কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি – ১৪

১৪

লোয়ার কোর্টে শুনানীর প্রথম দিনই ননী একটু গোলমাল করে ফেলল। ডিফেন্সের মোক্তার শ্রীপতিবাবু রেগে আগুন হলেন শপথবাক্য নামধাম পেশা জিগ্যেস করার পর শ্রীপতিবাবু বললেন, থার্ড মার্চ সকাল দশটায় আপনার বোন কুমারী কৃষ্ণা ভট্টাচার্য কলেজে গিয়েছিল?

ননী বলল, দশটা নয় প্রায় সাড়ে দশটা।

এসব ক্ষেত্রে খালি হ্যাঁ বলে যাওয়াই নিয়ম। ননী আগ বাড়িয়ে যাচ্ছে দেখে শ্রীপতি বিরক্ত হয়ে বললেন, ঠিক আছে আন্দাজ দশটা—সাড়ে দশটার মধ্যে আপনার বোন কুমারী কৃষ্ণা ভট্টাচার্য…

ননী বলল, না। সাড়ে দশটা। রোজ কৃষ্ণা বেরুবার সময় ঘড়ি দেখতাম।

হাকিম একটু হেসে বললেন, দ্যাটস ও কে প্রসিড।

শ্রীপতি আশ্বস্ত হয়ে বললেন, থ্যাংকস ইওর অনার। অফ কোর্স দিস ইজ দা প্রিলিমিনারি হিয়ারিং। দা কোর্ট ইজ সিম্পলি ইনভেস্টিগেটিং দা কেস। অলরাইট। ননীবাবু, তারপর…

ননী কথা বলল, কৃষ্ণা বাড়ি ফিরল না।

আমি যা জিগ্যেস করব, আপনি শুধু তারই জবাব দেবেন। শ্রীপতিবাবু চোখ কটমট করে তাকালেন। আপনি পাবলিক উইটনেস নাম্বার ওয়ান। ডোন্ট ফরগেট দ্যাট। এবার বলুন। আপনি ফোর্থ মার্চ সকালে মদনমোহনতলায় শ্রীমতী মানসী চক্রবর্তীর কাছে শুনলেন, একটা ডেডবডি মোতিঝিলের ধারে পড়ে আছে।…

মানু সিয়োর ছিল না। তার পিসেমশাইয়ের কাছে শুনে দৌড়ে এসেছিল। আমিও বিশ্বাস করিনি।

আবার আপনি আগ বাড়িয়ে কথা বলেছেন? সেসব আমরা তাঁর কাছে শুনব। আপনি যা জানেন, শুধু তাই বলবেন। শ্রীপতির মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট। একটু কেশে ফের বললেন, ফোর্থ মার্চ সকালে আন্দাজ এগারোটা, আপনি এবং শ্রীমতী চক্রবর্তী মোতিঝিলের ধারে গেলেন এবং দেখলেন ডেডবডিটা আপনার বোন কুমারী কৃষ্ণা ভট্টাচার্যের। তাই তো?

ননী একদমে বলল, হ্যাঁ। সবই ঠিক। কিন্তু পুলিশ ভুল লোককে ধরেছে। কৃষ্ণার খুনী কে আমি জানি।

শ্রীপতি দ্রুত ধমক দিলেন, থামুন। ভুল লোক না ঠিক লোক সেটা প্রমাণ করব আমরা। আপনাকে দালালির জন্যে ডাকা হয়নি।

ননী চটে গেল। কিন্তু আমি জানি কে—

শ্রীপতি বাকা হেসে বললেন, ওয়েট ওয়েট। আপনার পেশা তো শিক্ষকতা?

হ্যাঁ।

তাহলে তো আপনি অনেক কিছুই জানেন। আপনি জানেন, পৃথিবীটা গোল, সূর্যের চারদিকে ঘোরে। কিন্তু সে জানা নিয়ে কোর্টের কাজ তো চলবে না। আমি যা জিগ্যেস করব, আপনি শুধু সেটাই জানেন কি না জবাব দেবেন। জানলে বলবেন হ্যাঁ, না জানলে বলবেন, না। ব্যস!

ননী আরও রেগে বলল, তাই বলে নির্দোষ লোক সাজা পাবে? আশ্চর্য তো!

আসামিপক্ষের বিধুমোক্তার এবং তাঁর জুনিয়র নাড়ুবাবু খিকখিক করে হেসে ফেললেন। হাকিম নিষ্পলক চোখে ননীর দিকে তাকিয়ে আছেন। শ্রীপতিবাবুও শুকনো হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে বললেন, ভেরি ওয়েল! ওই যে দেখছেন—দ্যাট ইয়ং ম্যান, ওকে চেনেন? কী নাম ওর?

ননী বলল, চিনি। ওর নাম গাবু। আমাদের পাড়ার ছেলে।

ফোরটিনথ মার্চ আপনি যখন সাইকেল চেপে স্কুলে যাচ্ছিলেন তখন সে আপনাকে মোটরসাইকেলে ফলো করেছিল। তারপর আপনাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল এবং আপনাকে ড্যাগার নিয়ে তাড়া করেছিল। যা বললাম, এবার আপনি তার জবাব দেন। হ্যাঁ, বা না। ব্যস। দ্যাট উইল বি এনাফ!

ননী বলল, হ্যাঁ। কিন্তু প্রথমে—

হাত তুলে শ্রীপতি বললেন, চুপ করুন। কথা বাড়াবেন না। ডিটেলস আপার কোর্টে হবে! আপনি পুলিশের কাছে ডাইরি লিখিয়েছেন। সই করেছেন। তার উইটনেসও রয়েছেন জনাব শাহাদত হোসেন। দ্যাট ইজ এ ডিফারেন্ট কেস।

আসামিপক্ষের মোক্তার বিধুবাবু উঠে প্রতিবাদ করলেন, ইয়োর অনার। ডিফেন্স ল—ইয়ার নিজে বলছেন, দ্যাট ইজ এ ডিফারেন্ট কেস। তাহলে কেন এসব অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা? আই অবজেক্ট!

শ্রীপতি ব্যস্তভাবে বললেন, ইয়োর অনার! আমার উদ্দেশ্য আছে এবং একটু পরেই বুঝবেন ইট ইজ কোয়াইট রিলেভেন্ট! ননীবাবু আপনাকে দ্যাট ভেরি ইয়ং ম্যান—গাবু ওরফে সুশান্ত বোস ড্যাগর নিয়ে তাড়া করেছিল। তাই না? এমন কী, জনাব শাহাদত হোসেন না এসে পড়লে—

বিধুবাবু ফের দাঁড়িয়ে বললেন, আই অবজেক্ট ইয়োর অনার। অপ্রাসঙ্গিক।

শ্রীপতি বললেন, ইয়োর অনার, আমি আসামির কিলার—ইনস্টিংক্ট, আই মিন, সে যে সহজেই খুন করতে পিছ—পা নয়, সেটাই ইস্টাব্লিস করতে চাইছি।

বিধুবাবু হেসে বললেন, আই অবজেক্ট দ্যাট ভেরি পয়েন্ট ইয়োর অনার। সেই যে কথায় বলে লঙ্কাধামে রাবণ মলো আর বেহুলা কেঁদে বিধবা হলো। সংসারে কোন প্রাণীর কিলিং ইনস্টিংক্ট নেই?

আদালতে চাপা হাসির ঝড় বয়ে গেল। শ্রীপতিবাবু মুখের ঘাম মুছে ননীর দিকে লাল চোখে তাকিয়ে বললেন, ফোরটিনথ মার্চ আপনাকে গাবু ড্যাগার নিয়ে তাড়া করল। তবু বলবেন….

বিধুবাবু প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, আই অবজেক্ট!

হাকিম গম্ভীর মুখে বললেন দা অবজেকশান ইজ সাসটেনড। শ্রীপতিবাবু প্লীজ কাম টু আওয়ার কেস।

শ্রীপতিবাবু এবার একটা কালো ডাইরি তুলে ননীকে দেখিয়ে বললেন, এটা আপনার বোনের ডাইরি বলে চিনতে পারেন? দেখে বলুন।

ননী ডাইরিটা তুলে দেখে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু কৃষ্ণা যা লিখেছে, তাতে কিছু প্রমাণ হয় না।

শ্রীপতিবাবু গলার ভেতর বললেন, পি ডবলিউ নাম্বার ওয়ানকে আমরা হোস্টাইল ডিক্লেয়ার করব। কোনো প্রয়োজন নেই। ননীবাবু আপনাকে আমাদের দরকার নেই। আপনি আসুন। নেক্সট পি ডবলিউ শিবু রজক।

পেয়াদা হাঁকল—শিবু রজোক! শি—বু র জো—ক হাজির।…

ননী ঘর থেকে বেরিয়ে হনহন করে চলে গেল। কে পিছন থেকে ডাকছে মনে হল, কিন্তু ঘুরেও দেখল না।

লাঞ্চ রিসেসের পর ফের শুনানী চলল। শ্রীমতী মানসী চক্রবর্তী অনুপস্থিত। অসুস্থ। ডাক্তারি সার্টিফিকেটসহ পিটিশান পেশ করলেন নাড়ু মোক্তার। শ্রীপতিবাবুর চোখ ছানাবড়া। বললেন, ওকেও আমরা হোস্টাইল ডিক্লেয়ার করব।

পুলিশ এস আই অরুণ নন্দী, হাসপাতালে ডাক্তার নবদ্বীপ ঘোষ, তারপর কাঠগড়ায় এল রেলের গেটম্যানের বউ মালতী বেসরা। ঘোমটার ফাঁকে হাকিম দেখতে থাকল।

শ্রীপতিবাবু বললেন, যেদিন মোতিঝিলে একটা মেয়ের লাশ পাওয়া যায়, তার আগের দিন বিকেলে ঝড়জল হয়েছিল?

মালতী বলল, হাঁ হুজুর। খুব ঝড়ি। ফির শিলভি গিরছিলেক।

ঝড়ের সময় তুমি পুরনো পল্টনের ময়দানে একটা ছাগল খুঁজতে গিয়েছিলে?

হাঁ হুজুর। রশ্বি টুটে পলাইছিলেক। ছাগলঠো…

ফালতু কথা নয়। যা বলছি, তার জবাব দেবে। মাঠের কাছে গিয়ে দেখলে, দুজন লোক একটা মোটরসাইকেল চেপে….

না হুজুর। ভটভটিয়া ছিলেক।

মোটরসাইকেলকেই ভটভটিয়া বলে। শ্রীপতি মুচকি হাসলেন।

বিধুবাবু উঠে বললেন, অবজেক্ট। দা ডিফেন্স ইজ ইনসিসটিং ইটস ওন কনক্লুসন ইন দা মাউথ অব দা উইটনেস।

শ্রীপতিবাবু দ্রুত ঘুরে বললেন, ঠিক আছে। ভটভটিয়া চেপে ঘুরছিল বলছ তো?

মালতী সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ। মেইয়াঠোকে বারেংবারেং (বারে বারে) ঢু মারতে যাচ্ছিলেক! মেইয়াঠোর ইধারে উধারে ঘুরপাক খাঞে—মালতী আঙুল তুলে নিজের চারপাশে ঘোরাবার ভঙ্গি করল।

শ্রীপতি একগাল হেসে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। সব শুনব, সব শুনব। আগে আমি যা বলি, জবাব দাও। ওই দ্যাখো, ওই যে ওখানে একটা ভটভটিয়া রয়েছে—ইয়োর অনার! একজিবিট নাম্বার ওয়ান।

বিধুবাবু লাফিয়ে উঠলেন, এগেন ইউ আর সাজেস্টিং ইওর ওন কনক্লুসন। আই অবজেক্ট।

শ্রীপতি হাসলেন। অলরাইট, অলরাইট। আই অ্যাপ্রিসিয়েট ইউ মাই লার্নেড ফ্রেন্ড। তা হ্যাঁ গো মা! ওই যে দেখছ কালো মতো দু—চাকাওয়ালা জিনিস। ওটা কী?

মালতী বলল, হ্যাঁ। ভটভটিয়া আছে হুজুর।

তাহলে তুমি ঝড়ের সময় ছাগল খুঁজতে গিয়ে দেখলে, ওই ভটভটিয়ায় চেপে দুজন একটা মেয়েকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে এবং তুমি…

মালতী চোখ বড় বড় করে মোটরসাইকেলটা দেখছিল। এবার শ্রীপতি মোক্তারের কথার মধ্যে জোরে মাথা নেড়ে বলল—না, না। উঠো না আছিলেক হুজুর। উ ভটভটিয়া না আছে। ওত্তা যন্তর না আছিলেক। উ ভটভটিয়া—মালতী রঙ খুঁজতে থাকল ব্যাকুল দৃষ্টিতে। তারপর ঘুরে দরজার দিকে একটা লোকের জামা দেখেই বলে উঠল ফের, ওহি রং আছিলেক হুজুর। ওহি নীল রং আছিলেক।

শ্রীপতিবাবু গর্জে বললেন, থামো! ঝড়ে ধুলো উড়ছিল না? মেঘে আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল না? কী? বলো!

মালতী ঘাবড়ে গিয়ে বলল, তা হইছিলেক বটে।

তুমি একটু দূর থেকে দেখেছিলে কি না?

হাঁ হুজুর। শও—দুশো পা দূরে আছিলেক।

বিধুবাবুরা হো হো করে হাসছিলেন। হাকিম বললেন, অর্ডার। অর্ডার!

শ্রীপতি বললেন, তোমার ভুল হতে পারে কি না। ঝড়ের সময় তো বটে।

মালতী গোঁ ধরে বলল, না হুজুর। ভুল হবেক ক্যানে? উঠো নীলা ভটভটিয়া আছিলেক। বলেই সে আদালতের বড় দরজা দিয়ে নীচের প্রাঙ্গণে রাখা একটা স্কুটারের দিকে আঙুল তুলল। বাচ্চা মেয়ের মতো চেঁচিয়ে উঠল। চেরা গলায়, ওহি রকম ভটভটিয়া হুজুর! ওই যে! দ্যাখেন, দ্যাখেন।

হাকিম হাতের ইশারায় দরজার ভিড় হটাবার নির্দেশ দিলেন। প্রতিটি চোখ ঘুরে গেল ওদিকে। তারপর হাকিম বললেন, দ্যাট ইজ এ স্কুটার। অলরাইট! প্রসিড।

শ্রীপতিবাবু পুলিশের কোর্ট ইন্সপেক্টারের কাছে চাপা গলায় বলেছিলেন, কী হচ্ছে মশাই? তলার ফুটো না মেরামত করে নৌকো ভাসিয়ে বসে আছেন। কেলেঙ্কারির হল যে! সিওর থাকুন, কেস সেখানে যাচ্ছে না। যতঃ সব।

নিয়মমতো সব সাক্ষীকেই তৈরি করা হয়েছিল আগেভাগে। মালতীকেও বলা হয়েছিল, যা এই মোক্তারবাবু জিগ্যেস করবেন, খালি হ্যাঁ দিয়ে যাবে। কিন্তু নতুন সাক্ষীদের বেলায় সচরাচর যা ঘটে, তাই ঘটল।

মরিয়া হয়ে শ্রীপতিবাবু বললেন, সে যাই হোক। ভটভটিয়াটা একটা মেয়েকে তাড়া করে ঘুরছিল। তারপর তুমি দেখলে মেয়েটি আছাড় খেল। কেমন?

হাঁ, হুজুর।

তারপর—তাকিয়ে দেখ, ওই যে ছেলে দুটো দাঁড়িয়ে আছে, তার মধ্যে লম্বা মতো যে—সে মেয়েটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাই না?

বিধুবাবু বললেন, এগেন আই অবজেক্ট, ইয়োর অনার। হিজ সাজেস্টিং দা কনক্লুসান।

হাকিম বললেন, দা অবজেকশান ইজ সাসটেনড।

শ্রীপতিবাবু সাদা কোটের দু’ পকেটে হাত ভরে বললেন, তুমি সেই ভটভটিয়ার একজনকে মেয়েটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখলে। তাই তো?

হাঁ হুজুর। দেখলেক বটে—তবে উ তো দুসরা আদমী আছিলেক।

শ্রীপতি দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, তুমি একেবারে সর্বদর্শী! ঝড়ের সময় ধুলো উড়ছে। মেঘে—মেঘে সব কালো। তার মধ্যে তুমি একেবারে চোখে জ্যোতি জ্বেলে দিয়েছিলে। যা বলেছি, তার জবাব দাও।

মালতী ধমক খেয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। ঘোমটার পাড়ে নাক ঝেড়ে মুছে বলল, আমি বেটাবেটির মা আছেক হুজুর। আমি ঝুটা বুলবেক নাই। দুঠো লোক ছিলেক—তমে উরা না ছিলেক। একহি চুল ছুটো—ছুটো। দুই সিপাইজীর চুল দেখে লিন—ওত্তা ছুটো। দুসরা লোকর ভি ছুটো ছুটো দাঢ়ি ছিলেক। বলে সে নিজের চিবুক দেখিয়ে দিল।

আদালতে আবার হাসির ঝড় বয়ে গেল। হাকিম বললেন, অর্ডার! অর্ডার!…

সন্ধ্যায় ননী বারান্দায় আবছা অন্ধকারে বসে আছে। পুরো চাঁদের জ্যোৎস্না ভাসিয়ে দিচ্ছে বাড়ি আর উঠোন। হু হু করে বাতাস বইছে। আজকাল সন্ধ্যার পর কতক্ষণ ননী আলো জ্বালে না। গোঁসাই কোথায় কোথায় গান শেখাতে যান। ফেরেন রাত নটা সাড়ে নটায়। ততক্ষণ ননী চুপচাপ বসে থাকে।

সদর দরজায় কড়া নড়ার সঙ্গে সঙ্গে ননী চমকে উঠেছিল—যেন বলবে, কৃষ্ণা এলি? এরকম সেই কবে থেকে হচ্ছে। এর হাত থেকে রেহাই নেই।

উঠোনে নেমে মনে হল মানু কি? এক মুহূর্তে দাঁড়াল। মানু সত্যি এলে কী করবে ননী? কড়া জোরে নাড়ছে। না, মানু নয়। মানুর কড়া নাড়া তার পরিচিত। বুঝতে পারে ননী। তার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। নিশ্বাস ফেলে দরজা খুলে দেখল, গাবুর বাবা গৌতম ঘোষ। ধপধপে সাদা পানজাবি চকচক করছে। হাওয়ায় ফুলছে। গৌতমবাবু বললেন, তোমার কাছে এলুম ননী। ক’দিন থেকে আসব—আসব ভাবছিলুম। নানান ঝামেলায় থাকি। তোমার বোন বেচারির স্যাড ডেথের পরও ভেবেছিলুম…

ননী বলল, ভেতরে আসুন কাকাবাবু। আমিও যাব ভেবেছিলুম আপনার কাছে।

গৌতমবাবু ঢুকলেন। অন্ধকার কেন? লাইটে গণ্ডগোল নাকি?

ননী বলল, না। এমনি। তারপর বারান্দায় উঠে আলো জ্বেলে দিল। চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, বসুন কাকাবাবু।

গৌতমবাবু বসলেন। ননী তাকিয়ে রইল। ফেমাস গোমো কায়েত এখন তার বাড়িতে। ভাবা যায় না। গতবার নিজের সিনেমা হলে একটা ছবি এনে তার হিরো—হিরোইনকে দিয়ে উদ্বোধন করেছিলেন। শহরে হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। কৃষ্ণা ছটফট করে বেড়াচ্ছিল। পিউ পাস পেয়েছে। পিউ যাবে। দাদা তুই যা না রে গৌতমকাকার কাছে! তোকে তো খাতির করে। ননী হেসে ফেলেছিল। গৌতমকাকা! গোমো কায়েত কারও কাকা নয়, জানিস? কৃষ্ণা বলেছিল, আহা! আমরা কি পাস চাইছি? টিকিট আনবি। কোথাও টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না শুনলুম। শেষ অবধি কৃষ্ণার তাগিদে ননী গিয়েছিল। গোমো কায়েত ননীকে যেন চেনেনই না, এভাবে বলেছিলেন, আমি কি টিকিটের গাছ হে? নাকি আমি টিকিট বেচি? যেখানে বেচছে, সেখানে যাও। ননী অপমানে মুখ লাল করে ফিরে এসেছিল। কৃষ্ণা মনমরা হয়ে বলল, বরং গাবুদাকে বললে হয়তো পেয়ে যেতে! ননী রেগে গিয়েছিল। যেতে হয়, তুই যা! কৃষ্ণা তা যাবে কেন? গাবুর মতো আজেবাজে ছেলের কাছে পিউ যেতে পারে। কৃষ্ণা যাবে না কোনোদিন। পরে কৃষ্ণা বলেছিল, জানিস দাদা? একেবারে ঝুল ছবি। সবাই বলছে। পয়সা বেঁচে গেছে আমাদের। ননী একটু হেসে বলেছিল, হুঁ, দা গ্রেপস আর সাওয়ার। কৃষ্ণা সে বেলা কথা ছেড়েছিল তার সঙ্গে!…

সেই গোমো কায়েত তাদের বাড়িতে এসেছেন। ভিজে গলায় কথা বলছেন। কৃষ্ণা যদি থাকত!

ননী ভাবছিল, বরং কৃষ্ণার আত্মাটাত্মা থাকলেও খুব ভালো হত। এই সব সময়ের জন্যেই মানুষের আত্মা থাকার খুব প্রয়োজন। কিন্তু এখানেই মানুষের হার। তার আত্মা নেই। ম্যান ইজ মেসিন।

ননী, তুমি আমাদের গর্ব। রিয়্যালি, আমি হলফ করে বলতে পারি এ যুগে তোমার মতো অনেস্ট, সত্যবাদী এবং ন্যায়পরায়ণ মানুষ একজনও নেই। গৌতমবাবু উজ্জ্বল মুখে বললেন।

ননী নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।

তুমি প্রকাশ্য আদালতে বলে এলে, গাবু নির্দোষ। সত্যি সে নির্দোষ।

ননী আস্তে বলল, হ্যাঁ। আমি জানি, সে বা লটকনিয়া কৃষ্ণাকে খুন করেনি।

গৌতমবাবু মোলায়েম স্বরে বললেন, এই তো চাই! তুমি একজন শিক্ষক। আমাদের আজ এও এক গর্ব যে, তোমার ছাত্ররা এ থেকে শিক্ষা পাবে। সত্য কথা বলতে পিছ—পা হবে না। তা কথা হচ্ছে গিয়ে, আমার ছেলে গাবু—গাবু ইজ মিসগার্ডেড অফ কোর্স। দেখতেই তো পাচ্ছ, যুগের কী রকম হাওয়া—বাতাস। ওদের কচি ব্রেন বিষিয়ে যেতে দেরি হয় না।…সেদিন তোমাকে অপমান করে ফেলেছে হঠাৎ রাগের বশে।

ননী দ্রুত বলল, ঘুষি মেরেছিল। তবে আমি মেরেছি ওকে। রক্ত পড়ছিল। তখন ও মরিয়া হয়ে ছোরা বের করল। পরে ভেবে দেখলাম, আমি গাবু হলে হয়তো ঠিক তাই করতুম।

গৌতমবাবু খুশি হয়ে বললেন, বলো! তাহলে বলো সে কথা?

বলছি। ননী শক্ত গলায় বলল। কেউ যদি তোমাকে মিথ্যে করে কেসে ঝোলাত যে আমি একটা মেয়েকে রেপ করে গলা টিপে মেরে ফেলেছি, আমি নিশ্চয় তাকে ক্ষমা করতুম না।

ননী থামলে গৌতমবাবু বললেন, এক্স্যাক্টলি! এক্স্যাক্টলি।

ননী বলল, সত্যি এ বড় অপমানজনক ব্যাপার। কাজেই ভেবে দেখলুম, গাবু আমাকে ঘুষি মেরেছে—ঠিকই করেছে।

গৌতমবাবু ঝটপট জিভ কেটে বললেন, না না। এতটা ঠিক নয়! আফটার অল তুমি ওর দাদার বয়সি।

হ্যাঁ। গাবু আমাকে বরাবর খাতির করেছে। ননী শান্তভাবে বলল। দেখা হলেই হেসে কথা বলেছে।

তবে? তাহলেই দ্যাখো বাবা ননী।

সেদিন গাবু যে ড্যাগার বের করেছিল সেও নিজের প্রাণ বাঁচাতে। আমার পায়ের কাছে মোটাসোটা পাথরের পাঁজা ছিল। আমার মাথায় খুন চড়ে গিয়েছিল। পাথর ছুড়ে ওকে মেরে ফেলতে পারতুম। ভাগ্যিস সঙ্গে ও ড্যাগার রেখেছিল! ননী হাঁ করে দম নিল।

গৌতমবাবু নড়ে উঠে বললেন, আর ওই ব্যাটা মোছলমান ড্রাইভারটার কী সাহস দেখ। একটা ঝামেলা হচ্ছে, মিটিয়ে দিবি বুঝিয়ে সুঝিয়ে—তা নয়, দল বেঁধে ওকে মারতে গেলি! দেশের যা অবস্থা, এ কত বড় রিস্ক—আগুন নিয়ে খেলা, ভেবে দেখ তো বাবা! কমিউন্যাল রাইট বেধে যেতে পারত—যদি আমি না সবাইকে বুঝিয়ে থামিয়ে দিতুম। সত্যি বলছি। অনেকে তো বলেই ফেলল, এ কি পাকিস্তান পেয়েছে ব্যাটা?

ননী জোরে মাথা নেড়ে বলল, না, না। ব্যাপারটা ওভাবে কেন নেবে ওরা—মানে যাদের কথা বলছেন! সেও অন্যায়। তবে এও ঠিক, শাহাদত গাবুকে তাড়া না করলে একটা মার্ডার হত। হয় আমি নয়তো গাবু। শাহাদত ভালোই করেছিল কাকাবাবু।

তা তুমি যখন বলছ, মেনে নিতে আপত্তি কী? এখন কথা হচ্ছে, যা হবার হয়ে গেছে। ও কেসটা তো যা বুঝেছি, লোয়ার কোর্টেই ডিসমিস হয়ে যাবে। এখন দ্বিতীয় কেসটা—মানে অ্যাটেম্পট টু মার্ডার কেসটার মিটমাট করে ফেলা যাক!

আমি রাজি।

ননী ভারি নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার আর ঝামেলা ভালো লাগে না। আমি চুপচাপ কাটাতে চাই। কিন্তু এও তো পুলিশ কেস। পুলিশের সঙ্গে আগে কথা বলে নিন।

গৌতমবাবু গলা চেপে বললেন, কথা বলেই আসছি। চার্জশিট সাবমিট করবে না ওরা। খালি একটার পর একটা ডেট পড়বে। তারপর হাকিমের তাড়া দেখলে একটা ফোঁপরা ধরনের চার্জশিট দেবে। ব্যস! তখন সেকেন্ড হিয়ারিং—এ দৈবাৎ তোমাকে ডাকা হলে এইমাত্র যা বললে তাই বলবে। তবে সামান্য ঘুরিয়ে বলতে হবে। মার্ডার কথাটা একেবারে বাদ দিয়ে বলবে। বলবে, গাবুর সঙ্গে তোমার মারামারি হয়েছিল। তুমি ওকে মেরেছ, ও তোমাকে মেরেছে। আর ডাইরিতে কী লিখেছিল পুলিশ—তুমি না পড়েই সই করেছ বলবে। ব্যস!

ননী বলল, ঠিক আছে।…

এরপর গৌতমবাবু ননীকে খাওয়াদাওয়া এবং সাংসারিক কয়েক ঝাঁক প্রশ্নের পর উঠে দাঁড়ালেন। চলি বাবা ননী! ঈশ্বর তোমার দীর্ঘজীবী করুন। তুমি বরাবর এরকম সত্যভাষী নির্ভীক এবং ন্যায়পরায়ণ হয়ে মাথা উঁচু করে চলো। তুমি এ টাউনের গর্ব, ননী।

তারপর সদর দরজার কাছে গিয়ে কামিনী ফুলের গাছটা দেখিয়ে নাক উঁচু করে বললেন, কী ফুল?

কামিনী। কৃষ্ণা ছোটবেলায় পুঁতেছিল!

আহা! তা হলে তো ‘মেমারি’! বাঁচিয়ে রেখো যত্ন করে। জলটল দিয়ো। কিন্তু এ কি হচ্ছে বলো তো ননী?

আজ্ঞে?

ঘুরে চাঁদের দিকে তাকালেন গৌতমবাবু। সেই কবে একটুখানি ঝড়জল হল। তারপর টানা খরা। গাঁয়ের দিকে নাকি হাহাকার পড়ে গেছে। দেখবে, প্রচুর মানুষ মরবে। না খেয়ে মরবে। তবে প্রাণ এ যুগে বড্ড সস্তা হে ননী। হেঁ হেঁ হেঁ বড্ড সস্তা।

দরজা বন্ধ করে এসে ননী কামিনী গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। মনে হল, কৃষ্ণাকে দেখতে পাচ্ছে। কৃষ্ণা, ফিরেছিস নাকি?

হ্যাঁ রে, দাদা! তোর আজ দেরি হলে যে?

ওই একটু চৌমাথায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিলুম সজলদার সঙ্গে।

খুব আড্ডাবাজ হয়েছ! আর আমার বেলা?

যাঃ! তোর বেলা আবার কী? তুই ওখানে অন্ধকারে ঝোপে ঢুকেছিস কেন? পোকামাকড় থাকবে। চলে আয়!

ও দাদা! গাছটা কতবড় হয়েছে রে! দেখে যা আমার বুক অব্দি।

এই, এই! জড়াসনে। পোকা থাকবে।

কী নরম আর ঠান্ডা! আঃ।

শুঁয়োপোকা আছে কিন্তু, সকালে দেখেছি জানিস?

এই! যাঃ! ভালো হবে না বলছি। আমার গাছে শুঁয়োপোকা হয় না।

বেশ। গায়ে লাগুক, বুঝবে ঠ্যালা।

দাদা! শোন, শোন!

কী?

কামিনী ফুল কখন ফোটে রে?

জানি নে। বর্ষাটর্ষায় হবে।

কৃষ্ণা কামিনীর গালে ঠোনা মারে। এই মেয়ে! যদি অনেক, অ—নে—ক ফুল না ফোটাও তো কী করব জানো? গান্ধীজীর মতো ছাগল পুষবো!

ননী হেসে অস্থির। গান্ধীজীর মতো ছাগল পুষবি? বলিস কী!

হ্যাঁ। আমার বইয়ে লেখা আছে না? গান্ধীজী ছাগল পুষিতেন। কারণ, ছাগলের দুগ্ধ খুব পুষ্টিকর।

আচ্ছা পুঁটি, বল তো গান্ধীজীর হত্যাকারীর নাম কী ছিল?

নাথুরাম। না রে দাদা?

হ্যাঁ, নাথুরাম বিনায়ক গডসে। তার ফাঁসি হয়েছিল।

দাদা!

উঁ?

ফাঁসি কীভাবে হয় রে?

গলায় দড়ির ফাঁস আটকে ঝুলিয়ে দেয় আর কী!

ইসস! দম আটকে যায় না?

হ্যাঁ। দম আটকেই তো মারা যায়।

কৃষ্ণা নিজের গলায় দুটো হাত চেপেই ছেড়ে দেয়। সত্যি রে দাদা। ভীষণ কষ্ট হয়—ভীষণ! যাঃ বড্ড খারাপ।

ননী হাসে। গলা টিপে ধরে বুঝলি?

হুঁউ। তার চেয়ে গুলি করে মারল না কেন?

সে তো মিলিটারি আইন। কোর্টমার্শাল বলে। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। আমাদের দেশে গণতন্ত্র তো! তাই মৃত্যুদণ্ড মানেই ফাঁসি।

ও দাদা, আমার ফাঁসি হলে কী করব রে? যেন সত্যি ফাঁসি হচ্ছে, এমন নাকি কান্নার সুরে কথাটা বলে।

তুই একটা পাগলি। কেন তোর ফাঁসি হবে? তুই কি মানুষ মারবি নাকি? দেখিস বাবা।

ধর, যদি হয়! উরে বাবা! আমি ভয়েই মরে যাব।

ননী হাসতে হাসতে তার কান ধরে বলে, খালি ডেঁপোমি! ছ’টা বেজে গেছে খেয়াল আছে? পড়তে বসবি কখন?…

ভারি একটা নিশ্বাস ফেলে ননী বারান্দায় উঠল। স্মৃতি বড় জ্বালায়। স্মৃতি বড় নিষ্ঠুর। বড় সহজে সে হামলা করে, বিনা প্রতিরোধে। ননী কি বাকি জীবন এভাবে মার খেয়ে যাবে তার হাতে? একটা কিছু করা দরকার।…