কে তুমি – ৩

তিন

এলাহাবাদ স্টেশনে বাড়ির মোটর গিয়েছিল আনতে।

হাডসন গাড়িটা লোহার ফটকে ঢোকবার আগে সুধার চোখে পড়ল, গেটের পাশে শ্বেতপাথরের টুকরোয় লেখা ‘সান্যাল—বাড়ি’। ফটক ছাড়িয়ে কাঠা পাঁচ—ছয় জমির ফুল—বাগান। বেশির ভাগ মরশুমী ফুলের বেড়। কিছু চন্দ্রমল্লিকার ঝাড়। মাঝখানে রাঙানো সিঁথির মতো লাল সুরকির পথ। পথটা গিয়ে পৌঁছেছে রীতিমতো বড় একটা দোতলা বাড়ির পায়ের গোড়ায়। বাড়ির গড়ন অনেকটা সেকেলে দুর্গের মতো।

এই হল জাস্টিস অমরনাথ সান্যালের বাড়ি।

গাড়িটা ভালো করে থামবার আগেই নেমে পড়ল সুজিত। তারপর দরজাটা ভালো করে খুলে দিয়ে বললে, আসুন বউদি।

শাড়ির আঁচলটা মাথায় তুলে দিয়ে নামল সুধা। তারপর সুজিতের পিছু পিছু জড়িত পদে যেখানটায় এসে দাঁড়াল, সেটা একতলার হলঘর। উলটো দিকে খোলা দরজা দিয়ে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি নজরে পড়ে। হলের দু’পাশে দু’খানা দু’খানা চারখানা ছোট ঘর। চারটে দরজাই বন্ধ।

হলের মাঝখানে এসে সুজিত ফিরে তাকালে সুধার দিকে। বললে, এত বড় বাড়িটা কেমন ভূতুড়ে হয়ে আছে দেখছেন?

সুধা জিজ্ঞাসু চোখ তুলে তাকাল।

তেমনি মিষ্টি হাসি দেখা দিল সুজিতের মুখে। বললে, ভূত—টুত অবিশ্যি নেই এখানে। তবু বাড়িটা এত চুপচাপ যে ভূতুড়ে বলেই মনে হয়। থাকবার মধ্যে কেবল মা আর আমি। আমাদের দুটো ঘর ছাড়া গোটা বাড়িটায় আর আলো জ্বলে না। আপনি এলেন, এবার যদি এই ভূতুড়ে আবহাওয়াটা পালায়!

পশ্চিমের ছেলে বলেই বোধ হয় সুজিতের কথায় অন্তরঙ্গতার সহজ সুর। হয়তো তারই দরুণ সুধার আড়ষ্টতা ট্রেনেই খানিকটা কেটে গিয়েছিল। মনে মনে খানিকটা তৈরি করে নিতে পেরেছিল সে নিজেকে।

সুজিতের কথায় কি বলবে ভেবে পেল না সুধা। তার মনে হল, ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট থেকে এখনও যা ঘটছে, তার সবটাই তো ভূতুড়ে। কিছু না বলে মৃদু একটু হাসল শুধু।

সুজিত বললে, চলুন, আগে মার কাছে যাই। তারপর দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে ডাকতে লাগল, মা! মা!

কিন্তু ডাকবার দরকার ছিল না। দেখা গেল, সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন স্বর্ণময়ী। দোতলার বারান্দা থেকে হাডসন গাড়িটা দেখতে পেয়েছিলেন তিনি।

নিচের শেষ ধাপে পৌঁছে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন স্বর্ণময়ী।

মাকে দেখে সুজিত একেবারে শোরগোল করে উঠল, বউদিকে একেবারে নিয়েই এলাম মা। ওঁর দাদা কিন্তু আসতে পারলেন না। ভাগ্যিস তোমার আশীর্বাদ নিয়ে বেরিয়েছিলাম, তাই তো আস্ত গোটা বউদিকে ফিরিয়ে আনতে পারলাম। এবার তুমি বুঝে—পড়ে নাও মা!

কথা শেষ করার আগেই তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে গেল সুজিত। হলঘরের মাঝখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সুধা।

আর সিঁড়ির নিচের শেষ ধাপে স্বর্ণময়ী।

দুজনে দুজনকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল শুধু। আর বড় দেওয়াল—ঘড়িটা মুহূর্ত গুনতে লাগল টক টক করে।

স্বর্ণময়ী দেখলেন, ক্লান্ত পাখির মতো আশ্রয়মুখী একটি মেয়ে। সুশ্রী ম্লান বিষণ্ণবদনা। সলজ্জতা ও সঙ্কোচে হতবাক। এই তাঁর পুত্রবধূ। সান্যাল বাড়ির বউ।

সুধা দেখছিল, জগদ্ধাত্রীর মতো রূপ, থানপরা মাতৃমূর্তি, মাথায় কাঁচা—পাকা চুলগুলি ছোট করে ছাঁটা। দুই চোখ দয়া আর ক্ষমায় উপচে পড়ছে।

অনেকক্ষণ কাটল। গেল অনেকগুলি মুহূর্ত।

তারপর একসময় দু—হাত বাড়িয়ে স্বর্ণময়ী ডাকলেন, এসো!

এক—পা এক—পা করে এগিয়ে গিয়ে তাঁর পায়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়ল সুধা।

সুধার হাত দুটি ধরে টেনে তুললেন স্বর্ণময়ী। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখে পড়ল, সুধার ডান হাতের মধ্যমায় বড় ফিরোজা রঙের পাথরটার মাঝখানে জ্বলজ্বলে ‘A’ অক্ষরটা।

দরদর করে জলের ধারা নেমে এল স্বর্ণময়ীর দু’গাল বেয়ে। দু’হাত দিয়ে টেনে নিলেন সুধাকে তাঁর বুকের ওপর।

সুধা অভিনেত্রী নয়। তবু স্বর্ণময়ীর বুকে মুখ রেখে সেও কাঁদল। অনেকক্ষণ ধরে। এত কান্না তার বুকের মধ্যে কোথায় লুকিয়েছিল, সুধা নিজেও জানতে পারেনি।

একজন কাঁদল হারিয়ে পাওয়ার আনন্দে, আর একজন কাঁদল জীবনের প্রথম অপরাধ—বোধের বেদনায়।

.

কথা হচ্ছিল রাতের খাওয়া—দাওয়ার পর। দোতলার দক্ষিণমুখী ঘরখানায় সুধার থাকবার ব্যবস্থা করেছেন স্বর্ণময়ী। কথা হচ্ছিল সেই ঘরে বসে।

স্বর্ণময়ী বলছিলেন, সান্যাল বাড়িতে প্রথম বউ এল, অথচ শাঁখ বাজল না, আলো জ্বলল না, উৎসব হল না। এ আমারই কপাল! অলোক যে আমায় এমনি করে ফেলে পালাবে, ভাবতেও পারিনি আমি। শেষ হবার আগে একটা খবরও কি দিতে পারোনি বউমা?

স্বর্ণময়ীর শেষের ডাকটি শুনে তেইশ বছরের কুমারী মেয়ের বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। মুখ নিচু করে সুধা বললে, সময় ছিল না। ছোটনাগপুর থেকে বাড়িতে আনার পর তিনি মাত্র একটা রাত বেঁচেছিলেন।

জানলার ধারে একখানা চেয়ার টেনে চুপ করে বসেছিল সুজিত। বলে উঠল, বাড়িতে! কিন্তু আপনার চিঠিতে লেখা ছিল দাদা হাসপাতালেই মারা গিয়েছিলেন।

সুধার গলার কাছটা শুকিয়ে উঠল। বললে, প্রথমে বাড়িতেই আনা হয়েছিল। তারপর ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে হাসপাতালে।

কোন হাসপাতালে?

সুধার বুকের ধুক—ধুক দ্রুত হয়ে উঠল। অত বড় শহর কলকাতার অসংখ্য রুগির মধ্যে অ—দেখা অজানা অলোক সান্যাল কোন হাসপাতালের কোন বেডে মরেছে, সুধা তা জানবে কেমন করে? তবু অন্ধকারে ঢিল ছুড়লো সুধা। বললে, শম্ভুনাথ হসপিটালে।

সুজিতের চোখে কিসের যেন ছায়া পড়ল। বললে, কাগজে কিন্তু বেরিয়েছিল, পি—জি’তেই দাদাকে দেওয়া হয়।

সুধার গলার কাছে কি যেন আটকে গেছে। একটা ঢোক গিলে বললে, হ্যাঁ, সেটা পরে অপারেশনের জন্যে। তারপর স্বর্ণময়ীর মুখের পানে চেয়ে কেমন যেন অসহায় কণ্ঠে বললে, ওসব কথা থাক মা।

ও প্রসঙ্গ স্বর্ণময়ীরও ভালো লাগছিল না। একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, থাক সুজিত, যে যাবার সে তো গেছেই, জয়ন্তীর মনে নতুন করে ঘা দিয়ে আর লাভ কি!

সুজিতের মুখের ভাব বদলে গেল। অনুতপ্ত গলায় শুধু বললে, মাপ করবেন।

তারপর আস্তে আস্তে উঠে চলে গেল।

স্বর্ণময়ী সুধার পিঠে একখানি হাত রেখে বলতে লাগলেন, তোমার মধ্যেই আমার অলোককে আবার ফিরে পেয়েছি বউমা। এত দুঃখের মধ্যে এইটুকুই আমার সান্ত্বনা। এ বাড়িতে আমার পরেই তোমার স্থান। এতকাল সংসারের জোয়াল বয়ে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। শেষ দিন ক’টা আমায় ছুটি দাও বউমা।

আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে সুধার আঁচলে বেঁধে দিলেন স্বর্ণময়ী। তারপর বললেন, রাত হয়েছে, শুয়ে পড়ো মা!

ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন স্বর্ণময়ী।

চাবির গোছাটা হাতের মুঠোয় নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইল সুধা। তারপর একসময় উঠে দরজাটা বন্ধ করে বাতিটা নিভিয়ে দিলে। ঘুম কি আজ আসবে সুধার? মাথার কাপড়টা নামিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল জানলার ধারে। বাইরে ফিকে ফিকে জ্যোৎস্না মোমের মতো গলে গলে পড়ছে এলাহাবাদ শহরের ওপর। কৃষ্ণপক্ষ কেটে গিয়ে শুরু হয়েছে শুক্লপক্ষ। কিন্তু সুধার মনের কৃষ্ণপক্ষ কাটল কই? এত ঐশ্বর্য, এত আদর, এতখানি বিশ্বাস—এর কিছুই তো তার পাওনা নয়। আর একজনের কাছ থেকে চুরি করে নেওয়া। সারাটা জীবনই চোর হয়েই কি কাটাতে হবে তাকে? ধরা পড়ার ভয়ে প্রতি মুহূর্তে মরমে মরে গিয়ে! যে অলোক সান্যাল মরে গেছে ছ’মাস আগে, জগৎ—সংসারের কাছে আজ সে তার স্ত্রী। মরা মানুষের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে সুধা। এই মিথ্যা পরিচয়ের ফাঁদ থেকে এ জীবনে বুঝি তার আর মুক্তি নেই!

না, আজ আর ঘুম আসবে না সুধার চোখে।

.

গৃহস্থালী করার অভ্যাস সুধার আঠারো বছর বয়েস থেকে। যখন যতিশঙ্করের আর্থিক অবস্থা পড়তির শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছে। বাবুর্চি গেল, খানসামা গেল, চাকর গেল, এল আট টাকা মাইনের ঠিকে ঝি আর পনেরো টাকার রান্নার লোক। গৃহস্থালীতে সুধার হাতেখড়ি হয়েছে সেইদিন থেকেই।

স্বর্ণময়ীর চাবির গোছা হাতে পেয়ে সুধার তাই কোনো কিছুই আটকায়নি। সান্যাল বাড়ির সংসারের ভার অনায়াসে তুলে নিয়েছে হাতে। তাকে বাদ দিলে লোকের সংখ্যা মোটে দুটি। কিন্তু কাজের সংখ্যা অনেক। ভোরবেলায় উঠে স্নান সেরে সবার আগে স্বর্ণময়ীর পুজোর জোগাড় করে দেওয়া। তারপর সুজিতের চা—পর্বের আয়োজন করে দিয়ে রঘুয়াকে বাজারে পাঠানো। বাজার মানে শুধু আলু—পটল—কুমড়োর সওদা নয়। স্বর্ণময়ীর জন্যে বিশেষ বিশেষ ফলমূল, সুজিতের জন্যে একটু টাটকা মাংস, চাকর—বাকরদের জন্যে আলাদা জাতের বাজার। তাছাড়া, স্বর্ণময়ীর হরলিকস ফুরোল কিনা, সুজিতের কফির টিন কতটা ভর্তি, সে খোঁজও রাখতে হয়।

পুজো সারতে স্বর্ণময়ীর প্রায় ঘণ্টা দুয়েক লাগে। তার আগেই এক ফাঁকে সরবতটুকু করে রাখে সুধা। শরীর খারাপ বলে স্বর্ণময়ীকে বেলা এগারোটার মধ্যেই একরকম জোর করে খাইয়ে দেয় সে। পারে না শুধু সুজিতকে বাগ মানাতে। সুজিতের ঘড়ি প্রায়ই গ্রিনউইচ টাইমে চলে। দুপুরে খাওয়া—দাওয়ার পাট চুকতে তাই বেলা দেড়টা—দুটো বাজে। তারপর দক্ষিণের বারান্দায় বসে স্বর্ণময়ীকে খানিকটা রামায়ণ পড়ে শোনানো। আবার বিকেল পাঁচটা থেকে ও—বেলার পাট শুরু। মিটতে সেই রাত এগারোটা।

ছোট সংসার, কিন্তু কাজ অনেক। খাটুনি একটু বেশিই হয়। তা হোক, তবু বেঁচে গেছে সুধা। সংসারের চাকার সঙ্গে সঙ্গে তার মনটাও অনবরত ঘুরতে থাকে। ভোর থেকে রাত এগারোটা অবধি সে সান্যাল বাড়ির বউ জয়ন্তী সান্যাল। সুধা সোম তার ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারে না। আর পারে না বলেই সে শান্তি পায়। তাই এতটুকু কাজকে ফুলিয়ে—ফাঁপিয়ে অনেকখানি করে তোলে সুধা। কোথাও যেন ফাঁক না থাকে।

এমনি করে দিন গড়িয়ে চলে।

সেদিন দুপুরে একরাশ আধময়লা কাপড়ের ডাঁই নিয়ে বসে বসে ধোপার হিসেব লিখছিল সুধা। কাপড়—চোপড়ের বারো আনাই সুজিতের। পোশাক বদলানোর কোনো নিয়ম নেই তার। আর কাপড়—চোপড় ময়লা হলে যে ময়লা কাপড়ের বাক্সে রাখতে হয়, তাও জানা নেই তার। সেগুলি আবিষ্কার করতে হয় খাটের তলা থেকে, কিংবা টেবিলের পাশ থেকে, নয়তো আলমারির নিচের তাক থেকে। সুধাই করে।

বুধনি এসে জানালে, ছোটদাদাবাবু বউমাকে ডাকছেন।

ধোপাকে বিদায় করে দিয়ে সুধা উঠে দাঁড়াল। শাড়িখানা একটু গুছিয়ে নিলে, তারপর ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে মনে হল, বুধনিকে তো জিজ্ঞাসা করা হয়নি সুজিত কোথায়? বারান্দা দিয়ে এগিয়ে সুজিতের শোবার ঘরে একবার উঁকি দিলে সুধা। সুজিত নেই। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল একতলায়। হলের দরজা পার হয়ে আস্তে আস্তে ঢুকল লাইব্রেরি ঘরে। এটা সুজিতের বাবা অমরনাথের লাইব্রেরি ছিল। মোটা মোটা আইনের কেতাবে চারপাশের আলমারি ঠাসা। কিন্তু কোথায় সুজিত? আশ্চর্য ছেলে! ডেকে পাঠিয়ে কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেল, কে জানে!

খানিক দাঁড়িয়ে থেকে সুধা ফিরল। হঠাৎ শোনা গেল, চলে যাচ্ছেন যে?

চমকে তাকাল সুধা। দেখলে, লাইব্রেরির অপরপ্রান্তে পিঠ উঁচু বড় একটা চেয়ারের পাশ থেকে সুজিতের হাসিমুখ উঁকি দিচ্ছে।

মৃদু গলায় সুধা বললে, ডেকে পাঠিয়েছেন?

সুজিত বললে, হ্যাঁ, বসুন।

সুধা বসলে না। টেবিলের উলটো দিকে একখানা চেয়ারের পিঠ ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

খাওয়া হয়েছে?

সুধা ঘাড় নাড়লে।

এখন তাড়া নেই তো?

ছোট্ট করে সুধা জবাব দিলে, না।

তাহলে দাঁড়িয়ে না থেকে চেয়ারটায় বসুন। না বসলে কথা হয় না।

সুধাকে অগত্যা বসতে হল।

একখানা মোটা আইনের বই সুজিতের সামনে খোলা ছিল। তার ওপর কনুইয়ের ভর রেখে প্রশ্ন করলে, কেমন লাগছে এ বাড়িতে?

ভালোই।

কাজের পাঁচিল তুলে নিজেকে এমন আড়াল করে রেখেছেন যে আপনাকে দেখতেই পাওয়া যায় না।

অল্প হেসে সুধা বললে, সময় পাই না।

সুজিত বলতে লাগল, এ বাড়ির হাওয়ায় হাওয়ায় প্রত্যেক জায়গায় আপনার উপস্থিতি টের পাই। আপনি আসার পর এ বাড়ির হাওয়াই বদলে গেছে। তবু মনে হয়, কাজের আড়ালে আপনি যেন অনেক দূরে সরে যাচ্ছেন। এ বাড়িতে আপনি যেন থেকেও নেই। কেন বলুন তো বউদি?

সুধার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। একথার কি জবাব দেবে সে? জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললে, আমি স্বভাবতই একটু চুপচাপ। তাছাড়া কাজ ভালোবাসি।

সুজিত আচমকা একটা প্রশ্ন করলে, মানুষের চেয়েও?

একটুখানি রক্তের আভাস খেলে গেল সুধার মুখে। আঁচলের প্রান্তটা আঙুলে জড়াতে জড়াতে কি বলবে ভেবে পেল না।

তরল কণ্ঠে সুজিত হেসে উঠল হঠাৎ, আপনি খুব কাজের লোক জানি। একটা সার্টিফিকেট লিখে দেব’খন। কিন্তু কাজ ছাড়াও মানুষের জীবনে আরও কিছু করবার আছে। এসে অবধি তো বাড়ি থেকে বেরোননি। এলাহাবাদ শহরটা কেমন, দেখতেও ইচ্ছে করে না? চলুন আজ বিকেলে বেড়াতে বেরোই।

সুধার দুই চোখে ভয়ের ছায়া ঘনিয়ে এল। অনুনয়ের সুরে বলে উঠল, আজ থাক, আর একদিন বরং যাব। কাজ আছে।

চমৎকার ছেলে সুজিত। আলাপে, অমায়িকতায়, অন্তরঙ্গ ব্যবহারে অতি ভদ্র। তবু কেন যে তাকে এড়িয়ে চলতে চায়, সুধা নিজেই জানে না।

মাথার কাপড়টা একটু সরে গিয়েছিল। টেনে নিয়ে সুধা উঠে দাঁড়াল। বললে, মার বোধ হয় ঘুম ভাঙল। আমি যাই।

ব্যস্ত হয়ে সুজিত বললে, আরে বসুন, বসুন। কাজের কথাটাই বলা হয়নি এখনও।

টেবিলে একখানা হাত রেখে সুধা দাঁড়িয়ে রইল।

সুজিত বললে, বিয়ের আগে দাদা একটা লাইফ ইনসিওর করিয়েছিলেন, আপনি জানেন নিশ্চয়?

প্রশ্নটা যেন ধাক্কা মারল সুধাকে। এ খবর তার জানবার কথা নয়। আলোক সান্যালের কথা কতটুকুই বা জানে সে? তবু নিজেকে সামলে নিল সুধা। এ বাড়িতে আসার পর থেকে এমনি বেকায়দা প্রশ্নকে এড়িয়ে যেতে খানিকটা শিখেছে সে। তাই ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছু না বলে পালটা প্রশ্ন করল, একথা কেন?

পকেট থেকে একখানা চিঠি বার করতে করতে সুজিত বললে, একখানা চিঠি এসেছে ইনসিওর কোম্পানি থেকে, কলকাতা থেকে রি—ডাইরেক্টেড হয়ে।

কি লিখেছে?

হাফ ইয়ার্লি প্রিমিয়াম বাকি পড়েছে বলে জানিয়েছে। আচ্ছা, ওরা কি দাদার মৃত্যুর খবর পায়নি?

বোধ হয় পায়নি।

তাহলে তো খবরটা জানাতে হয়। আর টাকাটা আদায়ের চেষ্টাও করতে হয়। পলিসিখানা আপনার কাছেই আছে তো?

না, ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে হারিয়ে গেছে।

সুজিতের কপালে রেখা দেখা দিল। চিন্তিত মুখে বললে, ও। তবু দেখি চেষ্টা করে, আপনার পাওনা টাকাগুলো আদায় করা যায় কিনা।

মুহূর্তের জন্যে কাঠ হয়ে গেল সুধা। ‘আপনার পাওনা টাকা’! কার পাওনা টাকা? সুধা সোমের, না জয়ন্তী সান্যালের?

একটু চুপ করে থেকে সুধা বললে, আমার মনে হয়, ও—ব্যাপারে কিছু না করাই ভালো।

তারপর আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

.

এলাহাবাদে সুধা এসেছিল বৈশাখের শেষাশেষি। দেখতে দেখতে এসে গেল শ্রাবণ মাস। ধুলোয় ভরা রুক্ষ এলাহাবাদের চেহারাটাই বদলে যেতে লাগল। ইস্পাতের মতো চকচকে আকাশ যমুনার জলের মতো স্নিগ্ধ হয়ে এল। গাছে গাছে লাগল সবুজ রং। মৌসুমি হাওয়ায় মিষ্টি আমেজ।

সেদিন দুপুর থেকেই মেঘ করে এসেছে। দক্ষিণের বারান্দায় বসে যথারীতি রামায়ণ শোনানোর পর স্বর্ণময়ীর জন্য হরলিকস তৈরি করছিল সুধা। সুজিত এসে হাজির। ব্যস্ত হয়ে সুধা মাথায় কাপড় তুলে দিতে যাচ্ছিল, স্বর্ণময়ী বললেন, ওকে দেখে আর ঘোমটা দিতে হবে না। ও আবার একটা মানুষ!

সুজিত বলে উঠল, বা! মানুষ নই তো কি আমি? চিড়িয়াখানার বাসিন্দা? আপনারও ওই মত নাকি বউদি?

সুধা মুখ নামিয়ে হাসি গোপন করল। স্বর্ণময়ীও না হেসে পারলেন না। বললেন, তা বটে! সারাদিন কোথায় ঘুরে বেড়াস বল তো? বাজে কাজগুলো ছেড়ে বউমাকে নিয়ে খানিক বেড়িয়ে এলেই তো পারিস! এ বাড়িতে এসে অবধি খাঁচার পাখি হয়ে আছে বেচারি।

সুজিত বললে, কেউ যদি শখ করে খাঁচার পাখি হয়, তাহলে আমি কি করব বলো? জিজ্ঞেস করো তো, কতদিন বলেছি বেড়াতে যাবার কথা? তোমার কুনো বউ সে—কথা কানেই তোলেন না।

স্বর্ণময়ী ধমকের সুরে বললেন, তুই থাম! আমার বউয়ের নিন্দে করিসনি। অনেক ভাগ্যে এমন বউ পায় লোকে।

দুই কানে দুই হাত চাপা দিয়ে সুজিত চেঁচিয়ে উঠল, উঃ, আর শুনতে পারছি না! হিংসেয় আমার প্রাণ ফেটে যাচ্ছে।

হেসে ফেলে স্বর্ণময়ী বললেন, তুই যা দিকিন এখান থেকে, গাড়িটা বের করগে।

হার ম্যাজেস্টির জন্যে গাড়ি নিচে অপেক্ষা করছে। সুজিত আস্তে আস্তে উঠে গেল।

স্বর্ণময়ী সুধাকে বললেন, মাঝে মাঝে বেড়াতে যাও না কেন মা? বাইরে বেড়ালে মনটাও তো ভালো থাকবে। যাও, একটু ঘুরে এসো আজ।

মনে মনে প্রমাদ গুনলে সুধা। আস্তে আস্তে বললে, কিন্তু ও—বেলার রান্নাবান্নাগুলো দেখিয়ে না দিলে মহাদেও হয়তো ঠিক পারবে না।

না পারে আমি দেখিয়ে দেব’খন! স্বর্ণময়ী বললেন, আমি তো আছি, তুমি খানিক ঘুরে এসো।

নিরুপায় সুধা উঠে দাঁড়াল।

স্বর্ণময়ী বললেন, ভালো করে চুল আঁচড়াবারও সময় হয় না তোমার? একটা কাজ করো তো, চিরুণিখানা নিয়ে এসো, জটগুলো ছাড়িয়ে দিই।

তারপর আবার বললেন, একটু দাঁড়াও। স্বর্ণময়ী এবার নিজেও উঠলেন। ঘরে ঢুকে দেরাজ থেকে মরচে—পড়া একটা চাবি বের করে আলমারি খুললেন। বের করলেন মকরমুখো দু’গাছা রুলি। তারপর ফিরে এলেন বারান্দায়। সুধার হাতে রুলি জোড়া পরিয়ে দিতে দিতে স্বর্ণময়ীর চোখ দুটি মমতায় গাঢ় হয়ে এল। ধরা ধরা হয়ে এল গলার স্বর। বললেন, আমি যতদিন বেঁচে আছি, হাত থেকে এ দু’গাছা খুলো না বউমা।

অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুধা।

নিচ থেকে মোটরের হর্ন শোনা গেল। সুজিত তাড়া দিচ্ছে।

.

হাডসনখানা এসে থামল ফোর্টের খানিক তফাতে। সুজিত নেমে পড়ে দরজা খুলে দিলে। উঁচু—নিচু অসমান জমির ওপর দিয়ে সুধা চলতে লাগল সুজিতের পিছু পিছু। কেল্লার পিছনে নদী। ঢালু পাড় নেমে গেছে নদীগর্ভে।

সুজিত বললে, এখানে একটু বসলে মন্দ কি!

একটা ঢিবির ওপর বসল দুজনে।

সুজিত বললে, কেমন লাগছে জায়গাটা?

জায়গাটা সত্যিই ভালো। ওদের পিছনে মেঘলা আকাশের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে এলাহাবাদের প্রাচীন দুর্গ। সামনে নদী, ওপাশে ব্রিজ! চারপাশে দিগন্তজোড়া মুক্তির মাঝে শহুরে মেয়ে সুধা নতুন একটা স্বাদ পেল যেন। হু—হু হাওয়ায় অনেক দিন পরে বুক ভরে নিশ্বাস নিল সে।

এটা কোন নদী জানেন? প্রশ্ন করলে সুজিত।

সুধা তাকাল জিজ্ঞাসু চোখে।

সুজিত বললে, যে নদীর নাম শুনলে কবিদের জিভে জল আসে, মানে কলমে কালি আসে! বুঝতে পারলেন না? যে নদীর ধারে আপনাদের ফেমাস কেষ্টঠাকুর বাঁশি প্র্যাকটিস করতেন, এ হল সেই যমুনা।

সুজিতের বলার ধরনে সুধা হাসি চাপতে পারল না। সুজিত বললে, কিন্তু শুধু—মুখে গল্প জমে না! তারপর পকেট থেকে এক ঠোঙা বাদাম বের করে বললে, নিন বউদি। আমি আবার বেশি সাধতে পারি না।

সুধা গোটাকতক বাদাম তুলে নিল, কিন্তু মুখে দিল না।

বাদাম চিবোতে চিবোতে সুজিত বললে, একটা কাজ করা যাক। এসো, দুজনে মিলে ‘আপনি’টাকে এই নদীর জলে ছুড়ে ফেলে দিই। সম্পর্কে বড় হলে কি হয়, বয়সে তুমি আমার চেয়ে ঢের ছোট। আপত্তি নেই তো?

একটু রক্তের আভাস খেলে গেল সুধার মুখে। ঘাড় নেড়ে জানাল, না।

সুজিত বললে, থ্যাঙ্ক ইউ। তোমাকে একটা সুখবর দিই। যে কোম্পানিতে দাদা ইন্সিওর করিয়েছিলেন, এলাহাবাদে তাদের একটা ব্রাঞ্চ অফিস আছে। তারা বলেছে, পলিসি খোয়া গেলেও টাকাও পাওয়া যাবে।

সুধার মুখ থেকে রক্তের আভাসটুকু মিলিয়ে গেল। মৃদু গলায় বললে, ওটা ছেড়ে দিলেই ভালো হত।

সুজিত বললে, ও টাকা তুমি দান করে দাও, বিলিয়ে দাও, যা খুশি করো, কিন্তু ইনসিওরেন্স কোম্পানিকে ছেড়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। টাকাটা দিন পনেরোর মধ্যেই পাওয়া যাবে। পেলে এখানকার ব্যাঙ্কে তোমার নামে জমা করে দেব ভাবছি।

সুধা চুপ করে রইল। জয়ন্তী সান্যালের মুখখানা অস্পষ্টভাবে মনে পড়তে লাগল তার। আর বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠল সেই পুরোনো যন্ত্রণাটা। ঘৃণায় মুখ বেঁকিয়ে তার বিবেক বলতে লাগল, সুধা, তুমি চোর, তুমি জালিয়াত! এ যে কত বড় শাস্তি তার জীবনে, সুধা ছাড়া আর কে বুঝবে দুনিয়ায়? মনে মনে অস্থির হয়ে উঠে সুধা বললে, ওকথা থাক।

থেমে গেল সুজিত। একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সুধার দিকে। যমুনার দিকে দৃষ্টি রেখে বসে আছে। ক্লান্ত—করুণ মুখের ভাব। মাঝে মাঝে এই মেয়েটিকে ঠিক বুঝতে পারে না সুজিত। কি যেন চাপা আছে এর মনের মধ্যে। কি সে জিনিস? দুঃখ, বিরহ, না অন্য কোনো রহস্য?

উতল হাওয়ায় সুধার ঘোমটা গেছে খসে। হাঁটুর ওপর কনুইয়ের ভর রেখে, হাতের তালুতে চিবুক ঠেকিয়ে বসে আছে। যেমন করে মডেল বসে থাকে শিল্পীর সামনে। মেঘের ফাঁকে একটু মরা আলো চিকচিক করছে ওর মুখে। পাণ্ডুর দেখাচ্ছে মুখখানা।

সুজিত মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করে, কোনো শিল্পী এই ছবি আঁকলে কি নাম দিত? রিক্তা?

দেখতে দেখতে কেমন একটা অদ্ভুত মমতায় ভরে উঠল সুজিতের মন। তার মনে হল, একটা শূন্যতা ঘিরে রয়েছে এই মেয়েটিকে। আর সেই শূন্যতার মাঝে সে যেন একেবারে একা! আস্তে আস্তে সুজিত ডাকলে, শোনো!

সুধা ফিরে তাকাল। অত্যন্ত কোমল গলায় সুজিত বললে, আমি শুধু তোমার আপনজন নই, আমাকে সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু বলে মনে কোরো তুমি। তারপর একটু থেমে আবার বললে, তোমার জীবনে কতটুকু সুখ কতখানি দুঃখ, তা আমি ঠিক জানিনে। তবু বিশ্বাস করো, তার ভাগ নেবার লোক পৃথিবীতে আছে।

এ—কথা শোনার জন্যে সুধা তৈরি ছিল না। তার তেইশ বছরের কুমারী জীবনে পরিচিত—অপরিচিত কোনো পুরুষের মুখেই সে এ—কথা শোনেনি। সুধার অনভ্যস্ত মন কথাগুলোকে তাই সহজভাবে গ্রহণ করতে পারলে না। অস্বস্তিভরা মন নিয়ে চোখ তুলতেই মিলে গেল সুজিতের চোখে। নারীর চোখ পুরুষের চোখের ভাষা চেনে এক নিমেষে। সুজিতের বড় বড় দুই সরল চোখে স্নিগ্ধ আন্তরিকতা ছাড়া সুধা আর কিছুই খুঁজে পেল না। আর, কি আশ্চর্য, সুধার আতপ্ত মন যেন এক মধুর শীতলতায় ধীরে ধীরে জুড়িয়ে আসতে লাগল। ভারি হয়ে নেমে এল চোখের দীর্ঘ পল্লবগুলি যেন ঘুমের আবেশে।

সুধার জীবনে সুখ—দুঃখের ভার নেবার লোক পৃথিবীতে আছে। একথা সত্য, না মিথ্যা, সুধা আজ তা ভাববে না। সে শুধু শুনবে—শুনবে কান ভরে, প্রাণ ভরে।

অনেকগুলি মুহূর্ত কেটে গেল। বয়ে গেল যমুনার অনেক জল।

হঠাৎ বিদেশি গলার আওয়াজে চমক ভাঙল দুজনের।

ক্ষমা করবেন!

দুজনে তাকিয়ে দেখল, প্রৌঢ় এক বিদেশি ভদ্রলোক কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাতে ক্যামেরা, পাশে একটি প্রৌঢ়া মহিলা।

পরিষ্কার ইংরাজিতে বিদেশি বললেন, আমরা টুরিস্ট, পোল্যান্ড থেকে ইন্ডিয়া দেখতে এসেছি। এলাহাবাদের কিছু কিছু ফোটো আমরা নিয়েছি। আপনাদের একখানা ছবি নিতে পারি কি?

হাসিমুখে সুজিত বললে স্বচ্ছন্দে। আমাদের দেশে আপনারা অতিথি। অতিথিকে খুশি করাই আমাদের উচিত।

প্রসন্ন মুখে পোলিশ ভদ্রলোক বললেন, ধন্যবাদ। দয়া করে যেমন বসেছিলেন, তেমনি বসুন আপনারা।

সুধা কিছু বলবার আগেই সুজিত বললে, আমরা রেডি।

ক্লিক করে একটা শব্দ।

পোলিশ ভদ্রলোক বললেন, আর আপনাদের কষ্ট দেব না। এই নদীর ধারে এমন সুন্দর কম্পোজিশনে আপনারা বসে আছেন যে, দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না।

সুজিত বললে, কিন্তু আমি একটু কষ্ট দেব আপনাকে। এই ছবির একখানা কপি যদি পাঠিয়ে দেন আমার ঠিকানায়, খুব খুশি হব।

নিশ্চয়! আনন্দের সঙ্গে।

পকেট থেকে নোটবই বের করে বিদেশি প্রৌঢ় সুজিতের ঠিকানা লিখে নিলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা, গুডবাই!

সুজিত সুধাকে কি একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কানে এল, প্রৌঢ় ভদ্রলোক তার সঙ্গিনীকে বলছেন, ওরা নিশ্চয় খুব সুখী দম্পতি, নয় জেনি?

প্রৌঢ়া বললেন, হ্যাঁ, ওরা যেন আমাদের হারানো যৌবন।

অজান্তে দুজনে তাকাল একবার দুজনের দিকে। সুধা আর সুজিত।

পরমুহূর্তেই মুখ ঘুরিয়ে নিল সুধা নদীর দিকে। আর সুজিত কেল্লার দিকে। এক মুহূর্তেই দুজনের মাঝখানে যেন পাঁচিল উঠে গেল।

বিকেল গড়িয়ে গেল সন্ধ্যার দিকে। মেঘলা আকাশ চিরে চিরে বিদ্যুতের চোরা হাসি ইশারা জানাতে লাগল আসন্ন বর্ষণের!

সুজিত একসময় দাঁড়িয়ে উঠে বললে, চলো, ফেরা যাক।

নিজের মধ্যে ডুবে গিয়ে বসেছিল সুধা। এবার উঠল।

অন্ধকার হয়ে এসেছিল নদীতীর। উঁচু—নিচু অসমান পথে চলতে চলতে সুধা একটা হোঁচট খেল।

সুজিত ফিরে দাঁড়িয়ে একটা হাত বাড়িয়ে দিলে। বললে, হাতটা ধরে এসো, রাস্তাটা ভালো নয়।

সত্যিই তাই, জীবনের যে পথে সুধা চলেছে, সেখানে পদে পদে হোঁচট খাওয়ার ভয়। বন্ধুর পথে চলতে গেলে বন্ধু চাই বইকি!

আবছা অন্ধকারে নরম একখানা হাত সুজিতের হাতের মধ্যে আশ্রয় নিলে।

পথ চলতে চলতে সুজিত বুঝতে পারলে, তার মুঠোর মধ্যে ঘামে ভেজা ভীরু হাতখানি মৃদু মৃদু কাঁপছে।

.

মাঝরাতে আবার বৃষ্টি এল। খোলা জানলা দিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো জলের ঝাপটা আসতেই ঘুম ভেঙে গেল সুধার। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। জানলাটাও খোলা, বাতিও জ্বলছে।

উঠে পড়ল সুধা। জানলাটা বন্ধ করতে হবে। দু’পা এগোতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। উজ্জ্বল আলোয় ড্রেসিং আলমারির আয়নায় ছায়া পড়েছে তার। মাথা থেকে পা অবধি সম্পূর্ণ প্রতিচ্ছায়া। এক সুধা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল আর এক সুধাকে। সেই নির্জন নিশীথরাত্রে মনে হল, সুধার আত্মা যেন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে তার সামনে।

তখন দুই সুধার মধ্যে সেই নিরালা প্রহরে নিঃশব্দ ভাষায় যা কথাবার্তা হল, তা এই:

 আর্শির ছায়া।। কে তুমি?

 সুধা।। আমি জয়ন্তী সান্যাল।

 ছায়া।। মিথ্যে কথা!

 সুধা।। এ মিথ্যে পৃথিবীতে একজন ছাড়া আর কেউ জানে না।

 ছায়া।। কেউ না জানুক, আমি জানি। তুমি সুধা সোম। এ বাড়িতে কেন এসেছ?

 সুধা।। ভাগ্য আমাকে এনেছে।

 ছায়া।। তুমি ভাগ্য বিশ্বাস কর?

 সুধা।। করি বইকি।

 ছায়া।। ভাগ্য যদি তোমাকে আর কোথাও নিয়ে যায়, যেতে পারবে?

 সুধা।। কেন পারব না? এ বাড়ি থেকে যেতে পারলেই তো বাঁচি। প্রতি মুহূর্তেই মিথ্যা অভিনয় অসহ্য হয়ে উঠেছে আমার।

 ছায়া।। তাই যদি হয়ে থাকে তো পালিয়ে যাও না কেন?

 সুধা।। ভাগ্য যদি কোনোদিন সুযোগ দেয়, পালাব বইকি?

 ছায়া।। না, তা পারবে না। এ বাড়ি থেকে পালাবার পথ তুমি নিজেই বন্ধ করেছ।

 সুধা।। কেমন করে?

 ছায়া।। তাও বলতে হবে? মিথ্যে অভিনয় করতে করতে সান্যাল বাড়িকে তুমি ভালোবেসে ফেলেছ। ভালোবেসেছ স্বর্ণময়ীকে, হয়তো সুজিতকেও।

 সুধা।। ছি, ছি, সুজিতের সঙ্গে আমার অন্য সম্পর্ক।

 ছায়া।। আবার মিথ্যে বলছ! তুমি তো সত্যিই অলোক সান্যালের স্ত্রী নও। কিসের সম্পর্ক তোমার সুজিতের সঙ্গে? কিসের বাধা সুজিতকে ভালোবাসতে! সাবধান সুধা সোম, মাকড়সার মতো নিজের জালেই জড়িয়ে পড়ছ তুমি।

 সুধা।। চুপ করো! ও কথা আমি শুনব না। ও কথা শুনতে চাই না।

 ছায়া।। এখনও সময় আছে সুধা। পালিয়ে যাও এ—বাড়ি থেকে—পালিয়ে যাও—

বিদ্যুদ্বেগে বাতিটা নিভিয়ে দিলে সুধা। তারপর লুটিয়ে পড়ল বিছানায়। জানলাটা আর বন্ধ করা হল না। খোলা জানলা দিয়ে তেমনি আসতে লাগল ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছাট। বালিশে মুখ গুঁজে মনে মনে বলতে লাগল সুধা, কেন, কেন পালাব এ বাড়ি ছেড়ে? অনেক দুঃখ সয়ে, অনেক কষ্টের পথ হেঁটে পেয়েছি এই শান্তির বাসা—পেয়েছি স্বর্ণময়ীর স্নেহ আর সুজিতের বন্ধুতা। কেন দেব ছেড়ে? কে বললে এসব আমার পাওনা নয়? ভাগ্য যাকে যা দেয় সেটা তো তারই পাওনা। বাকি জীবনটা যদি জয়ন্তী সান্যাল হয়েই বেঁচে থাকি, তাতে কার কি ক্ষতি? কেউ তো জানবে না কোনোদিন।

কিন্তু নরেন? সুধার বুকের ধুক ধুক যেন এক নিমেষের জন্যে থেমে গেল। জীবনে যদি কোনোদিন দেখা হয় নরেনের সঙ্গে? কিন্তু দেখা যে হবেই, তারই বা ঠিক কি? এই তো চার মাস কেটে গেল, আসেনি তো সে! কে জানে, কেন! হয়তো নতুন কারবার ফেঁদেছে, কিংবা পুলিশে ধরা পড়াও আশ্চর্য নয়!

সুধা একটা আশ্বাস খুঁজে পেল। আর সেই আশ্বাসকেই সবলে আঁকড়ে মনে মনে সে বারবার বলতে লাগল, না, নরেন আর আসবে না। সুধার জীবনে নরেনের ছায়া পড়বে না কোনোদিন।

খোলা জানলা দিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছাটের সঙ্গে ঠান্ডা ঘুম এসে লাগল সুধার চোখে।