কুয়াশার রাত – ৮

তারপর থেকেই মোড় ঘুরে গেল তার জীবনের।

ভিড়ে গেল সে নীলকান্তর দলে। যোগাযোগটাও হয়ে গেল সহজেই। স্কুলের ছুটির পর সেদিন ফটকের বাইরে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল বৃজলাল। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে নেই। অথচ কোথায় যাওয়া যায়, তাও মনে মনে খুঁজে পাচ্ছিল না।

পিঠের ওপর একখানা হাত পড়ল আলগোছে। বৃজলাল তাকিয়ে দেখলে নীলকান্ত। নীলকান্ত তার চেয়ে মাত্র বছর দুই—তিনের বড়, তবু তার চোখের কোল দুটো বসা। সেই কোটরে বসা চোখ নাচিয়ে নীলকান্ত বললে, কি হে গুড বয়, চুপচাপ দাঁড়িয়ে কেন?

এমনি।

বাড়ি যাবে না? মা যে দুধু—ভাতু নিয়ে বসে আছে।

বৃজলালের মনটা এক মুহূর্তে তেতো হয়ে গেল। মা কোনোদিনই বিকেলে তার জন্যে বাড়িতে বসে থাকেন না, এ সময় তিনি থাকেন থিয়েটারে।

একটা অদ্ভুত বেপরোয়া মন নিয়ে বৃজলাল নীলকান্তকে জিজ্ঞেস করল, তোরা কোথায় যাস ছুটির পর?

আমরা? আমরা আড্ডা দিতে যাই। সে খোঁজে তোমার কাজ কি সোনার চাঁদ?

চল তোদের সঙ্গে যাই।

নীলকান্তর কোটরে বসা চোখ দুটো স্থির হয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত, তারপর সবস্মিয়ে বলে উঠল, তুই যাবি—আমাদের আড্ডায়!

নীলকান্তর পেছনে দাঁড়িয়েছিল উমাপতি আর বিলাস ওরফে বিলে।

তারা হই হই করে উঠল। বলিস কি রে গুড বয়! আমাদের দলে ভিড়লে তুই খারাপ হয়ে যাবি যে!

বৃজলাল গম্ভীর হয়ে শুধু বললে, খারাপই হব আমি। কোথায় যাবি চল।

চলতে চলতে নীলকান্ত বললে, বুঝেছি, মনটা তোর বিগড়ে আছে আজ। আচ্ছা দাঁড়া, মন ভাল করে দিচ্ছি।

নীলকান্তর পকেট থেকে বেরোল সিগারেটের একটা প্যাকেট। একটা নিজের মুখে গুঁজে আরেকটা বৃজলালকে দিলে। বললে, নে টান।

কয়েক সেকেন্ডের জন্য থতিয়ে গেল বৃজলাল। সিগারেট!

নীলকান্ত মুখ টিপে হেসে বললে, কি সোনার চাঁদ, খারাপ হওয়ার সাধ মিটে গেল?

বিলে ফস করে বৃজলালের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে নিজে ধরিয়ে বললে, আরে দুর, তুই একটা নাড়ুগোপাল! যা যা, মায়ের কোলে বসে দুধু—ভাতু খা গে যা!

নিজেকে অত্যন্ত ছোট মনে হল বৃজলালের। কেমন যেন অপমানিত বোধ হল। তীব্র চোখে চেয়ে বিলেকে ধমকে উঠল, থাম।

তারপর বিলের মুখ থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা আচমকা নিয়ে একটা টান দিলে সে। টেনেই কিন্তু কেশে ফেললে।

নীলকান্ত হেসে বললে, জিতা রহো বেটা। দু’দিনেই অভ্যেস হয়ে যাবে।

চলতে চলতে তারা এল একটা পার্কে। ছোট পার্ক, নিরিবিলি। একটা ঝোপের আড়ালে বসল তারা। বিলের পকেট থেকে বেরিয়ে এল এক জোড়া তাস, শুরু করলে সে ভাঁজতে। এসে জুটল আরও দুটি ছোকরা। চেহারাতেই মালুম তারা কোন শ্রেণীর।

বিলে বৃজলালকে শুধোলে, ক্যাশ আছে পকেটে?

আছে কিছু। কেন?

তা হলে তোকেও তাস দেব।

কি খেলা?

তে—তাস।

বিলে তিনখানা করে তাস দিলে প্রত্যেককে। মাঝখানে পড়তে লাগল পয়সা। শুরু হয়ে গেল তাসের জুয়া। পুড়তে লাগল অনেক সিগারেট। দু’—তিন দানেই খেলাটা শিখে ফেললে বৃজলাল।

খারাপ হওয়ার পথে সেই প্রথম তার হাতেখড়ি।

ছবির মতো সব যেন দেখতে পাচ্ছে বৃজলাল। সন্ধে অবধি পার্কে কাটিয়ে তারা গেল একটা সস্তা রেস্তোরাঁর কেবিনে। নীলকান্ত তার খাতার মধ্যে থেকে মোটা একখানা খাম বার করে বললে, আজ যা দেখাব, দেখে তোদের তাকে লেগে যাবে মাইরি।

সবাই ঝুঁকে পড়ল খামখানার ওপর। তার ভেতর থেকে বেরোল খান কয়েক নিষিদ্ধ ফরাসি ছবির কার্ড। দেখে বৃজলালের কান লাল হয়ে উঠল, তবু চোখদুটো বারবার গিয়ে পড়তে লাগল ছবিগুলোর ওপর।

নীলকান্ত আর সঙ্গীদের মধ্যে হাসাহাসি চলতে লাগল। চলতে লাগল অশ্লীল কথা আর রসিকতা। বিলাস একটা বিশ্রী গান ধরে দিলে। আর সব কিছুর মাঝে ষোলো বছরের নিষ্পাপ কিশোর বৃজলাল বসে বসে ভাবতে লাগল, কাল থেকে এদের সঙ্গে সে আর কথাও বলবে না।

কিন্তু খারাপ হওয়ার পথটা ঢালু। একবার সে পথে পা দিলে তরতর করে’ নেমে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। বৃজলালের অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলে।

পরদিন স্কুলের ছুটির পর বৃজলাল আবার গেল নীলকান্তদের আড্ডায়। তার পরের দিনও। তারপর থেকে রোজ নিয়মিত! নীলকান্ত তার প্রাণের বন্ধু হয়ে উঠল।

সিগারেট টানতে আর তার কাশি আসে না। তে—তাস খেলায় সে পাকা হয়ে উঠল। ফরাসি নিষিদ্ধ ছবি দেখলে আর কান লাল হয় না। কেউ অশ্লীল রসিকতা করলে বৃজলাল তার জবাব দিতে পারে।

তাসের জুয়ায় প্রায়ই সে হারত। ফলে মায়ের দেরাজে প্রায়ই তার হাত পড়ত। কখনো বা স্কুলের বই দু’—একখানা পুরানো বইয়ের দোকানে চলে যেত। তবু জুয়ার আড্ডায় বৃজলালের কামাই হত না একদিনও।

কিন্তু মায়ে দেরাজ একদিন বন্ধ হয়ে গেল, ফুরিয়ে এল স্কুলের পাঠ্য বই। মুশকিল পড়ে গেল বৃজলাল, খুঁজতে লাগল উপায়।

উপায়ও মিলে গেল একসময়। সহজেই।

ক্লাসে সেদিন সুধীরের দামি ফাউন্টেন পেনটা হারিয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজি, দরোয়ান চাকর ঝাড়ুদারকে অনেক জেরা। তবু পাওয়া গেল না।

বিকেলে পার্কে গিয়ে বিলে তাদের বললে, দাঁড়া, এখুনি আসছি।

অদূরে একটা বেঞ্চে আধাবয়সী এক ভদ্রলোক বসেছিলেন। বিলে তাঁর কাছে এগিয়ে গেল। যাবার আগে মাথার চুলগুলো এলোমেলো আর মুখখানা অত্যন্ত করুণ করে’ নিলে। পকেট থেকে একটা পেন বের করে ভদ্রলোককে বললে, বাড়িতে ছোট বোনের বড় অসুখ স্যার, ওষুধ কিনতে পারছি না। কলমটা নিয়ে যদি পাঁচটি টাকা দেন—

বৃজলাল আশ্চর্য হয়ে দেখল, কলমটা সুধীরের।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই বিলাস পাঁচটাকার একখান নোট হাতে বিজয়—গর্বে ফিরে এল। নীলকান্ত বললে, শাবাশ বেটা!

সন্ধের পরে আড্ডা থেকে বাড়ি ফিরছিল বৃজলাল। বাসে ছিল ভিড়। বৃজলালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল একটি সাহেবি পোশাকপরা ভদ্রলোক। কোটের বুক পকেটে সোনার ক্যাপওয়ালা পার্কার। বৃজলালের হঠাৎ বিলাসের কথা স্মরণ হল। নিসপিস করতে লাগল তার হাতের আঙুলগুলো। অথচ বুকের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি।

কোথা দিয়ে কি যে হয়ে গেল। হঠাৎ ঘণ্টা বাজিয়ে বাস ভাল করে থামবার আগেই বৃজলাল নেমে পড়ল।

তার পকেটের মধ্যে তখন সেই সোনার ক্যাপওয়ালা পার্কার! হাতের আঙুলগুলো তখনো কাঁপছে থরথর করে।

কিন্তু তারপর থেকে আর কাঁপত না হাত। বদলে যেত না মুখের ভাব। বাহবা দিয়ে বন্ধুরা বলত, ওস্তাদ। বেশ লাগত শুনতে।

ভালো বৃজলাল এমনি করেই একদিন খারাপ হয়ে গেল।

.

অনেকদিন অবধি মা টের পাননি কিছুই। কিন্তু চোখ এড়ায়নি ফাদার রেক্টারের!

শুধু স্বভাবের নয়, মুখের চেহারায়ও পরিবর্তন ঘটেছিল বৃজলালের। কিশোর বয়সের স্নিগ্ধ কমনীয়তা মুছে গিয়ে মুখে ক্রমশ ফুটে উঠছিল একটা রুক্ষ চোয়াড়ে ভাব। রং ফর্সা বলেই চোখের কোলে অস্পষ্ট কালো ছাপটা বেশি স্পষ্ট দেখাত।

ফাদার রেক্টর তাকে বিশেষভাবে লক্ষ করতেন। বৃজলালের ওপরেই তাঁর আশা ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ক্লাসের মাসিক পরীক্ষায় ক্রমেই অবনতি হতে লাগল তার। শেষ অবধি বার্ষিক পরীক্ষায় দেখা গেল বৃজলালের ফল যা অবশ্যম্ভাবী, তাই হয়েছে। ফেল করেছে সে।

রেক্টর তাকে ডেকে সেদিন অনেক কথাই বলেছিলেন। তাঁর কথার মধ্যে শাসন ছিল যতখানি, স্নেহ ছিল তার চেয়ে বেশি। কিন্তু সবটাই তিক্ত লেগেছিল বৃজলালের।

স্কুলের নিয়ম অনুসারে চিঠি গেল বাড়িতে। বৃজলালের মায়ের নামে।

সেই দিন জানতে পারলেন মা। লক্ষ পড়ল ছেলের ওপর। প্রচণ্ড আঘাতে চুরমার হয়ে গেল তাঁর বিশ্বাস। সেই সঙ্গে তাঁর ভবিষ্যতের আশা স্বপ্ন সুখের কল্পনা। রাগে আর হতাশায় বহু তিরস্কার তিনি করেছিলেন ছেলেকে। চোখের জলও ফেলেছিলেন।

ধরা পড়ে সেদিন লজ্জা অনুতাপ অনুশোচনা সবই হয়েছিল বৃজলালের। এবার থেকে পড়াশুনোয় মনে দেবে, আবার ভাল হবে বলে মনে মনে শপথও করেছিল। কিন্তু ভাল সে আর হয়নি। হতে পারেনি। নীলকান্তর দল তাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরেছিল। তাকে পেয়ে বসেছিল জুয়ার নেশায়।

সুতরাং দিন যেমনই চলছিল, তেমনই চলতে লাগল।

একদিন স্কুলও ছাড়তে হল। জন নামে একজন ফিরিঙ্গি সহপাঠীর হাতের রিস্টওয়াচ একদা খোয়া গেল। টিফিনের ঘণ্টায় ঘড়িটা খুলে রেখে জন ‘ভলি বল’ খেলছিল, তারপর আর পায়নি!

ঘটনাটা জন চুপচাপ রেক্টরকে জানায়। রেক্টর শুনে কিছুই বললেন না বটে, কিন্তু ছুটির একটু আগে হঠাৎ ক্লাসে এসে বৃজলালকে ডেকে নিয়ে গেলেন নিজের অফিস ঘরে। ব্যাপারটা এমনই আচমকা যে, বৃজলাল সাবধান হওয়ার অবকাশ পায়নি।

তল্লাসি করতেই তারা মোজার ভেতর থেকে বেড়িয়ে পড়ল জন’—এর ঘড়ি।

আবার চিঠি গেল তার মায়ের কাছে। চুরির অপরাধে বৃজলালকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল।

বৃজলাল চোর হয়েছিল আগেই। এবার হল দাগি চোর।

স্কুলের চিঠি শুধু তার মা নয়, তার বাবাও দেখেছিলেন। দেখে কি বলেছিলেন তার মাকে, বৃজলালের মনে আছে : ‘আমি তো’ বলেছিলাম, ভালমন্দ হওয়ার বীজ মানুষ তার রক্তে নিয়ে জন্মায়।’

আজ কিন্তু বৃজলালের মনে হয়, ভুল—তার বাবার কথা অত্যন্ত ভুল। জন্মকালে সব শিশুর রক্ত একই রকম থাকে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশের পরিবেশ অনুসারে কারও রক্তে ভাল বীজ, কারও রক্তে মন্দের বীজ বোনা হয়ে যায়। সেজন্যে কোনো শিশুই দায়ী নয়।

সেতো’ আর পাঁচটা ছেলের মতোই ভাল হয়ে জন্মেছিল। লেখায় পড়ায় আচারে ব্যবহারে, সততায় সভ্যতায় ভাল হয়েই উঠছিল। তবে কেন সে খারাপ হয়ে গেল?

কেন সে হয়ে উঠল অশিক্ষিত অসৎ চরিত্রহীন? একি তার বিধিলিপি? না। বৃজলাল তার সমস্ত জীবন দিয়ে বুঝেছিল সেদিন একটু যত্ন একটু স্নেহ একটু ভালবাসা পেলে সে হয়তো খারাপ হয়ে যেত না। বড় হয়ে ওঠার পর তার উদাসীন বাপ আর অভিনেত্রী মায়ের কাছ থেকে সে তো পায়নি।

মিশনারি স্কুলের ছাত্র ছিল সে, বাইবেল পড়তে হয়েছিল। আজ তাই মনে হয় বৃথাই মানবপুত্র পাপীর স্বপক্ষে আবেদন জানিয়ে গেছেন। আজও দুনিয়ায় কেউ শোনেনি তার কথা। শুনতে চায়ও না। অপরাধীকে ঘৃণা করে সবাই। তাই যারা মন্দ, যারা অপরাধী, তারাও মনে প্রাণে ঘৃণা করে তাদের, যারা জীবনে ভাল হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।

কিন্তু এসব কথা ভেবে আর কি হবে? কি লাভ ভাল হওয়ার কথা ভেবে? খারাপ হওয়ার রাস্তা বড় ঢালু। একবার নামতে শুরু করলে আর ওঠা যায় না।

স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়াতে সুবিধেই হল বৃজলালের। পুরোপুরি খারাপ হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল।

ছোট বৃজলাল ক্রমশ বড় হল। সেই সঙ্গে জুয়া থেকে বড় জুয়ায় তার প্রোমোশন হল। মানে তাসের আড্ডা থেকে ঘোড়দৌড়ের মাঠ। ছোট চুরি থেকে বড় চুরিতে হাত পাকল। আর সিগারেট থেকে উন্নতি হল মদে।

প্রথম যেদিন মদের গন্ধ পেয়েছিলেন মা, সেদিন আহত বিস্ময়ে দুটি মাত্র কথা বেরিয়েছিল তাঁর মুখ দিয়ে, তুই মাতাল! এতটা অধঃপাতে গেছিস!

দ্রব্যগুণে সেদিন বৃজলালেরও মুখ খুলে গেল। সোজা জবাব দিল, নটী মায়ের ছেলে মাতাল জোচ্চেচার ছাড়া আর কি হবে?

ছেলের মুখে এ জবাব কোনও মা—ই আশা করে না। বৃজলালের মা পাথর হয়ে গিয়েছিলেন শুনে। একটি কথাও তিনি আর বলেননি। শুধু মিনিট খানেক নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে তিনি ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

বৃজলাল আজও স্পষ্ট দেখতে পায় মায়ের সেই মুখখানি।

দ্বিতীয়বার জিন—এর গেলাস নিঃশেষ করে বৃজলাল তৃতীয় পেগ অর্ডার দিলে। হলদে সিগারেটের প্যাকেটটা শূন্য হয়ে গেছে। ফেলে দিয়ে পকেট থেকে নতুন একটা প্যাকেট খুললে। মনে মনে বললে, গুলি মারো পুরনো দিনের চিন্তায়। সে কি হত—কি হতে পারত, কাজ কি সে কথা ভেবে? বৃজলাল জুয়ারি নেশাখোর চোর এই হল সবচেয়ে স্পষ্ট সত্য। এই পরিচয়ই থাক। দুনিয়ার ভালো মানুষদের সে কেয়ার করে না।

 * * *

তিনটের পর জজ সাহেব আবার এসে আসনে বসলেন। ধীরে ধীরে সাক্ষী সন্ধ্যামালতী এসে দাঁড়ালেন ডাকে। রমেন বোস প্রশ্ন করল, আচ্ছা, মনে করে বলুন তো সে—রাতে চারতলার ফ্ল্যাট থেকে কুণাল যখন নেমে এসেছিল, সে সময় তার গায়ে কি ছিল?

তারও গায়ে ছিল সবুজ কোট, লাল টাই।

কুণালও তাই পরেছিল! কেন?

মাস দুই আগে কুন্তলের জন্মদিন উপলক্ষে ওদের দু’ভাইকে একই পোশাক তৈরি করিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিন সন্ধেবেলা এক পার্টিতে যাবে বলে দু’জনে একই পোশাক পরেছিল।

ও! সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে কুণাল কি করলে?

আমায় দেখে বললে, ‘শোভাকে আমি খুন করে ফেলেছি, পুলিশ এলে দরজা খুলো না।’ ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল, আমি বাধা দেওয়ায় নিচে নেমে গেল। আর আসেনি।

সমস্ত আদালত যেন দমবন্ধ করে শুনছে। মিনিট খানেক চুপ করে রইল রমেন বোস। তারপর গাঢ় স্বরে বললে, আর আমার প্রশ্ন নেই সন্ধ্যামালতী দেবী। পারেন তো ক্ষমা করবেন আমাকে।

তাঁকে ধরে একখানা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে, এজলাসের সামনে এসে দাঁড়াল রমেন বোস। অতি ধীরে ধীরে খাদের গলায় বলতে শুরু করলে :

মি লর্ড! জেন্টলমেন অফ দি জুরি! সাক্ষী সন্ধ্যামালতী দেবীর সব কথাই আপনারা শুনলেন। আমি বলেছিলাম, সত্যানুসন্ধানে আদালতকে সাহায্য করব, আশা করি, আমি তো পেরেছি। আমার বিজ্ঞ সহযোগী মিস্টার ভাদুড়ি বলেছেন, নরহত্যা পৃথিবীর জঘন্যতম পাপ। মানুষ খুন করা জঘন্যতর পাপ কিনা জানি না, তবে পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক পাপ, ইতিহাস তা বলে। আদি মানুষের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এই পাপেরও জন্ম হয়েছিল, আর আজও যে এই পাপ ঘটছে, তার প্রমাণ আমরা আজ আদালতে পেয়েছি। মানুষের সভ্যতা আর কিছুই করতে পারেনি—মানুষ—খুনের সংখ্যাকে বাড়িয়ে আদর্শবাদের যুদ্ধ বা বিশ্বযুদ্ধ নাম দিয়েছে মাত্র। তাই আজকের মানুষের কাছে মানুষ—খুনটা অতি সাধারণ অপরাধ।

রমেন বোস জুরিদের বেঞ্চের কাছে গিয়ে দাঁড়াল : কিন্তু এই অপরাধের বিচার করতে গিয়ে যদি কোনও নিরপরাধ মানুষ দণ্ডিত হয়, সেটাই হবে অসাধারণ অপরাধ। সেক্ষেত্রে বিচারক হয়ে যাবেন খুনি। আজকের বিচার—সভাকে তাই আমি সতর্ক করে দিতে চাই। সন্ধ্যামালতীদেবীর সাক্ষ্য থেকে জানা গেল যে, নর্তকী শোভা ইম্যানুয়েলকে খুন করেছে কুন্তল চ্যাটার্জি নয়, নেশাখোর জুয়াড়ি কুণাল চ্যাটার্জি। একই বাপের সন্তান হওয়ার দরুণ বা যে কোনও কারণেই হোক, কুন্তল কুণালের দেহের গড়ন একই ধাঁচের। লম্বাতেও দুজনে প্রায় সমান। আর সে—রাতে সবুজ কোট আর লাল টাইয়ের মিলটা যে নিতান্তই দৈবের ঘটনা নয়, তাও সাক্ষীর মুখে শুনলেন। এক্ষেত্রে যমুনা লালার ভুল করা খুব স্বাভাবিক নয় কি?

এখন, সন্ধ্যামালতী দেবী যা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তা সত্য কিনা—তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে কিনা, এই নিয়ে আইনের প্রশ্ন উঠতে পারে। আমি কিন্তু আইনের তর্ক তুলব না। কেননা আইনের চেয়ে মায়ের অশ্রুজল অনেক বড়। পৃথিবীতে কোনো মা—ই নিজের ছেলেকে মিথ্যে করে খুনের দায়ে জড়াতে পারে না। আর আমার বলার কিছু নেই। মাননীয় জুরিদের আমি অনুরোধ করছি, একবার ওই মহীয়সী মায়ের চোখের জলের দিকে তাকাতে। ওই চোখের জল বলছে, লক্ষ অপরাধীর শাস্তি হোক, কিন্তু জগতে একটিও নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়।

রমেন বোস থামল। তার শেষ কথাগুলো আদালত—ঘরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

জুরিরা উঠে গেলেন মন্ত্রণা—কক্ষে। ফিরে এলেন পাকা দেড় ঘণ্টা পরে।

আদালত রুদ্ধনিঃশ্বাসে অপেক্ষা করছে।

জজসাহেব প্রশ্ন করলেন, জেন্টলমেন অফ দি জুরি, আপনাদের সিদ্ধান্ত কি? আসামি দোষী, না দির্দোষ?

নির্দোষ।

সন্ধ্যামালতী দুর্বল পায়ে টলতে টলতে এগিয়ে গেলেন আদালত—ঘরের একধারে লোহার খাঁচার দিকে—যার মধ্যে কুন্তল তখনও দাঁড়িয়েছিল উদভ্রান্তের মতো।

অশ্রুভেজা মুখে অপূর্ব হেসে সন্ধ্যামালতী ডাকলেন, কুন্তল!

কুন্তল শুধু বললে, মা! তারপর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল।

 * * *

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। কিন্তু হংকং কাফের কিবা দুপুর, কিবা রাত। জাহাজি মাল্লাদের কৃপায় সব সময়ই জমজমাট।

বৃজলাল এখনও বসে আছে নিজের অতীতের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে। জিন—এর পঞ্চম পেগ পার হয়ে ষষ্ঠে এসে পৌঁছেছে। মেয়ে—পুরুষে গিসগিস করছে পানশালা। বৃজলাল কিন্তু নিজের মধ্যে একা।

লেখাপড়া চুলোয় গেল, রয়ে গেল জুয়া আর মদের নেশা। কিন্তু নেশা মানেই খরচ। মায়ের বাক্স আর গয়না ভেঙে কিছুদিনের চলল, তারপর আর চলে না। বৃজলাল অগত্যা জাহাজে কাজ খুঁজতে লাগল। মাল্লার কাজ।

মাল্লার কাজটা উপলক্ষে মাত্র, আসল লক্ষ্য হল চোরা—কারবার—যার নাম স্মাগলিং। এতদিনে বৃজলাল একটা মনের মতো কাজ খুঁজে পেল। কি দোষ তার? টাকার দরকার দুনিয়ায় সকলেরই। আর সোজা পথের চেয়ে বাঁকা পথে টাকা আসে অনেক, অনেক বেশি। সে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে কেন বোকার মতো?

জাহাজের কাজে ঢুকে পড়ল বৃজলাল। আর সেই সূত্র ধরেই সীমেনস ক্লাবে প্রথম দেখা তার সঙ্গে।

বৃজলালের ভাবনা হঠাৎ থমকে থেমে গেল। যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার নামটা সে মনে মনেও উচ্চচারণ করতে পারল না—যেন অদৃশ্য কান দিয়ে কেউ শুনে ফেলবে!

কিন্তু তার লম্বাটে সুঠাম দেহটা আজ দেড়মাস ধরে কেবলই তার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বৃজলাল আজও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, সীমেনস ক্লাবের ডায়াসের ওপর সে নাচছে। ঢেউয়ের মতো ছন্দিত হচ্ছে তার মজবুত দেহ। ফুলে ফুলে উঠছে খাটো ঘাঘরা। রঙিন স্পট লাইটের ফোকাসে দেহের রেখায় রেখায় হাতছানি দিচ্ছে তার বন্য যৌবন।

দেশ—বিদেশের বন্দরে অনেক মেয়ে দেখেছে বৃজলাল, কিন্তু এমন মেয়ে তার চোখে পড়েনি কখনো। মদের গেলাসে চুমুক দিতে ভুলে গিয়েছিল সে।

কিন্তু কে জানত একেবারে হাতের নাগালের মধ্যে এসে যাবে। মেয়েটা! হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল তাদেরই ফ্ল্যাট—বাড়ির সিঁড়িতে। বৃজলাল উঠছিল, মেয়েটা নামছিল। গুচ্ছ গুচ্ছ রেশমি চুলের নীচে ঝকঝকে কালো চোখ তুলে তাকিয়েছিল একবার, তারপর টকটকে লাল ঠোঁটের ফাঁকে একটু অকারণ হেসে নেমে গিয়েছিল।

দারোয়ানের কাছে বৃজলাল খবর পেল, মেয়েটা নতুন ভাড়াটে। তারপর আলাপ জমতে কতক্ষণ? বাপ—মা আর কিছু না দিন, চেহারাটা দিয়েছেন বৃজলালকে। তারই দৌলতে মেয়েদের ভালবাসার দোরগোড়ায় পৌঁছে যেতে তার আটকাত না। তাদের ফ্ল্যাট—বাড়ির নতুন ভাড়াটের দরজাও খুলে গেল তার জন্যে। পাগল হয়ে গেল মেয়েটা বৃজলালকে পেয়ে।

ভালবাসা—টাসা বৃজলাল অবিশ্যি বুঝত না, তবু মনে মনে সে একদিন ঠিক করে ফেললে, এবার সে নেশা ছেড়ে দেবে, ভালো হবে, ভদ্রলোক হবে। মেয়েটাকে নৈলে যখন তার চলবেই না, তখন বিয়েই করে ফেলবে রেজিস্ট্রি করে।

সুন্দরী মেয়ের পাল্লায় পড়লে মানুষ কত বোকা হয়!

রেজিস্ট্রেশনের দিন পর্যন্ত ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এক লহমায় ভেস্তে গেল, সবই—যেমন ক’রে ভেস্তে যায় তাসের খেলা।

মেয়েটার বিছানায় একদিন সে একটা বেল্ট দেখতে পেল। বেল্টটা বৃজলালের চেনা—উজ্জ্বল নিকেলের বকলসে ইংরেজি ‘ডি’ অক্ষরটা মীনে করা। ‘ডি’ মানে ডিক জোন্স, তার প্রাণের বন্ধু। জাহাজে শুয়োরের মাংস চালান দেয়। টাকার কুমির। কিন্তু খাল তো’ বৃজলাল নিজেই কেটেছিল গত বড়দিনে মেয়েটার সঙ্গে ডিকের আলাপ করিয়ে দিয়ে। তারপরের ব্যাপারটা সংক্ষিপ্ত। একটা রিভলভারের খোঁজেই বেরিয়েছিল বৃজলাল, তাড়াতাড়িতে তার মুঠোয় এসে গেল পাৎলা একখানা চিনে ছুরি।…তাই সই! কিন্তু আফশোস এই যে, চকচকে ফলাটা লাল হয়ে উঠল শুধু একজনের রক্তেই। ডিকের রক্ত লাগল না, সে তখন ব্যাংককের জাহাজে।

সে রক্তের দাগ তো কবে মুছে ফেলেছে বৃজলাল, তবু কেন বারবার চোখ পড়ে নিজের হাতখানার দিকে। মরা মানুষ কেন তাড়া করে বেড়ায় রাতদিন?

অস্থির হয়ে উঠল বৃজলাল। অন্যমনস্ক চোখ দু’টো চঞ্চল হয়ে উঠেই আটকে গেল হল—এর দরজার ওপর। দুটো পুলিশ অফিসার শিকারি কুকুরের মতো অপরাধীর গন্ধ শুঁকছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে তৈরি হয়ে রইল বৃজলাল। কিন্তু না, এগিয়ে এল না তার দিকে, বাইরে থেকেই চলে গেল।

বিড় বিড় করে বলে উঠল বৃজলাল, কুত্তার বাচ্চচা!

তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আধ—খাওয়া জিন—এর গেলাসটা মুখে তুলে লম্বা একটা চুমুক দিলে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই তার পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, গুড ইভনিং কুণাল চ্যাটার্জি! শোভা ইম্যানুয়েলের খুনের দায়ে আমি তোমাকেই খুঁজছি।—উঁহু পালাবার চেষ্টা কোরো না, বাইরে পুলিশ হাজির।

পাথরের চোখের মতো স্থির দৃষ্টি মেলে কুণাল দেখলে, নিখুঁত নেভি সুট পরা লম্বা চওড়া এক সেলার তার পাশে দাঁড়িয়ে। মুখে হাসি, হাতে রিভলভার।

আশ্চর্য, লোকটা পাশের টেবিলেই এতক্ষণ বসেছিল গোটাকতক বিয়ারের বোতল নিয়ে।

সেলারটা আবার বলল, নিজের পরিচয়টা না দিলে খারাপ দেখায়। আমি একজন ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ।

তারপর কুণালের টেবিল থেকে গোল্ডফ্লেক সিগারেটের প্যাকেট ছেঁড়া সোনালি রিবনের ফাঁস—বাঁধা একটা গোল—রিং কুড়িয়ে নিয়ে শুধু বললে, এসো—

কাচের গেলাসটা কুণালের আড়ষ্ট হাত থেকে পড়ে চুরমার হয়ে গেল।

 * * *

রায় বেরোল পরদিন। আসামি কুন্তল চ্যাটার্জির বেকসুর খালাসের অর্ডার।

দরজাটা খুলেই রেখেছিল মিতালি। আর নিজে দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়, কোলের কাছে দীপুকে নিয়ে। যেমন ভঙ্গিতে সেই সাতাশে মাঘের সকালে কুন্তলকে বিদায় দিয়েছিল।

সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ হল। দরজার কাছে এসে দাঁড়াল কুন্তল আর রমেন। মিতালির মুখে তখন রোদ—বৃষ্টির খেলা। কুন্তলকে ভেতরে ঠেলে দিয়ে রমেন দরজার কপাট দুটো টেনে দিলে আস্তে আস্তে! তারপর শিস দিতে দিতে নেমে গেল।

এখুনি একবার অ্যাটার্নি সেনের অফিসে যেতে হবে। আরও একশো টাকার বিশেষ দরকার এখন।