গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

কীচক বধে ঘনাদা

কীচক বধে ঘনাদা

উপমাটা কী দেব ভেবে পাচ্ছি না।

আহ্লাদে আটখানা হয়েই বোধহয় কথা জোগাচ্ছে না মাথায়। তাই বেড়ালের শিকে ছেঁড়া, না মরা গাঙে বান ডাকা, কোনটা জুতসই হবে ঠিক করতে দেরি হচ্ছে।

যাক, গুলি মারো উপমায়! আসল কথাটা শোনালেই যখন নেচে উঠতে হবে, তখন উপমার কী দরকার? আর নেহাত যদি উপমা না দিলে মান থাকে না মনে হয়, তা হলে র‍্যাশনে যেন মিহি চাল পুরো দিয়েছে বলতে দোষ কী?

ব্যাপারটা অবশ্য র‍্যাশনে মিহি চাল পাওয়ার চেয়েও খুশিতে ডগমগ করবার। বাহাত্তর নম্বরের তাই প্রায়ই সবাই হাজির টঙের ঘরে। বাহাত্তর নম্বর বলতেই রহস্যটা বোঝা গেছে নিশ্চয়ই।

হ্যাঁ, অনুমানটা কারওই ভুল নয়। ঘনাদা সত্যিই সদয় হয়েছেন।

আবহাওয়ার এই অভাবিত পরিবর্তনটা সকালবেলাতেই টের পেয়েছি। বেশ একটু ভয়ে ভয়েই গৌর আর আমি সকালবেলা একবার হালচালটা বুঝে নিতে টহলদারিতে এসেছিলাম। ক-দিন ধরে যা খরা হচ্ছে তাতে বৃষ্টি তো বৃষ্টি, একটু মেঘের টুকরোও দেখবার আশা অবশ্য করিনি।

কিন্তু ন্যাড়া সিঁড়ি বেয়ে টঙের ঘর পর্যন্ত পৌঁছবার আগেই বুকগুলো দুলে উঠেছিল। না, বৃষ্টি তখনও না পড়ুক, আকাশ যাকে বলে মেঘমেদুর। ধান একটু মাপতে না মাপতেই কেঁপে নেমে আসবে মনে হয়।

ঘনাদা ঘরের মধ্যে অন্যদিনের মতো তাঁর জগদ্দল কাশীরাম দাসে মুখ গুঁজে বসে নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদের ওপরেই পায়চারি করছেন।

ঘনাদার ছাদে পায়চারি! এমন দৃশ্য আগে তো কখনও কেউ দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এ পায়চারির অর্থ কী? আর লক্ষণটা শুভ, না অশুভ? কিছুই ঠিক বুঝতে না পেরে একটু উদ্বিগ্ন হয়েই জিজ্ঞাসা করেছি, কী হয়েছে, ঘনাদা?

হয়েছে? যেতে যেতে ঘনাদা ফিরে দাঁড়িয়েছেন।

ব্যস! ওই ফেরাটুকুতেই যা বোঝবার, আমরা বুঝে নিয়েছি। বুক আমাদের তখনই দশ হাত।

যেটুকু ধন্দ ছিল, ঘনাদার পূরণ করা বাক্যাংশেই তা দূর হয়ে গিয়েছে।

না, হয়নি তো কিছু! ফিরে দাঁড়িয়ে তাঁর কথাটা শেষ করেছেন ঘনাদা, একটু যুদ্ধের কথা ভাবছিলাম।

যুদ্ধের কথা ভাবছিলেন ঘনাদা!

শুনেই কেল্লা ফতে! বলে চিৎকার যে করিনি, সে আমাদের কঠোর আত্মসংযম।

মনে মনে অদ্ভুত ব্যাপারগুলো শুধু একবার ভেবে নিয়েছি। এ পর্যন্ত যা দেখলাম শুনলাম, সবই তো হিসেবের বাইরে।

ঘনাদা সাতসকালে ছাদের ওপর পায়চারি করছেন।

আমাদের ডাকে তিনি ফিরে দাঁড়িয়েছেন ও তখন তাঁর মুখের পেশির কুঞ্চনে যে ভাবটা প্রকাশ পেয়েছে, তাকে প্রসন্ন হাসি বললে মানহানির দায়ে বোধহয় পড়তে হয় না।

সবচেয়ে মোক্ষম কথা হল এই যে, ঘনাদা প্রত্যুষের পদচারণার সঙ্গে যুদ্ধের কথা ভাবছেন বলে নিজমুখে স্বীকার করেছেন।

এর পর আর আমাদের পায় কে!

নেহাত ওপরে আসবার ছুতো হিসেবে বিকেলের মেনুটা একটু আলোচনা করেই নীচে নেমে গেছি তৈরি হয়ে আসবার জন্য।

যুদ্ধের কথা ভাবছেন ঘনাদা। সুতরাং জঙ্গি দপ্তরের সব বিভাগেই খবর চলে গিয়েছে তৎক্ষণাৎ! বনোয়ারি চলে গেছে গরম জিলেবির দোকানে, রামভুজ কড়া চাপিয়েছে নিজেদের হেঁশেলেই কচৌরি ভাজবার জন্য।

আর আমরা ঠিকমতো তোড়জোড় করে সদলবলে গিয়ে হাজির হয়েছি টঙের ঘরে। উপস্থিতিটা ঠিক সময়েই ঘটেছে। ছাদের পায়চারি শেষ করে ঘনাদা ঘরে এসে তাঁর নিজস্ব চৌকিতে বসে বসে গড়গড়ায় দু-একটি টান মাত্র দিয়েছেন।

যুদ্ধের কথা ভাবছিলেন, ঘনাদা? গৌর চৌকাঠে পা দিয়েই শুরু করেছে, যুদ্ধের সেরা কিন্তু মল্লযুদ্ধ, শুনলেই গা গরম হয়ে ওঠে।

গরম হয়ে ওঠার প্রমাণ হিসেবে গৌর আবৃত্তি শুরু করতেও দেরি করেনি–

মহাপরাক্রম হয় কীচক দুর্জয়।
দশ ভীম হৈলে তার সম যুদ্ধে নয়॥
কৃষ্ণার ধরিয়া কেশ আয়ু হৈল ক্ষীণ।
বিশেষ চরণাঘাতে বল হৈল হীন।।
তথাপি বিক্রমে ভীম হইতে নহে ঊন।
পদাঘাত দৃঢ়মুষ্টি হানে পুনঃ পুনঃ॥
আঁচড় কামড় মুণ্ডে মুণ্ডে জড়াজড়ি।
ধরাধরি করি ভূমে যায় গড়াগড়ি।।
কখন উপরে ভীম কখন কীচকে।
শোণিতে জর্জর অঙ্গ পদাঘাতে নখে।।

গৌর আরও খানিক আবৃত্তি চালিয়ে যেতে পারত বোধ হয়। কিন্তু ঘনাদার মুখের দিকে চেয়েই তাকে একটু দ্বিধাভরে থামতে হল।

তখন আমাদেরও বুকে একটু ধুকপুকুনি শুরু হয়েছে।

এই খানিক আগে যেখানে অমন অনুকূল বাতাস বইছিল, সেখানে হঠাৎ একটু গুমোটের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি?

ঘনাদা গড়গড়ার নলটা হাতে নিয়ে যেন টানতে ভুলে গেছেন। ভাতের গ্রাস মুখে দিতে দাঁতে যেন একটু বালি পেয়েছেন এমনই মুখের ভাব।

মনে মনে আমরা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম।

এমন সুদিনে কোনখানে পান থেকে চুন খসল বুঝতে না পেরে শিশির তাড়াতাড়ি সিগারেটের প্যাকেট খুলে ধরে বলল, তামাকটা বুঝি ঠিক জুতসই হয়নি আজ?

ঘনাদা শিশিরের এগিয়ে দেওয়া সিগারেটের দিকে দৃকপাতও করলেন না। সেই ঈষৎ বালি-চেবানো মুখের ভাব নিয়ে কোন সুদূর ভাবনায় যেন মগ্ন হয়ে অন্যমনস্কভাবে বললেন, না, ভুল।

ভুল! আমরা তো তাজ্জব! ভুলটা কোথায়? তামাক সাজায়?

নিজেদের বুদ্ধির দৌড় মাফিক ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তামাকটা আর একবার সাজিয়ে দেব, ঘনাদা?

না, ভুল তামাক সাজায় নয়, ঘনাদা গড়গড়ার নলে দু-তিনটে চটপট টান দিয়েই বুঝিয়ে বললেন, ভুল ওই লড়াইয়ের বর্ণনায়।

লড়াইয়ের বর্ণনায় ভুল! ক-দিন ধরে লাইনগুলো মুখস্থ করেছে বলে গৌর বেশ ক্ষুণ্ণ, কিন্তু কাশীরাম দাসের খাঁটি সংস্করণ থেকে তুলে এনেছি।

তা ছাড়া, আমিও এবার একটু মদত দিলাম গৌরকে, কালী সিংহীর আদি মহাভারতের অনুবাদেও তো ওই রকম আছে।

যা আছে তা ভুল। যেন নিতান্ত আফশোসের সঙ্গে জানালেন ঘনাদা, আসলটা পাওয়া যায়নি বলে অমনই করে গোঁজামিল দেওয়া হয়েছে।

আসলটা পায়নি?

মূল মহাভারতেও গোঁজামিল?

কীচক-ভীমের অমন জবর যুদ্ধটার বর্ণনাও বেঠিক?

আমাদের চোখগুলো কপালে ওঠার সঙ্গে সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসাগুলো ভেতরে আর চাপা রাখা গেল না।

তার অমন আবৃত্তিটা মাঠে মারা যাওয়ার জন্যে গৌরের মেজাজটাই সবচেয়ে খারাপ। বেশ একটু ঝাঁঝালো গলাতেই সে জিজ্ঞাসা করলে, আসলটা কী ছিল?

কী ছিল? ঘনাদা একটু জীবে দয়া গোছের মুখের ভাব করে বললেন, ছিল সত্যিকার একটি নিযুদ্ধের বিবরণ।

নিযুদ্ধ! সে আবার কী?

প্রশ্নটা আমাদের মুখ দিয়ে বেরোবার আগেই ঘনাদা অবশ্য নিজেই ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন, নিযুদ্ধ মানে বিনা অস্ত্রে লড়াই। তখনকার দিনের শাস্ত্রীয় মল্লযুদ্ধের ওই ছিল আরেক নাম। আর ভীমসেন কীচকের সঙ্গে শাস্ত্রমতেই লড়েছিলেন।

শাস্ত্রমতে লড়েছেন ভীমসেন। তবে যে?

ওই তবে যেটুকুই ফাঁকি। আমাদের বাধা দিয়ে বিবৃত করলেন ঘনাদা, ভীমসেনের অন্য যা দোষই থাক, রাজাগজার মানের জ্ঞান টনটনে। তাই সে মহলের আদবকায়দা সম্বন্ধে খুবই হুঁশিয়ার। জংলি বলে ধরে হিড়িম্বের সঙ্গে যেভাবে যুদ্ধ করেছেন, কীচকের বেলা তা ভাবতেও পারেন না। যত বড় পাপিষ্ঠই হোক, কীচক রাজাগজাদেরই তো একজন। বিরাট রাজার সম্বন্ধী, তার ওপর আবার মৎস্য দেশের সেনাপতি। তাই তাকে মোক্ষম শিক্ষা দিতে গিয়েও শাস্ত্রের বাইরে ভীমসেন যাননি।

শাস্ত্রমতে আসল নিযুদ্ধটা কী রকম হয়েছিল, শুনি? গৌরের গলায় বেশ ছুঁচোলো সন্দেহ।

শুনবে? শোনো তা হলে। ঘনাদা চোখ বুজে যেন ধ্যানস্থ হয়ে ফ্ল্যাশব্যাক-এ দেখার ধারাবিবরণী দিতে শুরু করলেন, শাস্ত্রমতে নমস্কার আর হাত নেওয়ার পর কীচক করল কাস্ফোটন আর ভীমসেন স্কন্ধতাড়ন। এবার দুজনে কক্ষাবন্ধ হয়েছে। ওই কীচক ভীমসেনকে পূর্ণকুম্ভপ্রয়োগ করছে। ভীমসেন টলছে, টলছে, চোখে যেন সর্ষেফুল দেখছে, পড়ে যাচ্ছে কাটা কলাগাছের মতো। ওই পড়ছে, পড়ছে, পড়ল,–না, না, পড়েনি। পড়তে পড়তে ভীমসেন সামলে বাহুকণ্টক লাগিয়েছে। গেল গেল, কীচক বুঝি জরাসন্ধ হয়ে গেল, চিড় খাচ্ছে, খাচ্ছে,-না, ভীমসেনের কৃত-এর পর কৃতমোচন করেছে কীচক, সুসংকট দিয়ে সন্নিপাত করে অবধূত করেছে ভীমসেনকে—

দোহাই! দোহাই, ঘনাদা! একটু থামুন।

সবাই মিলে আর্তনাদ করেই ঘনাদাকে থামাতে হল। কাস্ফোটন স্কন্ধতাড়ন থেকে কক্ষাবন্ধ, পূর্ণকুম্ভপ্রয়োগ পর্যন্ত কোনওরকমে সহ্য করা গেছল, কিন্তু বাহুকণ্টক থেকে কৃত, কৃতমোচন হয়ে সুসংকট, সন্নিপাত ছাড়িয়ে অবধূত-এ পৌঁছার পর আমাদেরই অবস্থা কাহিল। চরকিপাক-লাগা মাথায় তাই প্রায় খাবি খাওয়া গলায় বলতে হল, বনোয়ারিকে দিয়ে ক-টা অ্যাসপিরিন আগে আনিয়ে নিই।

ওঃ! ঘনাদা অনুকম্পায় কোমল হলেন, মাথায় কিছু ঢুকছে না বুঝি! আচ্ছা, বুঝিয়ে দিচ্ছি। এসব হল সেকালের আখড়াই বুলি! বিরাটপুরীর জিমূত পালোয়ানের আখড়া ছিল সবচেয়ে নামকরা। নিযুদ্ধের বুলি সেখান থেকেই বেশির ভাগ আমদানি। কক্ষাস্ফোটন আর স্কন্ধতাড়ন হল লড়াইয়ের আগে মল্লদের হাত-পা নেড়ে যাকে বলে গা-গরম করা—কক্ষাবন্ধ হল লড়াইয়ের প্রথম জাপটাজাপটি মানে আলিঙ্গন। পূর্ণকুম্ভপ্রয়োগ হল দুহাতে আঙুল শক্ত করে শত্রুর মাথায় চাঁটি! এক পা চেপে ধরে আরেক পা টেনে ছেঁড়ার নাম বাহুকণ্টক। শত্রুকে মারের প্যাঁচ হল কৃত, আর সে প্যাঁচ ছাড়ানো মানে কৃতমোচন হল প্রতিকৃত শক্ত ঘুষি-পাকানো হল সুসংকট, আর তার কাজ হল সন্নিপাত। অবধূতহল শত্রুকে ধরে দূরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া।

ঘনাদার এ ব্যাখায় মাথা ঘোরা বন্ধ না হলেও ভীমসেনকে অবধূত করার খবরে বেশ একটু বিমূঢ় হয়েই জিজ্ঞাসা করতে হল, স্বয়ং ভীমসেনকে অবধূত মানে দূরে ছুড়ে ফেললে কীচক?

তা তো ফেললেই। ঘনাদা সত্যের খাতিরে স্বীকার করতে যেন বাধ্য হলেন, শুধু কি অবধূত? মাটিতে ফেলে তারপর যা প্রমাথ মানে দলাইমলাই দিতে লাগল তাতে মনে হল, ভীমসেনের হাড়গোড়ই বুঝি গুঁড়ো হয়ে যায়। প্রমাথতেও সন্তুষ্ট না হয়ে ভীমসেনকে তুলে ধরে উন্মথন মানে পেষাই দিতে লাগল কীচক।

ঘনাদা এমন একটা মহাসংকটের গুরুত্ব বোঝাবার জন্যই একটু থামলেন। তারপর ত্রিকালদর্শী টেলিফটো লেন্সটা যেন ঠিক ফোকাস করে নিয়ে চাক্ষুষ ধারাবিবরণীতে মেতে উঠলেন আবার—এখনও উন্মথিত করছে কীচক। কী হল, কী, ভীমসেনের? সাড় নেই নাকি শরীরে? কীচক তো এবার প্রাণের সুখে প্রসৃষ্ট মানে আলগা হাতের চাপড় লাগাচ্ছে। এরপর তো বরাহোদ্ধতনিঃস্বন মানে কাঁধে তুলে মাথা নীচে ঝুলিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে দূরে আছড়ে মারবে। তা হলেই তো খেল খতম!

নাচঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দ্রৌপদী ভয়ে কাঁপছেন। কাঁপছেন অলক্ষ্যে বিনা টিকিটে যাঁরা লড়াই দেখতে এসেছেন সেই ছোট-বড় দেবতারা। ভীমসেনের রুস্তম-ই-হিন্দ থুড়ি ভারত- মাতঙ্গ খেতাব বুঝি যায়, ভীমসেন বুঝি মহাভারত ডোবায়। ন্‌-ন্‌-ন্‌-ন্‌-না—। ওই তো শলাকা মানে, সোজা লোহার মতো শক্ত এক আঙুলের খোঁচা লাগিয়েছে ভীমসেন। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে ভীমসেনকে কাঁধ থেকে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছে কীচক। মাটিতে পড়েই লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছে। ভীমসেন। ভীমসেন, না মত্ত মাতঙ্গ। কীচকের চারিধারে অভ্যাকর্ষ অর্থাৎ বাগে পাবার মৌ-কা পেতে পাক দিয়ে ফিরছে ভীমসেন। এক আচমকা অবঘট্টন মানে হাঁটু আর মাথার গুঁতো কীচকের বুকে আর পেটে। তারপর আকর্ষণ, মাটিতে ফেলে বিকর্ষণ, কোলে তুলে হাত-পা দুমড়ে প্রকর্ষণ আর সর্বশেষে প্রাণ-হরণ।

ঘনাদা থামলেন। আমরা অভিভূত স্বরে বললাম, এই তা হলে কীচক বধের আসল বৃত্তান্ত! কিন্তু এতে তো ভীমসেনের লজ্জার কিছু নেই। যা আছে বরং যুদ্ধ হিসেবে গৌরবের। সুতরাং এ সব কথা মহাভারত থেকে লোপাট করার দরকারটা কী ছিল?

কিছুই ছিল না। ঘনাদা যেন মুখোনা তেতো করে বললেন, ওই দুটো বোকা ফালতু ভাইয়ের দোষেই এই হিতে বিপরীত।

বোকা ফালতু ভাইদুটো মানে নকুল-সহদেব বুঝলাম। কিন্তু তাদের বুদ্ধির দোষটা কী, আর তাতে হিতে বিপরীতটা কীরকম?

সেই কথাই জিজ্ঞাসা করলাম ঘনাদাকে।

কীরকম তা বলতেও মেজাজ খিচড়ে যায়! ঘনাদা যেন আমাদের কাছেই সাড়ে তিনহাজার বছরের জমানো গা-জ্বালাটা প্রকাশ করলেন, দুই হাঁদা ভাইয়ের মাথায় হঠাৎ বাই চাপল, আদি পর্ব থেকে জতুগৃহদাহ অধ্যায়টা একটু ছাঁটাই করতে হবে। মানে কুন্তী মায়ের নামে কোনও নিন্দে যেন কখনও না উঠতে পারে।

কুন্তী মায়ের নামে নিন্দে উঠবে কেন? আমরা অবাক, জতুগৃহ পোড়াবার প্ল্যান তো দুর্যোধনের হুকুমে পুরোচনের!

তা ঠিক। ঘনাদা আমাদের জ্ঞান দিলেন, কিন্তু আসলে ও মোম-গালার ঘরে আগুন দিয়েছিল তো ভীমসেন, আর ছেলেদের সঙ্গে লুকিয়ে কাটা সুড়ঙ্গ দিয়ে পালাবার আগে কুন্তী দেবীর একটা দারুণ অন্যায় হয়েছিল।

কুন্তী দেবীর আবার কী অন্যায়? আমরা বিমূঢ়।

অন্যায় পালাবার আগে ব্রাহ্মণ-ভভাজনের নামে ভুরিভোজের ব্যবস্থা। ঘনাদা কুন্তী দেবীর সমালোচনায়, না সেই সুদূর ভুরিভোজের গন্ধে নাক কুঁচকোলেন, ঠিক বোঝা গেল না—যে এসেছে তাকেই গাণ্ডেপিণ্ডে খাইয়ে একেবারে অচল করে দিয়েছেন। সেই নিষাদ মা আর তার পাঁচ ছেলে ওই ফাঁসির খাওয়া খেয়েই না পেট ঢাক হয়ে অমন বেহুশ হয়েছিল। নিজেরা পালাবার সময় ওই মা-ছেলেদের জাগিয়ে দিয়ে সঙ্গে নেওয়া উচিত ছিল না কুন্তী দেবীর? এ সব কথা কেউ যাতে আর না তুলতে পারে, নকুল-সহদেব তাই কুন্তী দেবীর ভোজ দেবার ব্যাপারটাই বাদ দিতে চেয়েছিল মহারভারত থেকে।

কিন্তু সে সব কথা তো মহাভারতে জ্বলজ্বল করছে এখনও। আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ও দুই হাঁদা ভাই আসল জায়গায় মানে দারুক-মূষিক এজেন্সিতে যায়নি বুঝি? সেখানে গেলে তো গণেশের বাহন বাহাদুর কবে বেমালুম সব কেটে উড়িয়ে দিত।

হাঁদা হোক, ফালতু হোক, যমজ দুভাই সে কথা কি আর জানত না! ঘনাদা নকুল সহদেবের হয়ে একটু বললেন, ভীমদাদা আর পুরুতমশাই ধৌম্য ঠাকুরের কাছে একটু আঁচ পেয়েই তো তারা মতলবটা ভেঁজেছিল। কিন্তু তারা যখন খোঁজ করতে গেছে, তখন ইন্দ্রপ্রস্থের চোরাগলিতে সব ভোঁ ভোঁ। দারুক-মুষিক কোম্পানি লালবাতি জ্বেলে গণেশ উলটে পালিয়েছে।

দারুক-মূষিক এজেন্সি ফেল! আমরা যেমন বিস্মিত তেমনই একটু হতাশ হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?

কেন আর! ঘনাদা গোপন তথ্যটা জানালেন, গণেশঠাকুরের বাহনটি ঘুষ খেয়ে খেয়ে শুয়োরের মতো এইসা মোটকা তখন হয়েছে যে, পুথিঘরের গর্ত দিয়ে গলতেই পারে না। ওদিকে শ্রীকৃষ্ণের সারথি দারুক বাবাজির পেছনেও তখন খাজাঞ্চি দপ্তরের চর লেগেছে। সব দিক দিয়ে বেগতিক বুঝে দ্বারকাতে গিয়ে ড়ুব মেরেছেন তাই।

দারুক-মূষিকের খোঁজ না পেয়ে দুই হাঁদা ভাই যখন দিশেহারা তখন একদিন দুপুরে শোনে তাঁদের রাজড়াপাড়ার রাস্তা দিয়ে ফেরিওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে—কান কটকট, দাঁতের দরদ, ছাতা-জুতো সারাই, উই লাগাই, উই ধ—রা–ই।

ছাতা-জুতো-জামা কাপড় সারানোর কথা তো জানা, দাঁতের কানের ব্যথা সারানোও। কিন্তু উই লাগানো, উই ধরানো আবর কী! ডাক! ডাক তো ওকে। দুই ভাই ব্যস্ত হয়ে উঠল।

ফেরিওয়ালার সঙ্গে আলাপ করে দুই ভাইয়ের আহ্লাদ আর ধরে না। মোক্ষম যা একটি প্যাঁচ এবার পাওয়া গেছে, তার কাছে দারুক-মূষিক কোম্পানির কসরত কোথায় লাগে!

ফেরিওয়ালার কাঁধে ঝোলানো বিজ্ঞাপনে তার খেতাব লেখা আছে, বল্মী-বিশারদ। গালভরা নামটার আসল মানে হল উই পোকার ওস্তাদ। ফেরিওয়ালা উই পোকা পোষে। সেই পোষা উই দিয়ে পুঁথিপত্র দলিল-দস্তাবেজ সব সে যেমনটি চাই তেমনই সংশোধন করে দিতে পারে।

তাকে ঠেকাবার ক্ষমতাও কারও নেই। দারুকের শুয়োর মার্কা মূষিক তো ছার, সবচেয়ে পুঁচকে নেংটি ইদুরের ল্যাজও যেখানে ঢোকে না। চুলের মতো মিহি তেমন একটা ফুটো পেলেই তার কাম ফতে। তার পোষা উইয়েদের অসাধ্য কিছু নেই। হুকুম পেলে তারা রাজধানীর মহাফেজখানাই এক রাত্রে সাফ করে দিতে পারে!

মহাফেজখানা নয়, সামান্য ক-টা ছত্র। আনন্দে গদগদ হয়ে নকুল-সহদেব বারণাবতের জতুগৃহদাহের কোন জায়গাটা লোপাট করতে হবে বুঝিয়ে মোটা বায়না দেয় বল্মী-বিশারদকে।

তাইতেই সর্বনাশ হয়।

পোষা উই-বাহিনী কাজ করে দেয় ঠিকই, কিন্তু একচুল দিক ভুলের দরুন বারণাবতের জতুগৃহের বদলে বিরাট পর্বের ভীম কীচক যুদ্ধটাই দেয় চিরকালের মতো কেটে লোপাট করে।