কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি – ১৩

১৩

ম্যান ইজ মেসিন। আত্মাটাত্মা বাজে কথা। অথচ কী একটা থাকে, থেকে যায় বহুকাল—যা মৃতরা রেখে যায় জীবিতদের কাছে। রেখে যায় তাদের ফেলে যাওয়া ঘরবাড়িতে, পৃথিবীতে কোথাও—কোথাও। জীবিতদের মনে তারা বেঁচে থাকে কতদিন—কতকাল। সেই তার ভূত। ননী বুঝেছে, কৃষ্ণার অশরীরী ভূতের বর্তমান নেই, ভবিষ্যৎ নেই—খালি অতীতকালটা আছে। তাই এত ভোগাচ্ছে। আসলে তো মানুষেরা নিজের এবং অন্যের অতীতকাল নিয়েই বেঁচে আছে। এযাবৎ মানুষ ও তার সমাজের ইতিহাস অতীতকালকে কেন্দ্র করেই এবং সবই পাস্ট টেন্স, এই কঠিন সত্য ননীর কাছে নতুন হয়ে বুকে ধাক্কা মারছে। চতুর্দিকে ভূত। তাই ভয়টা কীসের? ভবিষ্যতের দিকে লম্বা পায়ে হেঁটে চলো। পেছনে চেয়ো না, চাইলেই রক্ত শুকিয়ে যাবে।

কৃষ্ণার শ্রাদ্ধের দিনটা ননী ছাপোষা গেরস্থর মতো ব্যতিব্যস্তভাবে কাটাল। গোঁসাইজী, মধুবাবু, বিদ্যুৎ মিলে ত্র্যহস্পর্শের ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছিল। ননী অনেক যত্নে বাগ মানাল। কাঙালিভোজন শেষ হতে রাত এগারোটা বেজে গেল। দুপুরে গঙ্গায় গিয়ে শান্তিস্বস্ত্যয়ন কৃত্যাদি চুকিয়ে এসেছিল। কিন্তু ক্ষৌরকর্ম করেনি ননী, দাড়ি রেখে নিজেকে চমৎকার দেখাচ্ছে বলে তাঁর ধারণা। তারপর দুপুর রাতে গানের আসর বসালেন ফেলু গোঁসাই। উঠোনভরা লোকজন। শামিয়ানা চৈত্রের বাতাসে ফুলে ফুলে উঠতে থাকল। গোঁসাই বারান্দায় বসে একটার পর একটা ভজন গাইলেন। সে আসর ভাঙল একেবারে রাত দুটোয়। বিদ্যুৎ ননীর কাছে শুলো। আর গোঁসাই সেই যে ঢুকেছেন কৃষ্ণার ঘরে, আর মায়া কাটাতে পারছেন না। সেদিন থাকতে গিয়ে মানুদের বাড়ি থেকে যন্তর এবং স্যুটকেশ নিয়ে চলে এসেছেন। ননীর বরং ভালোই লেগেছে।

কিন্তু মানু আসেনি শ্রাদ্ধে। ননী গিয়ে অত করে বলে এসেছিল, তবু আসেনি।

গোঁসাই বলেছেন, বলেছিলুম না। মহা ধড়িবাজ মেয়ে। ওকে তুমি সহজ মেয়ে ভাবছ? মোটেও না। সম্পর্কে আমার শালার মেয়ে—সেই ন্যাংটো থেকে দেখছি। স্কুলে যাবার নাম করে টোটো করে ঘুরত ভাইবোনে। আর মেয়ে হয়েও ছেলেদের কান কেটে বেড়াত। আজ একে মার, ওর চুল ছেঁড়া—কাল কার বইকলম কেড়ে নেওয়া। যেমন ভাই তেমনি বোন। একদিন আপন খেয়ালে আসছি, একখানে দেখি একটা ছেলেকে মাটিতে পেড়ে তার বুকের ওপর বসে আছে। চুল খামচে ধরেছে। বলো তো, কার কথা বলছি? মানু। হ্যাঁ, ওই মানু।

ননী বোঝে, গোঁসাইয়ের খানিকটা বাড়াবাড়ির অভ্যাস আছে। তাহলে মানু একটু অন্যরকম।

গোঁসাই এসে রান্নাঘরটি ফের গুছিয়ে নিয়েছেন। ফের চালডাল নুনতেল আনাজপাতি এসেছে। প্রথম দিনটা গোঁসাইয়ের নিজের পয়সায়। তারপর ননীর। কেরোসিনকুকারে গোঁসাই মোড়ায় বসে রাঁধেন। বলেন, এ অভ্যেস চিরকাল; একটুও অসুবিধে হয় না। বাছবিচার করিনে, কিন্তু তাই বলে সব জায়গায় প্রবৃত্তি তো হয় না বেটা। গাঁগেরামে কোনো নতুন ছাত্র—ছাত্রীর বাড়ি গিয়ে একবেলা খেয়েই বুঝে নিই, অসম্ভব। তখন বলি, চালডাল দাও। স্বপাক খাওয়াই অভ্যেস। কালেভদ্রে…হেঁ হেঁ….

গোঁসাই খুন্তি নাড়তে নাড়তে হেসে অস্থির হন। ননীও হাসে। কিন্তু কখন একসময় টের পায়, তার চোয়াল আঁটো হয়ে গেছে। মাথার ভেতরটা শূন্য লাগছে আর খুলির ভেতর ফের চক্কর দিচ্ছে কালো—হ্যাঁ, কালো একটা মোটরসাইকেল। কিছুতেই ওখানে নীলরঙের একটা স্কুটারকে ঢোকাতে পারছে না। হঠাৎ কালো মোটরসাইকেল ব্রেক কষার সঙ্গে সঙ্গে ননী নড়ে ওঠে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।

এবং হঠাৎ—হঠাৎ সেই বিমূর্ত সেন্টের গন্ধ স্নায়ুকে অবশ করে চলে যায়। সদরদরজায় যেন কড়া নড়ে ওঠে। ননীর অবচেতনা থেকে সাড়া সাড়া জাগে অনুচ্চারিত নিঃশব্দ একটি বাক্যে : কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি। উঠোনে অলীক পায়ের শব্দের পর অলীক কণ্ঠস্বরে কে জানতে চায়, কৃষ্ণা ফিরেছে কি? ননী ঠোঁট ফাঁক করে—প্রায় বলে ওঠে আর কী—না। কৃষ্ণা এখনও বাড়ি ফেরেনি।

দশ দিন পরে ননী স্কুলে যাচ্ছিল।

সকালে কিছুক্ষণ রোদ্দুর ছিল। তারপর আকাশ মেঘলা হয়ে গেছে। নদীর শুকনো বালিতে স্রোতের দাগের মতো মেঘের ভাঁজ। রাস্তার দুধারে কৃষ্ণচূড়া লাল হয়ে ফুটেছে। ননী আস্তে চাপ দিচ্ছিল প্যাডেলে। অল্প অল্প বাতাস আছে। পেছন থেকে ঠেলছে। তোপপাড়ার বাজার এলাকা ছাড়িয়ে নির্জন রাস্তায় বাঁক নিল সে। একটু পরে চমকাল। মোটরসাইকেলের শব্দ হচ্ছে। মাথাটা ঘুরে উঠল তার। তারপরই সামলে নিল। মাথার ভেতরকার সেই ব্যাপারটা নয়, তার পিছনে একটা মোটরসাইকেল আসছে। ননী রাস্তায় ধার ঘেঁষে যাচ্ছিল। পিচ থেকে চাকা নামিয়ে দিল ঘাসে। সামনে একটা ট্রাকও আসছে।

ট্রাকটা চলে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে ননী দেখল, মোটরসাইকেলটা তার খুব কাছে এসে গেছে এবং গাবু বসে আছে। চোখে মস্ত সানগ্লাস। সে ব্রেক কষল।

ননী সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল থেকে নামল। একটু হেসে বলল, এই যে গাবু। ভালোই হল। তোমার সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবছি ক’দিন ধরে। হচ্ছে না। কৃষ্ণার শ্রাদ্ধটাদ্ধ নিয়ে ঝামেলা ছিল। আমি খুব দুঃখিত গাবু….

গাবু মোটরসাইকেল থেকে নেমেছে। দু’হাতে কালো গ্লাভস। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ননীর সামনে।

গাবু ওর শার্টের কলার ধরে টেনে দাঁড় করাচ্ছিল। ননী ব্যস্তভাবে বলল, গাবু শোনো—কথা শোনো আগে।

গাবু অন্য চোয়ালে ঘুষি মারল। ফের ননী ছিটকে পড়ল ঘাসের ওপাশে জড়োকরা পাথরকুচির ওপর। গাবু পা বাড়িয়ে হাতের গ্লাভস ঠিক করতে করতে গলার ভেতর বলল, শালা নোনে! তোমার ওই কালোকুচ্ছিত পেত্নী বোনের….

জঘন্যতম অশ্লীল বাক্য দিয়ে গাবু বুঝিয়ে দিল, সে কয়েকশো কৃষ্ণা ন্যাংটো হয়ে পড়ে থাকলেও তাকিয়ে দেখবে না। এবং ননী সঙ্গে সঙ্গে চাপা গর্জন করে দাঁড়াল। দু’হাতে দুটো মোটা পাথর। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। প্রচণ্ড জোরে গাবুর মুখ লক্ষ করে ছুড়ল সে। পর পর দুটো পাথর। তারপর দ্রুত ঝুঁকে আবার দুটো পাথর নিল।

গাবু এক লাফে সরে গিয়েছিল। কিন্তু একটা পাথর তার নাকে লেগেছে। অন্যটা কানের পাশে। তারপর ননী পাথর ছোড়ার হিংস্র খেলায় মেতে উঠল। গাবু মোটরসাইকেল থেকে পিছু হটছে। মুখ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ননী পাথরের পাঁজার কাছে দাঁড়িয়ে পাথর ছুড়ছে একটার পর একটা।

ওপাশে একটা আবলুস গাছ—গাবু তার আড়ালে যেতেই ননী চোয়ালের যন্ত্রণার মধ্যে অতিকষ্টে হাতের পাথরটা নেড়ে বলল, কাম অন! কাম অন! তারপর ছুড়ে মারল পাথরটা; গাছের গুঁড়িতে লাগল সেটা।

এবার গাবু এদিকে ওদিকে তাকিয়ে পাথর খুঁজছে। ননী পিচে কয়েক পা এগিয়ে চিৎকার করে বলল, কাম অন শুয়োরকা বাচ্চা!

হঠাৎ গাবু সোজা হয়ে দাঁড়াল। ড্যাগারটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। ননীর অতর্কিত পালটা আক্রমণের কথা ভাবতে পারেনি—হকচকিয়ে গিয়েছিল। সে এবার ফিল্মের ভিলেনের ভঙ্গি করে ড্যাগারটা বের করল পকেট থেকে। তারপর একটানে চোখের সানগ্লাস উপড়ে নীচে ফেলে দিল। তার রক্তমাখা মুখটা ভয়ংকর দেখাচ্ছে। সে একটা করে পা বাড়াচ্ছে। ততক্ষণে রাস্তার দুদিকে রিকশো, একটা খালি টেম্পো আর ইট বোঝাই একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে গেছে। লোকগুলো এগিয়ে আসছিল কাছাকাছি। কিন্তু গাবুর হাতে ড্যাগার দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছে।

ননী পিছু হটতে থাকল। সাইকেলটার কাছে পৌঁছলে সে একটা কিছু করতে পারবে ভাবছিল। সাইকেলটা দু’হাতে তুলে ধরে নিজেকে বাঁচাবে কিংবা গাবুর ওপর সাইকেলটা সুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঠিক কী করবে জানে না। শুধু জানতে পারছে, তার মধ্যে অন্য এক ননী ছিল। এতদিনে বেরিয়ে এসেছে। সেই ননী এতকাল ধরে তাকে বলেছে, কোনো কারণে প্রাণ যদি যায় যাবে—সে ভয় পাবে না। শুধু প্রাণ যাওয়ার সময়টা লম্বা না হলেই হল।

ইটের লরির ড্রাইভার এতক্ষণে নামল। চেঁচিয়ে কাকে জিগ্যেস করল, ক্যা হো রাহা বে বুড়বক? মালুম পড়ো, কৈ স্যুটিং হোতা ফিল্মকা। ক্যা?

কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ননী ঘুরেছিল লোকটার দিকে। তারপর চেঁচিয়ে উঠল, শাহাদত!

মাস্টারবাবু! শাহাদত ড্রাইভার সাড়া দিল। এবং সঙ্গে সঙ্গে সে হাত বাড়িয়ে সিটের তলা থেকে হ্যান্ডেল বের করল। চেঁচিয়ে উঠল, ক্যা বে শালা লোক? ক্যা দেখ রাহা আঁখ ফাড়কে।

ট্রাকবোঝাই ইটের ওপর থেকে কয়েকটি সুরকিমাখা শরীর ধুপধাপ লাফিয়ে পড়ল। প্রত্যেকের হাতে ইট। তারপর শাহাদত এক বিকট চিৎকার করে দৌড়ে গেল গাবুর দিকে। ট্রাকের কুলিরা ইট ছুড়তে ছুড়তে দৌড়ল। গাবু রাস্তা থেকে নীচের নয়ানজুলিতে ঝাঁপ দিল। লোকগুলো চেঁচামেচি করে তাড়া করল তাকে।

ওদিকে কিছুটা পোড়ো জমির পর রেলের তারের বেড়া। তারপর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ। সেখানে উঁচু কংক্রিট পাঁচিল। গাবু পাঁচিলের ধারে ধারে ছুটেছে ধাঙড়বস্তির দিকে। খালঅব্দি তাকে ভাগিয়ে দিয়ে শাহাদত ড্রাইভার ফিরে এল হাঁফাতে হাঁফাতে।

ননী হাতের পাথর ফেলে দিয়ে ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। রুমালে মুখের কষার রক্ত মুছছে। দেখছে। এতক্ষণে ফের চোয়ালের যন্ত্রণা টের পাচ্ছে। মুখ নাড়া যায় না। কিন্তু কী অকারণ একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল। একটা ভুল লড়াই ভুল মানুষের সঙ্গে ভুল মানুষের। এর কোনো দরকার ছিল না।

নাকি ছিল? ননী আজ জানল, সে নিজেকে যত ভীতু আর নিরীহ ভাবত, সত্যি সত্যি তত ভীতু ও নিরীহ নয়। ইচ্ছে করলে সেও গাবু হতে পারে—হতে পারত। এসবের জন্যে দলবল চাই। সেও কিছু কি কঠিন ছিল তার পক্ষে? মানুর ভাই জনের এমন কিছু শারীরিক শক্তি নেই, তবু তাকে নাকি পাড়ার সবাই ভয় করে—মানু কত গল্প করেছে জনের। এই জনকে নিয়েও সে দল পাকাতে পারত।

নাঃ, অতটা পারত না ননী। পারবে না। সে নিজেকে বেজায় ভদ্রলোক মনে করে। তার পদে পদে চক্ষুলজ্জা আছে। ভদ্রতাবোধ আছে। দয়ামায়া আছে। ক্ষমা করার ক্ষমতা আছে। সে বিশ্বাস করে, করুণা করতে পারে বলেই মানুষ মানুষ। অতএব ননী গাবু হতে পারে না। কিংবা রবিনহুডও হতে পারে না।

শাহাদত বলল, সেলাম মাস্টারবাবু! কী হয়েছিল? হারামি কোন আছে?

ননী বলল, গোমো কায়েতের ছেলে। গাবু।

ওর এক সঙ্গী চমকে উঠে বলল, ঊরে ব্বাস। শাহাদতদা, শালা এক গুন্ডা আছে। দেখবে, শোধ লেবে।

শাহাদত বাঁহাত নেড়ে কিছু কেড়ে ফেলার ভঙ্গি করল। আরে ছোড়। শাঁলা কেত্তা গুন্ডা হাম দেখ লিয়া। হুয়া ক্যা মাস্টারবাবু?

ননী সংক্ষেপে বলল, স্কুল যাচ্ছিলুম। হঠাৎ আমাকে ধাক্কা মারল। তারপর…

সমঝ লিয়া। শাহাদত বলল। তো আইয়ে। আভি থানাকা সামনে হোকে যায়েগা। ডাইরি কোরে দিন। ফির হাসপাতালে ভি চলেন। আবে ফটিক, মাস্টারবাবুকা সাইকেলঠো উঠা।

ফটিক বলল, ভটভটিয়া?

উওভি উঠা লো। থানামে জিম্মা দেগা। উঠা! শাহাদত গাবুর মোটরসাইকেলের কাছে গেল। আ বে! জলদি কর না বে!

ননী বলল, থাক। আমি স্কুলে যাই, শাহাদত।

শাহাদত গম্ভীর হয়ে বলল, নেহী মাস্টারবাবু। তব হমারভি মুশকিল হোয়ে যাবে। গোমাবাবু যো আছে না—বহৎ ঝামেলা পাকাবে। হামি গরিব আদমি আছে বাবু। ইয়ে ভটভটিয়া বহৎ মুশকিল কোরে দিল সমঝালেন না? হামি গুন্ডাকা সাথ লড়নে শেকে, লেকিন কানুন কা সাথ হাম সিরফ বেচারা বন যায় মাস্টারবাবু।

ননী সমঝাল। শাহাদত বুদ্ধিমান লোক। ননী বলল, ঠিক আছে। তাই চলো।

গত বছর স্কুলের কয়েকটা ঘর বাড়ানো হয়েছিল। ননীর সঙ্গে ইটখোলার মালিক ঘোঁতনবাবুর পাড়া সম্পর্কে চেনা—জানা শুধু তাই নয়, ঘোঁতনবাবুর ছেলেমেয়েদের একসময় সে পড়াত। কথায়—কথায় হেডমাস্টার আশুবাবু সেটা জানতে পারেন। সেক্রেটারির কানে তোলেন! ঘোঁতনবাবু রোডস ডিপার্টের টেন্ডারে যে ইট সাপ্লাই করেছিলেন, তারই রিজেক্টেড স্টক ইটখোলা জুড়ে ছড়ানো ছিল। অজস্র ভুসিমাল। হাতের চাপে গুঁড়ো হয়ে যায়। সেই ইঁট স্কুলে আসে এবং তাই নিয়ে ঝামেলা চলছিল। পেমেন্ট বন্ধ করায় ঘোঁতনবাবু মামলা ঠুকে দেন। ইনজাংশন হয়। কাজ আটকে যায়। তখন সেক্রেটারি বেকায়দায় পড়ে ননীকে ধরেন। ননীকে ঘোঁতনবাবু খুব খাতির করতেন। সেই খাতিরে সব মিটমাট হয়ে যায়। ননী দাঁড়িয়ে থেকে ভালো ইট বেছে বোঝাই করে ট্রাকে।

ননীর সঙ্গে ঘোঁতনবাবুর ট্রাকের ড্রাইভার শাহাদতের আলাপ তখন থেকে। এই প্রৌঢ় বিহারি মুসলমান ড্রাইভারকে তার কেন যেন ভালো লাগত। সেই ভালোলাগার শুরুও একটা সামান্য ঘটনায়। একদিন ননী স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখেছিল রাস্তার ধারে ইট বোঝাই ট্রাক দাঁড় করিয়ে রেখে ঘাসের উপর বসে শাহাদত ড্রাইভার দু’হাত তুলে প্রার্থনা করছে। তার মুখে পশ্চিমের বিকেলের সোনালি রোদ্দুর পড়েছিল। ননীর কেমন অবাক লেগেছিল। সে সাইকেল থেকে নেমে ছায়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে আনমনা হয়েছিল কিছুক্ষণ। ননী সাবালক হওয়া অব্দি কখনও ঈশ্বরকে প্রণাম করেনি। তার ঈশ্বরে বিশ্বাসও নেই। অথচ কোনো কোনো মুহূর্তে ঈশ্বরের উদ্দেশে প্রার্থনারত মানুষকে দেখে তার কী যে ভালো লাগে। এই পৃথিবী সত্যি তো বড় সুন্দর এবং তার বাসযোগ্যতার তুলনা নেই। এই জীবন পেয়েছে বলেই তো ননী বেঁচে থাকার আনন্দময় মুহূর্তগুলো শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে, প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে শুষে নেয়। আর তার চেতনা, ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি? এগুলো মানুষের পক্ষে কত অসামান্য পাওয়া ওইসব প্রাণীর দিকে তাকালে, জড়বস্তুর দিকে ঘুরে দাঁড়ালে, তুলনা করে দেখলে তবে বোঝা যায়। এসব পাওয়ার জন্যই কি কারও কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ইচ্ছে জাগে না?

শাহাদত প্রার্থনা শেষ করেছিল দু’হাত মুখে ঘষে। তারপর উঠে আসতেই ননীর মুখোমুখি হয়েছিল। সেলাম মাস্টারবাবু। ছুট্টি মিলা?

হ্যাঁ শাহাদত। তুমি নামাজ পড়ছিলে। তাই দেখছিলুম।

শাহাদত হেসেছিল। হাঁ মাস্টারবাবু! নামাজের ওয়াক্ত হইয়ে গেল, তো সেরে নিলাম।

ঘোঁতনবাবুর কাছেই ননী জেনেছিল, শাহাদত একসময় প্রচণ্ড মদতাড়ি খেত। বদমাইশি গুন্ডামিও কম করেনি। জেলেও কাটিয়েছে অনেক বছর। ফিরে এসে বদলে গেছে দিনে দিনে। এখন ওই বাতিক—পথে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে নামাজটি পড়া চাই। সে তোমার যতই আর্জেন্সি থাক। কপালে কেমন ঘেঁটো পড়েছে দেখনি?

ননী দেখছে। আজ কপালে দীর্ঘ প্রার্থনার ঘেঁটো নিয়ে শাহাদত তাকে বাঁচাতে ডান্ডা তুলে তাড়া করেছিল গাবুকে। থানায় ঢুকে বলেও এল, হাম গাওয়া (সাক্ষী) ভি দেবে স্যার। নাম লিখে লেন। শাহাদত আলি। মরহুম (স্বর্গত) মোবারক আলিকা বেটা। পারমানেট মোকাম আরা, গয়া মুল্লুক, বিহারমে। হালমোকাম ফরাসডাঙ্গা; রাজীববাবুকা ইটখোলামে। লিখে লেন। দরকার হোলে খবর ভেজবেন। হামি গাড়ি ছোড়কে তুরন্ত আ যাবে।

সাবইন্সপেকটার বরুণ সোম বললেন, জামিন ক্যান্সেল। মোটরসাইকেলটা বেপাত্তা করে রেখেছিল। যাইহোক, সেটা পাওয়া গেল। ওটাই তো একজিবিট! সিওর থাকুন ননীবাবু। গোমো কায়েত হোল লাইফ চিটিংবাজি করে টাকা করেছে। পুত্র বাবাজীবন তা উড়িয়ে ফতুর করবে। এই তো নিয়ম মশাই। অল রাইট। কই, ডাক্তারের সার্টিফিকেটটা দিন। দিয়ে চলুন; কোর্টে যাওয়া যাক।

ননী বলল, থাকগে। সামান্য ব্যাপার।

এ্যাঁ! সামান্য ব্যাপার? সোমবাবু চোখ কপালে তুললেন। সামান্য ব্যাপার তো মিথ্যেমিথ্যি ডাইরি লেখালেন কেন মশাই? ড্যাগার নিয়ে তাড়া করেনি আপনাকে? প্রাণ বাঁচাতে আপনি পাথর ছোঁড়েননি? উলটে আমিই যে আপনাকে অ্যারেস্ট করব এবার। ওই ড্রাইভারটাকেও ছাড়ব না। ইয়ারকি পেয়েছেন নাকি?

ননী বলল, হ্যাঁ! সব সত্যি। কিন্তু…

সোমবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, অত চিকেনহার্টেড হলে চলে না। খগেন, দেখ তো ড্রাইভার কে আছে! বলো, কোর্টে যাব। আর রতনবাবু! দেখুন তো বড়বাবুর ঘরে কে আছে। আমি যাব।

ননী ফাঁদে আটকে যাওয়ার মতো চোয়ালে ও কষার কাছে ব্যান্ডেজ নিয়ে বসে ছিল। অগত্যা উঠল। সব ভুল পথে চলেছে। একটা ভুল থেকে ক্রমাগত ভুল হবে। সে মরিয়া হয়ে বলল, কিন্তু গাবু তো আমার বোনকে খুন করেনি।

এ্যাঁ! বরুণ সোম ফের কপালে চোখ তুললেন। সর্বনাশ, সর্বনাশ! আপনি মশাই কেলেঙ্কারি করে ছাড়বেন। স্টেট ভার্সেস কেস। আমার চাকরিটি আপনি খাবেন দেখছি! আপনি ডিফেন্সের মূল উইটনেস!

ননী শক্ত গলায় বলল, একটা মস্ত ভুল হয়েছে। ওটা মোটরসাইকেল ছিল না। রেলের গেটম্যান ভুল বলেছে। ওটা একটা নীলরঙের স্কুটার।

থামুন! সোমবাবু চোখ পাকিয়ে ধমক দিলেন। ছিল মোটরসাইকেল হয়ে গেল স্কুটার?

হ্যাঁ ওটা স্কুটার। আমি দেখেছি….

তখন বলেননি কেন? এ কি ছেলেখেলা পেয়েছেন? সোম রাগে ফুঁসছেন। পুলিশকে মিসগাইড করার জন্যে আপনাকে এখুনি অ্যারেস্ট করতে পারি জানেন?

ননী চুপ করে রইল। সোম গটগট করে বেরিয়ে হয়তো বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকলেন। ননী বসে রইল চুপচাপ। গাবু তাকে মেরেছে বা স্ট্যাব করতে আসছিল, এজন্যে তার শাস্তি হোক। কিন্তু কৃষ্ণার মৃত্যুর জন্যে সে কেন শাস্তি পাবে? এটাই বড় খারাপ লাগছে ননীর।

সোমবাবু ফিরে এসে বললেন, দেখুন মশাই! কেস যেভাবে দাঁড় করানো হয়েছে, তা থেকে একচুল সরে আসা মানেই পোলিশ উইল বি হেভিলি কনডেমড বাই ইদা কোর্ট। এ তো আপনার আমার ঘরোয়া ব্যাপার নয়। ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা ভাবুন। সোম চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর ঝুঁকে এলেন। বুড়ো আঙুল নিজের কাঁধের পিছনে নির্দেশ করে গলা চেপে বললেন, কোনো স্কোপ তো রাখেনি আপনার অরুণ নন্দী। নতুন ঢুকেছে পুলিশে, সবতাতেই দে লাফ, ভাঙ মাথা। অগ্রপশ্চাৎ চিন্তাভাবনা নেই। প্রপার প্রসিডিওর মেনটেন করবে না। কে এসে বলল, চিলে কান নিয়ে গেল—তো চিলকে অ্যারেস্ট করতে দৌড়ুবে। কী বলতে চাইছি, বুঝতে পারছেন?

ননী তাকাল।

বুঝলেন না? আপনি যেই আপনার বোনের ডাইরি প্লেস করলেন, আর ওদিকে প্রিলিমিনারি ইনভেস্টিগেশনে যেই নন্দীবাবু গেটম্যানের বউয়ের কথা শুনে এলেন—সঙ্গে সঙ্গে গোমো কায়েতের ছেলেকে ধরে কোর্টে হাজির করে দিলেন। এফ আই আর তৈরি হতে দেরি সইল না। একবারও ভাবলেন না, আরও খানিকটা তলিয়ে দেখা যাক, হোয়েদার ট্রাপিং দা রং রাইট পার্সন!

ননী সায় দিয়ে বলল, একজ্যাক্টলি! সেটাই বলছি।

সোমবাবু দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, বলছেন! এখন বলছেন! যান না নন্দীর কাছে। সে তো গতিক বুঝে বড়বাবুকে ম্যানেজ করে আমার কাঁধে চার্জশিটের দায়িত্ব চাপিয়ে দিল। এবার আমি যদি চার্জশিটে বলি, দা রং মেন আর ট্র্যাপড? দে আর কোয়াইট ইনোসেন্ট?

ননী আস্তে বলল, তাতে ক্ষতি কী মিঃ সোম? নির্দোষ খালাস পাবে।

সোমবাবু ফ্যাচ করে হাসলেন। এতক্ষণে নিজস্ব পূর্ববঙ্গীয় বুলিতে বলে উঠলেন, আপনে মশয় য্যান পোলাপান। মশয়, এক মোর্গা দুইবার জবাই অয়? অয় না।

কেন? নতুন করে কেস সাজালেই তো…

টেবিলে থাপ্পড় মেরে সোম বললেন, অয় না! তখন আপনারাই কাগজে লিখবেন, পুলিশ নির্দোষেরে হয়রান করছে। গোমো কায়েত ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লুক জানেন না? ছাড়ান দ্যান। খগেন! ড্রাইভার আইছে।

হ্যাঁ, স্যার। একজন কনেস্টবল দরজার বাইরে থেকে বলল।

সোম উঠে দাঁড়িয়ে ফাইল গোছাতে গোছাতে বললেন, দুষী বলেন দুষী, নির্দুষী বলেন নির্দুষী—আমাগো হাত মশয় বান্ধা। যা এফ আই আর—এ লেখা হইছে, রাইট অর রং, চার্জশিটে তারেই এস্টাব্লিশ করব। আরও ডালপালা ছড়াইব। দিস ইজ দা পোলিস প্রসিডিওর। কইলাম না? এক মোর্গা দুবার জবাই অইব না। চলেন, যাই গিয়া।

ননী উঠল। শরীর ক্লান্ত। চোয়ালে যন্ত্রণা হচ্ছে। ট্যাবলেট খেয়েও কমল না। বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়তে পারলে বেঁচে যেত।

গাড়িতে বসে সোম ফের বললেন, স্কুটার বলছেন ননীবাবু। উপায় নেই। পুলিশ নিজের গালে থাপ্পড় খাবে না। কারণ, অনেক ঠেকে পুলিশ শিখেছে, কমলিকো পাকাড়কে হাম ছোড় দেতা তো কমলি কভি হামকো ছোড়ে গা নেহী। যা ধরেছি, চোখ বুজে ধরে থাকতেই হবে। শুধু প্রেসটিজ নয়, দা কোয়েশ্চান ইজ দা এফিসিয়েন্সি অব দা পোলিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?

ননী চুপ করে বসে রইল। এতক্ষণে মনে হল, কেন সে পুলিশের কাছে এসেছিল! ভুল হয়ে গেছে। আর তিনটি ভাষায় দক্ষ এই সোমবাবু ঠিকই বলেছেন, অরুণ নন্দী খুব তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন। ঠিকমতো তদন্ত করে তবে কিছু অ্যাকশান নেওয়া উচিত ছিল। তা ছাড়া, সোমবাবুকে এক নম্বর ঘুষখোর বলেছিলেন নন্দী। সম্ভবত সোমবাবুর ওপর ওঁর কোনো বিদ্বেষ আছে। একটু রগচটা হলেও লোকটাকে বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। ননীর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।…

বিকেল আহত চোয়াল নিয়ে ননী পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ডে একটা ঝোপের আড়ালে বসে আছে। চোটখাওয়া বাঘের মতো ওত পেতে আছে। সাইকেল থানায় রয়েছে। কোর্টে এক্সিবিট হবে। গাবুর মার খেয়ে সাইকেল পড়ে গিয়েছিল। প্যাডেল বেঁকে গেছে। ননী ঠান্ডা মাথায় অপেক্ষা করছে একটা নীল স্কুটারের।

দূরে মদনমোহনতলার রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখে ব্যথা ধরল। ওদিকে সূর্য ডুবছে। সকালের চরপড়া নদীর বুকের মতো সেই আকাশটা এখন অন্য রকম। মেঘ সরে গেছে টুকরো হয়ে। সূর্যের উজ্জ্বল লাল রঙটা দৃষ্টিকে ঘুলিয়ে দিচ্ছে। বাতাস বইছে জোরে। ঝিলের ধারে জঙ্গলে পাখি ডাকছে। দিনের এই শেষ সময়টা বরাবর নদী উপভোগ করেছে। কৃষ্ণাকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে। এখন কৃষ্ণা নেই। আর ননীও প্রকৃতি দেখছে না। সে এখন প্রকৃতির করতলগত হয়ে গেছে—যে প্রকৃতিতে ধর্ষণ ও হত্যার জন্যে শোক নেই, বিষাদ নেই, গ্লানি নেই। সেখানে কত অনায়াস এবং স্বচ্ছন্দে স্বাভাবিকতায় শুয়ে থাকে ঘাসে পিঠ দিয়ে এক কুমারী মেয়ে। আর তার নিবাবরণ নাভির ওপর উঠে আসে ঘাসফড়িং। নাকে—ঠোঁটে চলাফেরা করে পিঁপড়েরা। প্রধর্ষিত পাণ্ডুর স্তন ছুঁয়ে উড়ে যায় বর্ণময় প্রজাপতি। ঊরুতে বসে থাকে লাল ভেলভেট পোকা। আর কত অনায়াসে আকাশ থেকে শিলাবৃষ্টি এসে মুহুর্মুহু জর্জরিত করে তার সাড়াহীন শরীর! গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিতে চায় প্রকৃতির মধ্যে।

ননী সাবধানে মুখ তুলল। হাইওয়েতে গোঁসাই যাচ্ছেন। নিশ্চয় ভানুবাবুর কাঠগোলায়। ননী তাকিয়ে রইল। গোঁসাই কাঠগোলার কাছে পৌঁছুলে সে ঘুরল উলটোদিকে। নীল স্কুটারটা এখনও আসছে না। সূর্য ডুবে গেল দূরের ঘরবাড়ির আড়ালে। হালকা লাল—ধূসর মেশা আলো ছড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর শুধু ধূসরতা। নীল স্কুটারটা আসছে না।

ধূসরতা গাঢ় হতে হতে কালো হল। তারপর দৃষ্টি চলে না। ননী কান পেতে রইল।

নীল স্কুটার এল না।

তারপর ননী মুখ ঘুরিয়ে পিছনে দক্ষিণ—পশ্চিম কোণে একফালি চাঁদ দেখতে পেল। হুঁ, আজ পঞ্চমী। চাঁদটা কিছুক্ষণ থাকবে। সন্ধ্যার কালচে রঙটা একটু করে হলুদ হয়ে উঠছে। কালো—কালো দুটো জন্তু উঁচু পিঠ নিয়ে চলে গেল মাঠের পায়েচলা পথটা দিয়ে—সঙ্গে লোক। ঝিলের ধার থেকে ধোপারা চাপা গলায় কথা বলতে বলতে বাড়ি ফিরছে। ননী ইচ্ছে করল, এখন যেন নীল স্কুটারটা না আসে।

আবার শূন্য নির্জন মাঠ। অস্পষ্ট জ্যোৎস্না। হাওয়া আরও বেড়েছে। ননী সাবধানে সিগারেট ধরাল। হাতের আড়ালে টানতে থাকল। দারুণ সুসময় এখন। এখন যদি স্কুটারটা আসে।

স্কুটারটা এল না।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ননী উঠে দাঁড়াল। ঝিলের দিকে ঘুরল। ওইখানে কৃষ্ণা শুয়ে ছিল। ননীর গায়ে কাঁটা দিল সঙ্গে সঙ্গে। হৃদপিণ্ডে রক্তকে ছলকে উঠল। তারপর সে শক্ত হয়ে দাঁড়াল। ম্যান ইজ মেসিন। আত্মা—টাত্মা বাজে কথা। মনের ভুল। স্মৃতির ভুল।

যদি কৃষ্ণা ওখানে এই জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়েও থাকে, ননী জানবে মায়া—হ্যালুসিনেসান।

তারপর পা বাড়াতে গিয়ে একটু চমকাল। সাপটাপ থাকতে পারে, যা হ্যালুসিনেসান নয়। ভীষণতম বাস্তবতা। সঙ্গে টর্চ থাকলে কত ভালো হত। তবু ভাগ্যিস, যত আবছা হোক—জ্যোৎস্নাটা আছে। ননী সাপে কামড়ে কিংবা গাবুর ছুরিতে এখনই মারা পড়তে চায় না। তার কাজ শেষ হয়নি এখনও। যে—কোনো ভাবে তাকে বেঁচে থাকতেই হবে। সে টের পেয়ে গেছে, তার ভেতরে একটা শক্তি আছে। তাকে কাজে লাগাতেই হবে। সেই দুপুর থেকে খালি তার চমক লাগছে, তাই তো! সে একজন রীতিমতো সাহসী মানুষ। মরিয়া এবং হিংস্র হয়ে ওঠার ক্ষমতা তার আছে। যদি থাকত, সে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলত, অপেক্ষা করো কৃষ্ণা। দম আটকে মরার সময় তুই নিশ্চয় দাদার কথা বলে ভয় দেখিয়েছিলি ওদের—তাই তোকে মরতেও হয়েছে। কিন্তু তুই ভুল করিসনি। ঠিক শাসিয়েছিলি। অপেক্ষা কর। একটা কিছু ঘটবেই।

ননী মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছে স্বস্তি পেল। একটা খালি রিকশো ডেকে দাঁড় করাল। উঠে বসে বলল, মদনমোহনতলা।

মানু রাগ করে আছে। ননী আর সময় পায়নি যাবার। মনে হচ্ছে, সম্ভবত মানু গিয়ে সেই ডাক্তারের ছেলেকে সোজা চার্জ করে বসেছিল। তাই মাঠে আর আসে না সে। মানু খুব রাগী এবং শক্তিমতী মেয়ে। কাকেও পরোয়া করে না—ননী জানে। আর কৃষ্ণার জন্যে মানু সেদিন কত ছুটোছুটি না করল। কৃষ্ণাকে সে এক সময় কিছুদিন পড়িয়েও ছিল। খুব ভালোবাসত। আগ্রহ করে গান শুনতে চাইত। তাই সে নিজেই গোঁসাইজীর কথা তুলেছিল। অথচ কৃষ্ণা কেন যেন মানুকে পছন্দ করত না। ওদের বাড়ি যেতে বললে বেজার হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত ননী সাধাসাধি করলে না গিয়ে পারত না। কেন মানুকে সে অপছন্দ করত? তাই দাদাকে মানু কেড়ে নিচ্ছে—কেড়ে নেবে ভেবেই কি? পাগল কৃষ্ণা! তাই হয় নাকি? ননীর আত্মা কৃষ্ণা তার ছোট বোন। তার মুখে দুঃখের ছাপ টের পেলে ননীর সব আনন্দ কালো হয়ে যেত! আর এখন যে কৃষ্ণা নেই—কৃষ্ণা আর বাড়ি ফিরে আসবে না কোনোদিন—ননী কি সত্যি ভারমুক্ত এবং নিজের জীবনের কথা আলাদা কি ভাবতে পারছে? অসম্ভব। আর যে পারুক, ননী পারে না। ননীর আলাদা কোনো জীবন ছিল না বোনকে বাদ দিয়ে—আজও নেই। আজ তার সামনে ধুধু শূন্যতা। অর্থহীন ভবিষ্যৎ সামনে ছড়ানো। অভ্যাসে সেদিকে পা ফেলে চলেছে ননী।…

মানুদের দরজায় তালা আটকানো! কাকে জিগ্যেস করবে, ভেবে পেল না ননী। বাড়িটা আলাদা। সামনে ফাঁকা জায়গায় কয়েকটি ছোট ছেলেমেয়ে হইহল্লা করে খেলছে। ননী একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর একটি মেয়েকে ডেকে বলল, এ বাড়ির মানু নামে একজনকে চেনো? কোথায় গেছে বলতে পারো?

মেয়েটি একবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা দুলিয়ে বলল, মানুমাসি তো? জানি না। তারপর সে খেলার মধ্যে ঢুকে গেল ফের।

এক ভদ্রমহিলা এসে নিজের ছেলেমেয়েদের তম্বি করে ডাকলেন, ঝুন, টুপু! বাড়ি এসো—এসো বলছি। আবার এখানে খেলতে এসেছ? পড়াশুনো নেই?

ননী বলল, শুনুন! মানু কোথায় গেছে বলতে পারেন?

ভদ্রমহিলা ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, আপনাকে তাই চেনা মনে হচ্ছিল। আপনি তোপপাড়ায় থাকেন না?

ননী ঘাড় নাড়ল।

হ্যাঁ, মানুদের বাড়িতেই দেখেছি আপনাকে। আপনার বোনই তো…আহা! খুব কষ্ট হয়েছিল শুনে।

ননী দ্রুত বলল, মানু কোথায় গেছে জানেন?

ভদ্রমহিলা বললেন, মানু তো দুদিন আগে আসানসোল গেছে। ওর মা আছে ওখানে। অসুখ হয়েছে বলল। তাই দেখতে গেল। জনও আছে ওখানে। আপনাকে বলে যায়নি?

ননী ভাবল বলবে, আমাকে বলে যাওয়ার মানেটা কী—কিন্তু কিছু বলল না। তার এ বাড়ি আসা নিয়ে পাড়ায় নিশ্চয় অনেক জল্পনাকল্পনা চলে। ননী ফের ঘাড় নেড়ে এগিয়ে গেল। সেই খাবারের দোকানে ঢুকে চা বলল। তারপর বেঞ্চে বসে আস্তে আস্তে চা খেতে থাকল।

চা খেতে খেতে ননী কী করবে সিদ্ধান্ত নিল। চায়ের দাম দিয়ে বলল, দাদা! এখানে অঘোরবাবু ডাক্তারের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?

ওই যে দেখা যাচ্ছে! বারান্দার মাথায় কমলা ডিসপেন্সারি সাইনবোর্ড।

বারান্দা খালি। ভেতরে বেঞ্চে ও চেয়ারে কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা বসে আছে। নিশ্চয় রুগি। অঘোর ডাক্তার ছোট্ট টর্চের আলো ফেলে একটা বাচ্চা ছেলের কান দেখছিলেন। ননী গিয়ে দাঁড়ালে একপলক দেখে নিয়ে বললেন, বসুন।

ননী বলল, আপনার সঙ্গে কথা আছে।

অঘোরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, অত তাড়াহুড়ো করলে চলবে? অ্যাঁ? দেখছেন না পেশেন্ট দেখছি। আরও কত সব বসে আছে না? এসেই বলছেন…

কথা কেড়ে ননী বলল, না। আমার কোনো অসুখ নেই।

অঘোরবাবু তাকালেন। তারপর ঘ্যাঁচ করে অদ্ভুত হেসে বললেন, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। অ্যাকসিডেন্ট করেছেন তো? নিজেই প্লাস্টার সেঁটে ফেলেছেন? তা মন্দ নয়। কিন্তু মারা পড়বেন বলে দিচ্ছি। কক্ষনো নিজে থেকে ডাক্তারি করতে যাবেন না। বসুন। সময় হলেই টিটেনাস দেব।

ননী বলল, আপনার পল্টু নামে কোনো ছেলে আছে? তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

অঘোরবাবু চোখ গোল হয়ে গেল। কে আপনি?

আমি ননী—ননীগোপাল ভট্টাচার্য। তোপপাড়া থেকে আসছি।

পল্টুর সঙ্গে কী দরকার?

আছে। তাকেই বলব!

নেই।

আমার তাকে জরুরি দরকার।

অঘোরবাবু রেগে গেলেন। কে মশাই আপনি লর্ড ক্লাইভ, না নবাব সেরাজুদ্দোলা যে আমার সামনে জাঁক দেখাচ্ছেন?

ননী গলার ভেতর বলল, আপনার ছেলে একটা নীল রঙের স্কুটারে চেপে বেড়ায়। আমি নিজে দেখেছি। পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ডে ঝড়ের দিন…

অঘোরবাবু টেবিল চাপড়ে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, শাট আপ! আপনাকে আমি পুলিশে দেব। বেরিয়ে যান বলছি। গেট আউট! গেট আউট!

রোগীরা সন্ত্রস্ত। কেউ কেউ কোনায় সরে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। ননী উঁচু মানুষ। চোয়ালে প্লাস্টার আঁটা এবং মুখে একরাশ বিশৃঙ্খল দাড়ি। গর্তে বসা উজ্জ্বল চোখ। তার চেহারা ভয়ংকর দেখাচ্ছে। একটা বাচ্চা মায়ের কোলে কেঁদে উঠল। কম্পাউন্ডার পাশের ডিসপেন্সিং ঘর থেকে উঁকি মেরে রইল।

ননী দাঁতের ফাঁকে বলল, পুলিশ দেখাবেন না। আপনার ছেলে আমার বোনকে খুন করেছে। তাকে আমি চাই। ডাকুন তাকে।

অঘোরবাবু দমে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, আপনি গুন্ডা! প্রকাশ্যে এত লোকের সামনে আপনি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছেন। ওরে! খবর দে তো পল্টুদের। সব্বাইকে ডেকে আন। বল একটা গুন্ডা এসে হামলা করছে ডিসপেন্সারিতে।

ভেতরদিকের দরজার পর্দা তুলে মেয়েরা উঁকি দিচ্ছিল। হঠাৎ পর্দা সরিয়ে এক প্রৌঢ়া মহিলা বেরিয়ে এলেন। ননী তাকাল। নিশ্চয় অঘোর ডাক্তারের স্ত্রী।

ননীর প্রায় মুখের ওপর হাত নেড়ে বাঁকা মুখে বললেন, বাঃ! আপনি তো মহা ভদ্রলোক। শুনেছি, মাস্টারিও করেন। এ্যাঁ? লজ্জা করছে না এত লোকের সামনে এসে কেলেঙ্কারি করতে! গলায় দড়ি দিন গে, যান। ইস! ভারি আমার রোয়াব দেখানো হচ্ছে রে! বাঃ! বা বা বা বাঃ। এই হল বিচার? কে খেল মাছের মুড়ো, কে খেল বন্দুকের হুড়ো!

ননী বলল, আপনার ছেলে আমার বোনকে—

মিথ্যে। ডাহা মিথ্যে। ডাক্তার গিন্নি চেঁচিয়ে উঠলেন। যত দোষ নন্দ ঘোষ! পল্টু ভদ্রলোকের ছেলে। যান না, গিয়ে জিগ্যেস করুন অক্ষয়ের মেয়েকে। কে কী করেছে, সে তো ভালোই জানে। জেনেশুনে এখন পল্টুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। বাঃ! বা বা বা বা বা বাঃ!

অঘোরবাবু গিন্নির সঙ্গে গলা মিলিয়ে বললেন, মানুকে জিগ্যেস করুন। মানুর সঙ্গে তো আপনার ভালো জানাশোনা। মানু চেপে আছে কেন?

ননী ঘড়ঘড় করে বলল, মানু কী চেপে আছে? মানু কিছু জানে না।

ডাক্তারগিন্নি মুখ ভেংচে বললেন, না। মানু একেবারে সতীলক্ষ্মী। ধোয়া তুলসীপাতা। কিচ্ছু জানে না। ওর ওই হারামজাদা ভাইয়ের পাল্লায় পড়েই তো আমার পল্টুর আজ বদনাম। থানাপুলিশ ঠেকিয়ে বেড়াও, মোক্তারের কাছে যাও!

অঘোরবাবু নরম সুরে বললেন, মানুও যায়নি মোক্তারের কাছে আমার সঙ্গে? বেশি চ্যাঁচাবেন না। আমার মেজাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন আজ। স্ট্রোক না হয়ে যায়!

ননী মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুখ তুলে ডাক্তারগিন্নিকে কাঁপাকাঁপা গলায় ফের বলল, মানু কী জানে?

সব জানে। আগাগোড়া জানে। ডাক্তারগিন্নি ক্লান্তভাবে বললেন। জন সারা মুখে গলায় রক্ত মেখে পল্টুর বাবার কাছে এল। এসে বলল, অ্যাকসিডেন্ট করেছে। অ্যাকসিডেন্ট! ন্যাকামি।

অঘোর ডাক্তার বললেন, টিটেনাস দিলুম শুয়োরের বাচ্চাকে। তখন কি জানি কিছু?

ননী বলল, তারপর?

অঘোরবাবু বললেন, সেভাবে যদি আসতেন, সব বলতুম। আপনি এলেন কিনা গুন্ডার মতো। শুনেছি আপনি একজন টিচার। যাই বলুন, এ আপনার অত্যন্ত জঘন্য বিহেভিয়ার। আপনার লজ্জিত বোধ করা উচিত।

আমাকে আপনারা ক্ষমা করুন। বলে ননী দরজার দিকে পা বাড়াল।

অঘোরবাবু এতক্ষণে উঠলেন চেয়ার থেকে। বললেন, আপনি জনের নাম করে দিন গে থানায়। পল্টু আপনার ফেভারে উইটনেস হবে! মোক্তার আমাকে তাই বলেছে। আমি খালি পথ তাকিয়ে আছি, কবে জনকে পুলিশ এসে অ্যারেস্ট করবে।

ডাক্তারগিন্নি বললেন, সেই ভয়েই তো মানু পরদিন ভাইকে মায়ের সঙ্গে আসানসোলে পাঠিয়ে দিল। এবার শুনেছে, তোপপাড়ার কাকে ধরে মামলা উঠেছে। তাই ভাইকে আনতে গেছে। ও কি সহজ মেয়ে ভাবছ? মহা ধড়িবাজ।

বাইরে দরজার পাশে কিছু ভিড় জমেছিল। ননীকে রাস্তা দিল। ননী নিচে নামলে অঘোরবাবু বারান্দায় এসে বললেন, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যে। সবাই তো শুনল। জানাজানিও হল। আর লুকোবার কী আছে? জন রেপ করেছে। মার্ডার করে বডি ফেলে এসেছে মোতিঝিলে। আর পল্টু ব্যাপার দেখেই ভয়ে পালিয়ে এসেছে। কোর্টে সব খুলে বলবে। সত্যি কথা বলবে, তাতে ভয়টা কীসের তার? সে তো নির্দোষ—কোয়াইট ইনোসেন্ট। আর শুনে যান। আমিও সাক্ষী দেব। আমি জনের ব্যান্ডেজ করেছি। টিটেনাস দিয়েছি।…

গোঁসাইয়ের গান শোনা যাচ্ছিল। ননী দরজা ঠেলে বাড়ি ঢুকল। নিজের ঘরের দরজার তালা খুলে সে ঘরে গিয়ে অন্ধকারে কিছুক্ষণ বসে রইল চুপচাপ।

তারপর পা ছড়িয়ে শুল। সিগারেট ধরাল।

গোঁসাই বাগেশ্রী গাইছেন। কোমল রে’তে নেমে এলে কে চাপা স্বরে বলছে, বাঃ! ননী বুঝল, অন্য কেউ আছে গোঁসাইয়ের কাছে। বাইরের লোক কেন আসবে ওঘরে—কৃষ্ণার ঘরে?

ননী বেরুল। পর্দা তুলে দেখল, বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ বলল, আজ জয়েন করলিনে, তাই জানতে এলুম। ও কী রে? মুখে কী সব?

গোঁসাই গান বন্ধ করে বললেন, সর্বনাশ! সর্বনাশ!

ননী বলল, অ্যাকসিডেন্ট। স্কুলে যাচ্ছিলুম। হঠাৎ চাকা স্লিপ করে পাথরে পড়ে…

কেলেঙ্কারি! বিদ্যুৎ হাসল। ওই নিয়ে যাবি নাকি কাল?

না। ননী বলল। এসে ভালোই করেছিস। ছুটি আরও এক্সটেন্ট করব। না কী…বলে ননী ঠোঁট কামড়ে ধরল।

কী করবি? বিদ্যুৎ বলল। যাবি?

জানি না। আসলে ননী বলতে চাইছিল, রেজিগনেশান লেটার পাঠাবে নাকি।

বিদ্যুৎ বলল, ঠিক আছে। সকালে শরীর কেমন থাকে দ্যাখ। আমি আসব’খন।

হঠাৎ গোঁসাই বললেন, ননী! তোমার ওটা অ্যাকসিডেন্ট নয়। ভানুর ওখানে সব শুনেছি। ভুলো মনে এই ফ্যাসাদ। দেখছ কাণ্ড?

ননী তাকাল। বিদ্যুৎ হাসিমুখে বলল, তবে কী?

গোঁসাই বেজার মুখে বললেন, গোমো কায়েতের ব্যাটা ননীকে স্ট্যাব করতে গিয়েছিল। তার জামিন ক্যান্সেল। ফের অ্যারেস্ট হয়েছে। ধাঙড় ছোকরাও। বেটা ননী, তুমি এমন বোকা—তা ভাবিনি।

ননী বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। তারপর বিদ্যুতের দিকে তাকাল। তুই গান শোন। আমি একটু শুয়ে থাকি। আজ সারাদিন বড্ড ঘুরেছি। খুব ক্লান্ত।

ননী আবার তার অন্ধকার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।…