কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি – ১১

১১

ননী তার ঘরে চুপচাপ বসে ছিল।

মাথার খুলির ভেতর কালো মোটরসাইকেলটাকে সে কিছুতেই বদলে দিতে পারছে না। দেখতে চেষ্টা করছে একটা নীলচেরঙের স্কুটার। অথচ কালো মোটরসাইকেল কিছুতেই বেরিয়ে আসবে না এরিনা ছেড়ে, স্কুটারটাকে ঢুকতেই দেবে না। বড্ড গোলমেলে পরিস্থিতি। এরিনার বাইরে চক্কর দিতে দিতে নীলচে স্কুটার চলে গেল মদনমোহনতলার দিকে। কালো মোটরসাইকেল তেমনি ঘুরতে লাগল। কিন্তু আর ঝড়টা নেই। ঠান্ডা হিম অন্ধকার এরিনা। তার মধ্যে চাপা গরগর গোঁ গোঁ আওয়াজ হতে হঠাৎ ব্রেকের ক্যাঁ—চ…ধাতব এবং চেরা শব্দ একটা তীক্ষ্ন চিৎকারের মতো, এবং ননী চমকাল।

এই রকম হচ্ছে ননীর—যখন তখন। বসে থাকার সময়। হাঁটার সময়। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে। কতবার।

আর হঠাৎ—হঠাৎ সদরদরজায় কার ডাক—কৃষ্ণা!

কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি।

উঠোনে কার পায়ের শব্দ হয় দুপুরবেলা। কৃষ্ণা বাড়ি ফিরেছে, কে বলে ওঠে চাপা গলায়।

ফ্যানের ঘূর্ণিতে কালো মোটরসাইকেল দেখতে দেখতে ননী মনের ভেতর জবাব দেয়, না। কৃষ্ণা আর বাড়ি ফিরবে না।

তারপর সে ভয় পেয়ে উঠে বসে। নিষ্পলক চোখে সাদা ঝলসানো উঠোন দেখতে দেখতে একবার বারান্দা ঘুরে আসে। সদরদরজা বন্ধ আছে দেখে নিশ্চিন্ত হয়।

আর কখনও আনমনে কিছু ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ননীর মনে হয়, সেই সেন্টের গন্ধটা পাচ্ছে। সে দ্রুত ঘোরে। এদিকে ওদিকে তাকায়। গন্ধটা আর নেই।

কাল রাতে ননী ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ওই গন্ধটা পেয়ে জেগে গিয়েছিল। আতঙ্কে কিছুক্ষণ কাঠ হয়ে শুয়ে ছিল। বারান্দার আলোটা সারারাত জ্বলে। মনে হচ্ছিল, উঁকি দিলেই কৃষ্ণাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে। ননী ভেবেছিল, মৃতরা কি জীবিতদের শত্রু হয়ে যায়? কৃষ্ণার আত্মা কি তার দাদার গলা টিপে নিজের মৃত্যু যন্ত্রণার স্বাদ পাইয়ে দিতে চাইবে? ননী নিজের দুটো হাত গলায় চেপে দম আটকে রেখেছিল। যতক্ষণ না তার ফুসফুস ফেটে যাবার উপক্রম হল, ছাড়েনি। যখন ছাড়ল, তখন তার ফুসফুস হাঁপরের মতো কাঁপছে। প্রচুর বাতাস দরকার। অথচ বেরুতে পারছিল না কৃষ্ণার ভয়ে। ভেবেছিল, বিদ্যুৎকে বলবে নাকি তার কাছে এসে থাকতে? বিদ্যুৎ একটা মেসে থাকে। জঘন্য অবস্থা।

কিন্তু সকালে ননী মত বদলাল। দিনের আলো রাতের সেই ভয়গুলোকে হাস্যকর করে তোলে। ননীর ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হাসি ফুটল। এই ভয়ের সঙ্গে তার লড়াই তো কবে ছেলেবেলা থেকেই চলেছে। কৃষ্ণার মৃত্যু সেটা আরও তীব্র করে দিয়েছে। কিন্তু ননী মরিয়া হয়ে বুঝবে। এ তার চরম বোঝাবুঝি। এখন তার খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে—যে হও তুমি, সামনে এসো, দেখি। সে মনে মনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, আর আমি ভয় পাব না। কিছুতেই ভয় পাব না। ভূতপ্রেত একটা কুসংস্কার। আত্মা বলে কিছু নেই। হয় না। শরীর একটা যন্ত্রের মতো। যন্ত্র বিগড়ে গেলে যা হয়, আধিব্যাধিভোগা শরীর তাই। এবং মেরামতের অযোগ্য হয়ে গেলে যন্ত্র যা, মৃত মানুষ তাই। কর্তার সিং গ্যারেজের চত্বরে ভাঙা মোটরগাড়িগুলোর মতো—যাদের এঞ্জিনের ছেঁদা দিয়ে কালকাসুন্দে ঝাড় উঠে হলদে ফুল ফুটিয়েছে। গিয়ারের গায়ে সবুজ ঘাস গজিয়েছে। স্টিয়ারিঙে বসে আছে লাল গাঙফড়িং। ছ্যাৎরানো মরচে ধরা বনেটে পিঁপড়ের সার।

কৃষ্ণার নাভি ও ঊরুতে যেমন পোকামাকড় বসে ছিল। কান, মুখ ও নাকের ফুটোয় যেমন পিঁপড়েরা চলাফেরা করছিল।

‘ম্যান ইজ মেসিন—এ থিং প্রডাক্টেবল ইন দা ল্যাবরেটরি।’ আণবিক জীববিজ্ঞানী জাঁক মোদের কথা। নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন জানিস?

ননী তাকাল। সামনে বিদ্যুৎ নেই। এম এস—সিতে নাকি ফার্স্টক্লাস। মফসসলের স্কুলে সেই মেদিনীপুর থেকে এসেছে মাস্টারি করতে। পায় শ’তিনেক, লেখা থাকে শ’পাঁচেক। বিদ্যুৎ ননীকে বিজ্ঞান বুঝিয়ে গেছে। সাইকলজির জ্ঞান দিয়েছে। বলেছে, সাবধান নোনে। হ্যালুসিনেশনে ভুগছিস। কেলেঙ্কারি করে ছাড়বি! শীগগির বিয়ে করে ফ্যাল। ঝটপট কাচ্চাবাচ্চা পয়দা করে দে। দেখবি সব নর্মাল হয়ে গেছে। আমি জানি।

বিদ্যুৎ কত কিছু জানে। ননীকেও জানায়। এইসব জানাকেই তো জ্ঞান বলে। অথচ ননীর সব জ্ঞান বরবাদ করে খুলির ভেতর ঠান্ডা—হিম অন্ধকারে কালো মোটরসাইকেল চক্রাকারে ঘোরে। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ব্রেকের শব্দ ওঠে ক্যাঁচ—চ। ননী কাঠ হয়ে ঘামতে থাকে। হঠাৎ ভেসে আসে উগ্র মিঠে সেন্টের গন্ধ। স্নায়ুকে আচ্ছন্ন করে যায় কয়েক সেকেন্ড। হঠাৎ কে ডেকে ওঠে, কৃষ্ণা। আর ননী জবাব দিতে ঠোঁট নাড়ে—কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি। উঠোনে পায়ের শব্দ হয়। কেউ বলে ওঠে, কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি। ননীর নিঃসাড় জিভে মাথা কোটে একটি ভিজে বাক্য—কৃষ্ণা আর বাড়ি ফিরবে না।….

কড়ানাড়ার শব্দে ননী গিয়ে দরজা খুলে দিল। পিউ। চোখে কেমন চাউনি। নাকের ডগায়, চিবুকে ঘামের ফোঁটা। হাতের বইখাতা বুকের সঙ্গে ধরা। ননী বলল, কী রে? কলেজ যাচ্ছিস?

পিউ বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

বেশ তো! আয়।

বারান্দায় গিয়ে পিউ থামে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।

ননী চেয়ারটাতে বসে সিগারেট ধরিয়ে বলল, কী রে পিউ?

পিউ আস্তে বলল, তুমি ভীষণ—ভী—ষ—ণ ভুল করলে নোনেদা। কোয়াইট এ ব্লান্ডার।

ননী নিষ্পলক তাকাল। কী বল তো?

গাবুদাকে তুমি অ্যারেস্ট করালে। পিউ শ্বাসপ্রশ্বাস মিশিয়ে ঠোঁটের ডগায় বলল। বাট হি ইজ অ্যাবসোলিউটলি ইনোসেন্ট।

ননী একটু চুপ করে থেকে বলল, গাবুকে অ্যারেস্ট করেছে নাকি? কখন?

লাস্ট নাইটে। ওকে—তারপর ধাঙড়বস্তির একটা ছেলেকে। ওর মা কান্নাকাটি করছে। ও নাকি সেদিন ছিল না। পাকুড় গিয়েছিল। …পিউ রুমাল বের করে মুখ স্পঞ্জ করতে থাকল।

ননী উঠোনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কিছু জানিনে রে? সবই তো পুলিশের ইচ্ছেয় হচ্ছে—কিংবা হবে। তুই বিশ্বাস কর পিউ, আমি গাবুকে অ্যারেস্ট করতে বলিনি। তাছাড়া, এখন আমার ধারণা, কৃষ্ণার কিলার গাবু তো নয়ই—কারণ….

ননীকে চুপ করতে দেখে পিউ দ্রুত বলল, কী গো নোনেদা!

কারণ, জানিস পিউ? কাল আমি পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ডে এক নীলচে রঙের স্কুটারে একটি ছেলেকে দেখলুম—সার্কেল করে ঘুরছে আর হঠাৎ ব্রেক চেপে থেমে যাচ্ছে। রিপিটেডলি। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হল। ননী দম নিয়ে শান্তভাবে বলতে থাকল।…আমার ভুল এক্ষেত্রেও হতে পারে। কিন্তু …যাক সেকথা। আমি এখনই যাচ্ছি অরুণবাবুর কাছে। গিয়ে বলছি গাবুকে ছেড়ে দিতে। ভাবিসনে।

পিউ চমকখাওয়া গলায় বলল, ভ্যাট, আমি কী ভাবব? জাস্ট পাড়ার ছেলে। আমাদের বাড়ি আসে—টাসে। তাছাড়া হি ইজ ভেরি—ভেরি হুইমজিক্যাল টাইপ। আমার ভয় হল, তোমার ওপর রেগে যাবে। তাই বলতে এলুম।

ননী একটু হাসল। অবিকল মানু একই কথা বলেছিল। ননী উঠে দাঁড়িয়ে সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে বলল, আমি এখনই যাচ্ছি, পিউ। বলছি অরুণবাবুকে।

পিউ চলে গেলে ননী সাইকেল নিয়ে বেরুল।

থানার গেটে ঢুকে সে দেখল প্রিজনভ্যান দাঁড়িয়ে আছে উঁচু বারান্দার নীচে। অরুণ নন্দী সবে সামনের দরজা খুলে পাদানিতে পা রেখেছেন। ননী বলল, মিঃ নন্দী।

নন্দী ঘুরে দেখে বললেন, এই যে! আসুন ননীবাবু।

ননী প্রিজনভ্যানের ভেতরটা দেখবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, খুব জরুরি কথা ছিল মিঃ নন্দী।

নন্দী ঘড়ি দেখে বললেন, পুলিশকোর্টে যাচ্ছি আসামি নিয়ে। ঝটপট বলুন।

ননী একটু তফাতে নিয়ে নন্দীকে। তারপর চাপা গলায় বলল, গাবুকে….

কথা কেড়ে নন্দী বললেন, কোর্টে নিয়ে যাচ্ছি। সেকসান ইজ ননবেলেবল। তবে পার্টি তো ইনফ্লুয়েন্সিয়াল। আমাকে পয়লা দফাতেই ঘা মেরে বসিয়ে দিয়েছে, ননীবাবু! আই অ্যাম ভেরি সরি। দেখুন না চার্জশিট তৈরি করলুম আমি। প্রিলিমিন্যারি ইনভেসটিগেশন যা করার করলুম আমি। প্রাইমা ফ্যাসি কেস দাঁড় করাতেই আই হ্যাড ট্রায়েড মাই বেস্ট। অথচ এখনই বড়বাবু আভাস দিলেন কেস যাবে বরুণ সোমের হাতে। সোমই চার্জশিট প্লেস করবে। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে বুঝলেন?

ননী তাকাল।

আমার হাত থেকে পুরো ব্যাপারটা চলে যাচ্ছে সোমবাবুর হাতে। নন্দী তেতোমুখে চাপা গলায় বলল ফের, মশাই। এখন পস্তাই। কেন এই শালা ইয়েতে ঢুকেছিলাম! লাইফটা হেল হয়ে গেল। ওঃ! আমি হিসট্রি স্টুডেন্ট ছিলুম।

ননী মুখ খুলল। বুঝলেন? আমারই ভুল হয়েছে। গাবু না। অন্য কেউ। মনে হচ্ছে, মদনমোহনতলারই কেউ। কারণ কাল একটা….

ফের কথা কেড়ে নন্দী একটু হেসে বললেন, ভেরি সরি ননীবাবু! দিস ইজ স্টেট—ভার্সেস কেস! তা ছাড়া, বললুম তো, এখন সবটাই বিয়ন্ড মাই কনট্রোল চলে গেছে। … বলে নন্দী ফের গলা চেপে বললেন, মশাই! সোম ইজ দা নাম্বার ওয়ান করাপ্টেড অফিসার ইন দা পোলিশ। সিগারেট ঘুষ নেয় কেউ, শুনেছেন কখনও? অলরাইট। চলি। ফাস্ট আওয়ারে আসামি হাজির করিয়ে আমার ছুটি। ব্যস!

গাড়ির দিকে যেতে যেতে নন্দী ফের বলে গেলেন, আপনার বোনের জন্য কিছু করতে পারলুম না। ক্ষমা করবেন ননীবাবু।

যেন কাকেও শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন কথাটা। গাড়িতে ওঠামাত্র স্টার্ট দিল। ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়ার পরও ননী দাঁড়িয়ে আছে লনে। রোদে ঘামছে।

তারপর সে সাইকেলে চাপল। বেরিয়ে গেল। কালো প্রিজনভ্যান তখন হাসপাতালের পেছনে আড়াল হয়ে গেছে। কিন্তু পথে ডিজেলের পোড়া গন্ধ আর কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পরে ননী দেখল, সে মদনমোহনতলার দিকে যাচ্ছে। সামনে প্রবল বাতাস। কুঁজো হয়ে প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে সে। গায়ে এতটুকু জোরও নেই যেন। মানুদের বাড়ি পৌঁছতে পারবে তো? মাথা ঘুরে পড়ে যাবার ভয়ে ননী সাইকেল থেকে নামল। এই রাস্তাটা নতুন। সবে গাছ পোঁতা হয়েছে দুধারে। এতটুকু ছায়া নেই। খালপোলের সামান্য আগে হঠাৎ সে ঘাড় ঘুরিয়ে দূরে পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে তাকাল। থমকে দাঁড়াল। সেই নীলচে স্কুটারটা চক্কর দিচ্ছে। চোয়াল আঁটো হয়ে গেল ননীর। কিন্তু ভীষণ ক্লান্ত আর দুর্বল এই শরীর—গলা থেকে বুক অবধি শুকনো। দূরে গনগনে রোদের মধ্যে কাঁপা কাঁপা অসংখ্য তাপরেখাকে ভাঙচুর করে বেড়ানো নীলচে স্কুটারটা অসহায় চোখে ঘুরতে দেখল ননী। তারপর ভাবল, মানুর কাছে গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা জল চাইবে। ওদেরটা ডিপ টিউবওয়েল। খুব স্বচ্ছ চমৎকার জল।

কিন্তু গিয়ে পৌঁছল যখন, তখন দেখল মানুদের দরজায় তালা আটকানো। ননী একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা খাবারের দোকানের দিকে এগোল!…

বিকেলে ফেলু গোঁসাই ভানুবাবুর কাঠগোলায় যাচ্ছিলেন। খালপোল পেরিয়ে একটু এগোলে ডাইনে পোড়ো রেশমকুঠি। আগাছার জঙ্গল। পায়ে চলা একফালি রাস্তা তার ভেতর দিয়ে গিয়ে পুরনো পল্টনের মাঠে পড়েছে। সারা মাঠ ঘাসে ঢাকা। কিন্তু উইটিবি আর খানাখন্দে ভরা। ফালি রাস্তাটা মাঠ দু ভাগ করে গিয়ে হাইওয়ের তেমাথায় মিশেছে। সেখানে ডাইনে কিছু দূর এগোলে কাঠগোলা। বাঁয়ে এগোলে কালেকটরি এলাকা হয়ে নদীর ব্রিজ এবং সোজা হেঁটে গেলে গার্লস কলেজ। তারপর বসতি এলাকা। তোপপাড়া। জলের ট্যাঙ্ক। বাজার।

গোঁসাই ‘সুপথ দূর ভালো’ প্রবাদে বিশ্বাসী। বরাবর ঘুরে পাকা রাস্তায় হেঁটে যান কাঠগোলা বা স্টেশনের দিকে। কিন্তু আজ মনের খেয়ালে আগাছার জঙ্গলে ঢুকলেন। খালের ধার অবধি ছড়ানো এই জঙ্গলে রাজ্যের আবর্জনা—আর মদনমোহনতলার খাটা পায়খানার ময়লা ফেলে যায় মেথরেরা। শুয়োরের পাল ঘোঁত ঘোঁত করে ঘুরে বেড়ায়। গুনগুন করে পুরিয়া ভাঁজতে ভাঁজতে এক সময় হঠাৎ টের পেলেন, বড্ড দুর্গন্ধ। তখন নাকে রুমাল গুঁজে জোরে হাঁটতে থাকলেন।

প্রতিবার দেখেশুনে পা ফেলছিলেন গোঁসাই। নীচের দিকে দৃষ্টি। দেখলে মনে হবে, ভদ্রলোক বড্ড বিপদে পড়েছেন। নিজের স্বভাবের ওপর এসব সময় গোঁসাই ভারি চটে যান। নিজেকে বিড়বিড় করে গালমন্দ করেন।

ফাঁকা মাঠে পৌঁছে মুখ তুললেন। আশ্চর্য, নিজেই তো হরদম ছাত্র—ছাত্রীদের উপদেশ দেন, শর্টকাট খুব খারাপ, ভীষণ খারাপ। সরগমের রাস্তা দূর মনে হবে। তাই তুরন্ত তাড়াহুড়ো ভাবছ রাগ—রাগিণীতে যাব, দু’ কলি পদ মুখস্থ করে কেল্লা ফতে করব। তাই কি হয় রে বাবা? শর্টকাটে অভীষ্ট মেলে না। ফাঁকি দিলে ফাঁক থেকে যাবে।

মুখ তুলতেই গোঁসাই থমকে দাঁড়ালেন।

চাপা গরগর আওয়াজ করে সামনে মাঠের মাঝামাঝি একটা নীলচে স্কুটার চক্কর দিচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর কী একটা চিড়িক করে উঠল। মালতী ও হরিপদর কথা মনে পড়ে গেল। সেদিনকার ঝড়জলের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল ননীগোপালের হতভাগিনী বোনটার কথা। হুঁ, ওর হত। নিশ্চয় হত। গোঁসাইয়ের জহুরীর চোখ। এ মুহূর্তেও মনে পড়ছে পায়ে লুটিয়ে প্রণাম করেছিল। নাকে ঝাপটা মেরেছিল কী এক সুঘ্রাণ। সারা ঘর ভরে গিয়েছিল। গোঁসাই ভাবাপ্লুত হয়ে বলে উঠেছিলেন, জিতি রহো বেটি!

গোঁসাইয়ের মনে হারিয়ে যাওয়া বিষণ্ণতাটা ফিরে এল। তারপর সেই বিষণ্ণতা তীব্র হতে—হতে যখন ক্ষোভ এবং রাগে ফুঁসে উঠল, তখনই মনে পড়ল তাই তো! মালতী একটা ভটভটিয়ার কথা বলেছিল। এটা মোটেও সে জিনিস নয়। দেখতে বড্ড নিরীহ নীলচে একটা স্কুটার ফ্যাশানবাজ মেয়ের মতো।

তারপর মনে পড়ল, কী মুশকিল! ওবেলা আচায্যিপাড়ায় শুনে এসেছেন বেজা অর্থাৎ ব্রজমোহনের কাছে, আসামি পাকড়া গেছে। তোপপাড়ারই এক মস্তান ছোকরা। গোমো কায়েতের হারামজাদাটি। গোঁসাই অবশ্যি তাকে চেনেন না। তার বাপকে চেনেন অল্পস্বল্প। ভারি দেমাকি লোক সে। গোঁসাইয়ের তাতে অষ্টরম্ভাটি। ইস! ভারি আমার ইয়ে রে! তুই দেমাকি আছিস, পয়সাওয়ালা আছিস নিজের জায়গায়। আর ফেলু গোঁসাই সারা দুনিয়া জুড়ে নামি মানুষ। কত সব পয়সাওলা ছাত্রছাত্রী। দেখলে পায়ে লুটিয়ে ধুলো নেয়। হুঁঃ! গোমো কায়েত অক্কা পাবি—সঙ্গে সঙ্গে ফক্কা হয়ে যাবি। কিন্তু গোঁসাই মরেও অমর হয়ে থাকবেন।

ফেলু গোঁসাই শেষ পর্যন্ত এই গর্বে মুখ উঁচু করে খুশি মনে পা বাড়ালেন। খানিক এগিয়ে স্কুটারের ছেলেটিকে চিনতে পারলেন। আরে কী আপদ! এ তো সেই অঘোর ডাক্তারের গুগলিচোখো ছাগলদাড়ি ডেঁপোটা। সেদিন সকালে গিয়ে স—স করছিল। চোখে সানগ্লাস পরে আছে এখন। কিন্তু গোঁসাই জীবনে একবার যাকে দেখেন, ভোলেন না। দেশচরা ‘মুসাফির’ মানুষের এই এক গুণ। ক্রমাগত লোক চিনে রাখার চেষ্টা থেকেই গুণটা জন্মায়। কাকে কখন দরকার হয়, বলা তো যায় না। গোঁসাই অনেক ঠেকে এ গুণ রপ্ত করেছিলেন।

স্কুটারটা এবার তাঁর দিকে গরগর করে এগিয়ে আসছে। ডেঁপো ছোকরার মুখে লালচে রোদ্দুর পড়েছে। কাঠঠোকরা ঠোঁটের মতো রামধনু হাসিটা টানা আছে। আরে, আরে! কী মতলব হারামজাদার! ঘাড়ের ওপর এসে পড়বে নাকি? গোঁসাই সরে গেলেন এক লাফে। হারামজাদা গররর করে বেরিয়ে গেল।

এ্যাঁ! চক্কর মেরে ফের তাঁর দিকেই আসছে যে! ফের লাফ দিয়ে সরে গোঁসাই রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন, এ্যাই! এ্যাই! তারপর বুঝলেন, হারামজাদাটি তাঁকে নিয়ে খেলা জুড়েছে। যত এগোচ্ছেন, চক্কর মেরে তাঁর দিকে ছুটে আসছে। কান অবধি টানা চাঁদপানা হাসির বদমাইশি। এ্যাই উল্লুকে! এ্যাই কুত্ত্বাকা বাচ্চে! গোঁসাই লাফালাফি জুড়ে দিলেন মাঠের মাঝখানে। বাজখাঁই চেঁচিয়ে গাল দিতে দিতে গলা চিড় খেল। রাগে দুঃখে অপমানে গোঁসাই দূরে কাঠগোলার দিকে তাকিয়ে শেষ চেষ্টায় চেঁচালেন, ভানুউ—উ—উ!

আশেপাশে কোথাও লোকজন নেই। দক্ষিণে ঝিলের দিকে ধোপারা দিন—মান রোদ্দুরে কাপড় শুকোতে দিয়েছিল। এখন তুলে ভাঁজ করছে। একটা গাধা আপন মনে ঘাস খাচ্ছে ঝিলের ধারে। আরও তফাতে একটা মোষ পা ডুবিয়ে জলজ দাম চিবুচ্ছে। তার পিঠে কেউ বসে আছে। মুখটা অন্যদিকে ঘোরানো। রেল লাইনের বাঁকের মুখে আপ ট্রেনের হুইসল শোনা গেল। গোঁসাই চারদিক দেখতে দেখতে ভাঙা গলায় যাচ্ছেতাই গলা জুড়ে দিলেন। ওরে গুখেকোর বেটা! এ্যাই ভূতের বাচ্চা! এক্ষুনি থানায় যাব। শালাকে ছ’ বচ্ছর ঘানি টানিয়ে ছাড়ব। আমার নাম ফেলু গোঁসাই! তারপর মরিয়া হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। আস্তিন গুটিয়ে বুক চিতিয়ে গর্জালেন, চলে আয় শালা!

স্কুটারটা তাঁর দিকে আসছে। গোঁসাই ঘুষি বাগিয়ে রিঙে দাঁড়ানো ক্যাসিয়াস ক্লের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছেন। তারপর এক—দেড় মিটার তফাতে এসে স্কুটারটা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। ক্যাঁ—অ্যাচ করে বিশ্রী চেরা আওয়াজ হল এবং গোঁসাই চোখ বুজে ফেললেন।

কী পিসেমোসা! খুব ভয় পেয়ে গেলেন নাকি?

গোঁসাই চোখ খুলে নিষ্পলক তাকালেন।

মাইরি পিসেমোসা, আপনি বড্ড ভীতু লোক। পল্টু একগাল হেসে বলল। সরবত খাবেন, সরবত? বলে সে হাতের আঙুলে গেলাস ধরার ভঙ্গি করে মুখে ঠেকাল।

গোঁসাইয়ের বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে। ইদানীং প্রেসার একটু বেড়েছে। মুখ লাল টকটক করছে। মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে, এক্ষুনি হার্টফেল করে মারা পড়বেন। কাঁপা—কাঁপা ঠোঁট, স্ফুরিত নাসারন্ধ্র—ফেলু গোঁসাই হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো ফুঁপিয়ে উঠলেন।

পল্টু হাততালি দিয়ে হেসে উঠল। ই হি হি হি হিঃ! উরে ব্যস, পিসেমোসা মাইরি ভ্যাঁ করে গেল? নাঃ, আর ঘাঁটাব না পিসেমোসাকে। যান, যান। যেখানে যাচ্ছিলেন যান।

তারপর সে স্কুটারে স্টার্ট দিল।

গোঁসাই ভেজা চোখে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ঘুরে লক্ষ রাখলেন, কিন্তু স্কুটারটা আর ঘুরল না। সোজা মাঠের দক্ষিণ দিক হয়ে দূরে আগাছার জঙ্গলে সেই ফালি রাস্তায় ঢুকে পড়ল এবং অদৃশ্য হল।

গোঁসাই ধূপ করে বসে পড়লেন ঘাসের ওপর।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ মনে চমক খেলে গেল। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন।

ভানুবাবু ট্রাকের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছকড়িবাবু গজগজ করছেন, আমি বলছি—দেখো, রিজেক্ট করবেই করবে। অর্ডার ক্যানসেল করে দেবে। সেন বড্ড গোঁয়ার লোক।

ভানুবাবু বললেন, আহা! উনিশ বাই উনিশ বললেই তো হয় না। পয়দা করব? এক—আধ সুতো এদিক—ওদিক হবেই।

করাতকলের ওখান থেকে মিস্তিরি বলল, গোডাউনের বিম তো? মাথা খারাপ না কী! ওয়ালের গাঁথুনি কত জিগ্যেস করেছেন?

কুড়ি।

কুড়ি? মিস্তিরি হাসতে লাগল। এই মরেছে। কুড়ি কী গো? কুড়ির মাথায় উনিশ বাই উনিশ শাল বিম! হুড়মুড় করে পড়ে যাবে যে! ওভারসিয়ারবাবুর মতলব আছে কিছু।

ছকড়িবাবু দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন, আমাদের তা দ্যাখবার দরকার কী? ওরা বুঝবে।

ভানু!

ভানুবাবু চমকে উঠলেন। ট্রাকের আড়াল থেকে হঠাৎ ফেলু গোঁসাই যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছেন। কিন্তু এ কী চেহারা! দেখে ভড়কে যাওয়ার মতো। বললেন, ওস্তাদজী!

গোঁসাই খপ করে ওঁর একটা হাত ধরে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, ভুল লোককে ধরেছে বুঝলে? একেবারে ভুল লোক। নির্ঘাৎ পয়সা খাবার জন্যে। ওর বাপের পয়সা আছে কি না!

ভানুবাবু অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার?

গোঁসাই ফিসফিস করে বললেন, ওই মেয়েটি গো! সেই যে ডেড বডি!

ছকড়িবাবু এগিয়ে এসে শুনছিলেন! বললেন সে তো তোপপাড়ার গোমো কায়েতের ছেলেকে ধরেছিল। শুনলুম আজ জজ—কোর্টের জামিন নিয়ে ছাড়া পেয়েছে। নিবারণ দেখে এল। এই তো খানিক আগে।

গোঁসাই জোরে দু’হাত নেড়ে বললেন, ভুল লোক। ভুল লোক! আসল লোককে আমি চিনতে পেরেছি। এইমাত্র শুয়োরের বাচ্চা, হারামজাদা, গুখেকোর বেটা…

ভানুবাবু হাত তুলে বললেন, আঃ ওস্তাদজী। আপনি বড্ড ছেলেমানুষী করছেন কিন্তু। আপনার ওসব ঝামেলায় যাবার কী দরকার। ছাড়ুন তো! ছকাদা, ওনাকে গদিতে নিয়ে যাও।

গোঁসাই চুপ করে গেলেন। গদিঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, ভানু! গরম গরম দুধ খাব। আগে এক গ্লাস জল।…