কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি – ১২

১২

অপঘাতজনিত মৃত্যুর শ্রাদ্ধশান্তির নিয়মকানুন নিয়ে মধুবাবু অনেকক্ষণ বকবক করে গেলেন। ননী বারান্দায় বসে আছে। সন্ধ্যা থেকে বাতাস বইছে জোরে। বারান্দার আলো উঠোনে ছড়িয়ে আছে—সেখানে গাছের ছায়ার ঝালর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ননী ঘড়ি দেখল। সাড়ে সাতটা বাজে। প্রেসে গিয়ে নিমন্ত্রণ কার্ড নিয়ে আসা উচিত ছিল। সামনের বুধবার কৃষ্ণার শ্রাদ্ধ। পাড়ার কিছু লোককে বলবে। কাঙালিভোজন করাবে। সোমবার টাকা তুলে বিদ্যুৎকে নিয়ে কোমরবেঁধে কাজে নামতে হবে।

মাথায় এইসব চিন্তা। অথচ বারবার মনে হচ্ছে, ধুর! খামোকা কী সব হাঙ্গামা। আত্মাটাত্মা বাজে কথা। ম্যান ইজ মেসিন। একগাদা লোক গব গব করে খেয়ে যাবে। তারা কোনোদিন কি কেউ ননীর অভাব—অসুবিধার দিনে এক পয়সাও সাহায্য করেছিল? সব মনে আছে ননীর। ভাই বোন বেঁচে থাকবার জন্য কী লড়াইটা—না লড়েছে! কেউ তো পাশে এসে দাঁড়ায়নি। কৃষ্ণা যে বাড়ি ফিরল না, তার জন্যেই বা কার কী আসে যায়। এই মধুবাবুও উলটে বলে গেলেন, গাবুকে ধরিয়ে দিয়ে ভালো করোনি। পাড়ায় তো থাকতে হবে আফটার অল। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদে ফায়দা নেই। বোনকে মাথা ভাঙলেও ফিরে পাবে না বাবা ননী। বলবে, পাপীর পানিশমেন্ট! হুঁ। আজকাল কীসেরই বা পানিশমেন্ট হচ্ছে? চুরি—জোচ্চুরি তঞ্চকতা কী বেড়ে না গেছে! ওই করেই লোকে পয়সা করছে। নাম হচ্ছে। মূর্তি প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। খাবারে ভেজাল, ওষুধে বিষ মিশিয়ে মানুষ মারছে তিলে তিলে—তার বেলা? পুঁটিমা না হয় দুম করেই মারা পড়ল, কাগজে পড়েছ তো ননী, কোথায় যেন ভেজাল তেল খাইয়ে সাড়ে চারশো মানুষ হ্যান্ডিক্যাপ্ট হয়ে গেল—তার কী পানিশমেন্ট হল! পানিশমেন্ট যা দেবার, তিনি ওপরে বসে সব দেখে যাচ্ছেন। সময়মতো ঠিকই দেবেন। ও চিন্তা তুমি কোরো না।….

না। এখন সে—চিন্তা ননী করছে না। প্রেসে গিয়ে কার্ডগুলো আনার কথাই ভাবছে। কালকের মধ্যেই বিলি করে আসা উচিত।

সদরদরজা হাট করে খুলে রেখে গেছেন মধুবাবু। ননী দেখল, রোয়াকের কাছে রিকশো দাঁড়াল।

ননী কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চমকে উঠেছিল। সামলে নিল। দুচ্ছাই! কী উজবুকের মতো তার মাথায় এসব ভেসে আসে। কৃষ্ণা ছাই হয়ে গেছে। কৃষ্ণা কীভাবে আসবে? আসলে জীবিতদের মনের এই এক নিয়ম যেন—মৃতদের জন্যেও আমৃত্যু গোপনে প্রতীক্ষা থেকে যায়—যদি প্রিয় মানুষটি ফিরে আসে। আসলে মৃত্যু ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে কারও কারও সময় লাগে।

ননী তখুনি খুশি হয়ে ডাকল, এসো মানু! আমি ওবেলা তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলুম জানো? দেখলুম দরজায় তালা। ভীষণ জলতেষ্টা পেয়েছিল। একটা দোকানে বসলুম কিছুক্ষণ।

বলতে বলতে সে টের পেল, প্রচুর কথা বলার চাপ আসছে ভেতর থেকে। অমনি থেমে গেল। মানু উঠোনে একটু দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর উঠে এল বারান্দায়! থামে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।

ননী একটু হেসে বলল, কথা বলছ না যে? আবার কি ঝগড়া করতে এলে?

তুমি সকালে গিয়েছিলে?

বললুম তো।

ও। আমি কিছুক্ষণের জন্যে বেরিয়েছিলুম। তুমি অপেক্ষা করলে না কেন?

রোদ বাড়ছিল। আর শরীরটাও যেন ভালো যাচ্ছে না। সাইকেল চালাতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি।

কী দেখতে পাচ্ছ? বলে ননী ঘরের দিকে ঘুরল। মোড়াটা নিয়ে এসে বসো।

মানু বাধ্য মেয়ের মতো মোড়া এনে দরজার চৌকাঠ ঘেসে বসল। সেই ছেলেটাকে অ্যারেস্ট করেছে শুনলাম?

ননী হাসল। আরে, ও একটা বাজে ব্যাপার হয়ে গেল সত্যি! তুমি ঠিকই বলেছিলে, রং ম্যান। ভুল লোক।

মানু একটু চমকাল।….কী ব্যাপার?

হ্যাঁ, ভুল লোক। সেটা বুঝতে পেরেই হয়তো জামিন দিয়েছে, মধুবাবু নামে এক ভদ্রলোক একটু আগে বলে গেলেন। আমি মনে মনে বড্ড লজ্জা পাচ্ছি। গাবু আমাকে দাদা বলে খাতির করে অত।

ননী রুগণ মানুষের কণ্ঠস্বরে কথা বলছে। মানু বুঝতে পারছে। ননীর শরীর হঠাৎ ভীষণ ভেঙে পড়েছে ভেতর—ভেতর। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, ননী কীসের ভিত্তিতে ওকথা বলছে? মানু বলল, ভুল লোক বলছ! কীভাবে জানলে ও ভুল লোক?

তুমি কীভাবে সেদিন বলেছিলে ও ভুল লোক?

মানু দ্রুত বলল, জাস্ট ইনটুইশান। এমনি মনে হয়েছিল।

আমার এমনি মনে হয়নি। আমার হয়তো ইনটুইশান বলে কিছু নেই। ননী গম্ভীর হয়ে গেল হঠাৎ। তা থাকলে সে—রাতে ইসমিল দপ্তরিকে দেখে টের পেয়ে যেতুম সে সুইসাইড করতে যাবে। আর সেদিন কৃষ্ণা সেন্ট মেখে বেরিয়ে গেল, বাড়ি ফিরল না…ননী থেমে দম নিল। তারপর মানুর দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আস্তে বলল, মানু মনে হচ্ছে কৃষ্ণার কিলাররা তোমাদেরই পাড়ার।

মানু উত্তেজনা চেপে বলল, সে কী! কীভাবে জানলে?

আজ সকালে আমি তোমাদের বাড়ি যাচ্ছিলুম। ননী শান্তভাবে বলল। তখন দূর থেকে পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ডে একটি ছেলেকে নীলরঙের স্কুটারে সার্কেল করে ঘুরতে দেখলুম।

মানু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, হয়তো কেউ স্কুটারে চাপা শিখছিল। অনেকেই তো ওখানে তাই শেখে দেখেছি।

না। ননী দাঁতের ভেতর বলল। তারও আগে একদিন আমি ঘুরতে ঘুরতে ঝিলের ধারে গিয়েছিলুম।

কেন?

এমনি। তো গিয়ে কাঁটাঝোপে কৃষ্ণার শাড়ির একটা ফালি পেয়ে গেলুম। তোমাকে দেখাব।

পরে দেখব। তারপর কী হল বলো!

হঠাৎ দেখলুম, একটি ঢ্যাঙামতো রোগাটে চেহারার ছেলে সেই স্কুটার নিয়েই সার্কেল করে ঘুরছে। আমি লক্ষ রেখেছিলুম। আমি…

বলো।

ননী একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তার সার্কেলিং মুভমেন্ট দেখে মনে হল, সে যেন কাউকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ সার্কেল ছোট করে এনে জোরে ব্রেক কষল। চোখে সানগ্লাস ছিল।

মানু শুকনো হেসে বলল, যাঃ। তোমার ভুল হতে পারে। অনেক সময় আমরা তাই করি না? খানিকটা উইশফুল থিংকিং—খানিকটা কল্পনা আরোপ।

ননী নড়ে বসল। বিদ্যুতের মতো পণ্ডিতী ফলিয়ো না। আমি ঠিকই দেখেছি।

মানু ফের আস্তে বলল, আমাদের পাড়ার ছেলে? কে সে? চিনতে পেরেছ?

ননী সিগারেট বের করে বলল, না। তোমাদের পাড়ার কাকেও বিশেষ চিনিনে।

পুলিশকে জানাওনি?

জানাতে গিয়েছিলুম। কিন্তু গিয়ে দেখলুম, কোনও লাভ নেই। অরুণ দারোগার হাত থেকে কেস চলে গেছে অন্য এক দারোগা ভদ্রলোকের হাতে। ননী ধোঁয়ার রিং পাকিয়ে ফের বলল, অরুণবাবু বললেন, দা কেস ইজ লস্ট। কোনো লাভ নেই। সে ভদ্রলোক নাকি ঘুষের রাজা।

মানু মিনমিনে গলায় বলল, সে তো বুঝতেই পারছি। জামিনে ছাড়া পেয়েছে আসামি!

কিন্তু ও তো আসামি নয়। ননী প্রায় ফুঁসে উঠে বলল।

মানু চুপ করে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজনে। বাইরে রাস্তায় মাঝে—মাঝে মোটরগাড়ি আর রিকশোর ঘণ্টার শব্দ। তারপর বাতাসের শব্দ। কখনো রেলইয়ার্ড থেকে ইঞ্জিনের হুইসল শোনা যাচ্ছে। উঠোনে আলোছায়ার ঝালর কাঁপছে কলতলার দিকটা ঘন ছায়ায় ঢাকা। তাকালেই মনে হয় কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

ননী! মানু ডাকল।

উঁ?

তুমি কি আমার ওপর রাগ করছ?

না তো। কেন?

মানু ধরা গলায় বলল, এমনি। মনে হচ্ছে, তুমি আমায় সইতে পারছ না। কেন ননী? আমি…আমি তো যা ছিলুম, তাই আছি। আমার কাছে তুমিও যা ছিলে তাই আছ—বরং আরও বেশি করে ইচ্ছে করছে…

ননী তাকাল।

মানু ঠোঁট কামড়ে কাঁপাকাঁপা স্বরে বলল, আমার কী যে হচ্ছে, তোমায় বলতে পারব না। তুমি বুঝবে না।

সে দ্রুত মুখটা কপাটের দিকে ঘোরাল। কয়েকমুহূর্ত শক্তভাবে বসে রইল সেই ভঙ্গিতে। তারপর ননী ডাকল, মানু!

বলো।

তোমার কী হয়েছে মানু! ননীর গলায় বিস্ময়ের আভাস আছে। সেদিন তোমাদের বাড়ি গেলুম। তুমি ভীষণ ইমোশনাল হয়ে গেলে। নিজের গলায় আমার হাতফাত চেপে… ভ্যাট! তুমি অমন শক্ত মেয়ে ছিলে। তোমাকে আমি সবসময় শক্ত দেখতে চাই। …বলতে বলতে ননী হাসল। বরং দেখো, আমি ভীষণ শক্ত হয়ে গেছি। ভীষণ ডেঞ্জারাস হয়ে গেছি। আমি তো নিজেকে টের পেয়ে আজকাল ঘাবড়ে যাই। জানো? আমার মধ্যে এক সাংঘাতিক কিলার ইজ ম্যুভিং স্টেপ বাই স্টেপ। আমি কতসময় তার পায়ের শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাই।

থামো! মানু প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।

ননী খুকখুক করে হেসে সিগারেটের শেষটুকু মন দিয়ে টানতে থাকল।

মানু বলল, আমার ভয় হচ্ছে, তুমি একটা অসুখবিসুখ না বাধিয়ে ছাড়বে না। কী চেহারা করেছ, আয়নায় দেখেছ? একেবারে কঙ্কাল।

ননী খোঁচাখোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, সামনের বুধবার কৃষ্ণার শ্রাদ্ধ! কার্ড দিয়ে আসব’খন। গোঁসাইজীকেও বলব। সেদিন এসে দেখবে, দাড়িফাড়ি কেটে একেবারে ফ্রেশ হয়ে গেছি। তারপর ভীষণভাবে খাওয়া—দাওয়া শুরু করব। শরীরটা স্ট্রং করে নিতেই হবে।

ননী ডান বাহুটা কয়েকবার ছড়িয়ে এবং বাঁকিয়ে মাসল ফোলানোর ভঙ্গি করতে করতে হঠাৎ থেমে গেল। তারপর ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। দৃষ্টি অস্বাভাবিক।

মানু চমকে উঠে বলল, কী দেখছ?

দেখছি না। বলে ননী কয়েকবার কিছু শোঁকার ভঙ্গি করল। মানু, কোনো গন্ধ পেলে না একটু আগে?

কই! না তো!

মনে হল সেই সেন্টের গন্ধটা।

কোন সেন্ট?

কৃষ্ণা মেখেছিল। বলে ননী পা দোলাতে শুরু করল।

মানুর গা ছমছম করে উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে। সে দ্রুত এদিক ওদিক চোখের তারা সাবধানে ঘুরিয়ে দেখে নিল। এতক্ষণে মনে হল, এ বাড়ির ভয়াবহ একটা রূপ আছে—যা সে ভাবেনি এতদিন, এই নির্জন বাড়ির ভেতর ভেতর একটা বিভীষিকা সেদিন এসে ওত পেতেছে, যেদিন থেকে কৃষ্ণা আর বাড়ি ফেরেনি। এবং এই বাড়িতে ননী একা কাটায়! সারারাত একা শুয়ে থাকে!

কিন্তু কেন ননী তাকে ডাকছে না, ডাকল না একবারও? সে তো পা বাড়িয়ে আছে আসবে বলে। এই যে এমন করে সন্ধ্যার পর ননীর কাছে চলে এসেছে, সে আসার অন্যদিকটা কেন ননী টের পাচ্ছে না? ননীর এতকালের শীতলতার উৎসে কৃষ্ণা নামে টের পাচ্ছে না? ননীর এতকালের শীতলতার উৎসে কৃষ্ণা নামে একটা নন—কনডাকটিভ আড়াল হয়তো ছিল—যা বিদ্যুৎস্রোত ব্যাহত করে রাখে। কিন্তু আজ তো কৃষ্ণা নেই। ননী কি তাহলে তাকে ভালোবাসে না—নিছক ভদ্রতাবোধ? মানু মনে মনে মাথা কুটে বলল, অন্তত ভূতপ্রেতের ভয়েও তুমি একবার বলো ননী, মানু আমার কাছে থাকবে? মা নেই। জন নেই। গোঁসাইজী কিছুই ভাববেন না। বরং কোনো দোকান থেকে রিং করে দেব অঘোর ডাক্তারকে। আমি আচায্যিপাড়ায় মণিমাসিমার কাছে থাকছি। বাড়ি ফিরব না।…

মানু রাগ দেখিয়ে বলল, খালি তোমার মাথায় যত ভূতুড়ে চিন্তা। জানো। এতে বেচারি কৃষ্ণার বদনাম দেওয়া হয়। কেন ওসব আজেবাজে কথা ভাবো?

না, না। বিশ্বাস করো, হঠাৎ—হঠাৎ গন্ধটা…

থামো!

ননী শুকনো হাসল। না, না। ভূতপ্রেত বলছিনে। আমি ওসব বিশ্বাস করিনে। ম্যান ইজ মেসিন। কলকবজা বিগড়ে গেলেই শেষ। আত্মাফাত্মা একদম বাজে কথা। আসলে সবই স্মৃতির বদমায়েশি। অবসেসন যাকে বলে। বিদ্যুৎ ইজ রাইট। আরে, সে এম এস—সিতে ফার্স্টক্লাস পাওয়া ছেলে। এখানে পচতে এসেছে তিনশো টাকার জন্যে। কোনো মানে হয়?

মানু একই সুরে বলল, তোমার হয়েছে কী? অত বেশি বকবক করছ কেন। আগে তো সবসময় মুখ বুজে থাকতে।

ননী জিভ কেটে বলল, সরি। তুমি অনেকক্ষণ এসেছ। চা—ফা খাওয়ানো উচিত। কিন্তু সেই বাইরে থেকে আনতে হবে। ঠিক আছে, বসো নিয়ে আসি।

মানু তার হাত ধরে টেনে বসাল। চা খাবো না।

ননী চোখে হেসে বলল, বুঝেছি। একা থাকতে ভয় করবে তো? ঠিক আছে। তুমি দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

মানু জোরে বলল, না।

ননী একটু সিরিয়াস হয়ে বলল, কিন্তু ভাবতে গেলে ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত না মানু? সবচেয়ে প্রিয়জন যে, মৃত্যুর পর তাকে কেন শত্রু মনে করা হয়? রোজ রাতে আমার হঠাৎ মনে হয়, কৃষ্ণা পাশে দাঁড়িয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার গলা টিপে মারবে বলে ওত পেতে আছে। অমনি ঘুমের আমেজটা কেটে যায়। কোনো মানে হয়? কৃষ্ণা কেন আমার গলা টিপে মারবে বলো?

আঃ! মানু বিরক্ত হয়ে বলল। ফের বকবক শুরু করলে।

ননী থামল না। আচ্ছা মানু, কৃষ্ণা তো আমার বোন ছিল, তুমি আমার…কী বলব? রাগ করো না মানু—প্লীজ। তুমি আমার প্রেমিকা। রাগ করলে?

মানু হাসবার চেষ্টা করে বলল, বাঃ! তারপর?

হুঁ, তুমি আমার প্রেমিকাই তো। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে…

তুমি নিশ্চয় নেশা করেছ ননী? মদটদ খেয়েছ।

মোটেই না। শুঁকে দেখ।…বলে ননী তার মুখের কাছে মুখ আনল। পাচ্ছ মদের গন্ধ?

মানু চুপ করে থাকল। ননীকে এমন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে কেন, বুঝতে পারছে না সে।

ননী বলল, যা বলছিলুম। ধরো, তুমি কিংবা আমি দৈবাৎ কেউ মারা পড়লুম। এখন কথা হচ্ছে, মানু বলো তো—আমি কি তোমার শত্রু হতে পারি? নাকি মৃত্যুর পর তুমি আমার শত্রু হতে পারো? এ হয় না মানু, ইমপসিবল!

মানু অগত্যা রসিকতা করে বলল, হুঁ, মরে যেতে দাও না আমায়। দেখবে, ঠিক তোমার ঘাড় মটকাতে আসব।

না—গলা টিপবে। এই এমনি করে…বলে ননী তার দুটো হাত নিয়ে নিজের গলার দিকে তুলল। মানু ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে মোড়া থেকে পড়ল। তারপর দেখল, তার মাথা ননীর ঊরুর ওপর। ঠিক সেদিনকার মতো।

ননী সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে দিয়েছিল। সে মানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকল, মানু!

উঁ?

মানু চেয়ে রইল।

ননী ধরা গলায় বলল, আমার বড্ড ইচ্ছে করে মানু। আমি এত একা হয়ে গেছি। ইচ্ছে করে, তোমাকে নিয়ে আসি! তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। কত ভালো হত। বোবায় ধরলে জাগিয়ে দিতে। স্বপ্নে ভয় পেলে তোমাকে জড়িয়ে ধরতুম। এইসব কত কী ভাবি! কিন্তু….

কিন্তু কী ননী?

বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ননী শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল।

কেন? মানু দ্রুত মুখ তুলল।

ননী তাকে ঠেলে দিয়ে বলল, নাঃ। তুমি আমাকে লোভ দেখিয়ো না। তুমি চলে যাও।

মানু উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। ভেজা গলায় বলল, তাড়িয়ে দিচ্ছ?

হ্যাঁ, তুমি চলে যাও, নানু। ননী ছটফট করে বলল। আমার আর কিচ্ছু ভালো লাগে না। ভালো লাগে না। খালি মনে হয়, সব ভুল। খাওয়াদাওয়া পোশাকপরা চাকরিবাকরি টাকাপয়সা ঘরকন্না বেঁচে থাকা ভালোবাসা সেক্সটেক্স সব—সবকিছু ভুল। কারণ, আমার মাথায় ঢুকে গেছে একটা কথা, কৃষ্ণা—আমার বোন কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি! আমার খালি মনে হয়, যতদিন না কৃষ্ণা বাড়ি ফেরে, সব ভুল। খাওয়াদাওয়া পোশাক—আশাক প্রেম সেক্সটেক্স…সশব্দে দম টেনে ননী চুপ করল।

মানু তাকিয়েছিল ওর দিকে। ননীর চেহারায় একটা অস্বাভাবিকতা এসেছিল। এতক্ষণে যেন স্বাভাবিকতা ফিরে এল। বারান্দার বালবের তলায় ননীর মুখটা স্পষ্ট। তার চোখে জল। মানু উঠে তার কাঁধে হাত রাখল। ননী তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর একটু হাসল। চোখ পিটপিট করে বলল, অক্ষমের অভিমান। কিছু পারিনে বলেই যত বড়—বড় কথা বলি।

মানু নিশ্বাস ফেলে বলল, আসি।

আর একটু বসো।

তুমি আমায় তাড়িয়ে দিয়েছ।

তুমি থাকলে বেশি কথা বলব বলে। কিন্তু এনাফ হয়ে গেল। আমি এখন চুপ করে থাকব। তুমি কথা বলবে।

কী বলব? কী বলার আছে আমার?

ননী হাসল ফের। আমি জানি, এতকাল কৃষ্ণা ছিল বলে আমরা ভালো করে কেউ কথা বলতে পারিনি পরস্পর। এখন কৃষ্ণা নেই। কাজেই আমরা যতখুশি কথা বলতে পারি। যা খুশি করতে পারি। প্রচণ্ড ইমমর্যাল হয়ে যেতে পারি।

মানু মাথা নাড়ল। পারি না।

কেন পারি না? কৃষ্ণা নেই।

ননী উঠে দাঁড়াল। তার দুকাঁধে হাত রাখল। এখন আমরা এ বাড়িতে কত স্বাধীন বুঝতে পারছ না?

মানুর পায়ের কাছে শাড়ির পাড় কাঁপছিল। ঊরু ভারী মনে হচ্ছিল। অথচ সারা শরীরে কী এক নিঃশব্দ ঝড় এসেছে। সে ঠোঁট কামড়ে ধরল। দৃষ্টি নামিয়ে রাখল। তারপর আস্তে ননীকে ঠেলে একটু সরে এল।

ননী চাপা স্বরে বলল, আমি সবকিছু ভুলে থাকতে চাই, মানু। ভুলে যেতে চাই আমার পেছনে একটা জীবন ছিল, তার স্মৃতি ছিল। আমার কৃষ্ণা নামে একটা নির্বোধ বোন ছিল। সবকিছু না ভুলতে পারলে আমি পাগল হয়ে যাব। কারণ, আমি সত্যি বড্ড অক্ষম। ভীতু। আমি একটা কাওয়ার্ড।

মানু হাসবার চেষ্টা করে বলল, বসো।

ননী বসল না।

বলল, একটু আগে তোমাকে বলছিলুম ‘এ কিলার ইজ স্টেপিং ফরোয়ার্ড…’

আঃ, চুপ করো!

কথাটা আমার নয়। বইতে পড়া। কিন্তু আমার জীবনে এত সত্য হয়ে গেল।

তুমি থামবে?

আমাকে দ্রুত একটা কিছু করতেই হবে। হু হু করে সময় চলে যাচ্ছে, মানু।

মানু ওর মুখে হাত চেপে প্রায় আর্তনাদ করে বলল, তুমি চুপ করো!

হঠাৎ ননীর শক্ত আর ঋজুতার ভাবটা চলে গেল। সে নিস্তেজ হয়ে বলল নাঃ। ইট ইজ টু লেট। বরং আর কিছু ঘটার আগে এখানেই শেষ করা ভালো। তুমি চলে যাও মানু।

মানু ফের মোড়ায় ধুপ করে বসে পড়ল। পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে হাঁটুর ওপর দু’হাতের আঙুল জড়িয়ে বসে রইল।

ননী বলল, কী? যাবে না?

না।

ঠিক এই সময় সদর দরজার কড়া নড়ল। মানু দরজা আটকে দিয়ে এসেছিল। একটু চমকাল। তারপর সে ফিসফিস করে উঠল, দেখ কে এসেছে। আমি ঘরের ভেতর বসছি।

সে ননীর ঘরে গিয়ে ঢুকল। ননী উঠোনে নেমে সাড়া দিয়ে বলল, কে?

আমি গোঁসাইজী, বেটা ননী।

ননী দরজা খুলে বলল, আরে আসুন পিসেমশাই।

ফেলু গোঁসাই বাড়ি ঢুকে বললেন, খুব প্রাইভেট এবং টপ সিক্রেট কথা আছে ননী। বাড়িতে আর কেউ আছে নাকি?

আছে। ননী নিজের ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে বলল। মানু আছে।

মানু আছে নাকি? গোঁসাই চোখ নাচিয়ে বললেন। তাহলে তো খুব ভালো কথা, খুব ভালো কথা। প্রথমে ওকেই বলব ভেবেছিলুম। পরে ঠিক করলুম, না—যার ব্যাপার সরাসরি তাকে বলাই ভালো। কই? মানু কই? অ মানু কোথা রে? আ যা বেটি।

মানু বিব্রত বোধ করছিল। ঘরে না ঢুকে বাইরে বেশ তো বসেছিল। আর ননীও কী সহজে বলে দিল, মানু আছে! সে দ্রুত সাড়া দিল। পিসেমশাই নাকি?

হাঁ বেটি। গোঁসাই ঘরে ঢুকে খাটে বসে পড়লেন। তুই কতক্ষণ?

এই তো, এক্ষুনি। মানু সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বলল। তার হাতে একটা পত্রিকা। গিয়েছিলুম আচায্যিপাড়ায় মণিমাসিমার কাছে। ফেরার পথে ভাবলুম ননীদার কাছে মামলার ব্যাপারটা জেনে যাই।

খুব ভালো করেছিস। খুব ভালো করেছিস। গোঁসাই খুশি হয়ে বললেন। আফটার অল ননী আমাদের কত আপন ছেলে। তার বোনবেচারি বেঁচে থাকলে কী হত আজ! আহা হা! বেটা, এ ঘরেই কি কৃষ্ণাবেটি থাকত?

গোঁসাই বাদ্যযন্ত্র খুঁজছিলেন। ননী বলল, না। পাশের ঘরে।

আমি একবারটি দেখব বাবা। বড় ইচ্ছে করছে দেখতে।

নিশ্চয়! আসুন না!

উঠতে গিয়ে গোঁসাই শক্ত হয়ে বললেন। উঁহু! আগে যেটা বলতে এলুম বলে নিই। ভালো হল। মানুকেও পেয়ে গেলুম এক জায়গায়।

ননী ও মানু তাকিয়ে রইল গোঁসাইয়ের দিকে মানুর বুকটা একটু—একটু কাঁপছে। কী কথা বলবেন গোঁসাই?

গোঁসাই একটু চুপ করে থাকার পর ঠোঁট ফাঁক করলেন। সুন্দর ফরসা মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। তারপর বললেন, আমার গলার স্বরটা ভাঙা মনে হচ্ছে না তোদের?

মানু বলল, আঃ! কথাটা কী?

গোঁসাই গ্রাহ্য করলেন না। নিজের গলায় পলা ও মুক্তোবসানো আংটিপরা আঙুলগুলো ছুঁইয়ে বললেন, আমার দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের সাধা ভয়েস। ধরেছিলুম পনেরো বছর বয়সে। এখন আমি ষাট। সেই ভয়েস আজ টুটে গেছে—এইসা হি খতরনাক হো গেয়া। বলবে, কেন এমনটা হল? হল, অপমানে। দুঃখে। রাগে। জীবনে এতকাল ফেলু গোঁসাই সবখানে মানুষের কাছে খাতির পেয়েছে। প্রণাম পেয়েছে। বড়—বড় আমিরওমরা রইস লোক তাকে সেলাম ঠুকেছে। রাজা—মহারাজা পাশে বসিয়ে ডিনার খাইয়েছে। কত এম এল এ, এম পি, মিনিস্টারের বাড়ি…

মানু ফের অধীর হয়ে বলল, কথাটা কী বলুন না?

গোঁসাই চোখ কটমট করে ধমকে দিলেন, তুই থাম তো! আমি ননীকে বলছি। বেটা ননী, তুমি শোনো।

ননী বলল, বলুন পিসেমশাই।

গোঁসাই মুখটা আরও বিকৃত করে বললেন, একটা রাস্তার ছোকরা, একটা পুঁচকে মাস্তান, মানুদের পাড়ার ডাক্তার না ফাক্তার অঘোরবাবুর পুত্র হারামজাদা আমাকে পুরনো পল্টনের মাঠে যা না হয় তাই করলে গো! এর চেয়ে আমার মরে যাওয়া কি ভালো ছিল না?

মানু দম আটকানো গলায় বলল, কী করেছে পল্টু?

গোঁসাই চোখ রাঙিয়ে বললেন, হারামিবাচ্চা তো বেশ তোদের ন্যাওটা হয়ে থাকে দেখেছি। ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে বেশ তো গুপুরগাপুর করিস। তোরাই তো ওকে আস্কারা দিস। তাই গুখেকোর বেটার এত স্পর্ধা!

মানু মুখ ঝামটা দিল। কিন্তু কিছু বলল না। তার শরীর আবার ভারী হয়ে উঠেছে।

ননী বলল, আপনাকে অপমান করেছে?

গোঁসাই গলার স্বর চেপে বললেন, সেটা কোনো কথা নয়। চামচিকের অপমান করায় ঐরাবতের কিছু যায়—আসে না। কিন্তু এর তলায় একটা সাংঘাতিক ব্যাপার আছে, যেটা বলতে এলুম। তোমার বোনের খুনি বলে যাদের ধরেছে, তারা নির্দোষ। ভুল লোককে ধরেছে পয়সা খাবার জন্যে। আসল খুনি কে, আমি জেনে গেছি।

মানু নিশ্বাস মিশিয়ে বলল, কে?

আবার কে? অঘোর ডাক্তারের ওই হারামজাদা বংশধর।

ননী একটু হাসল। আপনি কীভাবে জানলেন সে কৃষ্ণাকে খুন করেছে?

গোঁসাই প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, স্কুটার! হরিপদর বউ বলেছিল, ভটভটিয়া। ভটভটিয়া নয়, নীল রঙের স্কুটার! বলে গোঁসাই একহাত মুঠো করে নিজের শরীরের চারপাশে ঘোরাবার চেষ্টা করে বললেন, যেই শর্টকাট করে মাঠে ঢুকেছি, অমনি হারামির বাচ্চার স্কুটার গোঁ গোঁ করে ছুটে এল। তারপর আমাকে তাড়া করল। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক করে আমি দাঁড়িয়ে গেলুম। তখন আমার চারপাশে চক্কর মারতে লাগল। তারপর হঠাৎ প্রায় গায়ের ওপর এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝে ফেললুম সব।

গোঁসাই চোখ বুজে রইলেন কয়েক সেকেন্ড।

ননী অন্যমনস্কভাবে বলল, হুঁ। দূর থেকে দেখেছিলুম। চিনতে পারিনি। আমাকে দেখে পালিয়ে গেল যেন।

গোঁসাই চোখ খুলে বললেন, তাহলে আর কী বলতে চাও? ওঠ, চলো। আমি থানায় যাব। সাক্ষী দেব। ফাঁসি হয়ে যাবে গুয়োটার।

মানু ঘুরে বলল, তাতে কী প্রমাণ হয়? এমন হতে পারে পল্টু ব্যাপারটা কারও কাছে শুনেছে, সেটাই নকল করতে গেছে। নেহাত খেলা হতে পারে। কোনো—ইনসিডেন্টও হতে পারে।

গোঁসাই চটে গিয়ে বললেন, তুই তো বলবি। শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইবি।

মানু ফুঁসে উঠল। যা তা বলবেন না তো! বুড়ো হয়ে আপনার বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে গেছে।

দ্যাখ মানু, বাজে কথা বলিসনে। ফালতু কথা বললে শুনব? গোঁসাই পা দোলাতে থাকলেন।

ননী মানুর দিকে তাকিয়ে বলল, ছিঃ মানু। ঝগড়া করতে নেই গুরুজনের সঙ্গে।

মানু ভিজে চোখে ওর দিকে তাকাল। তুমিও কি ভাবছ আমি পল্টু না ফল্টুকে…

ননী তাকে থামিয়ে বলল, না। তা ভাবিনি।

ভাঙা গলায় মানু বলল, আমার কে একেবারে আপনজন! তাকে নিয়ে গুপুর—গাপুর করি। শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছে। শুনলে, পিসেমশাই কীসব বললেন? জাস্ট পাড়াপড়শীর ছেলে। কখনওসখনও আমাদের বাড়ি আসে—টাসে। কথা বলতে হয়। তাছাড়া আর কি?

গোঁসাই হতাশ ভঙ্গিতে বললেন, যা বাবা। ভ্যাঁ করে কেঁদেই ফেললি যে। আরে আমি কি তাই বলছি? ওটা নেহাত কথার কথা। ননী, চলো। থানায় যাই।

ননী মাথা দোলাল। ছেড়ে দিন। কী হবে? বরং আসুন পিসেমশাই আপনি কৃষ্ণার ঘর দেখতে চাইছিলেন। ওর ঘরে তানপুরা এস্রাজ গিটার তবলা হারমোনিয়াম সবই আছে। আপনার গান শুনব, চলুন। কী বলো মানু?

মানু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই। ন’টা বেজে গেছে। চুরিটুরি হয়ে যাবে বাড়িতে।

ননী হাসল। কেন? বলতে, জনের ভয়ে চোরেরা বাড়ির ছায়া মাড়ায় না।

জন তো নেই।…বলে মানু পা বাড়াল। দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে বলল, চলি। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল…

ননীর খুব ভালো লাগছিল। ফেলু গোঁসাই কৃষ্ণার বিছানায় আসন করে বসে ইমনকল্যাণ গাইলেন কতক্ষণ। সত্যি, গলাটা একটু চিড় খেয়েছে। কিন্তু সে যেন বিষাদেরই একটি রূপ। কৃষ্ণার শূন্য ঘর ভরে গেল। সত্যি, কৃষ্ণার আত্মা থাকলে কত খুশি হত। কিন্তু আত্মা—টাত্মা বাজে কথা। ম্যান ইজ মেসিন।

এর ফাঁকে ননী টিফিনকেরিয়ারে কাছের হোটেল থেকে ভাত তরকারি এনেছিল। দুজনে বসে খেল। গোঁসাই রাতটা এঘরেই কাটাবেন বললেন। ননী আরও খুশি হল।

আজ ননীর ঘুম পাচ্ছিল। গোঁসাই বললেন, শুয়ে পড়গে বাবা। আমি এখনও কিছুক্ষণ গুনগুন করব। সুর আসছে অনবরত। তুমি শোও গে। আমি দরবারি গাইব।…

অনেক রাতে দরজার ধাক্কা এবং গোঁসাইয়ের কণ্ঠস্বরে ঘুম ভেঙে গেল ননীর। বেরিয়ে বলল, কী হল?

গোঁসাইয়ের চেহারা কেমন ঝড়খাওয়া, ফ্যাকাশে। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। বুঝতে পারছিনে বেটা। তুমি ওঘরে একবার এসো তো। শীগগির।

ননীর বুক কেঁপে উঠছিল। কৃষ্ণার আত্মা? আত্মা আছে? গোঁসাইকে দেখা দিয়েছিল? ম্যান ইজ নট মেসিন? তার মাথা ঘুরে উঠল। আলো—অন্ধকারে বাড়িটা আজ রাতে এক বিভীষিকার করতলগত যেন। তাকাতে ত্রাস লাগে। রোম খাড়া হয়। গোঁসাই ঘরে ঢুকে নাক উঁচু করে কিছু শুঁকতে শুঁকতে বললেন, আর তো পাচ্ছি না। অথচ শুয়ে শুয়ে পাচ্ছিলুম। সেই গন্ধ। কৃষ্ণা আমার কাছে যেদিন গেল…আশ্চর্য! খুবই আশ্চর্য!

ননী একমুহূর্ত গুম হয়ে থাকার পর হঠাৎ বালিশ তুলল এবং তোশকের তলা থেকে সেন্টের শিশিটা বের করে বলল, এই যে। তারপর ছিপিটা শক্তভাবে আঁটতে থাকল।

অমনি গোঁসাই হো হো করে হেসে উঠলেন। এ রাম তাই বলো। আমি ভাবি এ কী হচ্ছে।