কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি – ১৫

১৫

দুদিন পরে গোঁসাই বাইরে থেকে ঘুরে এসে বললেন, বেটা ননী! বেশ কতকগুলো দিন চমৎকার কাটালুম তোমার বাড়িতে। খুব আতিথ্য সেবাযত্ন পেলুম। তোমার অশান্তি দূর করতেও যতটা সাধ্যি করলুম—টরলুম। এবার বিদায় নেব। ওই যে বলে না—’এ মুসাফির, উঠা গাঁঠেরী আভি বড়ী দূর যানা হ্যায়!’ মুসাফিরের জীবন এই বেটা।

ননী জিগ্যেস করেছিল, সে কী! চলে যাবেন?

হাঁ বেটা। তবে দূরে নয়। মোল্লার দৌড় মসজিদ। গোঁসাই হেসে উঠেছিলেন। ভানুর কাঠগোলায়। বড় শান্ত নিঃঝুম জায়গা। নিরিবিলি। ঝিলের দিকটায় সিনসিনারি আছে। পাখি—ফাখি ডাকে। খুব ভালো লাগে।

আচ্ছা।

মনকে শক্ত করে বাঁধো, বাবা! এমন হয় সংসারে! কত মহামারি, বন্যা, ভূমিকম্প—কত কী হয়। সাজানো সংসার ছত্রখান হয়ে যায়। কিন্তু আবার মানুষ মাথা তুলে দাঁড়ায়। নতুন করে ঘর বাঁধে।

শেষে বলেছিলেন, মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে যেয়ো। কেমন? নিরিবিলি ঝিলের ধারে কেমন বসে থাকব। মন পবিত্র হয়ে যাবে। তারপর গুনগুন করে সেই গানটাই গাইলেন কিছুক্ষণ। ‘এ মুসাফির, উঠা গাঁঠেরী আভি বড়ী দূর যানা হ্যায়।’

ওই ঝিলের ধারে বসে থাকতে যাবে ননী! মন পবিত্র হবে! ওখানে ঘাসে পিঠ দিয়ে ধর্ষিতা কৃষ্ণা শুয়ে ছিল সারা রাত, সারা সকাল। নাভিতে বসে ছিল ঘাস—ফড়িং, ঊরুতে লাল ভেলভেট পোকা। নাকে ও ঠোঁটে পিঁপড়ের সার। একটা কি দুটি ছেঁড়াপাতা কুমারীর স্তনের উপর। সেখানে শান্তি পেতে যাবে ননী। কী বলছেন গোঁসাই।

বিকেলে গোঁসাই চলে গেলেন জিনিসপত্র নিয়ে।

একটু বিরক্তিও আসছিল ইদানীং ননীর। একেকটা সময় আসে, যখন সংগীতও কদর্য লাগে। আর খালি সারাক্ষণ বকর বকর। ননীর কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। তবে লোকটি মন্দ না। আন্তরিকতা আছে সবকিছুতে। হৃদয়বান মানুষও। যাই হোক, আত্মীয়স্বজন তো কেউ এল না কৃষ্ণার মৃত্যুর খবর পেয়ে। এসব সময়ে বাড়িতে লোকজন থাকা ভালো। মনে ভরসা থাকে। গোঁসাই সেই শূন্য জায়গা ভরাট করেছিলেন। কৃষ্ণার ঘর থেকে শূন্যতাকে ঠেলে বের করে দিয়েছিলেন। বাড়িটা আবার খাঁ খাঁ করছে। কৃষ্ণার ঘরের দিকে তাকাতে আবার কেমন লাগে।

খানিক পরে ভেজানো সদর দরজা ঠেলে কয়েকটি ছেলে উঠোনে এসে দাঁড়াল। ননী চমকে উঠেছিল। গাবু দলবল নিয়ে এসেছে। তাকে মারতে এসেছে নাকি?

কিন্তু গাবুর মুখে হাসি। নোনেদা, চিনতে পারছ তো?

ননী নিষ্পলক তাকাল।

গাবু হাসতে হাসতে বলল, কথা বলছ না যে? ভয় পেলে নাকি গো নোনেদা?

ননী শক্ত হয়ে বলল, না। কী ব্যাপার গাবু?

গাবু বারান্দার দিকে এসে ওপরের ধাপে বসে পড়ল। তার সঙ্গীরা উঠোনে দাঁড়িয়ে ঘুরে—ঘুরে বাড়ি এবং আকাশ দেখতে থাকল। গাবু চাপা গলায় বলল, আমি এখন ফ্রি। তোমার সঙ্গে মিটমাট হয়ে গেছে। তুমিও পাড়ার ছেলে, আমরাও পাড়ার ছেলে। কেমন তো।

ননী ভুরু কুঁচকে বলল, তারপর?

এই নোনেদা! তুমি মাইরি অমন করে তাকিয়ো না। আর্জেন্ট টক আছে তোমার সঙ্গে।

বলো না, কী বলবে? ননী চেয়ারে হেলান দিল এবার।

গাবু গম্ভীর হয়ে বলল, কৃষ্ণা আমাদের পাড়ার মেয়ে। তাকে বেপাড়ার ছেলে মার্ডার করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে। তোপপাড়ায় আমরা সব কী? হিজড়ে আছি, না কাওয়ার্ড? কী রে? তোরা যে এতক্ষণ হেভি তড়পাচ্ছিলি। এখন বল নোনেদাকে! এ্যাই ছোটকা! আয়, এখানে আয়।

ছোটকা মামে গাবুর বয়সি ছেলেটা সিঁড়ির সামনে দু’হাত কোমরে রেখে দু ঠ্যাং ফাঁক করে দাঁড়াল। নোনেদা! কথাটা হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকের বোন আছে। তারা রোজ স্কুল—কলেজে যায়। আপনার বোনের যেমন হল, তেমনি ওদেরও তো হতে পারে। কেউ একদিন আর বাড়ি না ফিরতেও তো পারে।

গাবু কথা কেড়ে বলল, মদনমোহনতলার গেঁয়ো ভূতগুলোর মুণ্ডু ঘুরে যায় যে তোপপাড়ার মেয়েদের দেখে।

উঠোন থেকে ননীর অচেনা একটা ছেলে বলল, আ বে, সিধে কথাটা বলতে এত টুইস্ট কচ্ছিস কেন? সোজা বলে দে না।

গাবু বলল, আমরা খবর পেয়েছি কে কে এ কাজ করেছে। তাদের আমরা ঝাড়ব নোনেদা।

ননী একটু দুলতে দুলতে চোখ বুজে রেখে বলল, কে করেছে গাবু?

কে এক ডাক্তার না কম্পাউন্ডারের ছেলে পল্টু—আর—

ছোটকা বলল, তারই স্কুটার আছে। খুব টাপ্পি মেরে ঘুরে বেড়ায়।

গাবু বলল, আর—আর তোমার সঙ্গে চেনাজানা আছে যে মেয়েটার, তার ভাই। কী নাম বলল রে? জন।

হ্যাঁ, জন। আমরা সব খবর নিয়ে ফেলেছি। গাবু বলল। তক্কে তক্কে থাকব সবাই। যে দেখতে পাবে, খবর দেবে। আমরা গিয়ে ঝাড়ব।

আরেকজন বলল, না বে! আসতে আসতে ভেগে যাবে। আমরা ক’দিন ঘুরি না ওদিকে। একেবারে বর্ডারে।

তেজি ছেলেটি বলল, ভ্যাট! খালি গুলগাপ্পি। আ বে, আমার সঙ্গে চলে আয়। পাড়ায় গিয়ে ঝেড়ে আসি। ওটা তো একটা জংলি গাঁ। খালি ভূতের আড্ডা।

গাবু বলল, তুমি তো গণ্ডগোলের গোড়া মাইরি নোনেদা। মার্ডারের দিনই যদি আমাকে বলতে গাবু একটা কিছু কর। দেখতে কবে সব হয়ে যেত। আর তোমার দিব্যি নোনেদা, পিউয়ের কাছে শুনে আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলুম। রাগও হয়েছিল। আফটার অল তোপপাড়ার মেয়ে তো বটে। কিন্তু তুমি এলেও না—উলটে গণ্ডগোল করে ফেললে। একটা মিস—আন্ডার স্ট্যান্ডিং হল খামোকা।

ননী চোখ খুলে বলল, বেশ। সব বুঝলুম। তা আমি কী করব?

ছোটকা বলল, আপনি কী করবেন? চুপ করে থাকবেন। দেখবেন আমরা কী করছি।

গাবু বলল, আপনাকে জানিয়ে রাখলুম।

ননী একটু হাসল। তোমরা পল্টু ও জনকে মার্ডার করবে তো?

তেজি ছেলেটি বলল, সে বলতে পারিনে দাদু। বোম ঝাড়ব, নয় ড্যাগার চালাব—তাতে বাঁচে বাঁচে—মরে মরে।

তারপর পুলিশ এসে তোমাদের ধরবে—কিংবা আমাকে ধরবে। এই তো?

গাবু বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, পুলিশ! হুঁঃ পুলিশ! ওই তো শুনলুম, দুই শালা ঘুরে বেড়াচ্ছে স্কুটার নিয়ে। খুব ধরছে। জানে না পুলিশ? আমরা জানি, আর পুলিশ জানে না? খালি উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাতে ওস্তাদ।

ছোটকা বলল, সে আপনি ভাববেন না নোনেদা। অন্য লাইনে চালিয়ে দেব। আপনার গন্ধও থাকবে না। সে—লাইন আমাদের জানা আছে। আপনি খালি বসে—বসে দেখে যান।

ননী মাথা জোরে দোলাল। না ভাই, ওসব কিছু করতে যেয়ো না।

গাবু উঠে দাঁড়াল। করতে যাব না? এটা কি কথা হল নোনেদা? ভারি বলছ তুমি! তোপপাড়ার প্রেসটিজ পাংচার হয়ে থাকবে, আর আমরা ছেড়ে দেব? তুমি কাওয়ার্ড হতে পার, আমরা নই। চল ছোটকা। আয় বে তোরা। নোনেদা আমাদের স্টুডেন্ট ভেবেছে। বই খাতা নিয়ে স্কুলে পড়তে এসেছি।

ওরা হেসে উঠল। ননী প্রায় চেঁচিয়ে বলল, গাবু!

গাবু সদর দরজার কাছে এগিয়ে বলল, তোপপাড়ার প্রেসটিজ নোনেদা—হতে পারে তোমার বোন। তুমি ঘরে বসে কান্নাকাটি করো। আমরা বুঝি পাড়ার প্রেসটিজ।

ছোটকা বলল, আর তোর কেমন হয়রানিটা গেল বল। তার শোধ না তুলে ছাড়া যায়?

ননী উঠে দাঁড়িয়েছিল। ওরা হাসতে হাসতে চলে গেলে আস্তে আস্তে বসে পড়ল ফের। ব্যস্তভাবে সিগারেট বের করে ধরাল। ঘন ঘন টান দিতে থাকল।

তা হলে কি জন ফিরেছে এবার? মানু তাকে ফিরিয়ে এনেছে বুঝি। গোঁসাই আর ওদের বাড়ি যেতেন না। গেলে ননী ঠিকই খবর পেয়ে যেত। ননী অস্থির হয়ে উঠল। যদি সত্যি কিছু ঘটে যায়, তা হলে তা ননীরই প্রচণ্ডরকমের হার। ননী এভাবে কোনো প্রতিশোধ চায়নি—এখনও চায় না। যেভাবে চায়, তাও নিজের কাছে স্পষ্ট নয়। সেদিন ঝোঁকের মাথায় ঝিলের মাঠটায় গিয়ে ওত পেতেছিল। মুখোমুখি পেলে কী করবে, কিচ্ছু ভাবেনি। সে ছিল স্বপ্নের ঘোরে কিছু করতে যাওয়ার মতো।

কিন্তু পরে সে স্বস্তি পেয়েছে, ভাগ্যিস অঘোর ডাক্তারের ছেলে সেদিন ওখানে স্কুটার নিয়ে যায়নি! আসল কালপ্রিট যে জন, তাতে কোনো ভুল নেই। সেদিন থেকে বারবার জন তার মনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আর ননী তাকে ভেতরের অন্ধকারে জোর করে ঠেলে দিয়েছে। কারণ জনের মুখটা মানুর মতো। ওদের ভাইবোনের চেহারার আশ্চর্য মিল! যখনই জনের চেহারা তার মনে পড়েছে, দেখেছে যেন মানুকেই। কী অদ্ভুত রূপান্তর ভাবা যায় না। এমনকী জনের ঠোঁটের ভাঁজ, কল্পনায় দেখা ক্রুর হাসি আর অশ্লীল চাউনি আস্তে আস্তে মানুর ঠোঁটের ভাঁজে, অনেক দেখা বাঁকা হাসিতে এবং কোনো সেক্সি মুহূর্তের চঞ্চল চাউনিতে বদলে গেছে। মানুকে না সরিয়ে তার ভাইকে দেখা যায় না। সবসময় মানু ভাইকে আড়াল করে দিতে সামনে এসে দাঁড়ায়।

আচ্ছা এমন যদি হত—জন হত ননীর ভাই, আর কৃষ্ণা হত মানুর বোন! তা হলে ননী কী করত? ননী, তুমি কী করতে? চালাকি কোরো না, ননী! বরাবর তুমি সত্যবাদী। বলো কী করতে? মানুকে বলতে যে আমার ভাই তোমার বোনকে রেপ করে মেরেছে। কিংবা তুমি ভাইয়ের গলা টিপে মেরে শোধ নিতে প্রেমিকার খাতিরে—প্রেমের সম্মানে? ননী, চুপ করে আছ কেন? জবাব দাও!

প্রেম—ট্রেম, মানবতা, আদর্শ ওসব বড় বড় কথা। ঢের শোনা হয়েছে এযাবৎকাল। ম্যান ইজ মেসিন। তার কতকগুলো সংযোজনকেন্দ্র আছে অন্য অন্য মানুষ মেসিনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার জন্যে, নিজের এবং সমাজের কাঠামো টিকিয়ে রাখার জন্যে! বিদ্যুতের প্লাগের মতো। আর তার ওপর ননকনডাকটিভ মোড়ক। টেপ জড়ানো। এগুলোই তো মূল্যবোধ—ওই মোড়ক বা ফিতে! অথচ যুগ যুগ ধরে ব্যবহারে সব টেপ ছেঁড়া—সব মোড়ক ফাটাফুটি। শর্ট সার্কিট হয়। স্ফুলিঙ্গ ঠিকরে পড়ে। আগুন জ্বলে ওঠে মাঝে মাঝে। প্লাগের মুখে বিরাট হাঁ। আমরা আলাদা হয়ে যাই পরস্পর। একা—একা নড়বড় করে চালু থাকি। ছেঁড়া তার বিচ্ছিন্ন করে পরস্পরকে। ঘড়ির দোলকের নিয়মে, কবে ছুড়ে দেওয়া বলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে, ইঞ্জিনের ঠেলে দেওয়া বগির মতো সময়ের লাইনে, শব্দ করে করে চলি এবং স্পন্দিত থাকি। প্রেমহীন, মানবতাহীন, আদর্শহীন। অথচ ওই দেখ, একটা বিরাট কারখানা চলছে পৃথিবী জুড়ে। কতবার ভোঁ বাজে। কত শব্দ হয়। কত ধোঁয়া ওড়ে। চাক্কা চালু হ্যায় তো সব ঠিক হ্যায়! শাহাদত বলেছিল ননীকে। গাড়িমে চাক্কা ঔর মেরা হাথমে চাক্কা। তো চাক্কা চলে, দিনভর রাতভর কেতনা দুরোঁ সে দূর তক চাক্কা চলে। চাক্কা চলে….চাক্কা চলে….চাক্কা চলে…..

ননী চমকে উঠল। ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। উঠোনে গাঢ় ছায়া থমথম করছে। ঘরবাড়ির কার্নিশ থেকে রোদ্দুরের তলানিটুকু ভেজা চুনকালির মতো গলে পড়ছে। তার পরই রাস্তার আলো জ্বলে উঠল। উঠোনের গাঢ় ছায়া সাঁৎ করে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। ননী হাত বাড়িয়ে বারান্দার আলোটা জ্বেলে দিল। বুঝতে পারল না কতক্ষণ এভাবে বসে আছে। শুধু মনে হল, তার বয়স বেড়ে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই দেখবে, চুলদাড়ি সব সাদা হয়ে গেছে।…

রাত দশটায় ননী বেরুল।

কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ বিরাট লাল মাটির জালার মতো রেলইয়ার্ডের ওপর ভাসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ননী হাঁটতে থাকল। হু হু করে বাতাস বইছে। রাস্তায় পড়ে থাকা ছেঁড়া জামার মতো আলোছায়ার চকরবকরা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঘন্টি বাজিয়ে চলে যাচ্ছে দু—একটা রিকশো। হঠাৎ একটা ট্রাক কিংবা জিপ। কদাচিৎ মানুষজন। শহরের এদিকটা মদনমোহনতলা অব্দি প্রায় ফাঁকা। সরকারি কিছু বাড়ি, গার্লস কলেজ ছাড়িয়ে আরও ফাঁকা। হাইওয়ের বাঁকে পৌঁছে ননী দূরে পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে তাকাল। ঝিলের ওদিকটা ঝাপসা কালো। জ্যোৎস্নার রঙ এখনও হলুদ। ডিসট্যান্ট সিগন্যালের লাল আলো জুলজুল করছে আরও দূরে।

একবার মনে হল কৃষ্ণা ওখানে এখনও শুয়ে আছে ঘাসে পিঠ দিয়ে জ্যোৎস্নায়। তারপর টের পেল, ওটা মায়া।

তবু ননী সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মনে পড়ল, গোঁসাই বলেছিলেন, যেয়ো ননী। দুজনে নিরিবিলি ঝিলের ধারে বসে থাকব। যাবে ননী—ঘাড় ঘোরালেই সেখানে কৃষ্ণার শুয়ে থাকা দেখা যায়?

এখন এই নির্জন রাতের রাস্তায় কতসব কথা ননীর মাথায়। মানুর সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনটা মনে পড়ছে। কৃষ্ণাও আলাপ করিয়ে দিয়েছিল তাদের স্কুলের ফাংশানে। মানু তখনও কলেজের ছাত্রী। কেন সেই ফাংশানে গিয়েছিল, মনে পড়ে না। পরে একদিন দেখা হয়ে যায় দৈবাৎ—কালেকটরির সামনে রাস্তায়। নমস্কার শুনে ননী ঘুরে দেখে, মানু। কিছুক্ষণ কৃষ্ণার কথা হল। তারপরও কত কথা—আবোল—তাবোল। শিরীষ গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে। পরের বার দেখা একটা বিয়েবাড়িতে আচায্যিপাড়ায়। মানুর মাসিটাসির বাড়ি যেন। সেই সবকিছুর মুরুব্বি। ননী দেখেছিল, মানু কৃষ্ণাকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিল। কৃষ্ণাকে বড় ভালোবাসত মানু—আজও ননীর তাই মনে হয়।

মানুর সঙ্গে তার আলাপ না হলে কৃষ্ণা কি এভাবে মরত না? কে জানে! কৃষ্ণার কতজনের সঙ্গে ভাব ছিল—ছোট বড় সব বয়সের সঙ্গে। মানু তাদের একজন। আসলে ননী নিজেই দায়ী কৃষ্ণার মৃত্যুর জন্যে। সে মানুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে গেল কেন? আর কেনই বা তেসরা মার্চ কৃষ্ণাকে মানুর বাড়ি যেতে বলল? যদি বা বলল, তাও পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ডে শর্টকাট করার কথা কেন তুলল? ননী তো জানত, কৃষ্ণা দাদার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে!

ননী মনে মনে বলল, কারও দোষ নেই। আমিই দায়ী। আমারই শাস্তি হওয়া দরকার। আর একথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে মাথার খুলির ভেতর আবার ঝাঁপিয়ে এল সেই কালো ভূতুড়ে মোটর সাইকেল। চক্কর দিতে থাকল শব্দ করে করে। তারপর আচমকা ব্রেকের আওয়াজ। ননী চোখ বুজে ফেলল।

আবার ননী হাঁটছে। আবার কত কথা ভাবছে! ম্যান ইজ মেসিন। টুটাকাটা টেপ। প্লাগে ফাটল। হাঁ করা গর্ত। তবু পৃথিবী জুড়ে কারখানা! ভোঁ বাজে। ধোঁয়া ওড়ে। রাশীকৃত উৎপাদন হয়। চাকা ঘোরে। মেরা হাথমে চাক্কা, গাড়িমে চাক্কা। কিতনা দূরোঁ সে দূর তক দিনভর রাতভর চাক্কা চাক্কা চলে…চাক্কা চলে….চাক্কা চলে।

ননী তাকাল। ডিসট্যান্ট সিগন্যাল এইমাত্র নীল হল। ট্রেন আসছে। দূরে শব্দ বাজছে চাক্কা চলে….চাক্কা চলে…চাক্কা চলে!

সামনে খালপোল। ননী জোরে হাঁটতে থাকল। মানুর ঘরের জানলা খোলা। আলো জ্বলছে। ননী জানলার নীচে দাঁড়িয়ে আস্তে ডাকল, মানু!

পর্দা সরে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মানু রডের ফাঁকে চিবুক রেখে বলল, কে?

আমি ননী।

দীর্ঘ আধ মিনিট পরে মানু বলল, আসছি।

আসছি! ননী মনে মনে হাসল। মানু আগের মতো বলতে পারল না, ভেতরে এসো। ওখানে কেন? এত ভয় ননীকে!

বাইরের ঘরের দরজা খোলার সাবধানি শব্দ হল। তারপর মানু বেরুল। রোয়াকের সিঁড়ি ভেঙে হালকা পায়ে ননীর সামনে এসে দাঁড়াল। একবার তাকিয়ে মুখ নামাল।

ননী বলল, একটা ভীষণ দরকারি কথা বলতে এলুম।

বলো!

এখানে দাঁড়িয়ে? ননী হাসবার চেষ্টা করল। তুমি—তোমরা কি আমাকে ভয় পাচ্ছ? পুলিশ এনেছি ভাবছ?

মানু ঠোঁট কামড়ে ধরল। ফের নীচে তাকিয়ে গলার ভেতর বলল, আমাকে এমনি করে অপমান করতে এলে!

ননী শান্তভাবে বলল, না। বিশ্বাস করো, আমি একটা ভীষণ জরুরি কথা বলতেই এসেছি। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে তা বলেই চলে যাব ভাবতে বরং আমারই সম্মানবোধে লাগছে, মানু। তুমি আমাকে ভেতরে যেতে বলছ না!

মানু মুখ তুলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, বাড়িতে জন আছে। তাকে দেখে তোমার ঘেন্না করবে। তাই যেতে বলছিনে।

নাকি ভাবছ, আমি তাঁকে স্ট্যাব করব?

মানু ঝাঁঝাল স্বরে বলল, না! তারপর গলা একটু চেপে ফের বলল, আমি যাবার আগেই তুমি কেন এলে? অপেক্ষা করতে পারলে না?

তুমি যেতে? ননী বাঁকা ঠোঁটে একটু হাসল।

মানু এদিক ওদিক দ্রুত দেখে নিয়ে বলল, চলো। খালপোলের ওদিকে যাই।

কিন্তু কথাটা জন সম্পর্কে। তারও সামনে থাকা দরকার ছিল।

জনকে তুমি সহ্য করতে পারবে?

ননী তাকাল। পারব না? মনে হয়, পারব। কেন পারব না? ননী বিড়বিড় করে বলল। চারপাশে এতসব জন নিয়ে মানুষ চলাফেরা করছে। কেউ—কেউ তো আমাদেরই ভাই, আপনজন। জেনেশুনেও তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি। আমি পারব না কেন?

পারবে না।

ধরো, জন যদি আমারই ভাই হত আর কৃষ্ণা হত তোমারই বোন?

তা যখন সত্যি নয়, তখন ওকথা ভেবে লাভ কী?

তুমি বড় নিষ্ঠুর মেয়ে মানু!

মানু মুখ ফিরিয়ে বলল, আমায় নিষ্ঠুর হতে হয়েছে। চলো ওদিকে যাই।

মানু হাঁটতে থাকল। ননী কয়েক সেকেন্ডে দেরি করে পা বাড়াল।….

খালপোল পেরিয়ে মানু আগে—আগে চলেছে। আজ রাতে ননী অত জোরে হাঁটতে পারছে না। কেন মানু অমন করে হাঁটছে? জনের খুব কাছাকাছি গিয়ে পড়েছিল বলেই কি মানুকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে? ভীষণ ভুল। ম্যান ইজ মেসিন। কিন্তু ননীর মেসিন বিপজ্জনক নয়। তার প্লাগপয়েন্টে বিরাট গর্ত। তার কলকবজা অকেজো হয়ে গেছে। খালি চাক্কা ঘুরছে চাক্কার নিয়মে, বলবিদ্যার ধর্ম মেনে। ননী বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল। স্কুলে বিজ্ঞান পড়ায়। তার চেয়ে এসব আর কে বেশি বোঝে? মানু বোঝে না। মানু অর্থনীতি পড়েছিল। তার পাইপয়সাগুনে বুঝে হিসেব করা চলার জ্ঞান আছে। আজ রাতে নিজের বাড়ির দরজায় ননীর অতর্কিত আসাটা তার কাছে হামলার শামিল। তাই সে অর্থনীতির নিয়ম মেনে হিসেব করে লোকসান থেকে বাঁচতে চাইছে। মানু! একটু দাঁড়াও। এই তো চমৎকার জায়গা। নিরিবিলি রাস্তার দুধারে পোড়ো মাঠ। ল্যাম্পপোস্টের ঝিমধরা আলো দুজনের অস্পষ্ট ছায়াকে টেনে বিছিয়ে দিয়েছে দীর্ঘতর। আমরা এখানে দাঁড়াতে পারি মানু! কথা খুব সামান্যই। বড়জোর দুই থেকে তিন মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। মানু এখানেই থামো! যে ভাইয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাকে হঠাতে চাইছে, অবাক হবে শুনলে যে আমিই বরং তার নিরাপত্তার কথা বলতে এসেছি।

ননী দেখল, তার জিভ ব্লটিং পেপারের মতো লালা শুষছে। গলায় যেন স্বর নেই। আর দেখল, মানু ডাইনে ঘুরল। আগাছার জঙ্গলে ঢুকল। তখন ননী জড়ানো গলায় ডাকতে চেষ্টা করল মানু!

মানু দাঁড়াল। তার মাথার ওপর চাঁদটা গ্রামের মেয়েদের মাথায় পেতলের কলসির মতো। রাস্তাটা নীচু ওখানটা উঁচু। ননী দেখে—দেখে পা ফেলে এগোল। এদিকে কোথায় যাচ্ছ মানু?

মানু শুধু বলল, এসো।

ননীর পায়ের কাছে সরু একফালি পায়ে—চলা পদ আগাছার জঙ্গলে ঢুকে গেছে। মুখ তুলতেই সে টের পেল এই সেই বিপজ্জনক শর্টকাট। ননী ভয় পাওয়া গলায় বলল, ওদিকে কোথায় যাচ্ছ তুমি?

মরতে।

ননী দুঃখে হাসল। কারও—কারও পক্ষে মরাটা সহজ নয়, মানু। তা ছাড়া ভারি যন্ত্রণাদায়ক।

কথা বাড়িয়ো না। এসো।

মানু হাঁটতে লাগল। ননী হাঁটতে লাগল। দুধারে আগাছার ঝোপঝাড় জোরালো হাওয়ায় হুলস্থুল। কটু পচাটে গন্ধ বারবার স্নায়ুতে এসে ঝাপটা মারছে। মানু আঁচল মুঠো করে নাক ঢেকেছে। ননী বলল, কেন এদিকে এলে?

মানু জবাব দিল না। তখন ননীও আরও কথা বলল না। ফালি রাস্তাটা দুধের মতো সাদা ধপধপ করছে জ্যোৎস্নায়। ডাইনে একটু দূরে খালের ধারে কোথাও প্যাঁচা ডাকল। একটু পরে সামনে মাঠের দিকে একটা গাধা ডাকল—লম্বা টানা—টানা ডাক। দূরে ছড়িয়ে যাওয়া ভাঙাচোরা বিপজ্জনক একটা আওয়াজ—অথচ মনে হয়, আবেগ আছে। আজ রাতে সব বিপদ আবেগময় মনে হয়। বুকের ভেতর থেকেও ঠেলে ওঠে বিপজ্জনক আবেগ। দুঃখের আবেগ। ক্রোধের আবেগ। ঘৃণার আবেগ। ননী বারবার ঢোক গিলল। আর মানু? মানু সামনে হাঁটছে। তার ছায়া ননীর ওপর। ননী দেখতে পাচ্ছে না মানুর মুখে কী আছে। কী থাকতে পারে আর? হিসেবি ধূর্ততা, গার্হস্থ্য অস্থিরতা কিছু, আর বাক্যরচনার সময় ছাত্রদের বা ছাত্রীদের মুখে যে কষ্টময় আকাশ—পাতাল হাতড়ানো ছটফটানি ফুটে থাকে—তাই আছে। আর কী থাকতে পারে? জন কিলার, মানু তার আশ্রয়কক্ষ। রাহু রাজা শনি মন্ত্র। সে যুগে জন্মালে ওরা ভাইবোনে মিলে সাম্রাজ্য স্থাপন করত। মানু তোমাকে ঘৃণা করি। ননীর গলার শিরা ফুলে উঠল। চোয়াল আঁটো হয়ে গেল।

সেই মারাত্মক শর্টকাট! ফালি রাস্তাটা সোজা মাঠ চিরে বেরিয়ে গেছে অর্ধবৃত্তাকার পাঁচরাস্তার দিকে। দূরে—দূরে সাদা আলো জ্বলজ্বল করছে। ফালি রাস্তাটা ছেড়ে মানু ঘাসে নামল। অনেকটা হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল। চারদিকে ঘুরে কিছু দেখে নিল যেন। মানুষজন? দুটো গাধা চরছে মাঠে। মাঝে মাঝে মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকাচ্ছে। জ্যোৎস্নায় চকচক করে উঠছে নীল চোখ। মানু বলল, এখানে বসা যাক।

বসার পর বলল, টর্চ নেই সঙ্গে?

ননী বলল, না।

মানু এপাশে—ওপাশে সাপ খুঁজল হয়তো। তারপর বলল, বসো।

ননী বলল, এতক্ষণে ফের সেই কালো রঙের অলীক মোটর সাইকেল ছুটে এসেছে ননীর খুলির ভেতর থেকে। শব্দহীন ঘুরছে চারপাশে। ননী চোখ বুজল।

মানু ডাকল, ননী!

উঁ?

এবার বলো।

কী?

যা বলতে গিয়েছিলে।

ভুলে গেছি।…বলে চোখ খুলল। এখানে এলে কেন মানু?

বললুম তো মরতে।

কীভাবে মরবে?

তুমি মারবে। মানু একটু ঝুঁকে এল তার দিকে। আমার ভাই তোমার বোনকে যেভাবে মেরেছে সেভাবেই আমাকে মারবে। পারবে না?

ননী তাকাল। জানি না।

দেখ চেষ্টা করে। মানু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল। কৃষ্ণা বাধা দিয়েছিল। আমি বাধা দেব না। তুমি যথেচ্ছ রেপ করে আমার গলা টিপে মারো।

মানু দু’হাতে মুখ ঢাকল। দু’ হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুজল। তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠতে থাকল। খোঁপা ভেঙে পড়ল। ননীর মনে পড়ল, একদিন মানু নিজের ঘরে অন্ধকারে ননীর ঊরুর ওপর মাথা রেখে এমনি কথা বলেছিল। কর্তার সিং গ্যারেজের পিছনের রাস্তায় ইসমিলকে দেখেও যেমন কিছু বুঝতে পারেনি। কেন ননী সঙ্গে সঙ্গে কিছু বুঝতে পারে না? বিদ্যুৎ বলে, নোনে! তুই বুঝিস সবই, তবে বড্ড দেরি করেই বুঝিস। এটাই তোর মস্ত ট্রাবল।

ননী ডাকল, কৃষ্ণা! ডেকেই চমকে উঠল। শুধরে নিয়ে বলল, মানু!

মানু দ্রুত মাথা তুলেছিল। তাকিয়ে রইল ননীর মুখের দিকে। তার ভিজে একটা চোখে ও গালের ওপর জ্যোৎস্না পিছলে পড়ছে। আস্তে বলল, কী বলল, কী বললে ননী? আবার বলো।

ননী ঠোঁটের কোণায় একটু হাসল। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল! যাক গে, কী লাভ এসবে? রাতটা আজ চমৎকার। আমরা অন্য কথা বলি। আর হ্যাঁ, সেই জরুরি কথাটা…

মানু তার কথার ওপর বলল, রাতে কৃষ্ণা বাড়ি ফিরল না। সকালে তোমার কাছে গেলুম। হসপিটাল থেকে ফিরে এসে দেখি, জন ও—ঘরে উপুড় হয়ে শুয়েছে। তারপর লক্ষ্য করলুম, ওর মুখে, গলায়, বুকে আঁচড়ের দাগ। প্লাস্টার আঁটা। মা বলল, পল্টুর স্কুটার থেকে পড়ে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। কিন্তু আমার কেমন যেন লাগল। তারপর গোঁসাই পিসেমশাই কথায় কথায় বললেন, ঝিলের ধারে একটা মেয়ের ডেডবডি পড়ে আছে।

ননী বলল, থাক ওকথা। অন্য কথা বলো।

মানু কানে নিল না। তোমাকে সব লুকিয়েছিলুম। বলবে জন আমার ভাই, তাই। হ্যাঁ, ঠিক তাই—ই। রাগে লজ্জায় ঘেন্নায় দুঃখে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলুম। আমার মাথার ঠিক ছিল না। একদিকে তুমি, অন্যদিকে মা। আর ওই নির্বোধ জন্তু জন আমার ভাই। বলো, আমি কী করতে পারতুম, ননী? আমিও বোকার মতো এই লজ্জা ঘেন্না রাগ দুঃখ থেকে বাঁচতে সব চাপা দিতে চেয়েছিলুম। এর জন্যে আমাকে শাস্তি দাও তুমি।

মানু ফের দু’ হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে দিল।

ননী হাত বাড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে ডাকল, মানু। শোনো।

মানু ওভাবে থেকেই ভাঙা গলায় বলল, তুমি খুব বড়, মহৎ মানুষ ননী। তা না হলে সব জেনেও আমার এই পোড়া মুখ দেখতে আসতে না। আমাকে ঘৃণা করতে।

ননী হাসল। একটু আগে হঠাৎ তোমাকে ঘৃণা হচ্ছিল। জানো?

মানু মুখ তুলল।

ঘৃণা হচ্ছিল। কারণ ভেবেছিলুম, তুমি জনের সেফটির কথা ভেবেই আমাকে ভুলিয়ে দিতে, আমাকে ঠেকাতে নিয়ে এসেছ এখানে। ভেবেছিলুম তুমি আমাকে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলতে চাইছ। আমি তৈরি হচ্ছিলাম।

মানু পিঠ থেকে ভাঙা খোঁপা কুড়িয়ে দু’ হাতে মাথার মাঝামাঝি চুড়ো বাঁধল। বলল, ঠিক তাই।

ননী জোরে মাথা দোলাল। না।

কেন না? সব জেনেও যে মেয়ে ধোয়া তুলসীপাতার মতো মুখ করে তোমার কাছে গেছে, তাকে হঠাৎ বিশ্বাস করে বসলে বুঝি? কেন ননী?

আমার স্বভাব দ্রুত দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলাই। মুহুর্মুহু ধারণা পালটাই। আমি বড় অস্থির মানুষ, মানু।

তাহলে আবার সিদ্ধান্ত বদলাবে। আবার ঘৃণা করবে।

কোনো গ্যারান্টি নেই। ননী মুখ উঁচু করে শ্বাস টানল। চাঁদের দিকে তাঁকিয়ে বলল, এই যে আজ রাতে ঠিক করেছিলুম, আমি…

হঠাৎ চুপ করে গেল সে। মানু বলল, কী ননী? কী করেছিলে!

ননী হাসল। ওই যেমন তুমি বলছিলে। মরতে।

মানু তার ওপর ঝাঁপিয়ে এল। দু’ হাতে তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ঘষতে ঘষতে লালা ও চোখের জলে ননীর মুখ ভিজিয়ে দিতে দিতে বলতে থাকল, আমার প্রাণ। আমার সোনা। কেন, কেন ওকথা ভাবলে? কৃষ্ণার জন্যে? আমি কৃষ্ণা। আমি তোমার কৃষ্ণা, ননী। তুমি আমায় কৃষ্ণা বলে ডাকো ননী, আবার ডাকো। ভুল করে নয়, সত্যি করে ডাকো!

ননী পা ছড়িয়ে শুয়ে রইল চুপচাপ। এমনি করে ঘাসে পিঠ দিয়ে শুয়ে বোনের মতো মৃত্যুর স্বাদ পেতে চেয়েছিল সে। হল না। কারণ ননী টের পেল, সেক্স মানুষকে মেরে ফেলে। ভালোবাসা তাকে বাঁচিয়ে রাখে। জন কৃষ্ণাকে মারল। মানু ননীকে বাঁচিয়ে রাখল।…