কুয়াশার রাত – ২

কত টাকার কিনবেন?

আড়াই হাজার!

ন্যাশনাল প্ল্যানিং সেভিং সার্টিফিটেক?

হ্যাঁ।

ইন্ডিয়া ব্যাঙ্কের গুজরাটি ম্যানেজার শঙ্করলাল হাসিমুখে বললেন, আপনাদের ফিল্ম লাইনে শুনতে পাই অপচয় আছে সঞ্চয় নেই। আপনাকে দেখে ধারণাটা বদলে গেছে মিস্টার চ্যাটার্জি।

হেসে কুন্তল বললে, কি জানেন শঙ্করলালজি, দশ বছরের বেশি কোনো আর্টিস্টই ভালোভাবে কাজ করতে পারে না। তাই আমার মতো আরও অনেকেই দশ বছর পরের ভাবনাটা এখনই ভেবে রাখেন।

পেন্সিলটা হাতে নিয়ে শঙ্করলাল বললেন, সার্টিফিকেট কার নামে কেনা হবে? আপনার?

না, আমার ছেলে দীপেন চ্যাটার্জির নামে। যা জানবার আছে লিখে নিন।

খসখস করে চলল শঙ্করলালের হাতের পেন্সিল। তারপর লেখা থামিয়ে ঘণ্টা টিপতেই এল চাপরাশি। স্লিপটা তার দিকে এগিয়ে বললেন, মিস লালা।

হাতঘড়িটা একবার দেখলেন শঙ্করলাল। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, একটু বসুন মিস্টার চ্যাটার্জি, আসছি। ততক্ষণে আমার স্টেনো ফর্ম ভর্তি করে দিক।

কতক্ষণ বসতে হবে?—কুন্তল প্রশ্ন করল।

খুব বেশি হলে মিনিট দশেক।

আর একবার হেসে শঙ্করলাল বেরিয়ে গেলেন। ম্যানেজারের ঘরে একা বসে রইল কুন্তল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল আজ সকালের সেই ছবিটা। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে মিতালি। হাসিভরা চোখ দুটি বলছে, শিগগির করে ফিরো কিন্তু। আর তারই কোলের কাছে একমাথা ঝাঁকড়া চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দীপু! আশ্চর্য! আজ সকালে এই ছবিটা দেখার পর থেকে সে মিতালিকে কিছুতেই আলাদা করে ভাবতে পারছে না। কোলের কাছে দীপু নইলে ছবিটা যেন কিছুতেই সম্পূর্ণ হয় না।

হাত আড়াল দিয়ে ছোট্ট একটা হাই তুলল কুন্তল। বেলা অবধি ঘুমোলেও রাত জাগার অবসাদটা এখনও যেন কাটেনি। চুপচাপ বসে থাকলেই সেই বিরক্তিকর অবসাদটা যেন চেপে ধরে। দশ মিনিট কি হয়নি এখনও? দশ মিনিট হতে কি দশটা মিনিটেরও বেশি সময় লাগে? একটা সিগারেট খাওয়া যাক। পকেট থেকে বেরোল গোল্ড ফ্লেকের আনকোরা প্যাকেট। অভ্যাসের বশে সোনালি বিরনটা খুলে নিল কুন্তল। তারপর অভ্যস্ত আঙুলে রিং তৈরি করে যখন বাঁধছে, ঠিক সেই সময়েই খুট খুট করে হাই হিল জুতোর মৃদু আওয়াজ হল।

ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাল কুন্তল। সুইংডোর ঠেলে ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে স্কার্ট পরা একটি মেয়ে। সাধারণ দোহারা চেহারা। কাঁধ অবধি খাটো ফাঁপানো চুল, হাতের নখে লাল রঙ। হাতে সার্টিফিকেটের ফর্ম। ব্যাঙ্কের কোনো কর্মচারী। স্টেনোও হতে পারে।

প্রায় পনেরো সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটি নিঃশব্দে। টকটকে লাল পুরু ঠোঁট দু’খানা কিছু বলার জন্যে ফাঁক হয়েই রইল। চোখের তারা দুটো একবার ঝিলিক দিয়ে উঠেই স্থির হয়ে গেল। পলক পর্যন্ত পড়ল না পনেরো সেকেন্ড ধরে। জ্যান্ত মানুষ হঠাৎ পুতুল হয়ে গেলে যেমন হয়।

শঙ্করলালজিকে খুঁজছেন?

অস্বস্তিকর নীরবতা কুন্তলই ভাঙলে প্রশ্ন করে।

হঠাৎ আবার নড়ে উঠল স্কার্ট পরা পুতুলটা। চোখে পড়ল পলক। অত্যুগ্র লাল ঠোঁট দু’খানা আরও একটু ফাঁক হয়ে প্রথমে ক্ষীণ আওয়াজ বেরোল ‘হ্যাঁ’। তারপরে ‘না’।

সোনালি রিঙটার মধ্যে তর্জনি ঢুকিয়ে ঘোরাচ্ছিল কুন্তল। আবার প্রশ্ন করলে, শঙ্করলালজি কখন ফিরবেন মনে হয়?

মেয়েটির কণ্ঠস্বরে কেমন যেন উৎসাহ প্রকাশ পেল, শঙ্করলালজি? এখনই আসবেন—এই এলেন বলে—আপনি যাবেন না যেন, বসুন—

বলতে বলতে সুইংডোর ঠেলে অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটি। আর সেইদিকে তাকিয়ে কুন্তল ভাবতে লাগল, দু’একটা ‘স্ক্রু’ ঢিলে আছে নাকি মেয়েটির মাথায়? কথাগুলো কেমন যেন এলোমেলো।

সোনালি রিবনের রিঙটাকে দু’আঙুলের টোকা দিয়ে কুন্তল ছুড়ে দিলে মাথার ওপর ঘুরন্ত পাখার দিকে। পাখার ব্লেডে লেগে রিঙটা ফিরে এল শঙ্করলালের টেবিলের ওপর। একটা সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে টানল কুন্তল। আরও কতক্ষণ বসতে হবে কে জানে! ব্যাঙ্কের দশ মিনিট যে দশটা মিনিটে হয় না, এটা তার আগেই বোঝা উচিত ছিল। বেলা হলেও মিতালি আজ অন্তত কিছুতেই একা খাবে না। আশ্চর্য! সিঁড়ির মাথায় সেই ছবিটা আবার মনে পড়ে গেল কুন্তলের। মিতালির কোলের কাছে দীপু দাঁড়িয়ে। একমাথা ঝাঁকড়া চুলের নিচে কচি পাতার মতো টুলটুলে মুখখানি।

সহসা একটা সমস্যার মধ্যে পড়ে গেল কুন্তল। কাকে সে বেশি ভালবাসে? মিতালি না দীপুকে? কখনও মনে হয়, তার মনের সবটাই দখল করে বসে আছে মিতালি; আবার কখনো মনে হয়, না, মিতালি তো নয়, দীপু। একটি মুখ ভাবতে গেলে আর একটি মুখ এসে আড়াল করে দাঁড়ায়। দীপু আসার পর থেকে মিতালির প্রতি তার ভালোবাসা কি কমে গেছে? মনে মনে কুন্তল অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে লাগল। মিতালিকে কোনোদিন কম ভালোবাসবে কুন্তল, এটা যেন একটা চোরা অপরাধ। অথচ নিজের ছেলেকে—বিশেষ করে দীপুর মতো ছেলেকে না ভালোবেসেই বা উপায় কি! বড় কঠিন সমস্যায় পড়া গেল।

কিন্তু সিগারেটে টান দিতেই বুদ্ধি খুলে গেল। আরে দূর, দীপুকে ভালোবাসা মানেই তো মিতালিকে ভালোবাসা। দীপু আর মিতালি কি তফাত? দীপু তো মিতালিরই অংশ। সুতরাং তার ভালোবাসায় কম পড়েছে কোথায়?

অত্যন্ত সহজে অত্যন্ত কঠিন একটা সমস্যার সমাধান করে খুশি হয়ে উঠল কুন্তল। ধরাল আর একটা সিগারেট। আজকে কি কি জিনিস সওদা করতে হবে, মনে মনে একটা লিস্ট করে ফেলল। মিতালির জন্যে ডজন দুই গোলাপ ফুল। আর ঝাল দেওয়া কাজুবাদাম। দীপুর জন্যে ‘ক্যাডবেরি’ চকোলোট। আর তার নিজের জন্যে ভাল একটিন সিগারেট। ওহো, তার নিজের জন্যে আরও একটা জিনিস বিশেষ দরকার। কিছু মিউজিক পেপার। গোয়ানিজ বাজিয়েদের জন্যে নতুন ছবির একটা গানের সুর ইংরাজিমতে লিখে দিতে হবে। আচ্ছা, কেমন দাঁড়াল নতুন গানটার সুর? দু’হাত দিয়ে শঙ্করলালের টেবিলে মৃদু মৃদু তাল দিতে দিতে কুন্তল গুনগুন করতে লাগল গানের মুখড়াটা। মন্দ কি, ভালোই তো হয়েছে। কিন্তু অন্তরা? কোন পথে উঠবে?

পুড়তেই লাগল অ্যাশট্রেতে—রাখা গোটা সিগারেট। ডুবে গেল কুন্তলের মধ্যেকার শিল্পী সুরের নেশায়। বিচিত্র ছন্দে টোকা পড়তে লাগল শঙ্করলালের টেবিলে। আর দেয়ালের গায়ে ঘড়ির ডায়ালের বুকে মুহূর্তরা মরে যেতে লাগল এক—এক করে।

অন্তরাটা মনে মনে শেষ করে সঞ্চারীতে এসে পৌঁছেছে কুন্তল, এমন সময় তার পেছনে জুতোর আওয়াজ হল। একটি নয়, অনেকগুলি। ফিরে তাকিয়েই কুন্তল যেন পাথর হয়ে গেল। সুইংডোর ঠেলে স্কার্ট পরা মেয়েটি এবার একা আসেনি। সঙ্গে এসেছে একজন পুলিশ অফিসার, দুজন সার্জেন্ট। আর জনকয়েক কনস্টেবল।

কুন্তলকে দেখিয়ে পুলিশ—অফিসার বললেন, এই লোক?

স্কার্ট পরা মেয়েটি ভয় আর ঘৃণা মেশানো দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল কুন্তলের দিকে। মুখ না ফিরিয়েই জবাব দিলে, হ্যাঁ, এই লোক—একেই দেখেছিলাম গত রাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে! এই সবুজ—চেক কোট আর লাল টাই।

আপনার নাম?

যমুনা লালা, ইন্ডিয়া ব্যাঙ্কের স্টেনো।

কুন্তলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে অফিসার বললেন, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে নর্তকী শোভা ইম্যানুয়েলকে হত্যা করার দায়ে আপনাকে আমি গ্রেফতার করলাম।

আশ্চর্য, একটিও জবাব দিলে না কুন্তল। শুধু চেয়ে রইল।

 * * *

কুন্তলকে যখন কয়েদি—গাড়িতে তোলা হল, তখন বেলা প্রায় চারটে। ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক থেকে থানা, থানা থেকে পুলিশ হেড কোয়ার্টাস, তারপর সেখান থেকে ব্যাঙ্কশাল কোর্ট। পুলিশ তদন্তের সুবিধের জন্যে কুন্তলকে জামিন দেওয়ার কোনও প্রশ্নই উঠল না। অতএব কোর্ট থেকে এখন চলেছে আলিপুর প্রেসিডেন্সি জেল।

শীতের ছোট দিন। এরই মধ্যে পড়ে আসছে। কালচে হয়ে আসছে শুকনো সূর্যমুখীর পাপড়ির মতো। কয়েদি—গাড়ি এসে থামল প্রেসিডেন্সি জেলের ফটকের সামনে। আরও ছ’জন কয়েদির সঙ্গে নামল কুন্তল। সহযাত্রী কয়েদিদের দুজন এসেছে চুরির দায়ে, দুজন দাঙ্গা আর ডাকাতির অভিযোগে। একজন নারীহরণ, আর একজন খুনের অপরাধে। এদের মধ্যে কুন্তল এতই বেমানান যে ফটকের বুলডগ—মুখো সার্জেন্টটি পর্যন্ত কয়েক মহূর্ত তাকিয়ে রইল তার দিকে। চার্জশিটের কাগজখানা আর একবার ভাল করে দেখল, লেখা রয়েছে ৩.২ আই পি সি। অর্থাৎ নিছক নরহত্যা। বুলডগ—মুখো সার্জেন্ট নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করল শুধু। তার মানে সার্জেন্ট প্রকৃতই বিস্মিত হয়েছে।

কয়েদিদের দেহ একে একে তল্লাশি করে ভেতরে চালান করে দেওয়া হল। এই পড়ন্ত বেলার আবছা অন্ধকারে মনে হল, প্রকাণ্ড জেলখানাটা একটা প্রাগৈতিহাসিক অতিকায় জন্তুর মতো মুহূর্তের জন্যে হাঁ করেই একসঙ্গে সাতটা প্রাণীকে গ্রাস করে নিলে। ভেতরে যেতে যেতে কুন্তল শুনতে পেল লোহার গেট বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। ক্ষণকালের জন্যে কুন্তলের সমস্ত শরীর হিম হয়ে এল। ওই লৌহ—কপাটের বাইরে পড়ে রইল আলো—হাসি—গানের জগৎ। সে চলে এল অন্ধ কারার গর্ভে। তার জীবনে ওই লৌহকপাট আর কোনোদিন খুলবে কি? পেছন থেকে মৃদু ধাক্কার সঙ্গে একটা কথা কানে এল, চলেন বাবু!

কয়েদিদের লাইনে কুন্তল আবার এগোয়।

ডেপুটি—জেলারদের অফিস—ঘর পার হয়ে একটা বাঁধানো সড়ক। সেই সড়কের বাঁ দিকে ‘চুয়াল্লিশ ডিগ্রি’। ইংরাজিতে যাকে বলে কনডেমড সেল। অর্থাৎ ফাঁসির আসামিদের ঘরে। সেগুলো ছাড়িয়ে সড়কটা ডান দিকে ঘুরে যেখানে গেছে, সেইখানেই ‘বড় হাজত’। বড় হাজত মানে একদিকে ইটের দেয়াল, আর তিন দিকে মোটা মোটা লোহার শিক দিয়ে ঘেরা লম্বা—চওড়া একটা খাঁচা—মানুষ—জন্তুদের পুরে রাখার জন্যে। সেই বিচিত্র খাঁচার মধ্যে কুন্তলদের পুরে ওয়ার্ডার চাবি দিয়ে চলে গেল। খাঁচার মধ্যে আরও জন—পঁচিশ—তিরিশ মানুষ—জন্তু পোরা রয়েছে। বিচিত্র খাঁচার মধ্যে এক বিচিত্রতর জগতে এসে পড়ল কুন্তল। এরা ঠিক কয়েদি নয়, বিচারাধীন কয়েদি।

ডোরাকাটা হাফ প্যান্ট, খাটো কুর্তা আর কাপড়ের টুপি মাথায় ষণ্ডামার্ক চেহারার একজন কয়েদি মুরুব্বির মতো ভঙ্গিতে বললে, কি রে মতিলাল, আবার এয়েচিস? এই তো তিন মাস হয়নি, গেলি।

মতিলাল আজকের চালান। চুরির আসামি। মাড়ি শুদ্ধ দাঁত বার করে বললে, কি করি মেট, কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে জেলখানার ওপর।

মেট ফতেলাল আবার বললে, এই যে, গঙ্গাও এসেছ দেখছি! আরে বা! রঙ্গুও যে! আজ দেখছি সব পুরোনো ইয়ারদের আমদানি।

গঙ্গা নারীহরণ আর রঙ্গু দাঙ্গা—ডাকাতির আসামি। দুজনেই দাগি। ফতেলালকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলবে, বড় হাজতে ‘দাগির’ আমদানিই বেশি।

কুন্তলের দিকে নজর পড়তেই ফতেলাল দু’পা এগিয়ে এল তার কাছে। তার আপাদমস্তকে একবার চোখ বুলিয়ে বললে, স্বদেশি তো? বোমা না পিস্তল?

কুন্তল শুধু বললে, না। তারপর সরে গিয়ে এক কোণে ক্লান্তভাবে বসল। আশেপাশে তখন কম্বল বিছানো শুরু হয়ে গেছে। রাতের আস্তানা। বাড়ি নয়, ঘর নয় জেলখানা। তবু তিন হাত জায়গা নিয়ে কাড়াকাড়ি। সমস্ত খাঁচাটা কয়েদির কলরবে একটা বড় ভীমরুলের চাকের মতো ভনভন করছে।

এগিয়ে এল মতিলাল। মাড়ি শুদ্ধ দাঁতগুলি বার করে বললে, বসে বসেই রাত কাটাবেন নাকি? নেন, কম্বলখানা বিছিয়ে ফেলুন। বলে নিজেই বিছিয়ে দিলে কোণ ঘেঁষে।

নোংরা কম্বলে বসতে কুন্তলের গা ঘিনঘিন করছিল। তবু একধারে বসল দেয়ালে হেলান দিয়ে। ক্লান্ত, অমানুষিক ক্লান্তি লাগছে তার।

মতিলাল বললে, পেথমবার আমারও অমন হয়েছিল বাবু। বড় হাজতে ঢুকে মনটা হু—হু করে উঠেছিল! কান্না পেয়ে গেছিল বউটোর জন্যে। নতুন আসামি হলে অমন ধারা হয়। তারপর দু’একবার এখানে আসা—যাওয়া করলে সব ঠিক হয়ে যায়।

অতি সহজেই অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠল মতিলাল। বোধ হয় দাগি আসামি চরিত্রের এও একটা লক্ষণ।

খান বাবু।

চোখ বুজে কুন্তল আচ্ছন্নের মতো বসেছিল। চোখ মেলে দেখলে, মতিলালের হাতে সাদা কাগজে পাকানো সরু লম্বা একটা সিগারেটের মতো বস্তু।

টানুন, মৌজ হবে। মনে কোনো দুঃখু থাকবে না।

কি এটা? কুন্তল প্রশ্ন করলে।

আর একবার মাড়ি শুদ্ধ দাঁত দেখিয়ে মতিলাল বললে, আজ্ঞে চরস!

ও আমি খাই না মতিলাল।

তবে বিড়ি খাবেন? বিড়ি?

না।

দেশলাই বার করে মতিলাল অগত্যা নিজেই ধরিয়ে ফেললে চরসের বিড়িটা।

কুন্তল এদিক—ওদিক চেয়ে দেখলে, শুধু মতি নয়, যে যার কম্বলে বসে আরও অনেকেই মৌতাত শুরু করে দিয়েছে। চরসের কটু গন্ধ লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে বাইরে সান্ত্রীদের নামে পৌঁছলেও তাদের বিন্দুমাত্র বিচলিত দেখা গেল না।

লাল কটাচুলো একটা জোয়ান এসে বসল কুন্তলের কম্বলে। পরনে ময়লা হাফ শার্ট আর কার্ডের ট্রাউজার। তামাটে ফর্সা মুখে অজস্র তিল। দু’হাতের কব্জির ওপর উল্কি দিয়ে নগ্ন মেয়ের ছবি আঁকা। এও আজকের চালান কুন্তলের সঙ্গে। আদালতে নাম শুনেছে পল জ্যাকসন, জাতে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, খুনের মামলার আসামি।

পল এসে বললে, গট ম্যাচিস বাবু?

উত্তরে কুন্তল শুধু ঘাড় নাড়লে।

মতি তার ট্যাঁক থেকে দেশলাইটা বের করে দিলে, এই লাও!

বিড়ি—সিগ্রেট কুছ হ্যায়?

মতির মাড়ি শুদ্ধ দাঁত আবার বেরিয়ে পড়ল। বললে, বা সাহেব, বেড়ে মজার লোক তো তুমি! দেশলাই নেই, বিড়ি—সিগ্রেট নেই, শুধু নেশার অভ্যেসটি নিয়ে খাতির জমাতে এসেছ? লাও, এটাতে দু’টান দিয়ে কেটে পড়ো।

আধ—খাওয়া চরসের বিড়িটা এগিয়ে দিলে মতিলাল। পল সেটা ছোঁ মেরে নিয়ে বললে, থ্যাঙ্ক ইউ ইয়ার।

চুপচাপ বসে আছে কুন্তল। দুই চোখের দৃষ্টিতে গভীর অবসাদ। পল আর মতির এত কাছে বসেও সে যেন বহু দূরে।

চরসে টান দিয়ে পল বললে, হোয়াই মোরোজ বাবু? ঘাবড়া গিয়া কাহে?

কুন্তল পলের দিকে তাকাল। যেন কিছুই বুঝতে পারেনি, এমনি ভোঁতা নির্বাক সে দৃষ্টি।

মতি বললে, নতুন আসামি কিনা, তাই।

কিসের চার্জ? জালিয়াতি? অ্যাডাকসন?

তিনশো দুইধারা।

পল যেন খুশি হয়ে উঠল। বলল, ব্র্যাভো! এতে ঘাবড়াবার কি আছে? আমারও তো ওই চার্জ।

কুন্তল হঠাৎ অসহায়ের মতো বলে ফেললে, কোথা দিয়ে কি যে হয়ে গেল—ভাবতেও পারছি না!

পল বললে, নেভার মাইন্ড! মানুষ হয়ে জন্মালে দু’চারটে মানুষ খুন করতেই হয়। দিস ইজ দি ল অফ গড। কিছু ভেবো না ম্যান। ইট ড্রিঙ্ক অ্যান্ড রি মেরি।

চরসের প্রসাদে পলের মেজাজটা বোধ হয় খুবই খুলে গেল। হঠাৎ গলা ছেড়ে সে গান ধরলে :

লাভ মি, অর লিভ মি—

বাইরে থেকে সান্ত্রীর কড়া ধমক এল। প্রত্যুত্তরে অ্যাংলো ভাষায় একটা কুৎসিত গালাগালি দিয়ে উঠল পল। আর মাড়ি শুদ্ধ দাঁত বের করে হাসতে লাগল মতি।

আচ্ছন্নের মতো আবার চোখ বুঝলে কুন্তল। এখন, ঠিক এই মুহূর্তে পল আর মতির পাশে তাকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে কি সে কুন্তল চ্যাটার্জি, ভদ্রবংশের সন্তান, একজন নামকরা সুরকার, মিতালির স্বামী, দীপুর বাবা?

.

 * * * *

.

তারপর একসময় নিশুতি হয়ে এল জেলখানার রাত্রি। নিস্তব্ধ হয়ে এল বড় হাজত। কয়েদিরা যে—যার কম্বলে শুয়ে চোখ বুজল! জেগে রইল কুন্তল। দেয়ালে তেমনি ঠেস দিয়ে, ক্লান্ত অবসন্ন ভঙ্গিতে বসে। ভাবতে চেষ্টা করল মিতালি এখন কি ভাবছে। খবরটা কি পেয়েছে সে? কে জানে! প্রতি বছরের মতো আজও কি সে জীবনের পুষ্পিত সাতাশে মাঘের রাত্রিকে মনে মনে স্বাগত জানাচ্ছে? না, ব্যর্থতায়, বেদনায়, লজ্জায়, ধিক্কারে অভিশাপ দিচ্ছে সাতাশে মাঘকে?

পাশের কম্বলে শুয়েছিল মতিলাল। কুন্তল হঠাৎ তাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকলে, মতি, ও মতি!

ঘুম চোখে উঠে বসল মতিলাল।

কুন্তল বললে, শুনতে পাচ্ছ, কিসের আওয়াজ বলো তো? নিশুতি রাত্রির বুকের ওপর দিয়ে একটা ভারী চলমান আওয়াজ যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে : ঝমর—ঝম, ঝমর—ঝম, ঝমর—ঝম—

হাই তুলে মতি বললে, ও ‘দায়মলি’দের ডান্ডা—বেড়ির আওয়াজ! শালারা কালাপানি যাবে কিনা, তাই ঘুমোতে পারে না—সারারাত পায়চারি করে।

কালাপানি যাবে? কেন মতি? প্রশ্ন করতে গিয়ে কুন্তলের গলাটা যেন শুকিয়ে এল।

খুনি আসামি যে! সাজা হয়ে গেছে।

মতি আবার ধুপ করে শুয়ে পড়ে চোখ বুজল। আর আড়ষ্ট হয়ে রইল কুন্তল। তার মনে হতে লাগল, নিশুতি রাত্রির বুকের ওপর ওই চলমান ঝমর—ঝম—শব্দটা যেন ক্রমশ বাড়ছে। কয়েদখানার দেয়ালে দেয়ালে ঘা খেয়ে লৌহশৃঙ্খলের ওই বিশ্রী নিষ্ঠুর আওয়াজটা একটা রক্তপায়ী হিংস্র জন্তুর মতো গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। যেন ঝাঁপিয়ে পড়বে তারই বুকের ওপর।

প্রাণপণে দুই কান চেপে ধরল কুন্তল।

.

 * * * *

.

অতি বড় বেদনায় যেমন হাসি পায়, অতি বড় উৎকণ্ঠায় তেমনি ঘুমও আসে।

দীপুর পাশে জেগে থাকতে থাকতে মিতালির চোখের পাতা বুজে এল। আর সেই ফাঁকে কখন ভোর হয়ে গেল সাতাশে মাঘের ব্যর্থ বিড়ম্বিত রাত্রি। শুকিয়ে গেল চোখের অশ্রু। মুছে গেল চন্দন—কুমকুমের টিপ। মলিন হয়ে গেল পায়ের আলতা। বৃথাই পুড়ে মরল মিতালির সাধের কস্তুরী ধূপ খাটের শিয়রে। আর মিছেই পড়ে রইল কুন্তলের জন্যে সাধের রান্না।

সামনের দেয়ালে ক্যালেন্ডারের সাতাশে মাঘ তারিখটা ঠোঁট বেঁকিয়ে যেন মিতালিকে ব্যঙ্গ করতে লাগল। ঘরের বাতিটা নিভিয়ে দিলে মিতালি। মনে—প্রাণে যেন চাইল অন্ধকারের কালিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক তাদের বিয়ের তারিখ।

ঘুম ভাঙতে বেলা হল মিতালির। বেলা হওয়াই স্বাভাবিক। এ—ঘুম ক্লান্তির ঘুম। সকালে উঠে অভ্যাস মতো দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম বারান্দার টেবিলে রাখতে যাচ্ছিল মিতালি, হঠাৎ মনে পড়ে গেল কুন্তল নেই! কুন্তল আসেনি কাল সারারাত। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মনের আকাশ, দু’খানা করে চিরে গত দিনের একটা ঘটনা বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠল।

বেলা একটার থেকেই বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল মিতালি। এইবার এসে পড়বে কুন্তল। যাবার সময় বলে দিয়েছিল মিতালি, ‘সকাল সকাল ফিরে এসো’। কতক্ষণ আর লাগে ব্যাঙ্ক থেকে সার্টিফিকেট কিনতে আর ফুলের দোকানে সওদা করতে? ঠাকুরটাকে আজ সকাল সকাল বিদেয় করে দিয়েছে মিতালি। রান্নার পাট চুকিয়ে স্নান সেরে এসেছে। আর্শির সামনে বসে কপালে পরেছে চন্দন কুমকুমের টিপ। পায়ে এঁকেছে আলতার রেখা। সাদা সাদা ফুলতোলা নীলাম্বরীর আঁচলে অল্প করে মেখেছে অনেক দিনের পুরোনো ‘খস’ আতর। এটুকু প্রসাধন মিতালি প্রায়ই করে। তবু আজ থেকে থেকে কেমন যেন লজ্জা করছে তার। কুন্তলের সেই একটু—বিস্ময়, একটু—হাসি, একটু মোহ—মাখানো চোখের দৃষ্টি কল্পনা করে কেমন একটা সুখকর অনুভূতি হচ্ছে তার।

কিন্তু এত দেরি হচ্ছে কেন কুন্তলের? সার্টিফিকেট না হয় না—ই কেনা হত আজ। না—ই হত গোলাপ ফুলের সওদা। সামান্য ক’টা গোলাপের জন্যে এত বেলা করার কি দরকার? বেলা করে বাড়ি ফেরাটা কুন্তলের সত্যিই স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। বিশ্রী লাগে মিতালির।

কিন্তু বেলা হতে হতে বেলাও ফুরিয়ে আসে একসময়। দুটো, তিনটে, চারটে। কতক্ষণ পরমায়ু শীতের বেলার? মিতালির ইচ্ছে হতে লাগল ঘড়ির কাঁটা দুটোকে চেপে ধরে। কুন্তলের ওপর শুধু রাগ—অভিমান নয়, কি একটা অনির্দেশ্য ভয় দলা পাকিয়ে মাঝে মাঝে আটকে যাচ্ছিল মিতালির গলার কাছে। কেন আসছে না কুন্তল? কোথায় গেল সে? সিঁড়িতে কার পায়ের আওয়াজ হল না? পড়ি—কি—মরি করে ছুটে গেল মিতালি। না, কুন্তল নয়, ডাক—পিয়ন। লেটার বাক্সে চিঠি ফেলে চলে যাচ্ছে। দড়াম করে কপাট দিয়ে ঘরে ফিরে এল মিতালি। ইচ্ছে হচ্ছিল, এক টানে খুলে ফেলে নীলাম্বরী, মুছে ফেলে চন্দন—কুমকুম, সাবান ঘষে তুলে ফেলে পায়ের আলতা। বছরে একটা মাত্র দিন, জীবনের পরম তিথি, তাও এমনি করে নষ্ট করে দেবে কুন্তল! মিতালির চোখ ফেটে জল আসতে গিয়ে থমকে থেমে গেল। সেই অনির্দেশ্য ভয়টা শুকনো পিণ্ডের মতো দলা পাকিয়ে গলার কাছটায় আবার আটকে ধরেছে। কুন্তল এখনও আসছে না কেন? কেন, কেন?

নড়ে উঠল দরজার কড়া। সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসল মিতালি। খুলবে না, এত সহজে সে দরজা খুলবে না কিছুতেই। সারাটা দিন যখন বাইরে থেকেছে, তখন কি দরকার দয়া করে এত সকাল সকাল ফেরবার?

আবার নড়ে উঠল দরজার কড়া। আরও একবার।

উঠতেই হল মিতালিকে। সারাটা দিন খাওয়া নেই দাওয়া নেই, বেচারিকে দাঁড় করিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না। সারা মুখে রাগ—অভিমান আর চাপা হাসির ইন্দ্রধনুচ্ছটা নিয়ে দরজা খুলে দিল মিতালি।

আর সঙ্গে সঙ্গে সেই অনির্দেশ্য ভয় দলা পাকিয়ে তার শ্বাসনালীর কাছে আটকে গেল। এবারেও কুন্তল নয়, পুলিশ। একজন অফিসার আর জন জনকয়েক সাদা পোশাকে কনস্টেবল।

মাথাটা সামনের দিকে একটু ঝুঁকিয়ে অফিসার প্রশ্ন করলে, কুন্তল চ্যাটার্জি আপনার কে হন?

স্বামী।—মিতালির গলা দিয়ে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ বেরোল।

কাল রাতে আপনার স্বামী কখন বেরিয়েছিলেন? মনে করে বলুন তো?

সাড়ে দশটা নাগাদ।

আর ফিরেছিলেন কখন?

ভোরবেলা।

তাঁর পরনে কি ছিল মনে আছে?

মিতালির কথা জড়িয়ে আসছে। তবু বললে, গ্রে ফ্লানেল ট্রাউজার সবুজ চেক টুইডের কোট আর লাল টাই।

‘সবুজ কোট, লাল টাই’! পুনরাবৃত্তি করলেন অফিসার। আচ্ছা, আপনার স্বামী কোন সিগারেট ভালবাসেন? গোল্ড ফ্লেক?

মিতালি ঘাড় নেড়ে সায় দিলে। নোটবইয়ে টুকে নিতে লাগলেন অফিসার। হঠাৎ সেই অনির্দেশ্য ভয়ের পিণ্ডটা সরে গেল গলার কাছ থেকে। শুকনো গলায় মিতালি চিৎকার করে উঠল, কোথায় তিনি—বলুন—কি হয়েছে তাঁর?

নোটবইখানা পকেটে রাখতে ভয়ঙ্কর শান্ত গলায় অফিসার বললেন, কাল রাতে একজন নর্তকী খুন হয়েছে। আপনার স্বামী গ্রেফতার হয়েছেন সেই খুনের চার্জে।

মিতালির মনে হল, পায়ের নিচে মেঝেটা লিফটের মতো নিচে নেমে যাচ্ছে, কত নিচে, কে জানে! অনেক দূর থেকে ভেসে এল অফিসারের গলা : এক্সকিউজ মি। আপনাদের ঘরগুলো একবার সার্চকরতে চাই।

একপাশে সরে গিয়ে দরজার পথটা মিতালি ছেড়ে দিল। আশপাশের ফ্ল্যাট থেকে কয়েকজন সাক্ষী নিয়ে পুলিশের দল ভেতরে ঢুকে গেল। কতক্ষণ পরে তারা বেরিয়ে গিয়েছিল, মিতালি তা জানে না। শীত—সন্ধ্যার অন্ধকার তখন কালো দুশ্চিন্তার মতো ঘনিয়ে এসেছে। সেই অন্ধকারে দরজার কপাটে টেস দিয়ে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রইল মিতালি।

হয়তো ঠিক সেই সময় কুন্তলকে নিয়ে কয়েদি—গাড়ি পৌঁছেছিল প্রেসিডেন্সি জেলের ফটকে।

লছমনের সঙ্গে পার্কে গিয়েছিল দীপু। ফিরে এসে মায়ের হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরতেই থর থর করে একবার কেঁপে উঠে হু—হু করে কেঁদে ফেলল মিতালি। স্নেহের উত্তাপে গলল কঠিন বেদনার তুষার।

ছেলেকে বুকে নিয়ে নতুন করে বুক বাঁধল মিতালি। আলো জ্বালল ঘরে। তারপর টেলিফোন করতে বসল ল্যান্সডাউন রোডের রমেন বোস, বার—অ্যাট—ল’কে।

 * * *