কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি – ৭

স্টেশন কোয়ার্টারে প্রাক্তন ছাত্রী রেবার ঘরে ঘণ্টাকয় কাটিয়ে এবং প্রচুর সন্দেশ খেয়ে ফেলু গোঁসাই যখন বেরুলেন, তখন বিকেলের রঙে ঘোর ধরেছে। আজ আকাশটা পরিষ্কার। দিনটাও মোটামুটি ঠান্ডা গেছে। শহরের পুবটেরে এই এলাকাটা গাছাপালায় ঠাসা। এখন বসন্তকাল। রাস্তায় গুঁড়ো সোনার মতো এখানে ওখানে আমের মুকুল ছড়িয়ে আছে। কালকের ঝড়জলে কেলেঙ্কারি করেছে। এবার আর আমের আশা বৃথা। রেললাইনের ধারে ধারে হেঁটে এসে হাইওয়ের ফটকের কাছে একবার দাঁড়িয়ে গোঁসাই হরিপদ বেসকার খোঁজ নিলেন। ফটকঘরের পিঠ ঘেষে একটা আমগাছ আছে। খুব ভালো জাতের আম হয়। চ্যাপটা প্রকাণ্ড বাতাসার মতো দেখতে। পাকলেও খোসা সবুজ থাকে, কিন্তু ভেতরে এক ইঞ্চি হলদে শাঁসের তলার আঁটি অব্দি আধ ইঞ্চি গোলাপি মাস—যেন রঙ করা ক্ষীর। হরিপদর ভাগ্নে কালি বা কালিপদ ভালো তবলা বাজাত। গোঁসাইয়ের ছাত্র ছিল। এখন নেভিতে চাকরি করছে। কিন্তু হরিপদ আর তার বউ গোঁসাইকে এখনও প্রচণ্ড খাতির করে। দেখলেই মাগ—মরদে সাষ্টাঙ্গে মিনিটখানেক প্রণাম করে। ওটা আদিবাসী প্রথা। গত বছর দুপুরবেলা ওই গাছের আম যা খাইয়েছিল, ভোলার নয়। নাম বলেছিল বাতাসাভোগ। গোঁসাই গাছটার দিকে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে হরিপদর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। হরিপদর বউ মালতী একটা মোড়া এনে বলল, বোঁইসেন ঠাকমশা, বোঁইসেন।

বসে থাকতে—থাকতে সাড়ে পাঁচটার আপ ট্রেন পাস করে গেল। ফটক এঁটে সবুজ নিশান নাড়ছিল হরিপদ। ট্রেন স্টেশনে গিয়ে ঢুকলে ফটক খুলে দিয়ে ফিরল। তারপর একগাদা পাথরকুচির ওপর বসে বলল, আর সুখ নেই ঠাকমশা। কিছুতেই ভি সুখ নেই।

উদাস চোখে তাকিয়ে গোঁসাই বাতাসাভোগের গাছটা দেখতে দেখতে মুচকি হেসে বললেন, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।

উঠোন মানে ফটকঘরের সামনে লাইনঅব্দি কয়েক মিটার জায়গা। তার মধ্যে তারের দোমড়ানো বেড়া আছে। ঝাঁকড়া একটা জবাগাছও আছে, লাল টকটকে বড়ো—বড়ো ফুলে ভরা। একটা ধাড়ি ছাগল আর দুটো বাচ্চা আছে তার গুঁড়িতে বাঁধা। কয়েকটা মোরগ—মুরগি আছে। কালী থাকলে মামা—মামিকে লুকিয়ে ওস্তাদজীর সেবায় লাগাত। সেই কালীর কথাও হল কিছুক্ষণ। কালী গতমাসে এসেছিল। কোচিনে থাকে এখন। সায়েব হয়ে গেছে একেবারে। গোঁসাই দেখলে আর চিনতেই পারবেন না।

গোঁসাই বললেন, হ্যাঁ হে, হরিপদ, ভাগ্নের বিয়েটা দিচ্ছ কবে? আমার যে খাওয়া হচ্ছে না প্রাণভরে।

হরিপদ মুখ গোমড়া করে বলল, কালিয়া? হু’ গ ঠাকমশা! বোঁইসে আছে কালিয়া। কখন—কবে!

তার বউ হেসে উঠল। বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, হাঁপানোর খাওয়া বাঁদ গেইস্যে গ ঠাকমশা। কালিয়া বিভা কোঁরেসে। বহুঁ লিয়েই তো এঁস্যেছিলোক গ।

সে কী? কোথায় বিয়ে করল কেলো? গোঁসাই হাসতে লাগলেন। কী বিপদ!

হরিপদ বলল, ভিনজাতে গ ঠাকমশা। তা বহুঁঠো পাসকরা মেয়্যাঁ! বহুৎ লিখাপঁড়হ।

ফটকঘরের বাঁ পাশে হাইওয়ে বেরিয়ে গিয়ে দক্ষিণে ঘুরেছে। মাঝে মাঝে শব্দ করে চলে যাচ্ছে প্রকাণ্ড ট্রাক কিংবা বাস। অন্য দিন ধুলোয় বসা যেত না এখানে। কাল ঝড়জলে ধুলোটা মরেছে। গোঁসাই ঘাড় ঘুরিয়ে হাইওয়ের ওপাশে ঝিলের দিকটা দেখছিলেন। হঠাৎ বললেন, ও হরিপদ, ওখানে পুলিশ ঘুরঘুর করছে কেন? আবার লাশ পড়ল নাকি?

হরিপদ ঘুরে দেখে বলল, না গ, শুনি নাই তো। মালুম ইংকুয়েরি করছেক।

তাই বটে। গোঁসাই দেখতে থাকলেন। একজনের পোশাক পুলিশের—নিশ্চয় দারোগা—টারোগা। অন্যজন ধপধপে পায়জামা আর সাদা পানজাবি—পরা। মাথাটা প্রায় ন্যাড়া। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, গোঁফটা ভারি ডাগর। হাতের তালুতে খৈনি ডলে ফুঁ দিল। গোঁসাই বললেন, কী বিপদ! ও হরিপদ, জানো? যে মেয়েটার লাশ ওখানে পড়েছিল, তার আমারই কাছে গান শেখার কথা ছিল। বড় ঘরের মেয়ে হে। কাল বিকেলে আমার সঙ্গে কথা বলে ফেরার সময় কার পাল্লায় পড়ে প্রাণটা খোয়াল। আহা রে!

গোঁসাই জিভ চুকচুক করলেন। হরিপদর বউ মালতী মুখে থমথমে ভাব ফুটিয়ে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ এক পা বাড়িয়ে চাপা গলায় বলল, ঠাকমশা! ঝড়ির সোঁমোয়ে আমি উঁই ছাগলীঠোকে ঢুঁড়তে গেঁসলেক। তো…

হরিপদ তক্ষুনি কড়া ধমক দিল, চুঁপ থাক। চুঁপ থাক। ফাঁড়িস নাই।

গোঁসাই কান খাড়া করে বললেন, আমাকে বললে কী হবে? আমি তো তোমাদেরই লোক। আর কাউকে বোলো না, ব্যস!

হরিপদ ফিসফিস করে বলল, বেঁশি কথা কী ঠাকমশা! হুঁই পল্টন ময়দানে দুই ব্যাটা ভটভটিয়া লিয়ে চক্কর দিঁইসিলে। ঝড়ির সুমায়তে।

বুঝলুম। ঝড়ের সময় দুই হারামজাদা ভটভটিয়া চেপে চক্কর দিচ্ছিল। তারপর?

মিঁয়্যাঠো যিদিকে যায়—হরিপদ জোর দিয়ে বলল, যিদিকে যায়—উঁয়ারা চক্কর মেরে আসেন।

মালতী বলল, আর আমি ছাগলীঠোকে ঢুঁড়ি। ঢুঁড়তে ঢুঁড়তে দেখি, কী করেক উঁয়ারা। তো মেঁয়্যাঠো ঠোক্কর খাঁই পড়ে গেঁলেক।

বেশ, বেশ। মেয়েটা আছাড় খেল। তারপর?

হরিপদ বলল, তো ঝড়ি বহুৎ বাঁঢ়ি গেঁসলেক। বহুঁ ছাগলীঠোকে লিয়ে চলে আসলেক। শিল ভি দড়বড়ায়ে পঁড়ছিলেক। আর কুছু দেঁখে নাই বহু। ব্যাস!

গোঁসাই জিভ চুকচুক করে আনমনে উঠে দাঁড়ালেন। হরিপদ! আমাকে যা বললে, বললে বাবা। আর কাকেও বোলো না। ঝামেলায় পড়বে। কী দরকার বাবা! সুখের অন্ন নুন ছিটিয়ে খাও, বেরালের চোখ গরম দেখবে কেন? চলি। বউমা, চলি রে মা!

মালতী উঠোন থেকে ন্যাংটো বাচ্চাটা কোলে তুলে নিয়ে একটু হেসে বলল, আমার ই পুকড়াঠো এত্তা বড়ো হুঁয়ে হাঁপোনোর কাছে গান শিকবে ঠাকমশা। হু শিঁখাই দিবেন আঁচ্ছাসে।

গোঁসাই বাতাসাভোগ গাছটার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।….জরুর! বলে পা বাড়ালেন। মালতী ছেলেকে আদর করে সুর ধরে বলতে থাকল, কেত্তো গান শিখবেক রে! ছিলেমাবাজী কোঁরবেক রে! ঠাকমশার কান কাঁটবেক রে!

হাইওয়েতে যেতে যেতে গোঁসাই গুন গুন করে উঠলেন পূরবীর সুরে। মনটা থেকে—থেকে কেমন করে উঠছে। মনে হচ্ছিল, জীবনটা এবার জমজমাট হয়ে উঠবে—যা সব আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছে এখানে ওখানে। বড়ো রকমের একটা আখড়া গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আচায্যিপাড়ার বাড়িটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। অথচ কেন যেন সারাক্ষণ কোথায় একটা সূক্ষ্ম অতি—মিহি তারে অন্য একটা সুর বেজে উঠছে।

মেয়েটি কাল কীভাবে যে প্রণাম করল, পায়ে মাথা রেখে। একটা বেণী এসে ডান পায়ে পড়েছিল। সেইখানটা এখনও শিরশির করে। আর নাকে তীব্র একটা সুগন্ধ ঢুকে গেল কাল বিকেলে। বেরুচ্ছে না, স্নায়ুর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। গুনগুনিয়ে পূরবী ভাঁজতে ভাঁজতে গোঁসাই নাক উঁচু করে সেই সুগন্ধটা শুঁকছেন। হ্যাঁ, সেই মিষ্টি তাজা মন—কেমন করা গন্ধ। জিয়াগঞ্জের আখড়ার ওস্তাদ মেহের খান একরকম আতরভেজা তুলো কানের ওপরকার ভাঁজে রাখতেন। ঘর সারাক্ষণ ম’ম’ করত। আরে বেটা, মন প্রফুল্ল না থাকলে সুরের দেবদেবীদের দেখা পাবি কেমন করে? জেরা সে খুঁশবো লে লো, মন প্রফুল্ল করো। তব না? সুগন্ধের এই গুণ। তোমাকে বিষণ্ণতা থেকে সরিয়ে আনন্দে নিয়ে যায়। মৌজমে রও বেটি! গোসাইয়ের এক মন পূরবী গাইছে। অন্য মন সেই মেয়েটিকে দেখে বলছে, মৌজমে রও বেটি। বড় অবাক লাগে গোঁসাইয়ের—মেয়েটি গন্ধময়ী হয়ে এসেছিল এবং পায়ে লুটিয়ে প্রণাম করেছিল। ওর হত। আলবৎ হত। ওর গায়ের রঙটা একটু শ্যামলা ছিল, মুখশ্রীও তেমন কিছু না—একটু রোগা, পোড়খাওয়া চেহারা। কিন্তু সচরাচর বিয়ের যোগ্যতা হিসেবে গানের সার্টিফিকেট জোগাড় করতে যারা গোঁসাইয়ের কাছে আসে, ও তাদের দলের নয়। চোখ দুটো কী উজ্জ্বল ছিল ওর! সব মনে পড়ে যাচ্ছে গোঁসাইয়ের। আর এই যেন এক বিচিত্র নিয়ম ঈশ্বরের রাজ্যে, একদিকে যাকে বঞ্চিত করা হয়েছে—অন্যদিকে তাকে পুষিয়ে দেওয়ার আয়োজন। ষষ্ঠিতলার বলাই। জন্মান্ধ ছেলে। কী অপূর্ব গায়, আর কী দারুণ তবলার হাত—লহরা শোনো চোখ বুজে। মনে হবে জ্যোৎস্নার রাতে পাহাড়ি ঝরনার ধারে একা দাঁড়িয়ে আছ। হুঁ, মেয়েটির হত। ঈশ্বর ওকে হয়তো স্বাস্থ্য বা রূপে বঞ্চিত করেছিলেন, কিন্তু তেমনি গুণেও পুষিয়ে দেবার আয়োজন রেখেছিলেন। কিন্তু বড় লাজুক মেয়ে। অত করে মানু সাধল, গোঁসাইও বললেন, মুখ খোলানো গেল না। গোঁসাই তানপুরায় ঝঙ্কার দিলেন। তীক্ষ্ন দৃষ্টে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন দেখতেও পেলেন, সুরের দেবী আসবেন বলে গাছে—গাছে ফুল ফুটতে শুরু করেছে, পাখিও ডাকছে—কিন্তু বড়—বড় লাজুক মেয়ে। অবশ্যি, ফেলু গোঁসাইয়ের সামনে মুখ খুলতে কত পাকা গাইয়েও ঘাবড়ে যায়, ও তো নিতান্ত কচি এক মেয়ে।

দুঃখে গোঁসাইয়ের মন আচ্ছন্ন। চড়া মা গা নি সা হয়ে গভীর এক মোচড় দিয়ে আহত কলজে চেপে ধরার ভঙ্গিতে পলা ও মুক্তো বসানো আংটি সমেত একটা হাত বুকের ওপর ধরলেন। অবরোহে কড়ি ও কোমল গাতে ঘুরতে ঘুরতে সেই হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিলেন সা—এর দিকে গভীর গাম্ভীর্যে।

একটু দূর থেকে কাঠগোলার সামনে দাঁড়িয়ে ভানুবাবু দেখছিলেন গোঁসাই আসছেন। মহা পাগল। রাস্তায় আপনমনে হাত নাড়তে নাড়তে আসছেন। বস্তি এলাকা হলে নির্ঘাৎ এতক্ষণ ছেলেপুলের পাল পেছনে লাগত। ভানুবাবু ডেকে বললেন, ছক্কাদা! গোঁসাইজী আসছেন। যন্তর টন্তর সাজিয়ে বোসো।

ভানুবাবুও একসময় ছাত্র ছিলেন গোঁসাইয়ের। তাঁর পার্টনার ছকড়িবাবুরও ওই রোগ আছে, তবে গোঁসাইয়ের ছাত্র নন। এখন ভানুবাবুর বয়স হয়েছে। তাতে কাজকর্মের চাপ। আর তত নেশা নেই। কিন্তু ছকড়িবাবুর আছে। গোঁসাই সকালে এসে টের পেয়ে গেছেন, একজন পয়সাওয়ালা ছাত্র টোপ গিলতে ছটফট করছে। তাই ফের এবেলা আগমন।

ভানুবাবু বললেন, আসুন গোঁসাইজী। আপনার কথাই ভাবছিলুম।

গোঁসাই কেমন গম্ভীর। একটু হেসে বললেন, এলুম ফের ঘুরতে ঘুরতে। ব্যস্ত আছ নাকি?

আজ্ঞে না। আসুন, আসুন।…বলে পায়ের ধুলো নিলেন ভানুবাবু।

পেছনদিকে খোলামেলায় কাঠচেরা করাতকলের টানা শিসদেওয়ার মতো শব্দ হচ্ছে। ছকড়িবাবু সেখান থেকে দৌড়ে এসে পা ছুঁলেন গোঁসাইয়ের। গোঁসাই বললেন, তোমাদের এখানটা—সব ভালো, তবে বড্ড আওয়াজ।

দুই পার্টনার হাসলেন। একটা মোষের গাড়িতে কারা তক্তা বোঝাই করছে। ওপাশে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। লোকেরা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গুঁড়ি নামাবে। হেঁইও হেঁইও বুলি আওড়াচ্ছে। গোঁসাই ভেতরে ঢুকে উঁচু গদিতে তুলে বসলেন। ছকড়িবাবু বললেন, এক মিনিট গুরুজী। শিলিগুড়ি থেকে ট্রাক এসেছে। একবার চোখ বুলিয়েই চলে আসছি। অপরাধ নেবেন না।

ভানুবাবু বললেন, দুধ খাবেন গোঁসাইজী। পাঠাব নাকি?

গোঁসাই ঘাড় নাড়লেন। নাঃ।

শরীর খারাপ নাকি?

না হে! এমনি।….তারপর তাকিয়াটা টেনে কোলে গোঁসাই ঝিলের দিকে তাকালেন। পুলিশ দুজনকে আর দেখতে পেলেন না। একটু পরে বললেন, এক কাণ্ড হয়েছে জানো ভানু?

ভানুবাবু পাশে পা ঝুলিয়ে বসে বললেন, আজ্ঞে?

সকালের ওই ডেডবডিটা…

হু! সে তো দশটা সাড়ে—দশটা নাগাদ মর্গে নিয়ে গেল। এতক্ষণ হয়তো দাহের জোগাড় হচ্ছে।

গোঁসাই আনমনে বললেন, ভানু! কাল বিকেলে ওই মেয়েটা আমার কাছে গিয়েছিল, জানো?

বলেন কী?

হ্যাঁ। আমার কাছ থেকে ফেরার পথে ঝড় উঠল। আর সেই সময় পল্টনের মাঠে দুই শালা শুয়োরের বাচ্চা….

ভানুবাবু দ্রুত চাপা গলায় বললেন, খুলে বলুন তো একটু?

গেটকিপার হরিপদর বউ দেখেছিল বলল। ভটভটিয়া চেপে দুই শালা মেয়েটাকে তাড়া করছিল নাকি।

ভানুবাবু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি দেখিনি। তবে জানেন, ঝড়ের সময় ওদিকে আওয়াজ পাচ্ছিলুম বটে। একটু আশ্চর্য লেগেছিল। ওখানে ঝড়ের সময় কেউ মোটর সাইকেলে ঘুরবে, ভাবতে পারিনি তো। তাই মনে হচ্ছিল, রাস্তায় লরি—টরি যাচ্ছে। কিংবা কানেরও ভুল। কিন্তু আওয়াজ যে সত্যি শুনেছিলুম, আপনার কথায় তা বোঝা যাচ্ছে।

হঠাৎ ফেলু গোঁসাই নড়ে উঠলেন। ভানু আমি চলি আজ।

সে কী! এসেই চলে যাচ্ছেন কেন? একটু চা—ফা খান অন্তত।

না হে। আমার কিছু ভালো লাগছে না মাইরি। ….বলে গোঁসাই নেমে চটি জুতোয় পা গলালেন।

ভানুবাবু বললেন, আহা, যাবেন কোথায়? এখানেই বসুন নিরিবিলি। মন ভালো হবে।

গোঁসাই বললেন, শ্মশানে গিয়ে বসে থাকি গে। মেয়েটিকে আবার একবার দেখবার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে বেটা।

ভানুবাবু পেছন পেছন গিয়ে বললেন, কী মুশকিল। সে কি আর এতক্ষণ আছে?

যাই তো! বলে গোঁসাই লম্বা লম্বা পা ফেলে রাস্তা ধরে শহরের দিকে এগোলেন। ছকড়িবাবু কিছু বলার চেষ্টা করলেন, গোঁসাইয়ের কান নেই। ভানুবাবু ইশারায় ছকড়িবাবুকে বললেন, যেতে দাও।

সূর্য ডুবেছে সবে। পশ্চিমে ভাগীরথীর আকাশে লালচে ব্যাপকতায় বৈরাগ্যের ঘোর লেগেছে যেন। মুখ উঁচু করে হাঁটছিলেন ফেলু গোঁসাই। বিশাল মানুষ। লম্বা কালো স্প্রিং করা চুল কাঁধ ও পিঠে এসে দুলছে। আজ সেজেগুজেই বেরিয়েছিলেন। পরনে চুস্ত পাজামা, গায়ে লখনউ ছাঁটের চিকন কাজ করা পানজাবি। তার ওপর ঘিয়ে রঙের তেমনি চিকন কাজ করা একটা জহরকোট। মুখটা মেয়েদের মতো মাকুন্দ ও লাবণ্যময়। উজ্জ্বল ফর্সা রঙ। মুখে দিনশেষের ছটা পড়েছে। তাকিয়ে দেখার মতো মানুষ। ঠোঁট দুটো কাঁপছে—তার মানে, ফের পূরবী গুমরে উঠেছে বুকের ভেতর।

ওয়াটার ট্যাংকের কাছে এসে রিকশো করলেন। তারপর সোজা শ্মশানে।….

ননী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। কৃষ্ণার চিতা নিভে গেছে। পাড়ার ছেলেরা একে একে চলে গেছে। ননী মানুর কথা ভাবছিল। সেই যে চলে গেল দুপুরে থানা থেকে, আর এল না মানু। শরীর খারাপ হচ্ছে বলেছিল। অত ঘোরাঘুরি ছোটাছুটিতে বেচারি নিশ্চয় অসুখ—টসুখ বাধিয়ে ফেলেছে। ননী ধরে নিল, জ্বর—টর এসেছে। তাই আসতে পারেনি। শুয়ে আছে লেপ মুডি দিয়ে।

যাব? ননী ভাবছিল। যাবে একবার খোঁজ নিতে? কিন্তু ইচ্ছে করছে না। কিছুই ইচ্ছে করছে না—না পা বাড়াতে, না কিছু করতে। কিচ্ছু না। তার চেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ননী যদি গাছ হয়ে যেত।

আচ্ছা, একটা কথা বলতে পারেন।

ননী ঘুরে তাকাল। চেনা মনে হল ভদ্রলোককে। মানুর পিসেমশাই ফেলু গোঁসাই।

একটা মেয়ে—মানে ঝিলের ধারে মার্ডার হয়েছিল…

ননী বলল, আমার বোন। ওই দেখুন! ননী হাতটা নিভে যাওয়া চিতার দিকে তুলে রইল কিছুক্ষণ।—