৩
কৃষ্ণা সেন্ট মেখে কলেজ গিয়েছিল। ননী তাকে দেখে বুঝতে পারেনি, সে সারারাত বাড়ি ফিরবে না। আগের রাতে স্টেশন রোডের বাঁকের কাছে ইসমিল দপ্তরিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। তখনও বুঝতে পারেনি, ইসমিল গলায় দড়ি দিয়ে মরতে যাচ্ছে। রেলইয়ার্ডে পড়ে থাকতে দেখা নির্দোষ খেলনার বলের মতো ব্যাপার। একেকটা বোমা। চারপাশের সব কিছুর মধ্যে কামোফ্লেজ করে থাকে। চেনা যায় না। বোঝা যায় না।
শেষ রাতে ননী কৃষ্ণার ঘর খুলে তন্নতন্ন করে হাতড়েছে, কোনো চিরকুটে লেখা দু—এক লাইন অগত্যা। বিছানা ওলটপালট করেছে। হারমোনিয়াম, তানপুরা, তবলা গানের খাতা। টেবিলের বইপত্তর, কলেজের খাতা, র্যাকের বই। আলনা, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার, কৃষ্ণার ব্যাগ। ঘরের মেঝেয় প্রতিটি কাগজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আর সারাক্ষণ তীব্র ঝাঁঝালো সেন্টের সৌরভ তার স্নায়ুতে আগুন ধরিয়েছে। ননী কৃষ্ণার ঘরে শেষরাতে এক অলীক শত্রুর সঙ্গে রক্তারক্তি লড়াই করে কাহিল হয়েছে।
তারপর ননী ফুঁপিয়ে কেঁদেছে—অভিমানে, দুঃখে, আক্রোশে কৃষ্ণা কি খুব কষ্টে ছিল? খাওয়া—পরার কষ্ট, ননীর শাসন ও স্নেহের কষ্ট, সাধারণ জীবনযাপনের কষ্ট? রান্না, ধোয়ামাজা, ঘরকন্নার কাজে আত্মসম্মানে কি আঘাত লাগত ওর? কিন্তু এসব তো ও নিজের তাগিদেই করেছে এতকাল। ঝি—চাকরের ব্যবস্থা করে দিতে চেয়েছে ননী—পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে, কিন্তু কৃষ্ণা তো নিজেই আপত্তি করেছে। তা হলে, কেন?
ভোরের আলো ফুটলে বারান্দার আলো নিভিয়ে ননী উঠোনে নেমেছে। ঘর—বার করেছে সদর দরজা খুলে। রাস্তা দেখেছে। ভেবেছে কাচুমাচু মুখে কৃষ্ণা ফিরবে। ফিরল না।
সূর্য উঠল। ঝড়—বৃষ্টির চোট—খাওয়া পৃথিবীর চেহারা আজ অন্যরকম। হাসিকান্নায় মাখা মুখ। উঠোনে সবুজ—সবুজ ছেঁড়াপাতা, টুকরো ডালপালা, নারকোলের বাগড়া—জঞ্জালের কাঁড়ি। কার্নিশ থেকে পাখির বাসা উড়ে পড়েছে। পড়ে আছে ভাঙা ডিমের খোলা, গোলাপি রঙের ছানা—টিকটিকির মতো দেখতে। রাস্তার ধারে ইলেকট্রিক তারে আটকে আছে ডালপালা। অথচ আবহাওয়ায় স্নিগ্ধ হিমভাব। গাছপালা ঘরবাড়ি জুড়ে ক্ষয়ের দাগগুলো আড়াল করে ফুটে উঠেছে তাজা জেল্লা। পাঁচিলের ধারে জবা, শিউলি, কামিনী ফুলের গাছ টকটকে সবুজ রঙ চড়িয়েছে।
আর এসবের মধ্যে ননী দাঁড়িয়ে আছে বাজ—পড়া ন্যাড়া গাছের মতো। রুক্ষ, শুকনো, ক্লিষ্ট চেহারা। কোটরগত লাল চোখ। কাল সেন্ট ছড়িয়ে কৃষ্ণা কলেজ গেল। ননী একটুও টের পেল না। নিজের ওপর রাগে ছটফট করছে সে। দেখতে দেখতে সূর্য রেলইয়ার্ডের উঁচু খাম্বার মাথায় চড়ে বসেছে। তার রোদ এসে কোনাকুনি ননীকে গেঁথেছে। ননী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
কতক্ষণ পরে সদর দরজার সামনে পিউয়ের ভাই টোনা এসে দাঁড়াল। নোনেদা!
কী রে টোনা?
দিদি বলল, পুঁটিদি ফিরেছে নাকি জিগ্যেস করে আয়।
না রে! ফেরেনি।
টোনা চলে গেল। ননীর চোয়াল ফের আঁটো হল। অস্পষ্ট স্বরে—চুলোয় যাক, আমার কী, বলে সে পুরো ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলে দেবার ভঙ্গি করল। তারপর টিউবওয়েলের কাছে গেল।
দাঁত ব্রাশ করল। এমনি হাত—মুখ ধুয়ে, ঘাড়ে জলের ঝাপটা খেয়ে সে শক্ত দৃঢ়চেতা মানুষের মতো বারান্দায় গেল। কৃষ্ণার ঘরে আলোটা এখনও জ্বলছে। টেবিলে তার ছবিটা হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। সহ্য করতে পারল না ননী। উপুড় করে রাখল। তারপর বাতি নিভিয়ে দরজার তালা আটকে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। প্যান্ট—শার্ট পরতে থাকল। সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। বাইরে চা খেয়ে নেবে। সিগারেট কিনবে। তারপর…
তারপর কী করবে বুঝতে পারছে না। ননী চুল আঁচড়াতে থাকল।
এই সময় বাইরে কেউ ডাকল, কৃষ্ণা! কৃষ্ণা! কই, বাঁদরমুখী ফিরেছে?
ননী উঁকি মেরে দেখল, মানু হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় উঠেছে। ননীকে দেখে সে উদ্বিগ্নমুখে বলে উঠল ফের, ফিরেছে কৃষ্ণা?
ননী আস্তে মাথাটা দোলাল। কৃষ্ণার ঘরের তালা আটকানো দরজার দিকে মানুর চোখ। তারপর সে দ্রুত এগিয়ে দরজার সামনে গেল একবার। ফিরে এসে বলল, চুপ করে আছ যে? খোঁজখবর নিলে—টিলে কোথাও?
ননী একটু চুপ করে থেকে আস্তে বলল, কোথায় খোঁজ নেব? ওর বন্ধুদের কাকেও বিশেষ চিনিনে। কে কোথায় থাকে, তাও জানিনে। এক ওই পিউ নামে মেয়েটা। সে বলল, কাল কলেজ থেকে একটু আগে—আগে বেরিয়ে কৃষ্ণা মদনমোহনতলা গেছে।
বারান্দার চেয়ারটায় বসে মানু বলল, কৃষ্ণা গেল, তখন প্রায় সওয়া পাঁচটা—টাচটা হবে। আমি চুপচাপ শুয়েই ছিলুম। শরীরটা ভালো না। কৃষ্ণা এসে আমার বিছানার পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বলল…
মানু হঠাৎ থেমে ননীর দিকে তাকালে ননী বলল, হ্যাঁ। ডিটেলস বলো।
হ্যাঁ। কৃষ্ণা বলল, জ্বর নাকি? বললুম, না রে! এমনি। ও বলল, তাহলে অবেলায় শুয়ে আছ?…তো কতক্ষণ এসব কথা। তারপর আমিই বললুম, গোঁসাই পিসেমশাই এসেছেন। বরাবর থাকবেন। একটা স্কুলটুল খোলার ইচ্ছে আছে। তা তোর দাদাকে বলেছিলুম, কৃষ্ণা, যদি চায়, চান্সটা নিক। ওঁকে বলব, বাড়ি গিয়ে শেখাবেন।
ননীর ডিটেলস অন্য। সে অধীরভাবে বলল, গান—ফানের কথা নয়। কৃষ্ণা আর কি সব বলছিল?
মানু মনে করার চেষ্টা করে বলল, তেমন কিছু নয়। এটা—ওটা আজেবাজে কথা। ওর বকবকানি তো জানি।
কতক্ষণ ছিল তোমার ওখানে?
বেশিক্ষণ না। চা—ফাও খেল না। বড়জোর মিনিট কুড়ি ছিল। আমি ওর সঙ্গে পিসেমশাইয়ের আলাপ করিয়ে দিলুম। তারপর রাস্তায় নেমে দেখলুম, ভীষণ মেঘ করেছে। তাই বললুম, একটু পরে বেরিয়ো বরং। কিছুক্ষণ দেখে যাও। কিন্তু শুনল না। বলল, না। মানুদি, দাদা ভাববে ভীষণ।
ননী চমকে উঠল। কৃষ্ণা বলল?
হ্যাঁ। বলল, দাদা ফিরে চায়ের জন্য হাপিত্যেশ করবে। যাই মানুদি।
ননী মুখ নামাল। তারপর ভাঙা স্বরে বলল, তারপর?
মানু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে বলল, কৃষ্ণা খালপোল অব্দি গেল—তখনও আমি দাঁড়িয়ে আছি। তারপর খেয়াল হল, ওকে রিকশো করে যেতে বললুম না কেন? কিন্তু তখন…
ননী আগের মতো ভাঙা গলায় বলল, রিকশো করে যায়নি যাবার সময়?
না। জানালা থেকে খালপোল অব্দি তো স্পষ্ট দেখা যায়। ওকে হেঁটে আসতেই দেখেছিলুম।
আমার পয়সা বাঁচাতে চেয়েছিল বাঁদর! ননী রুমাল বের করে নাক মুছল।
মানু বলল, খালপোল পেরিয়ে গেল কৃষ্ণা। তখন আমি ফিরে এলুম। তার মিনিট পাঁচেক পরেই ঝড়টা উঠল। ভাবলুম এই রে! মেয়েটা ঝড়ের মুখে পড়বে। বিশ্বাস করো, ভীষণ অ্যাংজাইটির মধ্যে ছিলুম। তারপর তুমি গেলে…মানুর গলা ধরে এল। মুখ ফিরিয়ে বলল, সারা রাত আমার ঘুম হয়নি জানো? শরীরটা একে ভালো যাচ্ছে না…
ননী তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, মানু?
উঁ?
কৃষ্ণা একা গিয়েছিল?
মানু ওর চোখে চোখ রেখে বলল, একাই তো! সঙ্গে কেউ ছিল না। কেন একথা বলছ?
আচ্ছা মানু, খালপোল অব্দি কৃষ্ণাকে লক্ষ করেছ যেতে—বলছ। তোমার চোখে পড়েনি, খালের ওপাশে কেউ ওর জন্যে অপেক্ষা করছে?
মানু জোরে মাথা দোলাল, নাঃ। ও একা গিয়েছিল। বলে সে একটু ঝাঁঝালো গলায় ফের বলে উঠল, তোমার নিজের বোন। তুমি ওকে চেনো না? আমি চিনি। বুঝতে পারি।
কী চেনো? কী বুঝতে পারো মানু?
কৃষ্ণা অন্য স্বভাবের মেয়ে। একটু চুপ করে থাকার পর মানু গাঢ়স্বরে ফের বলল, আমাদের মতো ইমোশনাল মেয়ে নয়। তা ছাড়া…
তা ছাড়া? আগ্রহ নিয়ে তাকাল ননী।
মানু জোরালো গলায় বলল, ভীষণ মরালিস্ট বলে মনে হয়েছে ওকে। ধরো, অনেক সময় তোমার—আমার প্রসঙ্গটা টাচ করে গেছে—সফটলি। আমি টের পেয়েছি, কী উদ্দেশ্য ওর। এও বুঝতে পেরেছি, ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ করে না। অথচ তুমি ওর দাদা, আমাকেও খাতির করে—ওকে এক সময় পড়িয়েছি—টড়িয়েছি। একদিন হঠাৎ কথায়—কথায় চার্জ করার মতো কী বলেছিল জানো? তুমি ওর ওপর রাগ করবে বলে বলিনি। তাছাড়া কিছু কিছু ব্যাপারে ও তো ভীষণ ছেলেমানুষ ছিল।
কী বলেছিল কৃষ্ণা?
মানু হাসবার চেষ্টা করে বলল, মানুদি, তুমি দাদাকে বিয়ে করছ না কেন গো?
বলেছিল?
হ্যাঁ। কিন্তু আমি খুব রেগে গিয়েছিলুম। তারপর আর কখনও ও প্রসঙ্গে যায়নি।
ননী হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল। এক মিনিট। সিগারেট নিয়ে আসি। আর যদি কিছু না মনে করো, কুকার জ্বেলে চা করবে?
ননী উঠোনে নেমে বলল, আমরা কৌটোর দুধ খাই। সব সাজানো আছে দেখবে—চা চিনি—টিনি।
রাস্তায় বেরিয়ে একটু দাঁড়াল সে। ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির চিহ্নের ওপর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে প্রাণবন্ত জীবন ফের চঞ্চল চলাফেরায় ব্যস্ত। কোথাও এতটুকু ভাঁজ পড়েনি, কুঁচকে যায়নি। যানবাহন আর মানুষজন তেমনি চলেছে সাবলীল স্বচ্ছন্দ। মোড়ের চা—সিগারেটের দোকানের সামনে তেমনি নির্লিপ্ত মানুষের ভিড়। উদাসীন চোখে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। পানের পিক ফেলছে ড্রেনের ওপর ঝুঁকে। বুঁদ হয়ে সিগারেট টানছে। অথচ কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি। কী এক গভীরতর অসহায়তার বোধ ননীকে চেপে ধরল কয়েক মুহূর্তের জন্য। মনে হল, যে পৃথিবীর প্রতি এত দরদ আর মোহ নিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা, সেই পৃথিবী কী নিষ্ঠুর আর নির্বিকার! কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি সারা রাত—কত কৃষ্ণা বাড়ি ফেরে না, রাত ভোর হয়ে যায়—তবু খাওয়াদাওয়া বেঁচে থাকা। কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি বলে ননীও কি খাওয়াদাওয়া বেঁচে থাকা চা—সিগারেট বরবাদ করে দিতে পারছে। পারবে কি?
পাড়ার তারকবাবু বাজারের থলি হাতে দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে চা খাচ্ছিলেন। ননীকে দেখে বললেন, কী নোনে! অসুখ—বিসুখ নাকি?
ননী বলল, নাঃ। এমনি।
অমন ঝোড়ো কাকের মতো দেখাচ্ছে কেন হে?…তারকবাবু ফ্যাঁচ করে হাসলেন। রাত জেগে ফাংশন শুনেছ নাকি?
ননী চমকে উঠে বলল, কোথায় ফাংশন ছিল জ্যাঠামশাই?
তা জানি নে বাবা। এমনি বললুম।
ও। বলে ননী চুপ করে গেল। মাঝে মাঝে এ শহরে সারা রাত গানের ফাংশন হয়। কৃষ্ণা কি কোনো গান—পাগলা বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ফাংশনে গিয়েছিল? এমনও হতে পারে, একেবারে চান—খাওয়া করে একসঙ্গে কলেজ যাওয়ার পথে বলে যাবে দাদাকে?
পরক্ষণে ননীর মনে হল, কৃষ্ণা হঠকারী স্বভাবের মেয়ে নয়। জীবনে একবারও এমন কিছু করেনি। ফাংশনে যেতে হলে অনেক আগে থেকে দাদাকে পটিয়ে রেখেছে। দুজনেই গেছে। কৃষ্ণা কখনও একা কিংবা কোনো বন্ধুর সঙ্গে ছবিও দেখেনি—ফ্যাংশন তো দূরের কথা।
ননী একবার ভাবল, তারকবাবুকে জিগ্যেস করবে নাকি কৃষ্ণাকে কোথাও দেখেছেন কিনা। পরে ভাবল, পাড়ায় অকারণ কানাকানি শুরু হবে। কেলেঙ্কারি রটিয়ে একশেষ করবে লোকেরা।
সে বাড়ি ঢোকার মুহূর্ত অব্দি আশা করল, কৃষ্ণা যদি এসে গিয়ে থাকে।
মানু চায়ের পাতা ভেজাতে দিচ্ছে। একা। বাড়ি তেমনি শূন্য ঝিম। উঠোনে সবুজ জঞ্জাল। কৃষ্ণা ফিরে এলে তক্ষুনি সাফ করতে লেগে যেত। কলতলায় হাতলের শব্দ শোনা যেত বাইরে থেকে। সারা উঠোন আর বারান্দা কোমরে আঁচল জড়িয়ে জল ঢেলে ধুয়ে ফেলত। চ্যাঁচামেচি করে বলত, এ কী রে দাদা! তুই বড্ড বাজে। ঘরে কত্তো ধুলো ঢুকেছে ঝড়ে। জানলা আটকাসনি নিশ্চয়?
মানু বলল, বিস্কুট আনলে কেন? কৌটো ভরতি বিস্কুট রয়েছে। তারপর সে কিচেনের ভেতর দিকে একবার ঘুরে ফের বলল, কৃষ্ণা ভীষণ গিন্নিবান্নি মেয়ে। কী ডিসিপ্লিনড, ভাবা যায় না!
ননী ডাইনিং চেয়ারে বসে বলল, কী করব বল তো মানু?
মানু অভ্যাসমতো ডান ভুরু একটু তুলে ভাবনার চোখে উঠোনের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল, আচ্ছা, তুমি ঘর খুঁজে দেখেছ? কোনো চিঠিফিঠি….
ননী দ্রুত বলল, খুঁজেছি। কিচ্ছু নেই। কেন থাকবে? ও কি কারও সঙ্গে চলে গেছে, ভাবছ? ইমপসিবল! কুচ্ছিত বাঁদরের মতো চেহারা। কে ওকে পছন্দ করবে?
চুপ করো তো! মানু কড়া গলায় বলল। ও কুচ্ছিত বাঁদরের মতো চেহারা আর তুমি মহা রূপবান! জাস্ট কথার কথা বলছি। একটা বয়সে ছেলেমেয়েরা এমন ইমোশনাল থাকে যে চেহারা টেহারা কোনো ফ্যাক্টরই না।
ননী আস্তে বলল, তুমি বললে একটু আগে, ওর সেন্স অফ মরালিটির কথা।
হুঁ। মানু চা করতে থাকল। একটু পরে হঠাৎ চমকে ওঠা স্বরে বলল, এই! একটা কথা আমরা কেউ ভাবিনি এতক্ষণ। ভগবান না করুন…
ননী বলল, কী মানু?
চলো না! হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিই। যদি দৈবাৎ কিছু ঘটে থাকে!
ননী কাঠ হয়ে বসে রইল কয়েক মুহূর্ত। এতক্ষণে তার মুখের ওপর আবছা কালো একটা ছায়া পড়ল। গভীর জলের তলা থেকে বুজকুড়ি তোলার মতো, কিংবা স্বপ্নের ঘোরে জড়ানো গলায় সে বলল, কেন একথা ভাবিনি, মানু? তার গলার স্বর ফের ভেঙে গেল। আমি খালি ওর পালিয়ে যাওয়ার কথাই ভেবেছি। তুমিও। কিন্তু এত স্বাভাবিক একটা কথা কিছুতেই মাথায় আসেনি। ঝড়ের সময় ভীষণ ধুলো উড়ছিল। রাস্তায় হঠাৎ কোনো গাড়ি ওকে চাপা দিয়ে চলে গেছে। কত স্বাভাবিক ঘটনা।
মানু চোখ বড়ো করে বলল, আজকাল হাসপাতালগুলোও তো তেমনি। তেমন কিছু ঘটলে ওর কাছে বইপত্তর আছে—নাম ঠিকানা পাওয়া কঠিন নয়। আসলে লোকগুলো বড্ড হার্টলেস। আমি দেখেছি।
ননী বলল, তুমি একটু থাকবে? আমি ঝট করে ঘুরে আসি!
মানু ওর কাঁধে হাত রেখে বাধা দিল। যদি তেমন কিছু ঘটেই থাকে, আর ব্যস্ত হয়ে লাভ তো নেই। রাতে কিছু খাওনি। চা—টা অন্তত খেয়ে নাও। আমিও যাব তোমার সঙ্গে।
ব্যস্তভাবে চা গিলতে থাকল ননী। তারপর সিগারেট ধরিয়ে বলল, এসো।
কলকাতা থেকে হাইওয়ে এসে শহরের মাঝখান চিরে নদী পেরিয়ে গেছে। উঁচু ব্রিজের ওপর দাঁড়ালে শহরটা বড় সুন্দর লাগে—ছবির মতো। একদিকে নদীর বাঁধ বরাবর ভাঙনরোধী সবুজ বন, অন্যদিকে হাসপাতাল। একদিন কৃষ্ণা ব্রিজে দাঁড়িয়ে বলেছিল, হাসপাতালটা কী সুন্দর দেখাচ্ছে রে দাদা! অসুখ হলে কী মজাই না হবে! তখন কৃষ্ণা স্কুলের মেয়ে। ফ্রক ছাড়বে ছাড়বে করছে। সেই সময়। হঠাৎ—হঠাৎ এমনি সব ছেলেমানুষী করে কথা বলত। ব্রিজের মুখে ডাইনে রিকশো ঘুরলে ব্রিজের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণার কথাটা মনে পড়ল ননীর। আসলে তার বোন এত বোকা মেয়ে ছিল ভাবা যায় না।
এই সাত সকালেই ভেতরে লোক গিজগিজ করছে। মানু বলল, এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে চলো। সামনে বোর্ড। লাল হরফে লেখা এমার্জেন্সি। ননী মানুর পরে নামল। রিকশোওলাকে পয়সা মিটিয়ে যখন পা বাড়াল, তখন মানু বারান্দায়।
ননী বারান্দায় উঠে মানুর গলা শুনতে পেল। তেমন কোনো কেস নেই বলছেন? কাল বিকেল থেকে এ পর্যন্ত?
নাথিং।
অ্যাকসিডেন্ট তো প্রায়ই হচ্ছে।
অ্যাপ্রন—পরা মহিলা চটে গিয়ে বললেন, হচ্ছে তো আমি কী করব? অদ্ভুত কথা তো!
ননী ঢুকে বলল, দেখুন—কাল বিকেলে আমার বোন কলেজে গিয়ে আর ফেরেনি। বছর আঠারো বয়েস। একটু শ্যামবর্ণ, রোগাটে গড়ন। পরনে…
আহা, বললুম তো! কোনো অ্যাকসিডেন্ট কেসের পেশেন্ট আসেনি।
কিংবা ধরুন, কোনো স্ট্যাবিং ইনজুরি, অথবা…বলতে বলতে নিজের কথায় নিজেই চমকে ননী ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। কৃষ্ণাকে কে স্ট্যাব করবে? কেন করবে? ওর কানে অবশ্য সোনার রিং ছিল। হাত খালি। কলেজে ঢোকার বছর একটা ঘড়ি কিনে দিয়েছিল ননী। হ্যাঁ, সেটা হাতে ছিল।
অ্যাপ্রন—পরা মহিলা রেজিস্টারে চোখ বুলিয়ে একটু ক্ষীণ হাসি এঁকে বললেন, তেমন কোনো কেস নেই। তবে ভোর ছটায় দুটো ইনজুরি কেস এসেছে। বোথ মেল। গ্রামের ব্যাপার। হাঙ্গামা হয়েছিল।
ননী বলল, ও। আচ্ছা।
সে মানুর দিকে তাকিয়ে ইশারা করল চলে আসতে। দরজার কাছে গেলে সিস্টার মহিলা ডাকলেন, শুনুন।
দু’জনে ঘুরে দাঁড়াল।
থানার খবর নিয়েছেন?
ননী বলল, না। কেন?
থানায় খবর নিন। আজকাল তো প্রায় শুনি ছেলেমেয়েদের হয়রান করছে পুলিশ।
ননী মানুর দিকে তাকাল। তারপর সিস্টারকে জ্বলন্ত দৃষ্টে বলল, আমার বোন সে—মেয়ে নয়।
আহা! ওভাবে নিচ্ছেন কেন? জাস্ট কথার কথা বলছি। সিস্টার চটে গেলেন ফের। কত ইনোসেন্ট ছেলেমেয়েকে তো ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখছে। আমারই এক রিলেটিভের সম্প্রতি এমন ঘটেছে। এ সর্ট অব ব্ল্যাক মেলিং বুঝলেন না?
ননী বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। তারপর বেরিয়ে গেল।
রাস্তায় পৌঁছে একটু দাঁড়াল ননী। সিগারেট বের করে ধরিয়ে নিল। মানু বলল, কৃষ্ণা ওই ঝড়জলের সময় কোথাও পার্কে—টার্কে আড্ডা দিচ্ছিল, এ হয় না। অমন প্রচণ্ড ঝড়, তারপর কী ভীষণ শিল পড়ল। তারপরও কতক্ষণ বৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে কৃষ্ণা…ভ্যাট! সব বাজে আইডিয়া!
ননী বলল, তাহলে থানায় যাবো না বলছ?
মানু একটু ভেবে নিয়ে বলল, শেষ অবধি থানায় হয়তো যেতেই হবে, যদি না ফেরে। মিসিং স্কোয়াডে খবর দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। তবে আমি একটা কথা ভাবছি, জানো?
কী?
আফটার অল, মেয়ে। খুব দ্রুত স্ক্যান্ডাল ছড়ায়। ভবিষ্যৎ তো আছে। বরং আগে ভেতর—ভেতর খোঁজখবর নিয়ে শেষ অবধি থানায় যাওয়া ছাড়া আর কী করা যাবে?
কোথায় খোঁজখবর পাব, ভাবছ?
ওর বন্ধুদের কাছে। অন্তত যদি কোনো ক্লু পেয়ে যাও।
ননী বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি ভীষণ ডিটেকটিভ স্টোরি পড়ো দেখছি। বাস্তব জীবনে ওসবের মূল্য নেই। তা ছাড়া, ওর বন্ধুদের মধ্যে পিউ ছাড়া কারও বাড়ি চিনিনে।
মানু রাগ করল। গাড়োলের মতো কথা বলো না। ওর কলেজে গেলেই তো খোঁজ পাবে।
ও। বলে ননী ঘড়ি দেখল। সেই সাড়ে দশটার আগে তো নয়। আচ্ছা, ঠিক আছে।
দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এগোল। তারপর বলল, শোন। আমাকে এখন বাড়ি ফিরতে হবে। একটু কাজ আছে। এক ভদ্রমহিলা আসবেন। তুমি কলেজে গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলে সোজা আগে আমার কাছে যেয়ো। রেডি হয়ে থাকব। তুমি আমাদের ওখানেই খেয়ে নেবে। চানটা করে নিয়ো বাড়ি ফিরে। কেমন?
ননী আনমনে বলল, আচ্ছা।
মানু একটা সাইকেল রিকশো দাঁড় করিয়ে বলল, এসো। তোমাদের বাড়ির রাস্তা হয়ে যাই। যদি মেয়েটা এতক্ষণ ফিরে থাকে।…
ফেরেনি কৃষ্ণা। বাড়ির দরজায় তালা তেমনি ঝুলছে। ননীকে নামিয়ে দিয়ে মানু ফের বলে গেল, যা বললুম, শুনো কিন্তু। এখনই চানটা করে নাও গিয়ে। কেমন?
ননী ফের বলল, আচ্ছা।…