কুয়াশার রাত – ৪

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন পাবলিক প্রসিকিউটর সুরেন ভাদুড়ি। দুলে উঠল তাঁর কালো গাউন। কাঁচা—পাকা ছাঁটা গোঁফের নিচে চাপা ঠোঁটে অবজ্ঞা আর অহঙ্কার ঝিলিক দিয়ে উঠল। সিংহের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে একবার তিনি তাকালেন বাঁ দিক থেকে ডান দিকে। লোকে গিসগিস করছে আদালত—ঘর। বোধ করি খুশি হলেন তিনি। তারপর মঞ্চে দাঁড়ানো পেশাদার বাগ্মীর মতো আবেগময় গলায় বলতে শুরু করলেন, ইওর অনার, আজ যে মামলার বিচারের জন্যে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি, সেটি কোনো সাধারণ মামলা নয়। পৃথিবীতে জঘন্যতম পাপ হল নরহত্যা। এই মামলা হল সেই জঘন্যতম পাপের কাহিনী। এর পিছনে আছে এক হতভাগিনীর জীবন—নাট্যের শোচনীয় পরিণতি! ইওর অনার, আজ আমি আদালদের সামনে সেই হতভাগিনীর জীবন—নাট্যের যবনিকা তুলে ধরার অনুমতি চাই।

পাবলিক প্রসিকিউটর ভাদুড়ি একবার থামলেন। টেবিলের ওপর কাচের গ্লাসে জল ছিল, এক চুমুক খেয়ে ফের শুরু করলেন, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের শোভা ইম্যানুয়েল জাতে মারাঠি হলেও ধর্মে ছিল ক্রিশ্চান। তার পেশা ছিল নাচ। মাঝে মাঝে সে কোনো কোনো নাচের দলের সঙ্গে শহরের বাইরে টুরে যেত বটে, কিন্তু বেশির ভাগ সময় তাকে দেখা যেত কলকাতার নামকরা হোটেলগুলির ক্যাবারে নাচের আসরে। সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি যে, তার পেশার দরুণ নানান লোকের সংস্রবে তাকে আসতে হত। সন্ধের পর প্রায়ই তার ঘরে বন্ধুবান্ধবের সমাগম ঘটত এবং নাচের প্রোগ্রাম না থাকলে মধ্যরাত্রির আগে তার ঘরের বাতি নিভত না। হাসি—খুশি স্বভাব, মিশুকে প্রকৃতি আর সুঠাম যৌবনের জন্যে শহরের বিশেষ এক শ্রেণির লোকের কাছে শোভা ইম্যানুয়েল অত্যন্ত প্রিয় ছিল। তাদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে নাচের মাস্টার, বাজিয়ে আর সঙ্গীত—পরিচালক। শোভা যে নির্মল চরিত্রের মেয়ে ছিল, আমি অবশ্য এমন ধারণা করতে বলছি না। সাধারণত নাচওয়ালীরা যা হয়, সেও তাই ছিল। কিন্তু সে কারও ক্ষতি করেছে, এমন কথা কখনও শোনা যায়নি। নাচ আর হাসি—হল্লার স্রোতে তার দিনগুলি তরতর করে বয়ে যাচ্ছিল। তারপর এল সেই ভয়ানক রাত্রি। তারিখটা ছিল ২৬শে মাঘ। শহরের বুকে তখন নেমেছে কুয়াশার রাত। ঘড়িতে তখন ঠিক বারোটা। শোভা ইম্যানুয়েল খুন হল। খুন হল তার নিজের ঘরে নিজেরই শয্যার উপরে। হতভাগিনী নর্তকীর জীবনের ওপর যবনিকা পাত হল নিতান্ত অসময়ে।

আবেগে কেঁপে কেঁপে উঠল সুরেন ভাদুড়ির কণ্ঠস্বর। কোনো ট্র্যাজিক দৃশ্যে থিয়েটারের অভিনেতারা যেমন গলা কাঁপায়। সিংহের মতো গ্রীবাভঙ্গি করে আর একবার তিনি তাকালেন শ্রোতৃমণ্ডলীর দিকে। সমস্ত আদালত স্তব্ধ হয়ে শুনছে। মনে মনে আর একবার খুশি হলেন তিনি। গলাটা কেশে সাফ করে নিলেন, তারপর আবার বলতে লাগলেন, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে প্রকাশ, বিষ নয়, ছোরা নয়, রিভলভারের বুলেটও নয়—সিল্কের রুমাল বা ওইরকম একটুকরো কাপড়ে ফাঁস গলায় লাগিয়ে শোভা ইম্যানুয়েলকে দমবন্ধ করে মারা হয়েছে। অধিকাংশ খুনের ব্যাপারে ছোরা বা রিভলভার উত্তেজনার বশেই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, ইওর অনার, গলায় ফাঁস লাগিয়ে মেরে ফেলাটা নিরুত্তেজ ঠান্ডা মাথার কাজ নয় কি? পাকা খুনির পক্ষেই এমন নৃশংসভাবে খুন করা সম্ভব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক কে? পুলিশ যাকে অভিযুক্ত করেছে, সেই কি প্রকৃত খুনি? সে বিচারের ভার আদালতের হাতে। (ভাদুড়ির গলা ধাপে ধাপে চড়তে থাকে) যুক্তি, সাক্ষ্য এবং ঘটনা দিয়ে আমি শুধু প্রমাণ করার চেষ্টা করব যে—

পশুরাজ যেমন কেশর ফুলিয়ে শিকারের ওপর থাবা চালায়, ঠিক তেমনি ভঙ্গিতেই সুরেন ভাদুড়ি আসামি কুন্তল চ্যাটার্জিই ফ্রি স্কুল স্ট্রিট হত্যাকাণ্ডের নায়ক—নিহত শোভা ইম্যানুয়েলের প্রকৃত খুনি।

একঝাঁক তিরের মতো বহু চোখের দৃষ্টি এসে বিঁধল কুন্তলের সর্বাঙ্গে। গুনগুন গুঞ্জন উঠল আদালত—ঘরে। হাতুড়ি ঠুকে জজসাহেব বলে উঠলেন, অর্ডার! অর্ডার!

কাঠগড়ার রেলিংটা শক্ত করে চেপে ধরলে কুন্তল। পাবলিক প্রসিকিউটরের গর্জন, আদালত—ঘরের গুনগুন আর জজসাহেবের ‘অর্ডার—অর্ডার’ ধ্বনি যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিল তার কানে। কুন্তলের মনে হল তার সর্বাঙ্গে গভীর ঘুমের মতো একটা ক্লান্তি নামছে। একটা বালিশ পেলে বুঝি—বা এখুনি ঘুমিয়ে পড়তে পারে।

এরপর শুরু হল জেরা।

ডাকা হল যমুনা লালাকে। বুড়ো হ্যারি সাহেবের পাশে বসে এতক্ষণ সে শুনছিল। আস্তে আস্তে সাক্ষীর কাটগড়ায় গিয়ে দাঁড়াল। কালো গাউন দুলিয়ে সুরেন ভাদুড়ি গিয়ে দাঁড়ালেন পাশে। ভগবানের নামে সত্য বলার শপথ গ্রহণ করল যমুনা।

কতকগুলি মামুলি প্রশ্নোত্তরের পর সুরেন ভাদুড়ি বললেন, ঘটনার রাতে সিঁড়ি দিয়ে যাকে আপনি পালাতে দেখেছিলেন, আসামি কি সেই লোক?

আসামির কাঠগড়ার দিকে তাকিয়ে যমুনা স্থির স্বরে জবাব দিলে, তাই মনে হয়।

মনে হওয়ার কারক কী?

পালাবার সময় আততায়ীর গায়ে সবুজ—চেক টুইডের যে কোট আর লাল টাই ছিল, পরদিন ইন্ডিয়া ব্যাঙ্কে আসামির গায়েও ঠিক তাই দেখেছিলাম।

এটাই কি একমাত্র কারণ?

না। আসামির পিঠ আততায়ীর পিঠের মতই চওড়া। তাছাড়া, লম্বায়, শরীরের গড়নে, এমনকি চুলের ধাঁচেও দুজনের মধ্যে হুবহু সাদৃশ্য।

সুরেন ভাদুড়ির ছাঁটা গোফের নিচে বিজয়ীর অহংকার আবার ঝিলিক দিয়ে উঠল। এজলাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, কথাটা লক্ষ্য করুন, ইওর অনার। লম্বায়, শরীরের গড়নে, এমনকি চুলের ধাঁচেও আসামি এবং আততায়ীর মধ্যে হুবহু সাদৃশ্য। এই সাদৃশে দেখেছেন কে? যিনি নিহত শোভা ইম্যানুয়েলের পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশিনী এবং ঘটনার সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান সাক্ষী। সেই হিসেবে আলোচ্য মামলায় মিস যমুনা লালার এই কথাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয় কি?

তারপর আবার প্রথম সাক্ষীর দিকে ফিরে পি. পি. বললেন, আর আমার কোনও প্রশ্ন নেই, মিস লালা। ধন্যবাদ।

সাক্ষীর ডকে দ্বিতীয় সাক্ষী উঠল। বৃদ্ধ এক পাঞ্জাবি। চুল—দাড়ি—গোঁফ সব ‘ক্রিসমাস বুড়োর’ মতো ধবধবে।

পি. পি. প্রশ্ন করলেন, W.B.T. 9001 নম্বর ট্যাক্সি কে চালায় সর্দারজী?

সাক্ষীর ডক থেকে জবাব এল, জী, আমি।

দিনে চালাও, না রাতে?

রাতে। দিনে আমার ছেলে চালায়।

কত রাত অবধি ভাড়া খাটো?

বারোটা—একটা অবধি হুজুর।

আচ্ছা, গত ১০ই ফেব্রুয়ারি রাতে গাড়ি বের করেছিলে কি?

করেছিলাম।

রাত বারোটা নাগাদ কোনও সওয়ারী পেয়েছিলে?

পেয়েছিলাম।

কোথা থেকে কেমন করে পেয়েছিলে, মনে আছে?

জী, মনে আছে।

ঘটনাটা বলো তো। ভাল করে স্মরণ করে বলো।

পার্ক সার্কাসে এক সাহেবকে পৌঁছে দিয়ে আমি চৌরঙ্গির দিকে ফিরছিলাম। লোয়ার সার্কুলার রোডের মোড় ছাড়িয়ে পার্ক স্ট্রিটে ঢুকতেই হঠাৎ কে যেন আমায় ডাকলে। কুয়াশার রাত ছিল বলে ভাল করে নজর চলেনি। আওয়াজটা যেদিক থেকে এল, সেই দিকে গাড়ি ব্যাক করে নিয়ে যেতেই দেখি, রাস্তার ধারে আর একখানা ট্যাক্সি থেকে কে জোয়ান ছোকরা নেমে আসছে। পরনে সাহেবি পোশাক। আমার গাড়িতে উঠে বসতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ও ট্যাক্সিখানা ছেড়ে দিলেন কেন? ছোকরা জবাব দিলে, ওর পেট্রল ফুরিয়ে এসেছে। তারপর আমাকে বললে, জলদি চালাও—যত জলদি পারো।

সওয়ারীকে কোথায় পৌঁছে দিলে?

টালিগঞ্জের এক বাগান—বাড়িতে হুজুর। শুনলাম সেখানে বায়োস্কোপ হয়।

আচ্ছা সর্দারজি সে—রাতের সেই সওয়ারীকে তোমার মনে আছে?

কিছুটা মনে আছে বইকি!

কালো গাউন দুলিয়ে, ছবি বিশ্বাসের ভঙ্গিতে পি. পি. এগিয়ে গেলেন আসামির ডকের সামনে। যেখানে রেলিংটা শক্ত হাতে চেপে ধরে একটা মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কুন্তল।

এই আসামির দিকে তাকাও সর্দারজী—ভালো করে দেখো। এবার বলো তো, সেদিন রাতের পার্ক স্ট্রিটের সেই সওয়ারী কি এই লোক?

ধবধবে ভুরুর তলা দিয়ে বুড়ো সর্দার চোখ দুটো কুঁচকে একবার তাকাল কুন্তলের দিকে। তারপর ঘাড় নেড়ে বললে, তাই তো মালুম হচ্ছে হুজুর। হুঁ, এমনি জোয়ান চেহারা, এমনি কাঁচা উমর!

ছাঁটা গোঁফের তলায় আবার বিজয়ীর হাসি নিয়ে সুরেন ভাদুড়ি তাকালেন এজলাসের দিকে। তারপর দু’নম্বর সাক্ষীকে বললেন, তুমি যেতে পারো সর্দারজী।

ডকে তৃতীয় সাক্ষী উঠল। বাণী চিত্রমের ব্যবস্থাপক বিপিন। তার দিকে অবজ্ঞাভরে তাকালেন সুরেন ভাদুড়ি। বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন করলেন, কি করা হয়?

অমায়কি হেসে বিপিন বললে, ম্যানেজ করি স্যার।

ভুরু কুঁচকে ভাদুড়ি বললেন, কি ম্যানেজ কর?

বিপিন বললে, আজ্ঞে সুটিং ম্যানেজ করতে হয়।

বটে! আচ্ছা বিপিন, গত ২৬শে মাঘ রাতে তুমি স্টুডিওতে হাজির ছিলে?

ছিলাম বইকি। নইলে চাকরি নট হয়ে যাবে যে!

কি কাজ ছিল সেদিন রাতে?

আমাদের পুষ্পবাসর ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক রেকর্ডিং ছিল।

পুষ্পবাসর ছবির মিউজিক ডিরেক্টর কে?

কাগজে সিনেমা—পেজ পড়েন না বুঝি? নাঃ, আপনি বড় ব্যাকওয়ার্ড স্যার!

একটা চাপা হাসির ঢেউ খেলে গেল আদালত—ঘরে। জজ সাহেব একবার কাশলেন। আর, সুরেন ভাদুড়ি চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়ে উঠলেন, বাজে বকছো কেন?

থতমত খেয়ে বিপিন বললে, এই সেরেছে! চটে গেলেন নাকি? আপনার প্রেসারটা একবার দেখাবেন। স্যার!

চাপা হাসির ঢেউটা এবার আর চাপা রইল না। জজ সাহেব আবার কাশলেন। আর আরক্ত মুখে সুরেন ভাদুড়ি গর্জন করলেন, ফের বাজে কথা! বল কে মিউজিক ডিরেক্টর?

কুন্তল চ্যাটর্জি।

রেকর্ডিং প্রোগ্রাম ক’টায় ছিল?

রাত এগারোটা থেকে।

আসামি কুন্তল চ্যাটার্জি কখন স্টুডিওতে গিয়েছিলেন?

রাত দেড়টা নাগাদ ট্যাক্সি করে যান।

তিনি কি বরাবরই এত লেট করে স্টুডিওতে যেতেন।

না স্যার। বরং দশ মিনিট আগে যেতেন, তবু এক মিনিট দেরি হত না কখনো। কেবল সেদিন তাঁকে প্রথম লেট হতে দেখলাম।

পাবলিক প্রসিকিউটরের মুখ প্রসন্ন হয়ে উঠল। জজ সাহেবের দিকে গ্রীবাভঙ্গি করে বললেন, ইওর অনার, তিন নম্বর সাক্ষীর শেষ কথাগুলো লক্ষ করবার মতো।—আচ্ছা, তুমি যেতে পার বিপিন।

বাঁচালেন স্যার।

এক লাফে সাক্ষীর কাঠগড়া থেকে নেমে গেল বিপিন।

জজসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, আর কোনও সাক্ষী?

প্রসন্ন মুখে পি. পি. বললেন, ইওর অনার, আসামির অপরাধ প্রমাণের জন্য মাত্র তিনটি সাক্ষীর বিবৃতিই আমার পক্ষে যথেষ্ট। আদালতের মূল্যবান সময় আর নিতে চাই না, কেবল আসামিকে একটিমাত্র প্রশ্ন করেই আমি আমার জেরা শেষ করব।

বীরদর্পে সুরেন ভাদুড়ি এগিয়ে গেলেন আসামির কাঠগড়ার সামনে। ঘায়েল হয়ে আসা শিকারের প্রতি শিকারি পশু যেমন পরিতৃপ্তির সঙ্গে তাকায়, তেমনি করে তাকালেন নিথর নিঃশব্দ কুন্তলের দিকে।

তারপর প্রশ্ন করলেন, আপনার স্ত্রী পুলিশের কাছে বলেছেন, ২৬শে মাঘ রাত সাড়ে দশটায় আপনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। আর, ব্যবস্থাপক বিপিন বলছে, আপনি স্টুডিওতে পৌঁছন রাত দেড়টায়। সাড়ে দশটা থেকে দেড়টা অবধি আপনি কোথায় ছিলেন?

কোনও জবাব এল না আসামির ডক থেকে।

বলুন—জবাব দিন আমার প্রশ্নের—

কুন্তল তেমনি নিথর নিঃশব্দ।

আবার বললেন ভাদুড়ি, বলুন, কোথায় ছিলেন?

হঠাৎ নড়ে উঠল নিস্পন্দ একটা মূর্তি। কলের পুতুলের মতো ঠোঁট নেড়ে কুন্তল বললে, মনে পড়ছে না।

গর্জন করে উঠলেন ভাদুড়ি, মনে করে বলুন—কোথায় ছিলেন ২৬শে মাঘ রাত বারোটার সময়? কোনো আত্মীয়ের বাড়ি?

না।

কোনও বন্ধুর কাছে?

না।

কোন গানের আসরে?

না।

তবে? (ভাদুড়ির গলা আর এক ধাপ চড়ল) সত্য গোপন করবেন না—২৬শে মাঘ রাত বারোটায় কোথায় ছিলেন বলুন?

ঝুঁকে পড়া মাথাটা তুলে, সোজা হয়ে দাঁড়াল কুন্তল। স্তিমিত দুই চোখে মরণাহত প্রাণীর মরিয়া দৃষ্টি ফুটে উঠল। তারপর পাবলিক প্রসিকিউটরের মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির কণ্ঠে উচ্চচারণ করলে, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ফ্ল্যাট—বাড়িতে ছিলাম।

মুহূর্তে আদালত—ঘরটা কবরখানার মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। বিজয়ীর হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করে সুরেন ভাদুড়ি বললেন, ইওর আনার, আমার জেরা শেষ হয়েছে।

আর, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জজসাহেব বললেন, মামলা মুলতবি রইল।

 * * *

সিগারেটটা নিভে গিয়েছে। তবু সেটাকে দাঁতে চেপে ব্যারিস্টার দত্তগুপ্ত বললেন, এর পরেও কি আপনি মামলা জেতার আশা রাখেন মিস্টার বোস?

প্রকাণ্ড ড্রয়িংরুমের এধার থেকে ওধার অবধি স্কচের গেলাস হাতে পায়চারি করছে রমেন বোস। কোনো কারণে বিচলিত হলে বা চিন্তার গভীরে ডুবে গেলে রমেন এক জায়গায় স্থির থাকে না। দত্তগুপ্তের সামনে এসে সে থামল, তারপর বললে, আমি মিসেস মিতালি চ্যাটার্জি হলে নিশ্চয় আশা রাখতাম গুপ্তসাহেব। যে—কোনও খুনি আসামির স্ত্রী তাই করে। আর তাদের আশা পূর্ণ করার চেষ্টাই আমাদের পেশা নয় কি?

লাইটার বের করে সিগারটা ধরাতে গিয়েও ধরালেন না দত্তগুপ্ত। সিগারের টুকরোটা বাঁ হাতের আঙুলে ধরে বলতে লাগলেন, রাইট! কিন্তু এক্ষেত্রে আশা করে লাভ কি? প্রত্যেকটি সাক্ষ্য—প্রমাণ কুন্তল চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে। —এক এক করে ধরুন, খুনের জায়গায় গোল্ড ফ্লেক সিগারেটের প্যাকেট আর সোনালি রিবনের রিং তৈরি করা তাঁর অভ্যেস। পাশের ফ্ল্যাটে প্রতিবেশিনী যমুনা তাঁকে পালাতে দেখেছে, হরদিৎ সিং ট্যাক্সি—ড্রাইভার তাঁকে খুনের ঠিক পরেই, অর্থাৎ রাত বারোটার সময় পার্ক স্ট্রিটের কোণ থেকে গাড়িতে তুলেছে। সবচেয়ে মারাত্মক হয়েছে তাঁর নিজের স্বীকারোক্তি—

ঘটনার রাতে খুনের সময় তিনি ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওই ম্যানসনেই ছিলেন।

রমেন বোস আবার পায়চারি শুরু করেছিল। প্রশ্ন করলে, কার কাছে, কি উদ্দেশ্যে ওই ম্যানসনে গিয়েছিল, সে বিষয়ে কুন্তল কিছু বলেছে আপনাকে?

না। আদালত থেকে বেরিয়ে তিনি সেই যে মুখ বন্ধ করেছেন। একবারও খোলেননি। ব্যাপারটা রীতিমতো রহস্যময়।

অন্যমনস্কভাবে রমেন শুধু বললে, হুঁ।

লাইটারটা বোধ করি খারাপ। বারকয়েক চেষ্টাতেও জ্বলল না। সেটা পকেটে রাখতে রাখতে দত্তগুপ্ত বললেন, শুনেছি, আপনি আর কুন্তলবাবু একসময় কলেজে সহপাঠী ছিলেন। সেই পুরাতন বন্ধুত্বের সূত্র ধরে কুন্তল—রহস্য ভেদ করা হয়তো আপনার পক্ষেই সম্ভব হতে পারে। আমি বলি কি, কেসটা আপনি নিজের হাতে নিলেই ভালো করতেন মিস্টার বোস।

রমেন তখন পূর্ণ গেলাস শূন্য করছিল। বললে, ক্ষেপেছেন গুপ্ত—সাহেব? আমি কেস নেব! মরা ঘোড়া কখনো ঘাস খায়?

গুপ্তসাহেব হেসে উঠলেন : কিন্তু হুইস্কি যে খায়, তা স্বচক্ষে দেখছি। সুতরাং মরা বলি কি করে?

তারপর রিস্টওয়াচের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, উঠি আজ।

দত্তগুপ্তের সঙ্গে সঙ্গে রমেন বেরিয়ে এল বাইরের বাগানে। গাড়িতে ওঠার আগে দত্তগুপ্ত বললেন, জোকস অ্যাপার্ট, আবার বলছি, এখনো সময় আছে, কেসটা আপনি নিন। আমার ওপর ভরসা রাখবেন না।

মানে?

জানেনই তো গ্যাসট্রিক আলসারের রুগি আমি। ক’দিন থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।

রমেন হেসে বললে, চল্লিশ পেরোলে সকলেরই শরীর নোটিশ দেয়। তাই বলে ঘাবড়ালে কি চলে?— গুডনাইট।

গুডনাইট।

দত্তগুপ্তের গাড়ি বেরিয়ে গেল। রমেন কিন্তু ভেতরে গেল না, অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেই জঙ্গলে—ভরা বাগানে। সত্যি, কুন্তলের কেসটা বড় জটিল হয়ে উঠেছে। তার চেয়েও জটিল হয়ে উঠেছে কুন্তল নিজে। কেন সে আদালতের সামনে ওই স্বীকারোক্তি করতে গেল—বিপদে পড়বে জেনেও? আর, গিয়েছিলই যদি অত রাতে ওই বিদঘুটে ম্যানসনে, তবে কার কাছে কি মোটিভ নিয়ে গিয়েছিল, সে—কথাই বা গোপন করছে কেন? সবার আগে ওই স্বীকারোক্তির জট খোলা দরকার।

কুন্তলের সঙ্গে দেখা করলে মন্দ হয় না। চিনতে পারবে কি দশ বছর বাদে? দেখাই যাক না।

কিন্তু কেন? কুন্তল চ্যাটার্জিকে নিয়ে মাথা ঘামাবার কি দরকার তার? সে রমেন বোস, ওরফে মাতাল বোস, আইন—আদালতের ধার ধারে না, দিনান্তে একটু স্কচ পেলেই খুশি, তার এত গরজ কেন কুন্তল চাটুজ্যের মামলা নিয়ে? কেন আবার! ঢাকের বাদ্যি শুনলেই চড়ুকে পিঠ সুড়সুড় করে। তেমনি মামলার গন্ধ পেলেই উকিল—ব্যারিস্টারের গা চুলকায়।

কিন্ত হাসনুহানার গন্ধে রোমাঞ্চিত এই অন্ধকারের ভেতর থেকে কে যেন হঠাৎ বলে উঠল, কাকে ফাঁকি দিচ্ছ রমেন বোস? কে কুন্তল চাটুর্জ্যে, তার মামলার জন্যে তোমার দায় পড়েছে। তোমার আসল দায় মিতালি তোমার মরা প্রেমকে যে কবর খুঁড়ে আবার বাঁচিয়েছে! যাকে তুমি এখনও ভালোবাসো।

বোগাস! রমেন প্রায় চেঁচিয়ে উঠল : ও—সব বাজে ব্যাপারে আমি নেই।

হঠাৎ তার চিন্তার খেই গেল ছিঁড়ে। একটা চমৎকার অর্কেস্ট্রার বাজনা ভেসে এল প্রথম ফাল্গুনের হাওয়ায়। আশেপাশে কোথায় যেন গ্রামোফোন রেকর্ড বাজছে। রমেনের মনে পড়ে গেল—এমনি হঠাৎই মনে পড়ে গেল—শোভা ইম্যানুয়েল খুন হবার সময় তার ঘরেও একখানা রেকর্ড বাজছিল। জ্যাক স্টিফেনের সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা।

 * * *