কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি – ৬

সুপ্রভা বাইরে রোয়াকে বসে ঝিমোচ্ছিলেন। গোঁসাইদাকে খাইয়ে দিয়েছেন। উনি তাকিয়ায় স্প্রিং করা লম্বা চুল দু’ধারে ও পেছনে সাবধানে সরিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছেন ঘরে। পাশে তানপুরাটা আছে। একটা হাত তার গায়ে। অন্য হাতে একটা বৃহৎ পাঁজি বুকের ওপর রেখে এখন নাক ডাকাচ্ছেন। মদনমোহনতলা এলাকা পাড়াগাঁয়ের মতো শান্ত নিঃঝুম। গাছগাছালি আছে। পাখপাখালি ডাকে। একটু দূরে খালের ওপারে পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ডে খাটালের গোরু—মোষ চরে বেড়ায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সেনাব্যারাক ছিল ওখানে। মাঠের চারদিকে ইঁটের স্তূপে জঙ্গল গজিয়ে আছে। শোনা যাচ্ছে ময়দানে বিদ্যুতের সাব—স্টেশন হবে। সেই সব কথা হচ্ছিল।

আসলে সুপ্রভা গোঁসাইদার কথায় তেমন আমল দেন না। একটু গপ্পে মানুষ বরাবর। নয় কে ছয় করতে ওস্তাদ। হুঁ, ননীর বোনকে কাল একবার দেখেই বলে দিলেন ঝিলের ধারে সেই খুন হয়ে পড়ে আছে। তবে এটা ভাববার কথা বইকি! আজকাল তো এই রকমই হচ্ছে। যেখানে—সেখানে মানুষ খুন হয়ে পড়ে থাকছে। মানুটার বুকের পাটা বড্ড বেশি। একা একা চলাফেরা করে। বেশি বললে বাঁকা হেসে বলবে, কেন? ঘরে তো গুণ্ডামস্তান পুষে রেখেছ। আমার গায়ে হাত দেবে ক্ষমতা কার? গুণ্ডা ছুরি উঁচিয়ে সামনে দাঁড়ালে বলব, আমি জনের দিদি। ব্যস! জন শুনতে পেলে চোখ নাচিয়ে বলে, বলেই দেখিস না। পায়ের ধুলো নেবে সব শালা।

না, না। মানু একটু বাড়িয়েই বলে জন সম্পর্কে। এ বয়সে আজকালকার ছেলেরা একটু দুষ্টমি করছে হয়তো, সেটা যখনকার যা রীতি। তাই বলে জন কি গুন্ডা? গুন্ডারা চোর—ডাকাত হয়। জন আজ অবধি কারও হরেহম্মে খায়নি, সুপ্রভা দিব্যি কেটে বলতে পারেন। পয়সা—কড়ির জন্যে যা জুলুম করার, তা মায়ের ওপরই করে। টানতে টানতে ব্যাঙ্কের চেক লেখায়, নয় তো পোস্টাপিসে নিয়ে যায় মাকে। তবে হ্যাঁ, জন যাকে বলে ডানপিটে। এই দেখ না, কাল রাতে কার সঙ্গে মারামারি করে রক্তারক্তি করে এসেছে। এমন ছেলে, কাকেও কিছু জানাবে না। কিছুক্ষণ আগে খাবার জন্যে সাধাসাধি করতে গিয়ে চোখ পড়েছিল সুপ্রভার। অনেক কথা খরচ করে জানতে পেরেছেন, পল্টের সঙ্গে এক হাত লড়েছে। মেয়েমুখো পল্টে বজ্জাতের শিরোমণি। তক্ষুনি জনের সঙ্গে মারামারি করবে, তক্ষুনি এসে প্যাঁচার মতো মুখ করে এসে বলবে, মাসিমা, আচার খাবে গো! কিন্তু মানুকে দেখলেই কেটে পড়বে জিভ কেটে। মানুকে কেন যেন ভয়—ভয়।

পল্টুর বাবা অঘোর বাঁড়ুয্যে ডাক্তার। কোয়াক ডাক্তার নেহাত। এক সময় হাসপাতালে কম্পাউন্ডারি করতেন। চুরি করে ওষুধ বেচার জন্যে ধরা পড়ে চাকরি গিয়েছিল। জনের বাবার সঙ্গে ডি এম ও—র খাতির ছিল। ওঁদের বাড়ির ছবি—টবি প্রচুর তুলতেন কি না। শেষে জনের বাবাকে অঘোর এসে ধরাধরি করে ডি এম ও—র কাছে নিয়ে যান। হাতকড়া পরতে হয়নি। কিন্তু চাকরিটি গেল। অনেক ভোগান্তির পর অঘোর ডিপেন্সারি খুলে বসলেন খালের এপারে মদনমোহনতলায়। পসার মোটামুটি মন্দ হয়নি। বাড়ি করেছেন। সম্প্রতি স্কুটার কিনেছেন। দুমেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আর চাই কী। শুধু পল্টুটারই কোনো সংগতি করতে পারলেন না। মহা খচ্চর ছেলে। বাবা রুগি দেখতে যাবেন বলে স্কুটার খুঁজতে গিয়ে দেখেন, নেই। কখন চাবি হাতিয়ে নিয়েছে। সেবেলার মতো কোথায়—কোথায় হয়তো হাইওয়েতে তেল পুড়িয়ে নিকেশ করছে। জনের কথায় বোঝা গেছে, অঘোর ডাক্তারের স্কুটার নিয়েই পল্টুর সঙ্গে মারামারি। তবে আঁচড়গুলো সবই পল্টুর নয়। চাকা স্লিপ করে ঝোপে গিয়ে পড়েছিল। জন ব্যাকে ছিল। কাঁটায় ছড়ে গিয়ে ফুঁসছে, আর পল্টু নাকি হি হি করে হাসছে। এটাই টলারেট করা যায় না—এই হচ্ছে জনের বক্তব্য। তাই গালাগালি এবং একহাত হয়ে গেল শালার সঙ্গে। শালা মাগিমুখো আমার গলার চেন ধরে টেনেছিল। হাতে তেমনি ক্র্যাক পড়ে গেছে।

খেতে খেতে জন এসব কথা ঠারেঠোরে বলেছে। মানু বলে, জন সান্ধ্যভাষায় কথা বলে। ঠিকই বলে। একে অর্ধেক কথা মুখের ভেতর, তার ওপর বাকিটা অস্পষ্ট—পরিষ্কার অর্থ করা যায় না। জনের কথায় জানা গেছে, পল্টে বক্সিং লড়তে জানে না। মেয়েদের মতো আঁচড়ায়। আগের জন্মে শালা বেড়াল ছিল।…হুঁ তাই ছিল যেন বাবা। সুপ্রভার হাসি পেয়েছিল। পল্টের চোখ দুটো কেমন বেড়ালের মতো। কখন বাড়ি ঢুকে পিঠের কাছে এসে দাঁড়ায়, এতটুকু শব্দ হয় না। একটুকু না। তা হ্যাঁ রে, অঘোরদার কাছেই ব্যান্ডেজ করে নিলি বুঝি?

কী করবে? শেষে পল্টে মাগিমুখোটা নিজেই কেঁদে খুন। এই মাইরি বাবার কাছে চল। জন এক কেরিকেচার করেছে। মুখের ভাত ছিটকে পড়েছে সুপ্রভার গায়ে। শেষে বলে, আঘোরশালা মাইরি এক মাল। বললে, টিটেনাস নে এক্ষুনি। বলে এত্তোবড়ো সিরিঞ্জ বের করল। বাপস তারপর প্যাক করে চালিয়ে দিয়ে বলে কখনও আমার স্কুটারে চড়বি? ব্যাপার দেখে পল্টে আউট।…

রিকশোর ঘণ্টা শুনে সুপ্রভা তাকালেন। ঝিমুনি কেটে গেল। মানু রিকশো থেকে নামছে। এ কি চেহারা হয়েছে মানুর। সুপ্রভা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কাছে এলে কথা ফুটল মুখে। দেখতে গিয়েছিলি নাকি? ননী এল না যে? হ্যাঁ রে, মেয়েটা কৃষ্ণা নয় তো?

মানু মায়ের দিকে তাকিয়ে আস্তে বলল, হুঁ, কৃষ্ণা।

এ্যাঁ! সুপ্রভা শিউরে উঠলেন। চোখ বড়ো করে তাকালেন। ফের বললেন, হায় ভগবান! তা, ননী—ননী বুঝি খুব কান্নাকাটি করছে রে? আহা, কী ভালোবাসত না বোনটিকে। হ্যাঁ রে, ওকে ধরে নিয়ে এলিনে কেন মা?

মানু গলার ভেতর বলল, ও কী করে আসবে এখন? থানায় গেল ওদের সঙ্গে। সেই ওবেলা বডি ডেলিভারি দেবে হাসপাতাল থেকে। তারপর—তুমি খেয়েছ?

সুপ্রভা বিরক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। আমার পেট চলে যাচ্ছে না কি। খাব। আয়, চান—ফান করে নে। জল তুলে রেখেছি। আমার চান হয়ে গেছে কখন। তারপর থেকে খালি ঘর—বার করছি। আয়।

মেয়ের হাত ধরে সুপ্রভা ভেতরে নিয়ে গেলেন। গোঁসাই চিত হয়ে তেমনি নাক ডাকাচ্ছে। এ ঘরে সিলিং ফ্যান নেই। জন একটা টেবিল ফ্যান সস্তায় জোগাড় করেছিল। সেটা গোঁসাইয়ের সেবায় লেগেছে। জনের আপত্তি না হওয়ার কারণ আবহাওয়া। রাতে এখনও বেশ শীত—শীত করে। দিনের দিকে দুপুরে সামান্য তাপ লাগে বটে, কিন্তু ওর ঘরটার দক্ষিণ—পূর্ব জুড়ে জানালা। প্রচুর হাওয়া ঢোকে। ওদিকটা খোলামেলা জায়গা। একটা লিচুবাগান আছে।

ভেতরের বারান্দায় থামে হাত রেখে সুপ্রভা ফিসফিস করে বললেন, কী বুঝলি বল তো?

মানু বলল, কী বুঝব? গলা টিপে মেরেছে।

সুপ্রভা কথা কেড়ে আরও আস্তে বললেন, নিশ্চয় রেফকেস? তাই না?

মানু মাথা দোলাল।

সুপ্রভা জিভ কেটে বিষণ্ণ মুখে বললেন, হায় ভগবান। কত ভালো মেয়ে ছিল। কত ভালো স্বভাব চরিত্র। হ্যাঁ রে, কীভাবে অমন হল, কিছু বুঝলি? পুলিশ কী বলছে?

মানু সেকথার জবাব না দিয়ে বলল, জন আছে?

হুঁউ! এই তো কিছুক্ষণ আগে খেয়ে—দেয়ে বাবু ঘুমোতে গেল। কাল অঘোরদার ছেলে পল্টুর সঙ্গে মারামারি করেছে।…সুপ্রভা তেতোমুখে বললেন, স্কুটারে চেপে এসেছিল। ঝড়জলের মধ্যে চাকা স্লিপ করে…

মানু দ্রুত বাধা দিয়ে বলল, না।

সুপ্রভা চমকে উঠলেন ওর চোখ দেখে। মেয়ের এমন চাহনি কখনও দেখেননি সুপ্রভা—ঠিকরে আসা আগুনের আঁচ গায়ে লাগে, এমন। বললেন, না মানে? তারপর ফের ফিসফিস করে উঠলেন, কী রে মানু?

মানুর নাসারন্ধ্র কাঁপছে। চাপা গলায় বলল, কাল যখন কৃষ্ণা খালপোলের ওখানে যাচ্ছে, জন আর পল্টুকে নিবারণের সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলুম। এখন আমার সব মনে পড়ছে মা। মানু থাম আঁকড়ে ধরে সেই বাহুতে মুখটা কাত করে রাখল। কয়েক মুহূর্ত পরে সামলে নিয়ে কাঁপাকাঁপা স্বরে বলল, কৃষ্ণাকে একা পেলে জন জ্বালাত। কৃষ্ণা বলেছিল একবার। সে জন্যেই এ—বাড়ি আসতে বললে দোনামনা করত, জানো? ও কাল অমন করে এসেছিল শুধু গানের নেশায়। নইলে ওর দাদা মাথা ভাঙলেও হয়তো আসত না। এসেও কেমন তাড়াতাড়ি চলে গেল মনে পড়ছে না মা? যেন তক্ষুনি পালাতে পারলে বাঁচে।

সুপ্রভা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেছে।

কৃষ্ণা বেরুলেই রাস্তায় ওকে ফলো করত। এখন সব মনে পড়ে যাচ্ছে। সব মনে পড়ে যাচ্ছে। বলে মানু ফের থামে রাখা ডান বাহুতে মাথাটা রাখল। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা।

সুপ্রভা হঠাৎ নিষ্ঠুর গলায় বলে উঠলেন, বেশ। খামোকা নিজের ভাইটাকে ফাঁসি দেওয়াতে ইচ্ছে হয়েছে তো তাই দে। তোরা কি ভদ্রলোকের বংশ? আগের জন্মের কর্মভোগ করতেই তো জুটেছিলুম তোদের বংশে।

তারপর হনহন করে নেমে উঠোনে কাঁঠালগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ালেন।

ওইভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর মানু মুখ তুলে সোজা দাঁড়াল। থাম থেকে হাত সরিয়ে নিল। তারপর সোজা এগিয়ে গেল জনের ঘরের দরজায়। পর্দা তুলে দাঁড়িয়ে রইল। দরজা বন্ধ করে জন শুয়ে আছে।

মানু ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর ধাক্কা দিতে থাকল কপাটে। জনের কোনো সাড়া আসছে না।

ধাক্কার শব্দটা অস্বাভাবিক। মানু কি পাগল হয়ে গেল? সুপ্রভা দৌড়ে এসে মেয়েকে ধরলেন। তোর কি সত্যি মাথা খারাপ হয়েছে মানু? করছিস কী তুই? বাড়ি ভেঙে পড়ছে একেবারে। লোকে শুনছে। আ! ছি ছি ছি!

মানু আস্তে আস্তে মাকে ঠেলে দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, সরে যাও। আমাকে ফেস করতে দাও ওকে। কাওয়ার্ড! স্কাউন্ড্রেল! ইতর!

সুপ্রভা কাঁদো কাঁদো মুখে দুহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন!…সোনা মা! লক্ষ্মী মা আমার! চুপ, চুপ! কেলেঙ্কেরি হবে। আয়, তোকে চান করিয়ে দিই। ছেলেবেলার মতো খাইয়ে দিই। ছি ছি মা! বড় হয়েছ, এডুকেটেড মেয়ে! কত বুদ্ধিমতী তুমি! এমন করে?

না। ওর যদি সাহস থাকে দরজা খুলে দিক। আমার সামনে দাঁড়াক। দেখি, কেমন বুকের পাটা।

সুপ্রভা হু হু করে কেঁদে ফেললেন। তার চেয়ে আমাকে মার তুই। নে, মার!

মানু ধরা গলায় বলল, ফুলের মতো নিষ্পাপ একটা সরল মেয়ে। নিজের বোনের বয়সি। অনু এদ্দিন বেঁচে থাকলে কী হত? নিজের বোন বলেও ওই লম্পট পশু রেহাই দিত ভাবছ?

সুপ্রভা মেয়ের মুখে হাত দিলেন।

ওপাশের ঘর থেকে গোঁসাইয়ের আওয়াজ এল—কী হয়েছে রে? মাননসা খেপল কেন!

অমনি সুপ্রভা কপাল চাপড়ে ফিসফিস করে উঠলেন নে! হল তো এবার! রাজ্য জুড়ে বলে বেড়াবে। ওরে, আমি কি তোদের জন্যে বিষ খাব, না গলায় দড়ি দেব বল তো তোরা।

মানু দ্রুত নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। গোঁসাইয়ের চটি পরার শব্দ আসছে। একটু পরে ভেতরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। কই বেটি মা—মনসা? হলটা কী? ও সুপু।

সুপ্রভা কাঁচুমাচু মুখে হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আবার কী হবে ভাইবোনের ঝগড়া। এখনও সেই…

গোঁসাই কথা কেড়ে হেসে বললেন—সেই ট্রাডিশান সমানে চলিতেছে। বহুত আচ্ছা! সুপু, আমি বেরুচ্ছি রে ভাই। একবার পাটোয়ারিজীর গদিতে যাব। ওবেলা আমার জন্যে কিছু রেখোটেখো না খেয়ে আসব’খন। এক প্রাক্তন ছাত্রীর বাড়ি জেয়াফৎ (নেমন্তন্ন) আছে। সেই স্টেশনে। বুঝলে তো? হুঁ হুঁ, এ এস এম!

সুপ্রভা মাথা দোলালেন। গোঁসাই উঠোনে কলতলায় গেলেন।

মানু খাটের পাশে দাঁড়িয়ে ডাঁইকরা বালিশের ওপর ঝুঁকে আছে। সুপ্রভা উঁকি মেরে দেখে বললেন, যা। বেলা গড়িয়ে গেল যে! চান করে নে। খাবি কখন?

খাচ্ছি। তুমি খেয়ে নাও।

সুপ্রভা রাগ দেখিয়ে বললেন, আমার পেটে তো রাক্ষস পোষা। যা খুশি করগে মা! এই আমি শুয়ে পড়লুম। ইচ্ছে হবে, খাবে। না হয় খাবে না। আর তো সেই কচি খুকি নও যে জোর করে গেলাব।

ঝকঝকে মসৃণ লাল বারান্দায় আঁচল বিছিয়ে সত্যি শুয়ে পড়লেন সুপ্রভা। সারা গ্রীষ্ম ওভাবেই দুপুর বেলাটা কাটানো অভ্যাস। এ ঘরে সিলিংফ্যান আছে। ফ্যানের হাওয়া বরদাস্ত করতে পারেন না। গ্রামের মেয়ে। সেই কবে বিয়ে হয়ে শহরে এসে কাটাচ্ছেন এতকাল। কিন্তু কিছুতেই শহর জীবনকে ভালো লাগাতে পারলেন না। কথায় কথায় গ্রাম—শহরের তুলনা দেন। মানু ঠাট্টা করে বলত, মায়ের প্যারাডাইস লস্টের ব্যাপার। স্বর্গ হইতে পতন। পতন এবং মূর্ছাও!

মানু ভাবছে, কী করবে? তার জীবনে এ এক সাংঘাতিক সংকটকাল এসে গেছে অপ্রত্যাশিতভাবে। এই কয়েকটা বছর ধরে ননীর সঙ্গে পরিচয় আস্তে আস্তে এমন একটা জায়গায় তাকে এনে ফেলেছে, তার আর সরে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। ননী তাকে কী চোখে দ্যাখে, সত্যি সত্যি তার কোনো আবেগময় অনুভূতি জেগে আছে কি না, মানু স্পষ্ট বুঝতে পারে না। কখনও মনে হয়েছে, আসলে ননী একটু ভীরু স্বভাবের ছেলে। কৃষ্ণা ঠাট্টা করে বলত, লক্ষ্য করেছ মানুদি? দাদা তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারে না! ননী থাপ্পড় তুলে বলত, দাদার সঙ্গে জ্যাঠামি? মানু চোখ তুলে ননীকে বলত, বেশ তো! প্রমাণ করো যে কৃষ্ণার কনক্লুশ্যান মিথ্যে। তাকাও। ননী হাসতে হাসতে বলত, হিপ্নোটিজমে কী করে জানো তো? চোখে—চোখে তাকালেই তুমি আউট।

কী করব? মানু মনে মনে মাথা কুটছে। কী করবে মানু? এ বড় সংকটকাল। কোনো ভুল নেই যে জন আর পল্টুই এমন সাংঘাতিক কাণ্ড করেছে। সকালে তখন জনের প্লাস্টার দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার ইনটুইশান তাকে নাড়া দিয়েছিল। ওভাবে আঁচড় দিতে পারে শুধু কোনো বুনো পশু—পাখি আর মেয়েরাই। কোন মেয়ে পারে? না, যে নিজেকে বাঁচাতে চায়। আর কৃষ্ণার বাঁ হাতের তালুটা সে লক্ষ্য করেছে। চেরা দাগ ছিল একটা। ওটা জনের গলার মিহি চেনেরই দাগ। আর তার চেয়েও বড় কথা, কৃষ্ণাকে মরতে হয়েছে তার আক্রমণকারী চেনা জানা বলেই। জনকে কৃষ্ণা চেনে—পল্টুকে চেনে না। জনই মেরে ফেলেছে ওকে। মোটিভ খুব স্পষ্ট।

কিন্তু কী করবে মানু? জন তার সহোদর ভাই। বদমাশ খুনি জনের মা প্রাণ দিতে তৈরি। মায়ের আস্কারা না থাকলে জন মানুষ হত। মা—ই ওর মাথাটা খেয়েছেন। ছোট বোন অনুর মৃত্যুর পর থেকে মা জনকে নিয়ে পাগল।

মানুর হঠাৎ মনে হল, সে ননীকে আসতে দেখছে সামনে। অমনি বালিশের স্তূপ থেকে মুখ তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। একটা ব্যাপার ভারি অবাক লেগেছে মানুর। বোনের লাশ দেখার পর থেকে ননী যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। চাহনিতে অপ্রকৃতিস্থতা থাকাটা স্বাভাবিক এ সময়। কিন্তু তার হাবভাব, পা ফেলার ভঙ্গি, কণ্ঠস্বর সবই যেন অন্য এক মানুষের। আশ্চর্য, মানু ভেবেছিল—ননী যা ভীরু, কোমল মনের মানুষ, আকাশ—পাতাল ফাটিয়ে কান্নাকাটি করবে। বোন ছিল তার আত্মার একটা অংশ, মানু তো জানে। ননী মাথা ভাঙবে, কীভাবে তাকে সামলাবে—মানু অস্বস্তিতে ভুগছিল। কিন্তু ননী লাশটা দেখেই থমকে দাঁড়াল। বদলে গেল।

এস আই অরুণবাবু বারবার বলছিলেন, কাকেও সন্দেহ হয় না আপনার? ডোন্ট হেজিটেট টু টেল। আপনার কোনো ভয় নেই। বলুন! ননী স্থির তাকিয়ে জবাব দিয়েছে, আমার কাকেও সন্দেহ হয় না। ওরা যখন থানায় বসে আছে, একটু পরে একজন পুলিশ অফিসার কৃষ্ণার বইখাতাগুলো এনে টেবিলে রাখলেন। ননী একটা বইয়ে হাত রেখে বলল, হ্যাঁ কৃষ্ণারই। বইখাতাগুলো কালকের বৃষ্টিতে ভিজে কুঁকড়ে গেছে। ছেঁড়াখোঁড়া অবস্থা। মানু কৃষ্ণার রিস্টওয়াচের কথা জিগ্যেস করেছিল। খোঁজা হয়েছে। পাওয়া যায়নি। তবে এরিয়াটায় বড্ড জঙ্গল। অরুণবাবু বললেন, কিন্তু ওদিকে আপনার বোন ঝড়জলের সময় গেল কেন? ক্যান ইউ এক্সপ্লেন? ননী বলল, আমি কথায় কথায় ওকে বলেছিলুম, প্যারেড গ্রাউন্ড হয়ে গেলে শর্টকাট হবে। তার সঙ্গে মানু বলল, ঝড়—টড় আসছে দেখেই কৃষ্ণা হয়তো শর্টকাট করে গ্রাউন্ড হয়ে যাচ্ছিল। তারপর…

হুঁ, দ্যাটস রাইট। অরুণবাবু বলেছেন। তারপর গিয়ে পড়েছে বদমাইশের পাল্লায়। দি প্রব্লেম ইজ…আপনার উচিত ছিল রাতেই থানায় ইনফর্ম করা। বড্ড ভুল করেছেন ননীবাবু। অফ কোর্স, অরুণ নন্দী ইজ হিয়ার। ওয়েট অ্যান্ড সী। খড়ের গাদা থেকে সূচ খুঁজে বের করার অভ্যেস আছে আমার।

অরুণ নন্দীর হাসিটা কানে আসছে মানুর। জনের ক্ষতচিহ্নই জনকে ধরিয়ে দেবে। কিন্তু তারপর? তারপর ননীর মুখোমুখি হবে জনের দিদি কোন মুখে? ননীর চোখ—ওই বদলে যাওয়া নিষ্পলক লাল দুটো চোখ বলবে, মানু! তোমার কাছে পাঠিয়েছিলুম আমার বোনকে। তোমার ভাই তাকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলল গলা টিপে। তোমারই সহোদর ভাই, মানু! আর আমি কিনা তোমার কাছেই পাঠিয়েছিলুম আমার সহোদর বোনকে।…

মানু ভেঙে পড়ল বালিশের স্তূপে। হু হু করে কেঁদে বলতে থাকল, আমি পারব না। আমি পারব না।…