কুয়াশার রাত – ৭

ফটক পেরিয়ে সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ উঠলেই মস্তবড় হলঘর। একদিকে তার নাচের ছোট মঞ্চ আর অর্কেস্ট্রা দলের বসবার আসন, বাকি জায়গাটা জুড়ে ছোট ছোট বেতের গোল টেবিল আর চারখানা করে বেতের চেয়ার।

হলঘরের একেবারে একটেরে বারান্দা ঘেঁষে একখানা চেয়ার দখল করে বসে আছে বৃজলাল। তার টেবিলে বাকি তিনখানা চেয়ার এখনও খালি। অন্যান্য টেবিল মধুপিয়াসীদের ভিড়ে ভরে উঠেছে। সমস্ত হলঘরটা তাদেরই হাসি গল্প কথাবার্তায় মৌচাকের মতো গুঞ্জরিত।

এইমাত্র একটা নাচ হয়ে গেল, পিয়ানোতে এখন টুং টাং করে ‘ওভার দি ওয়েভস’ বাজছে। বৃজলালের কোনো দিকেই খেয়াল নেই। এমনকি তার নতুন বন্ধুরা—অ্যালফ্রেড আর ইসমাইল টেবিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ‘হ্যালো বৃজলাল’ বলে সম্ভাষণ করা সত্ত্বেও কোনো জবাব দেয়নি সে। তাদের সম্ভাষণ হয়তো কানেই যায়নি তার।

বৃজলাল এ অঞ্চলে হালে এসেছে। লোকে জানে ডকে কাজ করে সে। বাপ ভাই বউ বোন—কোনো বালাই নেই। স্রেফ একা মানুষ। বাজারের কাছে একখানা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে, আর দু’বেলা হোটেলে খায়। ঘরে তার প্রায়ই তালা ঝুলতে দেখা যায়। সারাদিন কোথায় কোথায় ঘোরে সেই জানে।

সহজে মেশে না কারও সঙ্গে। বন্ধু তার খুবই কম, কিন্তু চেনে অনেকে। তার কারণ বৃজলালের চেহারাটা মন্দ নয়, অন্তত ভিড়ে মিশিয়ে যাবার মতো নয়। কিন্তু উগ্র একটা রুক্ষ্মতার ছাপ তার সর্বাঙ্গে। মুখখানায় অশিক্ষিত চোয়াড়ে ভাব, টানা চোখের কোলে অসংযত জীবনের কালো ইতিহাস। দেখতে মোটামুটি সুন্দর হলেও বৃজলালকে ভদ্র বলতে যেন বাধে।

একপাত্র ‘জিন’ সামনে রেখে বৃজলাল বড় অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে আজ। ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে ধূমায়িত সিগারেট। অন্যদিন এত চুপচাপ সে থাকে না, ডক—শ্রমিক অ্যালফ্রেড আর ইসমাইলের সঙ্গে গল্প হাসাহাসি করে। কদাচিৎ বা দু’—একটি পণ্যানারীর আবির্ভাব হয় তার টেবিলে।

আজ কিন্তু বৃজলাল নিজের মধ্যেই ডুবে আছে। একা একা বসে মাঝে মাঝে ‘জিনে’র গেলাসে মৃদু চুমুক দিচ্ছে আর কি যেন ভাবছে। ঠিক ভাবছে না নিজেরই জীবন—নাটকের গোড়ার দিকের দু’—একটা অঙ্গ নিজেই যেন দর্শক হয়ে নীরবে দেখছে।

.

ভাল করে যখন তার জ্ঞান হয়েছিল, সেই তখন থেকেই সংসারে মা ছাড়া আর কাউকে দেখেনি। মাঝে মাঝে বয়স্ক একটি ভদ্রলোক আসতেন, শ্যামবর্ণ, দীর্ঘ দেহ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, চেহারা সম্ভ্রান্ত। শুনেছিল তিনি নাকি খুব বিদ্বান।

তিনি এলেই মা তাকে বলতেন, ও ঘরে গিয়ে খেল গে।

একদিন সে জিজ্ঞেস করেছিল, ও কে মা?

গম্ভীর হয়ে মা বলেছিলেন, তোমার বাবা।

এ কথা শুনে সেদিন তার শিশু—মন খুশি হওয়ার বদলে আশ্চর্যই হয়েছিল। এ কেমনতর বাবা? তাকে দেখলে হাসে না, আদর করে না, কাছে ডেকে একটা লজেন্সও দেয় না! আর পাঁচজন ছেলের বাবাদের সঙ্গে তার বাবার কোথাও মিল নেই।

স্কুলে ভর্তি হবার পর তার বাবা দেখা হলে শুধু একটি প্রশ্নই করতেন, পড়াশুনা কেমন হচ্ছে?

এ ছাড়া আর কোনও কথা নয়। অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে, স্কুলে তার বাড়ির অভিভাবক হিসেবে তার মায়ের নামই লেখানো ছিল। এর কারণটা ছোটবেলায় বুঝতে না পারলেও বড় হয়ে সে জানতে পেরেছিল। তার বাপ—মায়ের বিবাহিত সম্পর্কটা আর দশজন স্বামী—স্ত্রীর মতো খোলাখুলি ছিল না—ছিল ঢেকে রাখা। তাঁদের দাম্পত্য পরিচয়টা সমাজের সামনে কুণ্ঠিত হয়ে থাকত, তার মধ্যে কোথায় যেন অগৌরব লুকানো।

তবু মনে পড়ে, বাড়িতে একদিন তার বাবা এসেছিলেন। সেদিন তার জন্মদিন। তাকে প্রণাম করতে বলে তার মা বাবাকে বলেছিলেন, আশীর্বাদ করো এ যেন ভাল হয়—যেন তোমারই আদর্শে মানুষ হয়ে ওঠে।

সেদিন তার বাবা কি জবাব দিয়েছিলেন, তাও স্পষ্ট মনে আছে। অল্প একটু হেসে তিনি বলেছিলেন, ভাল—মন্দ হওয়ার বীজ মানুষ তার রক্তে নিয়ে জন্মায়। শুধু আশীর্বাদে তাকে বদলানো যায় না মালতী।

তারপরে বাবা মানিব্যাগ খুলে কিছু টাকা মায়ের হাতে দিয়ে বললেন, ওকে ওর পছন্দমতো কিছু কিনে দিও।

বৃজলালের আনন্দ হওয়ারই কথা। কিন্তু দুরন্ত একটা অভিমানে তার ছোট্ট বুক তোলপাড় হয়ে উঠল। কি জানি কেন তার মনে হল, এটা বাপের স্নেহ—উপহার নয়। এটা যেন বখশিস দেওয়া—চাকর—বাকরকে যেমন বখশিস দেয় মনিবরা!

সেদিন টাকার বদলে বাবা যদি তাকে কাছে ডেকে একটু আদর করতেন, মাথায় যদি একটু হাত বুলিয়ে দিতেন, তবে হয়তো এ অভিমান তার হত না।

বাপের সম্পর্কে তার মনে ক্ষোভ থাকলেও তার মা তাকে ভালবাসতেন। খুবই। তবু মাকে সে সব সময় পেত না। সপ্তাহে কয়েকটা দিন বিকেলের দিকে মা যে কোথায় চলে যেতেন তা সে জানত না। মা ফিরতেন রাত করে, তার আগেই দাসী নানুর মা তার পিঠ চুলকে চুলকে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিত। কখনও ঘুমের মধ্যেই সে অনুভব করতে মা তার গালে আলতোভাবে চুমু দিচ্ছেন।

বৃজলালও তার মাকে অসম্ভব রকম ভালবাসত। বাপকে না পাওয়ার ক্ষুধা সে মায়ের মধ্যেই মিটিয়ে নিত। মা যখন তাকে বুকে জড়িয়ে মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করতেন, খোকা তুই বড় হয়ে খুব ভাল হবিতো’? আমার মনে কষ্ট দিবি না?

বালক বৃজলাল তখন মনে মনে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে বসত—যেমন করেই হোক ভাল সে হবেই। আর, সে কি যেমন—তেমন ভাল? পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ভাল। মাকে সে কক্ষনো কষ্ট দেবে না, সবাই তার মাকে দেখে বলবে, ওই যে ‘ভাল’ বৃজলালের মা!

মাকে তখন সে আরও—অনেক ভালবাসবে। আকাশের মতো অনেক!

কিন্তু মা ছেলের সেই ভালবাসায় একদিন ভাঙন ধরল। বিশাল কোনও নদীর ওপর কংক্রিটের সেতুতে হঠাৎ একদা যেমন ফাটল ধরে। মিশনারি এক স্কুলে ভর্তির হয়েছিল বৃজলাল। নীলরঙের কলারওয়ালা সাদা পোশাক পরে গলায় নীল টাই ঝুলিয়ে রোজ সে স্কুলে যেত। ফাদার রেক্টরকে আজও তার মনে পড়ে। ভয়ানক রাসভারী চেহারা ছিল তাঁর, ভীষণ কড়া মানুষ। পোশাকে একটু ময়লা বা বুটজুতোয় সামান্য কাদা লেখে থাকলে ধমকে দিতেন। স্কুল বসার আগে প্রার্থনার সময় কেউ উসখুস করলে, শাস্তি স্বরূপ ছুটির পরে একঘণ্টা আটকে থাকতে হত।

কিন্তু না, বৃজলাল কখনও আটকে থাকেনি। শুধু লেখাপড়ায় নয়, নিয়মানুবর্তিতা আর শান্ত ভদ্র ব্যবহারে সে জুনিয়রে ক্লাসে আদর্শ ছাত্র ছিল। অমন যে রাসভারী ফাদার রেক্টর, তিনিও বৃজলালের সঙ্গে হেসে কথা বলতেন।

.

জিনের গেলাসে একটা চুমুক দিলে বৃজলাল। জুনিয়র ক্লাসের সেই দিনগুলি কত মধুরভাবে কেটেছিল। কিন্তু তারপর? সেই দিনটা—সেই কালো কুৎসিত দিনটা একটা বিষাক্ত ক্ষতের চিহ্ন রেখে গেছে তার মনে। সে চিহ্ন এ জীবনে মুছবে না।

বৃজলাল তখন সিনিয়র ক্লাসের ছাত্র। লম্বা—চওড়া জোয়ান ছেলে।

একদিন তার সহপাযিঠী নীলকান্ত একখানা পত্রিকা এনেছিল। পত্রিকাখানা সিনেমা আর থিয়েটার সংক্রান্ত। অনেক রংবেরঙের ছবিতে ভরা। নীলকান্ত ছেলেটা ভদ্রলোকের এক কথার মতো বছর তিনেক ধরে একই ক্লাসে ছিল। পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে, সুতরাং স্কুলের মাইনেটা জমা পড়ত ঠিকই, কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে রুচি ছিল না নীলকান্তর। সে ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসে বসে নিবিষ্ট চিত্তে যা পড়ত, তা হয় সিনেমা—থিয়েটারের পত্রিকা, নয় প্রায় নগ্ন নারীমূর্তির ছবিওয়ালা স্বাস্থ্যবিষয়ক আমেরিকান ম্যাগাজিন, কিংবা ওই ধরনের আর কিছু।

নীলকান্তর নিজস্ব পাঠ্যপুস্তকগুলির প্রতি বৃজলালের কোনোদিনই কৌতূহল হয়নি। সে—অবকাশও তার ছিল না। নিজের পড়া নিয়েই সে ব্যস্ত থাকত। সেজন্য নীলকান্ত এবং লাস্ট বেঞ্চের অন্যান্য ছেলেদের কাছ থেকে ‘ভাল ছেলে’ ‘বিদ্যেসাগরের পকেট এডিশন’ ইত্যাদি দু—চারটে বাঁকা মন্তব্য মাঝে মাঝে তাকে শুনতে হয়েছে। বৃজলাল অবশ্য গ্রাহ্য করেনি।

কিন্তু সেদিন টিফিনের ঘণ্টায় নীলকান্তর হাতের পত্রিকাখানা হঠাৎ চোখে পড়ে যেতেই একবার নেড়েচেড়ে দেখার ইচ্ছে হল বৃজলালের।

চেয়ে নিল সে নীলকান্তর কাছ থেকে। সিনেমা—শিল্পীদের কতরকম ছবি। কত সাজে, কত ঢঙে। পাতার পর পাতা উলটে যায় বৃজলাল।

হঠাৎ একটা পৃষ্ঠায় তার চোখ যায় আটকে। সমস্ত চেতনা দুই চোখের তারায় জড়ো করে সে চেয়ে থাকে একখানা ছবির দিকে। সুন্দরী একটি নারীর ফোটো; এ নারীটিকে সে চেনে, অথচ চেনেও না। টানা টানা আশ্চর্য ওই দুটি চোখ বৃজলালের আজন্ম চেনা, কিন্তু সে—চোখে এ কেমনতর দৃষ্টি? পাতলা দুটি অধরে এ হাসিই বা কেমন ধারা? মাথায় আধ—ঘোমটা কই? ঘাড়ের কাছে নুয়ে—পড়া এলো খোঁপায় ফুলের মালা জড়ানো!

ছবির নীচে লেখা, বঙ্গ নাট্যাকাশের দীপ্তিময়ী তারা। আর, তার তলায় যে নাম লেখা, সেটা তার মায়ের নাম নয়। তবুও তার মায়েরই ছবি।

তার মা থিয়েটারের অভিনেত্রী! না, না, এ অসম্ভব।

বৃজলালের মুঠোয় জোর ছিল। পত্রিকাখানা তার শক্ত মুঠোর মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে বিশ্রী হয়ে গিয়েছিল। নীলকান্ত চটে গিয়ে বললে, এঃ অমন সুন্দর সুন্দর ছবিগুলো কি করলি বল দেখি!

উত্তরে বৃজলাল শুধু বলেছিল, বেশ করেছি।

তারপরে দলা পাকানো পত্রিকাখানা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল জানলা গলিয়ে। তার মুখ—চোখের পানে তাকিয়ে নীলকান্ত একটি কথাও আর বলেনি।

সেদিন বাড়ি ফিরে মাকেও সে কোনো কথা বলেনি। বারবার শুধু সেই ছবিখানার সঙ্গে মায়ের মুখখানা মিলিয়ে দেখেছিল। সেই মুখ কি এই মুখ?

ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি বৃজলাল। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি। সন্দেহ মেটাবার জন্যে সে যা করেছিল, আজ পরিষ্কার মনে আছে তার।

কখনও যা করেনি, সে একদিন তাই করল।

মায়ের বাক্স থেকে কয়েকটা টাকা চুরি করল। আর, সেই টাকা নিয়ে সে গেল থিয়েটারে একা। টিকিটও কিনল একখানা, কিন্তু ঢুকল না।

থিয়েটারের লবিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দেখতে লাগল অভিনেত অভিনেত্রীদের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিগুলো। সব ছবির মাঝখানে সুন্দর একটা ফ্রেমে সাজানো রয়েছে সেই পত্রিকায় দেখা ছবি। লবির ভিড়টা সেইখানেই বেশি।

ঢুকতে গিয়েও ঢুকতে পারে না বৃজলাল। কেমন ভয় ভয় করে। সে যা দেখতে চায় না, যদি থিয়েটারের ভেতরে গিয়ে তাই দেখতে পায়!

প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে বৃজলাল ঢুকল থিয়েটার—হলে। টর্চের আলো ফেলে একজন লোক তার আসন দেখিয়ে দিল। জীবনে তার সেই প্রথম থিয়েটারে আসা। সেই প্রথম আর সেই শেষ।

নিজের আসনে বসে বৃজলাল ভাল করে তাকাল স্টেজের দিকে। তার মা কোথায়? নেই তো’! একজন বৃদ্ধ, একটি যুবক আর একটি বউ কথা বলছে। তাদের কথা সে তেমন মন দিয়ে শোনেনি, শুধু রতনবাঈ নামটা বার কয়েক তার কানে এল। রতনবাঈকে নিয়েই এদের মধ্যে একটি অশান্তি দেখা দিয়েছে।

হঠাৎ স্টেজের আলো নিভে গেল, আর অন্ধকারের মাঝেই স্টেজটা ঘুরতে লাগল। আবার যখন আলো জ্বলে উঠল, তখন চমৎকার মেয়ে—গলার গান শুরু হয়ে গেছে। বৃজলাল দেখলে, একটা সুসজ্জিত ঘরের মাঝখানে ফরাস পাতা, তার একদিকে একজন সারেঙ্গী, আর একজন তবলা বাজাচ্ছে। অন্যদিকে আগের দৃশ্যে দেখা সেই যুবকটি আর তার দু’—চারজন বন্ধু তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসে। সামনে একটা বোতল আর গোটাকয়েক গেলাস। কিন্তু মাঝখানে ও কে? পরনে ঝলমলে পেশোয়াজ, পিঠে জরিজড়ানো দীর্ঘ বেণী, চোখে কাজল, ঠোঁটে রং—গানের তালে তালে ও কে নাচছে হাজার লোকের চোখের সামনে? ও কি রতনবাঈ, না তার মা?

চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল বৃজলালের। দপদপ করতে লাগল কপালের দু’পাশের রগ। নিজের নিঃশ্বাসে নিজেরই ঠোঁট পুড়ে যেতে লাগল। স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে উঠল সে, চীৎকার করে ডাকতে গেল, মা! কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোবার আগেই পেছনের আসনের এক দর্শক বলে উঠল, বসুন মশাই, বসুন।

মুহূর্তে বৃজলাল নিজেকে সামলে নিল। তারপর ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল প্রেক্ষাগৃহ থেকে। যেন সবাই জেনে ফেলেছে, সে থিয়েটারের অভিনেত্রীর ছেলে—যে অভিনেত্রী হাজার লোকের চোখের সামনে রং মেঘে বাঈজী সেজে দেহ দুলিয়ে নাচতে লজ্জা পায় না!

সেদিন অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিল বৃজলাল। দশটার পর।

মা জেগে বসেছিলেন। সেই মা! তেমনি সুন্দর শান্ত, টানা টানা চোখ দু’টিতে তেমনি মিষ্টি কোমল চাউনি, পরনে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। জন্ম থেকে যে মূর্তি দেখছে বৃজলাল।

এক মুহূর্তের জন্য সমস্ত জ্বালা জুড়িয়ে গেল তার। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল থিয়েটারের সেই দৃশ্য। স্টেজের ওপর ঝলমলে পেশোয়াজ পরে জরিজড়ানো বেণী দুলিয়ে রাঙা ঠোঁটে বিশ্রী একরম হাসি ছড়িয়ে রতনবাঈয়ের সেই নাচ!

আবার জ্বালা করে উঠল মনটা।

তবু সে কোনো কথা বলেনি। কোনো প্রশ্ন করেনি মাকে। মা খেতে ডাকায় শুধু বলেছিল, খিদে নেই। তারপর শুয়ে পড়েছিল নিজের বিছানায়।

মা একবার তার কপালে হাত দিয়ে দেখেছিলেন। আর কিছু বলেননি।

শুয়ে পড়েছিল বটে, কিন্তু ঘুম আসেনি প্রায় সারারাত। তাদের বাড়ির কাছে—পিঠে একটা রাজবাড়ির দেউড়িতে প্রহরে প্রহরে ঘণ্টা বাজতো। সে—রাতে শুয়ে শুয়ে বৃজলাল শুনেছিল বারোটা একটা দু’টো বেজে যাচ্ছে। এমনি করে সাড়ে তিনটেও বেজে গেল। খোলা জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া তার তপ্ত কপালে হাত বুলিয়ে দিল। জানলার একেবারে ধারেই যেন নেমে এল শেষরাতের ঝকঝকে বড় তারাটা। তারপর আর কিছু দেখেনি সে, আর কোনো শব্দও শোনেনি। ঘুমিয়ে পড়েছিল অগাধে।

সেদিন রাত সাড়ে তিনটি অবধি জেগে জেগে কি সব ভেবেছিল, বৃজলাল আজও তা ভুলে যায়নি।

বারবার একটা কথাই তার মনে চোরকাঁটার মতো খচখচ করছিল। তার মা থিয়েটারের নটী—বাঈজী সেজে রং মেখে দেহ দুলিয়ে হাজার লোকের চোখের সামনে নাচে। নীলকান্তর সঙ্গে তার বেশি মেলামেশা না থাকলেও তার মুখে সে শুনেছিল থিয়েটারের অভিনেত্রীরা ভাল হয় না, ভদ্র হয় না। ওই নীলকান্ত যখন শুনবে বৃজলালের মা ডায়মন্ড থিয়েটারের নাম—করা অভিনেত্রী, তখন কি ভাববে? কি বলবে সে বৃজলালকে?

অন্ধকারের মধ্যেও বৃজলাল যেন স্পষ্ট দেখতে পেল, নীলকান্তর মুখে বাঁকা হাসি, চোখে ঘেন্নার দৃষ্টি, ভঙ্গিতে তাচ্ছিল্য।

সেই বাঁকা হাসি, ঘৃণার দৃষ্টি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়বে আরও বহুজনের মুখে চোখে। সবাই এড়িয়ে চলবে তাকে, বন্ধু বলতে লজ্জা পাবে। অবজ্ঞা করবে। সামনে হয়তো কিছু বলবে না, কিন্তু আড়ালে মুখ বেঁকিয়ে বলবে, নটীর ছেলে!

আর্শ্চয, একটা রাতের মধ্যেই মানুষের পরিচয় আকাশ—পাতাল তফাত হয়ে যায়! কাল সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার কোনো ভদ্র পরিচয় থাকবে না। সে আর ভদ্রঘরের ছেলে নয়। একটা রাস্তার ছেলের সঙ্গে বৃজলালেরও আর কোনো তফাত নেই।

অথচ তার এই লজ্জাকর ঘৃণ্য পরিচয়টা এতদিন লুকিয়ে রাখাটাই তার জীবনে আরও বেশি লজ্জার। কাল থেকে কি করে সে মুখ দেখাবে স্কুলে? কেমন করে উঁচু মাথায় দাঁড়াবে সে ফাদার রেক্টরের সামনে?

আজ সে বুঝতে পারছে, কেন তার বাবা চুপিচুপি আসেন আর চুপিচুপি চলে যান। কেন থাকেন না তাদের সঙ্গে, কেন তাকে কাছে টেনে আদর করেন না। বাপ হয়েও ছেলেকে তিনি ঘৃণা করেন নিশ্চয়। সে যে নটীর ছেলে।

বৃজলালের মনে হল, তবে আর কেন ভদ্র হওয়ার চেষ্টা—ভাল হওয়ার প্রয়াস? হাজার পালিশ করলেও গিলটি কখনো সোনা হয়? কি হবে লেখাপড়া শিখে ভাল হয়ে? একটা নটীর ছেলেকে দুনিয়ায় কে ভাল বলে ভদ্র বলে স্বীকার করবে? সারা গায়ে তার মায়ের দেওয়া কালির দাগ লেগেছে, সেই কালো পরিচয় নিয়েই তাকে জীবন কাটাতে হবে।

না, অনর্থক সে আর ভদ্র হওয়ার চেষ্টা করবে না।

সে রাতে নিজের ওপর সহসা কেমন যেন নিষ্ঠুর আর হিংস্র হয়ে উঠেছিল ষোলো বছরের কিশোর বৃজলাল।

.