কুয়াশার রাত – ৬

ন—নম্বর ফ্ল্যাট থেকে রমেন যখন বেরিয়ে এল, তখন দুপুর। পার্ক স্ট্রিট ধরে শিস দিতে দিতে চলল সে। খুশি হলে সে শিস দেয়।

কাজ এখনো একটু বাকি আছে। অ্যাটর্নি সেন অ্যান্ড রায়ের অফিসে গিয়ে আজকের এই চমকপ্রদ খবরটা জানানো। ব্যাস, তা হলেই ছুটি।

কিন্তু আরেকটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল রমেন বোসের জন্য। অ্যাটর্নির অফিসে পৌঁছতেই, সিনিয়র পার্টনার সেন প্রায় লাফিয়ে উঠলেন : কোথায় ছিলে হে বোস? সকাল থেকে পাঁচ—পাঁচবার ফোন করেছি তোমাকে।

একটা চেয়ার টেনে নিয়ে রমেন বললে, কেন? কি ব্যাপার?

আর ব্যাপার! মিস্টার দত্তগুপ্ত হাসপাতালে।

হাসপাতালে মানে?

ক’দিন থেকেই ভীষণ পেটের যন্ত্রণা হচ্ছিল, আজ সকালে অপারেশন হয়েছে।

চেয়ারে সোজা হয়ে বসল রমেন, মাই গড! কাল যে কুন্তলের কেস—লাস্ট ডে। উপায়?

সেন বললেন, উপায় আর কি! কোর্টের অনুমতি নিয়ে রেখেছি, দত্তগুপ্তের বদলে কাল কোর্টে তুমিই অ্যাপিয়ার করো।

আমি!—রমেনকে হঠাৎ যেন বিছে কামড়াল। তারপর চেয়ারে হাত—পা এলিয়ে দিয়ে বললে, গুপ্তসাহেব এমনি করে জব্দ করল আমায়!

সেন বললেন, কেস তো তোমার জানাই আছে। তবু সন্ধেবেলা কাগজপত্র নিয়ে দত্তগুপ্তের জুনিয়র যাবে তোমার বাড়িতে।

গম্ভীর মুখে রমেন বললে, না গেলেই বাধিত হব। সন্ধের পর আমি একটু দাম্পত্য—কর্তব্য সারি।

দাম্পত্য—কর্তব্য! সেনের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, বিয়ে করেছ নাকি হে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। লাভ ম্যারেজ।

বটে! বটে! কার সঙ্গে?

নির্বিকার ভাবে রমেন জবাব দিলে, স্কটল্যান্ডের ভাটিখানার সঙ্গে।

অফিস—ঘর কেঁপে উঠল সেনের অট্টহাসিতে। রমেন একখানা স্লিপ টেনে নিয়ে খসখস করে একটা নাম লিখল। সেখানা সেনের হাতে দিয়ে বললে, কাল যেন এই নতুন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় সেন—সাহেব। চলি।

কিন্তু চলে যেতে গিয়েও ফিরে এল রমেন। ব্যস্ত হয়ে বললে, ভয়ানক ভুল হয়ে গেছে—র্যাশন কেনা হয়নি। গোটাকতক টাকা হবে?

একখানা বড় নোট বের করে সেন বললেন, তা হবে। কিন্তু কাল কোর্টে ঠিক সময়ে দেখা হবে কি?

নোটখানা পকেটে পুরে রমেন বললে, বাই স্কচ, সিওর ।

রহমেন চলে গেলে মিঃ সেন ভুরু কুঁচসকে স্লিপথানার দিকে তাকালেন। নতুন সাক্ষীর নাম লেখা রয়েছে—

সন্ধ্যামালতী দেবী

ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ম্যানসন

ফ্ল্যাট—৯

 * * *

ধীরে ধীরে সাক্ষীর ডকে উঠলেন নতুন সাক্ষী। সাদা শাড়ির কালো পাড় ঘিয়ে আছে তাঁর অত্যন্ত গৌরবর্ণ বিষণ্ণ মুখটিকে। টানা চোখ দুটি রক্তাভ, অল্প ফোলা।

আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ভূত—দেখার মতো চমকে উঠল কুন্তল। বিবর্ণ হয়ে গেল মুখ। চিৎকার করে বলতে গেল, ‘যাও তুমি, যাও,’ আওয়াজ বেরুল না গলা দিয়ে।

কালো গাউন দুলিয়ে, সিংহের মতো রাজকীয় ভঙ্গিতে পাবলিক প্রসিকিউটর সুরেন ভাদুড়ি এগিয়ে গেলেন নতুন সাক্ষীর কাছে। শপথ গ্রহণের পর শুরু হল জেরা।

আপনার নাম?

অপূর্ব মধুর গলায় জবাব শোনা গেল, সন্ধ্যামালতী দেবী।

কোথায় থাকেন?

ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ম্যানসনের ন—নম্বর ফ্ল্যাটে।

ঘটনার রাতে কোথায় ছিলেন?

আমার ঘরে।

জেগে ছিলেন?

ছিলাম।

আচ্ছা, ঘটনার বিষয় কি জানেন বলুন তো?

সন্ধ্যামালতী বলতে লাগলেন, তখন রাত বারোটা হবে। আমি অসুস্থ হয়ে শুয়েছিলাম ঘরে। হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার শুনতে পাই, আর তারপরেই সিঁড়িতে জুতোর দ্রুত আওয়াজ। ভয়ানক একটা কিছু ঘটেছে আশঙ্কা করে আমি অসুস্থ অবস্থাতেও দরজা খুলে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াই।

তাহলে আসামিকে আপনি পালাতে দেখেছেন নিশ্চয়?

মৃদু অথচ অতি স্পষ্ট গলায় সন্ধ্যামালতী বললেন, না! কুন্তল আমার ঘরেই ছিল। আমার জন্যে একটা কবিরাজী ওষুধ খলে মাড়ছিল তখন।

সুরেন ভাদুড়ির মোট ভুরু জোড়া কুঁচকে সেকেন্ড ব্র্যাকেট হয়ে গেল। কড়া পণ্ডিত মশায়ের মতো কঠোর স্বরে তিনি ধমকে উঠলেন, কি বলছেন আপনি জানেন?

সাক্ষীর ডক থেকে জবাব এল, জানি। যা সত্যি, তাই বলছি।

তাহলে আপনি বলতে চান যে, আসামি খুন করেনি?

স্থির শান্ত গলায় সন্ধ্যামালতী বললেন, না।

এক মুহূর্তের জন্যে নিশ্চুপ হয়েই আদালত—ঘর আবার গুঞ্জনে ভরে উঠল। কৌতূহলী দর্শকদের দৃষ্টির সামনে সন্ধ্যামালতী মাথার কাপড় আরও একটু টেনে দিলেন! আর আসামির কাঠগড়া থেকে নিষ্পলক চোখে কুন্তল চেয়ে রইল তাঁর দিকে।

কিন্তু এত সহজে দমবার পাত্র নন সুরেন ভাদুড়ি। বহু ক্রিমিন্যাল কেস করে করে তিনি মামলা—বিশারদ হয়েছেন। ছাঁটা গোঁফের নিচে কুটিল হাসি হেসে তিনি প্রশ্ন করলেন নতুন সাক্ষীকে, আচ্ছা, সে—রাতে আসামি কুন্তল কতক্ষণ ছিল আপনার ঘরে? প্রায় ঘণ্টাখানেক।

তারপরে?

স্টুডিওতে চলে যায়।

আসামি কুন্তল যখন আপনার ঘরে ছিল, তখন তার গায়ে কি ছিল বলতে পারেন?

সবুজ রঙের গরম কোট।

আর টাই? কি রঙের ছিল মনে আছে?

লাল রঙের।

যেন বহুপ্রার্থিত কোনো হারানো জিনিস খুঁজে পেয়েছেন, এমনি মুখের ভাব নিয়ে ভাদুড়ি এজলাসের দিকে তাকিয়ে পুনরুল্লেখ করলেন, সবুজ কোট, লাল টাই! তারপর পাকা খেলোয়াড় যেমন কর্নার থেকে গোলে বল মারে, তেমনি করেই প্রশ্ন করলেন, আসামি কুন্তল যদি না—ই খুন করে থাকে, তবে এ—কথাটা পুলিশকে বা আদালতকে এতদিন জানাননি কেন আপনি?

সন্ধ্যামালতীর মুখখানা আরও ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। কোনো কথা বেরোল না তাঁর মুখ দিয়ে।

বলুন, কি উদ্দেশ্যে কথাটা চেপে রেখেছিলেন?

সন্ধ্যামালতী তবু নির্বাক।

বিজয়ী সিংহের মতো গ্রীবাভঙ্গি করে ভাদুড়ি বললেন, ইওর অনার, সাক্ষীর কাছে আর কোনো প্রশ্ন আমার নেই। শুধু মাননীয় জুরিদের কাছে আমার শেষ কথা বলতে চাই।

তারপর কালো গাউন দুলিয়ে তেমনি রাজকীয় ভঙ্গিতে জুরিদের বেঞ্চের দিকে এগোতে এগোতে বলতে লাগলেন, সাক্ষী সন্ধ্যামালতী দেবীর উক্তি কতখানি যথার্থ, তা আপনাদেরই বিচার করে দেখতে অনুরোধ করি। তাঁর সাক্ষ্য যেমন অসঙ্গতিপূর্ণ তেমনি অবিশ্বাস্য। আপনাদের স্মরণ থাকতে পারে, নিহতা শোভার প্রতিবেশী যমুনা লালা তাঁর সাক্ষ্যে বলেছেন যে, সবুজ কোট আর লাল টাই পরে আসামিকে তিনি চারতলা থেকে স্বচক্ষে নেমে যেতে দেখেছেন। অথচ সন্ধ্যামালতী বলছেন, ঠিক সেই সময় আসামি ওই একই পোশাক পরে দোতলায় তাঁর ঘরে বসে ‘খলে’ ওষুধ মাড়ছিলেন। একই পোশাকে একই ব্যক্তির একই সময়ে দু—জায়গায় উপস্থিতিটা ভৌতিক ব্যাপার বলে মনে হয় না কি? তাছাড়া, সন্ধ্যামালতী বলেছেন, ঘটনার প্রায় ঘন্টাখানেক পরে আসামি কুন্তল ওই বাড়ি থেকে চলে যায়। তাঁর এ—কথাও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। কেননা, হত্যাকাণ্ডের ঠিক আধ ঘন্টার মধ্যেই ওই ম্যানসনের সদরে কড়া পুলিশ—পাহারা মোতায়েন হয়ে যায়। সবুজ কোট, লাল টাই পরা কোনো লোককে তারা ঢুকতে বা বেরোতে দেখেনি। সন্ধ্যামালতী বলেছেন বটে, আসামি কুন্তল খুন করেনি, কিন্তু তাঁর এই উক্তির স্বপক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণও দেখাতে পারেননি? তাছাড়া তিনি তাঁর এই সাক্ষ্য এতদিন কেন গোপন করেছিলেন, সে—বিষয়ে তাঁর অদ্ভুত নীরবতা সন্দেহজনক নয় কি? এক্ষেত্রে সন্ধ্যামালতীর সাক্ষ্য—বিবৃতি সত্য না মিথ্যা দিয়ে তৈরি, তা আপনারাই বুঝে দেখুন।

এক সেকেন্ড থামলেন সুরেন ভাদুড়ি। জুরিরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে তাঁর বক্তৃতা। মনে মনে খুশি হয়ে গুরুগম্ভীর আওয়াজে আবার তিনি শুরু করলেন, মাননীয় জুরিগণ, এই মামলার প্রথম দিকে আমি বলেছিলাম, পৃথিবীতে জঘন্যতম পাপ হচ্ছে নরহত্যা। আজও সেই কথাই বলছি। পূর্ববর্তী তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে পরিষ্কার ভাবে বোঝা গেছে যে, ২৬শে মাঘ রাতে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ম্যানসনের নর্তকী শোভা ইম্যানুয়েলকে আসামি কুন্তল চ্যাটার্জিই খুন করে পালিয়েছিল। হত্যাকারী কুন্তল এবং নিহতা শোভা—দুজনেই গারাজনা জগতের লোক—সুতরাং দুজনের মধ্যে যোগাযোগ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। অথচ আসামি কুন্তল চ্যাটার্জি সমাজে একজন ভদ্র সৎ—চরিত্র যুবক, একজন কৃতী সঙ্গীতশিল্পী বলে সুখ্যাত। এই ধরনের মুখোশধারী শয়তানেরাই সমাজের পরম শত্রু। সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মুখ চেয়ে ওই খুনি আসামির কঠোর শাস্তি হওয়াই কি উচিত নয়? মাননীয় জুরিগণ, আজ ন্যায়ের তুলাদণ্ড হাতে আপনারা বিচারের আসনে বসেছেন। আপনাদের মহান দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমি আমার বক্ত্যব শেষ করলাম।

সার্কাসের খেলোয়াড় যেমন খেলা শেষে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানায়, তেমনি করে এজলাসের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে পাবলিক প্রসিকিউটর সুরেন ভাদুড়ি নিজের আসনে বসলেন। তাঁর গুরুগম্ভীর স্বর গমগম করতে লাগল আদালতকক্ষে।

জজসাহেব বললেন, এবার আসামি পক্ষের কাউন্সেল সাক্ষীদের জেরা করতে পারেন।

কিন্তু জেরা করবে কে? দেখা গেল ডিফেন্স কাউন্সিলের আসন শূন্য। গুনগুন ধ্বনি উঠল দর্শক—মহলে।

দত্তগুপ্তের জুনিয়র উৎকণ্ঠায় এদিক—ওদিক তাকাতে লাগল। কোথায় রমেন বোস? অ্যাটর্নি সেন প্রমাদ গুনলেন। রমেন বোস কি সত্যিই ডোবালে মামলাটা? কি ভুলই করেছেন তিনি গতকাল তার হাতে একশো টাকার নোটখানা দিয়ে! সাধে কি আর লোকে তাকে মাতাল বোস বলে!

জজসাহেবে আবার বললেন একটু গলা চড়িয়ে, আসামিপক্ষ সমর্থনের জন্যে কেউ আছেন কি আদালতে?

ইয়েস মি লর্ড!

আদালত—ঘরের ও—প্রান্ত থেকে এটা সুপরিচত কণ্ঠের সাড়া ভেসে এল। উদগ্রীব হয়ে তাকালেন জজসাহেব, তাকালেন সুরেন ভাদুড়ি, জুনিয়র ব্যারিস্টার, অ্যাটর্নি, দর্শকমণ্ডলী সবাই। দেখা গেল, দর্শকের ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছে কালো গাউন পরা দীর্ঘাকার একটি অতি পরিচিত মূর্তি। রমেন বোস!

এজলাসের সামনে এগিয়ে এসে স্মিত মুখে সহজ গলায় রমেন বোস বললে, আজকের এই বিচার—সভায় আমার আসার কথা নয়! কিন্তু সুযোগ্য ডিফেন্স কাউন্সেল মিস্টার দত্তগুপ্ত হঠাৎ গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে আসতে হল। দুনিয়ায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ন্যায়ের পক্ষ সমর্থনের অধিকার সকলেরই আছে, ব্যারিস্টারের অধিকারের চেয়েও সর্ব মানুষের সেই অধিকার অনেক বড়। সেই বৃহত্তর অধিকার নিয়েই আমি আজ এখানে এসেছি।

মি লর্ড, জেন্টলমেন অফ দি জুরি, দর্শকদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি এতক্ষণ পাবলিক প্রসিকিউটর মহোদয়ের ওজস্বিনী বক্তৃতার তারিফ করছিলাম। আমার বিশ্বাস, আদালতের বদলে তিনি রঙ্গমঞ্চে যোগ দিলে, বোধ করি শিশির ভাদুড়ির সমতুল্য শিল্পী হতে পারতেন। কিন্তু ব্যারিস্টারের আসল কাজ হল সত্যকে খুঁজে বার করা! বহু প্রশ্ন, বহু জেরা, বহু তর্কেও আমার সহযোগী মিস্টার ভাদুড়ি সত্যকে খুঁজে পেয়েছেন বলে মনে হয় না। তাঁর সত্যানুসন্ধানে সাহায্য করবার জন্যেই আমি শুধু একটি সাক্ষীকেই জেরা করব। তিনি হলেন সন্ধ্যামালতী দেবী।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যামালতী আবার সাক্ষীর ডকে উঠলেন।

স্মিত মুখে রমেন বোস এগিয় গেল তাঁর সামনে। ধীর নম্র স্বরে প্রশ্ন করল, আপনি তো বিবাহিতা?

স্বাক্ষীর ডক থেকে জবাব এল, হ্যাঁ।

স্বামী জীবিত?

না।

আপনার স্বামীর নাম?

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সন্ধ্যামালতী বললেন, হিন্দু স্ত্রীকে স্বামীর নাম মুখে আনতে নেই।

একটা প্যাড আর পেন্সিল এগিয়ে দিয়ে রমেন বললে, তাহলে লিখে দিন।

আমি লেখাপড়া জানি না।

মৃদু হাসলে রমেন বোস। তারপর পেন্সিলটা প্যাডের ওপর ঠুকতে ঠুকতে প্রশ্ন করলে, অধ্যাপক কমলেশ চ্যাটার্জিকে আপনি চিনতেন?

পাথর হয়ে গেলেন সন্ধ্যামালীত। আর, আসামির কাঠগড়া থেকে চিৎকার করে উঠল কুন্তল, না, না, চেনেন না—কোন দিনও চিনতেন না।

আদালত—ঘরে চাঞ্চল্য দেখা গেল! জজসাহেব হাতুড়ি ঠুকলেন, অর্ডার, অর্ডার!

রমেন বোস সন্ধ্যামালতীর একেবারে কাছে সরে গেল। কোমল অন্তরঙ্গ সুরে বলতে লাগল, আপনারই জবাবের ওপর একটা মানুষের মরা—বাঁচা নির্ভর করছে। চুপ করে থাকবেন না—কাল আমাকে যা বলেছিলেন, তা যদি সত্য হয়, তবে বলুন, কমলেশ চ্যাটার্জি আপনার কে?

আমার স্বামী।—সন্ধ্যামালতীর অপূর্ব মধুর গলা কেঁপে গেল।

কি ভাবে আপনাদের বিয়ে হয়?

রেজিস্ট্রি করে।

হিন্দু মতে নারায়ণ আর অগ্নিসাক্ষী করে হয়নি কেন?

আমি থিয়েটারের অভিনেত্রী ছিলাম, তিনি ছিলেন সমাজের মানী ব্যক্তি। তাই গোপনে আমাদের বিয়ে হয়েছিল।

শোনা যায়, কমলেশ চ্যাটার্জির আরেকটি স্ত্রী ছিলেন। কথাটা কি সত্য?

সত্য। তিনিই হিন্দুমতে বিবাহিতা স্ত্রী।

পেন্সিলটা চিবুকে ঠেকিয়ে রমেন বললে, কুন্তল তাহলে কার ছেলে? মানে, কোন স্ত্রীর গর্ভজাত? আপনার?

সন্ধ্যামালতী বললেন, না। আমার স্বামীর প্রথমা স্ত্রীর সন্তান।

আপনি তাহলে কুন্তলের বিমাতা? আপনার কোনো সন্তান আছে?

একটি মাত্র ছেলে।

কত বড়?

কুন্তলের চেয়ে দু—বছরের ছোট।

দেখতে কেমন?

কুন্তলেরই মতো মাঝামাঝি লম্বা, দোহারা স্বাস্থ্যবান চেহারা। তফাত শুধু রঙ আর মুখের গড়নে।

এজলাসের দিকে ফিরে রমেন বলে উঠল, মি লর্ড, সাক্ষীর এই কথাগুলিই বিচারাধীন হত্যারহস্যের চাবিকাঠি।

তারপর সন্ধ্যামালতীকে আবার প্রশ্ন করলে, আচ্ছা, কুন্তলের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন? সাধারণত সৎ মায়ের সঙ্গে সতীনের ছেলের সম্পর্ক যেমন হয়, তেমনি?

সন্ধ্যামালীত একবার তাকালেন আসামির কাঠগড়ার দিকে। নিবিড় মমতায় স্নিগ্ধ হয়ে এল তাঁর মুখ। স্নেহসিক্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, না। কুন্তল আমার আপন সন্তানেরও অধিক। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর তার সেবা, তার সাহায্য না পেলে আমি বাঁচতাম না।

কিন্তু কুন্তল যদি আপনার সন্তানের অধিক হয়, তবে তার এত বড় বিপদে এতদিন আপনি চুপ করে ছিলেন কেন? তদন্তের সময় কেন পুলিশকে বলেননি যে, খুনের সময় কুন্তল আপনারাই ঘরে ছিল?

ছলছলিয়ে এল ঘন কালো টানা চোখ দুটি। নতমুখে সন্ধ্যামালতী বললেন, তখন ভাবিনি যে ওর ফাঁসি অবধি হতে পারে।

আচ্ছা সে—রাতে কুন্তল কখন চলে গিয়েছিল আপনার ঠিক মনে আছে কি?

আছে। খুনের প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে।

সদরে পুলিশ—পাহারা এড়িয়ে গেল কি করে।

সদর দিয়ে সে যায়নি। হাঙ্গামার ভয়ে আমি তাকে ধাঙ্গড় আসা—যাওয়ার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে দিয়েছিলাম পাশের গলিতে।

স্মিত মুখে রমেন বোস বললে, আদালতের তরফ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সন্ধ্যামালতী দেবী। আমার আর একটি মাত্র প্রশ্ন বাকি আছে। ঘটনার রাতে চিৎকার শুনে, আপনার ফ্ল্যাটের দরজা খুলে কাকে দেখতে পেয়েছিলেন সিঁড়িতে? দ্রুত পায়ে কে নেমে আসছিল চারতলা থেকে?

সন্ধ্যামালতীর মুখ থেকে কে যেন শেষ রক্তবিন্দুটুকু পর্যন্ত শুষে নিলে। পাংশু হয়ে গেল পাতলা ঠোঁট দু’খানা। সাক্ষীর ডকের রেলিং ধরে নতমুখ দাঁড়িয়ে রইলেন আড়ষ্ট হয়ে। কোনো জবাব এল না তাঁর কাছ থেকে।

ধীর—গম্ভীর গলায় রমেন বোস আবার জিজ্ঞেস করলে, বলুন, সে—রাতে কাকে দেখেছিলেন সিঁড়িতে?

শ্বেতপাথরের মূর্তির মতো বোবা হয়ে রইলেন সন্ধ্যামালতী। সেই কঠিন বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে রমেন বোসেরও মুখের চেহারা বদলে যেত লাগল। ব্যগ্র কণ্ঠে বললে, বলুন, জবাব দিন আমার প্রশ্নের। আপনার জবাবের ওপর এই মামলার বিচার নির্ভর করছে সন্ধ্যামালতী দেবী।

শ্বেতপাথরের মূর্তি তবু মুখ খুলল না।

হাল ছাড়লে না রমেন বোস, আবেগ—স্পন্দিত গলায় আবার বলতে লাগল, তাকিয়ে দেখুন ওই আসামির কাঠগড়ার দিকে। যে লোকটি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, একটু আগে তাকেই আপনি বলেছেন সন্তানের অধিক, যার সেবা আর সাহায্য না পেলে আপনি বাঁচতেন না। সেই ছেলেকে আজ আপনি বাঁচাবার চেষ্টা করবেন না? হলেনই বা বিমাতা, তবু তো আপনি মা! আমি মিনতি করছি সন্ধ্যামালতী দেবী, যা সত্য, তাকে আলোয় আসতে দিন। বলুন, ঘটনার রাতে সিঁড়ি দিয়ে কাকে নেমে আসতে দেখেছিলেন?

সন্ধ্যামালতীর দুই চোখ তখন অশ্রুতে ভেসে গেছে। থরথর করে কাঁপছে তাঁর পাংশু দু’খানা ঠোঁট। সজল কম্পিত কণ্ঠে উচ্চচারণ করলেন, কুণাল।

কে সে?

আমার নিজের ছেলে।

কি করে?

জাহাজে কাজ করত।

.

খিদিরপুরে হংকং কাফে জাহাজি খালাসিদের একটা বিখ্যাত আড্ডা। ইতালি, স্পেন, চিন, জাপান, লিভারপুল, মোম্বাসা, আরও নানা দূর দেশ থেকে কত বাণিজ্য—জাহাজ এসে নোঙর ফেলে খিদিরপুর ডকে। দিন কয়েক—বড় জোর মাসখানেক থাকে, মাল খালাস করে, মাল বোঝাই করে, নতুন রং লাগায়।

তারপর আবার একদিন জাহাজের ঠাণ্ডা ইঞ্জিন চলার উৎসাহে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আকাশে আকাশে ভোঁ বাজিয়ে, বৃহৎ চাকায় গঙ্গার গেরুয়া জল কাটতে কাটতে নীল সমুদ্রের ডাকে উতলা হয়ে রওনা দেয়। যাযাবর জাহাজ! ফেলে—আসা বন্দরের স্মৃতি তার মনেও থাকে না।

জাহাজের যারা খালাসি মাল্লা, তারাও যাযাবর। জীবনের বারো আনা সময় তারা সাগর—পথিক, চার আনা সময় মাটির সঙ্গে সম্পর্ক। বন্দরের মাটিতে পা দিয়েই তাদের মনে হয়, এটা দু’দিনের বাসা।

দু’দিনের হলেও এখানে তারা অনেকখানি স্বাধীন। জাহাজে কাপ্তেনের রাজত্ব, কড়া শাসন। সেই শাসনের শিকল থেকে সাময়িক মুক্তি দেয় বন্দরের মাটি। তাই বন্দর তাদের কাছে লোভনীয় রমণীয় মোহময়।

হংকং কাফে জাহাজি মাল্লাদের একটা মধুচক্র বিশেষ। সুন্দর একটা বাগানের মধ্যে এই পানশালাটি। সন্ধে হলেই এই কাফে রূপসী বারনারীর মতো সেজেগুজে দেশ—বিদেশের খালাসিদের হাতছানি দেয়।

পণ্যানারীদেরও আসা—যাওয়া আছে এখানে। রঙিন পানীয়ের সঙ্গে রং—করা রূপেরও দরদস্তুর চলে। তারপর একসময় টলটলায়মান তরুণ খালাসি সাহেবের বাহুলগ্না হয়ে তার মায়ের বয়সী ভাড়াটে প্রণয়িনী গালে রুজ আর ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে, বাঁধানো দাঁতের হাসি হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়।

হংকং কাফেতে রোজই ভিড়। ঝলমলে আলোয়, উচ্ছল নাচ—গানে, উদ্দাম হাসিতে সন্ধে থেকে প্রায় সারারাতই এই পানশালা জমজমাট। কে আসে, কে যায়, কে তার খোঁজ রাখে!

তবু খোঁজ রাখতে হয় এক জাতের মানুষকে। তাদের নাম পুলিশ। মাঝে মাঝে হুস হুস করে একখানা জিপ জীবন গাড়ি এসে থামে, তারা নেমে গটগট করে হলঘরের মধ্যে চলে যায়, একে প্রশ্ন করে, ওকে জেরা করে। পানরত ভ্রমরকে জামার কলার ধরে টেনে নিয়ে যায়। পরদিন শোনা যায়, তারা ফেরারি আসামি।

হংকং কাফে বড় বিচিত্র জায়গা।

.