৩
নবীন যৌবনবতী কুন্তীর কানে দেব-সঙ্গমের রহস্য-মন্ত্র উচ্চারণ করে দুর্বাসা যেই চলে গেলেন, আর অমনই কুন্তীর কুমারী-হৃদয়ে শুরু হল নতুন এক অনুভূতি। তাঁর হৃদযন্ত্র কথা কইতে শুরু করল পুরুষ-গ্রহণের স্বাধীনতায়। সামান্যতম সংশয় শুধু মন্ত্রের বলাবল নিয়ে—পাব তো, যাঁকে চাই, তাঁকেই কি পাব? এ কেমন মন্ত্র যাতে ইচ্ছামাত্র বশীভূত করা যায় যে কোনও অভীপ্সিত পুরুষকে! আমি পরীক্ষা করব মন্ত্রের শক্তি, দেখব—যাকে চাই সে আমার ডাক শুনতে পায় কি না? কুমারী হৃদয়ে এই নবসঙ্গমের ভাবনায় তাঁর ঋতুভাব ত্বরান্বিত হল। ঋতুর এই অস্বাভাবিকতা বৈদ্যশাস্ত্রে মোটেই অস্বাভাবিক নয়, কারণ কুন্তী মন্ত্র পরীক্ষার জন্য সব সময় পুরুষের আসঙ্গ ভাবনায় আকুল ছিলেন—এবং সঞ্চিন্তয়ন্তী সা দদর্শর্ত্তুং যদৃচ্ছয়া।
তারপর একদিন। সেদিন অন্তঃপুরের অট্টালিকায় একলা ঘরে পুষ্পের বিছানায় শুয়েছিলেন পুষ্পবতী কুন্তী। ভোরের সূর্য তাঁর কিরণ-করের স্পর্শে নবযুবতীর গালখানিও যেন লাল করে দিল। কী ভাল যে লাগছিল কুন্তীর! পূর্ব দিগন্তে আকাশের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে রক্তিম সূর্য—তাঁর সুমধুর নান্দনিক পরাক্রমে মুগ্ধা কুন্তীর, মন এবং দৃষ্টি—দুইই নিবদ্ধ হল সূর্যের দিকে। রাত্রি-দিনের সন্ধিলগ্নের এই দেবতাটিকে এক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে কুন্তী তাঁর মধ্যে দিব্যদর্শন এক পুরুষের সন্ধান পেলেন। দেখতে পেলেন তাঁর কানে সোনার কুণ্ডল, বুক-পিঠ জুড়ে সোনার বর্ম—আমুক্তকবচং দেবং কুণ্ডলাভ্যাং বিভূষিতম্।
মনে রাখা দরকার—দেবতার রাজ্যে সূর্য এমন এক দেবপুরুষ, যাঁর প্রাধান্য এবং মহিমা অন্য সমস্ত দেবতার চাইতে বেশি। ঋগ্বেদে তিনি শুধুই দেবতামাত্র নন, অন্যান্য অনেক দেবতাকে তাঁরই বিভূতি বলে মনে করা হয়। এই তো কিছুদিন আগে দক্ষিণী পণ্ডিত অধ্যাপক সীতারাম শাস্ত্রী সমস্ত ঋঙ্মন্ত্রেরই সূর্যনিষ্ঠ ব্যাখ্যা করতেন। এমনকী পরবর্তী কালে যে সমস্ত দেবতার আবিভাব ঘটেছে—বেদের সঙ্গে যাঁদের সোজাসুজি কোনও যোগ নেই, তাঁদেরও সৌর-কুলীনতা প্রতিষ্ঠা করা গেলে মিথলজিস্টরা তাঁদের বেশি মযার্দা দেন। বেদের পরবর্তী কালে নারায়ণ-বিষ্ণুর যে এত মহত্ত্ব দেখতে পাই, সেই বিষ্ণু-নারায়ণও কিন্তু আসলে সূর্যই। ধ্যেয়ং সদা সবিতৃমণ্ডল-মধ্যবর্তী—তাঁরও কানে সোনার দুল, মাথায় মুকুট।
দেব-তত্ত্বের মূল-স্বরূপ ওই সূর্যকেই কুন্তী তাঁর মন্ত্ৰ-পরীক্ষার প্রথম আধার বলে বেছে নিলেন। হৃদয়ে হাত ঠেকিয়ে আচমন-পুরশ্চরণ করে দুর্বাসার মন্ত্রে কুন্তী আহ্বান জানালেন সূর্যকে। সূর্য নিজেকে দ্বিধা বিভক্ত করলেন। আকাশ থেকে নিজের তাপ-বিতরণের কাজ যেমন চলার তেমনই চলল, কিন্তু অলৌকিকতার সূত্রে তিনি শরীর পরিগ্রহ করে কুন্তীর সামনে এসে দাঁড়ালেন—মুখে হাসি, মাথায় বদ্ধমুকুট, তেজে চারদিক উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কুন্তীর জীবনের প্রথম অভীপ্সিত পুরুষ, তিনি তাঁকে ডেকেছিলেন সানুরাগে—তস্য দেবস্য ভাবিনী।
অতএব এই অনুরাগের প্রত্যুত্তরের মতো সুন্দর ভাষায় সূর্য বললেন—ভদ্রে। প্রথম আলাপে স্ত্রী-লোককে ‘ভদ্রা’ সম্বোধনটি অনেকটা ফরাসিদের মাদামের মতো। এই সম্বোধনের মধ্যে প্রথম আলাপের দূরত্বটুকু বজায় রেখেই সূর্য বললেন—ভদ্রে! আমি এসেছি তোমার মন্ত্রের শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে। এখন আমি সম্পূর্ণ তোমার বশীভূত—বল আমি কী করব—কিং করোমি বশো রাজ্ঞি? অনুরাগবতী কুন্তীর বুঝি এইবার আপন কুমারীত্বের কথা স্মরণ হল। কুন্তী বললেন—আপনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানেই ফিরে যান। আমি কৌতুকবশে অর্থাৎ এমনি মজা দেখার জন্য আপনাকে ডেকেছি, অতএব আপনি এখন ফিরে যান—কৌতূহলাৎ সমাহূতঃ প্রসীদ ভগবন্নিতি। সংস্কৃতে আছে—প্রসীদ—প্রসন্ন হোন, ফিরে যান; ইংরেজিতে এই ‘প্রসীদ’ হল—প্লিজ।
যৌবনবতী কুন্তী সানুরাগে দেব-পুরুষকে ডেকেছেন মজা দেখার জন্য—কৌতূহলাৎ সমাহূতঃ,—তিনি জানেন না একক পুরুষকে সানুরাগে ঘরে ডাকলে সে আর প্রসন্ন হয়ে ফিরে যায় না; প্রথম ভদ্র সম্বোধনের পরেই তার নজর পড়ে অনুরাগবতীর শরীরে। উচ্চাবচ প্রেক্ষণের পর যথাসম্ভব ভদ্র সম্বোধনে সে বলে—কৃশকটি সুন্দরী আমার! যাব, নিশ্চয় যাব, কিন্তু আমাকে সাদরে ডেকে এনে নিজের ইচ্ছে বৃথা করে এমন করে পাঠিয়ে দেবে আমাকে—ন তু দেবং সমাহূয় ন্যায্যং প্রেষয়িতুং বৃথা? সূর্য পরিষ্কার বললেন—আমি তোমার ইচ্ছেটুকু জানি। তুমি চাও—সোনার বর্ম-পরা সোনার কুণ্ডল-পরা আমার একটি পুত্র তোক তোমার গর্ভে। কিন্তু তার জন্য যে তোমার শরীরের মূল্যটুকু দিতেই হবে। তুমি নিজেকে আমার কাছে ছেড়ে দাও—স ত্বমাত্মপ্রদানং বৈ কুরুষ্ব গজগামিনি। তুমি যেমন ভেবেছ তেমন পুত্রই হবে তোমার এবং আমিও যাব তোমার সঙ্গে মিলন সম্পূর্ণ করে—অথ গচ্ছাম্যহং ভদ্রে ত্বয়া সঙ্গম সুস্মিতে।
সুর্যের প্রণয়-সম্বোধনের মধ্যে এখন রমণীর অলসগামিতা অথবা মধুর হাসিটিও উল্লিখিত হচ্ছে। অবশ্য এই সপ্রণয় ভাষণের মধ্যে পুরুষের ভয় দেখানোও ছিল। কথা না শুনলে অভিশাপ দিয়ে তোমার বাবা আর সেই ব্রাহ্মণ ঋষিটিকে ধ্বংস করব—এর থেকেও বড় দায় চাপানো হয়েছিল কুন্তীর নিজের চরিত্রের ওপরই। সুর্য বলেছিলেন—তুমি যে আমার মতো একজন দেবপুরুষকে ঘরে ডেকে এনেছ—এই অন্যায় কাজ তোমার বাবা জানেন না। কিন্তু তোমার অপরাধে আমি ধ্বংস করব তাঁকে এবং তাঁর পরিজনকে। এবারে সূর্য কুন্তীর স্বভাব নিয়েই বড় গালাগালি দিয়ে ফেললেন। সূর্য বলতে চাইলেন—বোকা হলেন সেই মুনি যিনি তোমাকে এই মন্ত্র দিয়েছেন। পুরুষের সম্বন্ধে যে রমণীর সংযমটুকু নেই, সেই রমণীকে এই মন্ত্র দেওয়াটাই একটা বাতুলতা। তা সেই ব্রাহ্মণকে গুরুতর দণ্ড দেব আমি, যিনি তোমার স্বভাব-চরিত্র না জেনেই এই পুরুষ-আহ্বানের মন্ত্র তোমায় শিখিয়েছেন—শীলবৃত্তমবিজ্ঞায়…যো’সৌ মন্ত্রমদাত্তব।
সুর্য যে প্রত্যাখ্যাত হয়েই কুন্তীর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে গালাগালি দিচ্ছেন, সে কথা আমরা বেশ বুঝতে পারি। কুন্তীর মন্ত্র-পরীক্ষার মধ্যে কৌতুক ছাড়া অন্য কোনও প্রবৃত্তি ছিল বলে আমরা মনে করি না। একান্ত মানবোচিতভাবে ব্যাপারটা ভেবে দেখুন—অসাধারণ কোনও লাভের অভিসন্ধি মেশানো এমন কোনও মন্ত্র যদি আমরা পেতাম, তবে আমরাও তা পরীক্ষা করেই দেখতাম। মন্ত্রের শক্তি যে আছে, সে সম্বন্ধে মানুষ ইতিবাচক ধারণা পূর্বাহ্নে পোষণ করে না বলেই মণি-মন্ত্র-মহৌষধি—মানুষ তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করতে চায়। তার মধ্যে এই মন্ত্র হল বশীকরণের মন্ত্র; আধুনিক যুবক-যুবতীর হাতে যদি পুরুষ বা রমণী বশ করার এমন সিদ্ধমন্ত্র থাকত, তবে তা অবশ্যই পরীক্ষিত হত কুন্তীর মতোই কৌতুকে—এ-কথা আমি হলফ করে বলতে পারি।
তবে দেবপুরুষ কুন্তীকে যে গালাগালি দিচ্ছিলেন, সে কুন্তীর স্বভাব-চরিত্রের জন্য যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি নিজের সম্মানের জন্য। সুন্দরী রমণীর কাছে সাদর আমন্ত্রণ লাভ করে কোন পুরুষেরই বা প্রত্যাখ্যাত হতে ভাল লাগে, নিজের বন্ধু-বান্ধব বা সমাজের কাছেই বা তার মুখ থাকে কতটুকু? সূর্যের আসল কথাটা এবার বেরিয়ে এল। তিনি বললেন—তুমি যে আমাকে অনুরাগ দেখিয়ে এখন বঞ্চিত করছ—এসব আকাশ থেকে আমার বন্ধু দেবতারা দেখছেন আর হাসছেন—পুরন্দরমুখা দিবি। ত্বয়া প্রলব্ধং পশ্যন্তি স্ময়ন্ত ইব ভাবিনি। তোমার তো দিব্যদৃষ্টি আছে, একবার তাকিয়ে দেখো আকাশপানে। কুন্তী সূর্যের কথা শুনে আকাশের দিকে চাইলেন, দেখলেন অন্য দেবতাদের।
কুন্তী নিজের বোকামিতে সত্যিই লজ্জা পেলেন। কৌতুক-লিপ্সু কুমারী এক মুহূর্তে যেন বড় হয়ে গেলেন। বললেন—তবু আপনি চলে যান সুর্যদেব। আমার পিতা-মাতা আমাকে এই শরীর দিয়েছেন, মেয়েদের কাছে এই শরীর-রক্ষার মূল্যই যে সবচেয়ে বেশি, কারণ দ্বিতীয় একটি কুমারীর শরীর তো আমি তৈরি করতে পারব না, অতএব আমার এই কুমারী-শরীরটাই আমাকে রক্ষা করতে হবে—স্ত্রীণাং বৃত্তং পূজ্যতে দেহরক্ষা। কুন্তী এবার অনুনয়ের সুরে বললেন—বিশ্বাস করুন, আমি আমার অল্প বয়সের চঞ্চলতায় শুধু কৌতুকের বশে মন্ত্রশক্তি জানার জন্য আপনাকে ডেকেছি। এটা ছেলেমানুষি ভেবেই আপনি ক্ষমা করে দিন।
সুর্য বললেন—বয়স তোমার অল্প বলে আমিও তোমাকে এত সেধে সেধে বলছি। অন্য কেউ কি আমার এত অনুনয় পাওয়ার যোগ্য? তুমি নিজেকে ছেড়ে দাও আমার কাছে, তাতেই তোমার শান্তি হবে—আত্মপ্রদানং কুরু কুন্তি কন্যে শান্তিস্তবৈবং হি ভবেচ্চ ভীরু। সূর্য শুধু একটা কথাই ভাবছেন। ভাবছেন—যে রমণী প্রথম যৌবনের চঞ্চলতায় সাদরে দেবপুরুষকে কাছে ডেকেছে, উপভোগের দ্বারাই তার শান্তি হবে। হয়তো এটাই ঠিক—কুন্তীর প্রথম আহ্বানটুকু মিথ্যে ছিল না, কিন্তু ডাকার পর পুরুষের একান্ত দুরবগ্রহ একমুখী প্রয়াস দেখে এখন তিনি চিন্তিত, ব্যথিত। যে কোনও ভাবেই হোক, সূর্য কুন্তীর শরীর-সম্ভোগ ব্যতিরেকে ফিরে যেতে চান না। স্বর্গের দেবতা হওয়া সত্ত্বেও মনুষ্য-রমণীর আহ্বানে তিনি মানুষের শরীরে নেমে এসেছেন ভঁয়ে। এখন এই সামান্যা মানবী তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবে, এ তিনি সহ্য করতে পারছেন না। কুন্তীর কাছে বারংবার দেবসমাজে তাঁর ভাবী অপমানের কথা তিনি বলেছেন, কারণ সেটাই তাঁর প্রধান লজ্জা—গমিষ্যামনবদ্যাঙ্গি লোকে সমবহাস্যতাম্।
কুন্তী অনেক চিন্তা করলেন। সূর্য সতেজে তাঁর হাত ধরেই রয়েছেন। তবু মুখখানি নিচু করে তিনি কত কিছুই ভেবে নিলেন। বুঝলেন—তাঁর প্রত্যাখ্যানে নিরপরাধ কুন্তিভোজ এবং স্বয়ং দুর্বাসার বিপদ নেমে আসতে পারে। অন্যদিকে স্বর্গের দেবতা উপযাচক হয়ে তাঁর কাছে প্রসাদ ভিক্ষা করছেন, তাঁর হাতখানিও ধরে আছেন নিজের হাতে—এই বিচিত্র অনুভূতি তাঁর মোহও জন্মাচ্ছে বারে বারে। একদিকে তিনি ‘শাপ-পরিত্ৰস্তা’ অন্যদিকে ‘মোহেনাভিপরীতাঙ্গী’—এই ভয় এবং মোহের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কুন্তী এবার তাঁর ভয় এবং মোহ দুই-ই প্রকাশ করলেন সুর্যের কাছে।
ভয়াবিষ্টা কুন্তী বললেন—আমার বাবা, মা, ভাই, আত্মীয়-স্বজন কী বলবে আমাকে? তাঁরা এখনও বেঁচে আছেন, আর আমি সমাজের নিয়ম ভেঙে নিজেকে হারিয়ে ফেলব? যদি সব নিয়ম ভেঙে এমনি করে হারিয়ে ফেলি নিজেকে—ত্বয়া তু সঙ্গমো দেব যদি স্যাদ্ বিধিবর্জিতঃ—তা হলে আমার বংশের মান-মর্যাদা সব যাবে।
মোহাবিষ্টা কুন্তী বললেন—আর এত কথা শুনেও যদি মনে হয়, আপনি যা বলছেন তাই ধর্ম, তবে আমি আত্মীয়-স্বজনের দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে আপনার ইচ্ছে পূরণ করব—ঋতে প্রদানাদ্ বন্ধুভ্য স্তব কামং করোম্যহম্। কিন্তু আমার একটাই কথা—আমার এই শরীর দিয়েও আমি সতী থাকতে চাই। কুন্তী এই মুহূর্তে সূর্যকে সম্বোধন করলেন ‘দুর্ধর্ষ’ বলে—আত্মপ্রদানং দুর্ধর্ষ তব কৃত্বা সতী ত্বহম্। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট।
মনস্তত্ত্ববিদেরা বলেন—অধিকাংশ ধর্ষণের ক্ষেত্রে রমণীর দিক থেকে প্রাথমিক বাধাদানের ব্যাপার থাকলেও পরবর্তী সময়ে কিছু আত্মসমর্পণের ইচ্ছাও থেকে যায়। কিন্তু কি রমণী, কি পুরুষ, তিন ভুবনের সার কথাটা কুন্তীর মুখ দিয়েই বেরিয়েছে—শরীর দিয়েও আমি সতী থাকতে চাই। প্রথম যৌবনের হাজারো চঞ্চলতার মধ্যেও রমণীর পক্ষে বিধিবহির্ভূত মিলনের এই হাহাকারটুকু বড়ই স্বাভাবিক—আমি আপনাকে শরীর দিয়েও সতী থাকতে চাই—আত্মপ্রদানং দুর্ধর্ষ তব কৃত্বা সতী ত্বহম্।
সূর্য সব বোঝেন। কুন্তীকে সামান্য উন্মুখ দেখা মাত্রই তিনি কথা আরম্ভ করলেন একেবারে কামুক পুরুষের স্বার্থপরতায়। বললেন—বরারোহে। বরারোহা মানে জানেন কী? A good mount for a distinguished personality. সূর্য বললেন—বরারোহে! তোমার বাবা-মা বা অন্য কোনও গুরুজন—কেউ তোমার প্রভু নন অর্থাৎ জীবনের এই বিশেষ মুহূর্তে তাঁদের ইচ্ছামতো চলার কথা নয় তোমার। যাতে তোমার ভাল হবে, সেই কথাই বরং আমার কাছে শোনো। সূর্য এবার পণ্ডিত-জনের পাণ্ডিত্য দেখিয়ে বললেন—‘কম্’ ধাতুর অর্থ কামনা করা। কন্যা শব্দটাই এসেছে এই ধাতু থেকে, অতএব কন্যাজন মাত্রই সব পুরুষকেই কামনা করতে পারে, সে স্বতন্ত্রা—সর্বান্ কাময়তে যম্মাৎ কমের্ধাতোশ্চ ভাবিনি। তস্মাৎ কন্যেহ সুশ্রোণি স্বতন্ত্রা বরবৰ্ণিনি।
সূর্য কন্যা-শব্দের মধ্যেই কামনার উৎস প্রমাণ করে দিয়ে কুন্তীর মনের আশঙ্কা দূর করতে চাইলেন। বোঝাতে চাইলেন সূর্যের প্রতি তাঁর অনুরাগবতী হওয়াটাই যথার্থ হয়েছে। কামনার চূড়ান্ত পর্যায়ে কুন্তীর কাছে সূর্যের যুক্তি হল—স্ত্রী এবং পুরুষ পরস্পরকে কামনা করবে, এইটাই স্বাভাবিক, এবং অন্যটাই বিকার—স্বভাব এষ লোকানাং বিকারো’ন্য ইতি স্মৃতঃ। সূর্য জানেন—এত যুক্তি, এত স্বভাব-বোধনের পরেও কুমারী কুন্তীর মনে সামাজিকের সেই ভ্রূকুটি-কুটিল জিজ্ঞাসাটুকু থেকেই যাবে। অতএব প্রথম যৌবনবতী রমণীর রিরংসা এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা কুন্তীকে আশ্বাস দিয়ে সূর্য বললেন—আমাদের মিলনের পর তুমি আবারও তোমার কুমারীত্ব ফিরে পাবে—সা ময়া সহ সঙ্গম্য পুনঃ কন্যা ভবিষ্যসি—আর তোমার ছেলেও হবে অনন্ত খ্যাতির আধার এক মহাবীর।
সূর্যের এই আশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে কুন্তী তাঁকে সম্বোধন করেছেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচার ভঙ্গীতে—হে আমার আঁধার-দূর-করা আলো—সর্বর্তমোনুদ। এই মুহূর্তে কুন্তী জানেন—যে ছেলে জন্ম নেবে সূর্যের ঔরসে, সেই ছেলের সঙ্গে তাঁর থাকা হবে না, তাকে লালন-পালন করার সামাজিক সাহস তাঁর নেই। থাকলে কুমারীত্বের জন্য লালায়িত হতেন না তিনি। কিন্তু ‘দুর্ধর্ষ’ এই তেজোনায়ক ফিরে যাবেন না অসঙ্গমের অসন্তোষ নিয়ে। অতএব সেই ভবিষ্যৎ সন্তানের জন্মলগ্নেই তার স্বয়ম্ভরতার নিরাপত্তা চান তিনি। কুন্তী বললেন—আপনার ঔরসে আমার যে পুত্র হবে সে যেন আপনার অক্ষয় কবচ এবং কুণ্ডল নিয়েই জন্মায়। সূর্য বললেন—তাই হবে ভদ্রে! এই কবচ এবং কুণ্ডল অমৃতময়। তোমার সেই পুত্র অমৃতময় বর্ম এবং কুণ্ডল নিয়েই জন্মাবে।
কুন্তী বললেন—যদি তাই হয়, যদি আমার পুত্রের কুণ্ডল এবং বর্ম দুটিই অমৃতময় হয় অর্থাৎ জীবনে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা যদি তার স্বায়ত্তই থাকে, তবে হোক আপনার ঈপ্সিত সঙ্গম, যেমনটি আপনি বলেছেন আমি তাতেই রাজি—অস্তু মে সঙ্গমো দেব যথোক্তং ভগবংস্ত্বয়া। মনে করি—আমার পুত্র আপনারই মতো শক্তি, রূপ, অধ্যবসায়, তেজ এবং ধর্মের দীপ্তি নিয়ে জন্মাবে।
কুন্তী দেখেছেন—সূর্যের হাত থেকে যখন নিস্তার নেই-ই, সেক্ষেত্রে তাঁর কন্যাসত্তা এবং ভাবী পুত্রের নিরাপত্তা—দুটিই তাঁর একান্ত প্রয়োজন—একটি বাস্তব কারণে, অন্যটি মানবিক। প্রথম যৌবনের কৌতুহলে তিনি যা বোকার মতো করে ফেলেছিলেন, তাকে তিনি শুধরে নিয়েছেন মনস্বিনীর মতো অতি দ্রুত, সূর্যের দ্বারা প্রায় আলিঙ্গিত অবস্থায়। ভবিষ্যৎ জীবনের পরিণত মাতৃত্বের ব্যাপ্তি প্রথম যৌবনের মাদকতার মধ্যে আশা করা যায় না বলেই, অন্তত পুত্রের নিরাপত্তার ভাবনাই যে তাঁকে এই মুহূর্তে স্বতন্ত্র নারীর মহিমা দিয়েছে, তাতে সন্দেহ কী? ভবিষ্যতে কর্ণের শত অভিমানের উত্তরে সূর্যের দুরাগ্রহ এবং তাঁর অসহায়তার জবাবদিহি সম্ভব ছিল না বলেই অন্তত এই নিরাপত্তার চিন্তাও আমার কাছে কুন্তীর বাস্তববোধের পরিচয়।
কুমারীত্ব এবং কুমারীপুত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতেই কুন্তী তাঁর প্রথম মিলনের কৌতুক যেন আবারও ফিরে পেয়েছেন অন্তত দেখাচ্ছেন সেইরকম। সূর্যের কথায় সায় দিয়ে তিনি বলেছেন—হোক সেই পরমেপ্সিত মিলন—সঙ্গমিষ্যে ত্বয়া সহ—যেমনটি তুমি চাও। আর প্রার্থিত রমণীর সোচ্চার আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে সূর্য একাধিক প্রিয় সম্বোধনে ভরিয়ে তুলেছেন কুন্তীকে—আমার রানি, যৌবন শোভার আধার, বামোরু। সূর্য আলিঙ্গন করলেন কুন্তীকে, হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন কুন্তীর নাভিদেশ। দেবভাব থাকা সত্ত্বেও মানুষের শরীরে সূর্যের করস্পর্শের এই ইঙ্গিত পণ্ডিত হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ফুটিয়ে তুলতে দ্বিধা করেননি। বলেছেন—বসনমোচনায় ইত্যাশয়ঃ।
নবীন যৌবনবতী কুন্তী যেদিন সূর্যকে দেখে সকৌতুকে পুরুষ বশীকরণের মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, সেদিন তিনি ভেবেছিলেন—দেখি তো পুরুষকে কাছে ডাকলে কেমন হয়! দেখি তো পুরুষ ভোলালে কেমন হয়! এই কৌতুক আর কৌতুক রইল না, কঠিন বাস্তব আর সুর্যের ‘দুর্ধর্ষতা’য় সে কৌতুক এক মুহূর্তে কুন্তীকে পৌঢ়া করে তুলল। আর এখন সেই অভীপ্সিত সঙ্গম-কৌতুকের মুহূর্তে পুরুষের ধর্ষণ-মুখরতায় কুন্তী অচেতন হয়ে গেলেন। মহাভারতের কবি দেবতা পুরুষকে বাঁচানোর জন্য লিখেছেন-কুন্তী সূর্যের তেজে বিহ্বল হলেন, বিছানায় পড়ে গেলেন অচেতনের মতো—পপাত চাথ সা দেবী শয়নে মূঢ়চেতনা—মোহাবিষ্টা, ছিন্ন লতার মতো—ভজ্যমানা লতেব। আমরা জানি—ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গমে প্রবৃত্ত হয়ে কুন্তী সংজ্ঞা হারিয়েছেন আর ‘দুর্ধর্ষ’ সূর্য তাঁর সঙ্গম সম্পন্ন করেছেন কুন্তীর অচেতন অবস্থাতেই, কারণ আমরা দেখেছি, ব্যাসদেবকে অধ্যায় শেষ করতে হয়েছে—একাকী সূর্যের সঙ্গম-সন্তোষের পর কুন্তীর চেতনা ফিরিয়ে দিয়ে—সংজ্ঞাং লেভে ভূয় এবাথ বালা। ব্যাসের শব্দ প্রয়োগও খেয়াল করবেন—‘বালিকা আবারও চেতনা ফিরিয়া পাইল’। এই বালা বা বালিকা শব্দের মধ্যেই কুন্তীর অজ্ঞতা, চঞ্চলতা, কৌতুকপ্রিয়তা ইত্যাদি নির্দোষ গুণগুলি নিহিত করে মহাভারতের কবি তাঁকে সমস্ত দোষ থেকে মুক্তি দিয়েছেন।