কে তুমি – ২

দুই

একটা লাঠিতে ভয় দিয়ে এগিয়ে এল নরেন। কপালটা ঘিরে একটা ব্যান্ডেজ। ডান পায়ে একটা নি—ক্যাপ। পায়ের চোটটা কাল টের পাওয়া যায়নি। আজ বেশ খানিকটা ফুলেছে। বাঁ—দিকের কপালটাও ইঞ্চি দেড়েক ফাঁক হয়েছে। ভয়ের কিছু নেই, ডাক্তার বলেছে। পুরোনো দাগটার পাশে আর একটা নতুন দাগ পড়বে মাত্র।

লাঠির খট খট আওয়াজ করে নরেন এগিয়ে এল সুধার বেডের পাশে। মুখ ফিরিয়ে একবার দেখে, সুধা সামনের খোলা দরজার বাইরে আবার তাকিয়ে রইল। অনেক দূরে জমাট—বাঁধা ধোঁয়ার মতো নীলচে পাহাড়ের গায়ে তখন সূর্য ডুবছে।

বেলা দুপুর থেকে সুধার জ্ঞান ফিরেছে। শুধু নার্ভাস শক লাগা ছাড়া মারাত্মক আর কিছুই হয়নি তার। শরীরের কয়েকটা জায়গায় সামান্য কাটাকুটি মাত্র। ডাক্তার বলেছে, মিরাকুলাস এস্কেপ। দৈব তার সহায়।

ঠান্ডা গলায় নরেন বললে, কেমন আছো এখন?

ভালো।

এখনও দুর্বল মনে হচ্ছে?

সুধা চুপ।

সেরে যাবে শিগগিরই।

চুপ করে রইল সুধা। চুপ করে শুনতে লাগল, কোথায় একটা সাঁওতালী বাঁশী বাজছে।

নরেন আবার বললে, তোমাকে যে ফিরে পাব ভাবিনি। এমন অ্যাক্সিডেন্ট কেউ বড় একটা বাঁচে না।

মুখ না ফিরিয়ে সুধা জবাব দিলে, আমি না বাঁচলে বাবার দেনা শোধ হবে কি করে?

নরেন বললে, ডাক্তার বলেছে, দৈব তোমার সহায়।

মাঝের কথাটায় জোর দিয়ে সুধা বললে, দৈব তোমার সহায়।

সুধার বেডের একপাশে নরেন বসল। লাঠিটা দু—হাঁটুর ওপর রেখে বলল, তা বলতে পারো, কথাটা মিথ্যে নয়। দৈব আমারও সহায়। নইলে ট্রেনের কামরায় জয়ন্তী সান্যালের সঙ্গে আমাদের আলাপ হবে কেন?

সুধা চমকে মুখ ফেরাল।

জয়ন্তী কোথায়?

তার স্বামীর কাছে গেছে।

ডান হাতের মুঠি দিয়ে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে সুধা বসে রইল কাঠ হয়ে। সুধাকে একটু সময় দিয়ে নরেন আস্তে আস্তে বললে, তোমাকে একটা জিনিস দিয়ে গেছে জয়ন্তী।

পকেট থেকে নরেন ফিরোজা রঙের পাথর বসানো আংটিটা বের করলে। তারপর টেনে নিল সুধার ডান হাতখানা। অনামিকায় আংটিটা ঢিলে হল, দেখা গেল মধ্যমায় মানানসই হয়েছে।

নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল সুধা আংটির দিকে। ফিরোজা রঙের পাথরটির মাঝখানে জ্বল জ্বল করছে ইংরেজি ‘A’ অক্ষরটা।

নরেন বললে, এ আংটি এখন থেকে তোমারই।

সুধার মুখ দিয়ে বেরোল, কিন্তু এ আংটি জয়ন্তী আমায় দিল কেন?

নরেন বললে, জয়ন্তীর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া দৈবের ইচ্ছে নয়। তার বদলে তুমি যাবে, তাই।

মাথাটা ঝিমঝিম করছিল সুধার। বিহ্বলের মতো তাকিয়ে বললে, কি বলছ তুমি? কোথায় যাব?

ঠান্ডা গলায় নরেন জবাব দিলে, এলাহাবাদে, তোমার শ্বশুরবাড়ি?

আমার শ্বশুরবাড়ি?

বার দুয়েক ঘাড় নেড়ে বললে, তোমারই তো। মনে করো, কাল রাতের ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে সুধা সোম আর বেঁচে নেই। তুমিই এখন জয়ন্তী সান্যাল। এলাহাবাদের জাস্টিস অমরনাথ সান্যাল তোমার শ্বশুর। মাস ছয়েক আগে তুমি স্বামীকে হারিয়েছ। সেও এক দৈব—দুর্ঘটনা। ছোটনাগপুর জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে হাতির পিঠ থেকে পড়ে…অমন করে তাকিয়ে থেকো না সুধা, শোনো. . . তোমার সেই পরলোকগত স্বামী প্রফেসর অলোক সান্যালের শেষ স্মৃতিচিহ্ন এখনও তোমার আঙুলে জ্বলজ্বল করছে। আর এই স্মৃতিচিহ্নটুকু নিয়েই তোমায় যেতে হবে এলাহাবাদে শ্বশুরঘর করতে।

হিস্টিরিয়া রুগির মতো গলা চিরে চিৎকার করে উঠল সুধা: না, না, না!

ছুটে এল নার্স। সচকিত হল রোগীরা।

নরেনের মুখ যেন পাথরের। চোখ দুটো ফসফরাসের মতো জ্বলছে। সেইদিকে তাকিয়ে সুধার চিৎকার আপনি থেমে গেল।

নার্সকে নরেন বললে, নার্ভগুলো এখনও দুর্বল। ভয় পেয়েছিল হঠাৎ।

সুধার একখানা হাত তুলে নিয়ে নার্স পালস দেখলে একবার। তারপর বললে, একে বেশি কথা বলতে দেবেন না।

চলে গেল নার্স।

আমিও এখন উঠি। লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল নরেন। বললে, অল্পেই উতলা হয়ে ওঠা মেয়েদের একটা দোষ। সব কিছু সহজ ভাবে নিতে পারাই ভালো। একটা বিশেষ ভদ্র পরিবার—একটা জাস্টিসের ফ্যামিলিতে যাবে তুমি, তাতে ভয় পাবার কি আছে সুধা! সেখানে তুমি সুখে থাকবে, আদরে থাকবে, আরামে থাকবে।

ক্লান্তিতে চোখ বুজে বসেছিল সুধা। চোখ খুলে বললে, তাতে তোমার লাভ?

সে কথা এখনই কেন? সেটা পরে। ধরো, তুমি সুখে থাকবে, সেটাই আমার লাভ! আচ্ছা, তুমি বিশ্রাম নাও।

দু’পা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল নরেন। বললে, হ্যাঁ, একটা কথা বলে রাখি। এলাহাবাদে আমি টেলিগ্রাম করে দিয়েছি। এলগিন রোডে। জাস্টিস অমরনাথ সান্যালের বাড়ি। সম্ভবত কালই তাঁরা এসে পড়বেন তোমাকে নিয়ে যেতে। তুমি তৈরি থেকো জয়ন্তী।

লাঠির খট খট আওয়াজ তুলে চলে গেল নরেন। আর সুধার দুই কান ভরে একশোটা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মতো বাজতে লাগল নরেনের শেষ কথাটা। সে আর সুধা নয়, আজ থেকে সে জয়ন্তী।

.

এলাহাবাদ থেকে লোক এল সত্যিই। পরের দিনই।

প্রথমে দেখা হল নরেনের সঙ্গে। প্রিয়দর্শন একটি যুবা। বয়স সাতাশ—আঠাশের বেশি হবে না। পশ্চিমের লোক বলে গায়ের ফর্সা রংটা রোদে পুড়ে তামাটে। পরনে পায়জামা, পাঞ্জাবি, জহরকোট। একমাথা রুক্ষ চুল, মুখে—চোখে সরল উৎকণ্ঠা আর কৌতূহল। বললে, আমি সুজিত সান্যাল। পরলোকগত অলোক সান্যাল আমার দাদা। আপনি?

নরেন বললে, আমি জয়ন্তীর দাদা, নরেন। আমই টেলিগ্রাম করেছিলাম।

পকেট থেকে টেলিগ্রামখানা বের করে সুজিত বললে, ও, নমস্কার! আপনার তার পেয়েই আমি ছুটে এসেছি। আমাদের বাড়ির অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। বউদি কোথায়? কেমন আছেন এখন?

জয়ন্তী পাশের ঘরে।

লাঠিতে ভর দিয়ে নরেন এগোল।

সুধা তার বেডে ছিল না। বারান্দায় রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড়টার দিকে চুপ করে তাকিয়েছিল।

সুজিতকে একটু তফাতে দাঁড়াতে বলে নরেন এগিয়ে গেল সুধার কাছে। বললে, জয়ন্তী, তোমার শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এসেছেন।

জয়ন্তী ফিরে তাকাতেই নরেন বললে, উনি তোমার দেওর, সুজিত সান্যাল।

তারপর মুখ ফিরিয়ে ডাকলে, আসুন সুজিতবাবু।

মুখ ফেরাতেই যেন পাথর হয়ে গেল সুধা। দূর থেকে সুজিত দেখছিল তাকে। সুধার মনে হল, এই মুহূর্তে যদি ভূমিকম্প হয়, সে আর নরেন যদি তলিয়ে যায় পাতালে!

কিন্তু হল না কিছুই। সুজিত সোজা এগিয়ে এসে হেঁট হয়ে সুধার পা ছুঁতে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেল সুধা। অস্ফুট স্বরে কি যে বলে উঠল বোঝা গেল না।

অপ্রতিভ হয়ে মাথা তুলতেই সুজিতের চোখ দুটো আটকে গেল বুকের কাছে জড়ো করে রাখা সুধার হাতের আঙুলে। এ আংটি তার অনেক দিনের চেনা—তার দাদার শেষ স্মৃতিচিহ্ন।

নরেন বললে, কিছু মনে করবেন না। চেনা—জানা তো ছিল না, তাই সহজ হতে পারছে না জয়ন্তী।

একটু মিষ্টি হাসি দেখা দিল সুজিতের মুখে। বললে, আমার কিন্তু অনেক দিনের চেনা মনে হচ্ছে বউদিকে। সংসারে ওঁর চেয়ে আপনজন আমাদের আর কে আছে!

নরেন বললে, আপনারা ছাড়া জয়ন্তীরও আর কেউ নেই।

সুজিত বললে, একে দাদা নেই, তার ওপর ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে মা বিছানা নিয়েছেন কাল থেকে। ভাবছি আজ রাতের ট্রেনেই ওঁকে নিয়ে যাব।

তারপর সুধার মুখের পানে সোজা তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, যেতে পারবেন তো বউদি?

তাকাতে গিয়ে সুধার চোখ পড়ে গেল সুজিতের চোখে। ভারি হয়ে নেমে এল পাতা দুটো।

নরেন বললে, পারবে বইকি। হাসপাতালে পড়ে থাকার চেয়ে আপনাদের ওখানে যাওয়াই ভালো। হাজার হোক নিজের ঘর তো!

সুজিত বললে, আমি তাহলে হোটেলে ফিরে যাই। রাত্রে এসে বউদিকে নিয়ে যাব।

ছোট একটা নমস্কার করে সুজিত চলে গেল। স্তব্ধ হয়ে সুধা চেয়ে রইল সেই দিকে। আর নরেন চেয়ে রইল সুধার মুখের পানে।

.

পশ্চিমের আপ ট্রেন প্রায়ই লেট করে।

বারো মিনিট পরে গাড়ি এল। রাত্রিকাল হলেও ফার্স্ট ক্লাস কামরা খালিই পাওয়া গেল। সুধাকে তুলে দিয়ে নরেন বললে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আমাকে যেন ভুলে যেও না জয়ন্তী। দরকার হলে কলকাতার ঠিকানায় চিঠি দিও।

সুজিত আত্মীয়তার সুরে বললে, আপনিও আমাদের সঙ্গে গেলে ভালো হত নরেনবাবু। মাও যেতে বলেছেন।

নরেন বললে, আপনার মায়ের কথা রাখতে পারলে খুশিই হতাম। কিন্তু কলকাতায় আমার কাজ পড়ে আছে। জয়ন্তীকে আপনার হাতে তুলে দিলাম, এবার আমার ছুটি।

সুজিত বললে, এমন অদ্ভুত জায়গায়, এমন অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে বউদিকে যে পাব, এ আমরা ভাবতেই পারিনি।

ফার্স্ট ক্লাস কামরায় জানলার ধারে স্থির হয়ে বসেছিল সুধা। সেই দিকে ক’বার তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় নরেন বললে, সংসারে বড়—গোছের পাওয়া হিসেবের বাইরেই ঘটে থাকে সুজিতবাবু। জয়ন্তীই কি আগে ভেবেছিল, আপনাদের কোনোদিন পাবে?

উত্তরে সুজিত কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ঢং ঢং করে বাজল ঘণ্টা। স্টপেজ এখানে অল্পক্ষণই।

নরেন বললে, নিন, উঠে পড়ুন সুজিতবাবু। আপনার মাকে আমার নমস্কার জানাবেন, তাঁর নিমন্ত্রণ আমার মনে থাকবে।

ছোট একটি নমস্কার করে সুজিত উঠে পড়ল গাড়িতে। বাজল গার্ডের হুইশল! দুলে উঠল সবুজ আলো। প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এলাহাবাদগামী ট্রেন মিলিয়ে গেল দূরের অন্ধকারে। শুধু জ্বলজ্বল করতে লাগল ট্রেনের পেছনের লাল আলোটা।

লাঠিতে ভর দিয়ে নরেন দাঁড়িয়ে রইল সেই দিকে তাকিয়ে। তৃতীয়বার তার মুখে ফুটে উঠল সেই বিচিত্র যান্ত্রিক হাসি।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে চলন্ত ট্রেনের জানলার ধারে চুপ করে বসে বসে জয়ন্তীর মতোই সুধা ভাবছিল, জীবনে যারা সবচেয়ে পর, তারাই আজ সবচেয়ে আপনার হতে চলেছে। এও একটা অদ্ভুত নাটক নয় কি? কে জানে, এ নাটকের পরিণতি কোথায়?

তবু এই ভালো। নরেনের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া।