কুন্তী – ১০

১০

কৃষ্ণ যখন কৌরব-সভায় শান্তির দূত হয়ে এলেন, তখন তিনি সভায় যাবার আগে একবার কুন্তীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন, আবার সভা ব্যর্থ হবার পরেও একবার দেখা করেছিলেন। প্রথমবার যখন কুন্তীর সঙ্গে কৃষ্ণের দেখা হয়, তখন কুন্তী একবার বলেছিলেন—আমার ভাশুরের ছেলেদের এবং আমার ছেলেদের কোনওদিনই আমি আলাদা চোখে দেখিনি—ন মে বিশেষো জাতু আসীদ্‌ ধার্তরাষ্ট্রেষু পাণ্ডবৈঃ। এই কথার মধ্যে হয়তো সত্য কিছু নিশ্চয়ই আছে, নইলে দিনের পর দিন বঞ্চনা সহ্য করে কুন্তী এত ধৈর্য ধরলেন কী করে! কিন্তু এই সত্যের চেয়েও আরও গভীর এক বিষণ্ণ সত্য আছে, যার জন্য দুর্যোধনের ব্যাপারে ধৈর্য ধরেছেন কুন্তী। সেই সত্য হয়তো কর্ণ, যাঁকে দুর্যোধন পালনে-পোষণে এবং মন্ত্রণায় এমনই এক পৃথক মর্যাদা দিয়েছেন যা কুন্তীর অপরাধী মনে অন্যতর ধৈর্যের জন্ম দিয়েছে।

দিনের পর দিন অস্থির অহঙ্কারী দুর্যোধনের সঙ্গে পড়ে নিজের একান্ত-জাত সন্তানকে একেবারে অন্য রকম হয়ে যেতে দেখলেন কুন্তী। অস্ত্রশিক্ষার আসরে দুর্যোধন যখন তাঁকে অঙ্গরাজ্য দান করে রাজার পদবীতে স্থাপন করেছিলেন তখন দুর্যোধনের ওপর কুন্তীর চেয়ে বেশি খুশি বোধ হয় কেউ ছিলেন না। কিন্তু কুন্তীর সেই খুশি একটু একটু করে ভেঙে যেতে থাকল। তিনি দেখলেন, দুর্যোধনের সঙ্গে মিশে মিশে, তার সমস্ত অন্যায়ের অংশভাগী হয়ে কেমন করে তাঁর কন্যাগর্ভের পুত্রটি একেবারে বয়ে গেল। কর্ণ যেদিন উন্মুক্ত রাজসভার মধ্যে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করার আদেশ দিয়েছিলেন দুঃশাসনকে—সে খবর কি কুন্তীর কানে যায়নি? গিয়েছিল। দুর্যোধনের ওপর খুশি থাকার এই বুঝি শেষ দিন, আপন কুক্ষিজাত পুত্রকে ক্ষমা করার পক্ষেও বোধহয় সেই দিনটি ছিল চরম দিন। কৃষ্ণের কাছে কথা বলতে গিয়ে বারংবার যখন দ্রৌপদীর প্রতি কৌরবদের অন্যায়ের প্রসঙ্গ আসছিল, তখন কর্ণকেও কুন্তী সমানভাবে দায়ী করেছেন—দুঃশাসনশ্চ কর্ণশ্চ পুরুষাণ্যভ্যভাষতাম্‌। পুত্র বলে তার অন্যায় অনুক্ত রাখেননি কুন্তী।

কিন্তু আজ কী হবে? দুর্যোধন শান্তির প্রস্তাব উড়িয়ে দিলেন এক ফুঁয়ে। যুদ্ধের উদ্যম শুরু হয়ে গেল সশব্দে, সোচ্চারে। বিদুর এসে কুন্তীকে বললেন—তুমি তো জান, ঝগড়া-ঝাঁটি এড়িয়ে শান্তি বজায় রাখার ব্যাপারটা আমি কীরকম পছন্দ করি। কিন্তু এত চ্যাঁচাচ্ছি, তবু দুর্যোধন কিছুই শোনে না। ওদিকে ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির, তাঁর ভীমার্জুন, কৃষ্ণ এবং অন্যান্য সহায়-শক্তি থাকা সত্ত্বেও দুর্বলের মতো শান্তি-শান্তি করে যাচ্ছেন—কাঙক্ষতে জ্ঞাতি-সৌহার্দাদ্‌ বলবান্ দুর্বলো যথা। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, তিনি বুড়ো হয়ে গেলেন, তবু তিনি থামবেন না—বয়োবৃদ্ধো ন শ্যামতি। ছেলের কথায় মত্ত হয়ে অন্যায়ের রাস্তা ধরেছেন তিনি, আর এই জ্ঞাতিভেদ সৃষ্টির কাজে বুদ্ধি জুগিয়ে যাচ্ছে জয়দ্ৰথ, কর্ণ, দুঃশাসন আর শকুনিরা।

এই যুদ্ধোদ্যোগের মুহূর্তে বিদুর যখন সমস্ত রাজনীতিটার ‘পারস্‌পেক্‌টিভ’ বুঝিয়ে দিচ্ছেন কুন্তীকে, ঠিক সেই মুহূর্তে আবারও কর্ণের নাম কুন্তীকে বুঝি শেষবারের মতো উচ্চকিত করে তুলল। বিদুর, ধর্মময় বিদুর বলেছিলেন—যদি ধার্মিক সুজনের প্রতি এত অধর্ম করবে, তবে কোন মানুষটা বিষিয়ে না যাবে—কো ন সংজ্জরেৎ? কৃষ্ণের শাস্তির কথাতেও যেখানে কাজ হল না, সেখানে কৌরবদের অন্যায়-অধর্মে যে বহু বীরপুরুষই মারা পড়বে, তাতে সন্দেহ কী? এইসব ভেবে ভেবে দিনে রাতে দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হয় না।

বিদুরের যেমন ঘুম হয় না, তেমনই কুন্তীরও ঘুম হয় না। বিদুরের রাজনৈতিক ভাষ্যে কর্ণ যুদ্ধ লাগবার অন্যতম কারণ, আর সে যুদ্ধ যদি লাগে তবে অনেক বীরপুরুষই মারা যাবে—সে ভীমও হতে পারে, অর্জুনও হতে পারে, কর্ণও হতে পারে। এই একটু আগে কৃষ্ণের মাধ্যমে বীর পুত্রদের যিনি যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত করেছেন, তিনি ওই ভবিষ্যৎ বীরনাশে এত উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন কেন? হ্যাঁ এই যুদ্ধের দোষ অনেক, কিন্তু যুদ্ধ না করলে সেই চিরকালীন নির্ধনতা, অপমান আর বঞ্চনা। একদিকে নির্ধনতার যন্ত্রণা অন্যদিকে জ্ঞাতিক্ষয়ের মাধ্যমে জয়লাভ—দুইই তাঁর কাছে সমান সমান—অধনস্য মৃতং শ্রেয়ঃ ন হি জ্ঞাতিক্ষয়ো জয়ঃ। কুন্তী এসব বোঝেন, এমনকী পাণ্ডব-কৌরবদের এই জ্ঞাতিযুদ্ধে প্রত্যেক সমরনায়কের রাজনৈতিক অবস্থিতিটাও তিনি ভালভাবেই জানেন।

কুন্তীর মতে এই যুদ্ধে ভয়ের কারণ তিন জন—পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ এবং কর্ণ। তিনজনই দুর্যোধনের জন্য লড়াই করবেন। তবু এর মধ্যে তাঁর সান্ত্বনা এবং স্থির বিশ্বাস যে, আচার্য দ্রোণ প্রিয় শিষ্যদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাইবেন না। আর পিতামহ ভীষ্মই বা কী করে পাণ্ডবদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্নেহমুক্ত হবেন? আর বাকি রইলেন শুধু কর্ণ। হায়! কুন্তী কী ভাবে বোঝাবেন নিজেকে। কৌরব পক্ষে এই কর্ণই হলেন একমাত্র ব্যক্তি, কুন্তীর মতে যার ভবিষ্যতের দৃষ্টি নেই কোনও। দুর্যোধনের পাল্লায় পড়ে মোহের বশে কেবলই সে কতগুলি অন্যায় করে যাচ্ছে, পাণ্ডবদের তো সে চোখেই দেখতে পারে না—মোহানুবর্তী সততং পাপো দ্বেষ্টি চ পাণ্ডবান্‌।

মুশকিল হল, যত অনর্থই ঘটাক এই কর্ণ, তার শক্তি এবং ক্ষমতা সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কুন্তী ভাবেন—ওই অসামান্য শক্তি নিয়ে কর্ণ যে শুধু তাঁর অন্য ছেলেগুলির বিপদ ঘটাতেই ব্যস্ত রইল—এই মর্মান্তিক বাস্তব তাঁকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিল—তন্মে দহতি সম্প্রতি। আজ যখন এই মুহূর্তে কৌরব আর পাণ্ডবদের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল, তখন দুর্ভাবনায় হতাশায় হঠাৎই ঠিক করে বসলেন—যাব আমি। ঠিক যাব। কন্যা-জননীর লজ্জা ত্যাগ করে আমার জ্যেষ্ঠপুত্রের কাছে গিয়ে জানাব যথাযথ সব কথা। জানাব—কেমন করে দুর্বাসার কাছে মন্ত্র পেয়ে কুন্তিভোজের ঘরে বসেই আহ্বান করেছিলাম তার পিতাকে। জানাব—একই সঙ্গে আমার কন্যাত্ব এবং স্ত্রীত্ব—এই পরস্পরবিরোধী আবেগ কী রকম ব্যাকুল করে তুলেছিল আমাকে—স্ত্রীভাবাদ্‌ বালভাবাচ্চ চিন্তয়ন্তী পুনঃ পুনঃ। একদিকে পিতার মর্যাদা রক্ষা অন্যদিকে কৌতূহল আর অজ্ঞানতার বশে সূর্যের আহ্বান—কুন্তী ঠিক করলেন—এক এক করে সব কর্ণকে জানাব আমি। কন্যাবস্থায় হলেও সে আমার ছেলে, আমার ভাল কথাটা কি সে শুনবে না, ভাইদের ভালটা কি সে বুঝবে না—কস্মান্ন কুর্যাদ বচনং পশ্যন্ ভ্রাতৃহিতং তথা। কুন্তী ঠিক করলেন—আজ আমি কর্ণের কাছে গিয়ে সব কথা বলব, তারপর চেষ্টা করব তার মন যাতে পাণ্ডবদের দিকে ফিরে আসে—আশংসে ত্বদ্য কর্ণস্য মনো’হং পাণ্ডবান্‌ প্রতি।

কুন্তী রওনা দিলেন। তিনি জানেন এই সময়ে কর্ণ গঙ্গার তীরে পূর্বমুখ হয়ে বসে থাকেন। জপ করেন বেদমন্ত্র। দ্বিপ্রহর কাল অতিক্রান্ত বটে, কিন্তু সূর্যের তাপ প্রচণ্ড। রোদে কুন্তীর শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে। সূর্য কি শাস্তির মতো কোনও কিরণ বিকিরণ করছেন আজ! ভাগরথীর তীরে এসে কুন্তী দেখলেন—পুব দিকে মুখ করে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে তপস্যায় বসে আছেন কর্ণ। তাঁর মুখ দিয়ে উদগীর্ণ হচ্ছে বেদমন্ত্রের নিস্বন—গঙ্গাতীরে পৃথাশ্রৌষীদ্‌ বেদাধ্যয়ন-নিস্বনম্‌। পশ্চিম দিক থেকে অলসগমনে আসা তাপার্তা কুন্তীকে কর্ণ দেখতে পাননি। পুত্রের জপ-ধ্যান-বেদমন্ত্র—কিছুর মধ্যেই মায়ের সহজ ভাব নিয়ে নিজেকে ঘোষণা করতে পারলেন না কুন্তী। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। সূর্যাতপে তপ্ত হয়ে নিজের চারদিকে ঘনিয়ে নিলেন আপন উত্তরীয়ের ছায়া, হয়তো প্রথম স্বামীর কাছে লজ্জায়। দেখে মনে হল পদ্মের মালা যেন শুকিয়ে যাচ্ছে—পদ্মমালেব শুষ্যতী।

কর্ণের জপ-ধ্যান শেষ হতে হতে বেলা গড়িয়ে গেল। পুব দিক থেকে কর্ণ এবার দৃষ্টি সরিয়ে আনবেন পশ্চিম আকাশে। বিদায় দেবেন প্রায় অস্তগামী সূর্যকে। এই দিক বদলের মুহূর্তেই চোখে পড়ে গেলেন কুন্তী! এই নির্জন নদীতীরে হঠাৎ এই প্রৌঢ়া মহিলাকে একলা দেখেই হাত জোড় করে এগিয়ে এলেন কর্ণ। কতবার তিনি এঁকে দেখেছেন দূর থেকে। অভিমানী বীর কর্ণ সৌজন্যে আনম্র হয়ে সস্মিত ভাষে নিজের পরিচয় দিলেন—আমি কর্ণ, ‘অধিরথসূতপুত্র রাধাগর্ভজাত’-রাধেয়ো’হম্‌ আধিরথিঃ কর্ণস্ত্বমভিবাদয়ে।

কুন্তীর মুশকিল হল—তিনি জানতেন না যে, কর্ণ সব ব্যাপারটাই জানেন। যে পুত্রের জন্মের বৃত্তান্তে কালিমা থাকে, সে নিজের গবেষণাতেই প্রথমত নিজের পরিচয় জানবার চেষ্টা করে। লোকের কথায় আরওই সে জেনে যায় কে সে, কোথা থেকে এসেছে, বিশেষত এখানে এই খানিক আগেই স্বয়ং কৃষ্ণ কর্ণকে একা রথে উঠিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন অন্যত্র। কৃষ্ণ তাঁকে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন—দেখো ভাই, তুমি কুন্তীর ছেলে অতএব চলে এসো পাণ্ডবের দিকে, ঝামেলা মিটে যাবে, দুর্যোধন ট্যাঁফো করতে পারবে না। কর্ণ রাজি হননি—সে অন্য কথা, কিন্তু ভাইপো কৃষ্ণ যেখানে পিসি কুন্তীর কন্যাগর্ভের কথা জানে, সেখানে কর্ণ সেটা জানতেন না, তা আমরা ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না। তা ছাড়া যদি আগে নাও জেনে থাকেন, তা হলেও অন্তত কুন্তী যখন তাঁর কাছে এসেছেন, তার আগে তো তিনি কৃষ্ণের মুখেই সব শুনে নিয়েছেন।

এই নিরিখে দেখতে গেলে বলতেই হবে যে, কর্ণের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে কুন্তীর যে সলজ্জ সংশয় ছিল, কর্ণের দিক থেকে তা ছিল না। ফলত প্রথম অভিবাদনের মুখেই কর্ণ তাঁর সারা জীবনের কলঙ্ক-অভিমান, একত্রিত করে দাঁত শক্ত করে নিজের পরিচয় দিয়েছেন—আমি ‘অধিরথসূতপুত্র রাধাগর্ভজাত’—রাধেয়ো’হম্ আধিরথিঃ।

সেকালের অভিবাদনে এই রকমই নিয়ম ছিল। অভিবাদনের সময় নিজের নাম বলতে হত, অপরিচিত হলে কখনও বা পরিচয়ও দিতে হত। অপর পক্ষ সম্মানে বা বয়সে বড় হলে অভিবাদিত ব্যক্তি নাম ধরেই আশীর্বাদ করতেন। কিন্তু কর্ণ, হয়তো ইচ্ছে করেই কুন্তীর মনে জ্বালা ধরানোর জন্য নিজের নাম বলার আগে নিজের পিতৃ-মাতৃ পরিচয় বিন্যাস করে সগর্বে নিজের নাম বলেছেন—আমি অধিরথসূতপুত্র রাধাগর্ভজাত।

‘গর্ভ’ কথাটা শুনেই কুন্তীর মনে অন্য এক প্রতিক্রিয়া হল। সেই যেদিন পুত্রকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে কুন্তী বলেছিলেন—যিনি তোমায় পালন করবেন সেই ভাগ্যবতী রমণী অন্য কেউ—সেই রমণী আজ শুধু পুত্র পালনের গুণে কর্ণের কাছে গর্ভধারণের অধিকার লাভ করছে। ‘আমি রাধেয়’—কথাটা শোনামাত্রই কুন্তীর মুখে তাই তীব্র প্রতিবাদ ঝরে পড়েছে—না না, বাছা তুমি মোটেই রাধার ছেলে নও। তুমি আমার ছেলে, তুমি কুন্তীর ছেলে, সূত অধিরথ মোটেই তোমার পিতা নন—কৌন্তেয় ত্বং ন রাধেয়ো ন তবাধিরথঃ পিতা। সারথির ঘরে তোমার জন্ম নয়। আমি যখন বাপের বাড়িতেই ছিলাম তখন কন্যা অবস্থায় আমারই পেটে জন্মেছিলে তুমি। তুমি আমার ছেলে, তুমি পার্থ। স্বয়ং স্বপ্রকাশ সূর্যদেব তোমার বাবা।

মহাভারতের সামান্য সংলাপকে কেন্দ্র করে যে কবি কর্ণের সারা জীবনের অভিমান এবং কুন্তীর সারা জীবনের পুত্রস্নেহ একত্র মন্থন করে ‘কর্ণ কুন্তী সংবাদ’ রচনা করেছিলেন, তাঁর পক্ষে মনস্তত্ত্বের অপূর্ব প্রসার ঘটিয়ে কর্ণকে সত্য, নিষ্ঠা এবং নীতিপরায়ণতার একান্ত ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করাটা অসম্ভব ছিল না। অসম্ভব ছিল না কর্ণকে বঞ্চনা এবং হতাশার তিলক পরিয়ে তাঁকে মহান করে দিতে। বিংশ শতাব্দীতে বসে মহাকাব্যের এক অন্যতম প্রতিনায়ককে জীবন-যন্ত্রণার চরমে পৌঁছে দেওয়া এবং তাঁকে মর্যাদার তত্ত্বে বিভূষিত করাটা নিঃসন্দেহে অন্য এক মাত্রা দিয়েছে। তবে মহাকাব্যের কবির এই দায় ছিল না। বিশাল মহাকাব্যের পরিসরে যে মানুষ নিজেই নিজের কাছে করুণার পাত্র, সেই কুন্তীকে দিয়ে তিনি আর কীই বা করাতে পারতেন এই মুহূর্তে? পুত্রের মনোযন্ত্রণার মূল্যে তিনি জননীর মনোযন্ত্রণা লঘু করে দেখেননি। বিংশ শতাব্দীতে কর্ণের মনস্তত্ত্বের জটিল আবর্ত তাঁকে শেষ পর্যন্ত মহান করে তুললেও মহাকাব্যের কবির কাছে সরলতার দায় ছিল বেশি।

কুন্তী বলেছিলেন—আমি কর্ণকে সব খুলে বলব। বলব—আমার নিজের চরিত্রের কথা ছেড়েই দাও, আমার পালক পিতার চরিত্র রক্ষার জন্য আমাকে এই কাজ করতে হয়েছে—দোষং পরিহরন্তী চ পিতুশ্চারিত্ররক্ষিণী। যে রমণী বালিকা অবস্থায় আপন পিতার স্নেহে বঞ্চিত হয়ে পালক পিতার ইচ্ছা অনুসারে মানুষ হয়েছেন, পালক পিতার সুনাম রক্ষার জন্য যাঁকে নিজের সন্তান ভাসিয়ে দিতে হয়েছে জলে, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে যাঁকে প্রজনন শক্তি-রহিত একটি পতি বরণ করতে হয়েছে, উপরন্তু শ্বশুরবাড়িতে যাঁর নিজের স্থিতিই অত্যন্ত শঙ্কাজনক, সেই অভাগা রমণী নিজেই নিজের কাছে এত বড় করুণার পাত্র যে, তাঁর পক্ষে আপন কন্যাবস্থার পুত্র নিয়ে জীবনে টিকে থাকা কঠিন ছিল।

আজ সেই কন্যাবস্থার পুত্রের সঙ্গে সংলাপে কুন্তী প্রথমেই ধাক্কা খেলেন। যে গর্ভ ধারণের জন্য এতকালের এত মানসিক চাপ—সেই গর্ভ ধারণের যন্ত্রণাটাই অস্বীকার করছে তাঁর পুত্র। হ্যাঁ, বালিকার প্রগল্‌ভতায় পুত্রের প্রতি সুবিচার তিনি করেননি ঠিকই, কিন্তু তাই বলে ছেলে তার গর্ভধারিণীর ভূমিকাটাই অস্বীকার করবে? জননীর মুখের ওপর ছেলে বলবে—না তুমি জননী নও? কুন্তী যত কথা বলবেন বলে ভেবে এসেছিলেন, সেসব কিছুই তিনি বলতে পারেননি। আচমকা নিজের গর্ভধারিণীর ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করার জন্য অপ্রস্তুতের মতো আগে বলতে হয়েছে—না-না তুমি রাধার ছেলে নও, তুমি আমার সবার বড় ছেলে, তুমি রাধেয় নও, তুমি পার্থ!

সব গুলিয়ে গেল। ভেবেছিলেন—গুছিয়ে গুছিয়ে দুবাসার কথা বলব, সূর্যদেবের কথা বলব, নিজের সমস্যার কথা বলব—কিছুই সেভাবে বলা হল না কুন্তীর, সব গুলিয়ে গেল। এই অবস্থায় নিজেকে সপ্রতিভ দেখানোর জন্য কুন্তীকে নিজের বিশাল জীবনসমস্যার কথা খুব তাড়াতাড়ি বলে ফেলতে হল। কুন্তী বললেন—আলোকদাতা সূর্যদেব আমারই কুক্ষিতে তোমার জন্ম দিয়েছিলেন। এইরকমই সোনার বর্ম, কানের দুল তোমার জন্ম থেকে। আমার বাবা কুন্তিভোজের অন্দর মহলে তোমার জন্ম দিয়েছিলাম আমি।

কুন্তী খুব তাড়াতাড়ি—কর্ণের দিক থেকে কোনও প্রতিবাদ, কোনও বিরূপতার আগেই বলে ফেললেন—সেই তুমি আমার ছেলে হয়েও নিজের মায়ের পেটের ভাইদের চিনতে পারছ না। উলটে কোন এক অজানা মোহে ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের তুমি সেবা করে যাচ্ছ। এই কি ধর্ম বাছা? যে পৃথিবী, যে ধন-সম্পদ অর্জুন জিতে এনেছিল অসাধু লোকেরা সেসব লুটেপুটে নিল, এখন তুমি বাছা আবার সেসব জুটিয়ে এনে নিজেই সব ভোগ করো। লোকে দেখুক—কর্ণ আর অর্জুন এক জায়গায় জুটলে কী হয়, কেমন মাথা নুয়ে যায় সবার—সন্নমস্তামসাধবঃ। কুন্তী ভবিষ্যতের এক অসম্ভবের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে সোৎসাহে বলে উঠলেন—কর্ণ আর অর্জুন এক জায়গায় হলে, ব্যাপারটা দাঁড়াবে ঠিক বলরাম আর কৃষ্ণের মতো! তোমাদের দু’জনের সংহত শক্তি রুখবে, এমন বুকের পাটা কার বাছা? পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তোমার শোভা হবে যেন দেবতাদের মধ্যে ব্রহ্মা। তুমি বাপু আর সারথির ছেলে কথাটা মুখেই এনো না—সূতপুত্রেতি মা শব্দঃ পার্থত্ত্বমসি বীর্যবান্—তুমি আমার ছেলে, তুমি পার্থ।

প্রায় প্রগলভ জননীর ভাষণে কর্ণ একটুও টললেন না। ‘তুমি কুন্তী অর্জুনজননী’—এত সব কবিতার পরিণত শ্লেষ মহাভারতে নেই। তবে উতোর-চাপান এখানেও কিছু কম হল না। কর্ণ কুন্তীকে সম্বোধন করলেন মায়ের ডাকে নয়, বললেন—‘ক্ষত্রিয়ে’। কথাটার মধ্যে সাংঘাতিক সত্য আছে, পরে আসব সে-কথায়। কর্ণ বললেন—আমাকে জন্মকালেই বিসর্জন দিয়ে যে অন্যায়টি আপনি করেছেন তাতে আর অন্য কোন শত্রু আপনার চেয়ে আমার বেশি অপকার করবে—ত্বৎকৃতে কিন্নু পাপীয়ঃ শত্ৰুঃ কু্র্যান্‌ মমাহিতম্। যে অবস্থায় আমি ক্ষত্রিয়ের সংস্কার লাভ করে মেজাজে থাকতে পারতাম, সেই অবস্থায় আপনি মায়ের কাজ এতটুকু করেননি, এখন নিজের স্বার্থে আপনি আমাকে খুব ছেলে-ছেলে করছেন—সা মাং সংবোধয়স্যদ্য কেবলাত্মহিতৈষিণী।

কুন্তী এই গালাগালি হজম করে যাচ্ছেন, একটি কথাও তিনি বলছেন না। আর কথাগুলি তো ঠিকই। কর্ণ বললেন—আজ যদি আমি সব ছেড়ে পাণ্ডবদের পক্ষে যাই, লোকে আমাকে ভিতু বলবে না? কোনওদিন আমার ভাই বলে কেউ ছিল না, আজ যদি এই যুদ্ধকালে হঠাৎ পাণ্ডবদের আমি ভাই বলে আবিষ্কার করি, তবে ক্ষত্রিয়জনেরা আমাকে কী বলবে—অভ্রাতা বিদিতঃ পূর্বং যুদ্ধকালে প্রকাশিতঃ। কর্ণ দুর্যোধনের অনেক গুণ-গান করলেন। কত সম্মান তিনি দিয়েছেন, কত ভোগসুখ—সবই একে একে বললেন। আর বলতেই বা হবে কেন কুন্তী সেসব জানেন, তিনি তাতে সুখীও ছিলেন। পুত্রের প্রতি মাতার কর্তব্য করা হয়নি বলেই, কর্ণের প্রতি দুর্যোধনের প্রশ্রয়-গৌরবে তিনি সুখীই ছিলেন। কিন্তু আজ কী হবে? যুদ্ধ যে লাগবেই, তিনি তা চানও।

ক্ষত্রিয়া রমণীর এই কঠিন হৃদয় কর্ণ জানেন। তিনি বলেছেন—যুধিষ্ঠিরের বাহিনীর মধ্যে অন্য চার ভাইয়ের সঙ্গে আমার যুদ্ধ হবে না, আমার যুদ্ধ শুধু অর্জুনের সঙ্গে। হয় সে মরবে আমার হাতে, নয় আমি তার হাতে। তবে আপনার তাতে ক্ষতি নেই কোনও। আপনি পঞ্চপুত্রের জননী, তাই থাকবেন আপনি, আপনি নিরর্জুনা হলে কর্ণ আপনার থাকবে, আর আপনি অকর্ণা হলে অর্জুন আপনার থাকবে—নিরর্জুনা সকর্ণা বা সার্জুনা বা হতে ময়ি।

কুন্তী শুনলেন, কর্ণের সব কথা শুনলেন, অন্যায়-ধিক্কার সব শুনে জননীর দায়-প্রত্যাখ্যান—তাও শুনলেন। ক্ষত্রিয় পুত্রদের জননী হিসেবে কুন্তী বুঝলেন কর্ণকে তার শেষ বক্তব্য থেকে নড়ানো যাবে না। ভবিষ্যতের পুত্রশোক তাঁর হৃদয় গ্রাস করল। তিনি আস্তে আস্তে কর্ণের কাছে এলেন। কর্তব্যে স্থির অটল, অনড় কর্ণকে তিনি সারা জীবনের প্রৌঢ় বাসনায় আলিঙ্গন করলেন—উবাচ পুত্রমাশ্লিষ্য কর্ণং ধৈর্যাদকম্পনম্‌! হয়তো আর হবে না। সেই বালিকা বয়সে পুত্রের জন্মলগ্নে জননীর যে স্নেহ প্রথম ক্ষরিত হয়েছিল, নিরুপায়তার কারণে জলে ভাসিয়ে দিতে হয়েছিল বলে যে শিশুপুত্রটিকে তিনি সজোরে কোলে চেপে ধরেছিলেন, আজ এতদিন পরে সেই ছেলেকে আবারও জড়িয়ে ধরলেন কুন্তী। বুঝলেন—জীবনের ধারায় জননীর কর্তব্য-বন্ধন মুক্ত করে একবার পুত্রকে ভাসতে দিলে সে ভেসেই চলে, সারা জীবন আর তাকে ধরা যায় না, ধরতে চাইলেও, না। কুন্তী তাই জড়িয়ে ধরলেন কর্ণকে। আর দেখতে পাই কি না পাই। হয় অর্জুন, নয় কর্ণ—একজন তো যাবেই, যদি কর্ণ যায় তবে সামনা-সামনি একতম পুত্রের সঙ্গে এই শেষ দেখা। কুন্তী কর্ণকে জড়িয়ে ধরলেন দ্বিতীয়বার।

ক্ষত্রিয় পুত্র যেমন তার সত্য থেকে চ্যুত হল না, ক্ষত্রিয়া রমণীও তেমনই তাঁর ভবিষ্যৎ ভাবনা থেকে সরলেন না। কর্ণাকে বললেন—কৌরবদের বিনাশ যাতে হয়, তুমি সেই খেয়ালটা রেখো, বাছা। আমি এত করে তোমায় বোঝালাম, কিন্তু কিছুই হল না। কপালে যা আছে হবে—দৈবন্তু বলবত্তরম্‌। অর্জুন ছাড়া তাঁর অন্য চার ছেলের দুর্বলতা কুন্তী জানেন, অতএব যুদ্ধকালে এই চারজনের যাতে ক্ষতি না হয়, সে কথা তিনি আবারও মনে করিয়ে দিলেন কর্ণকে; কেন না, কর্ণও কথা দিয়েছিলেন তিনি অর্জুন ছাড়া আর কারও ক্ষতি করবেন না। মহাভারতের কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ শেষ হল অদ্ভুত সৌজন্য-বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। কুন্তী বললেন—মঙ্গল হোক তোমার বাছা, সুস্থ থাকুক তোমার শরীর। উত্তরে কর্ণও বললেন একই কথা। যে আবেগ সারা জীবন ধরে কুন্তী জমা করে রেখেছিলেন কর্ণের জন্য, তা উপযুক্ত ভাবে মুক্ত হল না পাত্রের কাঠিন্যে। কুন্তী যখন জড়িয়ে ধরলেন কর্ণকে তখন ব্যাস তাঁর বিশেষণ দিয়েছেন ‘অকম্পনম্‌’। হয়তো কর্ণের এই বিশেষণ তাঁর অনড় অকম্প স্বভাবের জন্যই।