চার
কিন্তু নরেন সত্যিই এল। আরও মাসখানেক পরে। এলাহাবাদের আকাশে যখন বর্ষা যাই—যাই করছে।
রান্নাঘরে জলখাবারের তদারক করছিল সুধা। বিকেল তখন পাঁচটা। সুজিত একাই বেরিয়েছে। বৃষ্টির জন্যে সুধা যায়নি। রঘুয়া এসে জানালে, আপনার দাদা এসেছেন বউদি।
কয়েক মুহূর্ত বোকার মতো চেয়ে রইল সে। তারপরই সমস্ত শরীরের রক্তস্রোত হঠাৎ যেন থমকে থেমে গেল।
রঘুয়া খবরটা আবার জানালে।
সুধার রক্ত চলাচল আবার শুরু হল। শুরু হল আগের চেয়ে দ্রুতবেগে। রঘুয়াকে বললে, বসতে বলগে—আসছি।
নিজেকে সামলাতে সুধার বেশ কিছু সময় লাগল। তারপর আস্তে আস্তে এসে দাঁড়াল একতলার হলঘরে।
নরেন তখন গা থেকে রেনকোট খুলছিল। সুধাকে দেখে আগের মতোই ঠান্ডা গলায় বললে, এসো। তোমার দেরি দেখে ভাবলাম, বুঝি বা ভেতরেই যেতে হবে।
আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল সুধা। তেমনি আড়ষ্ট গলায় বললে, এ বাড়ির ভেতরে যাবার অধিকার তোমার নেই।
সে অধিকার তোমারই কি আছে?
রেনকোটটা সোফার হাতলে রেখে নরেন বসতে যাচ্ছিল, সুধা বললে, এখানে নয়, ও—ঘরে চলো।
লাইব্রেরি ঘরের ভারি পর্দাটা সুধা হাত দিয়ে তুলে ধরলে। রেনকোটটা কাঁধে ফেলে নরেন ঢুকল। পিছনে সুধা।
পকেট থেকে সিগারেটটা বের করতে করতে নরেন বললে, খুব অবাক হয়ে গেছ মনে হচ্ছে!
চাপা গলায় সুধা প্রশ্ন করলে, এলাহাবাদে কবে এসেছ?
আজই সকালে।
উঠেছ কোথায়?
ভবঘুরেরা যেখানে থাকে! হোটেলে।
এখানে এলে কেন?
বড় টেবিলটার এককোণে নরেন বসল কাগজপত্র সরিয়ে। তারপর বললে, আমাকে ভুলে গেছ কিনা দেখতে। সেই যে শ্বশুরবাড়ি এলে, তারপর এই চার মাস একদম চুপচাপ—না একটা চিঠি, না একটা খবর। মন কেমন করতে লাগল, তাই ছুটে এলাম।
দুই চোখে গভীর বিতৃষ্ণা নিয়ে চুপ করে রইল সুধা।
নরেন সিগারেটটা ধরাল। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললে, তারপর আছ কেমন? দেখে তো দিব্য মনে হচ্ছে। এলাহাবাদের জলহাওয়ায় ওজন বেড়েছে নিশ্চয়? অথচ এখানে আসতে বলেছিলাম বলে কতই রাগ করেছিলে আমার ওপর!
চাপা গলাকে একটু তীক্ষ্ন করে সুধা বলে উঠল, বাজে কথা থাক। এখানে কেন এসেছ, বলো!
নরেন বললে, অনেক আগেই আসতাম। তবে নতুন জায়গায় থিতিয়ে বসতে তোমার সময় লাগবে, তাই দেরি করেই এলাম। তোমার বোধ হয় মনে আছে সুধা, এই সান্যাল বাড়িতে তোমায় যখন আসতে বলেছিলাম, তখন তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে, তাতে আমার লাভ? লাভের কথাটা সেদিন হয়নি, সময়ও ছিল না।
তুমি কি আজ লাভের হিসেব করতেই এসেছ এখানে? সুধা বললে।
সিগারেটের মুখে খানিকটা ছাই জমেছিল। ঝেড়ে ফেলে নরেন বললে, তাছাড়া আর কি করতে আসব বলো? সত্যিই তো আর এটা আমার কুটুম্ব বাড়ি নয়! তুমি আমি মিলে জালিয়াতির যে কারবার ফেঁদেছি, আজ তার হালখাতা খুলব বলেই আমার আসা।
চকিতে উঠে গিয়ে সুধা একবার পর্দার বাইরেটা দেখে নিল। তারপর ফিরে এসে চাপা গলায় বললে, কি চাও বলো!
অত্যন্ত উদাসীনের মতো নরেন বললে, লাভের কড়ির আধাআধি বখরা।
একটু তিক্ত হাসি দেখা দিল সুধার ঠোঁটে। বললে, লাভ? প্রতি পদে লোকসানের ভয় ছাড়া এ বাড়িতে লাভ আমার কানাকড়িও নেই। তবু বলো, কি পেলে তুমি বিদেয় হবে—শিগগির বলো!
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে নরেন বললে, কিছু টাকা। কিংবা ভারিভুরি একখানা গয়না হলেও চলবে। ক’টা মাস বড় টানাটানি যাচ্ছে। পুলিশও পেছনে লেগেছে যেন আঠার মতো।
কয়েক সেকেন্ড কি যেন ভাবলে সুধা। তারপর বললে, একটু বসো, আসছি আমি।
সুধা চলে গেল নিজের ঘরে। ফিরে আসতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগল না। হাতে হাজার টাকার একখানা বেয়ারার চেক। চেকখানা নরেনের হাতে দিতে দিতে সুধার মনে হল, সুজিতের কাছে সে সত্যিই কৃতজ্ঞ। অলোক সান্যালের ইনসিওরেন্সের টাকাটা জয়ন্তী সান্যালের নামে ব্যাঙ্কে জমা করে চেকবইখানা তার হাতে না দিলে সুধা আজ বাঁচত না।
চেকখানা উলটে—পালটে দেখে নরেন বললে, বাঃ! এরই মধ্যে নিজের নামে অ্যাকাউন্টও খুলেছ দেখছি! ভালো, ভালো, কারবারে তোমার উন্নতি হবে সুধা। কিন্তু মাত্র এক হাজার? যতিশঙ্কর সোমকে আমি অনেক হাজার দিয়েছিলাম যে!
সুধার দুই চোখ থেকে ঘৃণা উপছে পড়ছে। সেই চোখ নিয়ে নরেনের দিকে তাকিয়ে সে বললে, আমার বাবাকে তুমি কত টাকা দিয়েছিলে, আমার তা জানবার কথা নয়। কিন্তু যে পাপ করতে তুমি আমাকে বাধ্য করেছ, তাতে তোমার সমস্ত পাওনা শোধ হয়ে গেছে। এই হাজার টাকা তোমার উপরি পাওনা। যাও, আর দাঁড়িয়ে থেকো না।
চেকখানা ভাঁজ করে নরেন পকেটে রাখলে। তারপর বললে, এই কারবারের সবটাই উপরি পাওনা। ন্যায্য পাওনা বলে কিছু নেই। কোথাকার কে সুধা সোম এ বাড়িতে এসে যা পেয়েছে, সেটাও কি তার উপরি পাওনা নয়? আমি তারই ভাগ চেয়েছি মাত্র। যেহেতু তুমি আর আমি একই কারবারের পার্টনার।
সুধা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, চুপ করো! তারপর চাপা গলায় আবার বললে, টাকা তো পেয়েছ, আর কেন দাঁড়িয়ে এখানে? যাও তুমি!
রেনকোটটা কাঁধে ফেলে ধীরে—সুস্থে উঠে দাঁড়াল নরেন। বললে, এত তাড়া কিসের? তোমার শ্বাশুড়ি আমাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন, একবার দেখা করে যাওয়া উচিত নয় কি?
দুই হাত জোড় করে সুধা অস্থির হয়ে বলে উঠল, তোমায় মিনতি করছি নরেনদা, আর দেরি করো না। এখুনি কেউ এসে পড়বে। যাও—তুমি যাও!
দরজার দিকে এগোতে এগোতে নরেন বললে, বেশ যাচ্ছি।
তেমনি অস্থির হয়ে সুধা বললে, হ্যাঁ, যাও—আর কখনও এসো না—
পর্দার কাছে গিয়ে ফিরে দাঁড়াল নরেন। অনেকদিন পরে ও মুখে দেখা দিল সেই যান্ত্রিক হাসি। বললে, তা কি বলা যায় সুধা! তোমার জন্যে মন—কেমন করলে আসতেই হবে আবার। তারপর হাত দিয়ে পর্দাটা সরাতেই থমকে থেমে গেল নরেন।
পর্দার বাইরে সুজিত দাঁড়িয়ে।
হঠাৎ সুধার ইচ্ছে হল, গলা চিরে চিৎকার করে সুজিতকে বলে, এখানে দাঁড়িয়ে কেন? কি শুনেছ তুমি?
কিন্তু নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল সুধার।
চমৎকার মিষ্টি হাসিতে ভরে গেল সুজিতের মুখ। বললে, একি, নরেনবাবু যে! এখানে দেখতে পাব আশাই করিনি।
নিরুত্তাপ গলায় নরেন বললে, আমিও আশা করিনি, আপনার সঙ্গে দেখা হবে।
হঠাৎ এলাহাবাদে যে?
সুধার মরা মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে নরেন বললে, জয়ন্তীকে দেখতে।
সুজিত বললে, ও। তা খাওয়া—দাওয়া না করেই যাচ্ছেন কেন? মা’র সঙ্গে দেখা হয়েছে?
নরেন বললে, আজ থাক সুজিতবাবু। আবার যদি আসি, সেদিন হবে। এলাহাবাদে একটা জরুরি কাজ আছে। সেটা সেরেই আমায় পরের ট্রেনে ফিরতে হবে। নমস্কার। তারপর সুধার দিকে তাকিয়ে বললে, আমায় যেন ভুলে থেকো না জয়ন্তী!
হলঘর দিয়ে অল্প খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে গেল নরেন। সুজিত তাকিয়ে রইল সেই দিকে। একটু পরে যখন মুখ ফেরালে, সুধাও সেখানে তখন নেই।
সুজিতের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সুধা! এ বাড়িতে সুধার নাম কেন? কে সে?
* * *
রাতে সুজিত খাবার টেবিলে বসবার পর সুধা যখন মাংসের স্টু গরম করে নিয়ে এল, একখানা চাদর গায়ে জড়িয়ে স্বর্ণময়ীও এসে দাঁড়ালেন সেখানে। বললেন, হ্যাঁ বউমা, শুনলাম তোমার দাদা এসেছিলেন বিকেলে?
সুধা ছোট করে জবাব দিলে, হ্যাঁ।
আমরা কিন্তু অলোকের চিঠি মারফত জেনেছিলুম, তোমার কোনো ভাই নেই।
নরেনদা আমার আপন ভাই নয়।
চামচে করে সুধা সুজিতের বাটিতে স্টু তুলে দিতে লাগল।
স্বর্ণময়ী বললেন, আচ্ছা, তোমার ছোট বোন এখন কোথায়?
স্টু ঢালা বন্ধ হয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে সুধা বললে, ঠিক জানি না। তার স্বামীর রেলের চাকরি। কখন যে কোথায় থাকে—
অত্যন্ত অবাক হলেন স্বর্ণময়ী। বিয়ে হয়ে গেছে তার? তোমার বিয়ের সময় তার মোটে ন’ বছর বয়েস ছিল শুনেছিলুম!
হঠাৎ যেন আগুনের আভা লাগল সুধার মুখে। ঝাঁ ঝাঁ করছে কান দুটো। কিন্তু সামলে নিতে শিখেছে সুধা। অল্প হেসে বললে, মাথায় খাটো বলে তাকে খুব অল্পবয়সী বলে মনে হয়। তাছাড়া হঠাৎ একটি ভালো পাত্র পাওয়ায় বাবা—
বাবা! এবার সুজিত মুখ তুলে তাকাল।
স্বর্ণময়ী বলে উঠলেন, সেকি! বিয়ের পর অলোক চিঠিতে জানিয়েছিল, ছোটবেলা থেকেই তোমরা কাকা—জ্যাঠার কাছে মানুষ। মানে তোমার মা আমারই মতো অল্প বয়সেই—
স্বর্ণময়ী চুপ করে গেলেন। আর সুধার মনে হল খাবার ঘরটা দুলছে। জয়ন্তী সান্যালের আত্মা হাসছে। তার দুর্দাশা দেখে।
কিন্তু সুধার স্নায়ু আগের চেয়ে অনেকটা শক্ত হয়েছে। এক নিশ্বাসে বলে উঠল, ছোটবেলায় জ্যাঠামশাইকে আমরা বাবা বলেই ডাকতুম কিনা। তারপর সুজিতের পাতের দিকে তাকিয়ে বললে, আর দু’খানা লুচি এনে দি—
দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুধা। কিন্তু মিনিট কয়েক পরে লুচি যে আনল, সে সুধা নয়—মহাদেও।
বউদি কোথায়? সুজিত প্রশ্ন করলে।
মহাদেও বললে, ওপরে গেলেন। মাথায় দরদ হচ্ছে।
ঠাকুর—চাকর থাকলেও স্বর্ণময়ী আর সুজিতকে সুধা খাওয়ায় নিজের হাতে। চার মাসের মধ্যে একটা দিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আজ হল।
স্বর্ণময়ী একবার ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর উঠে পড়লেন আস্তে আস্তে। সুজিতও উঠল হাত ধোয়ার জন্যে।
সিঁড়ি পার হয়ে স্বর্ণময়ী এসে দাঁড়ালেন সুধার ঘরের দোরগোড়ায়। অন্ধকার ঘর।
স্বর্ণময়ী মৃদু গলায় ডাকলেন, বউমা!
অন্ধকার থেকে সাড়া এল না। কিন্তু জ্বলে উঠল বাতিটা।
চৌকাঠ পার হয়ে স্বর্ণময়ী বললেন, আগুনতাতে মাথাটা ধরেছে বুঝি? তা তো ধরবেই মা! কতবার বলেছি, বিকেলের রান্নাটা মহাদেওয়ের হাতেই ছেড়ে দাও, শুনবে না তো কথা! তোমায় কি শুধু হেঁসেল ঠেলবার জন্যেই ঘরে এনেছি মা!
স্বর্ণময়ীর গলায় স্নেহসিক্ত সুর। হঠাৎ একটা কান্না সুধার বুক থেকে গলা অবধি উঠে আটকে গেল। স্বর্ণময়ী আবার বললেন, আমার ঘরে মেন্থলের শিশি আছে, পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি উঠো না মা, চুপ করে শুয়ে থাকো। বুধনি তোমার খাবার দিয়ে যাবে’খন।
বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে স্বর্ণময়ী আস্তে আস্তে চলে গেলেন।
কিন্তু সুধার শোয়া হল না। সুজিতকে মশলা দিয়ে আসতে হবে। তার ভয় সুজিতকেই বেশি। আর কারো হাতে দিয়ে পাঠালে যদি সে কিছু মনে করে! যদি মনে করে খাবার টেবিলে উলটো—পালটা কথা বলে ফেলে ধরা পড়ার ভয়েই সুধা আসছে না!
না, সুধা নিজেই যাবে। হয়তো স্বর্ণময়ীর মতো সুজিতও কোনো সন্দেহ করেনি তাকে। এ শুধু তার নিজের মনের সন্দেহ। তবু সাবধান হওয়া ভালো।
নকশা—কাটা মোরাদাবাদী রেকাবিতে চাট্টি মশলা সাজিয়ে ঘর থেকে বেরোল সুধা। কিন্তু না, সুজিত তার ঘরে নেই, নিশ্চয়ই গেছে লাইব্রেরি ঘরে। রাত জেগে পড়াশুনো করে সে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল সুধা। অন্ধকার হলটা পেরিয়ে, পর্দা ঠেলে ঢুকল লাইব্রেরি ঘরে। মোটা মোটা আইনের বইয়ের মধ্যে ডুবে গেছে সুজিত। ভালোই হয়েছে। মশলার রেকাবিটা টেবিলের ওপর রেখে নিঃশব্দে সুধা চলে যাচ্ছিল, সুজিত বললে, পালাচ্ছ কেন? বসো!
সুধার চলে যাওয়া হল না।
বইখানা রেখে সুজিত বললে, তোমার সঙ্গে একটা পরামর্শ আছে বউদি। আসছে সপ্তাহে আমার এক বন্ধুর বউভাত, কি দেওয়া যায় বলো তো?
সুধা বললে, দেওয়ার কত জিনিসই তো আছে—যেটা পছন্দ।
সুজিত বললে, ভাবছি তোমার গলার হারের মতো একটা হার দিয়ে আসব। প্যাটার্নটা ভারি সুন্দর!
বেশ তো।—বলে সুধা বাঁ—হাত দিয়ে ডান হাতের রুলিটা ঘোরাতে লাগল।
হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল সুজিত, আচ্ছা, তোমার নাম তো জয়ন্তী। তোমার হারের লকেটে ‘এস’, লেখা কেন?
সুধার মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আজ পাঁচ মাস ধরে কত বড় ভুলই না সে করে এসেছে! সুধা সোমকে শনাক্ত করার মারাত্মক চিহ্ন যে তার বুকের ওপরই দুলছে, এতদিন সে খেয়াল হয়নি তার!
নিতান্ত ছেলেমানুষের মতো সুজিত আবার প্রশ্ন করলে, তোমার বুঝি দুটো নাম?
টেবিলের কোণটা শক্ত করে চেপে ধরলে সুধা, কেমন যেন নিস্তেজ গলায় বললে, দুটো নাম থাকতে যাবে কেন?
সুজিত বললে, অনেকের তো থাকে। একটা পোশাকি নাম, একটা ডাকনাম। ‘এস’ অক্ষর দিয়ে তোমারও বুঝি কোনো ডাকনাম আছে? বলো না, কি নাম?
বাতির দিকে পিছন ফিরে সুধা হঠাৎ এলোমেলো বইগুলো গুচ্ছোতে শুরু করলে।
একটু হেসে সুজিত আবার বললে, লজ্জা করছে বুঝি বলতে? আচ্ছা, আমি বলব? হয় শান্তা, নয় সেবা, নয় তো সুধা।
সুধার মাথাটা হঠাৎ ঝিমঝিম করে উঠল। প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, না। শুক্তি।
সুজিত বলে উঠল, বাঃ! ফাইন নাম তো! লুকিয়ে রেখেছিলে কেন এতদিন?
তেমনি পিছন ফিরে সুধা বললে, লুকিয়ে রাখতে পারলাম কই! তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলে, কফি আনব?
সুজিত বললে, না, থাক। আজকের ডাকে চমৎকার একটা জিনিস এসেছে। এই দেখো—
বইয়ের ভেতর থেকে চৌকো একখানা খাম বার করলে সুজিত। সুধার হাতে দিয়ে বললে, মিস্টার কোলম্যান—সেই পোলিশ ভদ্রলোকটি পাঠিয়েছেন।
খামের ভেতর থেকে বেরোল একখান পোস্টকার্ড সাইজের ফটো। সুধা আর সুজিত পাশাপাশি বসে। পিছনে যমুনা। মাথার ওপর বর্ষার মেঘের জটা।
হঠাৎ সুধার চোখ পড়ল ছবির একটা কোণে। ইংরিজিতে দুই লাইন লেখা। প্রথম লাইনটা কিন্তু কলমের আঁকাবাঁকা আঁচড় দিয়ে কাটা, সুধা তবু পড়তে পারল। আর পড়তে পারার সঙ্গে সঙ্গেই তার ফ্যাকাশে মুখে সমস্ত রক্ত এসে জমা হল। ছবির কোণায় লেখা রয়েছে, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সান্যালকে উপহার। আর্থার কোলম্যান।
সুজিত বললে, ফোটোগ্রাফিতে আর্থার সাহেবের হাত সত্যিই ভালো। কি বলো?
আঁচল দিয়ে সুধা অকারণেই মুখটা একবার মুছে নিলে। তারপর মনে মনে আর্থার সাহেবের মুণ্ডপাত করে বললে, ফোটোগ্রাফির আমি কি বুঝি?
সুজিত বললে, ভাবছি এখানা এনলার্জ করে বাঁধিয়ে রেখে দেব।
সুধা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, না, ওসব করতে হবে না। তারপর দরজার দিকে এগোল।
কিন্তু অন্ধকার হলঘর পার হয়ে সিঁড়িতে পা দিতে আশ্চর্য একটা কাণ্ড ঘটে গেল। হলের অন্ধকার আবছা গলায় হঠাৎ ডেকে উঠল, সুধা!
সঙ্গে সঙ্গে সুধার অন্যমনস্ক চেতনা সাড়া দিয়ে উঠল, কি?
পরমুহূর্তেই চমকে উঠে সুধা দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। আর অন্ধকার হলঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সুজিত ভাবতে লাগল, সুধা বলে ডাকলে যে সাড়া দিয়ে ওঠে, সে কি সত্যিই জয়ন্তী, না শুক্তি, না সুধা? সান্যাল বাড়িতে এ কোন রহস্যচারিনি বাসা বেঁধেছে?
.
ঝড়ের বেগে সুধা ঢুকল নিজের ঘরে। তারপর বিছানার ওপর বসে হাঁফাতে লাগল। আলো জ্বাললে না। সুধা সোম তার সত্যকার পরিচয় নিয়ে যেন অন্ধকারেই লুকিয়ে থাকে। তবু সেই অন্ধকারেই কে যেন তার কানের পাশে ফিসফিস করে বলতে লাগল, পাপ কখনও চাপা থাকে সুধা! তোমার ছদ্ম পরিচয়ের খোলস ছিঁড়ে সত্য পরিচয় একটু একটু করে বেরিয়ে পড়ছে। ধরা পড়তে আর বেশি দেরি নেই। এখনও সময় আছে, দুই জীবনের খেলা তোমার এই বেলা শেষ করে দাও। পালাও—পালাও তুমি সুধা।
কে বলছে একথা? জয়ন্তী সান্যালের আত্মা, না সুধার অপরাধী মন?
যে—ই বলুক, সুধা তবু পালাতে পারবে না এ বাড়ি থেকে। মিথ্যা পরিচয়ের আড়াল দিয়ে এ বাড়িতে এসে জীবনে যে মধুরসের সন্ধান পেয়েছে সে, সুধার মিথ্যা জগতে সেই তো একমাত্র সত্য বস্তু। তার মোহ কেমন করে কাটাবে সে? পারবে না, কিছুতেই পারবে না সুধা এ বাড়ি ছাড়তে। এ বাড়ি ছাড়া মানে সুজিতকে ছাড়া।
মরতেই যদি হয়, এই সান্যাল বাড়িতেই মরবে সুধা।
আশ্চর্য নারীর ভালোবাসা! বিপদের সঙ্কেত শুনেও অন্ধের মতো অন্ধকারে সে এগিয়ে যেতে চায়।
চাপা কান্নার আবেগে সুধা ভেঙে পড়ল বালিশের ওপর।