৩
বকুল বাগানের মোড় ছাড়িয়ে দু’পা দক্ষিণে গেলেই লাল রঙের একখানা বহু পুরাতন বাড়ি। ল্যান্সডাউন রোডের ঠিক ওপরেই। যতটুকু জমির ওপর বাড়ি, চারপাশে তার অনেক বেশি জায়গা আগাছার জঙ্গলে ভর্তি। সেই জঙ্গলের মাঝে মাঝে দু’চারটে আধভাঙা পাথরের মূর্তি বাড়িটির বিগত যৌবন দিনের সাক্ষ্য হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এখন অবশ্য পৈতৃক আমলের এই জীর্ণ বাড়ি, আগাছা—ভর্তি কম্পাউন্ড আর হাল আমলের একটা টেলিফোন ছাড়া ব্যারিস্টার রমেন বোসের আর কিছুই নেই। কিন্তু ছিল আরও। খানতিনেক দামি মোটরকার, ব্যাঙ্কে গচ্ছিত লাখ দেড়েক টাকা। সে টাকার প্রায় সবটাই জলে গেছে। জলে মানে লাল জলে। টাকা গেলেও লাল জলের অভ্যেসটা কিন্তু এখনও যায়নি রমেন বোসের।
অত বড় বাড়িটায় একা থাকে রমেন বোস। বন্ধু—বান্ধবের বহু পরামর্শেও ভাড়া দিতে রাজি হয়নি। টাকার নিতান্ত অভাবে যেমন রাজি হয়নি হুইস্কি—ব্যাপারে স্কচের নিচে নামেত। রমেন বলে, আমার আভিজাত্য স্কচে।
দোতালার সব ঘরগুলোই বন্ধ থাকে। একতলার বিশাল ড্রয়িংরুমটাই এখন রমেনের আস্তানা। প্রতিদিনের মতো আজও স্কচের বোতল খুলে বসেছিল রমেন। ‘বারে’ খেতে অনেক খরচ পড়ে, তাই ঘরেই খেতে হয়। বাইরের অন্ধকার শীতের কুয়াশা আর হাসনুহানার গন্ধে মাখামাখি হয়ে আছে। গেলাসটা নামাল রমেন। অবাক হবারই কথা। সবাই জানে সন্ধের পর রমেন আর রমেন বোস থাকে না, গাইকোয়ার বা নিজাম গোছের একটা কিছু হয়ে যায়। একথা জেনেও তবু অফোন করলে কে? রিসিভার তুলে নিল রমেন।
হ্যালো! কে?
টেলিফোনের ওপার থেকে ভেসে এল, ব্যারিস্টার বোস আছেন?
কথা বলছি।
ও, রমুদা, আমি মিতা।
মিতা? কে যেন রমেনকে সজোরে ধাক্কা মারল।
হ্যাঁ, আমি মিতালি। আমার বড় বিপদ রমুদা। একটিবার আসবে? রমেনের মুখে কথা জোগাল না। নেশার ঘোরে ভুল শুনছে নাকি? কিন্তু নেশা তো হয়নি এখনও!
টেলিফোনের ওপর থেকে আবার শোনা গেল, সব কথা বলতে পারছি না, তুমি এক রমুদা—এখুনি—
অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে রমেন বললে, এখুনি? কাল সকালে গেলে হয় না?
না, না, এখুনি—আমি অপেক্ষা করছি। আসছ তো?
অগত্যা।
রিসিভার রেখে দিল রমেন। তারপর এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলল তৃতীয় পেগটা। দশ বছর বাদে মিতালি তাকে ডেকেছে। চট করে বিশ্বাস হয় না, তবু ডাকটা অবিশ্বাস্য রকমে সত্য। দশ বছরের ব্যবধান মনে মনে এক পলকে ডিঙিয়ে গেল রমেন। সিগারেটের কুণ্ডলী পাকানো নীলচে ধোঁয়ার মধ্যে ঝাপসা হয়ে আসা বহু পুরাতন একটা ছবি যেন দেখতে পেল।
বোম্বাই। জাহাজাঘাটা। বিলেতের জাহাজ এখুনি ছাড়বে। পোর্টারদের ওঠানামা কমে এসেছে। আর সপ্তমে উঠেছে খালাসিদের ব্যস্ততা। নানা জাতের নানা মানুষের ভিড়ে ছেয়ে গেছে জাহাজঘাটা। তাদের কলরবে সমুদ্র—কল্লোল চাপা পড়ে যাচ্ছে। সেই মুখর জনতার মাঝে একেবারে একা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুটি মানুষ। রমেন আর মিতালি। সেদিনের সেই শীতের সকালে তাদের কাছে জাহাজ, খালাসি, ভিড়, কলরব, কিছুই ছিল না। ছিল শুধু দুটি অপরিণতবুদ্ধি সবুজ মন। কতই বা বয়েস তখন মিতালির? সতেরো কি আঠারো। আর রমেনের তখন টগবগে তাজা যৌবন।
বিলেতে গিয়ে চিঠি লিখবে তো রমুদা?
চিঠি? উঁহু, পৌঁছতে অনেক দেরি হয়। তার চেয়ে বরং মাঝে মাঝে ফ্লাই করে এসে তোমায় দেখে যাব।
ও, ঠাট্টা হচ্ছে?
মোটেই না। আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়? ধরো, তুমিও আমার সঙ্গে জাহাজে উঠলে, তারপর সিঁড়িটা তুলে নেওয়া হল, তারপর আস্তে আস্তে ছেড়ে দিলে জাহাজ, তুমি আর নামতে পারলে না।
জলতরঙ্গের মতো হেসে উঠল মিতালি। বললে, চমৎকার আইডিয়া! কিন্তু উপায় নেই, (মেঘলা হয়ে এল মিতালির মুখ) আমি গেলে বাবাকে দেখবে কে?
কপালের ওপর কয়েক গাছা চুল পাকাতে পাকাতে রমেন বললে, তাহলে আর একটা কাজ করা যেতে পারে। ধরো, জাহাজ ছেড়ে দিল, আমি গেলাম না বিলেত, পড়লাম না ব্যারিস্টারি।
ঠিক এই সময় শীতের স্বচ্ছ আকাশ স্পন্দিত করে জাহাজটা একবার ভোঁ দিয়ে উঠল। রমেনকে একটা ঠেলা দিয়ে উদ্বিগ্নগলায় মিতালী বলে উঠল, এই রে! তোমার মাথায় আবার ভূত চেপেছে দেখছি! শিগগির ওঠো জাহাজে, ওঠো বলছি।
বেশ, তাহলে উঠি, বলে শান্ত ছেলের মতো রমেন পা বাড়াল। সঙ্গে সঙ্গে তার কোট টেনে ধরল মিতালি : বারে, অমনি চলে যাচ্ছ! কিছু বললে না!
রমেন ফিরে দাঁড়াল : তাইতো, কি বলি বলো তো? কি বলা উচিত? কি বললে মানায়?
ফুলে উঠল মিতালির গাল, ভারি হয়ে উঠল চোখের পাতা। বললে, যাও, কিছু বলতে হবে না, তোমার খালি ঠাট্টা!
হেসে ফেলল রমেন। তারপর অ্যাপোলো বন্দরের ভিড়—ব্যস্ততা—কলরব সব কিছু অগ্রাহ্য করে দু’হাতে মিতালির মুখখানে একটা বড় চন্দ্রমল্লিকার মতো আলতো করে তুলে ধরে গাঢ় গলায় বললে, আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো মিতা। শুধু আমারই জন্যে।
তারপর ছুটে চলে গেল রমেন। জাহাজের সিঁড়ি তখন তোলা হচ্ছে। জাহাজ ছেড়ে দেবার পরেও মিতালিকে সে দেখতে পাচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরে দেখাগেল তার মেরুন রঙের গরম কোট। তারপর মিলিয়ে গেল একসময়।
অপেক্ষা মিতালি করেছিল বইকি! কিন্তু দু’বছরের বদলে চার বছর কেটে গেলেও রমেন বোসের ফেরবার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। শোনা গেল, বিলেতে গিয়ে মদ্যপানকে সে আইনের চেয়ে বেশি আয়ত্ত করে ফেলেছে। তাছাড়া, কোন একটি লর্ডের মেয়ের নামও তার নামের সঙ্গে হয়ে সাগর পেরিয়ে ভারতবর্ষের মাটিতে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু ব্যারিস্টারিটাও সে পাস করতে ভোলেনি।
চার বছর বাদে রমেন বোস বার—অ্যাট—ল যখন ভারতবর্ষে ফিরে এল, কুন্তল চ্যাটার্জির সঙ্গে মিতালির তখন বিয়ে হয়ে গেছে। রমেন খবর পেল, কিন্তু খোঁজ করলে না। সে জানত যে এতদিন ধরে শুধু মিতালি কেন, কোনো মেয়েই অপেক্ষা করে থাকতে পারে না। মনে মনে পরম নিশ্চিন্ত হয়ে, সে একমনে আইন আর হুইস্কি—চর্চা শুরু করে দিলে। মাস আষ্টেকে সাড়া পড়ে গেল হাইকোর্টে। ক্রিমিন্যাল কেসে তাক লাগিয়ে দিলে রমেন বোস। কিন্তু ওই পর্যন্ত। তারপর থেকেই মামলার সময় রমেন বোসকে আদালতে প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যেত না। সেই সময়টা তাকে পাওয়া যেত হয় গ্র্যান্ড—গ্রেট ইস্টার্নের ‘বারে’, নয় ল্যান্সডাউনের বাড়িতে ড্রয়িংরুমের শোফার উপর ঘুমন্ত অবস্থায়। ক্রমশ : কমতে লাগল মক্কেলের আসা—যাওয়া। বেহাত হতে লাগল ব্রিফ। অ্যাটর্নি পাড়ায় রমেন বোসের নতুন নামকরণ হল মাতাল বোস।
অবস্থা বদলালেও রমেন কিন্তু বদলাল না। বন্ধু—বান্ধবের কাছে সে হাত পাতে না। আত্মসম্মানে লাগে বলেই নয়, আজকাল তারা আর টাকা দেয় না বলে। তবু নিত্য সন্ধ্যায় এক বোতল ‘স্কচ’ সে কোথা থেকে জোগাড় করে ভগবান জানে। নেহাত পুরোনো আইনজীবী বন্ধুরা পরামর্শের জন্যে এক—আধবার ডাকে বলেই কোনওরকমে চলে যায়। এমন দিন গেছে যখন এক মাসে রমেন বোসের রোজগার হয়েছে বাইশ হাজার টাকা। আবার এমন দিন গেছে যখন সারা মাসে মাসে বাইশটা টাকাও তার পকেটে আসেনি। জীবনের এই পিঠ ওপিঠ দু’পিঠই দেখা আছে তার। সুতরাং কোনো কিছুতেই সে আর আশ্চর্য হয় না।
কিন্তু এই টেলিফোনটা আজ তাকে সত্যিসত্যিই আশ্চর্য করে ছেড়েছে। কার গলার আওয়াজ বয়ে নিয়ে এল এই যন্ত্রটা? সে কি সত্যিই মিতালি? দীর্ঘ দশ বছর বাদে মিতালি যাকে ডেকে পাঠিয়েছে, সেও কি এই আজকের রমেন বোস? চেহারায় অবশ্য খুব পরিবর্তন আসেনি। মাথার সামনের চুলগুলো পাতলা আর অত্যধিক মদ্যপানের দরুণ নাকের ডগাটা ঈষৎ লালচে হয়েছে শুধু। কিন্তু এই দেহের খাঁচাটায় দশ বছর আগের সেই রমেন বোস কি সত্যিই আজও টিকে আছে? এতকাল নিশ্চিত ধারণা ছিল, সে নেই। কিন্তু আজ, উনিশশো পঞ্চান্ন সালের এক শীত—সন্ধ্যায়, তার মনে হচ্ছে আছে—বোম্বাইয়ের জাহাজঘাটার সেই পুরাতন রমেন বোস আজও অল্প অল্প বেঁচে আছে। তার মৃদু হৃদস্পন্দন সে আজ শুনতে পাচ্ছে তার বুকের মধ্যে। নইলে সেসব পুরোণো কথা নতুন করে আবার মনে পড়বে কেন?
কিন্তু এসব লক্ষণ তো ভালো নয়। মাঝখান থেকে নেশাটাই মাটি হতে বসেছে। কবেকার কোন মিতালি তার সঙ্গে কতটুকু মিতালি করেছিল, সে হিসেব—নিকেশে কাজ কি আজ? রমেন বোস কখনও হৃদয়—দৌর্বল্যকে প্রশ্রয় দেয় না। এত মদ খেয়েও তার হার্ট রীতিমতো স্ট্রং আছে।
গেলাসে ডবল পেগ স্কচ ঢাললে রমেন। কিন্তু মুখে তুলেতে গিয়েই মনে পড়ে গেল, মিতালি বলেছে বড় বিপদ। আর গলাটাও কেমন ভিজে—ভিজে ব্যাকুল। নাঃ, একবার যাওয়া উচিত। জীবন যে কোথায় কখন জটিল হয়ে ওঠে, কে বলতে পারে? মিতালীর বিপদটা যে কতখানি বিপদ, একবার জানা দরকার। গলাটাও কেমন ভিজে—ভিজে লাগল শুনতে। কেমন যেন কাঁপা—কাঁপা। দশ বছর আগে সে জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে যেমন করে বলেছিল, ‘বারে! অমনি চলে যাচ্ছ? কিছু বললে না?’
এক চুমুকে গেলাসটা নিঃশেষ করে বেরিয়ে গেল রমেন। টালা পার্কের কাছে মিতালির বাড়ি। ট্যাক্সি করে গেলে আর কতটুকু পথ?
.
সব কথা শুনে রমেন বললে, দুনিয়ায় এত লোক থাকতে শেষকালে কিনা আমাকেই মুরুব্বি ভাবলে! তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুই পাকেনি মিতালি!
জলে ভেজা চোখ তুলে মিতালি বললে, বাবা বেঁচে নেই, আত্মীয় পরিজন বলতেও কেউ নেই। এ বিপদে তোমার নামটাই আগে মনে হল।
আমার নামটাই আগে মনে হল! যাক, বাপ—মার দেওয়া নামটা সার্থক হল এতদিনে। (বাঁ হাতে একটা তুড়ি দিয়ে হেসে উঠল রমেন) কিন্তু আমি কি করতে পারি বলো? কি হতে পারে আমাকে দিয়ে? কিচ্ছু না, নাথিং অ্যাটঅল!
এ বিপদে তোমরাই তো—কাণ্ডারী রমুদা। হাজার হলেও তুমি ব্যারিস্টার।
চেয়ার থেকে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে রমেন বললে, ব্যারিস্টার! সে তে ‘ওয়ান্স আপন এ টাইট’! এখন আমি বন্দুকের একটা ফাঁকা টোটা। তুমি বোধ হয় জানো না, আজ বছর কয়েক আদালতের সঙ্গে সম্পর্কই নেই আমার।
কেন রমুদা? কি হল? ক্রিমিন্যাল কেসে তোমার অত সুনাম ছিল! লোকে তোমায় সেকেন্ড রাসবিহারী ঘোষ বলত!
তা বলত! (পোড়া সিগারেট থেকে একটা নতুন সিগারেট ধরালে রমেন) কিন্তু ব্যাপারটা কি হল জানো? আমি মদের প্রেমে পড়লাম বলে মক্কেলরা আমায় ডাইভোর্স করলে। আমিও তাই আর আদালত মাড়াই না।
তা হোক, তুমি এ কেসটা করো রমুদা।
না।
খাটের ধার থেকে মিতালি এসে দাঁড়াল রমেনের মুখোমুখি। তারপর সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, আমার এত বড় বিপদে তুমি দাঁড়াবে না? তুমি না একদিন আমায় ভালবেসেছিলে?
হো হো করে হেসে উঠল রমেন। যেন একটা ভারি মজার কথা শুনেছে। তারপর গলায় হাসির রেশ টেনে বললে, ফুটবল খেলা ছেড়ে দেবার পর পায়ে আমার একসময় বাত হয়েছিল। সে ব্যাধির মতো আরও অনেক পুরোনো ব্যাধিই আমার সেরে গেছে মিতা।
মিতালির চোখের জল শুকিয়ে গেল। একটা তিক্ত স্বাদে কুঁচকে গেল ঠোঁটের প্রান্ত। বললে, টাকা দেব আমি। তোমার পুরো ফিজ।
পায়চারি বন্ধ হয়ে গেল রমেনের। ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, টাকা! রমেন বোসকে টাকা দেবে মিতালি!
আবার হেসে উঠল রমেন। তারপর সহজ গলায় বললে, আসল কথাটা হচ্ছে, নিজের ওপর আর বিশ্বাস নেই আমার। তাই কেস নিই না। বিশেষত কেসটা যখন তোমার স্বামীর।
তবে কি করব আমি? কার কাছে যাব?—মিতালি যেন অকূল পাথারে ডুবে যাচ্ছে।
মিতালির দুই কাঁধ ধরে মৃদু একটা ঝাঁকানি দিয়ে রমেন বললে, এসময় নার্ভ শক্ত রাখো মিতা। আমার চেয়েও ভাল ব্যারিস্টার ঠিক করে দিচ্ছি—মামলা চালিয়ে যাও। তারপর—
নিজের কপালে রমেন একটা টোকা দিল।
টস টস করে জল গড়িয়ে এল মিতালির গাল বেয়ে। বললে, যেমন করে পারো, ওকে তুমি খালাস করে আনো রমুদা? আমার মন বলছে ওকে মিথ্যে অ্যারেস্ট করেছে। অমন ভয়ানক কাজ ও কিছুতেই করতে পারে না।
দরজার কাছ অবধি এগিয়ে গিয়েছিল রমেন। সেইখান থেকেই বললে, তা কি এত সহজেই বলা যায় মিতা? মানুষ হচ্ছে বিধাতার আজব তামাসা। সে কখনও সাজে রাম, কখনও সাজে রাবণ। কে বলবে কোনটা তার আসল চেহারা? কিন্তু আর দেরি নয়, আমার বিরহিনী স্কচের বোতল পথ চেয়ে রয়েছে।
রমেনের হাসির আওয়াজটা সিঁড়ি দিয়ে ক্রমশ নিচে নেমে গেল। আর, হঠাৎ ভয়ানক একটা সন্দেহে মনে মনে কেঁপে উঠল মিতালি। তার কানে বাজতে লাগল : মানুষ হচ্ছে বিধাতার আজব তামাসা। সে কখনও সাজে রাম, কখনও সাজে রাবণ। কে বলবে কোনটা তার আসল চেহারা?
.
* * * *
.
এগারো দিন বাদে।
দক্ষিণের বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে ঠিক তেমনি করেই বসে আছে কুন্তল। যেমন করে রোজ সকালে বসে থাকত আগে। মুখে দাড়ি জমেছে এগারো দিনের। চুলে তেল পড়েনি। ঝড়—খাওয়া নাবিকের মত ক্লান্ত, নিষ্প্রভ চেহারা। ডান হাতের দু’আঙুলে ধরা একটা জ্বলন্ত সিগারেটের মুখে অনেকটা ছাই জমেছে লম্বা হয়ে। শীতের এলোমেলো হাওয়ায় টেবিলের ওপর আজকের কাগজ মৃদু মৃদু উড়ছে ফরফর করে।
গতকাল জামিন পেয়েছে কুন্তল। ধরা পড়ার এগারো দিন পরে। তদন্ত শেষে ম্যাজিস্ট্রেট যখন কেসটা হাইকোর্টের দায়রা—জজের হাতে পাঠালেন। এমন কেসে জামিন পাওয়াটা সহজ নয়, অনেক কাঠ—খড় পোড়াতে হয়েছে কুন্তলের ডিফেন্স—কাউন্সেল ব্যারিস্টার দত্তগুপ্তকে। কুন্তল শুধু এইটুকুই জানে। কিন্তু কার ব্যক্তিগত তদ্বিরে সে লৌহকপাটের বাইরে আসতে পারল, সেটা আজও অপ্রকাশ।
জামিন পেয়ে কুন্তল বাড়ি ফেরেনি। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে গঙ্গার ধারে নির্জন একটা জায়গা বেছে নিয়ে চুপচাপ বসেছিল অনেকক্ষণ। তারপর এক সময় অন্ধকার হয়ে এল চারদিক। ওপারের চটকলে আলো জ্বলে উঠল, আর আকাশে তারা। সেই অন্ধকারে গা ঢেকে কুন্তল এসে দাঁড়াল ফ্ল্যাটের দরজায়। দিনের আলোয় কেন সে বাড়িতে ফিরতে পারল না, তার কারণটা তলিয়ে দেখতে সাহস হয়নি তার।
আশ্চর্য, মিতালিও কোনও প্রশ্ন করেনি। কেন ধরা পড়ল কুন্তল, কি ব্যাপারে, কিছুই জানতে চায়নি। এমনকি জামিনে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে ফিরতেই বা রাত হল কেন, তারও কৈফিয়ৎ চায়নি। যেন রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে ফেরাটাই আজ কুন্তলের পক্ষে স্বাভাবিক। হাজত—ফেরত স্বামী সম্পর্কে মিতালির এই কঠিন উদাসীনতার মূলে ছিল একটা চক্ষুলজ্জা। কোনো প্রশ্ন করলে পাছে কুন্তল কিছু মনে করে, কষ্ট পায়। কিন্তু এই চক্ষুলজ্জার আড়ালে আর একটা জিনিসও লুকিয়ে ছিল। সেটা হচ্ছে ওঝার শিকড়—ছোঁয়ানো সাপের মতো ঝিমিয়ে পড়া একটা বিষাক্ত সন্দেহ। কোনো প্রশ্নের উত্তর যদি ভয়ঙ্কর কিছু শুনতে হয়! তাই কুন্তলকে দরজা খুলে দিয়ে একটা প্রশ্নও করেনি সে। নীরবে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে সে শুধু তাকিয়ে ছিল। দেখছিল, এগারো দিন দাড়ি কামানো হয়নি আর মাথায় তেল পড়েনি বলে কী লক্ষ্মীছাড়ার মতোই না দেখাচ্ছে কুন্তলকে। এই কি তার সাতাশে মাঘের বাঞ্ছিত অতিথি? মাত্র এগারোটা দিনে মানুষ এতো বদলে যায়?
কিন্তু কুন্তল কেন সহজ ভাবে কথা বলতে পারল না স্ত্রীর সঙ্গে? ‘কেমন ছিলে’ বা ‘বড় রোগা হয়ে গেছ’ এই ধরনের একটা মামুলি কুশল—প্রশ্নও তার মুখে এল না কেন? সে কি সত্যই মিতালির চোখে সন্দেহের ছায়া দেখেছিল? না, এটা অতি—সতর্ক অপরাধী মনের স্বভাব।
কয়েক সেকেন্ড মাত্র চেয়েছিল সে মিতালির মুখের পানে। তার পরেই দ্রুত পায়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ভেতরে। অমন করে কেন তাকিয়েছিল মিতালি? কি দেখছিল সে। কুন্তলের মুখের কোথাও অপরাধের দাগ আছে কিনা? জেল—ফেরত আসামির কোনো লক্ষণ আছে কিনা তার মুখের গঠনে, চোখের চাউনিতে? তাহলে মিতালীও তাকে সন্দেহ করে! মনের মধ্যে একটা বিশ্রী সরীসৃপ কিলবিল করে উঠল। কুন্তল বুঝতে পারলে সেটা ঘৃণা। আর সে—ঘৃণা অন্য কেউ নয়—মিতালিরই প্রতি। বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই হাহাকার করে উঠল তার অন্তর। ঠিক সেই মুহূর্তে মিতালির কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে ঝঞ্ঝাহত পাখির মতো কিছুক্ষণ পড়ে থাকতে পারলে কুন্তল হয়তো বেঁচে যেত। কিন্তু আড়ষ্ট দেহটা তার এক পাও এগোল না। দুর্জয় একটা অভিমান বুকের মধ্যে ফেনিয়ে উঠতে লাগল শুধু।
দরজা বন্ধ করে মিতালি ঘরে ফিরে এল। শান্ত গলায় বললে, স্নানের ঘরে গরম জল রাখা আছে। তারপর আর একবার কুন্তলের পানে বোবা চোখে তাকিয়ে চলে গেল রান্নাঘরে।
এগারো দিন আগে ওরা শুধু স্বামী—স্ত্রী ছিল না, ছিল প্রেমিক প্রেমিকা। আর আজ? কোনো রেল—স্টেশনের ওয়েটিংরুমে দুটি আলাপী যাত্রী যেন।
খাটের ওপর ঘুমে নেতিয়েছিল দীপু। সেদিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল কুন্তলের। দু’হাত বাড়িয়ে ঘুমন্ত ছেলেকে বুকে তুলে নিতে গিয়েই থমকে থেমে গেল সে। না, এখন নয়, আগে স্নান সেরে আসুক, ধুয়ে আসুক বড় হাজতের অদৃশ্য ক্লেদ।
স্নান সেরে আসতেই খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে দিলে মিতালি। পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, ‘এটা খাও,’ ‘ওটা ফেলে রেখো না’। আগে যেমন রোজই বলতো। মনটা হালকা হয়ে এল কুন্তলের। মনে হতে লাগল, কোনো রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে নয়, সত্যিই নিজের সংসারে নিজের ঘরের মধ্যেই ফিরে এসেছে সে।
খেতে খেতে হঠাৎ একবার মুখ তুলে চাইলে কুন্তল। দু’জোড়া চোখ পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খেল। একটা মোটরের হেডলাইটের ওপর যেমন উল্টো দিক থেকে আরেকটা মোটরের হেডলাইট এসে পড়ে। একটা মুহূর্ত মাত্র। পরক্ষণেই ‘আর দু’খানা লুচি আনি’ বলে মিতালি চলে গেল। আর, জ্বোরো রোগীর মতো মুখটা তেতো হয়ে গেল কুন্তলের। মিতালি যখন লুচি নিয়ে ফিরে এল, কুন্তলের তখন আঁচানো হয়ে গেছে।
সেদিন একই বিছানায় শুয়ে দুটি মানুষের চোখে ঘুম আসেনি অনেক রাত অবধি। উষ্ণ অশ্রুজলে বালিশ ভিজিয়ে একজন ভাবছিল, ও কেন এখনও চুপ করে আছে? মুখ ফুটে অন্তত একটিবার কেন বলছে না, ‘আমি তোমার সেই কুন্তল, মিতা! কোনো পাপ, কোনও মালিন্য স্পর্শ করেনি আমায়!’ বলুক, হে ভগবান, একবার ও বলুক। সে—কথায় বিশ্বাস করে বাঁচুক মিতালি।
আর একজন বিনিদ্র নিশীথের অদৃশ্য কন্টক—শয্যায় ছটফট করতে করতে ভাবছিল, ও কেন এখনও চুপ করে আছে? মুখ ফুটে অন্তত একটিবার কেন বলছে না, ‘তুমি কি সত্যই অপরাধ করে এসেছ কুন্তল?
মিতালিকে ভালবেসেও এত বড় পাপ করতে পারলে? বলুক, বিধাতা, একবার ও বলুক। সে—কথার উত্তর দিয়ে বাঁচুক কুন্তল।
তবু চুপ করেই রইল দুজন। সারা রাত। আর, দুজনের মাঝখানে ছোট্ট দীপু দুজনের গায়ে দুটি পা তুলে দিয়ে পরম আরামে ঘুমিয়ে রইল। একটা সেতুর মতো।
.
চা নিয়ে এল মিতালি। খবরের কাগজটা টেনে নিল কুন্তল। তাড়াতাড়ি উল্টে দিল প্রথম পাতাটা।
মিতালি বললে, আজ কি বেরোবে কোথাও?
চায়ের পেয়ালায় দৃষ্টি রেখে কুন্তল বললে, ভাবছি বেরোব।
কখন?
দুপুরে?
দাড়ি কামাবার সরঞ্জামগুলো দেব?
নিরুৎসাহ গলায় কুন্তল শুধু বললে, দাও।
হেঁট হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে কুন্তল অনুভব করলে, মিতালি যায়নি, দাঁড়িয়েই আছে। হয়তো সেই ঠান্ডা অপচল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে কুন্তলের দিকে। দৃষ্টিটা সর্বাঙ্গে বিঁধতে লাগল যেন। কেন ও দাঁড়িয়ে আছে এখনও? আর কি বলতে চায়, বলে ফেললেই তো পারে। গোয়েন্দা—পুলিশের মতো সদা—সন্দিগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে কুন্তলের প্রতিটি মুহূর্ত কেন ও অতিষ্ঠ করে তুলছে?
অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে মাথা তুলল কুন্তল। মিতালি বললে, তোমার একটা ফোন এসেছিল—গত পরশু।
ফোন? কোত্থেকে?
রূপকথা পিকচার্স থেকে।
কি বলেছে?
বলেছে, এ ছবিতে কুন্তলবাবুকে আমরা নিতে পারলাম না।
অ্যাডভান্সের টাকাটা অবশ্য ইচ্ছে করলে উনি ফেরত নাও দিতে পারেন।
ও।
কুন্তলের দৃষ্টি আবার চায়ের পেয়ালায় নেমে এল। মিতালিও চলে যাচ্ছিল ফিরে, ঠিক এই সময় নিচ থেকে একটা হই—চই শোনা গেল। বারান্দার নিচেই একটা বড় চত্বর। ফ্ল্যাটবাড়ির ভাড়াটেদের ছেলেপুলেরা সকাল—বিকেল খেলা করে এখানে। কলরবটা সেইখান থেকেই আসছে মনে হল। মিতালি ঝুঁকে পড়ল বারান্দার রেলিং—এ ভর দিয়ে। দেখলে, একতলার চত্বরে যে নাটক চলছে, তার নায়ক স্বয়ং দীপু। দীপুর শার্ট ছেঁড়া, প্যান্টে ধুলো লাগা। লছমন তাকে ধরে রেখেছে। আর, তারই সামনে হাত তিনেক দূরে দু’হাতে নাক চেপে ধুলোর ওপর বসে বসে দীপুরই খেলার সাথী হাবুল কাঁদছে, না ডাকাত—পড়া চিৎকার করছে, বোঝা মুস্কিল। কিন্তু তার চিৎকারকেও ছাপিয়ে যাঁর ফাটা কাঁসরের মতো গলা আকাশ—বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছে, তিনি হচ্ছেন হাবুলের প্রৌঢ়া পিসিমা। হাবুলের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে দুই হাত কোমরে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, দীপুর মতো সর্বনেশে ছেলে তিনি জীবনে দেখেননি। হাবুলের নাকটা একেবারে আদা—ছেঁচা করে দিয়েছে! আসুক হাবুলের বাপ বাজার থেকে। তাকে দিয়ে তিনি পুলিশে ডায়েরি করিয়ে ছাড়বেন।
ছেলে—বুড়ো মেশানো ছোটখাটো একটি জনতা পরমানন্দে এই নাটকটি উপভোগ করছিল দাঁড়িয়ে। তাদের রসাস্বাদনে ব্যাঘাত ঘটিয়ে মিতালি ডাক দিলে, দীপু, ওপরে এসো।
একটু পরেই সিঁড়িতে দুপদাপ আওয়াজ শোনা গেল। লছমনের সঙ্গে হাজির হল দীপু। কোঁকড়ানো চুলের গোছা কপালের ওপর এসে পড়েছে। মুখ—চোখ তখনও রাগে লাল হয়ে আছে।
গম্ভীর গলায় মিতালি বললে, হাবুলকে মেরেছ কেন?
বাচ্চচা বাইসনের মত ঘাড়া বেকিয়ে দীপু জবাব দিলে, বেশ করেছি! আবার মারব।
ধমক দিয়ে উঠল মিতালি, চুপ করো, অসভ্য ছেলে! কেন হাবুলকে মারবে শুনি?
তেমনি ঘাড় বেঁকিয়ে দীপু বললে, ও কেন আমাকে খুনে—ডাকাতের ছেলে বলবে?
হঠাৎ যেন সাইরেন বেজে উঠল। দীপুর কান ধরবার জন্যে হাত বাড়িয়েছিল মিতালি। কয়েক মুহূর্তের জন্যে পঙ্গু হয়ে গেল হাতটা। মুখখানা তার একবার আগুনের মতো টকটকে হয়ে উঠেই আবার অস্বাভাবিক সাদা হয়ে গেল। কোনওমতে সে শুধু বলতে পারল, ঘরে যাও।
ঘরেই যাচ্ছিল দীপু, তার আগে কুন্তল ডাকলে, শোনো।
দীপু কাছে এসে দাঁড়াল।
কুন্তল বললে, হাবুলরা ওইদিকে তিনতলার ফ্ল্যাটে থাকে, না?
দীপু ঘাড় নেড়ে জানালে, হ্যাঁ।
‘আচ্ছা, তুমি যাও’ বলে কুন্তল হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোল। মিতালি পথ আগলে দাঁড়াল : কোথায় যাচ্ছ?
হাবুলের বাবার সঙ্গে একবার দেখা করব।
অস্বাভাবিক শান্ত গলায় মিতালি বললে, না, যেতে হবে না।
যেতে হবে না! গায়ে কেউ কালি ছিটোলেও চুপ করে থাকতে হবে নাকি? কি বলছ তুমি?
কুন্তলের নাকের রন্ধ্র দুটো ফুলে ফুলে উঠছে। এগারো দিনের দাড়ি আর রুক্ষ চুলের মাঝখানে চোখ দুটো খর হয়ে জ্বলছে।
মিতালি যেন তার তাপ অনুভব করতে পারল। তবু সে তেমনি শান্ত গলায় বললে, ঠিকই বলছি। ঝগড়া করে কেলেঙ্কারি বাড়াবার দরকার নেই।
কিন্তু দীপুর মুখ চেয়ে হাবুলের মুখটা বন্ধ করা দরকার।
আর পারল না মিতালি, তার শান্ত গলা তীক্ষ্ন হয়ে উঠল। বললে, থামো। কার মুখে হাত চাপা দেবে? হাবুলের মুখ বন্ধ করলেই কি সকলের মুখ বন্ধ হবে? জোর করে মুছতে চাইলেই সব কালি মোছা যায় না!
কান্না চাপতে চাপতে দ্রুত বেগে চলে গেল মিতালী। আর, হঠাৎ যেন একেবারে নিভে গিয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল কুন্তল। হু—হু করে এল এলোমেলো দমকা হাওয়া। ফরফর করে আবার উল্টে গেল খবরের কাগজের প্রথম পাতাটা। কুন্তল চেয়ে দেখলে, বড় বড় হরফে জ্বলজ্বল করছে খবরটা :
নর্তকী—হত্যার অভিযোগে সুরশিল্পী কুন্তল চ্যাটার্জি
জামিনে মুক্তিলাভ
মিতালি ঠিকই বলেছে। কার মুখে হাত চাপা দেবে কুন্তল?
.
‘দেখে নেবেন স্যার, এবারের ছবি আপনার সিওর হিট!’ ডান হাতের দু’আঙুলে এক টিপ নস্য টিপে প্রচারসচিব বটু মল্লিক বলছিল, গল্পটা কাল কাগজওয়ালাদের শোনালাম। শুনে সকলেই একবাক্যে বললে, ভারি ইন্টেলেকচুয়াল গল্প তো!
প্রকাণ্ড ঝকমকে টেবিলের ওপাশে ঘোরানো চেয়ারে একতাল কাঁচাগোল্লা সন্দেশের মতো বসেছিলেন প্রোডিউসার কন্দর্পকান্তি নন্দী। প্রচারসচিবের কথা শুনে বলে উঠলেন, কি বলেছে? ইন্টেলেকচুয়াল? গল্পটা বুঝতে পারেনি নির্ঘাৎ!
বটু মল্লিক তখনও নস্যির টিপ ছাড়েনি। জিব কেটে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, অমন কথা বলবেন না স্যার! তাঁরা সব গুণী ব্যক্তি। তারপর হঠাৎ প্রবল উৎসাহে গলার শির ফুলিয়ে বলে উঠল, এ ছবি রাষ্ট্রপতি পদক না পেয়ে যায় না। আমি বলি কি স্যার, দিন—ভেনিসেও পাঠিয়ে দিন। আন্তর্জাতিক ছবির জগতেও আপনার নামটা অক্ষয় হয়ে থাক।
কন্দর্পকান্তি বললেন, বটে! মাত্র সাতটা দিন সুটিং হয়েছে, তাইতেই তুমি ছবির ভবিষ্যৎ এতখানি সমঝে ফেললে বটু! ব্যাপারটা কি বলো দিকি? কিছু ক্যাশের দরকার হয়েছে নাকি?
বিনয়ে বটু মল্লিক বিগলিত হয়ে গেল। নস্যির টিপ সমেত হাতটা টেবিলের তলা দিয়ে বাড়িয়ে বললে, পায়ের ধুলো দিন স্যার। আপনি সাক্ষাৎ অন্তর্যামী।
ঘোরানো চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসে কন্দর্পকান্তি বললেন, সকলের না হলেও তোমাদের অন্তর্যামী বইকি! নইলে কি আর তোমাদের চড়িয়ে এই ‘রূপকথা পিকচার্স’ চালাতে পারতাম! তোমরা হয়তো ভাবো আমার চুলের মধ্যে শিং আর মোজার মধ্যে ক্ষুর লুকানো আছে।
নিজের রসিকতায় কন্দর্পকান্তি নিজেই টেনে টেনে হাসতে লাগলেন। অদ্ভুত সেই হাসি। অনেকটা হাঁপানি রোগীর কাশির মতো দমক দিয়ে দিয়ে।
কিন্তু হঠাৎ একটা হেঁচকি তুলে কন্দর্পকান্তির হাসি থেমে গেল। অন্য সবাই, যারা প্রোডিউসার হাসছে বলে হাসা উচিত ভেবে হাঁ করেছিল, তারাও একদম চুপ। পিনটুকু পড়লেও বুঝি বা শোনা যায়, এমনি স্তব্ধতা।
তারপরে কন্দর্পকান্তিই প্রথমে কথা কইলেন। সৌজন্যের অবতার হয়ে বললেন, আসুন কুন্তলবাবু। আসতে আজ্ঞা হোক। জামিন পেলেন তাহলে? পাবেন বইকি! আপনারা হলেন মানী লোক!
দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কুন্তল ‘রূপকথা পিকচার্স’র অফিস ঘরের এধার থেকে ওধার অবধি একবার চোখ বুলিয়ে নিলে। তারপর সোজা এসে দাঁড়াল প্রোডিউসারের টেবিলের মুখোমুখি। আপ্যায়নের ভঙ্গিতে কন্দর্পকান্তি বললেন, বসুন। চা আনতে বলি। না কফি?
কোনোটাই নয়।—একটা চেয়ার টেনে নিয়ে কুন্তল বললে, আপনি অনর্থক ব্যস্ত হবেন না কন্দর্পবাবু।
হাত জোড় করে কন্দর্পকান্তি বললে, বিলক্ষণ! আপনারা গুণী লোক; আপনাদের সেবা করাই তো আমার কাজ।—তারপর, কি মনে করে বলুন তো?
কন্দর্পকান্তির অতি অমায়িকতা কুন্তলের আদপেই ভাল লাগছিল না। কথাটা তাই সে সোজাসুজিই পাড়লে : শুনলাম কিছুদিন আগে আমার বাড়িতে আপনি ফোন করেছিলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি তখন প্রেসিডেন্সি—মানে ইয়েতে ছিলেন।
কুন্তলের কান দুটো ঝাঁ—ঝাঁ করে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, আমার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করা সত্ত্বেও, আজকের কাগজে দেখলাম, আপনার নতুন ছবির মিউজিক অন্য লোক করছেন। হঠাৎ আপনার মত পাল্টানোর কারণটা কি জানতে এলাম।
গলায় মধু ঢেলে কন্দর্পকান্তি বললেন, কারণটা কি জানেন? মানে আপনারা হলেন গুণী লোক—শিল্পী! মন—মেজাজ ঠিক না থাকলে ভাল সুর বেরোবে কেমন করে, বলুন? যে জালে জড়িয়ে পড়েছেন, সে জাল কেটে না বেরুনো অবধি আপনাকে বিরক্ত করা কি উচিত হবে? তাই ভেবে—চিন্তে এ ছবিটি থেকে আপনাকে বাদই দিলাম।
কপালের দুটো পাশ দপদপ করছিল কুন্তলের। একটা শুকনো হাসিতে ঠোঁটের রেখা বেঁকে গেল তার। বললে, আপনি সত্যিই বড় বিবেচক কন্দর্পবাবু।
সখেদে কন্দর্পকান্তি বলে উঠলেন, নারী বড় বিষম চিজ মশাই! ওরই জন্যে সোনার লঙ্কা পুড়ল, ট্রয়নগর ছারখার হল! তবু আহাম্মকেরা বোঝে না—ঘরে সতীলক্ষ্মী স্ত্রী ফেলে মরতে ছুটে যায় ডাইনীর কাছে!
ত্বরিতে উঠে দাঁড়াল কুন্তল। বললে, অর্থাৎ?
তার মুখ—চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন একটু থতিয়ে গেলেন কন্দর্পকান্তি। দেঁতো হাসি হেসে বললেন, মানে, পাঁচজনে পাঁচকথা বলছে আর কি! আপনি তো আর হেঁজিপেঁজি লোক নয়—সুর—জগতের একটা দিকপাল—
ও—কথা থাক। আপনার অ্যাডভান্সের টাকাটা কালই ফেরত পেয়ে যাবেন কন্দর্পবাবু। নমস্কার।
দরজা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুন্তলের কানে এল হাঁপানি রুগির কাশির মতো দমক দিয়ে সেই বিচিত্র হাসি! এবারে কন্দর্পকান্তি একা নয়, রামভক্ত কপিদলের মতো বটু মল্লিকের দলও হাসছে।
ম্যাডান স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা। রূপকথা পিকচার্স থেকে বাণী চিত্রম। হেঁটেই চলল কুন্তল।
পুরাতন ইজিচেয়ারটির ওপর হাঁটু মুড়ে বসেছিলেন বাণী চিত্রমের একমাত্র স্বত্বাধিকারী শ্রীযুক্ত গদাই পাল। বেশভূষায় অত্যন্ত শৌখিন। চেহারায় ডিসপেপাসিয়ার সজীব বিজ্ঞাপন। গতকালকের শুটিংয়ে তিরাশি কাপ চা কেন খরচ হয়েছে, এই নিয়ে প্রোডাকসনের ছোকরা বিপিনকে তিনি যৎপরোনাস্তি ধমকাচ্ছিলেন। ঠিক এই সময় ইজিচেয়ারের পেছন থেকে কুন্তলের স্বভাব—গম্ভীর গলা শোনা গেল : নমস্কার গদাইবাবু!
বিপিনকে তিনি বলতে চাইছিলেন, ‘এই করেই তুমি কোম্পানিকে ডোবাবে’, কিন্তু পিছন দিকে একবার তাকিয়েই কোম্পানির কো পর্যন্ত এসে গদাইবাবু আর এগোতে পারলেন না। বারকয়েক কো—কো করার পর কুন্তল পিছন থেকে সামনে এসে প্রশ্ন করল, কি হল, অমন করছেন কেন?
জবাব দিল বিপিন। একগাল হেসে বলল, বড়বাবু মেক—আপ করা খুনি দেখেছেন বটে, কিন্তু ওরিজিন্যাল খুনি তো কখনও চোখে দেখেননি, তাই আপনাকে দেখে কেমন নার্ভাস হয়ে পড়েছেন বোধ হয়। হোঁচট—খাওয়া জিবটাকে গদাই পাল ততক্ষণে সামলে নিয়েছেন। খিঁচিয়ে উঠে বিপিনকে বললেন, ইডিয়ট! কোথায় কি বলতে হয়, কোনও জ্ঞান নেই। যাও, এখান থেকে!
তিরাশি কাপ চায়ের হিসেব থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বিপিন নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিরস গলায় গদাইবাবু বললেন, কি খবর কুন্তলবাবু?
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলে কুন্তল। বলল, খবর জানতেই তো এলাম। ‘আশাবরী’ ছবির গান—রেকর্ডিং কবে রাখছেন?
তেমনি বিরস মুখে গদাইবাবু বললেন, কিছু মনে করবেন না কুন্তলবাবু, আপনাকে কাজ দেওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।
সম্ভব নয়! কারণ?
চোঁয়া ঢেঁকুর উঠলে মানুষের মুখটা যেমন বিশ্রী হয়ে যায়, তেমনি বিশ্রী মুখে গদাইবাবু বলতে লাগলেন, আমি বড় ফ্র্যাঙ্ক লোক মশাই, রেখে—ঢেকে বলা পছন্দ করি না। আমার ‘বাণীচিত্রমে’ পাঁচটা ভদ্রলোক কাজ করেন, সেখানে একজন খুনিকে রাখলে প্রতিষ্ঠানের বদনাম হতে পারে কিনা আপনিই ভেবে দেখুন
আর একটু হলেই কুন্তল চিৎকার করে বলে উঠত, ‘থামুন!’ কিন্তু তার বদলে সংযত ভদ্র কণ্ঠেই বললে, আমার মামলা এখনও শুরু হয়নি, পুলিশের তদন্তও শেষ হয়নি, অথচ আপনি আমাকে খুনি সাব্যস্ত করে বসলেন। আশ্চর্য!
অবিশ্বাসের হাসি হেসে গদাইবাবু বলেন, গোয়েন্দা পুলিশ ঘাস খায় না, বুঝলেন কুন্তলবাবু! প্রমাণ না পেলে কি তারা কাউকে ধরে? আর আশ্চর্যের কথা বলছেন—আশ্চর্য আপনি নয়, আমরাই হয়েছি। আপনার মতো একটা কালচারড ইয়ং ম্যান—শেষ কালে কিনা একটা নাচওয়ালীর প্রেমে পড়ে—ছিঃ!
ডিসপেপসিয়ার সজীব বিজ্ঞাপন আবার চায়ের স্লিপে মনোনিবেশ করলেন। আর কোনো কথা বলার ছিল না কুন্তলের, বলার প্রবৃত্তিও ছিল না। নিঃশব্দে সে উঠে চলে গেল।
তারপর একে একে আলোছায়া, কাকলি পিকচার্স, স্ক্রিন প্লে এবং নবজীবন প্রোডকসনস। কুন্তলের সামনে সব দরজাই একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সর্বত্রই একই কথা। তোমার গায়ে খুনের দাগ লেগেছে, তুমি খনি, ভদ্রসমাজে অচল, সংসারে বাতিল। এই সেদিনও একজন নামকরা শিল্পী, ভদ্র চরিত্রবান যুবক বলে জনসমাজে তার যে পরিচয় ছিল, লোকে তা রাতারাতিই ভুলে গেল? কালো ধোঁয়া আর কালো কুয়াশায় কলঙ্কিত শহরের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কুন্তলের হাসি পেল। মানুষের সুনাম কত ঠুনকো! তার চেয়েও ঠুনকো মানুষের কাছে মানুষের পরিচয়।
গায়ে একটা ধাক্কা লাগতেই ফিরে তাকায় কুন্তল। দেখে, অবিনাশ মিত্তির পান—খাওয়া দাঁত বার করে বলছে, মামলার তারিখ কবে পড়ল হে!
অবিনাশ তার পিসতুতো সম্বন্ধি। দাঁতে দাঁত চেপে কুন্তল বলে, কেন, যাবে নাকি কোর্টে?
অবিনাশ উৎসাহিত হয়ে বলে, যাব না? কি নাম যেন নাচউলীটার—শোভা ইম্যানুয়েল, না? বাঁধা ছিল বুঝি? কদ্দিন?
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে কুন্তল বললে, অনেক দিন।
একটা কাঠি বের করে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে অবিনাশ বললে, এঃ! ছ্যা—ছ্যা, এমন ভুলও মানুষে করে! বুদ্ধি খাটিয়ে খুনের দায়টা আর কারও ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারলে না?
খুব সহজভাবে কুন্তল বললে, তাই তো দিয়েছি। তোমার নামটাই বলেছি পুলিশের কাছে।
‘ওসব ইয়ার্কি আমি ভালোবাসি না মাইরি!’ বলতে বলতে কাঠি—হাতে অবিনাশ ভিড়ের মধ্যে ছিটকে সরে গেল। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কুন্তল হঠাৎ হা—হা করে হাসতে শুরু করলে পাগলের মতো। আর হাসতে হাসতেই তার মনে পড়ে গেল, পরশু তার মামলার প্রথম শুনানী।
জুরিদের সামনে খুনি আসামি কুন্তলের ভাগ্য নিয়ে আইনের পাশা খেলা শুরু হবে।
কে জিতবে? আইন না সত্য? মানুষ না বিধাতা?
.
*