কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি – ৫

কৃষ্ণা কাল সেন্ট মেখে কলেজে গিয়েছিল। তারপর আর বাড়ি ফেরেনি। এখন কৃষ্ণা ঝিলের ধারে হিজল গাছের ছায়ায় কুঁচ ফল নাটাকাঁটা বুনো শিমের ঝোপে ভিজে দুর্বাঘাসের ওপর শুয়ে আছে। মুখটা কাত, জিভের ডগা আঁটো দাঁতের ফাঁকে বেরিয়ে আছে। ঠেলে ওঠা নীলচে চোখ। ফালাফালা শাড়ি, চেরা নীল শায়া, ব্রেসিয়ার অর্ধেক ছেঁড়া, এবং সাদা ব্লাউজের কয়েকটা ফালি সেঁটে আছে গায়ে। উদোম কুমারীর নাভির ওপর সবুজ ও হলদে ছেঁড়াপাতা কয়েকটা, বুকের ওপর খড়কুটো, কাদার ছোপ। বৃষ্টির ধারা গড়িয়ে যাওয়ার দাগ ইতস্তত শরীরের খাঁজে—খাঁজে। ডান পায়ের হাঁটু ভাঁজ করা এবং ঊরুর ওপর লাল ভেলভেটপোকা চুপ করে বসে আছে বিষণ্ণ। কৃষ্ণার ঠোঁটের ওপর, নাসারন্ধ্রে পিঁপড়ের সার। বাঁ পা সোজা ঢুকে রয়েছে কুঁচ ফলের ঝোপে। কিছু কুঁচ ফল সবে পেকে ফেটে টুকটুকে লাল গুচ্ছ উঁকি মেরেছে, বোঁটায় ঘন উজ্জ্বল কালো রঙ। দুই ঊরুর ফাঁকে চিকন দুর্বার মধ্যে কিছু ছড়িয়ে আছে—কাল সন্ধ্যার শিলাবৃষ্টি ইচ্ছেমতো মুঠোমুঠো ছড়িয়েছে কুঁচ ফল কৃষ্ণার শরীরে। তার একটা বেণী সাপের মতো বাঁ কাঁধের ওপরদিকে বাঁকা হয়ে পড়ে আছে। সম্ভবত শেষরাতে একটা মাকড়সা সেখানে গেরো দিয়ে জাল বুনতে শুরু করেছিল—ছিঁড়ে গেছে কোনো জন্তুর খুরে। সেখানে ভেজা মাটিতে টাটকা কয়েকটা খুরের দাগ। শিবু ধোপা বলেছে, খাটালের মোষ ঝিলের ধারে চরতে এসেছিল। তাদের ফোঁসফোঁসানি শুনে তার এদিকে নজর পড়ে। শিবু আজ কমজোর হয়ে গেছে। পাটায় কাপড় আছড়ানোর তাকত নেই।

কাল যখন কৃষ্ণা বেরিয়ে গেল, ননী তাকে দেখে বুঝতে পারেনি কৃষ্ণা এভাবে ঝড় শিলাবৃষ্টি আর দীর্ঘ এক অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে রাতে এখানে শুয়ে কাটাবে। ননীর এই বরাত। সে বিস্ফোরণের আগের অবস্থাটা দেখতে পায়, কিন্তু কিছু টের পায় না। কৃষ্ণা কোথায় শুতে যাচ্ছে গায়ে সুগন্ধ নিয়ে, কেন ননী টের পায়নি?

কাঠগোলার ভানুবাবু ননীর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ছায়ায় আসুন। যত দেখবেন, তত কষ্ট হবে। এক্ষুনি পুলিশ এসে যাবে। কখন খবর পাঠিয়েছি।

ছোট্ট একটা ভিড় জমেছে। কেউ দেখেই শিউরে উঠে চলে যাচ্ছে। কেউ দৌড়ে আসছে ঝিলের ওপাশে পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ড পেরিয়ে। মানু ধোপাদের ঘাটে কাপড় চাইতে গিয়েছিল। পরের কাপড়, ওরা দেবে কেন? খাটালের দিকে চলে গেছে। হতভাগী মেয়েটার আব্রু ঢাকার কথা যেন ইচ্ছে করেই ভুলে গেছে এই লোকগুলো! তবে আপত্তিটা ভানুবাবুরই। ডেডবডি অ্যাজ ইট ইজ থাকা উচিত। আগে পুলিশ এসে দেখুক। আরে বাবা, ডেড ইজ ডেড। তার আব্রু কী, আর ইজ্জতই বা কী? মনকে শক্ত রাখা দরকার। মা—বোন কি আমাদের নেই?

ননী নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল কৃষ্ণার দিকে। কোথাও ক্ষত চিহ্ন নেই। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আছে। জিভও। নাকে ও কষায় হয়তো রক্ত ছিল। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে।

কাল ননী ইসমিলকে দেখার পর কতবার নিজের গলা চেপে শ্বাসকষ্ট টের পেতে চাইছিল। যে প্রাণের শেষ হওয়ার সময় হয়নি, তাকে জোর করে শেষ করাটা কতটা ভয়ংকর মনে হচ্ছিল। আর বরাবর, অবচেতনায় ভূতের ভয় যতই থাক, ননীর মনে হত, নিজের প্রাণ যাওয়াটা নিয়ে সে মোটেও ভয় পায় না। কিন্তু কাল ইসমিলকে দেখার পর থেকে এই এক নতুন ভয় তার পিছনে ছায়া হয়ে ঘুরছিল। মরার চেয়ে মরে যাওয়ার সময়টাই বড় ভয়ংকর। বিভীষিকাময় সেই মিনিটগুলো।

ভানুবাবু ননীর কাঁধে রেখে একটু টেনে ফের বললেন, আর দেখে কী হবে ভাই? সরে আসুন। তারপর দূরে রাস্তা দেখে বিরক্তি প্রকাশ করলেন। কী অরাজকতা মশাই! দু’ ঘণ্টার বেশি হল, লোক পাঠিয়েছি থানায়। কেউ এখনও আসছে? খুনখারাপি ডালভাত হয়ে গেছে, অ্যাঁ? কোনো আইন নেই, বিচার নেই, মাথাব্যথা নেই—কী অবস্থা! একেবারে ব্রিটিশ পিরিয়ডের আগের যুগের মতো। যাই বলুন মশাই, দেশ শাসনের ক্ষমতা আমাদের ধাতেই নেই।

কেউ বলল, ওই তো হাইরোডে গাড়ি এসে গেছে। হুঁ আসছে। ওই যে!

ননী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। জিপ থেকে খাকি পোশাকপরা কয়েকটা মূর্তি ঝোপ ভেঙে আস্তে—সুস্থে এগোচ্ছে। ফের ঘাড় ঘুরিয়ে সে মানুকে খুঁজল। কোথায় গেল মানু? ননীর মনে পড়ল, মানু তার সঙ্গে এসে কৃষ্ণাকে দেখেই তার মতো শক্ত দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তারপর ভাঙা গলায় কী যেন বলেছিল, মনে পড়ে না। কিন্তু তারপর ননী আর মানুকে দেখেনি। সারাক্ষণ কৃষ্ণার দিকে চোখ রেখেছে।

সাব—ইন্সপেক্টর অরুণ নন্দী, বুঝলেন? ভানবাবু চাপা গলায় বললেন। ভেরি সিনসিয়ার অ্যান্ড অনেস্ট। পুলিশ লাইনে এমন অফিসার আর পাবেন না। ইয়ং ম্যান। কোয়ালিফায়েড। দেখবেন, ঠিক খুঁজে বের করবেন।

ননী প্যান্টের পকেটে হাত ভরল, দৃষ্টি মানুর খোঁজে। তারপর দেখতে পেল, রেললাইনের ধারে খাটাল থেকে একটা কাপড় নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আসছে।

খুব কাছেই কয়েক জোড়া জুতোর শব্দ হল। ননী ঘুরে দেখল না। সে মানুকে দেখছিল। হঠাৎ মানুকে ভালোলাগাটা এত বেড়ে যাচ্ছে—কৃষ্ণার আব্রু ঢাকতে একমাত্র সেই ব্যস্ত হয়েছে বলেই কী? কৃষ্ণা মানুর নিন্দে করত। কৃষ্ণা এত বোকা ছিল।

এসেই কনেস্টবলরা বেটন উঁচিয়ে ভিড়টাকে ভাগিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়েছে। নন্দী হাসতে হাসতে বললেন, কী ব্যাপার ভানুবাবু? আপনার চোখের সামনে এমন কাণ্ড হল কীভাবে?

ভানুবাবু ননীকে দেখিয়ে বললেন, এরই বোন স্যার। তোপ—পাড়ার ভটচাযমশায়ের ছেলে। আদর্শ বিদ্যাপীঠের টিচার।

নন্দী ননীর আগাগোড়া দ্রুত দেখে নিয়ে লাশের কাছে দাঁড়ালেন। তারপর মাই গুডনেস বলে চারপাশে ঘুরে ঘুরে কীসব দেখার পর মুখ তুলে চারিদিকে ঘুরে—ঘুরে কী যেন খুঁজলেন। তারপর বললেন, বডি নাড়াচাড়া করা হয়নি তো?

প্রশ্নটা ননীর দিকে। জবাব দিলেন ভানুবাবু। না স্যার। শিবু ধোপা দেখে আমাকে খবর দিল। সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়ে এসেছিলুম। বডি অ্যাজ ইট ইজ আছে। কাকেও ঘেঁষতে দিইনি।

মানুর শাড়ির নিচেটা চোরকাটা আর জলকাদায় নোংরা হয়ে গেছে। বুকের ওপরটা অসাবধানে খোলা। মাংসটা লাল হয়ে উঠেছে। কপালে, নাকের ডগায় ঘাম। সে এসেই কৃষ্ণার দিকে ঝুঁকলে নন্দী বেটন তুলে বললেন—ওয়েট, ওয়েট। এক মিনিট।

মানু ভাঙা গলায় বলল, কেন?

প্লীজ! যা করার আমাদের করতে দিন। নন্দী বললেন। রামবাবু, ছবি নিন দাদা! ঝটপট। তারপর ঘড়ি দেখলেন। ডাক্তারবাবুর কী হল রে বাবা? বললুম, সঙ্গে আসুন।

গিরিধারী সিং কনস্টেবল বলল, অ্যাম্বুলেন্স আরহা স্যার।

ও। কিন্তু গাড়ি তো ঢুকবে না এখান অব্দি। গিরিধারী, স্টেচার আনতে বলো। যাও, রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াও।

মানুর সঙ্গে গয়লাদের একটি মেয়ে এসেছে। তারই মায়ের শাড়ি। বলল, দিদি, কাপড়া দো।

মানু রাগ করে শাড়িটা তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ননীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল, ননীর দিকে তাকাল। ননী নিষ্পলক চোখে কৃষ্ণাকে দেখছে আর সিগারেট টানছে। মানুর মনে হল, এ ননীকে সে চেনে না। দ্যাখেনি কোনো দিন। ননী বড় নরম মনের মানুষ ছিল। সময়ে আবেগ প্রকাশ করত নানা ব্যাপারে। চোখে জলও দেখতে পেত মানু। ধরা গলায় খুব আস্তে শব্দ উচ্চারণ করত। রিকশো করে মানু যখন তার কাছে গিয়ে কান্না জড়ানো গলায় খবরটা দিল, ননী প্রথমে শুকনো হেসে বলেছিল, অসম্ভব। কৃষ্ণা হতেই পারে না। তারপর কাঠগোলার কাছে নেমে গিয়ে পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলেছিল, তুমি যাও। দেখে এসো কৃষ্ণা নাকি! কৃষ্ণা হলে আমি দেখতে পারব না। মানুর একা আসতেও সাহস হচ্ছিল না। তাই তাকে জোর করে টেনে এনেছিল। আশ্চর্য, ননী যেন নির্বিকার হয়ে গেছে সঙ্গে সঙ্গে। একটি কথাও বলেনি। বলছে না। চোখের পলক পড়ছে না। একই ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে কৃষ্ণার দিকে।

রামবাবু ফোটোগ্রাফার এ—পাশ ও—পাশ থেকে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলছেন। বৃষ্টিধোয়া আকাশের রোদ আজ ঝকঝকে উজ্জ্বল হয়ে কৃষ্ণাকে এখন ঘিরে ধরেছে। রামবাবু বারবার বলছেন, ছবি খুব ভালো হবে। চমৎকার ছবি হবে। এক মিনিট। আর দুটো ক্লোজ—আপ নিয়ে নিই।

মানুর বাবা অক্ষয়বাবুও ফোটোগ্রাফার ছিলেন। খুনখারাপির সময় লাশের ছবি তুলতে যেতেন। রাতে বাড়ি ফিরে সেই সব গল্প বলতেন। জন সকালে বলত, দিদি! তুই ডেডবডি হ’না রে। আমি ছবি তুলি। মানু ডেডবডি সেজে পড়ে থাকত। জন একটা কৌটা নিয়ে ক্যামেরা করে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলত। জন বলত, নড়বিনে যেন। ছবি খারাপ হবে। মানু দুষ্টুমি করে দাঁত বের করে মুখটা বিকট করে রাখত। জিভ বের করত। কৌটো ছুড়ে মেরে চ্যাঁচাত, দাঁত দেখানো বাঁদরকে সত্যি মড়া করে দেব, হ্যাঁ। ভাবতে অবাক লাগে, বাচ্চাদের দেখে কিছু বোঝা যায় না—কে হবে কিলার, কে জজসাহেব।

আজ জনের গালে, ঠোঁটের পাশে প্লাস্টারের ফালি। গলায়, বুকের ওপরদিকে কালো চেরা দাগের ওপর লাল অ্যান্টিসেপটিক ওষুধের ছোপ। তার মধ্যে সরু রুপালি চেন চিকচিক করছে। চেনটা ছেঁড়েনি কেন? মানু বারবার চমকে উঠছে। কাল জন মারামারি করেছে কারুর সঙ্গে। সে জনের মুখ, গলা, বুক ফালাফালা করে দিয়েছে। কিন্তু চেনটা….

নাদুস—নুদুস কুমড়োর মতো চেহারা, হাসপাতালের নবদ্বীপ ডাক্তার কষ্ট করে ঝুঁকে বললেন, ডেথ বাই ব্রুটাল সাফোকেশান মনে হচ্ছে। হু এই তো! বলে কৃষ্ণার মাথাটা চিত করে থুতনি খামচে ধরলেন। গলা টিপে মেরেছে!

ভানুবাবু এগিয়ে গেলেন। সে আমরা দেখেই বুঝেছিলুম। রেপ—কেস তাই না স্যার।

গোমড়ামুখে ভানুবাবুকে দেখে নিয়ে নবদ্বীপ ডাক্তার বললেন, তা এখনই কেমন করে বলব? তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আই থিংক, কাল সন্ধ্যাবেলা ঝড়বৃষ্টির আগেই হয়েছে। এখানেও হতে পারে, অন্য কোথাও হতে পারে। পরে টেনে এনে এখানে বডিটা ফেলে পালিয়েছে। ড্র্যাগিং মার্ক খুঁজে পেলেন কিছু?

নন্দী ঘাড় নাড়লেন। ঝিলের ওদিকে মাঠটার দিকে তাকিয়ে হাঁটুর নীচে বেটনটা ঠুকতে থাকলেন।

হুঁ। ঝড়—জল—তার ওপর শিলাবৃষ্টি।

মানু এগিয়ে গিয়ে বলল, কিন্তু ওর হাতে তো বইপত্তর ছিল ঘড়ি ছিল, কলম—টলমও ছিল।

নন্দী ঘুরে তাকালেন ওর দিকে।…আপনি কে?

মানু একটু ভড়কে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর সামলে নিয়ে বলল, কাল বিকেলে কলেজ থেকে আমার ওখানে গিয়েছিল গানের মাস্টারের ব্যাপারে। তারপর…

বাঁ হাত তুলে নন্দী বললেন, ওয়েট। পরে স্টেটমেন্ট নেব। কই গো, বডি ওঠাও।

এতক্ষণে ননী কথা বলল, দাহ করতে পারব না?

পারবেন। মর্গে ডেলিভারি নেবেন ওবেলা। ননী পা বাড়ালেন। বকসী একটু দেখুন ভাই। ভানুবাবুর ওখানে বসে স্টেটমেন্টগুলো নিয়ে ফেলি আগে। চলুন ভানুবাবু। আর সেই ধোপা ভদ্রলোক কই?

ভানুবাবু হো হো করে হেসে বললেন, ওই যে ভদ্রলোক এখন ভদ্রলোকদের কাপড় ফাটাচ্ছেন। কই, আসুন ননীবাবু। মানুদিদি, এসো গো!…সকালে তোমার গোঁসাই পিসে এসেছিলেন। বলেন কী, পাশেই খাটাল। টাটকা দুধ এনে খাওয়া। তোমাদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে না? আর্টিস্ট মানুষের কাণ্ড।

মানু সবার সামনেই ননীর একটা হাত টেনে শ্বাস—প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, এসো…