কুয়াশার রাত – ৫

 ৫

বিকেল থেকেই দীপু বায়না ধরেছে, ‘রাণুমাসির বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে যাব।’ মিতালি কান দেয়নি। কিন্তু সন্ধের পর তার বায়না আদুরে কান্নার পর্যায়ে উঠল। ঠাকুরকে রাতের রান্না বুঝিয়ে দিতে দিতে, মিতালি দীপুর একঘেয়ে কান্না শুনতে পেল: ‘ওরে আমি রাণু মাসির বিয়েতে যাব রে। ওরে আমি নেমন্তন্ন খাব রে।’

রান্নাঘর থেকে শোবার ঘরে এসে দাঁড়াল মিতালি।

এই, চুপ কর!

কোঁকড়া চুলের গোছা দুলিয়ে দীপু বললে, আগে রাণুমাসির বিয়েতে চলো, তবে চুপ করব।

না, আমাদের যেতে নেই।

কেন যেতে নেই? আমাদের তো নেমন্তন্নর চিঠি পাঠিয়েছে।

পাঠাক। তবু আমাদের যেতে নেই। আমরা যাব না।

দীপু তৎক্ষণাৎ আবার সুর ধরলে, ওরে আমি রাণুমাসির বিয়েতে —ইত্যাদি।

বাইরের অন্ধকার বারান্দায় ভূতের মতো চুপ করে বসে ছিল কুন্তল। আলো জ্বালেনি। বাড়ি থেকে বেরুনো আজকাল প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। সারাটা দিন বহুবার পড়া বইগুলো আবার ওলটায়, নয়তো চুপচাপ কি যেন ভাবে। গভীর রাতে কখনও ঘুম ভেঙে গেলে মিতালি দেখেছে, অন্ধকার বারান্দায় একা একা বিনিদ্র কুন্তল পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। প্রেসিডেন্সি জেলে সেই কালাপানি—যাত্রী ‘দায়মলি’দের মতো। দীপুর কান্না শুনে কুন্তল উঠে ঘরে এসে দাঁড়াল। অসীম বিরক্তিতে মিতালি তখন দীপুর কান ধরে ধমকাচ্ছে, চুপ কর বলছি—চুপ কর—

কুন্তল আস্তে আস্তে বললে, দীপু নেমন্তন্ন খেতে ভালোবাসে, রাণুদের ওখানে গেলেই তো হয়।

দীপুর কান ছেড়ে দিয়ে, মিতালি সংক্ষেপে জবাব দিল, না।

গেলে ক্ষতিটা কি? রাণু তোমার আপন খুড়তুতো বোন, সামাজিকতার দিক থেকেও—

কি এক মর্মান্তিক জ্বালায় মিতালির দুই চোখ দপ করে জ্বলে উঠল। ধাতব গলায় বললে, কোন মুখে বলছ শুনি? বিয়েবাড়িতে যাব দশজনের টিটকিরি শুনতে? আমাদের আবার সামাজিকতা কি? আমরা সমাজের বাইরে, আমরা হাড়ি—মুচিরও অধম!

আগুনের হলকার মতো মিতালি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাপ—মায়ের কথা—কাটাকাটিতে ঘাবড়ে গিয়ে দীপু কিছুক্ষণ থেমেছিল, মা চলে যেতেই সানাইয়ের পোঁ ধরার মতো সেও ছেড়ে দেওয়া সুর তোড়ে ধরলে, ওরে আমি ইত্যাদি।

নিমেষে কুন্তলের মাথার মধ্যে কি যেন ঘটে গেল। আলনা থেকে টেনে নিল দীপুরই প্যান্টের বেলট। তারপর সপাং করে একটা আওয়াজ, আর একটা আর্ত—চিৎকার! দ্বিতীয় বার হাতখানা তুলতেই আর একটা হাত এসে বেলট চেপে ধরল।

‘থাক। তোমার হাতের মার ও সইতে পারবে না—মরে যাবে।’ চোখে—মুখে অপরিসীম ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা নিয়ে মিতালি চরম কথাটা উচ্চচারণ করলে, ‘খুনির হাত কিনা!’

কি বললে?—গলা চিরে চিৎকার করে উঠল কুন্তল। প্রচণ্ড ভূমিকম্পে তার পায়ের তলায় মেঝেটা যেন দুলছে। অবশ হাত থেকে খসে পড়ল বেলটটা। তারপর অসমছন্দে পা ফেলে ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অন্ধকার বারান্দায়—বারান্দা থেকে সিঁড়িতে—সিঁড়ি থেকে রাস্তায়—

মিতালি ডাকলে না।

 * * *

পথেরও শেষ নেই, চলারও শেষ নেই যেন। আকাশে একটি তারা থেকে অনেক তারা উঠল, তবু কুন্তল ঘুরছে পথে পথে। খুনির হাত! যে—হাত একদা পিয়ানোর ওপর বিদ্যুৎলীলায় খেলে বেড়াত। যে—হাতের সরু লম্বা আঙুল দেখে মিতালী নিজেই বলেছিল, ‘তোমার আঙুলগুলো মোজার্টের মতো—টিপিক্যাল আর্টিস্টের হাত!’ সেই শিল্পীর হাত সত্যই আজ খুনির হাত হয়ে গেছে, নইলে দীপুর কচি গায়ে এ হাত আঘাত হানল কি করে?

পথ চলতে চলতে কুন্তলের মনে হল, আশেপাশে সবাই যেন বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে, আর ফিসফিস করে বলছে, ওই দেখ খুনি!

সামনের দেয়ালে দৃষ্টি পড়তেই কুন্তল থমকে গেল। বাণী চিত্রমের ‘পুষ্পবাসর’ ছবির একটা রঙিন পোস্টার। রক্তের মতো লাল টকটকে হরফগুলো জ্বলছে—’সুরশিল্পী কুন্তল চ্যাটার্জি’।

দেখতে দেখতে হঠাৎ ‘সুরশিল্পী’ কথাটা মিলিয়ে গিয়ে ফুটে উঠল ‘খুনী’? হিংস্র হয়ে উঠল কুন্তলের চোখ দুটো। দু—পা এগিয়ে একটানে চড়চড় করে ছিঁড়ে ফেললে পোস্টারখানা। আর, ঠিক সেই মুহূর্তেই তার ঘাড়ে কে যেন হাত রাখলে। সেই হাতে উষ্ণ বন্ধুতার স্পর্শ। কুন্তল মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই লোকটা হাসল। মিষ্টি প্রসন্ন হাসি। হেসে বলল, আরে বা! চিনতে পারছ না নাকি? আমি রমেন বোস হে!

অবাক হয়ে চেয়ে রইল কুন্তল।

রমেন বললে, মনে পড়ে সেন্ট জেভিয়ার্সে সেই ফাদার জোশেফ, ডিবেটিং ক্লাবে তোমার—আমার সেই কথার লড়াই, গ্রীষ্মের ছুটির আগে সেই থিয়েটার—একবার ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ নাটকে তুমি সাজলে রোজালিন্ড আর আমি ওরল্যান্ডো। কি হে, ভুলে গেছো নাকি দোজ গ্রিন ইয়ার্স অফ আওয়ার লাইভস?

ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসতে লাগল কুন্তলের মুখের কুঞ্চন। নিভে এল দু—চোখের খরদ্যুতি। একটা ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে উদাস গলায় বললে, কিছুই ভুলিনি রমেন।

বহুদিন দেখা নেই, তোমার ওখানে যাব ভাবছিলাম। পথে দেখা হল, ভালোই হল। জরুরি কাজ নেই তো এখন? চলো আমার ওখানে, বেশ জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাক। ট্যাক্সি।

কোনো কথা বলবার অবকাশ না দিয়ে কুন্তলকে ট্যাক্সিতে তুলে নিলে রমেন।

চৌরঙ্গি দিয়ে যেতে যেতে রমেন হঠাৎ বলে উঠল, ড্রাইভার সাহেব, একটু বাঁয়ে রাখো। আমার র্যাশন নিতে হবে।

রাস্তার বাঁয়ে একটা স্টোর্স, বড় বড় করে সাইনবোর্ডে লেখা—ওয়াইন অ্যাণ্ড প্রভিসন। ‘জাস্ট এ মিনিট’ বলে রমেন নেমে গেল।

ব্রাউন পেপারে মোড়া একা বোতল হাতে দোকান থেকে বেরোতেই তার কানে ভেসে এল, ‘শ্যারাবী যা—যা—যা।’

মনে মনে গানটার তারিফ করে এদিক—ওদিক তাকাতেই রমেন দেখলে, পাশেই একটা গ্রামোফোনের দোকান। এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলে সে, তারপর ট্যাক্সি লক্ষ্য করে বললে, একবার নেমে আয় তো কুন্তল, দু—একটা রেকর্ড বেছে দিবি।

দোকানে ঢুকে রমেন বললে, বিলিতি রেকর্ড রাখেন?

দোকানি সবিনয়ে নিবেদন করলে, আজ্ঞে রাখি।

কিছু অর্কেস্ট্রার রেকর্ড শোনান তো!

খান দুয়েক রেকর্ড বাজাবার পর রমেন জিজ্ঞেস করলে, জ্যাক স্টিফেনের লেটেস্ট অর্কেস্ট্রা আছে?

ঘাড় নেড়ে দোকানি মেশিনে চাপাল জ্যাক স্টিফেনের সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা। আর, রুদ্ধনিশ্বাসে রমেন দু—চোখের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করে চেয়ে রইল কুন্তলের মুখের পানে। কিন্তু এ কি দেখছে সে? শান্ত সমাহিত মুখ, স্বপ্নগভীর দুই চোখ। জ্যোৎস্নারাতের সমুদ্রে মতো উদ্বেলিত সুর—মূর্ছনায় ডুবে গেছে শিল্পীর আত্মা। রেকর্ড থামলে ধীরে ধীরে কুন্তল বললে, অপূর্ব? এইখানাই নাও।

ট্যাক্সিতে ফিরে এসে রমেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। যে ঘরে জ্যাক—স্টিফেনের অর্কেস্ট্রা বাজে, সেখানে আর যেই পারুক, কুন্তল চ্যাটার্জি খুন করতে পারে না কখনও। আইনের চোখে এটাকে হয়তো একটা বড় রকমের সাফাই হিসাবে খাড়া করা যায়। তবু মনে মনে জোর পাচ্ছে না রমেন। আসল রহেস্যের কিনারা হল কই? ২৬ মাঘের সেই কুয়াশার রাতে কুন্তল কেন গিয়েছিল ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ম্যানসনে? কেন? কেন? কেন?

কুয়াশার রাত কি কাটবে না?

 * * *

দুটি সিগারেট থেকে নীলচে ধোঁয়ার দুটি সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। ড্রয়িংরুমে সবুজ ঘেরাটোপে ঢাকা আলোর নিচে মুখোমুখি বসে আছে দুই বন্ধু।

ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ম্যানসনে তুমি ঘটনার রাতে গিয়েছিলে, এ—কথা আদালতে স্বীকার করতে গেলে কেন কুন্তল?

পারলাম না রমেন—মিথ্যে বলার চেষ্টা করেও সত্যটাই বেরিয়ে গেল।

রমেনের গলা সহৃদয়তার কোমল হয়ে এল: তোমার মতো একটা আর্টিস্টের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তোমার স্বীকারোক্তি তোমারই বিপক্ষে কতখানি গেছে, তা বোঝ?

বুঝি?

ওই বাড়িতে তুমি কি সে—রাতে প্রথম গিয়েছিলে?

না। আগেও যেতাম।

আগেও যেতে! (দুর্বার কৌতূহলে রমেনের দুই চোখ দীপ্ত হয়ে উঠল) কার কাছে কুন্তল? নর্তকী শোভার কাছে?

না। চোখেই দেখিনি তাকে।

তবে কেন যেতে, কার কাছে যেতে?

কুন্তলের মুখে ছায়া পড়ল। বললে, ও—কথা জিজ্ঞেস কোরো না রমেন, জবাব দিতে পারব না।

ছায়া রমেনের মুখেও পড়ল। তবু কণ্ঠে আরও সহৃদয়তা এনে বললে, আমি তোর পুরনো বন্ধু, আমাকে বলতে বাধা কিসের?

এতক্ষণ সহজ ভাবে কথা বলছিল কুন্তল, হঠাৎ মনে মনে শামুকের মতো গুটিয়ে গেল। বললে, ও প্রশ্ন থাক।

‘ছেলেমানুষী করিস নে কুন্তল।’ রমেন উঠে এসে কুন্তলের পাশে বসল, ‘মিতা আর দীপুর’ মুখ চেয়ে বলতেই হবে তোকে। না বললে, প্রমাণ না দিলে আদালত বিশ্বাস করকে কেন যে, ঘটনার রাতে শোভা ইম্যানুয়েলের ঘরে তুই ছিলি না? বল কার ঘরে ছিলি—কে সে?

‘না—না—না, বলতে পারব না আমি—বলার উপায় নেই।’ কুন্তলের কঠিন মুখখানা লাল হয়ে উঠল এক অবরুদ্ধ আবেগে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলে উঠল, তার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক ইজ্জৎ জড়িয়ে আছে রমেন—প্রকাশ হলে আমার স্বর্গগত বাবর নামে কলঙ্ক পড়বে!

তারপর হঠাৎ উঠে ঘরের বাইরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

 * * *

সে—রাতে ল্যান্সডাউন রোডের একটি বাড়ির ড্রয়িংরুমে ভোর অবধি বাতি জ্বলেছিল, আর চিন্তামগ্ন একটি মানুষের অস্থির পদচারণার বিরাম ছিল না।

অনেক সিগারেট ছাই হল। নিঃশেষ হয়ে গেল স্কচের পুরো বোতল। রমেন বোসের চিন্তা তবু শেষ হল না। সারারাত ধরে সে ভেবেছে কুন্তলের শেষ কথাগুলো: ‘তার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক ইজ্জৎ জড়িয়ে আছে—প্রকাশ হলে আমার স্বর্গগত বাবার নামে কলঙ্ক পড়বে!’

এতখানি আশ্চর্য রমেন জীবনে হয়নি। কেননা, কুন্তলের পরলোক—গত বাবা অধ্যাপক কমলেশ চাটুজ্যেকে সে ব্যক্তিগত ভাবেই জানত। সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে রিপনে এসে সে তাঁর ছাত্র হয়েছিল দু’বছর। সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে কমলেশ চাটুজ্যের যতটা খ্যাতি ছিল, নৈতিক আদর্শের দিক দিয়েও তাঁর সুনাম ছিল ততখানি। কিন্তু কি এমন ঘটেছিল তাঁর মতো মানুষের জীবনে, যার কলঙ্কিত ইতিবৃত্ত সারাজীবন ধরে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে তাঁর ছেলে? এমন কে আছে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের সেই ফ্ল্যাট—বাড়িটায়, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে চাটুজ্যে—পরিবারের ইজ্জৎ? যার পরিচয় প্রকাশ পেলে কলঙ্ক পড়বে স্বর্গগত কমলেশ চাটুজ্যের মতো আদর্শবাদীরা নামে? কে সে? জানা কি এতই অসম্ভব?

অদ্ভুত জেদ ওই ইডিয়ট কুন্তলটার। কিছুতেই বললে না। ঠিক আছে, জেদ রমেন বোসেরও কম নয়। শেষ অবধি সে চেষ্টা করে দেখবে রহস্যভেদ করা যায় কিনা। ভাগ্যের কাছে শেষ সুযোগ চেয়ে নেবে খুনি আসামি কুন্তল চ্যাটার্জিকে বাঁচিয়ে, মিতালির মুখে হাসি ফোটাবার।

হ্যাঙার থেকে কোটটা নিয়ে কাঁধে ফেলল রমেন। জানালা দিয়ে সকালের রোদ এসে লুটিয়ে পড়েছে ঘরের মেঝেয়। সারারাত জেগে মাতালেরও দু’চোখ জ্বালা করছে। তা হোক, এখুনি যেতে হবে। সময় নেই। আগামীকাল কুন্তলের বিচারের শেষ দিন।

 * * *

শুধু পাঁচ টাকার একখানা নোট। তাতেই কাজ হবে রমেন জানত। দুনিয়াটা কার বশ? দুনিয়া টাকার বশ।

ফ্ল্যাট ভাড়ার সন্ধানে এসেছি বলায় রমেনকে দারোয়ান প্রথমে হাঁকিয়েই দিতে চেয়েছিল, ‘না, একভি কামরা খালি নেই এ বাড়িতে। সতোরোটা ফেলাট, সব ভর্তি।’ তারপর নোটখানা হাতে পেয়ে সুর বদলে গেল, হ্যাঁ, খালি আছে একটা—তিনতলায় ওই পচ্ছিম দিকে। লেকিন বাবুসাব, আজকাল ভারি কড়াকড়ি হয়েছে ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে।

কেন দারোয়ানজী?

এপাশে ওপাশে। তাকিয়ে চুপি চুপি দারোয়ান বললে, চারতলায় সেদিন একটা নাচওয়ালী খুন হয়েছে।

তাই নাকি?—রমেন যেন ভয়ানক ঘাবড়ে গেল : বাড়িটা তাহলে ভালো নয় বলো?

না, না, বাড়ি খারাপ নয় বাবুসাব। তবে অমন দু—একটা খারাপি হয়েই থাকে ফেলাট—বাড়িতে।

ভাড়াটেরা লোক কেমন?

বিলকুল ভদ্দর আদমি!

সবাই ফিরিঙ্গি নাকি? না, অন্য জাত আছে?

সবরকম আছে বাবুসাব—এ বাড়িটা মানুষের চিড়িয়াখানা। এই ধরুন চারতলায় থাকে ব্যাঙ্কের হিন্দুস্থানি মেমসাহেব, তিনতলায় সিন্ধি, দু—তলায় অফসর মাদ্রাজি আর ফলওয়ালা পাঞ্জাবি—

মনে মনে রমেন বলে উঠল, চুলোয় যাক চিনা সিন্ধি মাদ্রাজি পাঞ্জাবি। তারপর উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কোনও বাঙালি নেই।

জরুর আছে। দোতলার ন’ নম্বর ফেলাটে এক বুঢঢি বাঈ থাকে আর তার লেড়কা।

বটে! এক বুড়ি মহিলা আর তার ছেলে! কত বয়েস ছেলের? কি করে?

দারোয়ানের চোখে সংশয় দেখা দিল : এত খবরে আপনার কাজ কি বাবুসাব?

রমেন সামলে নিলে, বাঙালি কিনা, তাই খোঁজ নিচ্ছি।

পাগড়িটা জুত করে বাঁধতে বাঁধতে দারোয়ান বললে, কাল আইয়ে বাবুসাব। আমায় এখন মালিকের অফিসে যেতে হবে ভাড়ার রসিদ আনতে। কুছু ভাববেন না, ফেলাট আপনাকে জরুর পাইয়ে দেব, লেকিন হামার দস্তরীটা—

হেসে গোঁফ চুমরে দারোয়ান রাস্তায় নেমে গেল, আর ফ্রি স্কুল ফ্রিটের সতেরো ফ্ল্যাটওয়ালা সেই প্রকাণ্ড ম্যানসনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল রমেন। কি করবে সে এখন? ভাগ্যের কাছে শেষ সুযোগ নেবে? দেখাই যাক না অন্ধকারে ঢিল ছুড়লে কোথায় গিয়ে লাগে।

সামনেই সিঁড়ি। উঠে গেল রমেন। ন—নম্বর ফ্ল্যাটের দরজা খুঁজে নিতে বেশি দেরি হল না। আস্তে আস্তে টোকা দিলে কয়েকটা। একটু পরেই অল্প ফাঁক হয়ে গেল দরজার কপাট দুটো। দেখা গেল সাদা শাড়িপরা নিরাভরণা একটি বয়স্কা মহিলাকে। বৃদ্ধা না বলে প্রৌঢ়া বলাই উচিত। মাথার চুলে সবে রূপালি ছাপ। লেগেছে, রোগক্লিষ্টা হলেও চামড়া এখনও লোল হয়নি। শান্ত সংযত চেহারা তবু অত্যন্ত গৌরবর্ণ শীর্ণ মুখের রেখায়, ঘন—কালো টানা চোখের কালিপড়া কোলে, পাতলা, লালচে ঠোঁটের বঙ্কিমায় বিগত রূপ—যৌবনের কয়েক পৃষ্ঠা ইতিহাস যেন পড়তে পারলে রমেন।

কে?

আমি কুন্তল চ্যাটার্জির কাছ থেকে এসেছি।

অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন মহিলা। তারপর আশ্চর্যরকম মিষ্টি গলায় বললেন, চিনতে পারলাম না তো!

চিনতে পারলেন না। প্রফেসর কমলেশ চ্যাটার্জির ছেলে কুন্তল।—প্রত্যেকটি কথা স্পষ্ট করে উচ্চচারণ করলে রমেন।

চলন্ত একটুকরো মেঘ সরে গেল কি মহিলার মুখের ওপর দিয়ে? না রমেনের চোখের ভুল?

তেমনি শান্ত মধুর স্বরে মহিলাটি বললেন, তোমার বোধ হয় ভুল হয়েছে বাবা।

কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কথা হারিয়ে গেল তার। ভুল! সত্যিই কি ভুল হল তার জীবনে অঙ্ক কষায়? উত্তর তো মিলছে না!

দরজা বন্ধ করার জন্যে কপাটে হাত দিলেন মহিলা। হঠাৎ আবেগের সঙ্গে বলে উঠল রমেন, আগামীকাল কুন্তলের ফাঁসির হুকুম হবে। তাই তার শেষ কথাটা জানতে এসেছিলাম। ভুল হয়ে থাকলে, আমায় মাপ করবেন।

ছোট্ট একটা নমস্কার করে রমেন সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে সেই আশ্চর্য মিষ্টি গলার ডাক এল, শোনো।

ফিরে তাকাল রমেন। কি এক রুদ্ধ ব্যাকুলতায় মহিলাটির মুখের রেখাগুলি কাঁপছে।

ভেতরে এসো।

যেন সকালের রোদ লেগে ঝলমলিয়ে উঠল রমেনের রাতজাগা ক্লান্ত মুখ। না, ভুল হয়নি জীবনের অঙ্কে। মিলেছে উত্তর।

চৌকাঠ পার হয়ে ভেতরে পা দিতেই মহিলা বললেন, দরজাটা বন্ধ করে দাও বাবা। তোমার সঙ্গে নিরিবিলিতে কথা বলতে চাই।

 * * *