কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি – ১

রাস্তার বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে ননী আনমনে সিগারেট টানছিল।

কাল রাতে এখানেই ইসমিলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ননীর। কর্তার সিং গ্যারেজের পিছন ঘুরে রাস্তাটা এখানে রেলইয়ার্ডের পাশে—পাশে স্টেশন অব্দি এগিয়ে গেছে। দুধারে টানা জঙ্গল। অরণ্য নয়, নেহাত ঝোপঝাড় আর কিছু উঁচু—নিচু গাছ। দিনে তার ভেতর কদাচিৎ দু—একটা খেয়ালি গাধা কিংবা হাড়কুড়ানো মাঝি—মেঝেনের দেখা মেলে। রাতের বেলা রেল ইয়ার্ডের উঁচু খাম্বা থেকে দুধের মতো সাদা আলো ছড়ায়। তাতেই রাস্তাটা আলো পায় যেটুকু। মিউনিসিপ্যালিটির বাল্বগুলো কবে উপড়ে নিয়ে গেছে চোরেরা। জংধরা খাম্বার মাথাগুলো মড়ার মাথার মতো ভূতুড়ে দেখায়। সার সার কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে স্টেশন অব্দি।

ননী রোজ রাত দশটা নাগাদ এই রাস্তায় টিউশনি করে বাড়ি ফেরে। সে বোঝে, মিউনিসিপ্যালিটির কিপ্টেপনার প্রমাণ এটা নয়। রেলের ছড়িয়ে—ছিটিয়ে খাওয়া থেকে এঁটোকাঁটার মতো যেটুকু আলো মিলছে, তাই যথেষ্ট।

সেই আলোয় সে কাল রাতে ইসমিলকে এই রাস্তায় দেখেছিল। কিন্তু একটুও টের পায়নি ইসমিল কী মতলবে ওখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। সে স্কুলে ননীর ক্লাসফ্রেন্ড ছিল। দেখা হলে হেসে কথা বলত। পরে সে দপ্তরির দোকান খুলেছিল। ননী মাঝে মাঝে তার কাছে বইপত্তর বাঁধিয়ে নিত! নিজের স্কুলেরও কিছু কিছু কাজ পাইয়ে দিত।

কাল রাতে ননী যখন সাইকেলে আসছে, ইসমিল একটু হেসে শুধু বলেছিল—টিউশনি করে? ননী মাথা নেড়ে পালটা একটু হেসে চলে এসেছিল।

এখন মনে হয়, ইসমিলের চেহারায় কিছু টের পাওয়া উচিত ছিল। চাহনি বা গলার স্বরে কোনো অস্বাভাবিকতা অন্তত। কর্তার সিং গ্যারেজের অন্যপাশে খালের ধারে ধাঙড়—বস্তির লোকেরা ভোরবেলা তাকে গাব গাছের ডালে ঝুলতে দ্যাখে। জিভ বেরিয়ে গেছে। চোখ বেলুনের মতো ঠেলে উঠেছে। প্যান্ট থেকে তলায় মাটি অব্দি পেচ্ছাব পায়খানায় নোংরা হয়ে আছে। একটা সুস্থ প্রাণ শেষ হতে এত কষ্ট! ননী খুব ভয় পেয়ে গেছে। এতদিনে মনে হত, হঠাৎ কোনো কারণে প্রাণটা যদি যায়ই, যাবে—সে ভয় পাবে না। এখন খালি ভাবছে, নিজের হাতে যাক বা অন্যের হাতে যাক হঠাৎ বেমক্কা প্রাণ যাওয়াটা ভয়ংকর আর যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার।

বাড়ি ফিরে এলে কৃষ্ণা বলল—কী হয়েছে রে দাদা।

—কী হবে! বলে ননী বারান্দার চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাল। সাড়ে নটা বেজে গেছে। কৃষ্ণা কাঁধে তোয়ালে, শায়া, পাটকরা শাড়ি আর হাতে সাবানের কৌটো নিয়ে উঠোনে নামল। উঠোনের কোনায় ছাদবিহীন স্নান ঘর। স্নান করে খেয়েদেয়ে কলেজে বেরিয়ে যাবে। তার একটু পরে ননী স্কুলে বেরুবে। বাড়িতে কেউ থাকবার নেই। ঘরে—বাইরে কয়েকটা তালা আটকানো থাকবে। ডুপ্লিকেট চাবির গোছা আছে দুজনেরই।

কৃষ্ণা স্নানঘরের দরজায় ঘুরে ফের বলল—তোকে কেমন যেন দেখাচ্ছে দাদা।

ননী শুকনো হাসল। —ভাগ।

কৃষ্ণা জানে না, ননী ইসমিলের মড়া দেখতে গিয়েছিল। কৃষ্ণা আরও অনেকে কিছু জানে না ননীর। যেমন এই অদ্ভুত ব্যাপারটা। বরাবর ননীর জীবনে এমনটা ঘটে আসছে। কোনো ঘটনার চরম পরিণতির ঠিক আগের মুহূর্তে কীভাবে ননী সেই ঘটনার পাশ দিয়ে চলে যায়! নির্বোধের মতো। নির্লিপ্তের মতো।

একবার রেলইয়ার্ডের ওখানে একটা বলের মতো জিনিস পড়ে থাকতে দেখেছিল। একটু থমকে দাঁড়িয়েও ছিল ভালো করে দেখার জন্যে। তারপর কয়েক পা এগিয়েছে, একটা ধাঙড়দের ছেলে দৌড়ে গিয়ে বলটায় কিক করল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দ হল। ধোঁয়া আর বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়াল।

ধাঙড়দের ছেলেটা পরে হাসপাতালে মারা যায়। ননী সেবার মনে—মনে খুব কষ্ট পেয়েছিল। বিবেকে ঘা লেগেছিল। বোমাটা সম্পর্কে তার উদাসীনতার কোনো অর্থ হয় না। ভালো করে দেখা উচিত ছিল।

আর একবার বাস—স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। দূর পদ্মা সীমান্তের দিকে একটা বাস ছেড়ে গেল। আগাপাছতলা লোক আর জিনিসপত্রে বোঝাই বাসটা অকারণ তাকিয়ে দেখছিল সে। বাসটা রাধুবাবুর পেট্রলপাম্পে ঢুকে তেল নিল। তারপর এগিয়ে গিয়ে চওড়া হাইওয়েতে পড়ল। হাউসিং কো—অপারেটিভের আড়ালে চলে না যাওয়া—অব্দি ননী তাকিয়ে ছিল।

পরে বাসটা খাদে পড়ে অনেক হতাহতের খবর এসেছিল। ননী সেবারও শিউরে উঠেছিল। না, এ ব্যাপারে তার কোনো ইনটুইশান নেই। খালি মনে হয় চরম পরিণতির আগের একটা জায়গায় কীভাবে যে তার চোখ পড়ে এবং সে এক গোপন সাক্ষী থেকে যায় যেন!

খুঁজতে গেলে এমন ঘটনা তার জীবনে অজস্র আছে। ইসমিলের আত্মহত্যার পর সেগুলো মগজে কিলবিল করে উঠেছে। ঘুলিয়ে তুলেছে সমস্ত স্মৃতিকে। দাঁতের ফাঁকের ময়লার মতো। একটা খুঁচিয়ে সাফ করার পর সবগুলো খোঁচাতে ইচ্ছে করে। থুথু ফেলে ননী ভুরু কুঁচকে আকাশ দেখতে থাকল। মনটা তেতো।

শীতের মাস কবে চলে গেছে। আজকাল দুপুরের দিকে রোদের তাপ বাড়ে। শেষ রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে। ভোরবেলা কোনো কোনো দিন ঘন কুয়াশা এসে ঢেকে ফেলে শহরটাকে। পশ্চিমের নদী থেকে পুবের রেলইয়ার্ড অব্দি গাঢ় কুয়াশার ভেতর মানুষজন আর যানবাহনের সব শব্দ ভারি রহস্যময় মনে হয় ননীর। হাফপেন্টুলপরা বয়সে সেই কুয়াশার সুযোগ ননী আর কৃষ্ণা জজসাহেবের বাগান থেকে ফুল চুরি করতে যেত। বাবা তখন গঙ্গাস্নানে বেরিয়ে গেছেন। ফিরে এসে ফুল দেখে যত খুশি হতেন, তত রাগও দেখাতেন। এ বয়সে তোরা আমায় হাতকড়া না পরিয়ে ছাড়বিনে দেখছি। ছি ছি! এ যে তস্করবৃত্তি! সংস্কৃতের পণ্ডিতমশাই ছিলেন বাবা। বিশুদ্ধ বাংলা বলাটা কালচার মনে করতেন। সেই স্কুলে তাঁর ছেলে ননী এখন বিজ্ঞান পড়ায়। বাবার মতো সেও যে টাকার অঙ্কের পাশে সই করে, তার তিন ভাগের দু’ভাগ পায়।

কৃষ্ণা বেরিয়ে এল চুলে তোয়ালে জড়িয়ে। দাদা! আজ কাট করবি নাকি রে?

ননী বলল, কেন?

দশটা বাজতে চলল। তাড়া নেই!

ননী একটু দুলতে দুলতে বলল, যাচ্ছি। ফার্স্ট পিরিয়ডে আজ ক্লাস নেই। পুঁটি, ফেরার সময় একবার মানুর ওখান হয়ে আসবি?

কৃষ্ণা মুঠো তুলে বলল, তুই ফের আমায় পুঁটি বলছিস! আমি তোকে যদি বুড়ো বলি?

ননী হাসল। বল না। বুড়ো তো হয়েই গেছি। দেখ না, বুকের লোম পেকে গেছে।

কৃষ্ণা চোখ নাচিয়ে বলল, তাহলে আর মানুদির ওখান হয়ে বলছিস কেন? তোর চান্স নেই?

ননী আনমনে বলল, কীসের?

প্রেম করার। আবার কীসের? বলে কৃষ্ণা উঠোনের তারে ভেজা শাড়ি মেলতে থাকল।

ননী বোনের এসব স্পষ্টভাষিতায় রাগ করে না। বোন কেন, কৃষ্ণা তার বন্ধুও। বয়সে ছ’বছরের তফাতটা ক্রমশ দুজনেই ভুলে গেছে। মা তো কৃষ্ণার দশ বছর বয়সেই মারা গেছেন। তার বছর খানেক পরে বাবাও স্ট্রোকে মারা গেলেন। তারপর থেকে দিনে দিনে ভাইবোনে সংসারের লড়াইগুলো লড়ে যাচ্ছে সমানে। সেই লড়াই ওদের ক্রমশ বন্ধু করে তুলেছে। পরস্পরের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থেকেছে দুটিতে। আর কৃষ্ণা একটু হঠকারী, স্পষ্টভাষী। যাকে বলে ঠোঁট—কাটা মেয়ে। মুখের ওপর কড়া কথা বলতে ওস্তাদ। তার ন্যায়—অন্যায়বোধ ভারি কড়া। কিন্তু দাদার প্রতি আচরণে ঠিক কোথায় থামতে হবে সে জানে। তেমনি ননীও সেটা জানে।

কৃষ্ণা বারান্দায় উঠে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, মানুদির ওখানে কী রে দাদা?

ননী প্রেম করার কথাটা শুনেছে। আমল দেয়নি। বলল, হতচ্ছাড়ী! তোর নিজের ব্যাপারেই। মানুর…..

অভ্যাসমতো কৃষ্ণা নাচানাচি করে হাত নাড়তে নাড়তে বলল, মানুদির কাছে আমার কোনো ব্যাপার নেই। সব ব্যাপার তোমার। ওর কাছে আমায় যেতে বলো না বাবা। আমি কারও দূতী হতে পারব না। হংসদূত, মেঘদূত—কত দূত আছে। কাকেও পাঠাও।

ননী এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল, আঃ! মাঝে মাঝে বড্ড বাড়াবাড়ি করিস তুই। কথাটা শুনবি তো কী বলছি! খালি আবোল—তাবোল করে।

কৃষ্ণা গ্রাহ্য না করে নাকে কান্নার সুরে বলল, না না! অনেক ঘুরে যেতে হয় ওদের বাড়ি। সন্ধ্যা হয়ে যাবে। সেই কোথায় মদনমোহনতলা! ওরে বাবা! খাল পেরিয়ে তবে! আর তোমার মানু যা জিনিস। বাপস!

আহা, রিকশো করে যাবি। রিকশো করে চলে আসবি। ননী বলল। তোদের কলেজ থেকে জাস্ট টেন মিনিটসের বেশি নয়। পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ড হয়ে নাক বরাবর হাঁটলে তো ওনলি থ্রি মিনিটস। মানুর পিসেমশাই এসেছেন শুনলাম। তুই বলে আসবি….

কথা কেড়ে কৃষ্ণা বলল, হুঁ! মানু বাদ গেল, এবার তার পিসেমশাই! নে ঝটপট বল। আমি শুনতে শুনতে ভাতটা বেড়ে আনি।

বারান্দার শেষ দিকে ঘুরে লাগোয়া কিচেন। সামনে একটুখানি ডাইনিং স্পেস আছে। বাবার আমলে পিড়িতে বসে খাওয়াদাওয়া হত। এখন সস্তা কাঠের চেয়ার—টেবিলে কেনা হয়েছে। ননী বলল, মানুর পিসেমশাই ফেমাস লোক রে পুঁটি! ক্লাসিক সং—এ খুব নাম আছে। রেডিয়োতে গান ভদ্রলোক। নাম শুনেও থাকবি।

ভেতর থেকে কৃষ্ণা বলল, কী নাম বলো তো? এবার তার গলায় একটু আগ্রহ টের পাওয়া যাচ্ছে।

ননী বলল, ফেলানাথ গোস্বামী। ফেলু গোঁসাই বলে সবাই।

কৃষ্ণার সাড়া এল। হুঁ বলে যা। আই হ্যাভ মাই ইয়ারস।

মানুর সঙ্গে কথা হয়ে আছে। উনি কবে থেকে আসতে পারবেন, জেনে আসবি। মানুই তোর হয়ে সেটল করবে। বুঝলি তো?

কৃষ্ণা ভাতের থালা এনে টেবিলে রেখে মিষ্টি হাসল। ….তুমি আমার যথার্থ শুভাকাঙ্ক্ষী গার্জেন, দাদা। দণ্ডবৎ হই। তারপর চেয়ারে বসে ভাত মাখতে মাখতে ফের বলল, হ্যাঁ রে দাদা, সারেগামা করবে নাকি? তাহলেই গেছি। তাহলে কিন্তু আরও অনেকগুলো গাধার মৃত্যু হবে।

ভাই—বোন খুব হাসতে লাগল। প্রথম তানপুরা কেনার পর ননীই কথাটা বলেছিল। দেখিস পুঁটি শহরের গাধাগুলো যেন ঈর্ষায় স্যুইসাউড না করে। কিন্তু কৃষ্ণার গলাটা সত্যি সুরেলা। বেশ কিছুদিন একটা ক্লাবের মিউজিক সেন্টারে যাওয়া—আসা করেছিল। রবীন্দ্র—নজরুল আর তার সঙ্গে কিছু ক্লাসিক। উৎসাহের চোটে ননী একজোড়া তবলাও কিনে ফেলেছিল—বোনের সংগত করবে। কিন্তু ননীর এটা লাইন নয় নিজেই কতকটা বুঝে গেছে। শোভন নামে একটা ছেলে ফাংশনে ভালো বাজায়। তাকে দিনকতক ডেকে এনেছিল। পরে ননীর খটকা লাগল, শোভন কৃষ্ণার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে থাকে। আর একদিন কৃষ্ণাও বলেছিল, ছেলেটা বাজে। ওকে দরকার নেই; তারপর থেকে ননীর এই এক সাধনা, কৃষ্ণার সংগত না করে ছাড়বে না। তা বলে সে এ ব্যাপারে এমন আলসে যে কারুর কাছে তবলা শিখতে পা বাড়ানোর পাত্র নয়। ধুর ধুর! তার আরও কত কাজ আছে। টিউশনি আছে। বরং তবলা শিক্ষা বই কিনে এনে খুব মন দিয়ে লেগে থাকলেই হল। কৃষ্ণার তবলচি তাকে হতেই হবে!

এখন একথাটা মনে এসেও ননী হাসছিল। নিজের স্বভাব ও ক্ষমতার যতখানি সে আন্দাজ করে, তাতে সে বুঝেছে ব্যাপারটা ছেলেখেলার শামিলই হচ্ছে। অথচ কৃষ্ণা গাইবে এবং তার সংগত অন্য কেউ করবে, এটা যেন তার পছন্দই নয়।

কৃষ্ণা বলল, ফেমাস হলে তো অনেক টাকা চাইবে রে দাদা। তাই না?

নাঃ। ননী উঠে দাঁড়িয়ে ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল। মানু নিজেই তো কথাটা তুলেছিল। গিয়ে দেখবি, ও সেটল করে দেবে। তুই আবার আগ বাড়িয়ে কিছু কমিট করিসনে।

দাদা! জলটা ঢেলে দিবি?

ননী তাকাল। ফের খালি প্লাস নিয়ে খেতে বসেছিস? তুই কবে কেলেঙ্কারি করবি মাইরি! সে ব্যস্ত হয়ে এগোল। টেবিল থেকে প্লাসটা নিয়ে কোনার টুলে রাখা কুঁজো থেকে জল গড়াল। কৃষ্ণার সামনে রেখে ফের বলল, দিস ইজ ভেরি ডেঞ্জারাস হ্যাবিট কিন্তু। তোকে আমি অনেকগুলো ইনসিডেন্ট বলেছি।

ইনসিডেন্ট বলোনি। বলে কৃষ্ণা এক ঢোক জল খেল। অ্যাকসিডেন্ট। তবে ভেবো না আমার পরমায়ু প্রচুর। কত বেশি খাই আমি! সুতরাং গলার ফুটো হাইড্রেনের মতো চওড়া। কিছু গলায় আটকে আমার মৃত্যু নেই।

কৃষ্ণা হাসতে লাগল। ননী ধমক দিয়ে বলল, তুই মাইরি বড্ড বাচাল। কম বয়সেই পেকে ঝুনো। তারপর সে ঘরে প্যান্টশার্ট ছাড়তে গেল।

একটু পরে ননী টের পেল, সে আন্ডারওয়্যার পরে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর শরীরে কেমন একটা নিস্তেজ অবস্থা—রাতে জ্বর এসে ভোরের দিকে ছেড়ে যাওয়ার পর ঠিক যেমনটি লাগে। জিভে কটু স্বাদ। ডগাটা খরখর করছে। এই এক—দেড় ঘণ্টা হয়তো বেশি সিগারেট খাওয়া হয়ে গেছে বলেই। মনে হচ্ছে, স্নান করতে যাবার আগে ফের ঠোঁটে একটা সিগারেট থাকলে ভালো হয়।

বাইরে কৃষ্ণার আঁচানোর শব্দ হচ্ছিল। তারপর সে পাশের ঘরে ঢুকেছে। আর কয়েক মিনিট কোনো সাড়া শব্দ নেই। ও ঘরেই কৃষ্ণা থাকে। বছর পাঁচেক আগে হঠাৎ এক ভোরে ননী আবিষ্কার করেছিল, কৃষ্ণা বস্তুত মেয়ে এবং তার জীবনের কিছু গূঢ় গোপনতার ব্যাপার থাকবে। সে খুবই অপ্রস্তুত হয়েছিল। আর কৃষ্ণাও লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে বয়স্ক মেয়েদেরই গারজেনের ভূমিকা থাকে। কিন্তু বাড়িতে আর কেউ নেই ভাইবোন ছাড়া। সেদিন ননী দুঃখের সঙ্গে জেনেছিল, আজ থেকে যেন দুজনে দুটো আলাদা ও সমান্তরাল পথে হাঁটতে থাকল। আর কৃষ্ণার মুখের থমথমে ভাবটা লক্ষ্য করার মতো। ইচ্ছে করেই ননী একটু তফাতে সরে থাকছিল। কৃষ্ণা বিছানার চাদর—টাদর গুটিয়ে ভারি মুখে স্নানঘরে যাচ্ছে, এই ছবিটা ননী ভুলতে পারে না। খালি মনে হয়, প্রকৃতি মেয়েদের ওপর অত নিষ্ঠুর কেন? পদে পদে অপমান করে ছাড়ে।

তবে আলাদা ঘরে শোবার কথাটা আরও কয়েকটা দিন পরে উঠেছিল। তুলেছিল কৃষ্ণা নিজেই। দাদা, আমি রোজ রাত জেগে ঘ্যানরঘ্যানর করি, তোর ঘুমোতে ডিস্টার্ব হয়। তুই পাশের ঘরে শুলেই পারিস।

ননী ঠিক এটাই চেয়েছিল। প্রকৃতির চ্যালেনজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তবু যেন মানুষের হার মানতে ইচ্ছা করে না। একটু হেসে ননী বলেছিল, ডিস্টার্ব আবার হয় না? ভীষণ হয়। কিন্তু তোর যে বড্ড ভূতের ভয়। একা শুতে পারবি তো?

এখন মনে হয় মেয়েদের সঙ্গে প্রকৃতির গোপন যোগসাজস আছে। কিংবা ওরা প্রকৃতির খেলার পুতুল। কৃষ্ণা হেসে ও চোখ পাকিয়ে বলেছিল, বাজে বলিস নে। কে ভূতের ভয়ে গোঁ গোঁ করে সারা রাত? কে জাগিয়ে দ্যায় শুনি?

কথাটা ঠিক। ননী এখনও এ বয়সেও প্রায় রাতে ভূতের স্বপ্ন দ্যাখে।

কী ভাবে টের পায় ভূতটা স্বপ্নেরই এবং সে জেগে ওঠার চেষ্টা করে। যথাশক্তি চেঁচিয়ে কৃষ্ণাকে ডাকে। জিভ আর শরীর নিঃসাড় বলে মনে প্রচণ্ড ছটফটানি চলতে থাকে। তারপর সে জাগে বটে, কিন্তু বেশিক্ষণ ভয়—ভয় ভাবটা থেকে যায়। সুইচ টিপে ল্যাম্প জ্বেলে রাখে। সিগারেট খায়। এমনও হয়েছে, অনেক রাতে কৃষ্ণা পাশের ঘর থেকে সাড়া দ্যায়। দাদাকে ডাকে। এক রাতে সে উঠে এসে দাদার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়েও জাগিয়েছিল। তারপর থেকে ননীর অবচেতনায় একটা লড়ুয়ে ভাব থেকে গেছে। নিজের ভয় পাওয়ার সঙ্গে নিজেরই সাহসের লড়াই। কিন্তু ভূতের স্বপ্নে ভরা ঘুমটা ভাঙার পর রাতে ননীর মনে হয়েছে, আসলে ছেলেবেলাটাই মানুষের জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়। সবচেয়ে নিরাপদ আর নির্ঝঞ্ঝাট সময়। ভাইবোন পাশাপাশি একই বিছানায় শুয়ে থাকার কথা তার মনে পড়ে গেছে। বাড়িতে দুটো মোটে খাট। দুটো ঘর। বাবা—মা একঘরে একটা খাটে, ভাইবোন অন্যঘরে আরেকটা খাটে। ভয়ের স্বপ্ন দেখে কুঁজো হয়ে পা গুটিয়ে ধেড়ে ননী কচি বোনের দিকে পিঠটা ঠেলে রাখত। ঘুম ভেঙে কৃষ্ণা ছোট্ট হাতে কিল মেরে সরিয়ে দিত। রোজ শোয়ার আগে চ্যাঁচামেচি করে বলত, বুড়ো সারা রাত লাথি মারে মা। আমি কি ফুটবল? ননীর এখন মনে হয়, বাবা মায়ের সঙ্গছাড়া হতে পারতেন না। কী শুতে, বেড়াতে, চলা ফেরায়, সব সময়। যতক্ষণ বাড়িতে থাকতেন, মায়ের কাছাকাছি সারাক্ষণ। আর এলোমেলো কত গল্প। মা বলতেন, কাজকম্ম নেই তোমার? এবার ওঠ তো। কানের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছ খালি। রান্নাঘরে কী কাজ তোমার? বাবা মুখে রাগ দেখাতেন বটে, কিন্তু সেই অভ্যাস যাবে কোথায়? ফের গিয়ে বলতেন, দেখো—পুরো একটা ঝি—চাকরের কাজ আমি করে দিই তোমার। দিইনে বলো? বাজার করা থেকে, তোমার চানের জল তোলা, তরকারি কোটা—কী নয়? অমনি মা তেড়েমেড়ে বলতেন, করবে না কেন? ঝি—চাকর রাখার মুরোদ নেই যার, তাকে তো করতেই হবে।

বিজ্ঞানে বংশগতি বলে একটা কথা আছে। ননী বোঝে, বাবার অনেক স্বভাব, অনেক ছোটখাট অভ্যাস আর শারীরিক ভঙ্গি আস্তে আস্তে তার মধ্যে ফুটে বেরুচ্ছে। ননীর চেহারার মধ্যেও তার বাবার আদল খুব স্পষ্ট। গায়ের রঙ আর গড়ন পর্যন্ত। আর কৃষ্ণা যেন বাবা—মায়ের এক চমৎকার মিশ্রণ, বিজ্ঞানের কথায় কেমিকেল কম্পাউন্ড। মায়ের গায়ের শ্যামলা রঙ, সরু নাক, দুটো ভুরু ও চোখ, ঝাঁঝালো স্বভাব সে পেয়েছে। আবার বাবার বকবকানি, খুঁটিয়ে দেখার মতো দৃষ্টি, অর্থাৎ জোরে হেসে ওঠা কিংবা একটুতেই পাড়া মাথায় করা তার মধ্যে বেশ স্পষ্ট।

ভাইবোনে চেহারার অমিল খুব বেশি। ননীকে সুন্দর বলা যায় টেনেটুনে। কিন্তু সে স্বাস্থ্যবান পুরুষ। কৃষ্ণার মুখে ও শরীরে পুষ্টির অভাব আর যৌবনের স্বাভাবিক লাবণ্যেও বেয়াড়া কী একটা আছে, যা ননীকে রীতিমতো ভাবায়। মা, রেগে গেলে বলতেন, বুড়ো যদি আমার মেয়ে হত! ভুল করে ভাইবোন অদল—বদল হয়ে গেছে। এ মেয়েকে শ্মশানের বুড়োও নেবে না দেখে নিয়ো। যা রূপ আর মেজাজ মেয়ের!

মেয়েরা দেখতে মানানসই না হলেই এমন সব পরিবারের ভেতর—ভেতর বুঝি আক্রোশ দানা বেঁধে থাকে। মাঝে মাঝে ফুটে বেরোয়। ননীর রাগ হত মায়ের ওপর। বোনের প্রতি টানটা এমনি করেই দিনে দিনে বেড়ে উঠেছিল তার। মা তাকে বকলে প্রতিবাদ করত ননী। মা এবং বাবার মৃত্যুর পর থেকে ননীর মনের অনেকটাতে কৃষ্ণা জুড়ে বসেছে দিনে দিনে। কৃষ্ণা খুশিতে হেসে উঠলে ননীর বুক ভরে ওঠে সুখে। বোনের জীবনযাপনকে আনন্দে ভরে দিতে সে যথাসাধ্য করেছে! কৃষ্ণার ঘরে ঢুকলে তার ছাপ তীব্র হয়ে চোখে পড়ে। ড্রেসিং টেবিল, হরেক মেয়েলি প্রসাধন, সুন্দর পর্দা, বিছানার চাদর, বইয়ের সেলফ, দেয়ালের রঙ, একজিবিশনে কেনা ছবি আর কয়েক রকম বাদ্যযন্ত্রে ঘরটা সারাক্ষণ সেজেগুজে আছে। কিন্তু কৃষ্ণার নিজের সাজগোজে অতটা মন নেই। যত মন পড়াশুনোয় আর রান্নাবান্না, ঘরকন্নার খুঁটিনাটি কাজে। সেবার বোকার মতো একসেট লিপস্টিক কিনে এনেছিল ননী কলকাতা থেকে। কৃষ্ণা হেসে ও অবাক হয়ে বলেছিল, তোর কি মাথা খারাপ দাদা? তুই আমায় মেমসাহেব করবি নাকি?

পরে ননী বড্ড অপ্রস্তুত হয়েছিল। সব থাকতে লিপস্টিক কেনার কথাটা তার কেন মাথায় এসেছিল? মুখে অবশ্য সে গাঁইগুঁই করে বলেছিল, তোর বন্ধুরা তো কেউ কেউ লিপস্টিক ইউজ করে দেখেছি রে। করে না? সেই যে সেদিন মেয়েটা এল—সিং সায়েবের মেয়ে।

মুশকিল। ওরা তো খ্রিস্টান। কৃষ্ণা হাসতে হাসতে বলেছিল।

ননী চেপে গিয়েছিল। তবে এ শহরের কলেজটা মিশনারিদের। খ্রিস্টান বা অ্যাংলো—ইন্ডিয়ান কালচার একটু—আধটু এখনও বজায় আছে। ইদানীং উঠতি ধনী কনট্রাক্টর বা ব্যবসায়ীদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা ভীষণ ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে উঠেছে। দেখাদেখি একটু নিচের তলার বাঙালি কেরানি বাড়িতেও হাওয়া লেগেছে। কৃষ্ণার সহপাঠিনীদের কেউ রীতিমতো প্যান্টশার্ট আর ছোট চুল নিয়ে আসে, তারা ওইসব ফ্যামিলির মেয়ে। যেমন পিউ নামে মেয়েটা তার বাবা কট্টর বাঙালি ভদ্রলোক। কিন্তু পিউয়ের আঁটো পাতলুন আর মিনিজ্যাকেটের দিকে তাকাতে ননীর অশালীন লাগে। পেটের পুরোটা, গলার নীচে স্তনের ভাঁজ অব্দি খোলামেলা। ননী বলেও ফেলেছিল—মেয়েটা ভালো না রে। বেশি মাখামাখি করিস নে।

কৃষ্ণা চোখ কপালে তুলে বলেছিল, পিউ? পিউ কে জানিস? রীতিমতো স্ট্যান্ডকরা মেয়ে। পড়াশোনায় স্কলার। তুই কী বলিস দাদা? যাঃ তুই বড্ড সেকেলে হয়ে গেছিস। আজকাল পোশাক দেখে মেরিট জাজ করতে যাসনে। তাছাড়া জানিস পিউ কত ভালো স্প্যানিশ গিটার বাজায়? ভীষণ গুণী মেয়ে।

কৃষ্ণার এই একটা গুণ আছে। ননীর চেয়ে তার বন্ধুভাগ্য ভালো। বলতে কী ননী খানিকটা একলাষেঁড়ে। বন্ধু—বান্ধব তেমন নেই বা সে পছন্দও করে না। কিন্তু কৃষ্ণার মেয়েবন্ধুর সংখ্যা অগুনতি। মাঝে মাঝে এই প্রায় নির্জন চুপচাপ বিষণ্ণ বাড়ি হাসি ও কথায়, রূপের জেল্লায় ভরে ওঠে। কৃষ্ণার ঘরে যেন উৎসব চলতে থাকে। এ ঘরে ননী গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। ব্যাপারটা একবার ভীষণ ভালো লাগে, আবার ভীষণ খারাপ লাগে। কৃষ্ণার একটা আলাদা জগৎ সে দেখতে পায়। অবচেতন ঈর্ষায় ভোগে। ওরা চলে গেলে ননী জিগ্যেস করে—ওরা কারা রে পুঁটি?

কৃষ্ণা চোখ টিপে হেসে বলে, তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিইনে কেন জানিস দাদা? তুই একেবারে লেজেগোবরে হয়ে যাবি।

ননী হাসে। যাঃ!

যাঃ নয় মশাই। তুই তো মেয়েদের দিকে চোখ তুলে কথাই বলতে পারিস নে। বলে কৃষ্ণা ফের চোখ টেপে। …শুধু একজন বাদে।

ননী কিল তুলে বলে, ফের ফাজলেমি দাদার সঙ্গে? ডেঁপো মেয়ে কোথাকার!

বাচাল কৃষ্ণা একটুও ভড়কায় না। বলে, দাদা তোর চয়েস বড্ড বাজে। আমি অ্যাপ্রিসিয়েট করতে পারছিনে, ভেরি সরি।

তারপর চাপা গলায় ফের বলে, এই! আপন গড বলছি, মানুদি আমার বউদি হলে আমার অবস্থা শোচনীয় হবে!

এসব মুহূর্তে ননী নিঃসংকোচ হয়ে ওঠে। হেসে বলে কেন রে? মানুকে অত অপছন্দ করিস কেন?

কৃষ্ণা এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বলে, কেমন যেন চাপা—ভেতরে অনেক কথা থাকে। তাই না?

হুঁ, একটু ইনট্রোভার্ট টাইপ। ননীও সিরিয়াস হয়। তবে খুব ইনটেলিজেন্ট মেয়ে জানিস?

কে জানে বাবা! তোমার ব্যাপার তুমি জানো। কিন্তু যা করবার ভেবেচিন্তে কোরো।

ননী হো হো করে আসে। তুই কি সত্যি ভাবছিস মানুকে আমি বিয়ে করব? তোর কি মাথা খারাপ? নানান কাজে কদাচিৎ এক—আধবার আসে টাসে বলে তুই এসব কী ভাবিস বল তো? যদি সত্যি তেমন কিছু ঘটত, তোর সঙ্গে ফ্রাংকলি আলোচনা করতুম। তোকে তো কিছু গোপন করিনে কৃষ্ণা। বল, করি?

ননী যখন কৃষ্ণা বলে, তখন বুঝতে হবে সে সিরিয়াসনেসের শেষ সীমায় পৌঁছেছে। এসব সময় কৃষ্ণাও যেন টের পায়, তার দাদার ভেতর থেকে এক নিঃসঙ্গ বিষণ্ণ মানুষ কথা বলছে—যার অস্তিত্ব সেই শৈশবে আঁচ করে মা তাকে বুড়ো বলে ডাকতেন।

কৃষ্ণা হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে। এই যা! আমি করছি কী? আমার কত কাজ পড়ে আছে, আর তোর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি!

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে কৃষ্ণা বাড়ির ভেতর ঘোরে। উঠোন থেকে ঘর, ঘর থেকে উঠোন—কখনও দরজা খুলে রাস্তায় উঁকি, তারপর উঠোনের তারে মেলে দেওয়া কাপড় শুকিয়েছে কি না পরখ করে নাচের ভঙ্গিতে বারান্দায় ফেরে। দাদা! আজ একটা ছবি দেখতে ইচ্ছে করছে রে। যাবি?

ননী বলে, বেশ তো।…