১০
সকালে ননী কালেকটরির ওখানে একটা চায়ের স্টলে বসে পর পর দুকাপ চা খেয়েছে। সাইকেল নেয়নি। পায়ে হেঁটে বেরিয়েছে স্টেশনের দিকে। স্টেশনে ভিড় আছে এখন। সওয়া নটার ডাউন ট্রেনে কলকাতা যাবে। ননী উদ্দেশ্যহীনভাবে প্ল্যাটফর্মে ঘুরেছে কিছুক্ষণ! চেনাজানা কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তারা প্রথমদৃষ্টে কেউ ননীকে চিনতে পারছে না, এমন ভাব দেখিয়েছে। শেষে বলেছে, মুখে এত দাড়ি গজিয়ে ফেলেছ, চেনা যাচ্ছে না। তারপরই তৃষ্ণার জন্যে দুঃখপ্রকাশ। ননী চলতে শুরু করেছে।
রেললাইনের ধারে—ধারে এগিয়ে সে ডাউন সিগন্যালপোস্ট পেরিয়ে গেল। লাইন এবার বেঁকে হাইওয়ে পেরিয়ে গেছে। ফটকের কাছে সে দাঁড়াল। গেটম্যান বাঁহাতে গুটানো লাল নিশান এবং ডানহাতে খোলা নীল নিশান নিয়ে বন্ধ ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন আপের ডিসট্যান্ট সিগন্যালের কাছে। হু হু করে কালো ধোঁয়া উড়ছে। ওদিকটা আকাশ জুড়ে কালো মেঘের মতো।
হরিপদর বউ মালতী ছোট্ট ফটকঘরের লাল দেয়াল আরও নোংরা করে গোবরচাপড়ি দিচ্ছে। এক হাতে গোবরের তাল কান বরাবর উঁচু। আমগাছের তলায় ন্যাংটা বাচ্চাটা একটা করে পাথরকুচি ছুড়ে মারছে পায়ের দিকে। আর হাততালি দিয়ে খিকখিক করে হাসছে। ননী দেখতে থাকল। ঝিরঝিরে হাওয়ায় ছায়ায় একটি শিশু খেলা করছে আপন মনে। এই পৃথিবীতে একটা শুদ্ধতা, নির্মল আনন্দ ও দয়ামায়া স্নেহভালোবাসা করুণার দেশ আছে, যা দেখে মানুষ লোভে ও মোহে বাঁচতে চায়। বাড়তে চায়। আবার এই পৃথিবীতেই একটা দেশ আছে, যেখানে কৃষ্ণারা শুয়ে থাকে ঘাসে পিঠ দিয়ে এবং ঠান্ডা—হিম নাভির কাছে বসে থাকে বিষণ্ণ ঘাসফড়িং। আর এই বাচ্চাটা একদিন বড়ো হবে। কে বলতে পারে সে হবে খুনি, না প্রধর্ষক, কিংবা না সন্তপুরুষ? কোনো গ্যারান্টি নেই। এ সমাজ কোনো গ্যারান্টি দেয় প্রেমিক না। অক্ষয় কবচকুণ্ডল গলায় নিয়ে কোনো বাচ্চা জন্মদ্বার খুলে বেরিয়ে আসে না।
মালতী হঠাৎ ঘুরে ননীকে দেখে গোবরমাখা আঙুলে ঘোমটা টানার চেষ্টা করল। কুছু বলবেক বাবু?
ননী এগিয়ে গিয়ে আমতলায় দাঁড়াল। মুখে একটু হাসি। মালতী সন্দিগ্ধদৃষ্টে একবার ফটকে স্বামীর দিকে একবার ননীর দিকে তাকাল। ফের বলল, কুছু দরকার আছেক বাবু?
ননী আমগাছের গুঁড়ির কাছে পাথরকুচির স্তূপে বসে পড়ল। পেছনে রাঙচিতা বেড়ার নীচেটা ঢালু হয়ে খাদে নেমেছে। জল আর দামে ভর্তি খাদটা। ননী সেদিকে তাকিয়ে বলল, সেদিন যে মেয়েটা মরে পড়েছিল ওখানে, আমি তার দাদা।
মালতীর চোখে চমক খেলে গেল। নাসারন্ধ্র ফুলে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ভয়মেশানো হাসি হাসার চেষ্টা করে বলল, ঠাকুরবাবার কিরিয়া বাবু, আমরা কুছু দেঁখেক নাই।
ডাউন ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে এগিয়ে আসছে। মাটি কাঁপছে। শব্দ আর কাঁপন বাড়তে থাকল। ননীর চোয়াল আঁটো হয়ে গেল। ঝড়ের বিকেলে ধুলোওড়া মাঠে একটা মোটরসাইকেল চক্কর দিচ্ছে। ট্রেনটা পেরিয়ে গেল। শেষদিকে লাগেজভ্যানের পেছনের চাকার শব্দ আলাদা হয়ে বাজতে থাকল কতক্ষণ। তারপর ননী একটু কেশে ডাকল, দিদি।
মালতীর পায়ের কাছে ডোরাকাটা শাড়ির পাড় থর থর করে কাঁপছে। বাচ্চাটা খেলা ছেড়ে ননীকে এত কাছে দেখে আড়ষ্টভাবে পুতুল হয়ে বসেছিল—এবার হঠাৎ ভ্যাঁ করে কেঁদে চার হাত পায়ে ছটফট করে এগোল মায়ের দিকে। তারপর মায়ের পা ধরে উঠে দাঁড়াল। দুটো ছোট্ট হাতে জড়িয়ে রইল হাঁটুর কাছটা। মুখটা ননীর দিকে ফেরানো।
ননীর কেমন লাগল। তার মধ্যে ভয় পাওয়ার মতো কী আছে, যা বাচ্চাটাও টের পেয়ে গেল? কী আছে এখন তার মধ্যে? প্রতিহিংসাই কি তার চেহারায় জন্তুর হিংস্র ভাব ফুটিয়ে তুলেছে এই ক’দিনে? ননীও ভয় পেয়ে গেল—নিজের মধ্যে প্রতিহিংসাই টের পেয়ে। হুঁ, প্রতিহিংসা ছাড়া আর কী হতে পারে? আর কাল মানুও যে অমন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল, ভয় পেয়েছিল—তাহলে তাও ননীর মধ্যে প্রতিহিংসার জন্তুভাব দেখেই। মানু কাল যেন ভয় পেয়েই পালিয়ে গেল।
ননী তার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিল। এমন দাড়িও তার চেহারায় জংলিভাব ফুটিয়ে তোলার কারণ হতে পারে। ননী বলল, দিদি! আমি শুধু একটা কথা জানতে এসেছি। মাত্র একটা কথা।
মালতী ভয়পাওয়া গলায় তাদের বুলিতে স্বামীকে ডাকতে থাকল।
হরিপদ ফটক খুলে ব্যস্তভাবে এল। নিশান দুটো ফটকঘরের বারান্দায় ছুড়ে দিয়ে ননীর সামনে দাঁড়াল। সেলাম দিয়ে বলল, সার! আউর তো কুছু নতুন কথা আছেক নাই। কাল সাঁজবেলাকে আপনাদের দারোগা বাবুভি এঁস্যেছিলেন। এংকুয়েরি করলেক। বহু লিজের কথা বুললেক, আমি ভি লিজের কথা বুললেক।
ননী বুঝল, গেটম্যান তাকে পুলিশ ভেবেছে। সে কথা বলার আগেই মালতী গোবরের তাল নামিয়ে রেখে বাচ্চাটা সাবধানে কোলে তুলে বলল, বাবু পুলিশ না আছেক গ’। মেয়্যাটার দাদা আছেক।
মুহূর্তে হরিপদ নিষ্ঠুর সাহসে নড়ে উঠে বলল, ঝামেলা করবেন না বাবু! ঝামেলা করবেন না। আমরা কুছু জানেক নাই। আপনি চোহলে যান বাবু!
শুধু একটা কথা ভাই। ননী মিনতির সুরে বলল। ঝড়ের সময় দিদি নাকি দেখেছে দুজন মোটরসাইকেলে বসেছিল। যে চালাচ্ছিল, তার গায়ে লাল জামা আর পেছনের জনের কালো জামা ছিল, তাই না দিদি।
মালতী কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করল এবং তার চোখ দুটো উজ্জ্বল দেখাল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হরিপদ চেঁচিয়ে উঠল, ক্যানে ঝামেলা করেন বাবু? আমরা নুন ছিঁটাই ভাত খাবেক, তো ঝামেলায় যাবেক নাই। যান, বহু কুছু দেখে নাই।
তোমাদের ভয়ের কারণ নেই। তোমরা রেল ডিপার্টের লোক। ননী বোঝাতে চেষ্টা করল। তাছাড়া পুলিশ তোমাদের পক্ষে।
হরিপদ চ্যাঁচামেচি করে বলল, সম শালা আমাদের পক্ষেতে। দেখা আছেক বাবু। যান মেজাজ খারাপ করবেন না। আমি ডিউটিতে আছেক; আভি টিশনে যাবেক। হুঁ! পুলিশ দেখাই দিলেন বড়। পুলিশ।
ননী উঠে দাঁড়াল। অপমানিত বোধ করছিল এতক্ষণে। কৃষ্ণার জন্যে কারু মাথাব্যথা নেই। কৃষ্ণা বাড়ি না ফিরলে এবং ঘাসে পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকলে পৃথিবীতে কারুর কিছু যায় আসে না। সবাই এই গেটম্যানের মতো ভীত, নিষ্ঠুর। জেনেও সবাই সত্যকে চেপে রাখবে। এমনকী মানুও কাল কী অদ্ভুতভাবে তাকে বাধা দিচ্ছিল!
ননী হাঁটতে থাকল। হাইওয়েতে গিয়ে ভানুবাবুর কাঠগোলার একটু আগে সে বাঁদিকে নয়ানজুলিতে নামল। নয়ানজুলির খাদ শুকনো। সবুজ নরম দূর্বায় ঢাকা। সে খাদা পেরিয়ে আগাছার জঙ্গলে ঢুকল। তারপর একেবারে ঝিলের ধারে সেই হিজলগাছটার তলায় গিয়ে দাঁড়াল।
ওইখানে কৃষ্ণা শুয়ে ছিল। এখনও কৃষ্ণা শুয়ে আছে। ননী তেমনি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে কৃষ্ণাকে দেখতে দেখতে প্যান্টের পকেটে হাত ভরে সিগারেট বের করল। সিগারেট ধরানোর সময়ও তার চোখ রইল সেদিকে—ঠিক সেদিনকার মতো।
একটু পরে সে টের পেল বাঁহাতটা নিজের গলায় চেপে রেখেছে। দম আটকে আসছে। হাতটা নামিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল ননী। তারপর হঠাৎ চোখে পড়ল একটু তাকাতে এই কাঁটাঝোপের নিচের দিকে একটুকরো ন্যাকড়া আটকে আছে। নীলচে রঙের ফালি। আন্দাজ ইঞ্চি ছয় লম্বা, ইঞ্চি দুই চওড়া। ননী ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল। হাঁটু দুমড়ে বসে ফালিটা সাবধানে ছাড়িয়ে নিল কাঁটা থেকে। কৃষ্ণা সেদিন নীলচে রঙের শাড়ি পরে ছিল। ফালিটা হাতের মুঠোয় ধরে ননী তেমনিভাবে বসে রইল।
তার শরীরের ওপর দিকটায় কড়া রোদ। তাপে হু হু জ্বলে যাচ্ছে যেন। তারপর ননী শুনল, তার মাথার খুলির ভেতর ফের সেই কালো মোটরসাইকেলটা চক্কর দিচ্ছে। গরগর গোঁ গোঁ অদ্ভুত জান্তব শব্দ হচ্ছে। শব্দটা বাড়ছে। কমে যাচ্ছে। কৃষ্ণাকে কেন্দ্র করে মোটরসাইকেলটা ঘুরতে ঘুরতে বৃত্তরেখা কমিয়ে আনছে। তারপর ক্যা—অ্যাঁ—চ করে একটা ঘষটানো ধাতব শব্দ হল। অমনি ভয় পেয়ে মুখ তুলল।
একটু তফাতে পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ডে এইমাত্র একটা নীলচে রঙের স্কুটার ঝিলের প্রায় কিনারায় এসে ব্রেক কষেছে। তারপর মুখ ঘোরাল। আবার স্টার্ট দিল। চোখে সানগ্লাস, মাথায় কপালঢাকা গোল টুপি, গায়ে চকরাবকরা জামা আর ঢিলে মড পাতলুনপরা এক যুবক মাঠে চক্কর দিচ্ছে।
হ্যাঁ, স্কুটার। মোটরসাইকেল নয়। তবু ননী হাঁটতে থাকল। তার পা কোথায় পড়ছে, লক্ষ নেই। দুবার দামেঢাকা নীচু জায়গায় জুতো দেবে গেল কাদায়। ননীর চোখ সামনে। স্কুটারটা চক্কর দিচ্ছে। ক্রমশ বৃত্তরেখা কমিয়ে আনছে। ননী মাঠে পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল।
স্কুটারটা বৃত্তের কেন্দ্রে পৌঁছেই বোঁ করে ঘুরে সোজা মাঠ পেরিয়ে দূরে রাস্তার দিকে ছুটেছে।
ননী হাতের মুঠোর ন্যাকড়ার ফালিটা নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল। স্কুটারটা বাঁয়ে মোড় দিয়ে মদনমোহনতলার দিকে যাচ্ছে।…
ফেলু গোঁসাইয়ের ভোর পাঁচটায় ওঠা অভ্যেস। মদনমোহনতলায় এসে ঘুমটা আরও আগে ভেঙে যায়। আঁধার থাকতেই কারা খোল—কত্তাল বাজিয়ে ‘ভজ গৌরাঙ্গ জপ গৌরাঙ্গলহ গৌরাঙ্গের নাম রে’ গাইতে গাইতে গঙ্গাস্নানে যাবার সময় মানুদের বাড়ির পেছন ঘুরে যায়। আর গোঁসাইয়ের ঘুমের ইচ্ছে থাকে না। আজ কী ইচ্ছে হল, কেত্তুনে দলটাও যাবার একটু পরেই গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন। বাইরের ঘরের দরজা যেমন ভেজানো ছিল, তেমনি আছে। মানু তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। গোঁসাই জেনে গেছেন, জন এ বাড়ির এক জাদুমন্ত্র। চুরিচামারি হয় না। আর গোঁসাইয়ের সম্পত্তির মধ্যে একটা মাঝারি সাইজের চামড়ার স্যুটকেশ, একটা তানপুরা আর একটা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। স্যুটকেশটা মানুর ঘরে আছে। ব্যাগটা বালিশ উঁচু করার জন্য তোশকের তলায় ঢুকিয়ে রাখেন। তানপুরাটা ওপাশে নীচে থাকে। বাইরে থেকে ঢুকলে এখানে দেখা যাবে না। গেলেও ‘জন’ শব্দের তান্ত্রিক গুণে গোঁসাই বিশ্বাসী। হেসে খুন হয়ে বলেন, জন! এই তো সেদিন কোলে তুলতেই হিসি করে ভাসিয়েছিলেন, সেই জন! পেন্টুল খসে গিয়ে দৌড়ে এসে বলত, ঢেকে দাও তো! সেই জন! ভাবা যায়? পরে ফের বলেন, তবে অক্ষয় চাটুয্যে বেঁচে থাকলে কী করত, তাই ভাবি। একবার অক্ষয়কে কারা খেলা দেখতে গিয়ে মেরেছিল না? নিশ্চয় অক্ষয়বেচারা মনে মনে সেদিন খুব চেয়েছিল, তার বংশে কেউ জন্মে এর শোধ নিক। ও মানু, জন জানে রে ব্যাপারটা?
ফিরে এসে ব্যাগ আর তানপুরা দেখে জনের কথা মনে পড়েছিল গোঁসাইয়ের। তানপুরাটা চুরি হলে শোকে মারা যেতেন। কত স্মৃতি, কত খ্যাতি ওর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কাশিমবাজার রাজবাড়িতে এক বড় জলসায় মহারাজাকে খুব খুশি করেছিলেন। মহারাজা তখন অতি বৃদ্ধ। বলেছিলেন, কী চাও বলো ফেলুজী? উনি ওই রকমই বলতেন। গোঁসাই মাথা নুইয়ে বলেছিলেন, এই তানপুরাটা আমার এক সাগরেদের স্যার। আর কিছু বলার আগে মহারাজা খাজাঞ্চিকে হুকুম দিয়েছিলেন, কলকাতার সবচেয়ে বড় মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্টসের দোকানে খোঁজ নিন, একটা ভালো তানপুরার কত দাম। ফেলুজীকে কিনে দিন।…এটা গোঁসাইয়ের নিজের মুখের গল্প। ছাত্র—ছাত্রীদের না শুনিয়ে ছাড়েন না।
গঙ্গাস্নানের পর আজ কিছুক্ষণ ভৈরোঁ গেয়েছেন গোঁসাই। সাড়ে সাতটায় চোখ বুজে ভৈরবী ঠুংরির এক কলি গাইতে গাইতে টের পেলেন দরজা ঠেলে কেউ ঢুকল। তাকালেন। জনের বয়সি একটি ছেলে। দেখেছেন মনে হল, কিন্তু চিনতে পারলেন না। সে তক্তাপোশে বসে হাঁটু দোলাতে দোলাতে হাসল। মাথায় ঝাকড়মাকড় চুল, আর গোঁফ দুপাশে নেমে চিবুকের তেকোনো কদমকেশর নূরে মিশেছে। গোঁসাই বুঝলেন, এই নূরের বয়স অতি কচি। গালে একরত্তি মাস নেই। চিবুক ভাঙা গোঁজের মতো। কাঠঠোকরা দেখাচ্ছে ছোকরাকে। মুখের ফাঁক পেল্লায়। সেই ফাঁক—বরাবর হাসির যেন রামধনু। গোঁসাই থেমে গেলেন। চেহারা দেখেই মেজাজ বরবাদ হয়ে গেছে।
পিসেমোসা, আপনাকে মাইরি বৈজু বাওরা দেখাচ্ছে!
গোঁসাই রাগ চেপে বললেন, কে হে? কোথায় থাকো?
ছেলেটি অদ্ভুত ভঙ্গি করে নিজের কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনের দিকে বুড়ো আঙুল ঘুরিয়ে বলল, ওই যে ওখানে। আমার বাবা অঘোর বাঁড়ুয্যেকে চেনেন না? ফিজিসিয়ান! সেদিন সন্ধেবেলা তো দেখলুম আপনাকে। বাবার সঙ্গে খুব জমিয়ে বসেছিলেন।
অ। বলে গোঁসাই ঊরু থেকে তানপুরা নামিয়ে খোলে ঢোকাতে থাকলেন। নাম কী বেটা?
স্বপন। স্টপ করে দিলেন কেন পিসেমোসা? আপনি—মাইরি রেডিয়ো। বলে সে নিজের গলা দেখিয়ে হাসল। ব্যাটারি—পোরা পিসেমোসা!
গোঁসাই বলতে যাচ্ছিলেন, ব্যাটারি পুড়ে গেছে ব্যাটা—বলা হল না। মানু চায়ের কাপ—প্লেট হাতে ঢুকে থমকে দাঁড়াল। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
মানুদি, কেমন আছ গো?
মানু গলার ভেতর বলল, পল্টু কোথায় ছিলিস রে অ্যাদ্দিন?
পল্টু মুখ ঘুরিয়ে আঙুল মটকাচ্ছিল। বলল, ফাংশান দেখতে গিয়েছিলুম কলকাতা। জ্যোতিতে হল। কিশোরকুমার, লতা আর সব বড় বড় আর্টিস্ট এসেছিল না বোম্বে থেকে? জোর হয়ে গেল মাইরি মানুদি।
গোঁসাইয়ের সামনে কাপ প্লেট রেখে মানু ওর দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। পল্টু হাঁটু বাজাচ্ছে। মুখ দরজার দিকে। বলল, জন কোথা গো মানুদি?
সে কথার জবাব না দিয়ে মানু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠল, শোন। এদিকে আয় তো!
কী? পল্টু মুখ ফিরিয়ে শুকনো হাসল। ফের অন্যদিকে দৃষ্টি।
মানু ধমকের সুরে বলল, কথা আছে। আয়!
পল্টু উঠে দাঁড়াল। গলার ভেতর জড়িয়ে বলল, পরে আসব মানুদি। বাবা এক জায়গায় কাজে পাঠিয়েছিল। যেতে যেতে পিসেমোসার গান শুনে ঢুকে পড়েছিলুম। আপন গড। আসব’খন!
মানু দু’ পা বাড়িয়ে তাঁর কাঁধ খামচে ধরে বলল, চালাকি হচ্ছে? আয় বলছি। কথা আছে।
তারপর সে টেনেই নিয়ে চলল পল্টুকে। পল্টু ভেতরের দরজার কাছে গিয়ে মানুর হাতটা নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে বলল, যাচ্ছি তো! তুমি মাইরি বড্ড ট্রাবল করো, মানুদি! আর কখনও আসব না তোমাদের বাড়ি।
আসিস না। মানু কড়া মুখে বলল। শুনে যা। আমার ঘরে আয়।
উঠোনে কাঁঠালতলায় হাবলের না হাঁড়িথালা ছড়িয়ে বসে আছে। ঘুরে দেখে নিয়ে সে ছাই ঘষতে ব্যস্ত হল। মানু ঘরে ঢুকে বলল, বোস ওখানে।
ঘরের জানলাগুলো আজ খোলা। পর্দাও গুটানো। পল্টু খাটের পাশে চেয়ারটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মুখটা গুম। বলো না কী বলবে? কান আছে, শুনতে পাচ্ছি।
পল্টু তালব্য শ—কে দন্ত্য স উচ্চারণ করে। মানু চোখ কটমট করে বলল, স—স ছাড়। লাস্ট বুধবার থেকে কোথায় গাঢাকা দিয়েছিলি?
গাঢাকা দিয়েছিলুম? যাঃ! কী বলছ মাইরি!
মঙ্গলবার বিকেলে ঝড়ের একটু আগে তুই স্কুটার নিয়ে বেরিয়েছিলি। জন তোর সঙ্গে ছিল।
পল্টু মুখের দিকে তাকিয়েই চোখ নামাল।
কী? তাই না?
যাঃ! আমরা তো খালের ধারে বসে ছিলুম। তারপর ঝড় উঠল, তখন চলে এলুম।
মিথ্যা। মানু শক্ত গলায় বলল। তুই আর জন কৃষ্ণাকে ফলো করার মতলবে পোলের কাছে দাঁড়িয়েছিলি। কৃষ্ণা ঝড় আসছে দেখে পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ডে শর্টকার্ট করতে গেল। তখন তোরা ওকে স্কুটার নিয়ে তাড়া করলি।
পল্টু গোঁজ হয়ে দাঁড়াল। তারপর শুকনো হেসে বলল, ভেট! তোমার মাইরি খালি আজেবাজে কথা।
পল্টু! ভালো চাস তো এখনও বল…
যাও! ফালতু বোকো না। ঝুটমুট কমপ্লেন খালি।
পল্টু, কৃষ্ণার গলা টিপে ধরেছিল কে রে? জন, না তুই?
পল্টুর চোখ জ্বলে উঠল এতক্ষণে। সে কথা জনকে জিগ্যেস করো না! কে কী করেছিল বলবে।
মানু হিসহিস করে বলল, পল্টু! আমাকে তো জানিস, আমি কী। ভাই বলে জনকেও খাতির করব না।
পল্টু নড়ে উঠল। হুঁ। আপন—আপন ভাইয়ের টান সবার থাকে। জনকে কোথায় লুকিয়েছ, তুমি না বললেও বোঝা যায়।
মানু মাথা নেড়ে বলল, না। আমি জনকে লুকিয়ে রাখিনি। মা তাকে নিয়ে আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে গেছেন। পল্টু তোদের ভালোর জন্যেই বলছি, যা হয়েছিল—আমাকে সব খুলে বল।
বললুম তো তোমার ভাইকেই জিগ্যেস কোরো।
করেছিলুম।
পল্টু চমকে উঠে তাকাল। কী বলল জন? আমি মার্ডার করেছি বলল?
মানু সতর্কভাবে মাথাটা সামান্য দোলাল।
পল্টু স্টেনলেস স্টিলের বালাপরা হাত মুঠো করে অন্য হাতের তালুতে ঠুকে বলল, জনসালা মিথ্যুক! আমি ওকে বারণ করলুম ছেড়ে দে। শুনল না। স্কুটারের ব্যাক থেকে লাফিয়ে পড়ল সালা!…
মানু চোখ টিপে বলল, আস্তে। শুনবে।
পল্টু গলা চেপে বলতে থাকল, মেয়েটাকে আমি মোটেও লাইক করতুম, ভেবেছ? আগলি ফেস। রোগা—লিন অ্যান্ড থিন। জনসালা তোমার ভাই হতে পারে মানুদি, সালা একদম হারামিবাচ্চা আছে।
মানু এই কুৎসিত গাল কষ্টে হজম করে বলল, তারপর কী হল বল।
পল্টু ফিসফিস করে বলল, প্রায় ঝিলের ধার অব্দি তাড়িয়ে নিয়ে গেছি, তখন ঝড়টা হেভি এসে গেছে। জন লাফিয়ে পড়ল। হ্যাঁ, মেয়েটা আছাড় খেয়েছিল। জন তার ওপর পড়ে বলল, পল্টে! স্কুটারটা আড়াল করে দাঁড়া। মাইরি মানুদি, তোমার সামনে বলতে লজ্জা করছে…
লজ্জা থাক। পরে করিস। তারপর কী হল বল?
আপন গড, আমার অবস্থা তখন সিরিয়াস। জনের যা হাবভাব, কথা না শুনলে আমাকে মাইরি স্ট্যাব করবে। এদিকে পেছনের পাশে ফাঁকা মাঠ। তার মধ্যে জন লড়ে যাচ্ছে আর খালি বলছে, স্কুটায় স্ট্যান্ড করিয়া পা দুটো ধর না রে শালা! তখন আমি পাদুটো ধরে রইলুম। আর জন…
বুঝেছি। তারপর কৃষ্ণা চিৎকার করছিল না? কী বলে চিৎকার করছিল।
অত শোনার খ্যাল ছিল না মাইরি। সিচুয়েশান বুঝতে পারছ না মানুদি?
পারছি। তবু?
কী সব গোঁ গোঁ করে দাদা—দাদা করছিল। আর হ্যাঁ, তোমার নামেও—মানুদি মানুদি করছিল। তারপর মাইরি, কী যেন, বলল একটা—জন ওর হাতদুটো দুপাশে মাটিতে চেপে রেখেছিল, শুনেই হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে গলায় হেভি পেষাই দিল। বিলিভ মি মানুদি, গা কাঁপছে। রোয়া কিরকির করছে দ্যাখো। ই—ই—ইস।
পল্টুর চোখদুটো গুগলি। এখন গোল হয়ে ঠেলে উঠেছে। মানু দেখতে দেখতে বলল, হুঁ। বল।
পাদুটো হঠাৎ খুব জোরে নাড়াতে লাগল। আমি জুতো দাবিয়ে ধরে রাখলুম তখন। হাতে তো ধরেই রেখেছি তখন থেকে। কিন্তু তখনও তো বুঝিনি জন শালা মার্ডার করছে। একটু পরে পাদুটো আস্তে আস্তে নেতিয়ে গেল। জন তখনও পেটের ওপর বসে আছে। গলায় হাতদুটো চেপে রেখেছে। গোটাগতক দড়বড় করে যেই পড়েছে, আমি ছেড়ে দিয়ে স্কুটারে চাপলুম। তখনও বললুম, ছেড়ে দে না রে! পালিয়ে আয় না! জন শালা জবাবই দিল না। আমি শিলপড়ার মধ্যে স্কুটার নিয়ে পালিয়ে এলুম। তারপর আর জনের সঙ্গে দেখা হয়নি। ব্যস!
পল্টু ফোঁস ফোঁস করে শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলতে থাকল। একটু চুপ করে থাকার পর মানু বলল, জন কোথায় ব্যান্ডেজ নিয়েছিল জানিস?
বাবার কাছে। আবার কার কাছে? রাত্তিরে বাবা বললেন, জন কার সঙ্গে মারামারি করেছে রে পল্টু? বললুম আমি কেমন করে জানব। আমি ওর সঙ্গে ছিলুম নাকি?
মানু একটা চাপা এবং কাঁপা—কাঁপা নিশ্বাস ফেলে বলল, টিটেনাস নিয়েছিল জানিস?
পল্টু মাথা দোলাল। বাবাকে জিগ্যেস কোরো। বলবে। কিন্তু তোমার দিব্যি মানুদি, এসব কথা যেন বলে দিয়ো না। তোমার পায়ে ধরি মানুদি।
সে মানুর হাটুঅব্দি দু’হাত নামালে মানু হাতদুটো ঠেলে দিয়ে বলল, তুই ছুঁসনে তো আমাকে। ঘেন্না করছে তোদের।
পল্টুর গুগলিচোখ ফের জ্বলে উঠল। …যদি বলো, বলবে। পুলিশ ধরবে। আমি কিন্তু তোমার ভাইয়ের কথা ফাঁস করে দেব। আমার কী হবে? আমি তো কিছু করিনি।
তুই ওকে হেল্প করেছিস। তোকেও জেল খাটতে হবে।
পল্টু ফিক করে হাসল।
দাঁত বের করছিস যে?
বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পল্টু বলল, আমার ঘণ্টাটি হবে। আমি রাজসাক্ষী হয়ে যাব।
মানু চমকে উঠে বলল, তুই কীভাবে জানলি, রাজসাক্ষী হয়ে গেলে জেল হয় না?
পল্টু তেমনি কানঅব্দি হেসে বলল, বাবা নাড়ু মোক্তারের সঙ্গে কনসাল্ট করে এসেছে না?
মানুর বুক কাঁপতে থাকল। আস্তে বলল, তুই তাহলে অঘোর জ্যাঠাকে সব বলেছিস?
না বললে চলে? যদি ফেঁসে যাই? আফটার অল মাথার ওপর গার্জেন যখন আছে, তখন তাকে বলতে হবে না—এমন সিরিয়াস জিনিস? পল্টু চিবুকের নুর চুলকে ফের বলল, মাইরি, তুমিও বড্ড চালাক মানুদি। ট্রিপস মেরে আমার কাছে কথা আদায় করে নিলে। জনের কাছে অলরেডি সব জেনে বসে আছ বাবা!
মানু মাথা দোলাল। চোখের পলক দ্রুত হয়ে উঠেছে। খাটের গদি দুপাশে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে বসে আছে সে।
পল্টু বলল, বাবা তোমার কাছে আসতে পারে গো মানুদি! কনসাল্ট করবে বলেছিল। কোনো সোর্সে জানতে পেরেছে—পুলিশ অলরেডি জেনে গেছে, ঝড়ের সময় মোটরসাইকেল নিয়ে কারা দুজন তাড়া করেছিল মেয়েটাকে। বাবা বলল মোটরসাইকেল মনে করলেই সেইফ। স্কুটার বলে জানতে পারলে ফ্যাচাং বাধবে।
তারপর পল্টু কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলল, ছাড়ো। খুব হল। চেপে যাও।
মানু জবাব দিল না। ভাবছিল, অঘোর ডাক্তার এত নির্বোধ হল কেন? ভেতরে ভেতরে এতখানি করে বসে আছে ছেলেকে বাঁচাতে। মানু দেখছিল, জনের আড়ালটা ক্রমশ যেন নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে।
এই মানুদি! মুখ ব্যথা হয়ে গেছে মাইরি। চা—ফা খাওয়াও না!
ভাগ! কোথায় যেন যাচ্ছিলি বাবার কাজে। যা না।
তুমি মাইরি বড্ড ঠ্যাঁটা। ভারি এককাপ চা খেতে চাইলুম তো… যাও। আর কক্ষনো আসব না তোমাদের বাড়ি। আসতুমও না পিসেমোসার গান শুনে ভালো লাগল, তাই।
মানু খাট থেকে নামতে ধূপ শব্দ হল। বলল, হুঁ, তুই গান শুনেই এসেছিলি। এসেছিলি বাবার হুকুমে জন আছে নাকি দেখতে। তোদের মতলব কী রে? জনকে ধরিয়ে দিবি?
পল্টু অবাক হয়ে তাকাল।…সে কথা পরে। মানুদি, তোমার ভাইকে তাহলে তুমি সাপোর্ট করো?
তোর বাবা যে তোকে সাপোর্ট করছে, তার বেলা?
আমি তো কালপিরিট নই।
না। তুই ধোয়া তুলসী পাতা। বাবাকে বলগে, গঙ্গাজলে ধুয়ে তাকে তুলে রাখুন।
এই! মাইরি তুমি বড্ড বেসি—বেসি বলছ মানুদি।
বেশ করছি। যা পারিস করিস তোরা। বলগে বাবাকে।
পল্টু গুগলি চোখে আগুন নিয়ে তাকিয়ে থাকার পর বেরিয়ে গেল। মানু বারান্দায় গেল। গোঁসাই কলতলার পাশে পায়খানায় ঢুকেছেন। নীচের ধাপে চটিজোড়া রয়েছে। হাবলের মা ছাইমাখা বাসনগুলো বিরাট প্লাস্টিকের গামলার জলে আপন মনে ধুচ্ছে। ঘুরে বলল, অ দিদি! খালধারে ঘুরে এসো গে। আসার সময় দেখলুম ভৈরব বড়ো বড়ো ট্যাংরা এনেছে। ঝিলে ভোরবেলা আজ খুব মাছ ধরেছে শুনলাম।
মানু আনমনে বলল, উঁ?
হাবলের মা বলল, কোপারেটি’র হাতে পড়ে মোতিঝিলের খুউব উ—উন্নতি মানুদিদি বুঝলে।
মানু বলল, ঝিলটার নাম মোতিঝিল নাকি? শুনিনি তো!
হ্যাঁ গো। মোতিঝিলই বলে লোকে। উদিকে যাওনি কখনো? ওই যে রেলধারে— সেদিনেতে যেখানে মেয়েটার লাস বেরুল—সেই যে গো…
হ্যাঁ, বুঝেছি।
গোঁসাই পায়খানার ভেতর গলা ঝাড়ছেন। মানুর মনে রাগ। ওই লোকটি তো যত অঘটনের মূলে। গুণী মানুষ। গান—বাজনার জগৎ নিয়ে থাকেন। তাই থাকবেন। তা নয়, একটু কোথাও হুজুগ পেলেই হল। কী কোথায় শুনে রাজ্যজুড়ে যা ছড়িয়ে বেড়িয়েছেন। সময়মতো জানতে পারলে নিষেধ করা যেত। এখন আর উপায় নেই। সব টের পেয়ে যাবেন এবং তারপর তিলকে তাল করে শেষটুকু ঘটিয়ে ছাড়বেন। ভাগ্যিস মা খুব ভোরবেলা জনকে ভয় আর লোভ দেখিয়ে বাড়ির সদরদরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ভোর ছটায় ট্রেন। গোঁসাই সামনে থাকলে জনের প্লাস্টারগুলো দেখে একশো প্রশ্ন করে ছাড়তেন।
গোঁসাই বেরুলে মানু বলল, পিসেমশাই! রূপাদির কাছে আর খোঁজ নিয়েছেন।
গোঁসাই হাতমাটি করতে করতে ধাপে দাঁড়িয়ে বললেন, কীসের বেটি?
বিরক্তি চেপে মানু বলল, ঘরের। আবার কীসের? বলেছিলুম না, রূপাদিদের নীচে একটা বড় ঘর খালি আছে। রূপাদির নিজেরও গানটানে ঝোঁক আছে বড্ড।
আমি আচায্যিপাড়ার জমিদারবাড়িই নেব। ভাবিসনে। বলে গাড়ু হাতে টিউবওয়েলে গেলেন। হাতল টিপতে থাকলেন একহাতে, অন্য হাতে গাড়ুটা কলের মুখে ধরা।
মানু বলল, হোপলেস! আপনি খালি ছায়ার পিছনে দৌড়ুবেন।
গোঁসাই গাড়ুভরা জল নিয়ে উঠোনের নির্মল রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বললেন, আমার চিরকালই ওই রে বেটি। উমদা বাত বলেছিস। আমার সামনে ছায়া। দৌড়ে গেলুম তো, ছায়া ডাইনে গেল। ডাইনে গেলুম তো ছায়া পেছনে গেল। তো এইসাহি ঘুমতে ঘুমতে হম কিতনা দূর চলে আয়ে বেটি! খুদা না করে তো, কোইরোজ উও ছায়াকী সাথ মিল যায়। ঔর মেরা…
তারপর হাসিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, মেরা মৌত হি হো যায়। খুদা হাফিজ। পরোবার দিগার।
মানু রাগ চেপে মনে মনে বলল, লখনৌর কালোয়াত! হঠাৎ কোত্থেকে এসে আপদের মতো এসময়ই জুটে গেল!
গোঁসাই বারান্দায় উঠে ধারে পা বাড়িয়ে গাড়ুর জল ঢালতে থাকলেন। তারপর গাড়ু রেখে কাঁধের তোয়ালে দিয়ে পা মুছলেন। তারপর বললেন, জানিস? আর একটা জায়গার কথা আমার মাথায় ঘুরছে ক’দিন থেকে। মনে হয় রাজি হয়ে যাবে।
মানু আনমনে বলল, সে কোথায়?
শ্রীমান ননীর বাড়িটা। বুঝলি? ওকে আমি কিছু বলিনি এখনও। ওর তো দুটো ঘর দরকার নেই। দেখে এসেছি। বোনের ঘরটায় তালা দিয়ে রেখেছে! বলব, এতে বোনের আত্মারই শান্তি হবে। আহা! বড্ড নেশা ছিল সংগীতে। ওর হত! বুঝলি বেটি? বাঁচলে ওর হতই। গোঁসাই জিভ চুকচুক করে ফের বললেন, শ্রাদ্ধশান্তিটা যাক। তারপর ননীগোপালকে বলবখ’ন। মনে হচ্ছে হয়ে যাবে গুরুজীকী কিরপাসে।
মানু বলল, না।
না? গোঁসাই তাকালেন। মুখটা একটু করুণ দেখাল।
মানু ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল। বলল, না। ওকে ওসব বলবেন না।
কেন রে বেটি?
মানু জ্বলে উঠল।….আপনি সংসারী মানুষ নন, এসব সেন্টিমেন্ট আপনি বুঝবেন না। ননীদা ভীষণ রেগে যাবে। দুঃখ পাবে। কক্ষনো ওকে ওসব রিকোয়েস্ট করবেন না যেন।
তুই বলছিস?
হ্যাঁ।
আচ্ছা। বলে দুঃখিতভাবে গোঁসাই ঘরে ঢুকলেন।
উঠোনের কোনায় তোলা উনুনে ঘুঁটে আর কয়লা সাজাতে গেল হাবলের মা। মানু বলল, থাক। কুকারেই রেঁধে নেব আজ। তুমি এক কাজ করো। বাজারটা এনে দাও।
বাইরের ঘরের ভেতর থেকে গোঁসাই বললেন, মানু বেটি! দুপুরে আমার নেমন্তন্ন আছে এক জায়গায়।
মানু বলল, আচ্ছা।
সে হাবলের মাকে বাজারের থলে দিয়ে পয়সা আনতে ঢুকল ঘরে। বালিশের তলা থেকে মানিব্যাগ বের করে হঠাৎ থেমে গেল। নিজেই যাবে নাকি? অঘোরবাবুর কাছ হয়ে যাবে? ব্যাপারটা জানা দরকার। যা নেমকহারাম মানুষ, মানুর বাবা তাকে জেল থেকে বাঁচিয়েছিলেন, ভুলেও সেকথা মনে রাখার পাত্র নন। হয়তো ভেতর ভেতরে জনকে ফাঁসিয়ে নিজের ছেলেকে বাঁচাবার আয়োজন করছেন।
এসময় কয়েক সেকেন্ডের জন্য ননীর মুখটা মনে পড়ল মানুর। মনটা নাড়া দিল। এবং তারপর ক্রমাগত চকিত ঝিলিকের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে কথা তার স্নায়ুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে থাকল। ননী না জন…কাকে সে রাখবে? ননীকে সে ভালোবাসে। ননীকে ভালোবাসার তরল ও কোমল সেই ভাবাবেগ দিনে দিনে সমুদ্রের ফেনা যেভাবে কঠিন হয়ে ওঠে, তেমনি কঠিন হয়ে বুকের ভেতর আটকে আছে। আর জন তার ভাই। জনের সঙ্গে সে বেড়ে উঠেছে এবাড়িতে। কত সুখ—দুঃখের স্মৃতি আছে। ঘৃণা যদি বা থাকে, অন্ধ স্নেহ তো কম নেই—তার মায়ের মতো। আর সত্যি কি জনের মাস্তানি পরাক্রমে মানু মনের গোপনে গর্ব অনুভব করে না? মানুর ছোটবেলা থেকে বাইরে ঘোরাঘুরির অভ্যাস আছে। ছাত্রীজীবনে এবং তারপরও মাঝে মাঝে তার কোথাও অসম্মান ঘটলে সে জনের কানে তুলেছে। জন শায়েস্তা করে এসেছে প্রতিপক্ষকে। কলেজের গেটের পাশে প্রায়ই কয়েকটি ছেলে গিয়ে আড্ডা দিত। মেয়েদের দেখে মাস্তানি করত। মানু জনকে বলেছিল। তখন জনের বয়স আর কত? আঠারোর বেশি নয়। জন তার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে গিয়ে একদিন সবকটাকে বেদম পিটিয়ে এসেছিল। তারপর ওরা আর ওখানে ভুলেও পা দিত না।…
আর মা! জনের কিছু ঘটলে মা সইতে পারবেন না। ভীষণ কষ্ট পাবেন। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেবেন। বাবার মৃত্যুর পর থেকে মা কীভাবে যে ভাইবোনকে বড়ো করে তুলেছেন, কত ঝড়ঝাপ্টা গেছে—ফোটো স্টুডিয়োর পার্টনার রথীশবাবু তো সব আত্মসাৎ করে দিতেন, একদিকে জন অন্যদিকে মা হাঁটাহাঁটি ছোটাছুটি করে সব বাঁচিয়ে এনেছিলেন। বদমাশ রথীশবাবু অক্ষয়বাবুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেও আদালতের ইনজাংশন জারি করিয়ে ছেড়েছিলেন। তখন বড় কষ্টের দিন গেছে। খাওয়ার কষ্ট, পরার কষ্ট। ভাইবোনের স্কুলের মাইনে বাকি। বইপত্তর কেনা যায় না পর্যন্ত। সেই অছিলায় তো জনের আর পড়াশুনা হল না। এদিকে সুপ্রভা নিজে না খেয়ে ছেলেমেয়েকে খাইয়েছেন। নিজে পুরনো শাড়ি পরে পুজোয় ওদের নতুন পোশাক কিনে দিয়েছেন। সুপ্রভার স্নেহের তুলনা নেই। মানু তো আজকালকার মা দেখছে। তাঁরা কেউ তার মায়ের মতো নন বলে তার ধারণা। এই যে সুপ্রভা জনের ক্ষতচিহ্ন দূরে নিরাপদে সারিয়ে তুলতে গেছেন, মানু জানে—প্রতিমুহূর্তে মেয়ের জন্য তাঁর অস্বস্তির শেষ নেই। দু’দিন অন্তর চিঠি আসছে ডাকে। কী ঘটছে ইশারায় সেই প্রশ্নে ভরা প্রত্যেকটি চিঠি।
মানু ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, হাবলের মা। থাক গে! তোমাকে যেতে হবে না। আমিই ঘুরে আসি। কাজ আছে একটু। গোঁসাইপিসে বেরুলে তুমি দরজা আটকে দিয়ো। কেমন?…