কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি – ৮

সেই সন্ধ্যায় নদীর ধারে শ্মশানে দাঁড়িয়ে ননী যখন নিজেকে ওপড়াতে চাইছে, তখন ফেলু গোঁসাই যেন বার বার দুরমুশ মেরে তাকে আরও বসিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। বার বার খালি কৃষ্ণার কথা। জিভ চুক চুক। ইনিয়ে বিনিয়ে কৃষ্ণার ভাবভঙ্গি বর্ণনা বিশ্লেষণ।…ওর হত। বুঝলেন। দেখেই বুঝেছিলুম ওর হত! আমার জহুরির চোখ বেটা। আর ননী ক্ষেপে যাচ্ছিল ভেতর—ভেতর। কয়েকবার ওকথা থাক বলার পরও গোঁসাই থামছেন না দেখে সে পা বাড়িয়েছিল। হঠাৎ গোঁসাই বলে উঠেছিলেন পুরনো পল্টনের মাঠে (কেউ কেউ প্যারেড গ্রাউন্ড না বলে তাই বলে) ঝড়ের সময় একটা ভটভটিয়ার কথা। ননী কান করে শুনেছিল।

পরে সারারাত দৃশ্যটা দেখেছে শুয়ে শুয়ে। ধুলো—ওরা ঝড়ের মধ্যে একটা মোটর সাইকেল কৃষ্ণাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে বৃত্তাকারে। ক্রমশ বৃত্তগুলো ছোট হয়ে আসছে। ক্রমশ আরও ছোট। ননী এই অব্দি দেখেই চোখ খুলে তাকিয়ে থাকছিল সিলিং ফ্যানটার দিকে। ভাড়া নেওয়া কোন আমলের পাখা। ব্লেডে রং—চটা জীর্ণতা। ঘড়ঘড় শব্দ করে। বিজলি ভাণ্ডারের পরিমল বলেছিল, এবার সিজনের মুখেই রঙ চড়িয়ে দিয়ে যাবে। পরিমল কথা রাখেনি। মার্চের ভাড়াটা লোক পাঠিয়ে আদায় করেছে। তবে কৃষ্ণার পাখাটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেল। রাত দুপুরের আচমকা একটা অবিশ্বাস্য ঘটনার মতো কৃষ্ণার শূন্য ঘরের ছাদে পাখাটা গাঁথা আছে।

রাতে এখনও পাখা চালানোর দরকার হয়নি। সেই ঝড়—বৃষ্টির পর আবহাওয়া একপা পিছিয়ে গেছে যেন। তবু ননীর ইচ্ছে করেছিল, পাখাটা চালাবে। টেবিলবাতি জ্বালিয়ে রেখেছিল। বাইরে বারান্দার আর কৃষ্ণার ঘরের বালবও সারা রাত জ্বালানো ছিল। ননী উঠে গিয়ে ফ্যানটা চালিয়েছিল। তারপর চিত শুয়ে ফের দেখছিল, ঝড়ের মধ্যে গোঁ গোঁ শব্দ করে একটা মোটর সাইকেল চক্কর দিচ্ছে আর চক্কর দিচ্ছে। কেন্দ্রে কৃষ্ণা দাঁড়িয়ে আছে, মুখে ঠান্ডা একটা ভূতুড়ে হাসি।

ননী দেখছিল, তার মধ্যে এতকালের ভয়টা আর নেই—এবং এটা এক চমকপ্রদ আবিষ্কারের আনন্দ দিচ্ছিল তাকে। বারান্দার দিকে যে জানলাটার দিকে তাকাতে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল—হঠাৎ বারান্দার আলোর জানলার সামনে হঠাৎ যদি কৃষ্ণাকে দেখতে পায় ভেবে এবং সেটা একটু আগে বন্ধ করে দিয়েছিল, পরে ফের হাট করে খুলে দিল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে সিগারেট খেতে—খেতে কতক্ষণ বারান্দা থেকে উঠোন, উঠোন থেকে বারান্দা, এবং কৃষ্ণার ঘরের সামনে দিয়ে ঘুরে এসেছে। তারপর নিজের ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে শুয়ে পড়েছে। ঘুরন্ত ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন নিজের গলার ওপর ডান হাতটা উঠে গেছে। দম আটকানো ভাবটা বেড়ে গেলে সরিয়ে নিয়েছে। শুধু মনে হয়েছে, কৃষ্ণা মরার সময় বড় কষ্ট পেরেছিল।

শেষ রাতে ননী তন্দ্রার ঘোরে টের পেয়েছিল, ভীষণ ঝড়—বৃষ্টির মধ্যে পড়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে হিমে। তখন জেগে গেল। দেখল ওপরে ফ্যানটা ঘুরছে। গোঁ গোঁ শব্দ করছে। উঠে গিয়ে সুইচ টিপে ফ্যানটা বন্ধ করেছিল। তারপর টেবিলবাতিও নিবিয়ে দিয়েছিল। ঘরের ভেতর বারান্দার আলোর ছটা ভরে আছে। জানালাটা বন্ধ করে অন্ধকারে গাঢ় ওমের মধ্যে ননী চাদর মুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

এমন ঘুম জীবনে কখনও ঘুমিয়েছে কি? মনে পড়ে না ননীর। শরীরটা হালকা আর স্বচ্ছন্দ লাগছে। গাঢ় স্বপ্নবিহীন একটা ঘুম ঘুমিয়েছে সে। আসলে তার শরীর নিজস্ব ঘাটতি পুরো উশুল করে নিয়েছে। আর শেষ মার্চের এই সকালটা একেবারে অন্য রকম। ক্রমাগত কতকগুলো কথা তার মাথার ভেতর বুদ্বুদের মতো ভেসে উঠল, মিলিয়ে গেল। আর কৃষ্ণার জন্যে টাকাপয়সার ভাবনা তাকে ভাবতে হবে না। কলেজের মাইনে, বইপত্তর কেনা, রোজ একটা করে বাঁধানো খাতার বায়না, হাত—খরচ,…কিছু না। ভেতর—ভেতর একটা বড় ভাবনা ছিল—কৃষ্ণার বিয়ের ভাবনা। ওই স্বাস্থ্য আর চেহারা, গায়ের রঙ—গুণটা কোনো কথা নয়। কিন্তু সেই বড় ভাবনাটা আর তাকে ভাবতে হবে না। টিউশনিটা ছিল একটা বিশ্রি ব্যাপার। কত সহজে ছেড়ে দেওয়া যাবে এখন!…আর নিজের খাওয়াটা তো ননী হোটেলে খেয়ে নিতেই পারে।

নিজেকে ভারমুক্ত দেখে ননী কিছুক্ষণ অবাক হয়ে রইল। কিন্তু এইসব নানান বৈষয়িক কথা তাকে ঘিরে রেখেছে চারপাশ থেকে। সমানে ঘ্যান ঘ্যান করেছে। হুঁ, বাড়িটা তার একার পক্ষে যথেষ্ট বড়। সে নিজের ঘরটা রেখে বাকি ঘর, কিচেন সবটাই ভাড়া দিতে পারে কোনো ছোট ফ্যামিলিকে। তার জীবনটা হঠাৎ কত সহজ হয়ে গেল তাহলে। বোম বোম ঘোরো যেখানে খুশি। কোনো পিছুটান নেই।

কৃষ্ণা ছুটিছাটায় বাইরে যেতে বলত, সবাই যেমন যায়। ননী গাঁইগুঁই করেছে। একে একটু ঢিলেঢালা স্বভাব তার, ঠাঁইনড়া হতে ভালো লাগে না—তাছাড়া বাড়িতে কাকেও রেখে না গেলে চুরির ভয় ছিল। তবু রিস্ক নিয়ে এ অব্দি বার তিন—চার অল্প কয়েকদিনের জন্যে কৃষ্ণাকে ঘুরিয়ে এনেছিল। একবার পুরী, একবার দার্জিলিং। বাকি দুবার সিউড়িতে পিসির বাড়ি এবং পরের বার শান্তিনিকেতনে। ব্যস! ননী জানে কৃষ্ণা তার বন্ধুদের বানিয়ে বানিয়ে নানা জায়গায় যাবার প্রোগ্রামের কথা বলত। একবার পিউয়ের কাছে ননীর সামনে ধরা পড়ে গিয়েছিল কৃষ্ণা। ননী আগে জানলে বোনের মুখরক্ষা করত। সেদিন কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকাতে ভারি কষ্ট হয়েছিল ননীর। আচ্ছা, আচ্ছা! এবার পুজোয় তোকে নিয়ে যাব হরিদ্বারে। কথা দিচ্ছি।

ননী কথা রাখেনি। হরিদ্বার কি এখানে? গিয়ে ফিরতে কমপক্ষে সাতটা দিনের ব্যাপার। বাড়ি লুট হয়ে যাবে। ধাঙরপাড়া যা হচ্ছে দিনে দিনে। রোজ রেলইয়ার্ডে ওয়াগন ভাঙছে আর গুলি খাচ্ছে। মাঝরাতে গুলি আর বোমার শব্দ শুনিস জেগে থেকে। আসলে হয়েছে কী, ভদ্রলোকের বাড়ির মাস্তান ছেলেরাও যে ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। গাবুকে চিনিস তো? গৌতমবাবুর ছেলে গাবু। বল, ওদের কোনো অভাব আছে? রীতিমতো বিজনেস ম্যাগনেট। তার ছেলে গাবু ধাঙড়বস্তিতে গিয়ে আড্ডা মারে। পুলিশের তাড়া খেয়ে বেড়ায়।

কৃষ্ণা কাপড় কাচতে কাচতে বলেছিল, একটু চুপ করো তো বাবা! আমি কি যেতে চেয়েছি কোথাও?…

এবেলা ননীকে সান্ত্বনা দিতে একজন—দুজন করে চেনাজানা লোক ভিড় করছিল। পুরুষ ও মহিলারা। কত নাকিকান্না, ফোঁস—ফাঁস নাকঝাড়া, সদুপদেশ। মধুবাবু আপিস যাবার পথে বলে গেলেন, পুলিশের ভরসায় বসে থাকলে আসামি ধরা পড়বে না ননী। ওরা জানতে নিশ্চয় পারবে এবং টাকা আদায় করে চেপে যাবে। তুমি লেগে থাকো। বরং ডি এম, এস—পি—র কাছে যাও। এম এল ও অচিন্তাদাকে ধরো। তারপর তোমার গিয়ে ভোম্বলদাকে গিয়ে বলো। উনি তো এম পি। শুনলাম কাল রাতে বাড়ি ফিরেছেন। এখনই যাও। নইলে গিয়ে শুনবে দিল্লি উড়েছেন। চুপচাপ বসে থেকো না আর। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। সবারই ঘরে মেয়ে—টেয়ে রয়েছে। স্কুল—কলেজে যাচ্ছে। এ কি সর্বনেশে অবস্থা। গারজেনরা কি আর নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন বাড়িতে? এ্যাঁ? ভেবে দেখ ননী।

ননী ভেবেছে। আবছা কতকগুলো ভাবনা। তার ভাবনার মধ্যে একটা মোটরসাইকেল গোঁ গোঁ করে ঘুরছে আর ঘুরছে—মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণা, তার কাপড় উড়ছে ঝড়ে। ঘন ধুলো খড়কুটো, ছেঁড়াপাতার মধ্যে দৃশ্যটা অস্পষ্ট হয়ে আসে ক্রমশ। খালি মোটরসাইকেলের শব্দটা শোনা যেতে থাকে।

তারপর তীব্র তীক্ষ্ন ব্রেককষার আওয়াজ!…ক্যাঁ—চ করে একটা শব্দ। ননীর মাথার ভেতরটা খালি হয়ে যায়। আর তার মধ্যে ঠান্ডা হিম চিরে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ওই শব্দ মাথার খুলিকে দুভাগ করে ফেলতে চায় করাত—কলের মতো। ননীর চোয়াল আঁটো হয়ে যায়। গালের নীচে শক্ত হাড় ঠেলে ওঠে।

পোস্টমর্টেম রিপোর্টে আছে, ব্রুট্যালি রেপড বাই মোর দ্যান ওয়ান পার্সন। ডান হাতের তালু ও তিনটে আঙুলে চেরা ক্ষতচিহ্ন মে বি কজড বাই এ মেটাল স্ট্রিং—সামথিং লাইক এ চেন। উভয় স্তনেই ক্ষতচিহ্ন কজড বাই হিউম্যান টিথ। দুটো পাতা ধরে খালি দুর্বোধ্য মেডিকেল টার্মের হিজিবিজি। একটা জায়গা ফের স্পষ্ট। অফ কোর্স, শি রেসিস্টেড উইথ অল হার স্ট্রেংথ।

কৃষ্ণা যথাশক্তি লড়াই করেছিল। এটাই ভাবতে ভালো লাগে ননীর। এর পর গলা, শ্বাসনালি ফুসফুস এবং হার্ট সম্পর্কে আবার মেডিকেল হিজিবিজি। তারপর… হেন্স, দি ডেথ অকারড ফ্রম সাফোকেশান বাই দি ডিপ অ্যান্ড স্ট্রং প্রেসার অফ হিউম্যান হ্যান্ডস। আই থিংক, বোথ হ্যান্ডস অফ দি সেম পার্সন ওয়্যার ইউজড। দেয়ার আর ক্লিয়ার মার্কস ইনসাইড অ্যান্ড আউট সাইড দি থ্রোট।

ডাক্তার নবদ্বীপ ঘোষের রিপোর্টে কাব্য থাকে, জানেন? অরুণ নন্দী কাল বিকেলে বলেছিলেন। ভদ্রলোকের পোস্টমর্টেম রিপোর্টকে অনায়াসে ফরেন্সিক এক্সপার্টের রিপোর্ট বলে চালানো যায়। এই দেখুন না, বডির ব্যাকসাইডে পরীক্ষা করে লিখেছেন, দেয়ার ইজ নো ক্লিয়ার মার্ক, বাট আই ক্যান কনক্লুড ফ্রম সেভারেল আদার ফ্যাক্টরস হুইচ ইনডিকেট ভেরি ক্লিয়ার দ্যাট দি বডি ওয়াজ ড্রাগড ফ্রম দি প্লেস অফ ডেথ টু দি ভেরি প্লেস হোয়্যার ইট ওয়াজ ফাইনালি ফাউন্ড আউট…

ধর্ষণ করে গলা টিপে মারার পর কৃষ্ণাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। সম্ভবত ঝিলে পুঁতে ফেলাই উদ্দেশ্য ছিল। শিলাবৃষ্টির জন্যে ফেলে পালিয়ে যায়।

নন্দীর মতে ব্যাপারটা একটা জিনিস খুব পরিষ্কার করে দিচ্ছে। নতুন আনাড়ি হাতের কাজ। পাকা হাতের কাজ নয়। পাকা ঘুঘু বা দাগি হলে ঝড়—বৃষ্টি থামার পর সারারাত সময় পেয়েছিল, ফিরে গিয়ে স্বচ্ছন্দে লাশ গুম করে না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি পেত না। তাছাড়া মনে হচ্ছে, আপনার বোন তাকে চিনত। চিনত এবং হয়তো বার বার শাসিয়েছিলেন সব বলে দেবে বলেই ভয়ে ওকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ভেরি সাডেন কনক্লুশ্যান বলা যায়। আতঙ্কের চোটে হতবুদ্ধি হয়ে কাজটা করেছে। ও নো নো! আপনি ভাবছেন আমি সিম্প্যাথি দেখাচ্ছি! আপনার মাথা খারাপ মশাই? আমি অরুণ নন্দী, প্লীজ ডোন্ট ফরগেট দ্যাট।…

পিউ এসেছিল। চোখ লাল করে বেরিয়ে গেল। বলে গেল—কলেজে খবরটা দেবে। নিশ্চয় হলিডে ডিক্ল্যার করা হবে। ননী পিউকে দেখে ভাবছিল জিনের আঁটো মিনি জ্যাকেট আর পাতলুন পরা, ছোট ছোট চুল ইত্যাদি নিয়ে মেয়েদের শোকপ্রকাশ বড্ড অবান্তর লাগে। পিউ তো মেমসায়েব নয়। গায়ের রঙ কৃষ্ণার মতোই।

সাড়ে দশটায় ননী স্নান করে সাইকেল নিয়ে বেরুল, সদর দরজায় তালা আটকে, হঠাৎ পেছনে রাস্তায় একটা মোটর—সাইকেলের শব্দ হতেই চমকে উঠে ঘাড় ঘোরাল। শব্দটা তার খুলির ভেতর দিয়ে দূরে সরে যেতে থাকল।

চৌমাথায় কালেক্টরির পাশে অনেকগুলো হোটেল আছে। গাঁয়ের লোকেরাই কাজে এসে খায় সেখানে। ননী সেখানেই ঢুকল। খুব শস্তায় খাওয়া যায়। কৃষ্ণা তেমন কিছু রাঁধতে পারত না। নুন—ঝালটা কম—বেশি মতোই। কতদিন স্কুলে যেতে যেতে ননীর লোভ হয়েছে, মুখ বদলালে মন্দ হত না। কিন্তু পারেনি। আজ তারিয়ে তারিয়ে খেতে ইচ্ছে করছিল। দু’ প্লেট মাছের ঝোল নিল। দু’বার ডাল নিল। ডালটা চমৎকার রাঁধে এরা। রোজ এখানে এসেই খেয়ে যাবে। কিন্তু খেতে খেতে হঠাৎ একবার দ্বিধায় পড়ে গেল, কৃষ্ণার শ্রাদ্ধ—শান্তি এখনও হয়নি। আমিষ খাচ্ছে। বাকি ভাতগুলো আনমনে খেয়ে উঠে পড়ল। আসলে সংস্কারও একটা ভূত। এ—ভূতটা তাড়াবে ননী। বরাবর তাড়িয়েছে, অভ্যাস আছে। শেষবারের মতো তাড়াবে। লোকেরা বলে গেল, অপঘাতে মৃত্যুতে শ্রাদ্ধ—শান্তিটা খুব ভালোভাবেই করা উচিত। এই লোকেরা অ্যাদ্দিন কোথায় ছিল? খাওয়ার লোভে এখন লোলায় টসটস করে লালা গড়াচ্ছে।

আর কৃষ্ণা তো ইসমিলের মতো স্বেচ্ছায় মরতে চায়নি। তার মৃত্যুই বা স্বাভাবিক নয় কোন যুক্তিতে? ক্যান্সার মারে মানুষকে। কলেরা এসে মারে। কৃষ্ণাকে তেমনি একটা সাংঘাতিক ব্যাধি এসে মেরেছে।

ননী হাত মুছে পান কিনতে গিয়ে বলল, থাক, সিগারেট এক প্যাকেট।

স্কুলে ঢুকতে গিয়ে ননী টের পেল, ভুল করেছে। হঠাৎ সব হল্লা থেমে গেল তাকে দেখে। ছেলেরা যে—যেখানে ছিল তার দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেছে। ননী সাইকেল ঠিক জায়গায় রেখে তালা দিল। তারপর বারান্দা দিয়ে হনহন করে এগোল অফিসঘরের দিকে। স্যাররা কথা বলছিলেন। হেডস্যার কিছু লিখছিলেন। ননী ঢোকামাত্র সবাই মুখ তুলে মমি হয়ে গেল।

ননী একটু অপ্রস্তুত হাসল শুধু। তারপর অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারের পাতা ওলটাতে গেলেই হেড—স্যার আশুবাবু ডাকলেন, ননী!

বলুন স্যার?

তুমি… তুমি স্কুলে এলে?

কেন স্যার?

ওপাশ থেকে মহীতোষবাবু রাগ দেখিয়ে বললেন, কী দরকার ছিল স্কুলে আসার আজ? ছুটি পাওনা নেই? ভাবছ, তুমি না এলে স্কুল চলবে না—না কী? অদ্ভুত তো। বাড়ি যাও।

ননী চোখে চোখ রেখে বলল, কেন?

আশুবাবু একটু হেসে সস্নেহে বললেন, তুমি একজন টিচার, বাবা ননী। ডোন্ট ফরগেট দ্যাট। কাল তোমার ফ্যামিলিতে অমন একটা কাণ্ড হল—আফটার অল ইট ইজ এ ট্রাজেডি। আজ তুমি নির্বিকারভাবে স্কুলে এসেছ। তোমার যা মানসিক অবস্থা হওয়া উচিত, তাতে তুমি কি ক্লাস নিতে পারবে? ইমপসিবল।

ননী ঠোটের কোনায় হাসি এনে বলল, আই অ্যাম অলরাইট স্যার।

দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলার স্যার ভবেশবাবু। বললেন, আহা! বোনের শ্রাদ্ধ—শান্তিটা হোক। তারপর এসো। ছুটি নাও ক’দিন। তোমার মনের অবস্থা তো বুঝতে পারছি, ননী। কী শোকাবহ মৃত্যু! কী মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক ঘটনা।

ননী গোঁ ধরে আশুবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, সই করতে দেবেন না স্যার?

আহা! কী মুশকিল! ওভাবে নিচ্ছ কেন তুমি? আশুবাবু বললেন। ছুটির দরখাস্ত করো। পীযূষবাবু ওকে একটা কাগজ দিন।

ননী ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর, আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি কি আমার অশৌচ…

আশুবাবু এবার গাম্ভীর্য নিয়ে যথার্থ হেড—স্যারের ভঙ্গিতে একটু গলা চড়িয়ে বললেন, নো। সার্টেনলি নট।

মহীতোষ বললেন, প্রশ্নটা হিউম্যানিটি সংক্রান্ত ননী। কেন তুমি বুঝতে পারছ না? আমরা—আর এত সব ছেলে রয়েছে স্কুলে—সবাই তো মানুষ, না কী? কী ভাবছ তুমি আমাদের?

ননী গলার ভেতর বলল, বাজে সেন্টিমেন্ট।

মোটেই না। তুমি বয়সে আমাদের ঢের ছোট। তোমার সঙ্গে তর্ক করতে বাধে। মহীতোষ বললেন। তুমি এর সাইকোলজিকাল ইমপ্যাক্টটা কিছুতেই বুঝতে পারছ না। যতক্ষণ তুমি ক্লাস করবে, প্রত্যেকটি ছেলে তোমার দিকে তাকিয়ে ভাববে, ননীস্যারের বোন…

ননী ঢোক গিলে বলল, থাক। আপনি চুপ করুন।

ভবেশবাবু তার কাঁধে হাত রাখলেন। দেখ ননী, আমাদের দেখেই তো ছেলেরা শিখবে। স্বজন বিয়োগের পর মানুষ দুঃসহ বেদনায় আক্রান্ত হয়। তোমার মধ্যে যদি সেই বেদনা প্রকাশ না পায়, ছেলেদের কোমল মস্তিষ্কে এর প্রভাব সৃষ্টি হতে বাধ্য। মৃত্যু—শোকজনিত বেদনা মানবিক মূল্যবোধেরই দ্যোতক। সেই মূল্যবোধের বিভ্রান্তি যদি তোমাতে পরিস্ফুট হয়, কোমলমতি শিক্ষার্থিবৃন্দ…

বিদ্যুৎ বাইরে কোথাও ছিল। এসে ননীকে টেনে নিয়ে গেল বাইরে। ভবেশবাবু বক্তৃতা শেষ করতে না পেরে ঠোঁট ফাঁক করেই দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্তে। তারপর ছাতাটা মাপের র্যাকের খুঁটিতে ঝুলিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললেন। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে মিনিট পনেরো রোজ হেড—স্যারের সঙ্গে শিক্ষকদের একটা কনফারেন্সে বসতে হয়। বেশির ভাগ দিনই পাঠক্রম এবং অগ্রগতি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। ননী ও বিদ্যুৎ পারতপক্ষে এ সময়টা স্কুলের বাইরে কাটায়। ঘণ্টা পড়লে তাড়াহুড়ো করে ঢুকে অ্যাটেনডেন্সে সই করে ক্লাস নিতে যায়।…

ছুটির দরখাস্তে বিদ্যুৎ সই করিয়ে নেওয়ার পর ননী সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল। বেশ দিনটা কেটে যেত গোলমালে। হল না। এখন কোথায় যাবে ননী? কী করবে?

রাস্তার ধারে একটা বিশাল অশোকগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে ননী ঠিক করল, মানুদের বাড়ি যাওয়া যাক। মানুর নিশ্চয় জ্বর টর হয়েছে। তা না হলে সে কাল দুপুর থেকে এমন ডুব মেরে থাকত না।

যেতে—যেতে হঠাৎ মনে পড়ল রাতে কয়েকটা চিঠি লিখে রেখেছে। সেইগুলো ডাকে দিতে ভুলে গেছে। আত্মীয়দের মধ্যে যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, তাঁরা সবাই খুব দূরে থাকেন। কদাচিৎ দু—পাঁচ বছরে কেউ দৈবাৎ একবার এসে পড়েন। তাঁদের অন্তত কৃষ্ণার মৃত্যু—সংবাদটা জানানো উচিত ভেবেছিল ননী। কিংবা চিঠি লিখে সময় কাটাবারই ফিকির, নিজেই ভাবছিল—এতে কার কী আসে যায়? অবশ্যি সিউড়ির পিসিমা—পিসেমশাইয়ের কথা আলাদা। কিন্তু তাঁদের বয়স হয়েছে। চলাফেরা করতে পারেন না বিশেষ। তবু বলা যায় না, এসে পড়তেও পারেন।

কিন্তু ননী কাকেও আসল ব্যাপারটা লেখেনি। মৃত্যুই যথেষ্ট, কারণ লিখে খামোকা বিচলিত করা।

ননী বাড়ি হয়ে চিঠিগুলো নিতে গেল। তোপপাড়ায় ঢোকার মুখে পিউয়ের সঙ্গে দেখা। পিউ তাকে দেখে দৌড়ে এল। ও নোনেদা! কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

কেন রে?

পিউ শ্বাস—প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, কলেজে কৃষ্ণার জন্যে হলিডে ডিক্ল্যার করল। একদল মেয়ে আর আমাদের মিসেস সিনা, বোসদি এঁরা সব এসেছিলেন আমার সঙ্গে। এসে দেখি দরজা বন্ধ। বাঃ!

ননী ফের বলল, কেন?

পিউ একটু দমে গেল। ঢোক গিলে বলল, প্রিন্সিপাল পাঠালেন মিসেস সিনা আর বোসদিকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে। এদিকে তুমি নেই। নোনেদা, কাল তুমি পজিটিভলি দেখা করো প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে। ভেরি ভেরি ইমপর্ট্যান্ট কিন্তু। বোসদি বলে গেলেন বলতে। ডোন্ট নেগলেট।

ননী কিছু বুঝতে পারল না। আচ্ছা বলে প্যাডেলে পায়ের চাপ দিল।

সাইকেলটা বাইরে রোয়াকে ঠেস দিয়ে রেখে সে দরজার তালা খুলে বাড়ি ঢুকল। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা অগাধ শূন্যতা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এতক্ষণে। উঠোনে কাল থেকে সেই রাশিকৃত জঞ্জাল ছড়িয়ে রয়েছে। ড্রেনের পাশে পাখির বাসা ভেঙে পড়ে আছে। তার কাছে বসে একটা বেড়াল হাই তুলেছে। কাল নিশ্চয় বেড়ালটা তৃপ্তির সঙ্গে ডিম ভাঙা পাখির ভ্রূণটা খেয়েছিল। খোলাদুটোও কি খেয়েছিল? পড়ে নেই। হয়তো কাকে তুলে নিয়ে গেছে। কলতলা শুকনো খটখটে। বারান্দায় ধুলো। পাখির গু। সারা বাড়িটা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পোড়োবাড়ির রূপ নিয়েছে।

পরমুহূর্তেই ননীর যেন নতুন করে মনে পড়ে গেল, কৃষ্ণা ফেরেনি। কৃষ্ণা আর কোনোদিনও বাড়ি ফিরবে না।

তখন সে নড়ে উঠল। প্রচণ্ড অভাববোধের ধাক্কায় সে ব্যস্ত হয়ে উঠল। দ্রুত ঘরে ঢুকে চিঠিগুলো নিয়ে বেরিয়ে এল। আর ঘরের দরজায় তালা আটকে দু’পা বাড়াতেই তার মনে হল, সেই গন্ধটা পাচ্ছে। গা শিউরে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। চমক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

না, গন্ধটা মিলিয়ে গেছে।

চৌমাথায় লেটারবক্সে চিঠিগুলো ফেলে ননী যখন সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে তখন সামনে দক্ষিণের হাওয়ার চাপ তাকে বাধা দিতে এল। ননীর মনে হচ্ছিল, গায়ে এতটুকু জোর নেই। বুকের ভেতরটা ধক ধক করে কাঁপছে। ঘাম জমেছে ফোঁটায় ফোঁটায় মুখে, বুকে, ঊরুতে। হাতের তালুতে। আর তখনকার সেই প্রচণ্ড বোধ বারবার শূন্য খুলির ভেতর গমগম করে বলে বেড়াচ্ছে: কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি। কৃষ্ণা আর বাড়ি ফিরবে না।

নিষ্পলক চোখে ননী তাকিয়ে দেখল, সে কৃষ্ণাদের কলেজের পাশ দিয়ে যাচ্ছে।

কতদিন এমন সময় এখান দিয়ে কোথাও যেতে যেতে ননী বড় সুখে তাকাত বিশাল প্রাঙ্গণঘেরা গাছপালা ফুলবাগিচায় সাজানো এই বাড়িটার দিকে। এখানে তার বোন আছে মনে পড়ে খুব আনন্দ হত। ভাবত, দেখে যাবে নাকি একবার কৃষ্ণাকে? গেট থেকে দেখা যায়, গাছতলায় সবুজ ঘাসের ওপর মেয়েরা ছড়িয়ে বা বসে গল্পগাছা করছে। মাঝে মাঝে হেসে টলে পড়ছে কেউ। কেউ মুখে বইখাতা চাপা দিচ্ছে হাসি ঢাকতে। অবিকল কৃষ্ণার মতো। মা বলতেন কিনা—বড় বড় দাঁতগুলো আর বের করে না। সেই থেকে হাসবার সময় কৃষ্ণা মুখে কিছু আড়াল দিত।

ননী কতদিন বলেছে, জানিস? আজ তোদের কলেজের গেটের সামনে দিয়ে গেলুম?

তাই বুঝি? আমায় ডাকিসনি কেন রে দাদা?…বলে একটু পরে চোখে ঝিলিক তুলে বলত—বুঝেছি। সাতশো মেয়ে দেখে তোর অক্কা পাওয়ার অবস্থা!

ননী বলত, সাতশো রাক্ষুসী বল! যা সব চেহারার ছিরি!

কৃষ্ণা এত রাগ করত যে সেবেলার মতো কথা বন্ধ। আসলে ভাবত, দাদা তার চেহারা নিয়েই খোঁচাটা মেরেছে। ননী তাকে বোঝাতে নাকাল হয়ে যেত।

 গেটের মাথায় বুগানভিলিয়ার ঝাঁপি। লাল ফুলে ঢাকা। পরশু সন্ধ্যার বৃষ্টি জেল্লা এনেছে প্রকৃতিতে। গেটের একটা কপাট খোলা, একটা বন্ধ। দারোয়ান টুলে বসে আছে। ননী পা ঠেকিয়ে সাইকেল থামাল।

একটু দোনামোনা করে দারোয়ানকে জিগ্যেস করল, প্রিন্সিপ্যাল কি চলে গেছেন দারোয়ানজী?

দারোয়ান নিরাসক্ত গলায় টুলে বসে নিজের জুতো দেখতে দেখতে বলল, ছুট্টি হো গেয়া। মাইজী আভি নিকলেগি। কৈ কাম হ্যায় তো কালরোজ আইয়ে। বারাসে এক বাজতক দেখা মিলেগা।

ননী নেমে গেটের পাশে সাইকেল রেখে বলল, আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। দেখা করব।

দারোয়ান তেমনি হেঁট—মুণ্ডে হাত সামনে বাড়িয়ে বলল, তব যাইয়ে।

দীর্ঘ নুড়িবিছানো লন পেরিয়ে ননী অফিসের বারান্দায় পৌঁছল। স্মার্ট চেহারার এবং সাদা শাড়ি ও জামাপরা একটি মেয়ে, কোমরে আঁচলটা সুন্দর করে জড়ানো, যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কাকে চান? এখন তো ছুটি হয়ে গেছে।

ননী বলল, প্রিন্সিপ্যাল আমাকে ডেকেছিলেন।

কিন্তু এখন তো দেখা করা যাবে না। উনি ব্যস্ত। ফের অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে তবে আসবেন।

ননী সোজা পর্দা ঠেলে ঢুকে পড়ল। নমস্কার। আমি ননীগোপাল ভট্টাচার্য। কৃষ্ণার দাদা।

প্রিন্সিপাল নন্দিনী গৃহ তাকিয়ে ছিলেন মুখের দিকে। তিনজন অধ্যাপিকাও সামনের চেয়ারে বসে আছেন। ঘুরে তাকিয়ে ছিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে নন্দিনী বললেন, বসুন। কথা আছে আপনার সঙ্গে।

ননী একটা খালি চেয়ারে বসল।

আবার একটু নীরবতা। তারপর নন্দিনী বললেন, আমরা সবাই ভীষণ মর্মাহত। শকড অ্যান্ড টেরিফায়েড। এই কলেজের ইতিহাসে এমন কখনও ঘটেনি। আমাদেরই এক স্টুডেন্ট এভাবে ব্রুট্যালি মোলেস্টেড অ্যান্ড কিল্ড হবে, দিস ওয়াজ বিয়ন্ড আওয়ার ইমাজিনেশন। অফকোর্স, আমরা আর হোল কলেজের মেয়েরা মিলে শোকসভা করেছি। শোক—প্রস্তাব নিয়েছি। হিয়ার ইজ এ কপি—আই ওয়াজ জাস্ট থিংকিং টু ফরোয়ার্ড ইউ বাই পোস্ট।

ননী মুখে বলল, আপনি আমাকে কি ডেকেছিলেন? মনে মনে বলল, এই বাংরেজির কী দরকার ছিল?

দ্যাটস রাইট। নন্দিনী ননীর দিকে টাইপকরা শোকপ্রস্তাবের একটা কপি এগিয়ে দিলেন। শুনুন আমরা গার্জেনদের একটা আর্জেন্ট মিটিং ডাকছি। আজ থার্সডে। কামিং সাটারডে অ্যাট থ্রি, পি এম মোস্ট পজিটিভলি। আমরা রেজলুউশ্যান নেব। লোকাল অথরিটির কাছে ম্যুভ করব। ইভন, থ্রু প্রপার চ্যানেল টু দা চিফ মিনিস্টার। একি কাণ্ড! মেয়েদের কলেজে আসা যাওয়ার কোনো সিকিউরিটি থাকবে না।

ননীর বাঁ পাশের অধ্যাপিকা বলেন, কৃষ্ণা কত ভালো মেয়ে ছিল। কত সিম্পল অ্যান্ড ইনটেলিজেন্ট।

প্রিন্সিপ্যাল বললেন, পুলিশ কী বলছে?

ননী মাথা দোলাল। জানি না।

ননীর ডানপাশের অধ্যাপিকা বললেন, পুলিশ? হুঁঃ পুলিশ সব করবে। পুলিশ যদি কিছু করবে, এই অবস্থা হয় ভাবুন।

ননী উঠে দাঁড়িয়ে ঝকঝকে মসৃণ বন্ড পেপারের শোকপ্রস্তাবটা দুমড়ে ধরা হাত তুলে নমস্কার করল। চলি ম্যাডাম। মেনি থ্যাকংস টু ইউ .অল। আপনারা কৃষ্ণার জন্য ফিল করেছেন জেনে আমি কৃতজ্ঞ।

নন্দিনী গুহ বললেন, সার্টেনলি। খবর পেয়েই আমি হলিডে ডিক্ল্যার করে দিয়েছি।

ননী হনহন করে বেরিয়ে এল। নুড়ি বিছানো লনে হাঁটা সহজ নয়। কৃষ্ণা আর এই নুড়ি বিছানো পথে কোনোদিনও হাঁটবে না। কৃষ্ণা আর এ কলেজের ছাত্রী নয়। এখানে আসবে না কোনোদিনও। ননী শোক—প্রস্তাবের কাগজটা দুমড়ে গুটি পাকিয়ে একগুচ্ছ প্যান্সিফুলের ওপর ছুঁড়ে ফেলল।

কৃষ্ণা মরে গেল। কৃষ্ণারা মরে যায়। অপমানে, নিষ্ফল রাগে ছটফট করতে করতে আতঙ্কে বোবা হতে হতে দম আটকে ফুসফুস ফেটে, হৃৎপিণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে রক্ত ছলকে উঠতে উঠতে আমাদের বোনেরা নিস্পন্দ হয়ে যায়। ঘাসের ওপর তারা পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকে এবং অপমানিত লাঞ্ছিত যোনির ওপর বসে থাকে বিষণ্ণ ধূসররঙের কোনো পোকা।

তবু এত নিয়মকানুন চলে পৃথিবীতে। কত কেতা বজায় রাখা হয়। কত বাংরেজি উচ্চারিত হয়। শোক—প্রস্তাব টাইপ করা হয়। অরুণ নন্দীরা বারবার বলেন, হিয়ার ইজ অরুণ নন্দী। ভাববেন না।

সামনে গরগর শব্দ। ননী তাকাল। উজ্জ্বল রোদ্দুরে পিচ নরম হয়েছে। সামনে রাস্তার ওপর সাদা রোদ্দুর কাঁপছে। তার মধ্যে একটা কালো মোটরসাইকেল এগিয়ে আসছে তার দিকে। শব্দটা বাড়ছে। ননী রাস্তার মাঝখানে পা পিচে ঠেকিয়ে থেমে গেল। চোয়াল আঁটো হয়ে গেল। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকল।

মোটরসাইকেলটা সামনে এসে খুব কাছ ঘেঁষে টার্ন নিয়ে বেরিয়ে গেল। লাল হেলমেট পরা এক যুবক মুখ ঘুরিয়ে কী যেন বলে গেল। ননী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল কিছুক্ষণ। তারপর ভারি একটা নিঃশ্বাস ফেলে প্যাডেলে পা রাখল ফের।

খালপোলে এসে কালভার্টে পা রেখে সিটে বসে সে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। বাতাস বাঁচিয়ে ধরিয়ে নিল। তারপর এগোল মদনমোহনতলা দিকে।

কাছেই বাঁকের মুখে মানুদের বাড়ি। মানুর ঘরের জানালা বন্ধ। ননী রোয়াকের গায়ে সাইকেল রেখে বাইরের ঘরের দরজার কড়া নাড়ল।

ভেতরে ফেলু গোঁসাইয়ের নাকডাকা শোনা যাচ্ছিল। টেবিলফ্যানের চাপা ঘর্ঘর শব্দ ছাপিয়েও। নাকডাকা থেমে গেল। ঘুম জড়ানো ভারি গলায় বললেন—ভেজানো আছে। তারপর ফের নাক ডাকতে থাকল ওঁর। ননী দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল এবং দরজাটা ভেজিয়ে দিল আগের মতো।

গোঁসাই বুকে পাঁজি নিয়ে ঘুমোচ্ছেন। পরনে লুঙি। গা খালি। ননী ভেতরের বারান্দায় গিয়ে দেখল, বাড়ি চুপচাপ। সে আস্তে ডাকল, মানু।

মানুর ঘরের দরজায় পর্দা। কপাট খোলা। ভেতরে শব্দ করে ফ্যান ঘুরছে।

ননী একটু কেসে ফের ডাকল, জন!

এবার মানুর ঘর থেকে সাড়া এল—কে?

আমি ননী।

মানু পরনের শাড়ি ব্যস্তভাবে গোছাচ্ছিল। গোছাতে গিয়ে হঠাৎ থেমে শুয়ে পড়ল। ডাকল, ভেতরে এসো। আমার শরীর খারাপ।

জ্বর বাধিয়েছ! বলে ননী পর্দা তুলে ঘরে ঢুকল। তারপর বলল, মা কোথায়? দেখলুম না তো।

কয়েক মুহূর্ত ননী কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। এ ঘরে এই প্রথম সে ঢুকেছে। বাইরের উজ্জ্বলতা তখনও তার চোখে। সে ফের বলল, কোথায় তুমি? কিছু দেখতে পাচ্ছিনে।

এই তো। এখানে বসো।

ওরা সব কোথায় গেল?

মা আর জন আসানসোল গেছে কাল? বসো এখানে।

এমন অন্ধকার করে রেখেছ কেন? জানালা খুলে দাও।

আলো ভালো লাগছে না।

এতক্ষণে ননীর চোখের ধাঁধাটা ঘুচেছে। সে দেখতে পাচ্ছে মানু আলুথালু খোলা চুল ছড়িয়ে শুয়ে আছে। আর সে উঁচু খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং তার কোমর মানুর পেটের সমান উঁচু। ননী মাথার দিকে দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা চেয়ার দেখল। বসতে যাবার আগে সে হাত বাড়িয়ে মানুর কপাল ছুঁল তোমার কপাল বেশ ঠান্ডা।

মানু একটু হাসল। জ্বরটা ছেড়েছে। তাই ভীষণ ঘাম দিচ্ছিল। ফ্যান চালিয়ে শুয়ে আছি। এখানে বসো।

ননী একটু দোনামনা করে বসল, সাইকেলটা বাইরে রোয়াকে আছে।

মানু হঠাৎ হাত বাড়িয়ে ননীর হাত নিয়ে বলল, থাক। কেউ নেবে না। এ বাড়ির কোনো জিনিসে কারও হাত দেবার সাহস নেই জানো না?

ননী হাসল। বলেছিলে বটে—জনের খাতিরে! বলে সে যতটা পারে তফাত রেখে খাটের ধার ঘেঁষে পাদুটো ছোট—বড় করে ঝুলিয়ে বসল।

মানু তার ডান হাতটা ধরে থেকে বলল, দাহর খবর পিসেমশাইয়ের কাছে পেলুম কাল রাতে। বললেন, শ্মশানে গিয়েছিলেন। তোমার সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হল।

ননী বলল, একটা মোটরসাইকেল ঝড়ের সময় কৃষ্ণাকে তাড়া করেছিল বললেন।

মানুর বুক ছাঁৎ করে উঠল। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, কার মোটর সাইকেল?

উনি জানেন না। রেলের গেটকিপারের বউ নাকি দেখেছিল। ননী আনমনে বলল। আর কাঠগোলার ভানুবাবু নাকি তার শব্দও শুনেছিল ঝড়ের সময়।

দম আটকে মানু বলল, কোথায়?

পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ডে।

একটু চুপ করে থেকে মানু বলল, পুলিশকে জানিয়েছ?

না।

জানাবে না?

জেনে যাবেখন। তোমার পিসেমশাই যখন জেনেছেন—কথা বাকি রেখে ননী ওর মুখের দিকে তাকাল। আবছা অন্ধকারে মানুর মুখের রঙটা খুব হলদে—সাদায় মেশানো আর চোখ দুটো নিষ্পলক জ্বল জ্বল করছে। নাসারন্ধ্র স্ফুরিত। ননী বলল, অমন করে তাকিয়ে আছ কেন?

মানু দ্রুত সামলে নিয়ে চোখের পলক কয়েকবার ফেলে চাপা জোরালো প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, কেমন করে তাকিয়ে আছি? ভ্যাট! তোমার যতসব ইয়ে! তারপর সে কাত হয়ে দু’হাতে ননীর কোমর জড়িয়ে ডান উরুর ওপর নিয়ে গেল এবং তার শরীর বেঁকে খাটের এপাশে পাদুটো ছড়িয়ে রইল।

ননী এই অবস্থাটা অনেক সময় কল্পনা করেছে। মানুর সঙ্গে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার একটা সীমাঅব্দি সে মনে মনে পৌঁছেছে। তারপর সে একটু লজ্জিত বোধ করেছে, যেন মানু কোনো—না—কোনোভাবে বোধ দিয়ে এটুকুও জেনে ফেলবে এবং হয়তো বদলে যাবে। আসলে মানুকে তার কোনোদিনই সুলভ মেয়ে বলে মনে হয়নি! একটা সংকীর্ণ অথচ অতল খাদের দু’ধারে দুজন যেন দাঁড়িয়ে আছে। হাতটা বাড়ালে বড়জোর খাদের মাঝামাঝি যায় এবং মানুও যদি হাতটা বাড়িয়ে দেয়, পরস্পরের আঙুলে ছোঁয়াছুঁয়ি হতে পারে খাদের মধ্যিখানে—তার বেশি কিছু নয়। ননীর কি ইচ্ছে করেনি, মানুকে ইচ্ছাকৃত হঠকারিতায় অন্তত একটা চুমুও খেয়ে ফেলে? কিন্তু পর মুহূর্তেই একটা ঠান্ডা হিম স্রোত তার বুক থেকে মাথার খুলি পেরিয়ে চলে গেছে। হঠাৎ মনে হয়েছে কৃষ্ণার কথা। কৃষ্ণা তার নিজেরই এক সংস্কারান্ধ মরালিটি ছিল বুঝি। ভেবেছে, কৃষ্ণা চোখে হয়তো কিছু দেখল না—কিন্তু ননীর মনে তো কৃষ্ণা আছে। তার ছোটবোন, বাবা—মাহারা মেয়ে—ননী ছাড়া যার মাথার ওপর কেউ নেই। তাকে দূরে একলা দাঁড় করিয়ে রেখে কোন মুখে ননী জীবনের চরম আনন্দগুলো গোপনে ভোগ করতে ছুটে যাবে?

আর ননীর এই এক জ্বালা, সব মেয়ের মধ্যে যেন কৃষ্ণারই মেয়েভাব, তার নারীত্ব, ফেমিনিটি—সব দেখতে পেয়েছে। যেমন মানুর ঠোঁট, হাসি, কানের পাশটা, গ্রীবা ও ঘাড়, হাতের চিরোল আঙুল, পা ফেলে চলা—সবেতেই। ননী ভেবেছে, কৃষ্ণাও তো এমন। গায়ের রঙ ও চেহারা আলাদা। কিন্তু কৃষ্ণাও মেয়ে এবং মেয়েদের মেয়েত্বটা এমনি কমন ননীর কাছে।

বিদ্যুৎ তাকে কথায়—কথায় পারভারটেড বলে। বলে, তোর এত পার্ভার্সান নোনে! কথাটা হয়তো ঠিকই। ননী মনে মনে আঁচ করেছে। তর্ক করেছে। তবু এর হাত থেকে রেহাই নেই। কৃষ্ণা তার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করছিল যেন। সারাক্ষণ মনে কৃষ্ণা। ক্লাসে পড়াতে পড়াতে হঠাৎ চমকে উঠে ভেবেছে, কৃষ্ণা এখন কী করছে এবং কোথায় আছে! একদণ্ড অবসর নেই আড্ডা মারার, রাস্তায় অকারণ কিছুক্ষণ হাঁটার, কিছু উপভোগ করার—খালি কৃষ্ণার কথা মনে পড়ে যাওয়া। তীব্র এক চাবুকের মতো। ঝিলিকের মতো। লাগামে টান পড়ার মতো।

এখন কৃষ্ণা নেই। ননী ইচ্ছে করলে সবকিছু করতে পারে। মানুকে চুমু খেতে পারে—এমনকী মানুর দিক থেকে বাধা না থাকলে আরও শারীরিক ঘনিষ্ঠতাও। ননী ঘামছিল।

মানু তার ডান ঊরুর ওপর চিবুক রাখলে ননী অবাক হল না। শুধু মনে হল, মানুর কোথাও একটা অসহায়তা আছে। তাকে এভাবে আঁকড়ে ধরার মধ্যে শোকগ্রস্ত ননীকে প্রেমিকার সান্ত্বনা থাকতেও পারে—কারণ, কাল বেআব্রু কৃষ্ণাকে ঢাকতে কীভাবে সে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল মনে পড়ে যায়—কিন্তু মানু তার বাইরেও বরাবর বুঝি কোনো গভীরতর আঘাত মুখ বুজে সয়ে এসেছে দিনের পর দিন এবং এই স্বাধীন নির্জন ঘরে নিশ্চিন্ত সুযোগে তাই প্রকাশ করছে। আঘাতটা কীসের হতে পারে ননী হাতড়াচ্ছিল। বৈষয়িক—পারিবারিক? কিংবা অন্য কিছু? জনকে নিয়ে তার মা চলে যাওয়ার মধ্যে কি কিছু আছে?

ননী আড়ষ্ট হতে ওর কপাল থেকে চিবুকঅব্দি ছুঁয়েই নড়ে উঠল। মানু, তুমি কাঁদছ? কী ব্যাপার? ননী বলল।

মানু আস্তে বলল, না।

তুমি কাঁদছ! ননী শক্ত গলায় বলল। কেন মানু? মা কি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে জনকে নিয়ে গেছেন?

না।

নিশ্চয় তাই। ননী একটু হাসবার চেষ্টা করল। তাতে কাঁদবার কী আছে? রাগ পড়ে গেলে আবার ফিরে আসবেন।

মানু চিবুক ননীর ঊরুতে বিদ্ধ করে জোরে মাথাটা দোলাল। তারপর আরও জোরে একটা গরম নিশ্বাস ফেলল। ননীর মনে হল প্যান্টের ও আন্ডারওয়্যারের কাপড় ভেদ করে তার ঊরুর মাংসকে জ্বালিয়ে দিল মানুর ওই নিশ্বাস।

তখন ননী বলল, কৃষ্ণার জন্যে তোমার কষ্ট হচ্ছে বুঝি?

মানু জবাব দিল না সঙ্গে সঙ্গে। আস্তে আস্তে ঘুরে সে চিত হল এবং ননীর ডান ঊরুর ওপর মাথা রাখল। তার চুলগুলো ছড়িয়ে ঝুলে রইল ননীর হাঁটুঅব্দি। ননী তাকাল তার মুখের দিকে। জ্বলজ্বলে সেই রকম দৃষ্টি—অপ্রকৃতিস্থ মতো। কেমন গা—ছমছম করা চাহনি। ননী বলল, কী মানু?

মানু ফিসফিস করে রুগণ মেয়ের মতো বলল, আজ তুমি…তুমি আমাকে একটু আদর করো।

ননী নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। মাথার ওপর ঘড়ঘড় করে ফ্যানটা ঘুরছে। তবু ঘরে ভ্যাপসা গরম। আর গুহার মতো অন্ধকার।

করবে না?

ননী মুখটা সামান্য নামিয়ে বলল, তোমার কী হয়েছে মানু?

মানু ওর দুটো হাত টেনে নিল। তারপর নিজের গলায় রেখে নিজের দুটো হাতে চাপ দিতে দিতে বলল, তাহলে আমায় মেরে ফেলো তুমি। মেরে ফেলো। আমাকে শেষ করে দাও এক্ষুনি। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে হাঁপানির রুগির মতো ছটফট করে বারবার বলতে থাকল, গলা টিপে মেরে ফেলো আমাকে।

ননী আরও ঝুঁকে তার কপালে ঠোঁট রাখলে সে শান্ত হল।

ননী মুখ তুলে নিলে সে বলল, আমায় তুমি ভালবাসো, না ঘৃণা করো ননী?

হঠাৎ কেন একথা?

বলো, ঘৃণা করো, না ভালবাসো?

ননী একটু ইতস্তত করে বলল, কেন? ভালোবাসি। তোমাকে ঘৃণা করব কেন মানু?

তাহলে কথা দাও কোনোদিন ঘৃণা করবে না—যতদিন বেঁচে থাকব। যা কিছু ঘটুক—কিছুতেই ঘৃণা করবে না বলো?

বলছি।

না—অমন করে নয়। বলো, তোমায় ঘৃণা করব না।

তোমাকে ঘৃণা করব না। ননী ঠান্ডা গলায় আবৃত্তি করল।

আমাকে ছুঁয়ে বলছ?

বলছি।

মানু দ্রুত উঠে বসল। আঁচল দিয়ে চোখ—মুখ স্পঞ্জ করে ননীর পাশে পা ঝুলিয়ে বসল। তারপর চুল বাঁধতে বলল, খেয়েছ। কোথায় খেলে?

হোটেলে। বলে মাথা নেড়ে এতক্ষণে সিগারেট বের করতে গিয়ে দেখল, প্যাকেটটা চেপ্টে সিগারেটগুলোর অবস্থা শোচনীয়।…