৫
কুন্তীর রূপগুণের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই রূপগুণের ঔজ্জ্বল্য আরও বেড়ে গিয়েছিল তাঁর ধর্মাচরণ এবং ব্রতপালনের মাধ্যমে—সত্ত্বরূপগুণোপেতা ধর্মারামা মহাব্রতা। ধর্ম এবং ব্রতকে এই যৌবনবতী সুন্দরী কেন আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলেন, তার কারণ আমরা অনুমান করতে পারি। কন্যাবস্থায় সুর্য-সঙ্গম, পুত্রলাভ এবং পুত্রত্যাগ—এই সব কিছুই তাঁর যুবতী-হৃদয়ে এমন এক অনুশোচনা তৈরি করেছিল, যার প্রলেপ হিসাবে ধর্ম এবং ব্রতচারণের মধ্যেই তিনি আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু এই ধর্ম-ব্রত নতুন এক শুদ্ধতার তেজে কুন্তীর যৌবন এবং রূপ আরও বেশি উজ্জ্বল করে তুলল এবং সেই উজ্জ্বলতা লোক-সমাজে ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না।
তেজস্বিনী যৌবনবতীর মধ্যে লজ্জা এবং মৃদুতার মতো স্ত্রী-সুলভ গুণগুলি কুন্তীকে করে তুলল প্রার্থনীয়তরা। রাজারা অনেকেই আলাদা আলাদা করে প্রস্তাব দিলেন কুন্তীকে বিয়ে করার—ব্যাবৃণ্বন্ পার্থিবা কেচিদ্ অতীব স্ত্রীগুণৈর্যুতাম্। হয়তো কুন্তীও চাইছিলেন বিয়ে করতে। সময় বুঝে মহারাজ কুন্তিভোজ স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করলেন। ওদিকে কুন্তীর রূপ-গুণ এবং ব্রত-ধর্মের কথা যেহেতু অনেক জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল তাই কৌরবগৃহেও একটা প্রাথমিক কথাবার্তা তাঁকে নিয়ে হয়ে গেছে। স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম বিদুরের কাছে প্রস্তাব করেছেন—শুনেছি যাদবদের একটি সুন্দরী মেয়ে আছে, কুলে-মানে তারা আমাদের পালটি—ঘর শ্রূয়তে যাদবী কন্যা স্বনুরূপা কুলস্য নঃ।
‘যাদবী কন্যা’ কথাটা লক্ষ করার মতো। বোঝা যাচ্ছে কুন্তিভোজ যতই দত্তক নিন, কুন্তীর পরিচিতি ছিল যাদবদের মেয়ে হিসেবেই। কুন্তিভোজ যদি ভোজবংশের কেউ হন, তবে তাঁদের মধ্যেও যাদবদের রক্ত আছে এবং সে অর্থে কৃষ্ণের মামা কংসের মধ্যেও যাদের রক্ত আছে, কিন্তু তিনিও প্রধানত ভোজ-বাড়ির লোক ছিলেন। কংসকে বলা হত ভোজ-বংশের কুলাঙ্গার—ভোজানাং কুলপাংসনঃ। কিন্তু বংশে বংশে মামাতো—পিসতুতো সম্পর্ক হলেও যাদব আর ভোজদের জ্ঞাতিশত্রুতা ছিল। বিশেষত যাদব বলে যাঁরা গর্ব করতেন, তাঁদের মর্যাদা কিছু বেশিও ছিল। কৃষ্ণপিতা বসুদেব অথবা কুন্তীর পিতা আর্যক শূর ছিলেন যাদবদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তি। কংসের নিজের স্বজন ভোজেরাও তাঁর অত্যাচারে সন্তুষ্ট ছিলেন না এবং যাদব বসুদেব তথা যাদব কৃষ্ণ সবসময়েই চেষ্টা করেছেন কংসের নিজের স্বজনদের মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে তাঁদের নিজেদের দলে টানতে। হয়তো কুন্তিভোজের হাতে নিজের মেয়েকে দত্তক দেওয়ার মধ্যেও যাদবদের এই রাজনীতি কিছু থাকতে পারে।
মহাভারতের সভাপর্বে কৃষ্ণ নিজেই যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন যে, ভোজজাতির বৃদ্ধ-পুরুষদের অনুরোধেই তিনি কংসকে বধ করেছেন। অন্যদিকে হরিবংশে দেখছি—কংস নিজেই বলছেন যে, বৃষ্ণি, অন্ধক, ভোজ—এই সব জাতির শক্তিমান পুরুষেরা কংসের স্বজন হওয়া সত্ত্বেও যাদব কৃষ্ণের পক্ষ নিয়েছেন—শেষাশ্চ মে পরিত্যক্তা যাদবাঃ কৃষ্ণপক্ষিণঃ। আমার ধারণা—কুন্তীকে ‘সানন্দে’ একটি ভোজবাড়িতে দত্তক দেওয়ার মধ্যে কুন্তীর পিতা আর্যক শূরের কিছু রাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করে থাকতে পারে এবং একটি রমণীকে কেন্দ্র করে এই রাজনীতিক স্বার্থ-চেষ্টা কুন্তীর হয়তো একটুও ভাল লাগেনি। লাগেনি বলেই নিজের বংশের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিক অধস্তন কৃষ্ণের কাছে কুন্তী নিজের পিতা আর্যক শূর সম্বন্ধে তিক্ত কথা বলেছেন। অন্যদিকে যাদবদের মান-মর্যাদা অন্য জ্ঞাতিদের থেকে বেশি থাকায় কুন্তিভোজের পক্ষে কুন্তীকে দত্তক নিয়েও তাঁকে আত্মীকরণ করা সম্ভব হয়নি। কুন্তী তাই বিয়ের সময়েও ‘যাদবী’ কন্যাই রয়ে গেছেন এবং ‘যাদবী’ বলেই হয়তো পিতা ভীষ্ম তাঁকে নিজের কুলের উপযুক্তা বধূ হিসেবে কল্পনা করেছেন—শ্রূয়তে যাদবী কন্যা স্বনুরূপা কুলস্য নঃ।
যাক এসব কথা। কুন্তিভোজ স্বয়ম্বর সভা ডাকলেন কুন্তীর বিয়ের জন্য। দেশ-বিদেশ থেকে রাজা-রাজড়ারা এলেন ভোজবাড়িতে। এলেন পাণ্ডুও। হয়তো ভীষ্মের নির্দেশমতো। মহাভারতের কবি লিখেছেন—রাজসভায় মধ্যস্থানে বসা ভরতবংশের রাজা পাণ্ডুকে দেখতে পেলেন বুদ্ধিমতী কুন্তী, মনস্বিনী কুন্তী। পাণ্ডুকে দেখে তিনি মনে মনে আকুল হলেন—হৃদয়েনাকুলাভবৎ। তাঁর শরীরে দেখা দিল কামনার রোমাঞ্চ। তিনি সখীদের সঙ্গে সলজ্জে পাণ্ডুর কাছে উপস্থিত হয়ে বরমাল্য পরিয়ে দিলেন তাঁর গলায়।
মহাকাব্যের নিয়মে এই বিবাহ-সভার বর্ণনাগুলি প্রায়ই ‘স্টক্-ডেসক্রিপশন’। অর্থাৎ যাঁর গলায় মালা দেওয়া হচ্ছে, তিনি তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং শারীরিক সৌন্দর্যে অন্য রাজাদের অবশ্যই লজ্জা দিচ্ছেন। অপিচ নবীনতম পুরুষকে প্রথমবার চোখে দেখেই স্বয়ম্বর বধূটি তাঁকে পাবার জন্য ‘কাম-পরীতাঙ্গী’ হয়ে উঠছেন—এই বর্ণনা আমি আরও উদ্ধার করতে পারি।
এখানে খেয়াল করার মতো বিশেষণ আছে একটিই। তা হল বুদ্ধিমতী কুন্তী, মনস্বিনী কুন্তী। আমার ব্যাক্তিগত ধারণা—কুন্তীর বিয়ের মধ্যেও কিছু রাজনীতি ছিল। তখনকার দিনের রাজনৈতিক চিত্রে মগধরাজ জরাসন্ধ ছিলেন ধুরন্ধর পুরুষ। মথুরার কংস ছিলেন তাঁর জামাই এবং ‘এজেন্ট’। যাদবরা কংসের অত্যাচারে পযুর্দস্ত হয়ে রাজনৈতিক বন্ধু বাড়াবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন একভাবে। এসব কথা আমি অন্যত্র লিখেছি। কুন্তিভোজের কাছে কুন্তীকে দত্তক দিয়ে একদিকে যেমন কংসপক্ষীয় ভোজদের হাত করার চেষ্টা করেছিলেন আর্যক শূর, তেমনই অন্যদিকে ভরতবংশের সঙ্গে একটা বৈবাহিক যোগাযোগ গড়ে তোলাটাও তাঁদের দিক থেকে কাম্য ছিল।
ভরতবংশের কুলপুরুষ মহামতি ভীষ্ম কুন্তিভোজের বাড়িতে থাকা ‘যাদবী’ কন্যার কথাটা কোত্থেকে শুনেছিলেন—সেটা মহাভারতে বলা না থাকলেও আমার ধারণা—এ খবর এসেছিল যাদবদের কাছ থেকেই, হয়তো খোদ কৃষ্ণপিতা বসুদেবের কাছ থেকেই। এরপর কুন্তীর বিয়ের জন্য যখন স্বয়ম্বর-সভা ডাকা হল, সেখানে কুন্তীর দিক থেকে সবাইকে ফেলে পাণ্ডুকে বরণ করাটা ছিল কন্যাপক্ষের ঈপ্সিত। যাঁকে কুলমর্যাদা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সময় কুন্তিভোজকে বলতে হয়—মনে রেখো তুমি আর্য শূরের কন্যা, মহামতি বসুদেবের তুমি ভগিনী—বসুদেবস্য ভগিনী…শূরস্য দয়িতা সুতা—তিনি যে বিয়ের সময় শূর অথবা বসুদেবের ইচ্ছাটি বুঝবেন না, তা আমি মনে করি না। এই জন্যই বরমাল্য দেওয়ার সময় ঠিক পাণ্ডুকেই চিনে নেওয়ার মধ্যে কুন্তীর মনস্বিতা বা বুদ্ধিমত্তা দেখতে পেয়েছেন মহাভারতের কবি।
বরপক্ষ এবং কন্যাপক্ষ—দুয়েরই ঈপ্সিত ব্যক্তিটির গলায় স্বয়ম্বরবধূর মালাটি পড়ায় স্বয়ম্বর-সভার অবস্থা হল এখনকার দিনের পূর্ব-নির্ধারিত ব্যক্তির চাকুরি পাওয়ার মতো। বিশেষ এইটুকু যে, তার ‘কোয়ালিফিকেশন’ যথেষ্ট আছে। ইনটারভিউতে আসা গাদা গাদা কর্মপ্রার্থী ব্যক্তি যখন বুঝতে পারে লোক ঠিক করাই আছে, তখন তারা যেমন নিষ্প্রভ নিস্তরঙ্গতায় নিজেদের মধ্যে গজগজ করতে করতে ফিরে যায়, তেমনই কুন্তী পাণ্ডুকে বরণ করেছেন দেখেই রাজারা সব যেমন এসেছিলেন, তেমনই হাতি, ঘোড়া, রথের মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন—যথাগতং সমাজগ্মু-র্গজৈরশ্বৈ রথৈস্তথা।
কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডুর বিয়ে হল, যেন শচীর সঙ্গে মিলন হল ইন্দ্রের। পাণ্ডু বউ নিয়ে, কুন্তিভোজের বাড়ি থেকে অনেক সম্মান-উপহার নিয়ে মহর্ষি আর ব্রাহ্মণদের জয়ঘোষের মধ্যে রাজধানীতে ফিরলেন। কুন্তীর নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল—কন্যাবস্থায় সেই আকালিক দুর্ঘটনার পর এবার তিনি সুখে সংসার করবেন। কিন্তু সুখ তাঁর ভাগ্যে ছিল না। কুন্তী কৃষ্ণের কাছে দুঃখ করে বলেছিলেন—বাপের বাড়িতেও আমি সুখ পাইনি, শ্বশুরবাড়িতেও নয়। শব্দটা ছিল ‘নিকৃতা’ অর্থাৎ ওখানেও লাঞ্ছনা পেয়েছি, শ্বশুররাও আমাকে লাঞ্ছনা দিয়েছেন। শ্বশুর বা শ্বশুরস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম হলেন ভীষ্ম। কারণ পাণ্ডুর নামমাত্র-বাবা বিচিত্রবীর্য বেঁচে নেই এবং পাণ্ডুর জন্মদাতা ব্যাসদেব কোনওভাবেই কুরুবাড়ির সংসারে প্রবেশ করেননি। কাজেই কুন্তীর শ্বশুরের প্রথম সম্বন্ধটা ভীষ্মের সঙ্গেই।
বিয়ের পর কিছুদিন কাটতেই মহামতি ভীষ্ম পাণ্ডুর আরও একটি বিবাহ দেবার জন্য ব্যস্ত হলেন। মদ্রদেশের মেয়ে শল্যের বোন মাদ্রীর কথা তাঁর জানাই ছিল। তাঁকে বাড়ির বউ করে আনার জন্য তিনি নিজেই সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ছুটলেন সে দেশে। হয়তো পাণ্ডুর এই বিয়েতে বড় বেশি আসক্তি ছিল না। প্রথমা মহিষী কুন্তীর সঙ্গে বিয়ে হবার পর তিনি খুব উচ্চ-বাচ্যও করেননি। কিন্তু ভীষ্ম নিজেই আগ্রহ দেখালেন পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিবাহের জন্য।
ভীষ্মের আগ্রহটা কেন, তার কারণ আমরা বুঝি। নিজে তো বিয়ে করেননি। কিন্তু পিতা শান্তনুর দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্য মারা যেতে ভরতবংশের সিংহাসন খালি হয়ে গিয়েছিল। ভীষ্ম নিজে রাজা হবেন না অথচ রাজবংশের ভাবনাটা ছিল তাঁরই। এই অবস্থায় রাজমাতা সত্যবতী এবং তাঁর নিজের মতৈক্যে ব্যাসদেবকে স্মরণ করতে হয়। কুরুকুলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুরের জন্মের মাধ্যমে। কুরুকুলে বংশ-পরম্পরা রক্ষার একটা সমস্যা ছিল এবং ভীষ্ম সে বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুদের বিয়ের আগে বিদুরকে তিনি বলেছিলেন—তোমরা তিনজনই এই প্রসিদ্ধ ভরত-বংশের অঙ্কুর। যে কুল প্রায় লুপ্ত হতে বসেছিল—আমি, সত্যবতী আর ব্যাসদেব মিলে এখন তোমাদের মধ্যেই সেই বংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছি—সমবস্থাপিতং ভূয়ো যুম্মাসু কুলতন্তুষু। ভীষ্ম বলেছিলেন—তোমাদের চেষ্টা করা উচিত, যাতে সমুদ্রের মতো এই বংশ বৃদ্ধিলাভ করে—কুলং সাগরবদ্ যথা।
এই নিরিখে—আমার ধারণা, এই নিরিখে ভীষ্ম আগে থেকেই নানা বংশের মেয়ে খোঁজ ভাঁজ করছিলেন এবং সেই খোঁজের মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের মুখে গান্ধারীর কাহিনী শুনেছিলেন। শুনেছিলেন গান্ধারী মহাদেবকে তুষ্ট করে শতপুত্রের জননী হবার আশীর্বাদ পেয়েছেন। যিনি ভরতবংশের ‘সাগরবৎ’ বৃদ্ধি চান, তিনি যে গান্ধারীর মতো মেয়েকেই কুলবধূ করে আনবেন তাতে আশ্চর্য কী। মহাভারতের কবি লিখেছেন—গান্ধারীর শত পুত্রের জননী হবার আশীর্বাদ-সংবাদ ভীষ্ম পেলেন ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে—অথ শুশ্রাব বিপ্ৰেভ্যঃ। কারণ ব্রাহ্মণরাই এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়াতেন এবং এ রাজ্যের সঙ্গে ও রাজ্যের সংবাদের সূত্র ছিলেন তাঁরাই।
তো, ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের কাছে গান্ধারীর খবর পেলেন আর কুন্তীর খবর পেলেন না? বিশেষত দুর্বাসা মুনি কারও উপকার করলে সেই উপকার কাউকে না বলে থাকবেন—এটা তাঁর অভ্যাসের মধ্যে ছিল না। নানা পুরাণকাহিনীতে দুর্বাসার চরিত্র লক্ষ করে চৈতন্য-পার্ষদ রূপ গোস্বামী এই উক্তিটি করেছেন। কাজেই দেব-পুরুষ আহ্বান করে কুন্তীর সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতার কথাও ভীষ্ম জানতেন বলেই মনে হয়। জানতেন যে, তার একটা প্রমাণ দাখিল করতে পারি মহাভারত থেকেই।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম যখন শরশয্যায় শুয়ে আছেন, রাজারা সবাই যখন একে একে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে গেছেন, তখন কর্ণ এসে উপস্থিত হলেন ভীষ্মের কাছে—একা, নতশির, অপরাধীর মতো চেহারা। এসেই বললেন—আমি রাধার ছেলে কর্ণ এসেছি রাধেয়ো’হং কুরুশ্রেষ্ঠ। ভীষ্ম বললেন—এসো, এসো কর্ণ। তুমি যে রাধার ছেলে নও, কুন্তীর ছেলে—সে আমি জানতাম। সূর্যের তেজে কুন্তীর গর্ভে তুমি জন্ম নিয়েছ—এ সব কথা আমি নারদের মুখে শুনেছি। শুনেছি মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের কাছেও—সূর্যজস্ত্বং মহাবাহো বিদিতো নারাদান্ময়া। কৃষ্ণদ্বৈপায়নাচ্চৈব তচ্চ সত্যং ন সংশয়ঃ।
ভীষ্ম যেখানে কুন্তীর কানীন পুত্রটির কথাও জানতেন সেখানে তিনি তাঁর পুত্রলাভের ব্যাপারে দুর্বাসার আশীর্বাদের কথা জানতেন না—এটা ভাবা আমার পক্ষে মুশকিল। কাজেই গান্ধারীর কথা তিনি যেভাবে ব্রাহ্মণদের মুখে শুনেছিলেন, তেমনই কুন্তীর দৈবশক্তির কথাও তিনি জানতে পেরেছিলেন ব্রাহ্মণদের কাছ থেকেই—ইতি শ্রুশাব বিপ্ৰেভ্যঃ।
কুরুকুলের সন্তান-সমস্যা সমাধানের জন্য তথা এই কুল যাতে সন্তান-সন্ততিতে ‘সাগরবৎ’ ভরে ওঠে, সেজন্যেও যদি তিনি সুবল-সুতা গান্ধারী এবং যাদবী কুন্তীকে বধূ করে এনে থাকেন, তা হলে ভীষ্মের যুক্তিও সেখানে বোঝা যায়। কিন্তু দ্বিতীয়বার কেন তিনি পাণ্ডুর সঙ্গে মাদ্রীর বিয়ে দেওয়ার জন্য এত তৎপর হয়ে উঠলেন—তার মধ্যে একটা হেঁয়ালি থেকে যায়। প্রমাণ এখানে দেওয়া যাবে না, তবে প্রায় অখণ্ডনীয় একটা অনুমান এখানে করা যেতে পারে। বস্তুত মহাভারতের পঙ্ক্তির মতো শব্দ-প্রমাণ আমাদের হাতে নেই বলেই এমন একটা অনুমান আমাদের করতে হচ্ছে।
পাণ্ডুর পুত্র উৎপাদন করার ক্ষমতা ছিল না বলেই মহাভারতের কবিকে হয়তো কিন্দম মুনির অভিশাপের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। কিন্তু সে-কথা বলবার আগেই আমাদের অনুমান-খণ্ডের প্রথম প্রস্তাবটা করে নিই। মহামতি ভীষ্ম কি পাণ্ডুর এই অক্ষমতার কথা জানতেন? তিনি বলেছিলেন—নারদ এবং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের কাছে তিনি কুন্তীর খবর পেয়েছেন, কিন্তু পাণ্ডুর পুত্রোৎপত্তির অক্ষমতার কথাও তিনি ব্যাসের কাছেই শোনেননি তো?
আমরা একবারের জন্য পিছন ফিরে তাকাব হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির সেই ঘরটির মধ্যে যেখানে ‘অশেষ-যোগ-সংসিদ্ধ’ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস মায়ের আদেশ মেনে নিয়ে বিচিত্রবীর্যের দুই পত্নীর ক্ষেত্রে পুত্র উৎপাদন করছিলেন। আপনারা জানেন—রাজবধূর বিদগ্ধ রুচিতে অম্বিকা এবং অম্বালিকা—কেউই ব্যাসের সঙ্গে মিলনের ঘটনাটা পছন্দ করেননি। কিন্তু তাঁরা ছিলেন নিরুপায়, কারণ সে যুগে এই নিয়োগ প্রথা ছিল সমাজ-সচল। তার মধ্যে রাজমাতা সত্যবতী নিজেই হস্তিনাপুরের অরাজক সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর জন্য দুই বধুকে ব্যাসের সঙ্গে মিলিত হতে উপরোধ করেছিলেন।
সত্যবতীর ইচ্ছায় এই দুই রাজবধূর কোনও সম্মতি ছিল না। কিন্তু তাঁদের জন্য কুরুবংশের লোপ হয়ে যাবে—শুধু এই কারণে তাঁদের কোনওমতে রাজি করাতে পেরেছিলেন সত্যবতী। সত্যবতী বলেছিলেন—কিছুই নয়, তোমাদের ভাশুর আসবেন নিশীথ রাতে, তোমরা দুয়োর খুলে অপেক্ষা কোরো। কিন্তু রাজবধূর বিদগ্ধ-রুচিতে এই নিশীথ-মিলন পরাণ-সখার সঙ্গে অভিসারে পর্যবসিত হয়নি। এ মিলন বস্তুত তাঁদের কাছে ছিল ধর্ষণের মতো।
স্বয়ং ব্যাসও এটা জানতেন। সত্যবতীকেও তিনি বারবার সাবধান করেছেন। বলেছেন—আমার বিকৃত রূপ তাঁদের সহ্য করতে হবে—সে কথা মনে রেখো—বিরূপতা মে সহতাং তয়োরেতৎ পরং ব্রতম্। কিন্তু বলে-কয়েও কোনও শরীর মিলনে কি রুচি নির্মাণ করা যায়? শত-শত প্রজ্জ্বলিত দীপের আলোয় ব্যাসকে দেখেই অম্বিকা তিক্ত ঔষধ সেবনের মানসিকতায় সেই যে চোখ বুজেছিলেন, আর চোখ খোলেননি। তাঁর পুত্র শত হস্তীর শক্তি সত্ত্বেও অন্ধ হবে—ব্যাসই সে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এই দুর্ঘটনার ফলে দ্বিতীয়া রানি অম্বালিকার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল, কারণ অন্ধ ব্যক্তি কুরুবংশের রাজা হতে পারে না, অতএব তাঁর চক্ষু মুদে থাকা চলবে না।
চক্ষু মুদে যে অনীপ্সিত সঙ্গমে বড় রানি কোনও রকমে পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন, অম্বালিকাকে সেই সঙ্গম চোখ খুলে দেখতে হল বলেই তাঁর কাছে এই সঙ্গম সম্পূর্ণ ধর্ষণের বিকারে ধরা দিল। মহর্ষির লালচে কটা দাড়ি, মাথাভর্তি জটা, তপোদীপ্ত চক্ষু এবং গায়ের উৎকট গন্ধ—সব কিছু টান টান চোখে দেখে দ্বিতীয়া রানির শরীর ভয়ে ফ্যাকাসে-হলুদ হয়ে গেল। সত্যবতী পুনরায় জিজ্ঞাসা করলে ব্যাস বললেন—এই রানির ছেলে পাণ্ডুবর্ণ হবে।
ওপরের কথা এইটুকুই। কোনও ছেলের গায়ের রঙ যদি ফ্যাকাসে-হলুদ হয়, তাতে এমন কিছু আসে যায় না। বরঞ্চ এই গাত্রবর্ণে পাণ্ডুকে যে যথেষ্ট সুন্দর লাগত—তার বর্ণনা আমরা মহাভারতে বহু জায়গায় পেয়েছি। কালিদাসের যক্ষবধুর মুখে এই পাতা ছিল বলে আমরা তাঁকে বেশি পছন্দ করেছি। কিন্তু সঙ্গম-লগ্নে রাজরানির এই পাণ্ডুতার আড়ালে আরও কিছু ছিল, যা ব্যাস স্বকণ্ঠে সোচ্চারে বলেননি। বৈদ্যশাস্ত্রের নিয়মমতো রমণীর কাছে পুরুষের সঙ্গম যদি ধর্ষণের বিকারে ধরা দেয়, তবে সেটা এতই ‘শকিং’ হতে পারে যাতে বিকৃতাঙ্গ সন্তানের জন্ম দিতে পারে। এর ফলেই ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ, আর অম্বালিকাকে যেহেতু জোর করে এই ধর্ষণ চোখ মেলে সহ্য করতে হয়েছিল, তাই পাণ্ডু পুত্রোৎপত্তির অক্ষমতা নিয়েই জন্মেছিলেন। নইলে গাত্রবর্ণের পাণ্ডুত্ব এমন কোনও রোগ নয় যে, সত্যবতী পুনরায় ব্যাসকে আরও একটি সন্তানের জন্য উপরোধ করবেন।
সত্যবতী এই ইঙ্গিত বুঝেছিলেন হয়তো সেই কারণেই আরও একটি পুত্রও তিনি প্রার্থনা করে থাকবেন। কিন্তু কুরুবংশের পরবর্তী বৃদ্ধির জন্য আর বেশি কিছু তাঁর বলার ছিল না, কেননা মহর্ষি রানিদের গর্ভাধান করার সঙ্গে সঙ্গেই বলে দিয়েছিলেন—ধৃতরাষ্ট্র শত পুত্রের পিতা হবেন এবং পাণ্ডুও পাঁচ সন্তানের পিতা হবেন। কেমন করে হবে, কীভাবে হবে—সে কথা তখন অপ্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু আমার যা বক্তব্য ছিল—পাণ্ডুর জন্মদাতা পিতা এবং কালজ্ঞ ঋষি হিসাবে ব্যাস হয়তো জানতেন পাণ্ডুর পুত্রোৎপত্তির ক্ষমতা ছিল না। এই অক্ষমতার কথা মহামতি ভীষ্মকে তিনি জানিয়ে থাকবেন। কুরুবংশের এই সন্তানটির ওপর জন্মদাতা হিসেবে ঋষির যে মমতা ছিল, সেই মমতাতেই হয়তো ভীষ্মকে তিনি কুন্তীর খবর দিয়েছিলেন, আর সেই মমতাই মহাভারতের কবির হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়ে তাঁকে কিন্দম মুনির অভিশাপের গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। আপন ঔরসজাত প্রিয় পুত্রের প্রজনন-শক্তির অভাব তিনি কিন্দমের অভিশাপের প্রলেপ দিয়ে সকারণ করতে চেয়েছেন।
এখনও প্রশ্ন রইল মাদ্রীর বিবাহ তবে কেন? দেখুন, স্বামীর ব্যক্তিত্ব-বীজ ছাড়াই যে রমণীর পুত্র-উৎপাদনের শক্তি করায়ত্ত—সে যেভাবেই হোক, দৈববলে অথবা নিয়োগপ্রথায়, পুত্ৰমুখ সে দেখবেই। সে রমণীকে স্বামী অসাধারণী ভাবতেই পারেন, কিন্তু নিজের তীব্র স্বাধিকারবোধ তাতে পদে পদে মার খায়। মাদ্রীকে ভীষ্ম প্রায় উপযাচকের মতো মদ্র-নগরী থেকে নিয়ে এসেছিলেন, তাও আবার কন্যাপণ দিয়ে। নিয়ে এসেছিলেন শুধু পাণ্ডুর স্বামীজনোচিত স্বাধিকার তৃপ্ত করার জন্য নয়, নিয়ে এসেছিলেন হয়তো কুন্তীকে ‘ব্যালান্স’ করার জন্য। ভাবটা এই—শুধু পুত্র-ধারণের শক্তি থাকলেই হবে না গো মেয়ে, স্বামীর ভালবাসাটাও পাওয়া চাই। অর্থাৎ স্বামীর দৈহিক অক্ষমতায় তোমার নিজের অহঙ্কার যদি বেড়ে যায়, তবে অন্তত স্বামীর প্রণয়ের জন্য তোমার প্রতিযোগিনী রইলেন একজন। হয়তো মাদ্রীকে ভীষ্ম এই কারণেই কুরুবাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। কারণ তিনি বোধহয় পাণ্ডুর অক্ষমতার কথাও জানতেন আবার কুন্তীর দৈবী ক্ষমতার কথাও জানতেন।
মূল প্রস্তাবে ফিরে এসে বলি—বিবাহের কয়দিনের মধ্যে, হয়তো বর-বধূর উন্মত্ত-অন্তরঙ্গতা তখনও ভাল করে আরম্ভই হয়নি—তার মধ্যেই এই যে দ্বিতীয়া আরও একটি রমণীকে সযত্নে জুটিয়ে আনলেন ভীষ্ম, সে রমণী যতখানি পাণ্ডুর বউ হয়ে এলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কুন্তীর সতীন হয়ে এলেন। মনে মনে কুন্তী শ্বশুরকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন, দুঃখও পেয়েছেন মনে মনে।
হয়তো দুঃখের কারণ আরও বেশি ছিল এই কারণে যে, পুত্রোৎপত্তিতে অক্ষম জানা সত্ত্বেও পাণ্ডুর সঙ্গে যে তাঁর বিয়ে হল—তার মধ্যে ভীষ্মের অলক্ষ হাত ছিল, কারণ এই যাদবী কন্যাটিকে আগে থেকেই তিনি পাণ্ডুর জন্য মনোনীত করে রেখেছিলেন। লক্ষ করে দেখুন, দু-দুটি নববধুকে বাড়িতে রেখে বিবাহের এক মাসের মধ্যে পাণ্ডু রাজধানী থেকে দিগ্বিজয় করতে বেরিয়েছেন। এই এক মাস কুন্তী এবং মাদ্রীর সঙ্গে তিনি বিহার করেছেন যখন তাঁর ইচ্ছা হয়েছে অথবা যখন মনে হয়েছে বিহারে তাঁর সুখ হবে—যথাকামম্ যথাসুখম্। ভাষাটা খেয়াল করার মতো।
বুঝলাম, এটাও না হয় বুঝলাম। কিন্তু প্রসিদ্ধ ভরত বংশের কোন প্রসিদ্ধ রাজা বিয়ের এক মাসের মধ্যে দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছেন? ভরতবংশে রাজকার্য বা প্রজার কার্য বোঝার মতো রাজা কম ছিলেন না। সম্বরণ, শান্তনুর মতো প্রেমিক অথবা পাণ্ডুর পিতৃপ্রতিম বিচিত্রবীর্যের মতো ভোগী রাজার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, দুষ্মন্ত, ভরত, কুরু এমনকী পরবর্তীকালে যুধিষ্ঠির-অর্জুনও যে বিয়ের এক মাসের মধ্যে কোথাও নড়েননি! পাণ্ডু কি এতই বড় রাজা? ভোগের ইচ্ছে যে তাঁর কম ছিল না—সে কথাও পরে জানাব।
আসলে স্ত্রীদের কাছে আপন অক্ষমতা লুকিয়ে রাখার জন্য, অথবা ক্ষমতার ধ্বজাটুকু জিইয়ে রাখার জন্যই পাণ্ডুকে দিগ্বিজয়ে বেরতে হল—বিয়ের পর তিরিশ রাত্তিরের অক্ষম বিহার সেরেই—বিহৃত্য ত্রিদশা নিশাঃ। অন্তঃপুরের অন্দরমহলে পড়ে রইলেন কুন্তী—পাণ্ডুকে বরণ করার সময়ে যাঁর অতুল দৈহিক দীপ্তিতে মনে হয়েছিল যেন সূর্যের দীপ্তিতে ম্লান হয়ে গেছে অন্য রাজাদের মুখমণ্ডল—আদিত্যমিব সর্বেষাং রাজ্ঞাং প্রচ্ছাদ্য বৈ প্রভাঃ। যাকে দেখে কুন্তী তাঁর হৃদয়ের ভাব গোপন রাখতে পারেননি, শরীরে জেগেছিল রোমাঞ্চ, সেই পাণ্ডু তিরিশটি বিহার-নিশি দুই রমণীর মধ্যে তাঁরই ইচ্ছামতো ভাগ করে দিয়ে এখন রাজ্য জয় করতে বেরলেন।
রাজ্য-জয়েও অনেক দিন গেল। কম কথা তো নয়। ফিরে আসার পর দান-ধ্যান, সত্যবতী-ভীষ্ম-ধৃতরাষ্ট্রকে রাশি রাশি ধনরত্ন উপহার, ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা—অনেক কিছু করে পাণ্ডু বললেন—আমি বনে যাব, বনেই কিছু দিন কাটাব। তা রাজা-রাজড়াদের এই ধরনের বিলাস হতেই পারে। রাজমহল আর রাজার সুখবিলাস ছেড়ে পাণ্ডু দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনে গেলেন। পাণ্ডু ভেবেছিলেন বুঝি, রাজমহলে যা হচ্ছে না, বনে গিয়ে তাতে সুবিধে হবে। মাঝে মাঝে তাঁকে দুটি হস্তিনীর মধ্যগত ঐরাবতের মতো লাগছিল বটে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই দুই রানিকে ছেড়ে পাণ্ডু মৃগয়ায় মত্ত থাকতেন—অরণ্যনিত্যঃ সততং বভূব মৃগয়াপরঃ।
বনে আসা, আবার বনে এসেও মৃগয়ায় ডুবে থাকা—এই সব কিছুর মধ্যেই পাণ্ডুর দুর্বার হৃদয়-যন্ত্রণা ছিল, কিছু আত্ম-বঞ্চনা ছিল, যার চরম মুহূর্তে মহাভারতের কবি কিন্দম মুনির অভিশাপ বর্ণনা করেছেন। পাণ্ডু নাকি মৈথুনরত দুটি হরিণ-হরিণীকে মেরে ফেলবার পরেই দেখতে পেলেন হরিণটি ছিল এক ঋষিকুমার! মনুষ্যবসতির মধ্যে মৈথুন চরিতার্থ করার মধ্যে যে লজ্জা আছে, সেই লজ্জা থেকে বাঁচবার জন্যই ঋষিকুমার হরিণের আচ্ছাদন গ্রহণ করেছিলেন। ঋষি পাণ্ডুকে বলেছিলেন—স্ত্রীসম্ভোগের সুখ আপনি জানেন, অথচ সেই অবস্থায় আমাকে মেরে আপনি কী নারকীয় কাজটাই না করলেন! ঋষিকুমার বলেছিলেন—আমি পুত্রের জন্য মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম, আপনি সেই আশা বিফল করে দিলেন—পুরুষার্থফলং কর্তুং তত্ ত্বয়া বিফলীকৃতম্।
পাণ্ডু ঋষিকুমারের সঙ্গে নিজের সপক্ষে মৃগবধের কারণ উপস্থিত করে অনেক তর্ক করলেন বটে, কিন্তু মৈথুনরত অবস্থায় প্রাণিবধ মৃগয়ার বিধিতেও সত্যিই লেখে না। পুরাণ ইতিহাসে এমন গল্পও আছে যাতে দেখা যাচ্ছে—মৈথুন-চর পশু পক্ষীকে রাজপুরুষেরা ছেড়ে দিচ্ছেন। রামায়ণের মতো মহাকাব্যে যেখানে ক্রৌঞ্চ-মিথুনের একতরের মৃত্যুতে কবির শোক শ্লোকে পরিণত হয়েছিল, সেখানে মৈথুনরত প্রাণীকে হত্যা করার মধ্যে পাণ্ডুর যে অন্য কোনও আক্রোশ ছিল তা আমরা হলফ করে বলতে পারি। বস্তুত স্ত্রী-পুরুষের মিলনের মধ্যে পুত্রলাভের যে সুখ-সম্ভাবনা থেকে যায় সেই সম্ভাবনা তাঁর বারংবার প্রতিহত হচ্ছিল বলেই তিনি তাঁর অন্তরের আক্রোশ মিটিয়েছেন মৈথুনরত একটি মৃগকে হত্যা করে, নইলে মুনি যেমন বলেছেন—সম্ভোগ সুখের মর্মও তিনি জানতেন, শাস্ত্র এবং ধর্মের মর্মকথাও তিনি জানতেন—স্ত্রীভোগানাং বিশেষজ্ঞঃ শাস্ত্ৰধর্মার্থতত্ত্ববিৎ।
যাই হোক মুনি শাপ দিলেন—মৈথুনে প্রবৃত্ত হলেই পাণ্ডু মারা যাবেন এবং আমাদের কাছে পাণ্ডুর পুত্রোৎপতির অক্ষমতা এই মুহূর্তে থেকে যতই সকারণ হয়ে উঠুক, আমরা বেশ জানি—মনস্বিনী কুন্তী তাঁর শত দুঃখ সত্ত্বেও তাঁকে এই বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করেননি। কবি লিখেছেন—ঋষির অভিশাপ শুনে পাণ্ডুর মনে এত আঘাত লেগেছিল যে, দুই স্ত্রীকে ছেড়ে তিনি কঠোর ব্রত-নিয়ম আশ্রয় করে তপস্যা করবেন বলেই ঠিক করলেন। আমরা জানি—এও সেই আক্রোশ। বারংবার পুত্র-লাভের সম্ভাবনা ব্যাহত হওয়ায় নিজের ওপরে তাঁর যে আক্রোশ হয়েছিল, সেই আক্রোশই তিনি চরিতার্থ করতে চেয়েছিলেন গৃহস্থধর্মের ওপরে রাগ করে। এই অবস্থায় কুন্তী এবং মাদ্রী—দুজনেই তাঁকে অন্তত পত্নীত্যাগে বিরত করতে পেরেছিলেন। তাঁরা বরঞ্চ নিজেরাও স্বামীর অনুধর্মে কঠোর নিয়ম-আচার পালন করতে রাজি হয়েছিলেন।
এইভাবেই দিন কাটছিল। দিনরাত যজ্ঞ-হোম, তপঃ-স্বাধ্যায়, ঋষিদের সঙ্গ আর ফলমূল আহার—দুই স্ত্রীর সঙ্গে সহধর্মচারী পাণ্ডুর দিন কাটছিল এইভাবেই। কিন্তু গভীর ক্ষত মিলিয়ে গেলেও যেমন তার দাগ থাকে, তেমনই এই শত ব্ৰত-নিয়ম-আচারের মধ্যেও পুত্রহীনতার যন্ত্রণা তাঁকে পীড়া দিতে লাগল। প্রাথমিকভাবে পাণ্ডু নিয়োগপ্রথারও পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি স্বয়ং বিচিত্রবীর্যের পুত্র নন, তাঁর স্ত্রীর গর্ভে তিনি ব্যাসের ঔরসে জন্মেছিলেন। নিজের জন্ম-প্রক্রিয়ার এই অকৌলীন্যে হয়তো প্রাথমিকভাবে তিনি নিয়োগের বিরোধী ছিলেন। কারণটা পরিষ্কার। বাবা বিচিত্রবীর্য বেঁচে ছিলেন না, তাঁর অনধিকৃত ক্ষেত্রে কেউ সন্তান দান করলেন—সে এক কথা। আর পাণ্ডু বেঁচে আছেন, অথচ তাঁর চোখের সামনে বা আড়ালে অন্য কেউ তাঁরই প্রিয়া পত্নীতে উপগত হবে—এমন একটা অনধিকারচর্চা তাঁকে হয়তো ঈর্ষাকাতর করে তুলেছিল।
প্রিয়তমা দুই পত্নীর মুখের দিকে চেয়ে কাতর দীর্ঘশ্বাসে তিনি বলেছিলেন—সন্ন্যাসী হয়ে যাব আমি। আমার সন্তান উৎপাদন করার শক্তি নেই, কী দরকার আমার ঘর-গেরস্তির—নাহং… স্বধর্মাৎ সততাপেতে চরেয়ং বীর্যবর্জিতঃ। এই অবস্থায় অবশ্যই প্রশ্ন আসে এবং বলা যায়—পাণ্ডু তুমি কোনও ব্রাহ্মণের সাহায্য নিয়ে নিয়োগ-প্রথায় পুত্রলাভ করো। এই রকম আশঙ্কার আগেই পাণ্ডু তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন— কুন্তী-মাদ্রী দু’জনের কাছেই। পাণ্ডু বলেছিলেন—আমি কি কুত্তা নাকি যে, অন্যের কাছে ছেলে দাও, ছেলে দাও করে কাতর চোখে ভিক্ষে করব; যে ব্যাটা এমন করে, সে কুত্তা—উপৈতি বৃত্তিং কামাত্মা স শুনাং বৰ্ততে পথি।
কিন্তু হায়! যিনি এত বাগাড়ম্বর করেছিলেন, তাঁরও চিন্তা-ভাবনা অন্য রকম হয়ে গেল। যজ্ঞ-হোম, তপশ্চরণ অনেক অনেক করেও আবারও সেই কথাই মনে হল—একটি ছেলে থাকলে বেশ হত। আসলে একটা বয়সে বাৎসল্য মানুষকে কাঙাল করে। পাণ্ডুও তাই কাঙাল হলেন। যেমন করে হোক একটি ছেলে চাই।
এ কাজ সহজ নয়, স্ত্রীদের অভিপ্রেত নাও হতে পারে। কিন্তু পাণ্ডু, পুত্রচিন্তায় পাগল পাণ্ডু একদিন নির্জনে ডাকলেন কুন্তীকে। বললেন—তুমি আমার বিপদটা জান, কুন্তী! আমার প্রজননী শক্তি নেই-নষ্টং মে জননং—এই বিপদে তুমি আমাকে পুত্রলাভের ব্যাপারে সাহায্য করো কুন্তী। পাণ্ডু আরও বললেন—দেখো! এই এত বড় হস্তিনাপুর রাজ্যের কোনও উত্তরাধিকারী রইল না। শাস্ত্রে বলে—অন্তত ছ’রকমের ছেলে বাপের সম্পত্তি পায়—নিজের ঔরসজাত পুত্ৰ, অন্যের অনুগ্রহে নিজের স্ত্রীর গর্ভে জাত ক্ষেত্রজ—এই রকম করে পাণ্ডু কানীন পুত্রের কথাও বললেন। অর্থাৎ কন্যা অবস্থায় কুন্তীর যদি কোনও ছেলে থেকে থাকে তবে তার পিতৃত্ব স্বীকার করে নিতে পাণ্ডুর কোনও দ্বিধা নেই।
কিন্তু কুন্তী! কুন্তী একবারের তরেও স্বীকার করলেন না তাঁর সূর্য-সম্ভব পুত্রটির কথা। স্বীকার করলেন না, কারণ সে পুত্রের জন্মের মধ্যে জননীর ঈপ্সা ছিল না। ছিল কৌতুক। ছিল লজ্জা। ছিল গ্লানি, সবচেয়ে বেশি ছিল অনিচ্ছা। মনের গভীরে যাকে ইচ্ছের মতো লালন করেন জননী, সেই ইচ্ছে কর্ণের জন্মে ছিল না। আর ছিল না বলেই সে পর্ব তিনি ভুলতে চেয়েছিলেন। ধর্ম-ব্রতে নিজেকে শুদ্ধ করে ভালবেসেছিলেন হস্তিনাপুরের রাজাকে। নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। আজ স্বামীর এই বিপন্ন মুহুর্তে—যখন একটি কানীন পুত্রের জন্যও তিনি লালায়িত—তখনও তিনি তাঁর পূর্বের অভিজ্ঞতা বলতে পারেননি। পাণ্ডুকে তিনি ভালবাসতে চেয়েছিলেন, তাঁকে ঠকাতে চাননি। তাই আজ পাণ্ডুর মুখে যখন আস্তে আস্তে সেই প্রস্তাবেরই সূচনা হচ্ছে, তখনও কুন্তী কুণ্ঠিত, লজ্জিত।
পাণ্ডু একটা গল্প বললেন কুন্তীকে। বললেন—কেমন করে এক বীর রমণী স্বামীর আদেশ মতো এক যোগসিদ্ধ ব্রাহ্মণকে আশ্রয় করে পুত্রলাভ করেছিলেন। গল্প বলার শেষে পাণ্ডুর অনুরোধ—কুন্তী! আমি মত দিচ্ছি। তুমি কোনও বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের ঔরসে পুত্ৰ-লাভের চেষ্টা করো।
কুন্তী পাণ্ডুর ইচ্ছে-অনিচ্ছে জানতেন। প্রজননের শক্তি না থাকায় পাণ্ডুর গ্লানি, তাঁর ঈর্ষা, তাঁর কষ্ট তিনি অনুমান করতে পারেন। সব কিছুর ওপর অন্য পুরুষের নিয়োগে পুত্ৰ-লাভ করার ব্যাপারে পাণ্ডুর পূর্ব মনোভাব—অর্থাৎ সেই আমি কি কুকুর নাকি?—সেই মনোভাবও কুন্তী জানেন। নিজের জীবনে দুর্নিবার কৌতুক-খেলায় যা ঘটার একবার ঘটে গেছে। নিজের স্বামীর ঔরস পুত্রটি আপন কুক্ষিতে ধারণ করে পূর্বের সমস্ত গ্লানি তিনি ধুয়ে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে বুঝি আর হল না।
তবু কুন্তী বললেন—মহারাজ! তুমি ধর্মের রীতি-নীতি সব জান। আমিও তোমার ধর্মপত্নী মাত্র নই, তোমাকে আমি ভালবাসি—ধর্মপত্নীম্ অভিরতাং ত্বয়ি রাজীবলোচন। ধর্ম অনুসারে তুমি আমার গর্ভে বীর পুত্রের জন্ম দেবে। সেই বীর পুত্রের জন্য শুধু তোমার সঙ্গেই মিলন হবে আমার। তুমি ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে আমার শারীরিক মিলন হচ্ছে—সে যে আমি মনে মনে ভাবতে পারি না—ন হ্যহং মনসাপ্যন্যং গচ্ছেয়ং ত্বদৃতে নরম্। সত্যি কথা বলতে কি—তোমার চেয়ে উৎকৃষ্ট অন্য কোনও পুরুষ আমার কাছে আর কেউ নেই।
পাণ্ডু গল্প বলেছিলেন। তার উত্তরে কুন্তীও এবার গল্প বললেন পাণ্ডুকে। বললেন পাণ্ডুরই ঊর্ধ্বতন এক বিরাট পুরুষ ব্যুষিতাশ্বের গল্প। ব্যুষিতাশ্ব বহুতর যজ্ঞ এবং ধর্মকার্য করে দেবতাদের তুষ্ট করেছিলেন বটে, তবে নিজের স্ত্রী ভদ্রার প্রতি তাঁর অতিরিক্ত আসক্তি এবং সম্ভোগের ফলে তাঁর শরীর হল ক্ষীণ এবং তিনি অপুত্রক অবস্থাতেই মারা গেলেন। মারা যাবার পর মৃত স্বামীকে জড়িয়ে ধরে অশেষে-বিশেষে বিলাপ করলেন ভদ্রা। সেই বিলাপের সুর—কুন্তী যেমন শুনিয়েছেন—সে সুর কালিদাসের রতি-বিলাপ সঙ্গীতের প্রায় পূর্বকল্প বলা যেতে পারে। যাই হোক বিলাপে অস্থির ব্যুষিতাশ্বের প্রেতাত্মা অন্তরীক্ষ-লোক থেকেই জবাব দিল—তুমি ওঠো, সরে যাও, চতুর্দশী আর অষ্টমী তিথিতে তোমার শয্যায় ফিরে আসব আমি। আমারই সন্তান হবে তোমার গর্ভে-জনয়িষ্যাম্যপত্যানি ত্বয্যহং চারুহাসিনি।
কুন্তী পাণ্ডুকে বললেন—যদি শব-শরীর থেকে তাঁর পুত্র হতে পারে—সা তেন সুষুবে দেবী শবেন ভরতর্ষভ—তা-হলে মহারাজ! তোমার তো যোগ-তপস্যার শক্তি কিছু কম নয়, তুমিই আমাকে পুত্র দেবে—শক্তো জনয়িতুং পুত্ৰান্। পাণ্ডু এসব কথার ধার দিয়েও গেলেন না। নিজের যোগশক্তি বা তপস্যার শক্তিতেও খুব যে একটা আস্থা দেখালেন তাও নয়। বরঞ্চ পুরাণে ইতিহাসে কবে কে নিয়োগ-প্রথায় আপন স্ত্রীর গর্ভে অন্যের ঔরসে পুত্র লাভ করেছে, সেই সব উদাহরণ একটা একটা করে কুন্তীকে শোনাতে লাগলেন। পাণ্ডু মানসিকভাবে কুন্তীকে অন্য একটি পুরুষের ক্ষণিক-মিলনের জন্য প্রস্তুত করতে চাইছেন। শেষ কথায় পাণ্ডু বললেন—আমাদের জন্মও যে এই নিয়োগের ফলেই সম্ভব হয়েছে, তাও তো তুমি জান—অস্মাকমপি তে জন্ম বিদিতং কমলেক্ষণে।
পাণ্ডু নিজের কথা বলে, নানা গল্প-কাহিনী শুনিয়ে কুন্তীকে শেষে অনেক অনেক অনুনয় করে বললেন—আমার কথা তুমি শোনো কুন্তী, আমি নিজেই তোমাকে বলছি। শুধু একটি ছেলে, চিরটা কাল আমি ভেবেছি সেই ছেলের কথা। এইবারে একেবারে সত্যি কথাটা প্রকাশ হয়ে গেল। পাণ্ডুর হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত হল এতকালের তথ্য-বচন—আমার প্রজনন শক্তি নেই বলেই সন্তানের আকর্ষণ আমার চিরকালের বেশি—বিশেষতঃ পুত্ৰগৃদ্ধী হীনঃ প্রজননাৎ স্বয়ম্। পাণ্ডু অনেক আদর করে কুন্তীকে সম্পূর্ণ স্বমতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্বামীর সোহাগের সঙ্গে যেন আচার্যের গম্ভীরতা মিশিয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বললেন—এই আমি তোমার মাথায় আমার দুই হাত রাখছি, আমি পুত্র চাই কুন্তী, আমাকে পুত্র দাও।
কুন্তীর জীবনে স্বামীর ভালবাসার এই বুঝি চরম মুহূর্ত। পাণ্ডুর আবেগ-মধুর অনুনয়ে কুন্তী বিগলিত হলেন। আস্তে আস্তে শোনাতে আরম্ভ করলেন কুন্তিভোজের বাড়িতে সেই অতিথি-পরিচর্যার কাহিনী। বললেন তাঁর পরম তুষ্টির কথা এবং অবশ্যই বশীকরণ মন্ত্রের কথা। এই বিষণ্ণ গম্ভীর মুহূর্তে, যখন তিনি স্বামী থাকতেও স্বামীর ইচ্ছাতেই অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হতে চলেছেন, এই মুহূর্তে তাঁর পক্ষে সেই কৌতুক-সঙ্গমের কথা উল্লেখ করা সম্ভব হল না। স্বামী যা চাইছেন, ঠিক সেই রকম অর্থাৎ তাঁর অতি-অভিলষিত একটি খবর দেওয়ার সময় তাঁর পক্ষে স্থূলভাবে বলা সম্ভব হল না—মহারাজ! আমার একটি ছেলে আছে। কুন্তী এখানে নিজের স্বাতন্ত্র সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছেন। তিনি দেবতা আহ্বানের মন্ত্র জানেন, সেটা তিনি করবেন। কিন্তু কোন দেবতাকে আহ্বান করবেন, কখন করবেন—এই সমস্ত ভার তিনি পাণ্ডুর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। স্বামীর সম্মতি, স্বামীর চাওয়া—এই পরম অধীনতার মধ্যেই তিনি যেন পাণ্ডুর পুত্র পেতে চাইছেন, দেবতার আহ্বান তাঁর কাছে যান্ত্রিকতামাত্র।
কুন্তী বললেন—তুমি অনুমতি দাও। দেবতা, ব্রাহ্মণ—যাঁকে তুমি বলবে—যং ত্বং বক্ষ্যসি ধর্মজ্ঞ দেবং ব্রাহ্মণেব চ—তাঁকে আমি ডাকতে পারি। তবে কোন দেবতাকে ডাকব, কখন ডাকব—এই সমস্ত ব্যাপারে আমি তোমার আদেশের অপেক্ষা করব, আমি কিছু জানি না। তোমার ঈপ্সিত কর্মে তোমারই আদেশ নেমে আসুক আমার ওপর—ত্বত্ত আজ্ঞাং প্রতীক্ষন্তীং বিদ্ধ্যস্মিন্ কর্মণীপ্সিতে।
পাণ্ডুর কাছে কুন্তীর এই চরম আত্মনিবেদন এবং শরণাগতি একদিকে যেমন তাঁর প্রথম যৌবনের গ্লানিটুকু ধুয়ে মুছে দেয়, অন্যদিকে তেমনই দেবতা-পুরুষকে নিজে নির্বাচন করার স্বাধিকার ত্যাগ করে সমস্ত ভার পাণ্ডুর ওপর দিয়ে স্বামীর প্রতি একান্ত নিষ্ঠাও তিনি দেখাতে পেরেছেন। নিজের অনীপ্সিত সন্তানটির কথাও যে তিনি বলেননি—তাও পাণ্ডুর প্রতি নিষ্ঠাবশতই। পাণ্ডু যদি দুঃখ পান। স্বামীর সম্মতি বা সাহায্য ছাড়া একাই তিনি উৎকৃষ্ট সন্তানের জননী হতে পারেন—এই স্বাধিকার যদি পাণ্ডুকে আহত করে—তাই কন্যাবস্থায় তাঁর পুত্রজন্মের কথাও উল্লেখ করেননি এবং এখনও তিনি নিজের ইচ্ছায় কাজ করছেন না, করছেন পাণ্ডুর ইচ্ছায়, তাঁরই নির্বাচনে।
কিন্তু পাণ্ডু কী করলেন? কন্যাবস্থায় কুন্তীর কৌতুক-সঙ্গম যেমন হঠাৎই হয়ে গিয়েছিল, তেমনই এখনও কোনও মানসিক প্রস্তুতির সময় দেননি পাণ্ডু। কুন্তীর প্রস্তাবের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি কেবল একবার—আমি ধন্য হলাম, অনুগৃহীত হলাম, তুমি আমার বংশের ধারা রক্ষা করে বাঁচালে আমাকে—কেবল এই একবার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে বসেছেন—আজই, আর দেরি নয়, আজই তুমি আহ্বান করো ধর্মরাজকে।
প্রথম যৌবনে মন্ত্র পরীক্ষার জন্য যে কৌতূহল কুন্তীর মনে জেগেছিল, হয়তো পাণ্ডুও সেই মন্ত্র পরীক্ষার কৌতূহলেই কুন্তীকে বলেছিলেন—দেরি নয়, আজই ডাকো ধর্মরাজকে, তা হলে আমাদের পুত্রলাভ কোনওভাবেই অধর্মের সঙ্গে যুক্ত হবে না—অধর্মেণ ন নো ধর্মঃ সংযুজ্যেত কথঞ্চন। আসলে ধর্মকে প্রথম আহ্বান জানানোর মধ্যে পাণ্ডুর দুটি যুক্তি থাকতে পারে। প্রথমত এতদিন পাণ্ডু ধর্ম-আচার নিয়েই জীবন কাটাচ্ছিলেন, অতএব তার একটা প্রতিফলন ঘটে থাকবে তাঁর প্রস্তাবে। দ্বিতীয়ত, এইভাবে অন্য পুরুষের দ্বারা, হোক না সে দেবতা, তবুও অন্য একজন পুরুষের দ্বারা নিজের স্ত্রীর গর্ভে পুত্র উৎপাদনের ব্যাপারে তাঁর কিছু লজ্জা থেকে থাকবে। কিন্তু সেই পুত্রের জন্মদাতা যদি হন স্বয়ং ধর্মরাজ, তবে তার মধ্যে অধর্মের লজ্জা কিছু থাকে না। অতএব ধর্মকেই তিনি প্রথমে ডাকতে বললেন কুন্তীকে।
কুন্তী সংযত চিত্তে ধর্মের পূজা করে দুর্বাসার মন্ত্রে ধর্মকে আহ্বান জানালেন মিলনের জন্য। ধর্ম এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন—কী চাই তোমার কুন্তী। কুন্তী বললেন—পুত্র চাই। পুত্র দিন। তারপর শতশৃঙ্গ পর্বতের বনের ভিতর একান্তে ধর্মের সঙ্গে মিলন হল কুন্তীর—শয্যাং জগ্রাহ সুশ্রোণী সহ ধর্মেণ সুব্রতা।
জ্যৈষ্ঠ মাসের এক পূর্ণিমা তিথিতে কুন্তীর প্রথম ছেলের জন্ম হল। নাম হল যুধিষ্ঠির। প্রথম পাণ্ডব। ধর্মের দান প্রথম পুত্রটি লাভ করেই পাণ্ডুর এবার ক্ষত্রিয় জাতির শৌর্য-বীর্যের কথা স্মরণ হল। কুন্তীকে বললেন—লোকে বলে ক্ষত্রিয় জাতির শক্তি-বলই হল সব। তুমি মহাশক্তিধর একটি পুত্রের কথা চিন্তা করো। পাণ্ডুর ইচ্ছা জেনে কুন্তী নিজেই এবার বায়ুদেবতাকে স্মরণ করলেন। কারণ দেবতার মধ্যে তিনি মহাশক্তিধর। বায়ু এলেন। কুন্তীর দ্বিতীয় পুত্র লাভ হল—ভীমসেন।
যুধিষ্ঠির এবং ভীম জন্মানোর পর পাণ্ডু যেন নতুন করে আবিষ্কার করলেন নিজেকে। শাস্ত্রে শুনেছেন—উপযুক্ত পুত্রের জন্য মাতা-পিতাকে তপস্যা করতে হয়। যুধিষ্ঠির এবং ভীমের জন্মের মধ্যে পাণ্ডুর কৌতূহল ছিল, ফলে পুত্রজন্মের মধ্যে আকস্মিকতার প্রাধান্য ছিল বেশি। কুন্তীর শক্তিতে এখন তিনি সম্পূর্ণ বিশ্বাসী অতএব জেনে বুঝে রীতিমতো পরিকল্পনা করে একটি অসামান্য পূত্রের পিতা হতে চান তিনি। এমন একটি পুত্র চান যাঁর মধ্যে দেব-মুখ্য ইন্দ্রের তেজ থাকবে। থাকবে দেবরাজের সর্বদমন শক্তি এবং উৎসাহ। এমন একটি বীরপুত্রের জন্য তিনি নিজে তপস্যায় বসলেন আর ঋষি-মুনির পরামর্শে কুন্তীকে নিযুক্ত করলেন সাংবৎসরিক ব্রতে। স্বামী-স্ত্রীর যুগল-তপস্যায় সন্তুষ্ট হলেন দেবরাজ। স্বীকার করলেন—কুন্তীর গর্ভে অলোকসামান্য পুত্রের জন্ম দেবেন তিনি। পাণ্ডুর ইচ্ছায় কুন্তী এবার দেবরাজকে স্মরণ করলেন সঙ্গম-শয্যায়। জন্মালেন মহাবীর অর্জুন।
অর্জুনের জন্মের পর বহুতর দৈববাণী হল। তাঁর ভবিষ্যত পরাক্রম, চরিত্র এবং যশ বারংবার ঘোষিত হল স্বর্গের দেবতা আর ঋষি-মুনিদের মুখে। কুন্তীর এই পুত্রটি যে কুরুবংশের সমস্ত মর্যাদা পুনরুদ্ধার করে কুরুকুলের রাজলক্ষ্মীকে শ্রীময়ী করে তুলবে—সেকথা অর্জুনের জন্মলগ্নেই শোনা গেল বারবার। দেবতা, সিদ্ধ-গন্ধর্ব-চারণেরা, মুনি-ঋষিরা ভিড় করে অর্জুনকে দেখতে লাগলেন। এই অসাধারণ মুহূর্তে মহারাজ পাণ্ডুর কোনও প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাই না। যা দেখি তাতে আমাদের শ্রদ্ধা আহত হয়।
নন্দনের সংবাদ বয়ে আনা এই বীর পুত্রটির সম্বন্ধে শতশৃঙ্গবাসী ঋষিমুনিদের বিস্ময় এবং জয়কার তখনও শেষ হয়নি, তারই মধ্যে পাণ্ডু কুন্তীর কাছে আরও একটি পুত্রের জন্য বায়না ধরলেন। কুন্তী আর থাকতে পারলেন না। প্রজননশক্তিহীন এক অসহায় স্বামীর পুত্রকামনা মেটানোর জন্য তিনি তাঁরই ইচ্ছেতে অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছেন। তাও একবার নয়, তিনবার। এখন স্বামী আবারও বলছেন চতুর্থ এক পরপুরুষের সংসর্গে পুনরায় পুত্রবতী হওয়ার জন্য। কুন্তী আর থাকতে পারলেন না। বললেন—মহারাজ! বংশকর পুত্র না থাকায় আমাদের আপৎকাল উপস্থিত হয়েছিল—এ-কথা ঠিক। সেই রকম আপৎকালে স্বামীর সম্মতিতে দেব-পুরুষের সংসর্গে আমাদের পুত্রলাভ হয়েছে—তাতেও দোষ নেই। কিন্তু বিপৎকালেও তিন তিন বার পরপুরুষের সহবাসে পুত্রোৎপত্তির পর চতুর্থ পুত্রের জন্ম দেওয়া—সাধুদের আচার সম্মত নয়। কুন্তীর বক্তব্য—তোমার যতই অনুমতি থাকুক, এই বিপৎকালেও চতুর্থ পুরুষের সংসর্গে আমার উপাধি জুটবে স্বৈরিণীর, আবার যদি—যা মতিগতি দেখছি তোমার—পঞ্চম পুরুষের সহবাস জোটে আমার কপালে তা হলে লোকে আমায় বেশ্যা বলবে—অতঃ পরং স্বৈরিণী স্যাৎ পঞ্চমে বন্ধকী ভবেৎ।
আমরা যে সাহসিকা রমণীর আক্ষেপের কথা আরম্ভ করেছিলাম, অথবা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উল্লিখিত যে গৃহস্থ-পত্নী কুন্তীর উদাহরণে নিজের ব্যভিচার-দোষ সমর্থন করতে চেয়েছিল অথবা নীতি-যুক্তির নিয়মে এখনকার কালেও যাঁরা কুন্তীর মধ্যে অন্য কোনও ইঙ্গিত খুঁজে পান—তাঁদের আমি কুন্তীর ওই শেষ বক্তব্যটুকু স্মরণ করতে বলি। কন্যাবস্থায় কৌতুক-সঙ্গমের আকস্মিকতা ছাড়া সচেতনভাবে কুন্তী অন্য কোনও পুরুষকে সকাম অভ্যর্থনা জানাননি। এমনকী দেবতা-পুরুষদের আহ্বান করার মধ্যেও স্বামীর ইচ্ছে এবং নিজের দিক থেকে পুত্রোৎপত্তির যান্ত্রিকতা থাকায়, তাঁর দিক থেকে কোনও সকাম ভাব আমরা লক্ষ করিনি।
বস্তুত যিনি রসিকতা করে শ্লোক বেঁধে বলেছিলেন—কপালের জোর লোকে কুন্তীকে সতী বলে, তাঁকেও শব্দ-চয়ন নিয়ে ভাবতে হয়েছে। তাঁকে শ্লোক বাঁধতে হয়েছে কর্মবাচ্যে—অর্থাৎ পাঁচটি পুরুষের দ্বারা কুন্তী কামিতা হয়েছিলেন—পঞ্চভিঃ কামিতা কুন্তী। কর্তৃবাচ্যে এই বাক্যের রূপ দাঁড়াবে—সূর্য, পাণ্ডু, ধর্মরাজ, বায়ু এবং ইন্দ্র—এই পাঁচজন কুন্তীকে কামনা করেছিলেন। এই শ্লোকের মধ্যে কুন্তীর সম্বন্ধে সকৌতুক কটু ভাবনা আছে বটে। কিন্তু তবু কামনার ক্ষেত্রে কুম্ভীর কর্তৃত্ব নেই। অর্থাৎ রসিকতা করেও তাঁর সম্বন্ধে এ-কথা বলা যাচ্ছে না যে, তিনি স্বেচ্ছায় এবং সজ্ঞানে আপন রতিসুখ চরিতার্থ করার জন্য কোনও পুরুষকে কোনওদিন কামনা করেছেন। তিনটি পর-পুরুষ সংসর্গ সত্ত্বেও পাণ্ডুর প্রতি নিষ্ঠা এবং অনুরাগটুকু মিলিয়ে নিতে হবে কুন্তীর আপন বক্তব্য অনুযায়ী—আর নয় মহারাজ! তোমার যত ইচ্ছেই হোক শুধু পুরুষান্তরের সংখ্যাই এর পর আমাকে স্বৈরিণী বা বেশ্যা করে তুলবে—অতঃ পরং স্বৈরিণী স্যাৎ পঞ্চমে বন্ধকী ভবেৎ।
কুন্তী এইটুকু বলেই পাণ্ডুকে ছেড়ে দেননি। তাঁকে শাসন করে বলেছেন—ধর্মের নিয়ম-নীতি তুমি যথেষ্টই জান। কিন্তু জেনেশুনেও যেন কিছুই তোমার খেয়াল নেই এমনিভাবে সমস্ত ধর্ম-নিয়ম অতিক্রম করে আমাকে আবারও পুত্রের জন্য বলছ কেন—অপত্যার্থং সমুংক্রম্য প্রমাদাদিব ভাষসে!
আসলে এও এক বিকার। প্রজনন-শক্তিহীন অবস্থায় পাণ্ডুর এক ধরনের বিকার ছিল। কিন্তু অন্য পুরুষের সংসর্গে নিজের তিনটি পুত্র লাভ করেও পাণ্ডু যে এখনও পুনরায় স্ত্রীকে পুরুষান্তরে নিয়োগ করতে চাইছেন—এর মধ্যে বোধ হয় আরও বড় কোনও বিকার আছে। জানি না, মনস্তাত্ত্বিকেরা এ বিষয়ে কী ভাববেন, তবে পাণ্ডুর অবদমিত শৃঙ্গারবৃত্তিই যে তাঁর কুলবধূকে এক রকম দুর্গতির দিকে ঠেলে দিয়েছে, সে-কথা স্বীকার না করে উপায় নেই।
যাই হোক পাণ্ডুকে থামতে হল। পুত্রহীনকে পুত্র দান করে কুন্তী আপাতত চালকের আসনে বসে আছেন। আরও একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলতে হবে। নিজের বিয়ের কয়দিনের মধ্যে পাণ্ডুকে দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে দেখে তিনি নিশ্চয়ই পুলকিত হননি। মাদ্রীর প্রতি স্বামীর দেহজ আকর্ষণ হয়তো বা কিছু বেশিই ছিল, যার জন্য তিনি পীড়িত বোধ করে থাকবেন। কিন্তু মুখে কখনওই কিছু বলেননি। আজ পুত্রলাভের জন্য পাণ্ডুকে কুন্তীরই মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে—এতে যদি তাঁর অহঙ্কার কিছু নাও হয়ে থাকে, আত্মতৃপ্তি কিছু ঘটেইছে। চোখের সামনে কুন্তীর এই বাড়-বাড়ন্ত দেখে মাদ্ৰীও খুশি হননি। যে কোনও কারণেই হোক স্বামী-দেবতাটি তাঁর হাতের মুঠোয়ই ছিল, অতএব মাদ্রী কুন্তীর কাছে কোনও দীনতা দেখাননি। তাঁর অভীষ্টপুরণ করতে চেয়েছেন স্বামীর মাধ্যমেই।
মাদ্রী পাণ্ডুকে একদিন বলেই ফেললেন—মহারাজ! তোমার পুত্র জন্মাবার শক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছে—তাতেও আমার দুঃখ হয়নি। কিন্তু আমিও রাজার মেয়ে এবং পুত্র প্রসবের শক্তি আমারও ছিল। মাদ্রী বললেন—দেখ, গান্ধারীর একশোটি ছেলে হয়েছে—তাতেও আমার দুঃখ নেই, কিন্তু মহারাজ! আমি কুন্তীর চাইতে খাটো কীসে? তাঁর ছেলে হল অথচ আমার ছেলে হল না—এ দুঃখ আমি রাখব কোথায়—ইদন্তু মে মহদ্ দুঃখং তুল্যতায়াম্ অপুত্রতা। মাদ্রী নিজের দুঃখ জানিয়ে এবার আসল প্রস্তাব পেশ করলেন পাণ্ডুর কাছে। বললেন—কুন্তী আমার সতীন বটে। তাঁর কাছে আমি হ্যাংলার মতো ছেলে হওয়ার মন্ত্র শিখতে যাব না—সংরম্ভো মে সপত্নীত্বাৎ বক্তুং কুন্তিসুতাং প্রতি। যদি তোমার ইচ্ছে হয়, যদি তোমার ভাল লাগে, তবে কুন্তীকে তুমিই বলে রাজি করাও।
ছোট বউ বলে কথা। মাদ্রী যা বললেন, পাণ্ডু তা নিজেই ভেবেছিলেন। স্বামীর গাম্ভীর্য বজায় রেখেও কুন্তীর কাছে কিছু কাকুতি-মিনতি করতেই হল পান্ডুকে। কুন্তী রাজি হলেন। ভাবলেন—বেচারা! শেষে এইভাবে বলতে হল! স্বামীর আদরিণী ধনিকে করুণা করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। বললেন—ঠিক আছে। এইটুকু দয়া আমি তাকে করব—তস্মাদনুগ্রহং তস্যাঃ করোমি কুরুনন্দন। কুন্তী মাদ্রীকে মন্ত্র দিলেন বটে, কিন্তু সাবধান করে বললেন—একবার, শুধু একবারের জন্য যে কোনও দেবতাকে ডাকতে পারো তুমি।
মাদ্রী একবারে যমজ দেবতা অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে আহ্বান করে কুন্তীর বুদ্ধির ওপর টেক্কা দিলেন। কুন্তীর মনে মনে রাগ হল বটে কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। এর পর পাণ্ডু আবার মাদ্রীকে মন্ত্র শেখানোর জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন কুন্তীকে। একেই কুন্তী মাদ্রীকে সহ্য করতে পারেন না, তার মধ্যে তার চোরা-বুদ্ধিতে মনে মনে আরও রেগে রয়েছেন কুন্তী। স্বামীর এই দুর্বার পুত্রেচ্ছাও তাঁর আর ভাল লাগছে না। বস্তুত পুত্রের জন্য বারংবার এই প্রয়াসে পাণ্ডুরও কোনও সুপ্ত অভিলাষ থেকে থাকবে। আমার ধারণা—জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র শত-পুত্রের পিতা হয়েছেন—এই ঈর্ষা হয়তো তাঁর অন্তরের অন্তরে কাজ করে থাকবে। পাণ্ডু জানতেন—কুন্তীকে বলে আর কোনও সুবিধে হবে না, এখন যদি মাদ্রীকে দিয়ে তাঁর অভীষ্ট পূরণ হয়—তাতে ক্ষতি কী?
কুন্তী বুঝে গেছেন তাঁর স্বামীকে। মাদ্রীকেও তাঁর চেনা হয়ে গেছে। অতএব পাণ্ডুকে প্রায় তিরস্কারের ভাষাতেই কথাগুলি বলে গেলেন কুন্তী। মাদ্রীর সম্বন্ধে তাঁর চিরকালীন মনোভাব যা ছিল, বিশেষত স্বামীর ব্যাপারে তাঁর সপত্নীর অভিমানও বড় পরিষ্কার হয়ে গেল তাঁর কথার ভাষাতেই। কুন্তী বললেন—দেখ, মাদ্রীকে একবার একটি দেব-পুরুষকে ডাকবার কথা বলেছিলাম। সেখানে সে এক মওকায় যমজ-দেবতা ডেকে দুটি ছেলে পেয়েছে। এ তো চরম বঞ্চনা, আমাকে তো বোকা বানানো হয়েছে—তেনাস্মি বঞ্চিতা। এর পরেও আমি যদি তাকে আবার মন্ত্র-শিক্ষা দিই, তবে তো সন্তান-সৌভাগ্যে সে আমাকেও টেক্কা দেবে, অন্তত সংখ্যায়। তুমি আর বোলা না, খারাপ মেয়েছেলেদের কেতাকানুনই এইরকম—বিভেম্যস্যা হ্যভিভবাৎ কুস্ত্ৰীণাং গতিরীদৃশী। আমি বোকা কিনা, তাই বুঝিনি যে, যুগল-পুরুষের আহ্বানে ফলও দুটোই হয়। না, তুমি আর আমাকে অনুরোধ কোরো না, আমি খুব বুঝেছি, এবার আমাকে দয়া করো—তস্মান্নাহং নিযোক্তব্যা ত্বয়ৈযো’স্তু বয়রা মম। পাণ্ডু কুন্তীকে আর ঘাঁটাতে সাহস করেননি।