতর থেকে ব্যস্ত হয়ে এলেন অনুভা। এক হাতে রঙিন ছবির বই, আরেক হাতে পোষা একটা পায়রা নিয়ে অনুভা বলতে লাগলেন, ছি, কাঁদে না খোকন, এই নাও, ছবি নাও, পায়রা নাও! আমার কাছে এসো মাণিক। আরও কত জিনিস দোব তোমাকে—কত আদর করব। এসো খোকন!

কিন্তু ফিরেও চায় না টুটুল। ছোট্ট বুকখানার মধ্যে কি যে দুরন্ত অভিমান ফুলে ফুলে উঠছে তা সে—ই জানে। আরও শক্ত করে নেরনের গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুধু বলে, বাড়ি চলো বাপি—মামি যাব।

শক্ত দুটো হাতে টুটুলের কচি হাত দু’খানা মুঠো করে ধরলে নরেন। সামান্য এটু টান দিলেই নরম হাত দু’খানা খুলে আসবে নিজের গলার চারপাশ থেকে। তারপর অনুভার হাতে টুটুলকে দিয়ে উমেশবাবুর চেকখানা পকেটে পুরে চলে যেতেই বা কতক্ষণ!

কিন্তু একি আশ্চর্য কাণ্ড! নরেনের শক্ত সবল হাত দুটোতে জোর নেই একটুও। শুধু জোর নেই তা নয়, পুরু চামড়াওয়ালা হাত দুটো মোমের মতো নরম হাত দুটিকে আদর করছে আলতো ভাবে। যেমন করে ফুল ছোঁয় লোকে।

অনুভবা বললেন, বেশ খেলা করছিল, হঠাৎ কি যে হল—

স্থির হয়ে তাকিয়েছিলেন উমেশবাবু। ধীর গম্ভীর স্বরে বললেন, আমার মনে হয় নরেনবাবু, একদিনে হবে না। বেশ কিছুদিন আসা—যাওয়া করলে তবে যদি এ বাড়িতে খোকার মন বসে! রক্তের টান কি একদিনেই যায়?

কোনো জবাব দিল না নরেন। দিতে পারলে না। টুটুলের কচি দেহটা বুকে জড়িয়ে, উঠে চলে গেল আস্তে আস্তে। উমেশবাবু আর অনুভাকে একটা নমস্কার জানাতেও ভুলে গেল।

.

দশ হাজার টাকা মুঠোর মধ্যে এসেও ফসকে গেল। আফশোসের সীমা নেই নরেনের। ফসকে গেল শুধু ওই একফোঁটা টুটুলের জন্যে।

তবু হাল ছাড়েনি নরেন। পুরোনো হোটেল ছেড়ে বরানগর অঞ্চলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করতে হয়েছে টুটুলের জন্যে। সেইখান থেকেই চলেছে টুটুলকে নিয়ে উত্তরপাড়ায় যাতায়াত।

অনুভার ঘরে ঢুকলে মনে হয় একটা খেলনার দোকানে এসেছি। রবারের হাঁস, প্ল্যাস্টিকের জাহাজ, লাইনপাতা রেলগাড়ি, দম—দেওয়া মোটর, ঘাড়—নড়া বুড়ো, চাকা—লাগানো কাঠের ঘোড়া, আরও কত। টুটুল—পাখিকে ফাঁকে ফেলবার কতশত আয়োজন।

ফাঁদে অনেকখানি পাও দিয়েছে টুটুল। আগের মতো আজকাল আর ছুটে পালিয়ে আসে না অনুভার কোল থেকে। বেশ থাকে সারাদিন। শুধু সন্ধে হয়ে এলেই আর রাখা যায় না তাকে। আজকাল আর ‘মামি যাব’ বলে না, বলে, ‘বাপি যাব’। সন্ধেবেলা নরেন তাকে নিয়ে না আসা পর্যন্ত ছটফট করে। তারপর বরানগরে সেই ফ্ল্যাটে নরেনের বিছানায় শুয়ে বাপের গায়ে একটি পা তুলে দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। আর সারারাত ছটফট করে না।

কিন্তু ছটফট করে নরেন। এ জীবন তার নয়। এ জীবনের জন্যে সে তৈরি হয়নি। তার জীবনের ফরমুলা আলাদ, ছাঁচ আলাদা। সোজা সরল রাজপথ ছেড়ে বাঁকাচোরা গলিপথেই সে চলে এসেছে এতদিন। যে পথে সে চলেছে, সেটা হচ্ছে একমুখী রাস্তা। ওয়ান ওয়ে স্ট্রিট। এগিয়ে চলা যায়, ফেরা যায় না। এই বাঁকা—চোরা পথেই সে চলবে। যতদিন না তার জীবন—গাড়ি শেষ স্টপেজে থামে।

কিন্তু একি হল! সে কি বদলে যাচ্ছে?

শক্ত ধাতুর মানুষ সে। তার জীবনে দয়া মায়া স্নেহ প্রেম রাগ অনুরাগের বালাই নেই। সে জানে শুধু টাকা। টাকা ছাড়া আর কিছু জানতেও চায় না। অনেক টাকা এসেছে তার হাতে, উড়ে গেছে অনেক টাকা। আরো অনেক টাকা তার চাই। এই টাকার নেশাতেই আবার একদিন সে এলাহাবাদের ট্রেনে উঠে বসল সান্যাল বাড়ির উদ্দেশে।

টুটুল রইল অনুভার কাছে দিন দুয়েকের জন্যে।

.

মোগলসরাইয়ে ট্রেন থামল বেলা সাড়ে আটটায়।

হেমন্তের মাঝামাঝি। তবু পশ্চিমের শীত এরই মধ্যে কনকনে হয়ে উঠেছে। ওভারকোটের কলার তুলে দিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ল নরেন। ভালো সিগারেট এক টিন চাই। সঙ্গে যা আছে, তাতে কুলোবে না। কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে নরেন এগোল স্টেশনের স্টলের দিকে।

উলটো দিকের প্ল্যাটফর্মে তখন থেমেছে একখানা ডাউন ট্রেন। তারই একখানা ফার্স্ট ক্লাস কামরার জানলা থেকে মিলিটারি ক্যাপের নিচে দুটি তীক্ষ্ন—উজ্জ্বল চোখ হঠাৎ সজাগ হয়ে অনুসরণ করতে লাগল নরেনকে।

সিগারেট কিনে নরেন যখন নিজের কামরায় ফিরে এল, তখন গার্ডের হাতে সবুজ নিশান দুলছে, বাজছে হুইসল। নরেন দেখতে পেল না, উলটো দিকের প্ল্যাটফর্ম থেকে সেই মিলিটারি ক্যাপ—পরা মূর্তিটি ছুটে এসে এদিকের চলতি ট্রেনে উঠে পড়ল। উঠল ঠিক নরেনের পাশের কামরায়।

বর্ষার পর শরৎ, তারপর হেমন্ত। বেলা অনেক ছোট হয়ে এসেছে। যমুনার জল অনেক স্বচ্ছ। এলাহাবাদ ফোর্টের পিছন দিকে পাশাপাশি বসে আছে সুজিত আর সুধা। যমুনার ঢালু পাড়ের ঠিক উপরে।

কথা নেই দুজনের। ছোট ছোট মাটির ঢেলা কুড়িয়ে টুপটাপ করে জলে ফেলছে সুজিত। আর, সাদা একখানা শাল মুড়ি দিয়ে সুধা চেয়ে আছে জলের দিকে।

ঢিল ছোড়া থামিয়ে সুজিত একসময় প্রশ্ন করল, সান্যালবাড়িতে কি তোমার কোনো কষ্ট হচ্ছে?

চোখ তুলে তাকাল সুধা। বললে, একথা কেন?

সুজিত বললে, আগের চেয়ে তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছ। সর্বদা কেমন ক্লান্ত দেখায় আজকাল। আগের চেয়ে অনেক চুপচাপ। মনে হয়, অহরহ কি যেন নিগ্রহ চলেছে তোমার ওপর। মা’তে আমাতে এই নিয়ে প্রায়ই কথা হয়।

চমকে উঠে সুধা বললে, কি কথা হয়?

আমাদের বাড়িতে তোমার বোধ হয় কোন কষ্ট হচ্ছে।

ফিকে একটুখানি হাসি দেখা দিল সুধার মুখে। বললে, কষ্ট! এ যদি কষ্ট হয়, তাহলে সুখ কি আমি তা জানি না। ভিখারিণী মণি কুড়িয়ে পেলে কি কষ্ট হয়? তোমাদের সংসারে এসে যে সুখ পেয়েছি, তার চেয়ে বড় সুখ আমি কল্পনাও করতে পারি না।

সুজিত বললে, হয়তো সুখী হয়েছ, কিন্তু সান্যাল বাড়ির সঙ্গে তুমি ঠিক মিশে যেতে পারোনি। দেহটা তোমার সান্যাল বাড়িতে থাকলেও তোমার মনটা যেন সান্যাল বাড়িতে নেই।

সুধার মুখে ফিকে হাসিটি ঠিক তেমনি লেগে রইল। বললে, এটাও তোমাদের ভুল। সান্যাল বাড়ি ছেড়ে আমার মন একটা মুহূর্তও আর কোথাও থাকে না।

সুজিত বললে, তাই যদি হয়, তবু বলব, তোমার মন আজও ধরা দেয়নি আমাদের কাছে। তোমার আর আমাদের মাঝখানে একটা রেখা যেন টানা হয়েছে। সেটা ডিঙিয়ে তোমার মন আসতে পারছে না। তুমি কি বলতে চাও, এও আমাদের ভুল?

মুখের হাসি নিভে গেল সুধার। যেমন করে এক ফুঁয়ে নিভে যায় মোমের বাতি। আহত পাখির ডানার মতো কৃষ্ণপক্ষ চোখের পাতা দুটি নেমে এল ধীরে ধীরে। যমুনার দিকে মুখ ফিরিয়ে চুপ করে বসে রইল সুধা। দিগন্তের পটে আঁকা ছবির মতো।

সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সুজিত অত্যন্ত কোমল গলায় বলতে লাগল, তুমি নিশ্চিন্ত থেকো, তোমার মধ্যে কি রহস্য আছে, আমি কোনোদিন জানতে চাইব না। জানতে চাওয়াও আমার উচিত নয়। তবে কোনোদিন যদি বলার সময় আসে, অসঙ্কোচে বোলো। আত্মীয়তা ছাড়াও তোমার সঙ্গে আমার যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, কোনো মতেই তা ক্ষুণ্ণ হবে না জেনো।

জলের দিকে মুখ ফিরিয়ে সুধা তেমনি বাসে। সুজিত দেখতে পেল না, তার দুই গাল জলে ভেসে গেছে।

হেমন্তের ছোট বেলা পড়ে এল। যমুনার ওপর কুয়াশা আর অন্ধকার নামছে ভারি হয়ে। সুজিত উঠে দাঁড়িয়ে বললে, চলো, বাড়ি ফিরি। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমি ল’ ক্লাসে যাব।

নিজেকে সামলে নিয়ে সুধা উঠে দাঁড়াল। তারপর সুজিতের পিছু পিছু এগোল, দূরে যেখানে হাডসনখানা দাঁড়িয়ে।

যেতে যেতে সুজিত একবার মুখ ফিরিয়ে বললে, সাবধানে এসো, পথটা ভালো নয়।

সুধার বুকের মধ্যে কে যেন বলে উঠল, নাই ভালো হোক, তুমি তো আছো!

নারীর কাছে এই ‘তুমি’ বড় বিচিত্র। তার আধখানা মুখ দেবতার, আধখানা মুখ প্রিয়ের। নিজের কাছে নিজেই হার মেনে সুধা বুঝি আজ তারই শরণ নিল।

.

সান্যাল বাড়ির ফটকে সুধাকে নামিয়ে দিয়ে হাডসনখানা বেরিয়ে গেল। সুধার সমস্ত মন জুড়ে এক অপূর্ব মধুরতার রেশ রয়েছে তখনও।

আলো জ্বলছে বাইরের হলঘরে। ফটক ঠেলে বাগান পার হয়ে ভেতরে ঢুকল সুধা। হলে পা দিতেই যেন সাপ দেখল। একটা কৌচে বসে কালো ওভারকোট গায়ে একজন সিগারেট টানছে। পেছন থেকেও তাকে চিনতে ভুল হল না সুধার। নরেন দাশ! তার জীবনের শনিগ্রহ!

নিমেষে পাথর হয়ে গেল সুধা। মনে হল, শরীরের সমস্ত রক্ত যেন মাথায় উঠে যাচ্ছে।

সুধাকে দেখে কৌচ থেকে উঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কাছে এল নরেন। তারপর বললে, কোথায় গিয়েছিলে? বেড়াতে? আমি অনেকক্ষণ বসে আছি।

নরেনের চেয়েও ঠান্ডা গলায় সুধা বললে, কতক্ষণ এসেছ?

আধ ঘণ্টা হবে। আবার আমাকে আসতে হল সুধা। দশ হাজার টাকার সেই কারবারটা হয়েও হল না।

টাকার বড় দরকার, না?—অত্যন্ত শান্ত গলায় প্রশ্ন করলে সুধা।

ভয়ানক দরকার। তুমি তো জানো, টাকা ছাড়া আমি থাকতে পারি না, বাঁচতে পারি না।

আর আমার কাছে এলেই আমি টাকা দোব, এও তুমি জানো। তাই না?

ঠিক তাই। তুমি সত্যিই বুদ্ধিমতী সুধা।

একটু বসো।

দ্রুতপায়ে সুধা ওপরে চলে গেল।

নরেন বসলে না। ওভারকোটের পকেট থেকে সিগারেটের টিন বার করে একটা ধরাতে লাগল। এবার সুধার এই সুমতি দেখে খুশি হয়েছে সে।

.

দোতলায় উঠে নিজের ঘরে গেল না সুধা। সোজা ঢুকল সুজিতের ঘরে। বালিশের তলা থেকে চাবিটা নিয়ে খুলে ফেলল টেবিলের ড্রয়ার। প্রথম ডালাটা টানতেই বেরোল, সুধা আর সুজিতের সেই ফোটোখানা। সেই পোলিশ ভদ্রলোকের তোলা। স্তব্ধ হয়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল সুধা। তারপর প্রথম ডালাটা বন্ধ করে টানল দ্বিতীয় ডালা। ডান হাতে কি একটা জিনিস তুলে নিয়ে লুকিয়ে ফেলল শালের নিচে। তারপর বাঁ হাতে ড্রয়ারটা বন্ধ করে চাবিটা যথাস্থানে রেখে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

নিচের হলে সুধা যখন ফিরে এল, তখন সিগারেট টানতে টানতে পায়চারি করছে নরেন। সুধাকে দেখে উৎসুক গলায় বললে, কত এনেছ?

তেমনি ঠান্ডা আর শান্ত গলায় সুধা প্রশ্ন করলে, কত পেলে খুশি হও?

সিগারেটটা ঠোঁটের কোণে চেপে নরেন জবাব দিল, দশ হাজারের যে কারবারটা ফসকে গেল, সেটার ক্ষতিপূরণ হলেই খুশি হই।

তিক্ত হাসিতে সুধার চোখের প্রান্ত দুটো কুঁচকে গেল। দুই চোখের লক্ষ্য নরেনের মুখের দিকে রেখে সাপের নিশ্বাসের মতো চাপা আওয়াজে বলতে লাগল, প্রথমবারে এক হাজার, তারপর তিন হাজার, তারপর দশ হাজার। মানুষের লোভ এমনিই বটে! তুমি ভেবেছ, চিরকাল জুলুম চালিয়ে যাবে, আর ব্ল্যাকমেলের ভয়ে আমি সহ্য করে যাব চিরকাল! কিন্তু আর তা হবে না। মানুষের লোভের সীমা আছে, পাপের সীমা আছে, জুলুমেরও সীমা আছে। বেরিয়ে যাও—এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও এখান থেকে—নইলে জ্যান্ত ফিরতে পারবে না—

পলকে সুধার ডান হাতখানা বেরিয়ে এল শালের আড়াল থেকে। আর তার ডান হাতের দিকে তাকিয়ে নরেনের মুখ থেকে খসে পড়ল সিগারেটটা। কিন্তু শক্ত স্নায়ুর মানুষ নরেন। ভয়ঙ্কর ঠান্ডা গলায় শুধু বললে, পিস্তল নিয়ে তামাশা করতে নেই সুধা, ওটা রেখে দাও।

পিস্তলটা নরেনের দিকে উঁচু করে এগোতে এগোতে সুধা বলতে লাগল, আর একটা কথা নয়, বেরিয়ে যাও, এখুনি বেরিয়ে যাও—

আঃ, সুধা! ওটা রেখে দাও বলছি—

নরেন দাশ পিছু হাঁটছে।

চুপ করো, নইলে কুকুরের মতো—

সুধা!

আরও কয়েক পা পিছিয়ে গেল নরেন।

শেষবার বলছি, বেরিয়ে যাও!

উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে সুধার ডান হাতে।

চকিতের মধ্যে সেই যান্ত্রিক হাসি দেখা দিল নরেনের মুখে। আরও এক—পা পিছিয়ে গিয়ে বললে, আমিও শেষবার বলছি, পরিণামটা ভেবে দেখো—

উত্তরে দুম করে শুধু একটা আওয়াজ হল সুধার ডান হাত থেকে। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা চক্কর খেয়ে দরজার বাইরে অন্ধকারে ছিটকে পড়ল নরেন দাশ।

দোতলার সিঁড়ি থেকে শোনা গেল স্বর্ণময়ীর তীব্র ব্যাকুল গলার স্বর: কি হল? কিসের আওয়াজ হল? রঘুয়া—মহাদেও—বুধনি!

কাঁপতে কাঁপতে সুধা সুইচ টেনে হলের ভেতরটা দিলে অন্ধকার করে।

.

রাত ন’টা নাগাদ হাডসনখানা সান্যাল বাড়ির পোর্টিকোয় এসে থামতেই ছুটে এল রঘুয়া। জানালে, হাসপাতাল থেকে দু’বার টেলিফোন এসেছিল সুজিতের জন্যে। ব্যাপারটা ভয়ানক জরুরী। বলেছে, বাবু বাড়িতে আসামাত্র হসপিটালে যেন টেলিফোন করেন।

গাড়ি থেকে একরকম লাফিয়েই পড়ল সুজিত। প্রশ্ন করলে, কেন? কি হয়েছে? মা আর বউদি কোথায়?

রঘুয়া জানালে, তাঁরা তো বাড়িতেই!

তবে? ব্যস্ত হয়ে ছুটল সুজিত লাইব্রেরি—ঘরের দিকে। রিসিভারটা তুলে নিয়ে হসপিটালের কানেকশন চাইল সুজিত।

হ্যালো! হসপিটাল? আমি সুজিত সান্যাল কথা বলছি। আপনারা কি এর আগে আমায়…হ্যাঁ, হ্যাঁ, নরেন দাশকে চিনি বইকি। মাই গড—পিস্তলের গুলিতে জখম হয়েছেন? বাঁচবার আশা নেই?…হ্যাঁ, নরেনবাবুকে বলুন, তাঁর বোনকে নিয়ে আমি এখুনিই যাচ্ছি—একা দেখা করতে বলেছেন? বেশ, একাই যাচ্ছি।

রিসিভারটা নামিয়ে রাখল সুজিত। তারপর মিনিট দুয়েকের মধ্যেই হাডসনখানা বেরিয়ে গেল সান্যাল বাড়ির ফটক থেকে।

.

শেষ জবানবন্দি লিখে নিচ্ছিলেন পুলিশ অফিসার। রুগির মুখের ওপর ঝুঁকে প্রশ্ন করলেন, আপনাকে গুলি করেছে কে?

শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল নরেনের। সমস্ত বুকটা ব্যান্ডেজে বাঁধা। কোনো জবাব দিলে না।

অফিসার আবার বললেন, ঠিক মনে করে বলুন তো, কে গুলি করেছে আপনাকে?

আস্তে আস্তে নরেন বললে, আমার নিয়তি।

কিন্তু নিয়তি তো পিস্তল দিয়ে গুলি করে না, গুলি করেছে নিশ্চয় কোনো মানুষ। কে সে?

আবার শ্বাস টানতে লাগল নরেন। বাঁ—দিকের পাঁজরার মধ্যে যেন একটা আগুনের পিণ্ড।

একটু অপেক্ষা করে পুলিশ অফিসার বললেন, কে সে বলুন তো? কাকে গুলি করতে দেখেছেন আপনি?

নরেনের ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল শুধু। আর কেঁপে উঠল তার মাথার গোড়ায় দাঁড়ানো মিলিটারি পোশাক পরা একটি মূর্তি। সে মূর্তি বিজয় বিশ্বাসের।

লোহার খাটের রেলিংটা দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরলে বিজয় বিশ্বাস। তার মাথার চুল থেকে পায়ের গোড়া অবধি শীতার্তের মতো কাঁপছে থরথর করে।

অফিসার আবার বললেন, বেশ করে মনে করুন তো, কে আপনাকে গুলি করেছে?

আর একবার শ্বাস নিয়ে নরেন বললে, কেউ নয়, আমি নিজে।

হঠাৎ কি যেন বলবার চেষ্টা করলে বিজয়। একটা বিকৃত আওয়াজ বেরোল শুধু। আর ঠিক সেই মুহূর্তে নরেন তার দিকে চোখ ফেরাতেই বোবা হয়ে গেল সে।

কয়েকটি রেখা পড়ল অফিসারের কপালে। তীক্ষ্ন চোখে নরেনের মুখের পানে চেয়ে বললেন, আপনি তাহলে আত্মহত্যা করেছেন?

হ্যাঁ।

ভুল হচ্ছে না তো আপনার?

না।

আপনার কি নিজের রিভলভার আছে?

না।

তবে অস্ত্র পেলেন কোথা থেকে?

থেমে থেমে নরেন জবাব দিলে, আমার বন্ধু মিস্টার বিশ্বাসের রিভলভার লুকিয়ে নিয়েছিলাম।

ও। এই তাহলে আপনার শেষ কথা?

এই শেষ কথা।

কিন্তু আত্মহত্যা করলেন কেন?

জবাব এল না। যন্ত্রণার মুখ বিকৃত করলে নরেন।

নরেনের শেষ জবানবন্দি নিয়ে চলে গেলেন পুলিশ অফিসার। আর মাথার গোড়া থেকে এক—পা এক—পা করে নরেনের দিকে এগিয়ে এল বিজয় বিশ্বাস। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল খাটের পাশে। বলতে লাগল, এ কি করলেন আপনি? কেন মিথ্যে এজাহার দিলেন পুলিশের কাছে? কেন বললেন না, ট্রেন থেকে এলাহাবাদের হোটেল পর্যন্ত আপনার পিছু নিয়েছিলাম আমি। তারপর টুটুলকে ফিরিয়ে দিতে আপনি রাজি হননি বলে রাগের মাথায় আপনাকে আমি গুলি—

না, না, তুমি নও। অনেক কষ্টে নরেন বললে, ধস্তাধস্তির সময় আমি তোমার হাতে মুচড়ে—পিস্তল কেড়ে নিতে গিয়ে—হঠাৎ ফায়ার—

নরেনের ডান হাতখানা কাঁপতে কাঁপতে বিজয় বিশ্বাসের একখানা হাত স্পর্শ করলে। তারপর থেমে থেকে নরেন বললে, পলি আর টুটুলকে দেখার কেউ নেই। তুমি দেখো। কই, ওরা তো এখনও—

নরেনের মুখের ওপর ঝুঁকে বিজয় বললে, উত্তরপাড়ার ঠিকানা দিয়ে পলিকে আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করেছি। ওরা নিশ্চয় এতক্ষণ ট্রেনে।

উজ্জ্বল হয়ে উঠল নরেনের মুখ—চোখ।

একটু চুপ করে থেকে নরেন বললে, আমায় একটা জিনিস এনে দেবেন বিজয়বাবু?

কি, বলুন!

একটা ভাল খেলনা—রেলগাড়ি।

উঠে চলে গেল বিজয় বিশ্বাস। গভীর অবসাদে ধীরে ধীরে চোখ বুজে এল নরেনের। ভাবতে লাগল, রাত এখন কত। ভোর হতে কত দেরি। কত দূরে এসে এসে পৌঁছেছে পলি আর টুটুল।

নরেনবাবু!

আবার ধীরে ধীরে চোখ মেললে নরেন। সুজিত সান্যাল দাঁড়িয়ে।

সুজিত বললে, বাইরে পুলিশ অফিসারের মুখে সব শুনলাম। আমি ভাবতেও পারিনি যে আপনার মতো লোক অবুঝের মতন নিজের জীবনটাকে—

নরেন বললে, ও—কথা থাক। জরুরী কথা আছে।

জরুরী কথা! আমার সঙ্গে?

হ্যাঁ, আপনারই সঙ্গে। কাছে বসুন।

ছোট্ট টুলটা সুজিত টেনে নিলে বিছানার পাশে। বললে, বলুন।

শ্বাস টেনে টেনে নরেন বলতে লাগল, আপনারা যাকে জয়ন্তী সান্যাল বলে জানেন, সে জয়ন্তী নয়।

কয়েক মুহূর্ত হতবাক হয়ে গেল সুজিত। যেন অনেকদিনের প্রত্যাশিত একটা আঘাত এসে লাগল তার বুকে। তবু বিস্ময়, আঘাত আর বেদনাবোধকে ছাপিয়ে একটা গভীর স্বস্তির আভাস ছড়িয়ে পড়ল তার সারা মনে। নরেনের মুখের ওপর ঝুঁকে সে বলে উঠল, জয়ন্তী নয়? তবে কে? বলুন, কে সে?

একটা বড় শ্বাস টেনে নরেন বললে, ভদ্র বংশের একটি কুমারী মেয়ে। নাম সুধা সোম। আট মাস আগে এমনি এক অন্ধকার রাতে আমি আর সুধা চলেছিলাম বম্বে মেলে। সেই কামরায় ছিলেন আপনার বউদি জয়ন্তী—

নিচের ঠোঁটটা হঠাৎ দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলে নরেন। একটা আগুনের রেখা এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে পড়ছে সারা বুকটায়। ছুটে এল নার্স। বললে, আর কথা বলবেন না। কথা বললে আপনার ব্লিডিং বাড়বে যে!

প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে নরেন বললে, বাড়ুক। তবু আমাকে বলতেই হবে।

সুজিত বললে, এত কষ্ট হচ্ছে যখন, তখন না—ই বললেন নরেনবাবু।

অস্থির হয়ে উঠল নরেন। বললে, না, না, বাকিটুকু শুনে যান। নইলে আর বলা হবে না।

.

ধোঁয়ার সঙ্গে আগুনের ফুলকি উড়িয়ে ছুটে চলেছে মেল ট্রেন। দেড় মিনিট অন্তর পার হয়ে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল। তবু পথ যেন আর ফুরোয় না। ফুরোয় না এই অন্ধ ত্রিযামা রাত্রির শেষ যাম।

একটা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় আচ্ছন্নের মতো বসে আছে পলি। পলক নেই দুই চোখে। আর তারই বুকের কাছে র্যাপার মুড়ি দিয়ে বসে মাঝে মাঝে টুটুল বলছে, গাড়ি কেন থামছে না মামি? কখন যাব বাপির কাছে?

.

শ্বাস টেনে টেনে নরেন তখনও বলছে, এই হল জাল জয়ন্তী সান্যালের সমস্ত ইতিহাস। এর একটি কথাও মিথ্যে নয়। অপরাধ যা কিছু, সব আমার। বিশ্বাস করুন, সুধার কোনো অপরাধ নেই সুজিতবাবু। কতখানি নিরুপায় হয়ে সে আমাকে গুলি করেছিল, সে একমাত্র আমিই জানি। অনভ্যস্ত হাত, তাই বেঁচে গেলাম। কিন্তু নিয়তির হাত থেকে বাঁচতে পারলাম কই!

স্তব্ধ হয়ে বসে শুনছিল সুজিত। হাসপাতালের এই পরিবেশ যেন সে ভুলে গেছে।

নরেন আবার বললে, সুধার মতো নিষ্পাপ মেয়ে সংসারে খুব কমই দেখা যায় সুজিতবাবু। বিনা দোষে তাকে শাস্তি দেবেন না, এই আমার শেষ অনুরোধে। আর আমার বলবার কিছু নেই।

একটিও কথা বললে না সুজিত। জড়ের মতো বসে রইল কিছুক্ষণ! তারপর আস্তে আস্তে উঠে চলে গেল।

.

হাডসনখানা আবার যখন সান্যাল বাড়ির পোর্টিকোয় ফিরে এল, তখন রাত অনেক। অন্ধকার হলঘর পার হয়ে সুজিত সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল দোতলায়। স্বর্ণময়ীর ঘরের দরজা বন্ধ। সুজিত একবার থমকে দাঁড়াল। হয়তো শুয়ে পড়েছেন স্বর্ণময়ী। হয়তো জেগে আছেন বিনিদ্র চোখ মেলে। কি বলবে তাঁকে সুজিত? কেমন করে তাঁর বিশ্বাসের ভিত্তি এক আঘাতে ভেঙে চুরমার করে দেবে? কেমন করে জানাবে যে এ বাড়ির জয়ন্তী সান্যাল একটা চোর জালিয়াত মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নয়? তার চেয়ে বরং যে অপরাধী, তার সঙ্গেই আগে বোঝাপড়া করা যাক।

সুধার ঘরের দিকে এগোল সুজিত। দরজা ভেজানো। সরু ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। সুধা তাহলে ঘুমোয়নি এখনও।

সুজিত দরজায় আওয়াজ করলে।

কোনো সাড়া এল না।

আবার আওয়াজ করলে সুজিত। আরো একটু জোরে।

তবু সাড়া এল না।

অধৈর্য হয়ে দরজার কপাট দুটো খুলে দিলে সুজিত। শূন্য ঘর। সুধা নেই।

অস্থির হয়ে ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল সুজিত। এপাশ—ওপাশ তাকাতে তাকাতে হঠাৎ টেবিলের ওপর তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। ভাঁজকরা একখানি কাগজ রয়েছে। স্বর্ণময়ীর দেওয়া রুলি দু’গাছা চাপা দেওয়া। তারই পাশে পড়ে আছে সেই পোলিশ ভদ্রলোকের তোলা ফোটোর আধখানা। সুধার অংশটা নেই।

দম দেওয়া পুতুলের মতো হাত বাড়িয়ে সুজিত তুলে নিল ভাঁজ করা কাগজখানা। একখানা চিঠি:

শ্রীচরণেষু,

তোমাকে সব কথা নরেনদা জানাবার আগে আমিই জানিয়ে যাই। আমি জয়ন্তী নই। আমি তোমাদের কেউ নই। এতদিন আমি তোমাদের শুধু ঠকিয়েছি। তবু বিশ্বাস করো, তার চেয়ে বেশি ঠকিয়েছি নিজেকে। জয়ন্তী হয়ে পাবার উপায় নেই তোমাকে, সুধা হয়েও পাব না এ—জন্মে। আমার দুই জীবনই ব্যর্থ। তাই আজ শেষ করে দিয়ে যাচ্ছি এ মিথ্যে খেলা।

যাবার আগে মায়ের দরজার গোড়ায় প্রণাম করে গেলাম। বড় ইচ্ছে ছিল তোমাকেও একটা প্রণাম করে যাই। কিন্তু ভাগ্য আমাকে সে—ভিক্ষেটুকুও দিল না।

আমার অপরাধ ক্ষমা করতে পারবে না জানি। ভুলে যাবার চেষ্টা করো। হয়তো পারবে একদিন। আমার জন্যে ভেবো না। গঙ্গা—যমুনায় অনেক জল আছে। ইতি—

 সুধা

চিঠি পড়া শেষ করে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুজিত। দেওয়াল ঘড়ির পেন্ডুলাম আর তার বুকের স্পন্দন বাজতে লাগল একই তালে। চলে গেল অনেকগুলি মুহূর্ত। হঠাৎ কে যেন ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিলে সুজিতকে। চিঠিখানা হাতে নিয়ে সে ছুটে বেরিয়ে এল বারান্দায়। চিৎকার দিয়ে উঠল, মা! মা! রঘুয়া!

দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন স্বর্ণময়ী। উৎকণ্ঠায় শুকনো মুখে বললেন, কি—কি হয়েছে সুজিত?

সুধা কোথায় জানো মা?

সুধা!

জয়ন্তী—জয়ন্তী কোথায়?

কেন, ঘরে নেই? সন্ধে থেকে তো ঘরেই ছিল দোর বন্ধ করে!

রুদ্ধশ্বাসে সুজিত বললে, সে নেই।

স্বর্ণময়ীর চোখে জল এসে পড়ল। উৎকণ্ঠায় বলে উঠলেন, নেই! তবে গেল কোথায়? সন্ধে থেকে আজ এসব কী কাণ্ড হচ্ছে বাড়িতে!

তাঁর পায়ের কাছে চিঠিখানা ছুড়ে দিয়ে সুজিত একরকম ছুটেই নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। সিঁড়ির গোড়ায় রঘুয়া দাঁড়িয়ে।

বহুজী কোথায়, জানিস?

রঘুয়া বললে, তিনি তো খানিক আগে বেরিয়ে গেলেন।

কতক্ষণ আগে? সুজিতের নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে।

আধা ঘণ্টা হবে। আমি পুছলুম, কোথায় যাচ্ছেন? বহুজী বললেন, শিউ মন্দিরমে।

সুজিত আর দাঁড়াল না। একটু পরেই প্রচণ্ড গর্জন তুলে শিকারী কুকুরের মতোই বিদ্যুৎগতিতে বেরিয়ে গেল হাড়সনখানা।

.

ফোর্টের কিছু দূরে এসেই ব্রেক কষলে সুজিত। তারপর গাড়ি থেকে নেমে এগোতে লাগল দ্রুত পায়ে। চোখের দৃষ্টি যথা সম্ভব তীক্ষ্ন করে তাকাতে লাগল চারপাশে।

অনেক রাতে একফালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। ঝিমঝিমে জ্যোৎস্নায় কুয়াশা যেন গলে পড়ছে। ভালো করে ঠাহর হয় না কিছু। সব যেন আবছা।

এগিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ থমকে থেমে গেল সুজিত। যমুনার পাড় ঘেঁষে একটা ঢিবির ওপর কে যেন বসে না? গায়ে সাদা শাল মুড়ি দেওয়া।

লোকে যেমন করে প্রদীপ উস্কে দেয়, দৃষ্টিকে তেমনি আরও উজ্জ্বল করে তাকালে সুজিত। তারপর চিৎকার করে উঠল, সুধা!

মূর্তিটি কেঁপে উঠল। তারপর আস্তে আস্তে উঠে এগোতে লাগল গঙ্গার দিকে।

গলা চিরে ডাকতে ডাকতে সুজিত ছুটল, সুধা! সুধা! সুধা!

মূর্তি আরও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে!

আরও জোরে ছুটল সুজিত।

সুধা—দাঁড়াও—সুধা!

হু—হু বাতাস আর জল—কলরোলে ভেসে গেল সুজিতের ডাক। হঠাৎ দিগদিগন্ত অনুরণিত করে অতি—পরিচিত একটা জলোচ্ছ্বাসের শব্দ ভেসে এল দূর থেকে। এক সেকেন্ডের জন্যে হিম হয়ে গেল সুজিতের শরীরের রক্ত। তারপর চিৎকার করতে করতে তীরবেগে ছুটল সুজিত, আর এগিও না সুধা—দাঁড়াও! গঙ্গার পাড় ভাঙছে।

মূর্তি তবু এগিয়ে চলেছে।

আবার সেই জলোচ্ছ্বাসের শব্দ! সুজিত আর একবার চিৎকার করল, সুধা—এগিয়ো না—

সাদা মূর্তিটি ততক্ষণে গঙ্গার প্রায় তীরে এসে পৌঁছেছে। আর এক—পা এগোবার আগেই সুজিতের দু’খানা সবল বাহু তাকে তুলে নিয়ে পিছিয়ে গেল দশ—পনেরো হাত। আর সঙ্গে সঙ্গে নিশীথ—রাত্রির স্তব্ধতাকে খণ্ড খণ্ড করে প্রচণ্ড শব্দে ধসে পড়ল গঙ্গার খানিকটা পাড়।

সুধাকে নিয়ে যমুনার ধারে সেই ঢিবির কাছে সুজিত যখন এসে পৌঁছল, তখন সমস্ত শরীর তার ভিজে গেছে ঘামে। আর ভীরু পাখির মতন সুধার দেহটা নিশ্চেতন হয়ে আছে তার দুই সবল বাহুর মধ্যে। আস্তে আস্তে সুধাকে সে শুইয়ে দিলে ঢিবির ওপর। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে সেই নির্জন নদীতীরে খোলা আকাশের নিচে শেষ রাত্রির মরা জ্যোৎস্নার আলোয় সুধার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।

না, কোনো কালিমা নেই এ—মুখে। আলগোছে সুধার কপালে হাত রেখে মৃদু গলায় সুজিত ডাকলে, সুধা!

অতি ধীরে চোখ মেলে চাইলে সুধা। যেন অনেক ঘুমের পর জেগেছে।

সুজিত আবার ডাকলে, সুধা!

উঠে বসতে গিয়ে টলে পড়ছিল সুধা। সুজিত ধরে ফেললে দুই বাহু দিয়ে। বড় ক্লান্ত গলায় সুধা বললে, কেন মরতে দিলে না আমায়?

সুজিত বললে, তোমার মনকে এ প্রশ্ন কোরো, উত্তর পাবে। এখন বাড়ি চলো।

ক্লান্ত বিষণ্ণ চোখ দুটি তুলে তাকাল সুধা। বললে, বাড়ি? কেমন করে যাব? কোন পরিচয়ে?

তুমি সান্যাল বাড়ির বউ—এই পরিচয়ে। যে পরিচয় একদিন মিথ্যে ছিল, আজ তা সত্য হোক।

কিন্তু মা? মা আমার অপরাধ ক্ষমা করতে পারবেন?

সুন্দর একটু হাসি দেখা দিল সুজিতের মুখে। বললে, আমার মাকে তুমি ভালো করে জানো না সুধা, তাঁর ক্ষমায় তোমার সমস্ত অপরাধ ধুয়ে যাবে।

কোনো সাড়া দিলে না সুধা। সুজিতের দুই বাহুর আবেষ্টনে তার বুকে মুখ লুকিয়ে কান্নায় ফুলে ফুলে উঠতে লাগল।

সেই মহাকাশের নিচে চুপ করে বসে রইল সুজিত। সুধা কাঁদুক। তার সমস্ত দুঃখ আর সমস্ত আনন্দ কান্নার জলে ধুয়ে নির্মল হয়ে উঠুক।

.

সকালের প্রথম রোদ এসে পড়েছে হাসপাতালের বারান্দায়।

অপারেশন থিয়েটার থেকে তোয়ালেয় হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন সার্জন। বারান্দায় অস্থির হয়ে পায়চারি করছিল বিজয় বিশ্বাস। তাড়াতাড়ি সার্জনের কাছে এসে দাঁড়াল। কোনো কথা বলতে পারলে না। দুই চোখে শঙ্কিত প্রশ্ন নিয়ে তাকালে শুধু।

সার্জন বললেন, বাঁ—দিকের দুটো পাঁজরই কেটে বাদ দিতে হল। গুলিটা আর আধ ইঞ্চিটাক সরে লাগলেই ফুসফুস ফুটো হয়ে যেত।

কাঁপা গলায় বিজয় বিশ্বাস বললে, বাঁচার আশা আছে তো?

তোয়ালেখানা নার্সের হাতে দিয়ে সার্জন বললেন, পেশেন্টের শরীর থেকে যে পরিমাণ রক্ত বেরিয়ে গেছে, তাতে বাঁচার কথা অবশ্য নয়। তবু ডাক্তারেরা শেষ অবধি আশা ছাড়ে না। তারপর কতকটা যেন নিজের মনেই বললেন, আশ্চর্য! মনে হয়, পেশেন্ট বেঁচে আছে শুধু অসাধারণ মনের জোরে।

বিজয় বিশ্বাস হঠাৎ পাগলের মতো বলে উঠল, ওঁকে বাঁচিয়ে রাখুন সার্জন। অন্তত আজ বিকেল অবধি বাঁচিয়ে রাখুন। ওঁর বাঁচা দরকার। ওঁর ছেলে আসছে।

আকাশের দিকে হাত দেখিয়ে সার্জন বললেন, আর্জিটা বড় ডাক্তারের কাছে জানান, হয়তো ফল হতে পারে।

.

নরেনের জ্ঞান ফিরেছে বিকেল পাঁচটা নাগাদ। তারপর থেকেই কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করছিল বুকের মধ্যে। মাঝে মাঝে কে যেন সজোরে চেপে ধরছে হৃৎপিণ্ডটা। অ্যানেস্থেটিকের মৃদু ঘোরে আর গভীর অবসাদে চোখ বুজে পড়েছিল সে। আধো ঘুমন্ত আধো জাগ্রত চেতনার মাঝে হঠাৎ সে শুনতে পেল, বড় চেনা বড় মিষ্টি গলায় কে যেন ডাকছে, বাপি!

চোখ মেলল না নরেন। আবার ডাক এল, বাপি! ও বাপি!

এবার যেন আরও কাছে, আরও স্পষ্টভাবে।

ভারি চোখের পাতা দুটো জোর করে খুলে তাকাল নরেন। আর সঙ্গে সঙ্গে রক্তহীন ফ্যাকাশে মুখখানা তার আনন্দের আভায় ঝলমল করে উঠল। পলি আর টুটুল দাঁড়িয়ে! তার একান্ত কাছে, তার চোখের সামনে। ওরা সত্যিই এসেছে!

টুটুল বললে, শুয়ে আছো কেন বাপি, অসুখ করেছে?

নরেনের ফ্যাকাশে মুখে একটুকরো হাসি দেখা দিল। তার এতদিনের অভ্যস্ত যান্ত্রিক হাসি নয়। এ হাসি যেন সকালের প্রথম রোদের আভা। মায়া মমতা আর ভালোবাসায় উজ্জ্বল।

হেসে নরেন বললে, অসুখ করেছিল। এখন ভালো হয়ে গেছে।

খুশি হয়ে টুটুল বললে, ভালো হয়ে গেছে? তবে আমার সঙ্গে বাড়ি যাবে?

হাসি মুখে নরেন বললে, যাব।

আর পালিয়ে যাবে না?

না।

অত্যন্ত খুশি হয়ে টুটুল তার কচি মুখখানা নরেনের গালে ঠেকিয়ে বলে উঠল, তুমি খুব ভালো ছেলে বাপি। একটুও দুষ্টু না।

থেমে থেমে নরেন বললে, তোমার জন্যে কি এনেছি জানো টুটুল?

লাফিয়ে উঠল টুটুল: কি? কি এনেছ? দেখি—

নরেনের বেডের পাশে মিট—সেফের ওপর একটা বড় বাক্স রাখা ছিল। চোখের ইসারায় পলিকে সেটা দেখিয়ে নরেন বললে, ওটা ওকে দাও।

বাক্স থেকে বেরোল দম—দেওয়া একটা রঙিন রেলগাড়ি। লাইন সমেত।

ত্বর সইল না টুটুলের। মেঝের ওপর গোল লাইন পেতে দম দিয়ে সে ছেড়ে দিল রেলগাড়ি। তারপরে খুশিতে চিৎকার করে উঠল, কি সুন্দর চলেছে দেখো বাপি!

নার্স ছুটে এল বাধা দিতে। নরেন বললে, প্লিজ সিস্টার, ওকে দেখতে দাও।

এবার পলির দিকে তাকিয়ে নরেন বললে, বসো।

ছোট টুলটার ওপর বসল পলি। ঠোঁট দুটো থরথর করছে। দুই চোখ জলভরা মেঘের মতো থমথমে।

নরেন বললে, তোমাকে ডেকেছি টুটুলকে একবার দেখব বলে। তোমাকে ভালোবাসতে পারিনি, কিন্তু টুটুলকে ভালোবেসেছি। তাই ওকে ফিরিয়ে দিলাম তোমার কাছে।

ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল পলির দু’গাল বেয়ে।

নরেন আবার বললে, তিন বছর আগে যদি টুটুলকে পেতাম, আমার জীবনটা বদলে যেত। টুটুলের মা বলে তোমাকেও হয়তো ভালোবাসতে পারতাম! ছেলে এমন জিনিস পলি যে মরতে বসেও বাঁচবার সাধ হয়।

নরেনের বেডে মুখ লুকিয়ে কান্নায় ফুঁপিয়ে উঠল পলি। কি যেন বলতে গিয়ে বলতে পারল না নরেন। ধীরে ধীরে চোখ বুজলে। বুকের ভেতর সেই অস্বস্তিটা ক্রমেই বাড়ছে।

.

ঘুরতে ঘুরতে রেলগাড়িটা থেমে গিয়েছিল। মেঝের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে টুটুল ইঞ্জিনে দম দিতে শুরু করলে। চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে কট করে একটা শব্দ হল। লাইনের ওপর ইঞ্জিনটাকে রেখে দিয়ে টুটুল বলে উঠল, ওই যা! রেলগাড়িটা আর চলছে না বাপি!

কোনো উত্তর এল না নরেনের কাছ থেকে।

সমাপ্ত