কে তুমি – ১

এক

শেষ ইঞ্জেকশনটা দিয়ে ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর তাঁর থাকার প্রয়োজন নেই। নেহাত দিতে হয় বলেই ইঞ্জেকশনটা দেওয়া।

হয়তো ইঞ্জেকশনের জোরেই আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালেন যতিশঙ্কর। শ্বাস টানবার চেষ্টা করে ডাকলেন, নরেন!

নরেন দাঁড়িয়েছিল মাথার শিয়রে, উঠে এল যতিশঙ্করের সামনে। বলিষ্ঠ একহারা চেহারা, আন্দাজ করা যায় বয়েস তিরিশ পার হয়ে গেছে। বাঁ—দিকের ভুরুর কাছে একটা কাটা দাগ ছাড়া মুখের চেহারায় দ্রষ্টব্য আর কিছুই নেই। তবে বোঝা যায়, নরেন শক্ত প্রকৃতির ছেলে। নইলে মৃত্যুপথযাত্রীর সামনে বসে তার মুখের একটিও পেশী কাঁপল না কেন?

যতিশঙ্কর আবার ডাকলেন, নরেন!

নরেন শুধু বললে, বলুন!

শ্বাস টেনে টেনে যতিশঙ্কর বলতে লাগলেন, আমার জন্যে তুমি অনেক করেছ নরেন। তুমি না থাকলে—শেষ দিনগুলো আমার—তোমার কাছে অনেক দেনা রয়ে গেল—

একটু থেমে যতিশঙ্কর দম নিলেন: ভেবেছিলাম হিসেব—নিকেশ করে যাব—

শান্ত গলায় নরেন বললে, করলে দেনাটাই থেকে যাবে।

যতিশঙ্কর কেমন অস্থির হয়ে উঠলেন: না, না, দেনা রেখে আমি যাব না। শান্তি পাব না তাহলে। যতিশঙ্কর সোম কারও দেনা রাখে না।

তেমনি নিরুত্তাপ গলায় নরেন বলে উঠল, বেশ, আপনার ড্রয়ারের মধ্যে লুকোনো সেই চিঠির তাড়াটা আমাকে দিয়ে যান। দেনাটা তাতেই শোধ হয়ে যাবে।

মৃত্যুপথযাত্রীর ঘোলাটে দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল এক মুহূর্তের জন্যে। যতিশঙ্কর বললেন, তুমি কেমন করে জানলে?

নেশার খেয়ালে আপনিই বলেছিলেন একদিন। আপনার যৌবনের ভুলের কাহিনি।

টেনে টেনে যতিশঙ্কর বললেন, ভুল নয়, পাপ। কিন্তু সুনন্দার চিঠি—তুমি কেন চাও?

গলা এতটুকু কাঁপল না নরেনের: আমার মায়ের কলঙ্ক আমারই কাছে গচ্ছিত রাখব বলে।

ঘোলাটে চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এল। হাপরের মতো ওঠা—নামা করতে লাগল মৃত্যুপথযাত্রীর বুকখানা। যতিশঙ্কর বিকৃত আওয়াজে চেঁচিয়ে উঠলেন, তুমি—সুনন্দার ছেলে!

হ্যাঁ।

দেখতে দেখতে বুজে এল উদভ্রান্ত ঘোলাটে দৃষ্টি। শান্ত হয়ে এল তোলপাড় করা বুক। ক্ষীণ গলায় যতিশঙ্কর বললেন, বালিশের তলায় ড্রয়ারের চাবি।

নিঃশব্দে হাত চালিয়ে চাবিটা বের করে নিলে নরেন। তারপর ড্রয়ারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

নিভে—আসা দৃষ্টি মেলে কি যেন খুঁজতে লাগলেন যতিশঙ্কর। পায়ের ওপর ঢেউ খেলানো একরাশ কালো এলো চুল ছাড়া আসন্ন সন্ধ্যার ছায়া—ছায়া আলোয় আর কিছুই নজরে পড়ে না।

যতিশঙ্কর ডাকলেন, সুধা!

ঢেউ—খেলানো এলো চুলের স্তূপ নড়ে উঠল।

কাছে আয় সুধা, তোকে—

যতিশঙ্করের কথা জড়িয়ে গেল।

এবার কালো চুলের অন্ধকার পটভূমিকায় সন্ধ্যার প্রথম তারার মতো সকরুণ একটি অশ্রুভেজা মুখ দেখা গেল। সুধা।

লুটানো আঁচলটা কাঁধে তুলে দিয়ে সুধা এসে বসল বাপের ওপাশে।

যতিশঙ্করের দৃষ্টিতে তখন বিকারের ঘোর দেখা দিয়েছে। সভয়ে বলে উঠলেন, কে? কে এল?

বাপের মুখের ওপর ঝুঁকে সুধা বলল, আমি বাবা, আমি সুধা।

যতিশঙ্কর যেন অনেকটা শান্ত হলেন। কিন্তু বাইরে কাল—বৈশাখীর আকাশ অশান্ত হয়ে উঠল। হু হু করে এল বাতাস। কাঁপতে লাগল জানলার পর্দা। উড়ে গেল যতিশঙ্করের জ্বরের চার্ট।

সুধা ব্যাকুল হয়ে ডাকলে, বাবা!

ড্রয়ারের পাশ থেকে এগিয়ে এল নরেন।

দুর্বল হাতখানা তুলে যতিশঙ্কর সুধার মুখখানা অনুভব করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, আমার সবচেয়ে দামি জিনিস সুধা—তোমায় দিয়ে গেলাম নরেন। সুধাকে দেখো—

যতিশঙ্করের চোখে ফের বিকার দেখা দিল। জড়ানো বিকৃত আওয়াজে চিৎকার করে উঠলেন, দেনা শোধ! তারপরই মুখখানা হেলে পড়ল একপাশে।

সুধা চমকে তাকাল নরেনের দিকে।

নরেনের মুখের একটি পেশীও কাঁপল না। বহুদিনের অভ্যস্ত পাকা নার্সের মতো যতিশঙ্করের একখানা হাত তুলে নিয়ে আবার আস্তে আস্তে রেখে দিলে।

তীর—বেঁধা পাখির মতো লুটিয়ে পড়ল সুধা যতিশঙ্করের বুকের ওপর। হু হু করে হাওয়া এল জানলা দিয়ে। আর সেই হাওয়ায় সুধার একরাশ ঢেউ খেলানো কালো চুল ঢেকে দিল যতিশঙ্করের মুখ।

নরেন উঠে দাঁড়াল। তাকিয়ে দেখল, সুধা কাঁদছে। ওকে এখন কাঁদতে দেওয়াই ভালো। নরেন বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

মরাটাই মানুষের শেষ নয়। মরার পরেও অনেক কাজ নাকি থাকে।

.

সময় আর স্রোত। দুই—ই সমান। সমধর্মী। আজকের দাগ কাল মুছে দিয়ে যায়।

যতিশঙ্করের মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পরে সুধাও তাই আজ চুল বেঁধেছে, পাটভাঙা শাড়ি পরেছে, বসেছে একখানা বই নিয়ে জানলার পাশে। খেয়াল করেনি কখন নরেন ঘরে এল।

ঘরে পা দিয়ে নরেন এক মুহূর্ত দাঁড়াল। তাকিয়ে দেখল তেইশ বছরের মেয়ে সুধার দিকে। দেখল ফিকে হলদে বিকেলের আলো সোনার গুঁড়োর মতো ঝরে ঝরে পড়ছে সুধার বাঁ—দিকের গালে, চিবুকে আর শাঁখের মতো শাদা গলার নিচে। কিন্তু ওই এক মুহূর্তই। রাস্তার লোকে যেমন করে পোস্টার দেখে, তেমনি করেই তাকাল নরেন। তারপর সোজা এসে দাঁড়াল সুধার কাছে।

ভালো আছো আজ?

আছি।

একা একা অসুবিধে হচ্ছে না তো?

এমন কিছু না।

দিন কতক বাইরে ঘুরে এলে হয়। শরীর মন দুই—ই ভালো হবে তোমার। যাবে?

সুধা বইটাকে মুড়ে রাখলে। বললে, না। ভাবছি কলেজ ছেড়ে দিয়ে একটা চাকরি—বাকরির চেষ্টা করব।

হঠাৎ এ ভাবনা কেন?

বাবা নেই, খাওয়া—পরা চালাতে হবে তো!

পকেট থেকে নরেন সিগারেট বার করলে। মুখে দেওয়ার আগে বললে, সে ভাবনা তোমার নয়, আমার।

এক মুহূর্ত নরেনের দিকে তাকিয়ে সুধা উঠে দাঁড়াল। বললে, আমার ভাবনা আমারই। তোমার আর কিছু বলার আছে? আমি একটু বেরোব। একটা টিউশানি ধরেছি।

এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে নরেন বললে, আমায় তুমি পছন্দ করো না তা জানি। কিন্তু তোমার ইচ্ছেয় কিছুই আর হবে না।

সুধা চলে যাচ্ছিল, ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, কার ইচ্ছেয় হবে?

নিস্পৃহ কণ্ঠে নরেন বললে, আমার। কারণ যতিশঙ্কর সোমের মৃত্যুর পরদিন থেকেই তুমি আমার সম্পত্তি। অনেক টাকা দিয়ে তোমার বাবার কাছ থেকে তোমাকে আমি কিনেছি সুধা।

সুধার দু—চোখ দপ করে জ্বলে উঠল। সেই জ্বলন্ত চোখ তুলে তাকিয়ে বললে, তোমার এ—কথার মানে?

তেমনি ঠান্ডা গলায় নরেন বললে, উত্তেজিত হয়ো না। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। বোসো।

সুধা বসলে না। বললে, যা বলবার বলতে পার। আমার সময় কম।

সময় খানিকটা দিতেই হবে সুধা। টিউশানিটা আজ থাক।

ঘরের মাঝখানে নরেন পায়চারি শুরু করল। তারপর এক সময় শান্ত নিরুত্তাপ গলায় বলতে শুরু করল, তোমার বাবার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয় রেসের মাঠে। তাঁর এক বন্ধুকে পাঁচ হাজার টাকার একটা মিথ্যে চেক দিয়ে, সেই টাকা নিয়ে তিনি শেষবারের মতো ভাগ্য পরীক্ষা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য তাঁকে দয়া করেনি। সে টাকা শোধ দিয়েছিলুম আমি। আর সেই থেকে আজ তিন বছর তোমার বাবাকে আমি নিয়মিত টাকা জুগিয়ে এসেছি। রেস খেলার জন্যে, মদ খাবার জন্যে, কখনও বা সংসার চালাবার জন্যে। একথা তুমিও জানো।

পায়চারি করতে করতে হঠাৎ সুধার সামনে এসে নরেন থেমে গেল। অত টাকা কোনোদিনই ফেরত পাব না, এ আমি জানতাম। তবু কেন দিয়েছিলাম, আন্দাজ করতে পার?

একটা বিশ্রী স্বাদে সুধার মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে গিয়েছিল। তিক্ত গলাতেই বললে, পারি। টাকা দিয়েছিলে আমার লোভে। আমাকে বিয়ে করবে বলে।

নরেন এবার হাসল। আওয়াজ হল কি হল না। গত তিন বছরের মধ্যে সুধা এই প্রথম নরেনকে হাসতে দেখলে। কিন্তু হাসি যে এমন যান্ত্রিক হয়, সুধা তা জানত না।

হাসিটা নরেনের মুখে ফুটে উঠতে না উঠতে মিলিয়ে গেল। স্থির হয়ে গেল মুখের পেশীগুলো। তেমনি নিরুত্তাপ গলায় নরেন বললে, খুবই স্বাভাবিক কথা বলেছে সুধা। হিসেবে একটু কিন্তু ভুল হয়ে গেছে তোমার। দেখতে তুমি ভালোই। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার ওপর আমার একটুও লোভ নেই, বিয়ে তো দূরের কথা। তুমি আমাকে যতটা অপছন্দ করো, তোমাদের আমি তার চেয়ে কম করি না।

কয়েক মুহূর্ত পুতুলের মতো চোখ মেলে তাকিয়ে রইল সুধা। তারপর তার মুখ দিয়ে বেরোল, তবে কি জন্যে টাকা দিয়েছিলে বাবাকে?

নরেন আবার পায়চারি শুরু করলে। বললে, তোমাকে আমার দরকার, তাই! তোমাকে আমি আমার কাজে লাগাব।

একটা ভয়ঙ্কর সন্দেহে সুধার মাথাটা ঘুরে উঠল। টেবিলের কোণটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে প্রশ্ন করলে, কি কাজ?

সিগারেটটা অনেকক্ষণ নিভে গিয়েছিল। জানলা গলিয়ে ফেলে দিয়ে নরেন প্রশ্ন করল, এত টাকা আমি কোত্থেকে পাই জানো?

সুধা বললে, ঠিক জানি না। তবে বুঝতে পারি, তোমার টাকা আসে চোরা পথে।

ঠিকই ধরেছ! তুমি বুদ্ধিমতী সুধা।—নরেন আর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলতে লাগল, আমার টাকা আসে বাঁকাচোরা পথে। আজকের দুনিয়ায় এত টাকা সোজা রাস্তায় আসে না। টাকা আমার নেশা। দু—হাতে কুড়িয়ে নিই, চার হাতে উড়িয়ে দিই। তোমাকে আমার এই কাজে লাগাব সুধা। তাই তোমাকে দরকার। আর তোমারও দরকার টাকার।

ঘাড় ফিরিয়ে নরেন একবার দেখে নিল সুধাকে। সুধার শরীরটা তেমনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের একটা প্রান্ত কামড়ে আছে দাঁত দিয়ে। সেটা তিক্ত ঘৃণায়, না অবরুদ্ধ রাগে, বোঝা মুশকিল।

একটু যেন দুঃখিত ভাবেই নরেন বলতে লাগল, ইদানীং টাকার আমদানীতে বড় টান পড়েছে। পুলিশও পেছনে লেগেছে ফেউয়ের মতন। কলকাতা থেকে কারবার গুটোতে হবে। ভাবছি বাইরে কোথাও চলে যাব। পাটনা, এলাহাবাদ, দিল্লি—যেখানে কারবারের সুবিধে। আর যেতেই যখন হবে, তখন দেরি করে লাভ কি? কালকের ট্রেনেই আমরা বেরিয়ে পড়ব।

এতক্ষণে সুধার মুখ দিয়ে কথা বেরোল: আমরা মানে?

নরেন বললে, তুমি আর আমি। জিনিসপত্র আজই গুছিয়ে নিও।

আমাকেও যেতে হবে?

হবে বইকি। তুমি আমার কারবারের নতুন মূলধন। তোমাকে ছেড়ে যাবার কোনো মানে হয় না।

সুধার মনে হল কপালের রগ দুটো এখুনি ফেটে পড়বে বুঝি। সোজা পা ফেলে সে এগিয়ে এল নরেনের সামনে। ঘন নিশ্বাসে তার বুক ঢেউয়ের মতো উঠছে নামছে। স্পষ্ট গলায় বললে, তোমার সঙ্গে যদি না যাই?

যেতে তোমাকে হবেই সুধা। যেতে তুমি বাধ্য।

অবরুদ্ধ রাগ আর ঘৃণা উথলে উঠল সুধার দুই চোখ দিয়ে। ঘরের বাতাস যেন খান খান হয়ে গেল তার তীক্ষ্ন গলার চিৎকারে, চুপ করো স্কাউন্ড্রেল! যাব না—কিছুতেই যাব না আমি। কি করতে পার তুমি?

সেকেন্ড দুই—তিন নরেন চেয়ে রইল সুধার মুখের দিকে, তারপর দ্বিতীয়বার হাসল। তেমনি অদ্ভুত যান্ত্রিক হাসি। হেসে বললে, তাহলে সংক্ষেপেই বলি শোনো—না গেলে প্রমাণ করে দেব যে যতিশঙ্কর সোমের ঔরসে বিধবা সুনন্দা দাশের গর্ভে তোমার জন্ম।

মাথাটা টলে গেল সুধার। গলা থেকে বুক অবধি হঠাৎ যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। তবু প্রাণপণ শক্তিতে সে বলে উঠল, মিথ্যে কথা!

মিথ্যে বইকি। মিথ্যে তো বটেই। নরেন বলতে লাগল, কিন্তু দুনিয়ায় মিথ্যেও ভয়ঙ্কর সত্যি হয়ে উঠতে পারে, দৈব যখন সহায় হয়।

পকেট থেকে একতাড়া চিঠি টেনে বার করলে নরেন। বললে, এগুলোর মধ্যে কি আছে জানো? যতিশঙ্কর আর বিধবা সুনন্দার অবৈধ প্রণয়—কাহিনি। যার ফলে বাইশ বছর আগে সুনন্দার একটি মেয়ে হয়। মেয়েটি সুনন্দার দুঃখ—বিষ মন্থন করে এসেছিল বলে তার নাম রাখা হয় সুধা। সে—মেয়ে অবশ্য ছ’মাসের বেশি বাঁচেনি। কিন্তু আজ সমাজের কাছে সেই সুধাকে এই সুধা বলে চালিয়ে দেওয়াটা জলের মতোই সহজ। নয় কি?

চিঠির তাড়াটা অতি যত্ন করে নরেন আবার পকেটে ভরলে। তারপর বললে, তাই বলছি, আমার কথায় রাজি না হয়ে তোমার উপায় নেই সুধা। আচ্ছা, চলি। কাল সন্ধেবেলায় ট্রেন।

নরেন দরজার দিকে এগোল। আর সুধার মনে হল ঘরের মেঝেটা দুলছে।

নরেন চৌকাঠে পৌঁছেছে, হঠাৎ পেছন থেকে ডাক এল, শোনো!

ঘুরে দাঁড়াল নরেন। এক—পা এক—পা করে এগিয়ে এল সুধা। কি যেন বলতে গিয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল ঠোঁট দুটো, কোনো আওয়াজ বেরোল না।

নরেন বললে, ডাকলে কেন বলো? কিছু টাকা চাই?

হঠাৎ এক আশ্চর্য কাণ্ড করে বসল সুধা। তরঙ্গায়িত বুকের ওপর থেকে শাড়ির আঁচলখানা সরিয়ে দিয়ে এক বিচিত্র হাসি হেসে সে বলতে লাগল, আমার দিকে ভালো করে চাও নরেনদা, সত্যিই কি আমার ওপর কোনো লাভ নেই তোমার? ক’টা মেয়ে দেখেছ তুমি আমার মতো? আমি বলি কি, আমার এই দেহটাকে তুমি ভোগ করো, যতদিন খুশি, যেমন খুশি ভোগ করে নাও। বাবার দেনা তাতেই শোধ হবে। কিন্তু ভদ্রঘরের মেয়ে আমি, তোমার পাপের পথে সঙ্গিনী হতে আমাকে বলো না। আমায় শুধু এইটুকু দয়া করো নরেনদা—এইটুকু দয়া করো—

ঝড়ে ছিঁড়ে—পড়া এক গোছা ফুলের মতো সুধা উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ল নরেনের পায়ের ওপর।

নরেনের মুখের একটি পেশীও কাঁপল না। পা সরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় শুধু বললে, ছেলেমানুষী করো না সুধা! এখন যেটা শক্ত মনে হচ্ছে, দুদিন বাদে সেটা সহজ হয়ে আসবে। আর এমন কিছু ভয়ানক কাজ তোমাকে করতে হবে না, একটু চুরি, একটু জালিয়াতি, একটু ধাপ্পাবাজি—শুধু এই। তুমি আই—এ পড়া বুদ্ধিমতী মেয়ে, সহজেই পারবে।

চলে যেতে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল নরেন। বললে, হ্যাঁ, আর একটা কথা। তুমি অবশ্য সে চেষ্টা করবে না জানি, তবু বলছি, কোথাও পালাবার চেষ্টা করাটা মিছে। কারণ এই মুহূর্ত থেকে তুমি তোমার চাকর মণিলালের নজরবন্দি—যতক্ষণ না কাল সন্ধেবেলা বম্বে মেল ছাড়ে।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নরেন। আর ঘরের মেঝের ওপর পাথর হয়ে বসে রইল সুধা। ঘন সন্ধ্যার অন্ধকারে তার মাথার মধ্যে বিকট ঝঞ্ঝনা তুলে বাজতে লাগল বম্বে মেলের চাকার শব্দ।

রাতের কালো ভেলভেটের পর্দা ফুঁড়ে একটা তীক্ষ্ন আলোর বর্শা কে যেন ছুড়ে দিয়েছে। ছুটে চলেছে বম্বে মেল সার্চ লাইট জ্বালিয়ে।

একটা ফার্স্ট ক্লাস কামরায় তিনজন যাত্রী। একটা বার্থে আড় হয়ে শুয়ে নরেন। চোখের পাতা বন্ধ। হয়তো তন্দ্রা এসেছে ট্রেনের দোলায়। মাঝের বার্থে সুধা। কোলের ওপর একখানা বই খুলে বসে আছে। পড়ছে, না আকাশ—পাতাল ভাবছে, ভালো করে লক্ষ না করলে বোঝা যায় না। হয়তো কিছুই ভাবছে না। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে, দয়াহীন নিয়তিকে মেনে নিয়ে শেষ পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছে জীবনের অন্ধকার পথে। নরেন যে নিয়তির মতোই অনিবার্য, একথা সুধার চেয়ে বেশি কে জানে? ওপাশের বার্থে তৃতীয় যাত্রী। একটি মহিলা। সুধার চেয়ে বছর দুই—তিনের বড়ই মনে হয়। সুগঠিত দেহ, মাজা—মাজা রং। মুখশ্রীতে আভিজাত্যের ছাপ। রূপালি জরির পাড় বসানো সাদা মলমলের শাড়ি পরনে। জানলার ধারে পা মুড়ে বসে ভদ্রমহিলা চুপ করে অন্ধকারের দিকে চেয়েছিলেন। বার্থের অপর প্রান্তে মাঝারি একটি সুটকেশ। ডালাটার ওপর সাদা হরফে লেখা ‘জয়ন্তী সান্যাল’।

হঠাৎ একটা অস্ফুট কাতরোক্তি শুনে সুধা ফিরে তাকাল। জয়ন্তী সান্যাল তখন হাতের ছোট রুমাল দিয়ে একটা চোখ চেপে ধরেছেন।

কি হল? কয়লার গুঁড়ো পড়ল বুঝি?

ভদ্রমহিলা শুধু ঘাড় নেড়ে জানালেন, হ্যাঁ।

চোখটা রগড়াবেন না। বই রেখে সুধা বার্থ থেকে নেমে এল। স্ট্যান্ডে কাচের গ্লাস চাপা দেওয়া সোরাই ছিল। এক গ্লাস জল গড়িয়ে সুধা বললে, নিন—চোখে জলের ঝাপটা দিন।

বার দুই—তিন জলের ঝাপটা দেওয়ার পর সুধা জিজ্ঞেস করলে, গেছে?

অপ্রস্তুতের হাসি হেসে জয়ন্তী বললেন, গেছে।

জানলার শার্সিটা নামিয়ে দিন। বলে সুধা নিজের জায়গায় ফিরে গেল।

জয়ন্তী সান্যাল আলাপ শুরু করলেন, ট্রেনে বুঝি আপনার ঘুম আসে না?

মৃদু হেসে সুধা বললে, না।

আমারও। একজন সঙ্গী না থাকলে ট্রেন জার্নিটা যেন শাস্তি। ভাগ্যিস আপনার সঙ্গে আলাপ হল!

একটু চুপচাপ। সুধা বইখানা খুললে।

জয়ন্তীই আবার কথা পাড়লেন, কি বই পড়ছেন?

একটানা নাটক।

জয়ন্তী বললেন, নাটক পড়তে আমিও ভালোবাসি। দেখে কিন্তু ততটা মন ভরে না।

সুধা বললে, সময় কাটানোর জন্যেই পড়ি। নইলে নাটক আমি তেমন পছন্দ করি না। বেশির ভাগই কল্পনার রং ফলানো অবাস্তব মনে হয়।

জয়ন্তী হাসলেন। বললেন, জীবনটাই বা নাটকের চেয়ে কম কিসে? অনেক সময় অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যা আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ভাবা যায় না। তবু তো ঘটে! আমার জীবনেও ঘটেছে, আপনার জীবনেও ঘটতে পারে। হয়তো এমন বিচিত্র ঘটনা ঘটবে, যা আপনার কল্পনারও বাইরে। এই যে আমাদের ট্রেনের আলাপ, এও খানিকটা নাটকীয় নয় কি? কিন্তু আলাপটাই শুধু হল, নামটা জানা হয়নি।

সুধা সোম।

ভারি মিষ্টি নাম।

আপনারটাই বা কম কিসে?—হাসি মুখে সুধা সুটকেশের ওপরের লেখাটা দেখিয়ে দিল।

জয়ন্তী কি একটা বলতে গেলেন, পাতাল থেকে উঠে আসা গুমগুম আওয়াজে বোঝা গেল না।

অন্ধকারে একটা ব্রিজ পার হয়ে গেল বম্বে মেল।

চুপ করে বসে থাকবার মেয়ে নয় জয়ন্তী। গল্প ছাড়া ট্রেন জার্নি করা তাঁর পোষায় না। নাম জানা হল, এবার গন্তব্য।

কোথায় যাবেন আপনারা?

সুধা বললে, বম্বে।

বেড়াতে, না কাজে?

একটু চুপ করে থেকে সুধা জবাব দিল, বেড়াতে।

জয়ন্তী বললেন, আমি যাচ্ছি এলাহাবাদে। শ্বশুরবাড়ি। এই প্রথম যাওয়া।

একটু অবাক হয়ে সুধা বললে, একা যে?

একটু করুণ হাসির আভাস দেখা দিল জয়ন্তীর মুখে। বললেন, আমার সঙ্গে যাঁর যাবার কথা, তিনি সম্প্রতি চলে গেছেন এমন জায়গায়, যেখান থেকে আর ফেরা যায় না।

সুধা চুপ করে তাকিয়ে রইল জয়ন্তীর সাদা সিঁথির দিকে। জয়ন্তী বললেন, শিকারের বাতিক ছিল আমার স্বামীর। ছোটনাগপুরের জঙ্গলে হাতির পিঠ থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। আর তাঁর জ্ঞান ফিরে আসেনি।

সুধা প্রশ্ন করলে, কতদিন বিয়ে হয়েছিল আপনাদের?

জয়ন্তী বললেন, চার বছর। নাটকের মতো সেও এক অদ্ভুত ঘটনা। প্রফেসর অলোক সান্যাল তখন কলকাতার নাম—করা ইংরেজির অধ্যাপক, আমার বিয়ের সভায় তিনি এসেছিলেন কাকার বন্ধু হিসেবে নিমন্ত্রিত হয়ে। বরের মুখে মদের গন্ধ পেয়ে তিনি একরকম অপমান করেই তাঁদের তাড়িয়ে দেন। তারপর কাকাকে ডেকে বলেন, আমি বিয়ে করতে পারি জয়ন্তীকে—যদি তোমাদের আপত্তি না থাকে। কাকা বললেন, কিন্তু তোমরা ব্রাহ্মণ আর আমরা বদ্যি। তিনি বললেন, তা হোক। সেই রাতেই বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু পাওয়া গেল না আমার শাশুড়ির আশীর্বাদ। আমার শ্বশুরবাড়ি গোঁড়া হিন্দু। এলাহাবাদ থেকে চিঠি এল, সে বাড়িতে বদ্যির মেয়ের প্রবেশ নিষেধ। আমার স্বামীও আর কোনোদিন যাননি। কিন্তু হাওয়া ঘুরে গেল আমার স্বামীর মৃত্যুর পর। সপ্তাহখানেক আগে শাশুড়ি আমাকে লিখে পাঠিয়েছেন, আমার ছেলের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন তুমিই। সান্যাল বাড়ির একমাত্র বউ। তুমি চলে এসো। তাই যাচ্ছি।

সুধা বললে, এলাহাবাদে আর কখনও যাননি?

জয়ন্তী বললেন, যাবার সুযোগ পেলুম কই? সীতার মতো চোদ্দ বছর না হোক, চারটে বছর স্বামীর সঙ্গে তো বনবাসেই কাটল।

মাপ করবেন, এলাহাবাদ আমার জানা শহর। আপনাকে সাহায্য করতে পারি কী?

নরেন কখন তার বার্থে উঠে বসেছে, কেউই এতক্ষণ তা খেয়াল করেনি।

স্মিত মুখে জয়ন্তী বললেন, ধন্যবাদ। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার দরকার হবে না। এলগিন রোড শুনেছি এলাহাবাদের নামকরা রাস্তা। সেখানে জাস্টিস অমরনাথ সান্যালের বাড়ি খুঁজে নিতে অসুবিধে হবে না।

সুধা বললে, আপনাকে তাঁরা চিনতে পারবেন তো? কখনও তো দেখা হয়নি?

জয়ন্তী বললেন, চিনতে না পারলে এই চিহ্নটুকু দেখাব।

সুধার সামনে বাঁ—হাতখানি বাড়িয়ে দিলেন জয়ন্তী। অনামিকায় একটা বড় পাথর বসানো আংটি জ্বলজ্বল করছে। ফিরোজা—রঙের বড় পাথরটির মাঝখানে খোদাই—করা একটি ইংরেজি ‘A’ অক্ষর।

জয়ন্তী বললেন, এটি আমার স্বামীকে তাঁর মায়ের—দেওয়া উপহার। এই অভিজ্ঞান—অঙ্গুরী নিয়ে শকুন্তলার মতো যাত্রা করেছি শ্বশুরবাড়ি। আর আছে আমাদের বিয়ের একখানা ফোটো, এই সুটকেশটার মধ্যে।—কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন! জীবনে আজ সবচেয়ে আপনার যাঁরা, তাঁরাই আমার সবচেয়ে অচেনা। এও একটা অদ্ভুত নাটক নয় কি? কে জানে, এই নাটকের পরিণতি কোথায়? কে বলতে পারে কোন নাটকে কার কি অংশ—

হঠাৎ জয়ন্তীর মুখের কথা হারিয়ে গেল।

কোথায় যেন গর্জে উঠল হাজারটা বাজ। আর তারই প্রচণ্ড শব্দের আঘাতে ছিন্ন—ভিন্ন হয়ে গেল এই অন্ধকার রাত্রির হৃৎপিণ্ড।

পৃথিবীর ঝুঁটি ধরে কে যেন সজোরে নাড়া দিচ্ছে।

চিৎকার করে উঠল সুধা।

নরেন তাকে দু—হাতে আঁকড়ে ধরতেই মনে হল, গাড়ির কামরাটা নাগরদোলার মতো উলটে গিয়ে কোন অন্ধ পাতালে তলিয়ে যাচ্ছে।

.

কলিশনটা হল ধানবাদ আর গয়ার মাঝামাঝি। একটা মালগাড়ির সঙ্গে বম্বে মেলের ধাক্কা। তারই ফলে গোটাকয়েক বগি উলটে পড়েছে লাইনের পাশে নিচু ঢালু জমিটাতে।

নরেনের যখন চৈতন্য হল, তখন আহতদের গোঙানি, কখনও বা চিৎকার আর থেকে থেকে ছিটকে—পড়া আত্মীয়—স্বজনের নাম ধরে শোকার্ত যাত্রীদের দীর্ঘ ডাক স্তব্ধ রাত্রির বুকটাকে যেন নখ দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলছে। এক হাত দিয়ে নরেন মুখের ওপর থেকে নরম নরম পেঁজা তুলোর মতো কি যেন সরিয়ে ফেললে। পেঁজা—তুলো নয়, ঢেউ—খেলানো একরাশ এলো চুল। নরেনের আর এক হাতের বন্ধনে নরম পিণ্ডাকার বস্তু।

সুধা!

একহাতে ভর দিয়ে উঠে বসল নরেন। কোলের কাছে সুধার অচৈতন্য দেহ। বেঁচে আছে কিনা কে জানে! আন্দাজে ঠাহর করে নরেন নিজের হাত সুধার নাকের কাছে ধরলে। নিশ্বাস এখনও পড়ছে।

দু’হাত দিয়ে ভাঙা কাঠের টুকরো সরিয়ে নরেন টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। তারপর কুড়িয়ে নিলে সুধার অজ্ঞান দেহটা। ঢালু জমিটা যেখানে সমতল হয়ে এসেছে, সেইখানে এসে দাঁড়াল নরেন। শুইয়ে দিল সুধাকে। জল চাই, জল। সুধাকে বাঁচাতেই হবে। সুধা মরলে তার চলবে না। অন্ধকারে পাথরের টুকরো আর আগাছার ঝোপে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে চলল নরেন।

কিন্তু জল কোথায়? জল নেই। আশেপাশে আছে শুধু জলের জন্যে শুকনো কাতর অন্তিম প্রার্থনা। তবু দেখা যাক না খুঁজে। এই ধ্বংস—স্তূপের মাঝে হঠাৎ যদি মিলে যায় জলের একটা ফ্লাস্ক, কিংবা ভাঙা সোরাইয়ের টুকরোয় জলের তলানি।

ট্রাউজারের পকেটে তাড়াতাড়ি হাত ঢুকিয়ে নরেন বের করলে একটা টর্চ। এক সেকেন্ড পরেই ছুড়ে ফেলে দিল সেটাকে। টর্চটাও গেছে চুরমার হয়ে।

তবে আর কি হবে এই শ্মশানে দাঁড়িয়ে থেকে? ফিরল নরেন। ফিরতে গিয়ে কিসে যেন পা বেধে একটা বড় রকমের হোঁচট খাচ্ছিল, সামলে নিলে কোনোরকমে। জিনিসটা আর কিছুই নয়, রূপালি পাড়—বসানো সাদা মলমলের শাড়ির খানিকটা।

নরেনের সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। এ শাড়ি সে চেনে। জয়ন্তী সান্যালের শাড়ি। কিন্তু জয়ন্তী কই?

হঠাৎ হেঁট হয়ে, দু’হাত দিয়ে পাগলের মতো ভাঙা জিনিসপত্র সরাতে লাগল নরেন। আছে—জয়ন্তী সান্যাল আছে। একটা ভারি কেবিন—ট্রাঙ্কের তলায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে জয়ন্তী। ট্রাঙ্কের তলা থেকে বেরিয়ে আছে বাঁ—হাতখানা।

কেবিন—ট্রাঙ্কটাকে কোনোমতে সরিয়ে ফেলল নরেন। জয়ন্তীর নাকে হাত দিয়ে বুকে হাত দিয়ে দেখল বারকয়েক। জয়ন্তীর ঘুম এ জীবনে আর ভাঙবে না।

নাই ভাঙুক, জয়ন্তী সান্যালের প্রাণ তার কোনো কাজে লাগবে না। যা কাজে লাগবে, তা সে পেয়েছে।

হাঁটু গেড়ে বসে জয়ন্তীর বাঁ—হাতের অনামিকা থেকে ফিরোজা রঙের পাথর বসানো আংটিটা ধীরে ধীরে খুলে নিল নরেন। তারপর টাউজারের পকেটে ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে টর্চের তীব্র আলো ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ল তার মুখের ওপর।

সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ এল: কে ওখানে? দাঁড়াও।

নরেনের মুখের একটি পেশীও কাঁপল না। সাবধানে পা ফেলে সে এগিয়ে গেল আলোর দিকে। রেস্কিউ পার্টির লোক এসে গেছে তাহলে!

রেলওয়ে পুলিশ আর স্ট্রেচার বাহিনী সঙ্গে নিয়ে রেস্কিউ পার্টির লোক তখন আহতদের উদ্ধার শুরু করেছে। মরা লাশ টেনে বের করে বোঝাই করছে একটা গাড়িতে। নরেন কাছে এসে দাঁড়াতেই রেস্কিউ—অফিসার প্রশ্ন করলেন, প্যাসেঞ্জার?

নরেন ঘাড় নাড়ল।

ইস! কপালে আপনার বেশ চোট লেগেছে দেখছি, আসুন।

নরেন বললে, তার আগে আপনি আসুন, আমার এক আত্মীয় অজ্ঞান হয়ে আছেন। তাঁকে ওখানে সরিয়ে রেখেছি।

স্ট্রেচার সমেত অফিসার নরেনের পিছু পিছু নেমে গেলেন ঢালু জমি যেখানে সমতল হয়ে এসেছে।

.

অন্য একটি ট্রেনে করে আহত যাত্রীদের নিয়ে রেস্কিউ পার্টি যখন গয়ার হাসপাতালে এসে পৌঁছল, তখন পুব দিক ফরসা হচ্ছে।

ভর্তি করবার সময় অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, নাম?

নরেন্দ্রনাথ দাশ।

আপনার আত্মীয়ার নাম?

নরেন একবার তাকালে সুধার দিকে। তখনও জ্ঞান ফিরে আসেনি সুধার।

একটু থেমে নরেন বললে, মিসেস জয়ন্তী সান্যাল।