কে তুমি – ৫

পাঁচ

দেখাটা এমন হঠাৎ হয়ে যাবে, দুজনের কেউই আশা করেনি।

দেখা হল লিন্ডসে স্ট্রিটের ওপর। নিউ মার্কেটের বড় ফটকের সামনে। সন্ধ্যা তখন হয়—হয়। নরেন এসেছিল সিগারেট কিনতে। আর, পলি কিছু সিল্ক! প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দিয়ে একখানা ট্যাক্সি খালি হতেই দু’পাশ থেকে এগিয়ে এল দুজনে। পলি আর নরেন।

পলিই প্রথমে কথা কইলে: তুমি!

আশ্চর্য হয়ে গেছ?—নরেন বললে।

পলি কেমন আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সহজ হবার চেষ্টা করে বললে, না, আশ্চর্য হব কেন! ভালো তো?

তুমি কেমন?—নরেন পালটা প্রশ্ন করল।

ভালো। ট্যাক্সিটা তুমিই নিয়ে যাও। চৌরঙ্গীর মোড়ে গেলে আমি আর একখানা পেয়ে যাব।

ট্যাক্সির ওপাশ থেকে নরেন ঘুরে এপাশে এল। তারপর বললে, কি হবে অন্য ট্যাক্সি নিয়ে? চলো, তোমায় পৌঁছে দিই।

পলি বলতে চাইল, আমি একাই যাব; কিন্তু বলবার আগেই পিছনের দরজাটা খুলে দিয়ে নরেন বললে, উঠে পড়ো।

গাড়িতে উঠতেই হল পলিকে। নরেন উঠে দরজা বন্ধ করে দিলে। প্রশ্ন করলে, কোথায় যাবে?

বাড়ি।

ড্রাইভারকে নরেন বললে, পার্ক সার্কাস।

গাড়ি স্টার্ট নিতেই নরেন আবার বললে, তোমাদের ওখানেই যাব ভাবছিলাম।

পলি ওদিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল। ফিরে তাকিয়ে বললে, হঠাৎ?

এমনি। দেখা করার ইচ্ছে হল বলে।

পলি অস্ফুটে বললে, আশ্চর্য!

সিগারেটের টিনটা খুলতে খুলতে নরেন বললে, কি আশ্চর্য? তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা, না তোমাকে দেখার ইচ্ছেটা?

মৃদু স্বরে পলি বললে, দুটোই।

লাইটার জ্বেলে নরেন একটা সিগারেট ধরালে। বললে, তা তুমি বলতে পার পলি। এই ক’বছর অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়েছে আমাকে। নইলে মাঝে মাঝে দেখা হত।

রাস্তার দিকে তাকিয়ে পলি বললে, হলে লাভ কি হত?

জীবনে লাভটাই তো সব নয়! নরেন বললে।

হঠাৎ সমস্ত শরীরে একটা ঝাঁকানি দিয়ে পলি তাকালে নরেনের দিকে। বললে, জীবনে লাভ ছাড়া আর কিছু বোঝ তুমি?

অন্তত লোকসানটা বুঝি। নরেন জবাব দিলে।

সে লোকসান তো অপরের।

পলির দিকে একটু ঝুঁকে নরেন বললে, নিজেরও কম নয়।

পলি আবার মুখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। নরেন দেখতে পেল না, পলির দুই চোখ আগুনের মতো দপ করে জ্বলে উঠেই ধীরে ধীরে কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে এল।

.

সৈয়দ আমির আলি অ্যাভিনিউ দিয়ে যেতে যেতে ট্যাক্সিটা বাঁ দিকে ঝাউতলা রোডে ঢুকল। কিছু দেশি খ্রিস্টান আর কিছু মুসলমানের বাস এখানে। এই পাড়াতেই ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন মিসেস নীরজা নস্কর। নীরজা নস্কর, পাসকরা ধাত্রী। পলি তাঁর একমাত্র কন্যা।

ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে নরেন ঢুকল পলিদের ফ্ল্যাটে। এখানে তার আসা নতুন নয়। তবু এখানকার আসবাবের পরিবর্তনটুকু তার চোখ এড়াল না। নতুন পুরু গালিচার ওপর দামি সোফাসেটটি সাজানো। ড্রয়িংরুমের দেওয়ালগুলো পর্যন্ত দামি বাহারি কাগজ দিয়ে মোড়া। তিন বছর আগে ছিল না এসব। এ তিন বছরে নীরজা নস্করের পশার বেড়েছে নিশ্চয়।

নরেনকে পলি বলল, বসো, আসছি।

শুধু শাড়িটা বদলে ফিরে এল পলি। সাধারণ সৌজন্যের সঙ্গে প্রশ্ন করল, চা খাবে?

এতক্ষণে নরেন ভালো করে দেখার সুযোগ পেল পলিকে। রংটা আগের চেয়ে আরও মাজা—মাজা হয়েছে। মাথায় চুলগুলি তেমনি বব করা। সাধারণ মেয়েদের চেয়ে বেশি লম্বা বলে পলিকে একটু ছিপছিপে মনে হতো। এখন চর্বির একটা পাতলা আস্তরণ লেগেছে গায়ে। সুখ আর সচ্ছলতার চিহ্ন পলির সর্বাঙ্গে।

নরেন বললে, ঠিক চা খেতে আসিনি। তোমার সঙ্গে কথা আছে পলি।

কথা! আমার সঙ্গে! পলির সরু করে কামানো ভ্রূ দুটো ধনুক হয়ে উঠল। একটা সোফার হাতলে বসে বললে, কথা তো আমরা একদিন শেষ করে দিয়েছিলাম। আদালতের সামনে।

আর একটা সিগারেট ধরালে নরেন। বললে, কথা কখন ফুরোয়, কখন আবার শুরু হয়, কেউ জানে না। আদালতের সামনে তিন বছর আগে যা বলেছিলাম, সেটাই আমার শেষ কথা নয় পলি।

সোফার গায়ে হেলান দিয়ে বললে, বেশ বলো শুনি।

নরেন উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের এদিক থেকে ওদিক একবার পায়চারি করল। ঘরের ছবিগুলো একবার দেখল, ফুলদানি থেকে একটা ফুল ছিঁড়ল অকারণে। তারপর আবার ফিরে এল সোফার কাছে। ঠান্ডা গলায় যতটা সম্ভব আবেগ দিয়ে বললে, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি পলি। আর সে ভুলের জন্যে এই তিন বছরে কম শাস্তি পাইনি।

কি বলতে চাও? পলির গলাটা কেঁপে উঠল।

নরেন পলির কাছে আরও এক—পা এগিয়ে এল। বললে, তোমায় ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয় পলি। বার বার তোমায় ভুলতে চেষ্টা করেছি, পারিনি। ভুলতে পারিনি শিশু টুটুলের মুখখানা। আমার ভালোবাসা আজও মরেনি পলি। আমায় তুমি আরেকটি বার সুযোগ দাও। সুযোগ দাও তোমাকে আর টুটুলকে নিয়ে জীবনটাকে নতুন করে গড়ে তোলার।

হাত বাড়িয়ে নরেন পলির একখানা হাত ধরলে। ঘা—খাওয়া সেতারের তারের মতো সে—হাতখানা কাঁপছে।

এক ঝটকায় হাতখানা ছাড়িয়ে নিল পলি। তারপর কয়েক পা সরে গিয়ে বললে, আর তা হয় না।

কেন হয় না পলি?

মুখ ফিরিয়ে পলি বললে, তোমার আমার ভালোবাসার মীমাংসা আদালতেই হয়ে গেছে। তার জের টানা আর চলে না।

নরেন এসে দাঁড়াল পলির ঠিক পিছনে। তার কাঁধে একখানা হাত রেখে বললে, ভুল করলে কি ক্ষমা নেই?

ক্ষমা?

চকিতে ফিরে দাঁড়াল পলি। দুই চোখে জল আর বিদ্যুতের আগুন নিয়ে বলতে লাগল, শয়তানেরও লজ্জা থাকে, তোমার তাও নেই নরেন। বিয়ের পর দুটো বছর যেতে না যেতেই আদালতের সামনে যাকে ত্যাগ করতে পেরেছিল, ভালোবাসার ছল করে যার যথাসর্বস্ব চুরি করে পালাতে তোমার বাধেনি, আজ এসেছ তারই কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে! ভেবেছ আগের মতোই তোমার সব দোষ মেনে নেব আমি? ভুল করেছ নরেন, পলি আর ততটা বোকা নয়।

শক্ত স্নায়ুর লোক নরেন। নইলে এত বড় অপমানের পরেও তার মুখের একটি পেশী কাঁপল না কেন? স্বাভাবিক ঠান্ডা গলায় সে বললে, আমি দুঃখিত পলি। তুমি অমন উত্তেজিত হবে জানলে একথা তুলতাম না। যাকগে, পুরোনো বন্ধু হিসেবে কিছু সাহায্য চাইতে পারি কি তোমার কাছে?

কি সাহায্য চাও?

ভেবেছিলাম বলব না, কিন্তু না বলে আমার উপায় নেই। কিছু টাকার বড় দরকার।

ভুরু দুটো তুলে পলি বললে, টাকার দরকার? তোমার?

নরেন বললে, হ্যাঁ, আমারই দরকার। একদিন তুমি আমায় সত্যিই ভালোবেসেছিলে, তাই আজ—

বাধা দিয়ে পলি বললে, ওকথা থাক। মেয়েদের সবচেয়ে দুর্বলতার জায়গায় ঘা দিয়ে টাকা আদায় করাই যে তোমার পেশা, সেটা জানতে আমার বাকি নেই। কিন্তু আমি দুঃখিত নরেন, টাকা আজকাল আমার মায়ের হাতেই থাকে।

নরেনের চোখ দুটো পাথরের চোখের মতো কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইল পলির দিকে। তারপর সহজ ঠান্ডা গলায় বললে, ও, তাহলে তোমায় আর বিরক্ত করব না। টুটুল কোথায়? একবার দেখে যেতাম। আশা করি এতে তোমার আপত্তি হবে না।

ঘাড় বেঁকিয়ে পলি তাকাল নরেনের দিকে। তিন মাস বয়সে যাকে ফেলে তুমি চলে গিয়েছিলে, আজ আবার তাকে দেখতে চাও কেন?

নরেন বললে, ত্যাগ করলেও সে আমারই ছেলে। ছেলেকে দেখার অধিকার কি বাপের নেই?

সে অধিকারের মান তুমি কতটুকু রেখেছ? তবু ডাকছি টুটুলকে। দেখে যাও, যে ফুলের কুঁড়িকে তুমি তোমার নিষ্ঠুর খেয়ালে ফেলে চলে গিয়েছিলে, আমি কেমন করে তাকে আগলে রেখেছি।

বলতে বলতে গলা ধরে এল পলির। ছাপিয়ে উঠল জলভরা চোখের কোল।

হাতের রুমালে ভিজে চোখ দুটো বেশ মুছে পলি ডাক দিলে, আয়া, বেবিকো লাও।

মায়ের আওয়াজ পেয়ে টুটুল নিজেই এল। ছোট্ট ট্রাইসাইকেল চালিয়ে। তারপর একলাফে নেমে একদৌড়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল পলির হাঁটু দুটো। হাসি—হাসি কচি মুখখানা তুলে বললে, মামি, চকোলেট এনেছ?

মাতৃত্বের মহিমায় পলির মুখ আলোকিত হয়ে উঠল। টুটুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললে, এনেছি টুটুল! কিন্তু এখন নয়, কাল সকালে।

নরেন স্থির দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। এই টুটুল! একমাথা কোঁকড়ানো চুল। হৃষ্টপুষ্ট নধর দেহ। ভাসা ভাসা ডাগর চোখ। দেখলে যে কোন বাপ—মায়ের বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু আশ্চর্য, টুটুলকে দেখতে দেখতে নরেনের মনে পড়ে গেল, সপ্তাহ দুয়েক আগে খবরের কাগজে দেখা একটা বিজ্ঞাপন।

হঠাৎ নরেনের দিকে চোখ পড়তেই টুটুল কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল।

দু’হাত বাড়িয়ে নরেন ডাকলে, এসো টুটুল!

টুটুল কিন্তু এল না। পলির হাঁটু দুটো তেমনি আঁকড়ে ধরে শুধু বললে, না।

নরেন আবার ডাকলে, খেলনা দোব, এসো।

কিন্তু এত বড় প্রলোভনও টুটুলকে টলাতে পারল না। মাকে ছেড়ে সে একরকম ছুটেই বাড়ির ভেতরে চলে গেল। পড়ে রইল ট্রাইসাইকেলটা।

পলির মুখে একটু শ্লেষের হাসি দেখা গেল। বললে, এমনিই হয় নরেন। বাপ যদি ছেলেকে না চায়, ছেলেও বাপকে চায় না। এটা প্রকৃতির প্রতিশোধ।

স্থির দৃষ্টিতে ভেতরের দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল নরেন। হঠাৎ যেন চমক ভেঙে যাওয়াতে পলির দিকে তাকিয়ে বললে, আচ্ছা, গুড নাইট। তারপর বাইরের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু যাওয়ায় পড়ল বাধা। ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকল নরেনের অচেনা একটি ভদ্রলোক। পরনে সিল্কের হাফ শার্ট আর ট্রাউজার। মজবুত জোয়ান চেহারা। বয়সে নরেনের চেয়ে দু—এক বছর কমই হবে।

লোকটিও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল নরেনকে দেখে। চঞ্চল হয়ে উঠল পলি। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, এসো বিজয়। তারপর নরেনের দিকে তাকিয়ে বললে, বিজয় বিশ্বাস—আমার বন্ধু।

হাসিমুখে বিজয় বিশ্বাস পলিকে প্রশ্ন করলে, আর ইনি?

নরেন দাশ, মানে—

পলির গলা হঠাৎ আটকে গেল।

অদ্ভুত সেই যান্ত্রিক হাসি হেসে নরেন পাদপূরণ করলে, পলির শত্রু।

তারপর আর দাঁড়াল না।

.

পরদিন একটা লোকাল ট্রেন থেকে নরেনকে নামতে দেখা গেল উত্তরপাড়া স্টেশনে। পকেট থেকে খবরের কাগজ থেকে কাটা একটা বিজ্ঞাপন বের করে নিজের মনেই সে পড়লে। তারপর শহরের দিকে এগিয়ে গেল বিজ্ঞাপনদাতার সন্ধানে।

ঠিকানা বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না নরেনকে। কেননা বিজ্ঞাপনদাতা উমেশ মজুমদার উত্তরপাড়া মিউনিসিপ্যালিটির ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান। তাঁর দু—মহলা বাড়ি দেখে তাঁর ব্যাঙ্ক—ব্যালেন্সটা আন্দাজ করা যায় সহজেই।

বিজ্ঞাপনের টুকরোটা দেখিয়ে নরেন প্রশ্ন করলে, এ বিজ্ঞাপন কি আপনি দিয়েছেন?

উমেশবাবু বললেন, হ্যাঁ।

নরেন বললে, আমি এই জন্যই এসেছি।

আপনার নাম? উমেশবাবু প্রশ্ন করলেন।

নরেন্দ্রনাথ দাশ। আপনি যা চাইছেন, তার জন্যে কত টাকা দিতে পারেন, জানতে পারি কি?

উমেশবাবু বললেন, পছন্দ হলে দশ হাজার পর্যন্ত পারি। তবে মুশকিল হয়েছে কি নরেনবাবু, যিনি পছন্দ করবেন, তিনি উপস্থিত এখানে নেই। মানে আমার স্ত্রী মিহিজামে গেছেন চেঞ্জে। মাসখানেক বাদেই তিনি ফিরবেন। তিনি ফিরে আসা অবধি আপনি যদি অপেক্ষা করতে পারেন—

বেশ, তাই হবে। মাসখানেক পরেই আসব। নমস্কার।

নরেন উঠে পড়ল।

আরও হপ্তাখানেক পরে তাকে দেখা গেল এলাহাবাদ স্টেশনে নামতে।

মুখে—চোখে প্রবল বিতৃষ্ণা নিয়ে সুধা বললে, আবার এসেছ কেন?

সিগারেটের টিনটার গায়ে আঙুলের মৃদু মৃদু টোকা দিতে দিতে নরেন বললে, আমি কেন আসি, তোমার তো অজানা নয় সুধা। তবে আশ্চর্য হবার ভান করছ কেন?

প্রত্যেকটি কথা যেন কেটে কেটে উচ্চচারণ করলে সুধা: টাকা আমি আর দোব না।

তা বললে কি চলে সুধা? হাজার টাকায় কতদিন আর চলে? আমি আবার অল্প খরচে কষ্ট করে থাকতে পারি না। দু’হাত ভরে খরচ করতে না পারলে বাঁচার কোনো মানেই হয় না আমার কাছে। এবার কিছু বেশিই দিও সুধা!

তেমনি কেটে কেটে উচ্চচারণ করলে সুধা : একটি পয়সাও দেব না আমি। দিতে পারব না।

একটা সিগারেট ধরালে নরেন। তারপর লাইটারটাকে লুফতে লুফতে বললে, দেখো, চোরদের মধ্যেও একটা সততা থাকে, আর তুমি কিনা আমার কারবারের পার্টনার হয়ে বলছ লাভের অংশ দোব না? এই কি তোমার উচিত হল সুধাময়ী?

সুধা জবাব দিলে, তোমার পাপের কারবারের পার্টনার হতে চাই না আমি। তুমি যাও।

জিব আর তালুর সংযোগে চুক চুক করে আক্ষেপসূচক শব্দ করলে নরেন। বললে, পাপের কারবার! পাপ তুমি কাকে বলছ সুধা? বুদ্ধি খাটিয়ে রোজগার করা পাপ! রীতিমতো প্ল্যান করে বুদ্ধি খাটিয়ে এ কারবারে নেমেছি আমরা। পাপ কোথায় এর মধ্যে? আর নেহাতই সংস্কারের বশে একে যদি পাপ বলো, তবে এ বাড়িতে এসে তুমিই বা কোন পুণ্যটা করেছ শুনি?

সুধা বললে, পাপ যদি করে থাকি, তবে একটা পাপেরই অপরাধ আমার থাক। যখন—তখন তোমাকে টাকা দিয়ে পাপ আর বাড়াব না।

নরেন বললে, বাংলা ছেড়ে এলাহাবাদে এসে তোমার বুদ্ধি গুলিয়ে গেছে দেখছি। নইলে এমন কথা বলতে পারলে কি করে! যখন—তখন তুমি টাকা দেবে বলেই তো তোমাকে এখানে পাঠানো। নইলে কি তুমি একা একা সুখী থাকবে বলে তোমায় জয়ন্তী সাজিয়ে পাঠিয়েছি? যাও টাকা নিয়ে এসো, আমার তাড়া আছে।

মরিয়া হয়ে সুধা বললে, টাকা যদি না দিই, তুমি কি করতে পার?

চেয়ার ছেড়ে উঠে এল নরেন সুধার সামনে। তারপর তার সেই ভয়ঙ্কর ঠান্ডা গলায় বললে, টাকা না দিলে জাল জয়ন্তী সান্যালের মুখোশ খুলে দোব। আর বেরিয়ে পড়বে জালিয়াত সুধাময়ী সোম। তখন আদালতের সামনে থেকে, সমাজের সামনে থেকে, দুনিয়ার সামনে থেকে কোথায় মুখ লুকোবে তুমি, মাথা ঠান্ডা করে সেটা আগে ভেবে দেখো সুধাময়ী। তাছাড়া সেই চিঠির তাড়া এখনো আছে।

বিবর্ণ মুখে সুধা বললে, আমি ধরা পড়লে তুমিও কি রেহাই পাবে ভেবেছ?

নরেন ফিরে গিয়ে আবার চেয়ারে বসল। বললে, সে—চিন্তা আমার, তুমি তোমার চিন্তা করো।

চুপ করে রইল সুধা। আর সিগারেট টেনে যেতে লাগল নরেন।

বড় দেওয়াল ঘড়িটা একটানা আওয়াজ করতে লাগল টক টক টক। সুধার মনে হল, আওয়াজটা উঠছে তার হৃৎপিণ্ড থেকে।

সিগারেটের টুকরোটা পায়ের তলায় পিষে ফেলে নরেন এক সময় বললে, দিতে যদি তোমার নিতান্তই অসুবিধা হয়, তাহলে টাকাটা সুজিতের কাছ থেকেই নিতে হবে! বাড়িতে আছে নাকি সে? না অপেক্ষা করব?

নিষ্প্রাণ গলায় সুধা বললে, কত টাকা পেলে তুমি আমাকে রেহাই দেবে?

পাঁচ হাজার দিলেই ভালো হয়। অভাব তো নেই তোমার!

পাঁচ হাজার!

বেশ, উপস্থিত হাজার তিনেক হলেও চলবে।

উপস্থিতের কথা নয়, ভবিষ্যতের কথা বলছি।

ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে বলো? তবে আমার কারবার যদি ভালোই চলে, তাহলে অবশ্য তোমাকে ঘন ঘন বিরক্ত করার দরকার হবে না। এই ধরো, আসছে মাসে হাজার দশেক টাকার একটা বিজনেস হবার কথা আছে। সেটা হয়ে গেলে কিছুকাল দিব্যি নিশ্চিন্ত।

লাইব্রেরি ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সুধা। ফিরে এল সবুজ রঙের একখানা চেক হাতে নিয়ে। নরেনকে দিয়ে বললে, তিন হাজারই দিলাম।

চেকখানা ভাঁজ করতে করতে নরেন বললে, আমি জানতাম টাকা তুমি দেবেই। আচ্ছা, আসি।

সমস্ত শরীরটাকে শক্ত ঋজু করে সুধা বললে, হ্যাঁ, এসো। তোমার এই যাওয়াই যেন শেষ যাওয়া হয়। জীবনে আর কোনোদিন এখানে আসার চেষ্টা করো না। এলে তুমিও বাঁচবে না, আমিও না।

সুধার আগুনবরণ মুখের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেই অদ্ভুত যান্ত্রিক হাসি দেখা দিল নরেনের মুখে। বললে, আমায় ভয় দেখাচ্ছ তুমি? তারপর ধীরে—সুস্থে ভাঁজ করা চেকখানা পকেটে পুরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

দুলতে লাগল লাইব্রেরি ঘরের পর্দাটা।

.

স্বর্ণময়ী প্রশ্ন করলেন, তুই কিছু জানিস বাবা?

সুজিত বললে, কি বিষয় মা?

চিন্তার ছায়া পড়ল স্বর্ণময়ীর মুখে। বললেন, বউমার কথা জিজ্ঞেস করছি বাবা। দিন দিন ও যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। কথা কম বলে, না ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না, সদাই কেমন অন্যমনস্ক ভাব। বউমার কি হয়েছে, আন্দাজ করতে পারিস কিছু?

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সুজিত বললে, মা হয়ে তুমি যদি আন্দাজ করতে না পারো, আমি কি পারব?

স্বর্ণময়ী বললেন, কি জানি বাবা! এক এক সময় মনে হয়, ও নিশ্চয় লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। কি যে ওর দুঃখ—বলেও না, বুঝিও না। মেয়েটাকে ভালোবেসেছি বলেই তো এত ভাবনা আমার।

চুপ করে রইল সুজিত। স্বর্ণময়ীও যেন ডুবে গেলেন নিজের চিন্তায়।

হঠাৎ এক সময় সুজিত বললে, আচ্ছা মা, বউদি যদি তোমার পুত্রবধূ না হয়ে আর কেউ হত, তুমি তাকে এতখানি ভালোবাসতে?

অবাক হয়ে স্বর্ণময়ী বললেন, সেকি রে! বউমা আর কেউ হতে যাবে কেন?

ধরো যদি কোনো পরের মেয়ের হত—সান্যাল বাড়ির সঙ্গে যার কোনো সম্পর্কই নেই—

অপূর্ব মমতার আভা ছড়িয়ে পড়ল স্বর্ণময়ীর সারা মুখখানিতে। ক্ষীণ হেসে ধীরে ধীরে বললেন, স্নেহ ভালোবাসা কি আপন—পর বাছে রে পাগল? জয়ন্তী যেদিন এ বাড়িতে প্রথম এল, আমার অলোকের বউ না হলে সেদিন কি হত জানি না, কিন্তু আজ আর তাকে পর বলে ভাববার ক্ষমতা আমার নেই বাবা। কিন্তু এ—কথা কেন সুজিত?

সুজিতের কপালেও চিন্তার রেখা দেখা দিল। কতকটা যেন নিজের মনেই বললে, বউদির মধ্যে কি যেন একটা রহস্য লুকোনো আছে।

উদ্বিগ্ন মুখে স্বর্ণময়ী বলে উঠলেন, কি রহস্য?

সেটা যে কি, তা আমিও জানি না মা। তবে সে রহস্য চাপা থাকবে না, একদিন না একদিন প্রকাশ পাবেই।

কফির পেয়ালাটা শেষ করে সুজিত চলে গেল। আর স্বর্ণময়ীর বুকের ভেতরটা যেন তোলপাড় করে উঠল।

.

কলিংবেলটা প্রথমবার যখন বাজল, পলি তখন খেয়াল করেনি। দ্বিতীয়বার বাজতেই সচকিত হয়ে উঠল সে। দুধের গ্লাসটা টুটুলের হাতে দিয়ে বললে, নিজে নিজে খেয়ে ফেলো তো মণি, আমি আসছি এখুনি।

সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নামতে নামতে পলির মুখে দুষ্টু হাসির আভাস দেখা দিল। যে এসেছে, সে বিজয় ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। নিশ্চয় সিগারেট কেস ফেলে গেছে। নয়তো রিস্টওয়াচ। সত্যি এমন ভুলো লোক এই বিজয়! এমন কি কাজে বেরোবার সময় পলিকে যা দিয়ে যাবার কথা, এক একদিন তাও সে ভুলে যায়। আর ফিরে আসতে হয় মাঝ রাস্তা থেকে।

দরজা খুলতে খুলতে পলি বললে, হঠাৎ ফিরে এলে যে বিজয়? তুমি বুঝি—

মুখের কথা হারিয়ে গেল পলির। আগন্তুক ঠান্ডা গলায় বললে, ফিরে আসাটা হঠাৎই হল বটে। তবে বিজয় নয়, আমি।

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল পলি।

নরেন বললে, ভেতরে গিয়ে বসতে বলবে না?

পলি শুধু বললে, এসো।

ড্রইংরুমে গিয়ে একটা বড় কাগজের বাক্স সোফার ওপর নামিয়ে রাখল নরেন। তারপর সোফার হাতলের ওপর বসে বললে, ভয় নেই, কোন আর্জি নিয়ে আসিনি আজ। কোনো পুরোনো কথাও তুলব না।

হঠাৎ এদিকে এলে যে? পলি প্রশ্ন করল।

নরেন জবাব দিলে, হঠাৎ আসা আর হঠাৎ চলে যাওয়াই তো আমার স্বভাব পলি!

একটু অসহিষ্ণু হয়ে পলি বললে, আমি এখুনি বেরোব ভাবছিলাম—

বেরোবে? কোথায়?

কাছাকাছি একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল হয়েছে, টুটুলকে পৌঁছতে যাব।

মিনিট পনেরো অপেক্ষা করতে পারি।

যথেষ্ট। তার আগেই চলে যাব আমি।

পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা ধরাল নরেন। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে বললে, তোমায় অভিনন্দন জানাতে এলাম পলি।

পলির ভ্রূ দুটো অল্প বাঁকা হয়ে উঠল। বললে, অভিনন্দন! কিসের জন্যে?

আর্মি অফিসার বিজয় বিশ্বাসের সঙ্গে তোমার শুভ বিবাহের জন্যে। প্রার্থনা করি, তোমার দ্বিতীয় দাম্পত্য জীবন সুখের হোক।

এক মুহূর্তের জন্যে পলির মুখের সমস্ত রং হারিয়ে গেল। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললে, এ খবর কোত্থেকে শুনলে?

হালকা গলায় নরেন বললে, হঠাৎ দৈববাণী হল আকাশ থেকে।

হসপিটালে মার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বোধ হয়?

তোমার অনুমান সত্যি। সুখবরটা মিসেস নস্করের মুখ থেকেই পেলাম। শুনলুম, ক্যাথলিক মতে তোমাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু খবরটা আগের বার আমায় জানালেই পারতে। লুকোচুরির দরকার কি ছিল? তোমাদের প্রেমের পর্বে আমি বাধা দিতাম না নিশ্চয়ই!

পলির মুখখানা লাল হয়ে উঠল হঠাৎ। বললে, খবরটা তোমাকে জানাতেই হবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি?

সিগারেটে একটা টান দিয়ে নরেন বললে, তুমি আবার আমাকে ভুল বুঝছ পলি। বিশ্বাস করো, তোমার দ্বিতীয় বিবাহে আমি সুখীই হয়েছি।

উদ্দীপ্ত গলায় পলি বলে উঠল, তুমি সুখী হও না হও, আমি জানতে চাই না। আমি নিজে সুখী হয়েছি—এইটুকুই জানি। আমার যে নারীত্বকে তুমি দু’পায়ে দলে চলে গিয়েছিলে, বিজয় তাকেই মর্যাদা দিয়েছে, ভালোবেসেছে।

বাঁকা চোখে পলির দিকে তাকিয়ে নরেন প্রশ্ন করলে, আর তুমি?

কি জানতে চাও আমার সম্বন্ধে? বিজয়কে ভালোবাসি কিনা? বাসি বইকি! যে আমার সমস্ত শূন্যতা পূর্ণ করেছে, তাকে ভালোবাসব না? আমি তো ইট কাঠ পাথর নই!

সোফা ছেড়ে নরেন একবার ঘরের ওধার অবধি পায়চারি করে এল নীরবে। তারপর বললে, লেফটেন্যান্ট বিজয় বিশ্বাসকে ধন্যবাদ। তোমাকে সুখী করতে পেরেছেন বলে। প্রার্থনা করি, প্রথম প্রেমের সমাধির ওপর তোমার নতুন সুখের ঘরকন্না চিরস্থায়ী হোক।

হাতের ছোট্ট রিস্টওয়াচের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে পলি বললে, সেটা তো আগেই ঘটা করে জানিয়েছ। আর কিছু বলার আছে কি? টুটুলের স্কুলের সময় হয়ে এসেছে।

কাগজের বাক্সটা নরেন খুলল। বেরোল দম—দেওয়া খেলার এঞ্জিন একটা। বললে, টুটুলের কথা মনে পড়ল বলেই এলাম। একবার পাঠিয়ে দাও। তাকে এটা দিয়েই চলে যাব।

পলি ডাক দিতেই টুটুল ছুটে এল। নরেন ততক্ষণে দম দিয়ে এঞ্জিনটাকে ছেড়ে দিয়েছে মেঝের ওপর। শিস দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়িটা।

বড় বড় চোখে লোভ আর সরলতা নিয়ে দেখতে লাগল টুটুল।

নরেন বললে, তুমি চালাবে টুটুল? চালাও না!

আগের বার মাকে ছেড়ে টুটুল এগোয়নি নরেনের কাছে। আজ কিন্তু এগিয়ে এল নির্ভয়ে। পলিকে নরেন বললে, বিয়ের খাওয়াটা তো ফাঁকি দিলে, আজ অন্তত এক কাপ চা দিয়ে নেমন্তন্ন রক্ষে করো!

আর একবার রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে পলি ভেতরে চলে গেল। মুখ ফিরিয়ে নরেন তাকাল টুটুলের দিকে। মেঝেয় হাঁটু গেড়ে বসে টুটুল খেলনা—এঞ্জিনে দম দিচ্ছে উৎসাহের সঙ্গে।

এই তো সুযোগ!

.

হিটারে চা করতে তিন—চার মিনিটের বেশি লাগল না।

চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে পলি যখন আবার ড্রইংরুমে এল, সেখানে তখন কেউ নেই। নরেনও নেই, টুটুলও নেই।

পড়ে আছে শুধু খেলনা—এঞ্জিনটা। আর টেবিলের ওপর খোলা চিঠি একখানা।

চায়ের পেয়ালাটা রেখে কাঁপা হাতে পলি চিঠিখানা তুলে নিল:

টুটুলকে নিয়ে চললাম। কোন নিঃসন্তান দম্পতির হাতে তাকে দিলে হাজার দশেক টাকা লাভের আশা আছে। চিন্তা করো না, টুটুল সেখানে সুখেই থাকবে।

মিছে পুলিশে খবর দিও না। আইনের সাহায্য নিয়ে লাভ নেই। কেননা, দ্বিতীয় বিবাহের পর টুটুলের ওপর তোমার আইনগত অধিকার তুমি হারিয়েছ। আর হারিয়েছ বলেই টুটুলকে আমি নিশ্চিন্তে নিয়ে যেতে পারলাম। তোমার দ্বিতীয় বিবাহের জন্যে আরেকবার ধন্যবাদ।

নতুন জায়গায় গিয়ে তোমাকে ভুলে যেতে, আশা করি টুটুলের বেশি দিন লাগবে না।

চিঠিখানা হাতে ধরে পলি দাঁড়িয়ে রইল কাঠ হয়ে। টুটুল বলে একবার চিৎকার করতে গেল, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। তারপর হঠাৎ চারদিক ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে একাকার হয়ে গেল।